তোমার প্রেমের ছোঁয়ায় পর্ব -১৭

#তোমার_প্রেমের_ছোঁয়ায়💜
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি💜
#পার্টঃ১৭
আজ আদিয়াত এক এলোমেলো,বিধস্ত্ব প্রেমিকে রূপান্তরিত হয়েছে।মনের মাঝে শতো কষ্টগুলো চেপে ধরে আছে হৃদপিন্ডটা।নিজের প্রাণপাখিটার এরকম অবস্থা আজ আদিয়াত কিছুতেই সয্য করতে পারছে না।তবুও নিজেকে সামলাতে হবে আজ তার।সব সত্য জানতে হবে।ঠিক কি কি কারনে তার আহিয়ানার আজ এই অবস্থা।
আদিয়াত টলতে টলতে নিজের মায়ের কাছে আসলো।সেহরা জাহান তাকালেন ছেলের দিকে।নিজের ছেলের এই অবস্থা আজ তিনি মেনে নিতে পারছেন না।আদিয়াত বলে উঠে,

” মা! দ..দেখো না।সোহেব কিসব ব..বলছে।তুমিই বলো না। আমার আ..আহিয়ানার কিছু কি হতে পারে?আহিয়ানা তো জানে তাকে ছাড়া তার আ..আদিয়াতের কোন অস্থিত্ব নেই।তাহলে কেন সে এরকম করছে।”

সেহরা জাহান ঠুকড়ে কেঁদে উঠলেন।তার যা বুজার তিনি বুজে ফেলেছেন।আহিয়ানার কিছু হলে যে তার ছেলেকেও বাঁচানো সম্ভব না তা বেশ ভালোই বুজতে পেরেছেন তিনি।সেহরা জাহান ছেলের মাথায় হাত রাখলেন।বললেন,

” চিন্তা করিস না বাবা।আহি’র কিচ্ছু হবে না।ও ঠিক হয়ে যাবে।”

আদিয়াত হু হা করে হেসে উঠলো।সবাই অবাক দৃষ্টিতে এই পাগলাটে আদিয়াতকে দেখছে।আদিয়াত হাসি থামিয়ে এক ঝটকায় সেহরা জাহানের হাত সরিয়ে দিলো।উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বললো,

” তুমি সব মিথ্যে কথা বলো মা।সেদিন তুমি যদি আমায় মিথ্যে না বলতে তাহলে আজ আমার আহিয়ানার এই অবস্থা হতো না।কেন করলে মা?কেন করলে?”

সিয়া কাপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

” কি?মিথ্যে বলেছিলো ভাইয়া?”

আদিয়াত দুহাতে মাথা চেপে ধরলো।নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা চালাতে লাগলো।রাগে থর থর করে কাঁপছে সে।যথসম্ভব স্বাভাবিক হয়ে বলে,

” আহিয়ানা আমাকে ছোট থেকেই ভালোবাসে।এটা তো সবাই জানিস তাই না?”

সিয়া মাথা দোলালো।অর্থাৎ সে জানে।আগে না বুজলেও এখন সব বুজে সিয়া।আদিয়াত আবারো বলে,

” আহিয়ানার পাগলামি গুলো দিন দিন বেড়ে চলেছিলো।ও লেখাপড়ার দিকে অমনোযোগী হয়ে পড়েছিলো।অবশ্য আমার সামনে বেশি আসতো না।কিন্তু আমার জন্যে নানান ধরনের খাবার বানিয়ে এশা বা রোজার হাতে আমাকে ক্যাম্পাসে দিয়ে আসতে বলা।আমার রুমে নানান রকম ভালোবাসা মাখানো চিঠি।আরো কতো কি?অবশ্য আমার ভালোই লাগতো ওর এই ছোট্ট মনে আমাকে নিয়ে টুকরো টুকরো ভালোবাসা।কিন্তু ও যতো বড় হতে লাগলো এইগুলোর মাত্রা আরো বেড়ে গেলো।ওর এইচ.এস.সি রেজাল্ট অনেক খারাপ হলো।তো সেদিন মা সেই সুযোগটা কাজে লাগায়।আমাকে বলে যে আমি যদি এখানে থাকি তাহলে আহিয়ানার স্টাডি আরো খারাপ হয়ে যাবে।রেজাল্ট ভালো না আসলে ওর ক্যারিয়ার ভালোভাবে গড়বে কি করে?আমিও ভাবলাম। আসলেই আমি এখানে থাকলে ও আরো পাগলামি করবে।ওর লেখাপড়া দিন দিন আরো খারাপ হবে।মা আমাকে বললো যেহেতু তখন আমার মাস্টার্স এক্সাম দেওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিলো। রেজাল্ট টাও বেশ ভালো এসেছিলো।মা আমাকে বললো এব্রোড চলে যেতে।আমিও ভাবলাম অনেক ভাবলাম।মনকে শক্ত করলাম।মা বলেছিলো আমি আসা পর্যন্ত সে আমার আহিয়ানার খেয়াল রাখবে।আমি আসলেই তার কিছুদিন পরেই না-কি আমার আর আহিয়ানার বিয়ে দিবেন।আমিও আমার মায়ের কথায় রাজি হয়ে গেলাম।বিশ্বাস করলাম নিজের মা’কে।সিদ্ধান্ত নিলাম চলে যাবো।পাঁচটা বছর কষ্ট করে যদি আমার আহিয়ানা’র ভবিষ্যত উজ্জ্বল হয়।আমরা সারাজীবনের জন্যে একে-অপরকে পেয়ে যাবো তাতে ক্ষতি কি?জানি অনেক কষ্ট হবে।কিন্তু কষ্ট করলেই তো মিষ্টি মিলবে।জানিস যেদিন আমি চলে যাবো।আমার কলিজাটা ছিরে যাচ্ছিলো।আহিয়ানা আমাকে ভালোবাসতো ঠিকই কিন্তু আমার সামনে আসতো না।এইযা এক বাড়িতে থাকলে হুট হাট একটু দেখা পাওয়া।নাহলে যেচে কখনোই আসতো না।সেই আহিয়ানা সেদিন আমার কাছে হাত জোড় করেছিলো। বার বার চিৎকার করে বলেছিলো ওকে ফেলে না যেতে।আমার পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলো।আমি শুনি নি সেদিন ওর হৃদয় ভাঙ্গা আর্তনাদ।মনের মাজে শক্ত পাথর রেখে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূরে।কিন্তু জানতাম না আমার মা আমার বিশ্বাস এভাবে ভেঙে দিবে।আমার আহিয়ানাকে আমার থেকে চিরতরে দূরে সরাবার জন্যে নিকৃষ্ট পরিকল্পনা করবে।”

আদিয়াতের চোখ দিয়ে অঝোড়ে অস্রু ঝড়ছে।নিহান নিজেও কাঁদছে।তাহলে আদিয়াতের কোন দোষ ছিলো না।সে তো আহির ভালোই চেয়েছিলো।মাঝথেকে এদের নিকৃষ্ট পরিকল্পনার স্বিকার হয়েছিলো।যার কারনে আজ কষ্ট পাচ্ছে আহিয়ানা। কষ্ট পাচ্ছে আদিয়াত।এদের এসব নিচু মনমানষিকতার জন্যে আহি’র মনে তৈরি হয়েছে আদিয়াতের জন্যে ঘৃনা।আদিয়াত ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো নিহানের দিকে।দুহাত জোড় করে বলে,

” তুমি আর আমি সববয়সই হবো।তাও আমি হাত জোর করে বলছি।প্লিজ বলো আহিয়ানার সাথে ঠিক কি কি হয়েছিলো।আমি জানতে চাই সব জানতে চাই।দয়া করে বলো।”

নিহান আদিয়াতের দুহাত ধরলো বললো,

” আমি বলবো সব বলবো।আমার আহিয়ানার ভালোর জন্যে আমাকে বলতেই হবে।আহিয়ানা আমাকে সব বলেছে।আমি তা সব আজ বলবো।”

নিহান শ্বাস ফেললো।আবার লম্বা করে শ্বাস টেনে নিয়ে বলতে শুরু করলো,

” তুমি চলে যাওয়ার কিছুদিন পরেই না-কি তোমার মা আমার বাবা মাকে ডেকে নিয়ে যায় তোমাদের বাড়ি।আহিকে আমার বাবা মার সাথে পাঠিয়ে দিবে তাই।আহি যেতে চায়নি।তোমার মা আহিকে নানান ভাবে অপমান করে পাঠিয়ে দিয়েছিলো।ওকে দুশ্চরিত্রা,চরিত্রহীন মেয়ে নানান কথা বলেছিলো।ওর বাবা, মা মানে আমার কাকাই আর কাকিমার নামেও বাজে বাজে কথা বলেছিলো।তাই আহি সহ্য করতে না পেরে আমার বাবা মার সাথে এসে পরে আমাদের বাসায়।বাট ওরা ওরই বাসা।ওর ঢাকাতে মোট তিনটা বাড়ি আছে,বিশাল বড় বড় দুটো কোম্পানির মালিক ও।কিন্তু ও জানতো না।কাকাই আর কাকিমা মারা যাবার পর সব ওর নামে হয়ে যায়।আমার বাবা মা তা জানতে পেরেই আহিকে নেওয়ার জন্যে আসে।কারন যদি আহিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সব সম্পত্তি তারা হাতিয়ে নিতে পারে সেই লোভে।আমি তো জানতামই না আমার কাকাই কাকিমা আছে।কারন তারা না-কি সিলেট থাকতেন। ওখানেও আহি’র বাড়ি আছে,ব্যবসা আছে।ঢাকারগুলো আমার বাবাকে দেখাশোনা করতে দিয়েছিলেন কাকাই।তো আহিয়ানাকে আমাদের বাড়িতে আনার পর তাকে মা নানানভাবে মানষিক অত্যাচার শুরু করে।কতোদিন আর এই বাড়িতে বসে খাবি,মামা মামির ঘাড়ে বসে খেতে খেতে এখন আমাদের ঘাড়ে এসে পড়েছিস।নানান কথা শোনাতো।কারন আহি তখন জানতো না যে এইসব কিছুর মালিক ও।আমার বাবা মা আহি’র বিয়ে ঠিক করে।যার সাথে বিয়ে ঠিক করে তার সাথে আমার বাবা মা প্লান করে যে আহিকে বিয়ে করলে এই সম্পত্তি আহিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে লিখে নিবে।যার ফোরটি পার্সেন্ট ওই লোকটা পাবে আর সিক্সটি পার্সেন্ট আমার বাবা, মা।আহিকে দিনরাত মানষিক অত্যাচার করতে শুরু করলো বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্যে।অবশেষে আহি এতো এতো অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে রাজি হয়ে যায়।এমনিতেও ওর তোমার প্রতি অনেক অভিমান জমা ছিলো।সেই অভিমানের কারনে ও রাজি হয়ে যায়।ওর বিয়ের একদিন আগে আমি দেশে ফিরে আসি।আমি তো আর জানতাম না ওকে জোড় করে এখানে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।তাহলে সত্যি আমি সব আটকাতাম।ওকে এতোটা কষ্ট পেতে দিতাম না।আহি বিয়ে হয়ে যায়।জানো আহি সেদিন একটুও কাঁদিনি। শুরু রোবটের মতো ওকে যা যা বলে হয়েছিলো সব করে গেছে। ওকে বিদায় জানানো হয়।কিন্তু তার ঘন্টা দেড়েক পরেই খবর আসে আহি এক্সিডেন্ট হয়েছে।বিশাল বড় এক্সিডেন্ট।সেই এক্সিডেন্টে আহির হাজবেন্ট মারা যায়।আর আহি গুরুতর আহত হয়।ওর মাথায় অনেক আঘাত লাগে।ওকে আমি এব্রোডে নিয়ে যাই চিকিৎসা করতে।অবশেষে অনেক কষ্টে আমি আহিকে বাঁচাতে পারি।কিন্তু ডাক্তার বলে আহিকে যেন কোন কিছু নিয়ে প্রেসার না দেওয়া হয়।ওর যা মন চায় তাই যেন করতে দেওয়া হয়।যদি মাথায় বেশি প্রেসার পরে হয়তো ও সব ভুলে যাবে নাহয় ও আর বাঁচবে না।আমিও তাই আর জোড় করিনি।আহি অনেক চুপচাপ হয়ে যায়।সারাদিন নিজেকে ঘরবন্দি রাখতো।আমি ওকে জোড় করে খাওয়াতাম।ওর মনের কথা সব আমাকে বলতো।বলতে গেলে ও তখন শুধু আমার কাছেই আসতো।নাহলে আর কাউকে সহ্য করতে পারতো না।একদিন আহি ছাদে যাচ্ছিলো।সে সময় আবার বাবা আর মা তাদের ঘরে কথা বলছিলেন।তারা আহি আবারও বিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন।সাথে সেই জঘন্য প্লানিং।আহি সব শুনে ফেলে।তারপর আমাকে সব বলে।আমি সেদিন রেগে গিয়ে তাদের কিছু বলতে গেলে আহি আমাকে থামিয়ে দেয়।বারন করে তাদের কিছু বলতে।আমিও আমার বোনটার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হয়ে যাই।কারন আমি কখনই ওকে কোন কিছু নিয়ে জোড় করি না।কি করবো বল বাবা মা যতোই খারাপ হোক। বাবা মা তো কি করে তাদের ফেলে দেই।তবুও আমি পুলিশে দিতে চেয়েছিলাম।কিন্তু আহি আমাকে না করে।এইভাবেই কেটে যায় একবছর আহি নিজেকে সম্পূর্ণ পালটে নেয়।ওকে ভার্সিটিতে ভর্তি করাই আমি।তারপর থেকেই সে উড়নচণ্ডী স্বভাবের হয়ে যায়।আমি জোরও করতে পারি না।বেশি কিছু বললেই ওর মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়।তাই আর জোড় করতাম না।ওর একটাই কথা অনেক ভালো হয়েই তো চলতো কিন্তু জীবন তাকে কষ্ট ছাড়া কিছুই দেয়নি।তাই এখন আর ভালো হয়ে কি করবে?খারাপ হয়েই চলবে সে।এইভাবেই চলতে থাকে ওর। ড্রিংক্স,মদ পান করা,ক্লাবে যাওয়া,পোষাকের পরিবর্তন,অশৃঙ্গখল চলাফেরা। এইভাবেই কেটে যায় চারটি বছর। আহি এখন মাস্টার্স ১ম বর্ষে।
ওদের এতো এতো অত্যাচারে আজ আহি এমন হয়ে গিয়েছে।আমি ওর জীবনে আগে আসলে এমনটা হতে দিতাম না আমার বোনটার সাথে।আমি কেন আগে আসলাম না ওর জীবনে।কেন আসলাম না?আমার বোনটা আজ মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে।আর আমি ভাই হয়েও কিছু করতে পারছি না।ব্যর্থ আজ আমি।”

নিহান চিৎকার করে কাঁদছে।ওর কান্নায় শুধু বোনের জন্যে হাহাকার। আর আদিয়াতের কথা নাহয় পরেই বলি।

#চলবে__________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here