তোমায় পাবো বলে পর্ব -১৪

#তোমায়_পাবো_বলে
#পর্ব_১৪
#নিশাত_জাহান_নিশি

“আর ও একটা চড় তোমার প্রাপ্য। বুঝেছ তুমি? রীতিমতো বেয়াদব হয়ে উঠছ দিন দিন। সারা রাত ছাদে বেলাল্লাপনা করে বুকে ব্যাথা নিয়ে শয্যাশায়িত ছিলে তাই না? বাড়ি ভর্তি মেহমানদের সামনে আমার মান-সম্মান নিলামে উঠাতে একদম প্রস্তুত হয়ে আছো। যথার্থ সময়ে যদি পরশ আমাদের ডেকে না দিতো, তোমার ঠিক কি অবস্থা হতো আন্দাজ করতে পারছ তো তুমি?”

নেএযুগলে অবাধ্য অশ্রুকণারা এবার যেনো দল বেঁধে হানা দিলো। নিজেদের যেনো আর সামলে রাখতে পারছে না তারা। ধারা অনুযায়ী এবার বাহিত হতেই হবে। ব্যাথাযুক্ত গালে আলতো হাত ছুঁইয়ে আমি পরশ ভাইয়ার দিকে আহত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। মানুষটা সম্পূর্ণ স্তব্ধিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। রাগী ভাবটা যেনো মুহূর্তের মধ্যেই কোথাও উবে গেছে। সরল, সূক্ষ্ণ আঁখিপল্লবে উদ্বিগ্নতার ছিটিফোঁটা আমি গভীরভাবে অবলোকন করতে পারছি। তবে কি মানুষটা ও আমার ব্যাথায় সমব্যথী? কষ্ট পেয়েছেন আমার পাওয়া আঘাতে? রাগী ভাব পাল্টে হঠাৎ বিমূর্ষ ভাবে আক্রান্ত হয়ে উঠলেন কেনো? ধ্যাত, কিসব যা তা ভাবছি আমি! কেনো উনি আমার ব্যাথায় সমব্যথী হবেন? কে হই আমি উনার?

আব্বু ক্রোধান্বিত কন্ঠে পুনরায় আমায় শাসিয়ে উঠতেই পরশ ভাই দরজার কর্ণার থেকে আব্বুকে থামিয়ে শান্ত গলায় বললেন,,

“আঙ্কেল যা হয়েছে ভুলে যান প্লিজ। এই টপিকটা এখানেই ক্লোজ করুন। বিষয়টা নিয়ে যতো মাতামাতি করবেন বিষয়টা ততোই আত্নীয় – স্বজনদের কাছে বিস্তৃত হবে। এসব ভুলে আপনারা আপনাদের কাজে যান প্লিজ। আই থিংক বিয়ের অনেক কাজ পড়ে আছে। বাইরে প্যান্ডেলের লোকজনদের দেখলাম ভীড় জমিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। স্টেইজ সাজানো এখনো বাকি। ডেকোরেটিংয়ের ও অনেক কাজ পড়ে আছে। আই থিংক আপনাদের সবার এখন এই রুম থেকে যাওয়া উচিত!”

পরশ ভাইয়ার কথায় সম্মতি জানিয়ে আব্বু রাগে গজগজ করে প্রস্থান নিলেন। সাথে চাচারা, চাচীমনিরা, চাচাতো বোনরা সবাই মাথা নুঁইয়ে এক এক করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পিয়ালী আপু, পায়েল ও বিষন্ন মনে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। আম্মু আমার পাশে বসে দাঁতে দাঁত চেঁপে আমায় শুধিয়ে বললেন,,

“বাড়ির অন্য কোনো মেয়েদের নামে তো এতো বদনাম হয় না, তোর নামে যতোটা বদনাম হয়! এমন অদ্ভুত কেনো তুই? নিজের দোষত্রুটি গুলো ঢেকে রাখতে পারিস না? সবাই ঠিকই দোষ করবে, তবে মাঝখান থেকে সেই দোষের ভার তোর কাঁধেই এসে বর্তাবে। বোকা তুই, চরম বোকা তুই!”

বিষন্ন মনে আম্মু রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। রাগ নিবারন করতে না পেরে আমার গাঁয়ে বাধ্য হয়ে হাত তুলেছিলেন ঠিকই তবে মা হওয়ার বদৌলতে মেয়েকে আঘাত দেওয়ার পরের কষ্টটা নিবারন করতে পারছেন না আম্মু। রুমটা ফাঁকা হয়ে যেতেই পরশ ভাই দ্রুত পায়ে হেঁটে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। ঠিক তক্ষনি দরজার ওপার থেকে আন্টি বাজখাই গলায় পরশ ভাইকে শুধিয়ে বললেন,,

“এই পরশ? কোথায় যাচ্ছিস তুই?”

পরশ ভাই হাঁটার গতি থামিয়ে আশ্চর্যজনক দৃষ্টিতে পিছু ফিরে তাকালেন। আন্টি গজগজ করে রুমে প্রবেশ করে পরশ ভাইকে কড়া গলায় শাসিয়ে বললেন,,

“কি করছিস তুই এই রুমে? একটা অবিবাহিত মেয়ের রুমে একটা অবিবাহিত ছেলে কি করছে?”

পরশ ভাই ইতস্তত গলায় প্রত্যত্তুরে আন্টিকে বললেন,,

“তুমি যাও মা। আমি একটু পরে আসছি।”

“কোথাও যাচ্ছি না আমি। রুমে চল তুই। এক্ষনি, এই মুহূর্তে আমার সাথে রুমে যাবি তুই!”

“মা প্লিজ! তুমি কি আমাকে বাচ্চা ছেলে পেয়েছ? তোমার হাত ধরে রুমে যেতে হবে?”

“হুম বাচ্চা ছেলেই। তুই আমার কাছে এখনো বাচ্চা ছেলেই। তাছাড়া আমি চাই না, একটা নেশাগ্রস্ত মেয়েকে নিয়ে আমার ছেলে সম্পর্কে এই বাড়ির লোকজন কু-মন্তব্য করুক!”

“মা প্লিজ। অবিবেচকদের মতো কথা বলো না। নেশাগ্রস্ত বলতে তুমি কি বুঝাতে চাইছ? সামান্য মজার ছলে ভাং খেলেই বুঝি মেয়েরা নেশাখোর হয়ে যায়? তাহলে তো বলব তোমার মেয়েরা ও নেশাখোর! তারা ও তো লুকিয়ে ছুপিয়ে ভাং খেয়েছিলো। হয়তো তাদের বিষয়টা সামনে আসে নি। আর টয়ার বোকামির জন্যই বিষয়টা সামনে এসেছে। এখন কি বলবে? তোমার নিজের মেয়েরা ও নেশাখোর?”

আন্টি ক্ষুব্ধ গলায় পরশ ভাইয়ার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“বড় লায়েক হয়ে গেছো না? ঠিক, ভুল ধরতে এসেছ মায়ের? এমনকি নিজের বোনদের সাথে ও ঐ অসভ্য মেয়েটার তুলনা করতে এসেছ? যে কিনা তোমাকে বর্বর বলে আখ্যা দিতে ও দ্বিধাবোধ করে না!”

ক্ষনিকের মধ্যেই পরশ ভাই ভ্রু যুগল খড়তড় ভাবে কুঁচকে আন্টির দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“মানে?”

“যার হয়ে এতক্ষন সাফাই দিচ্ছিলে তাকেই জিগ্যেস করো না! সে ই তোমাকে সব খুলে বলবে!”

তেজর্শিনী দৃষ্টিতে আন্টি একবার আমার দিকে চেয়ে হনহনিয়ে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। পরশ ভাই কপালের ভাঁজে সহস্রাধিক বিরক্তিভরা ক্ষোভ নিয়ে পিছু ফিরে আমার দিকে তাকালেন। অনুমতিবিলম্বে আমি মাথা নুঁয়াতে বাধ্য হলাম। টপটপ শব্দে নিঃসৃত হওয়া অশ্রুকণাকে খুব যত্নে বাঁ হাত দ্বারা মুছে আমি হেচকি তুলতেই পরশ ভাই অতি নম্র গলায় আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“মা কি বলে গেলেন এসব? তুমি সত্যিই আমাকে….

উত্তেজিত গলায় আমি পরশ ভাইকে থামিয়ে চোখ জোড়া বুজে অর্নগল বলতে আরম্ভ করলাম,,

“হ্যাঁ বর্বর বলেছি! আমি আপনাকে বর্বর বলেছি। সাথে এ ও বলেছি আপনার মতো বদরাগী একটা ছেলেকে বিয়ে করা আদৌতে আমার পক্ষে সম্ভব না।”

পরশ ভাই নিরুত্তর, নির্বিকার, নিশ্চুপ। কিঞ্চিৎ মুহূর্ত সমভাবে মৌনতা বজায় রেখে মৌনতায় ছেদ ঘটিয়ে পরশ ভাই বেদনাহত গলায় আমার দিকে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“কখনো একবারের জন্যে ও আমি তোমাকে বলেছিলাম? আমি তোমাকে বিয়ে করবো?”

“না বলেন নি। তবে আন্টি বলেছিলেন! আন্টি চেয়েছিলেন আপনার সাথে আমার বিয়ে হোক!”

তিরিক্ষি পূর্ণ কন্ঠে পরশ ভাই বেড সাইডে জোরে এক লাথ বসিয়ে বললেন,,

“হোয়াট দ্যা হ্যাল!”

আর এক মুহূর্ত ও বিলম্ব করলেন না পরশ ভাই। সাইক্লোনের বেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। হু হু শব্দে কেঁদে উঠলাম আমি। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য আজ কত বিকট ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমায়। পরশ ভাইয়ার মন থেকে ও পুরোপুরি উঠে গেছি আমি। আর বুঝি পরশ ভাই আমায় ভালোবাসবেন না! আমার সাথে রাগ দেখাবেন না! বিপদ থেকে আমায় উদ্ধার করবেন না। রেগে গেলে ও বেহায়ার মতো আমার সাথে কথা বলতে আসবেন না। অনুভূতি নিঃসৃত কয়েক গুচ্ছ শব্দ যুগলে আমার মনে আর প্রেম জাগাবেন না। আমার ধারে কাছে ও আর ঘেঁষবেন না! এখানেই বুঝি সমাপ্তি ঘটল আমার মনে উঁকি দেওয়া ভালো লাগা, ভালোবাসার সেই নতুন অধ্যায়টা! যে অধ্যায়টাকে আমি আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম। জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শিখছিলাম! এসব ভেবেই ভীষন কান্না পাচ্ছে আমার, ভীষষষন কান্না পাচ্ছে। বিছানায় গোল হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আমি ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠতেই রুম্পা আপু হুড়মুড়িয়ে আমার রুমে প্রবেশ করলেন। হাতে খাবারের থালা নিয়ে রুম্পা আপু উদ্বিগ্ন চিত্তে আমার পাশে চিন্তিত গলায় বললেন,,

“কেমন আছিস এখন? বুকে ব্যাথা হচ্ছে?”

নাক টেনে আমি মিনমিন শব্দে কেঁদে বললাম,,

“ভালো আছি এখন। বুকের ব্যাথাটা আর নেই!”

“ভাগ্যিস পরশ ভাই মাঝ রাতে কোনো কারনে তোর রুমে এসেছিলেন। এসেই দেখলেন তুই অবচেতন হয়ে পড়ে আছিস। সঙ্গে সঙ্গেই পরশ ভাই আমাদের সবাইকে ডেকে দিলেন। কি এক হুলুস্থুল কান্ড বেঁধেছিলো তুই জানিস? পরশ ভাইকে দেখে তো মনে হচ্ছিলো এই বুঝি পরশ ভাইয়ার কিছু একটা হয়ে গেলো। বললে হয়তো বিশ্বাস করবি না! পরশ ভাই নিজে দায়িত্ব নিয়ে ডক্টরের বাড়ির ঠিকানা কালেক্ট করে ডক্টরের বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলেন এই মাঝরাতে। সঙ্গে করে ডক্টরকে নিয়ে পর্যন্ত এসেছিলেন। ডক্টর এসে তোকে স্যালাইন পুশ করেছিলেন। ভোরের দিকে স্যালাইন শেষ হতেই এই তো একটু আগে তোর জ্ঞান ফিরল!”

কান্নার স্রোত যেনো আমার দ্বিগুন হারে বৃদ্ধি পেতে লাগএ। মানুষটা কতোটা উতলা, উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন শুধুমাএ আমার জন্য। আমাকে একটু সুস্থ করে তোলার জন্য। আর আমি কিনা বিনিময়ে মানুষটাকে বর্বর বলে আখ্যা দিয়ে মানুষটার মনে এতোটা নির্মমভাবে আঘাত দিলাম? এতোটা নিষ্ঠুর, নিকৃষ্ট, বিকল কেনো আমি? সাংঘাতিক রকমের খারাপ আমি। অল্পতেই সবার মনে আঘাত দিয়ে বসি!

আমার কান্নার ঢেউ দেখে রুম্পা আপু অস্থির গলায় আমায় শুধিয়ে বললেন,,

“কি হয়েছে রে টয়া? তুই কাঁদছিস কেনো? বুকে আবার ব্যাথা হচ্ছে?”

নিশ্চুপ থেকে আমি বোবা কান্নায় এখনো বহাল আছি। আমার মৌনতা দেখে রুম্পা আপু পুনরায় উদ্বিগ্ন গলায় আমায় শুধিয়ে বললেন,,

“এই টয়া বল না? শরীর খারাপ লাগছে না তো তোর? ডক্টর বলেছিলেন কিন্তু সেন্স ফিরে এলেই তোকে কিছু একটু খাইয়ে দিতে। তাই তো চাচীমনি খাবারটা আমার হাত দিয়ে পাঠালেন। তোকে খাইয়ে দিতে!”

“আপু তুমি এখন যাও তো। এখন কিছু খাবো না আমি। আমাকে একটু একা ছেড়ে দাও প্লিজ।”

“উঁহু কিছুতেই নড়ছি না আমি। খাবারটা তোকে না খাইয়ে কোথাও নড়ছি না আমি!”

জোরপূর্বক আপু খাবারের লোকমা তুলে আমায় একটু একটু করে খাইয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মোট কথা বকবক করে আমার মাথা খেয়ে নিচ্ছিলেন আপুটা। বকবকানির বিষয় গুলো হলো,,

“পিয়ালী আপু খুব ভালো, পায়েল ও ভীষষষণ ভালো। আর আন্টি? আন্টি তো তাদের সবার থেকে ও দ্বিগুন ভালো! পিয়ালী আপুর উডবি হাজবেন্ড দেখতে ও মাশাআল্লাহ্। এই একদিনে পিয়ালী আপুর সাথে খুব সখ্যতা গড়ে উঠছে আপুর। খুব তাড়াতাড়ি মিশে গেছেন তারা একে অপরের সাথে। মিলি আপুর সাথে আন্টির সখ্যতা তৈরীর কথাটা ও বলতে বাদ দেন নি আপু। প্রতিটা মুহূর্ত খুব ভালোভাবে বিশ্লেষন করে আমায় শুনাচ্ছিলেন। আবার এ ও বলছিলে, বিকেলে মেহেন্দির অনুষ্ঠান আছে। সবাই সবুজ রঙ্গের শাড়ি পড়ে মেহেন্দি পড়তে বসবে। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ পার্লারের মেয়েরা এলেই হলুদের সাজ আরম্ভ হবে। হলুদে সবাই হলুদ রঙ্গের শাড়ি পড়বে। কোন গান দিয়ে কে কে নাচবে তাও এক এক করে বলছিলেন।”

এসব নানা জাতীয় কথা বিরামহীন ভাবে বলে চলছেন আপু। নির্লিপ্ত নির্বিকার ভঙ্গিতে সবক’টা কথা শ্রবণ করছি আমি। আপাতত মুখ বুজে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না আমি। খাবারটা কোনো রকমে শেষ করে আমি ঝিম ধরা গলায় আপুকে বললাম,,

“এবার তুমি যাও আপু। আমি একটু ঘুমুবো। যাওয়ার সময় দরজাটা আটকে যেও।”

কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম আমি। আমার কথা মতো আপু রুমের দরজাটা আটকে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। মুখ চেঁপে কাঁদতে কাঁদতে কখন যেনো চোখ জোড়া লেগে এলো ঠিক ঠাওড় করতে পারি নি আমি। ঘুমের অতলে তলিয়ে পড়তেই মস্তিষ্ক স্থির হতে দু সেকেন্ড বেগ ও হলো না। মস্তিষ্ক থেকে সমস্ত দুঃশ্চিন্তা অপসারন হতে লাগল একটু একটু করে। নিশ্চিন্তে দীর্ঘ এক ঘুমের রেশে গাঁ ভাসালাম আমি!

,
,

বিকেল চারটে নাগাদ ঘুম থেকে উঠে আমি ফ্রেশ হতেই আম্মু খাবার হাতে রুমে প্রবেশ করলেন। আদর, যত্নে আমায় ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিয়ে আম্মু নিশ্চিন্তে রুম থেকে প্রস্থান নিলেন। বিছানার উপর সবুজ শাড়ি, ম্যাচ করা অরনামেন্টস, গাজরা ফুল, টিপ, আলতা এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বাড়ির বাকি মেয়েরা সেজেগুজে অলরেডি স্টেইজে বসে আছে। পার্লারের মেয়েরা এলেই রুম্পা আপুর সাথে মেহেন্দি পড়তে সবাই শুরু করবে এবং নাচ, গান হৈ-হুল্লোড়ে মেতে উঠবে। বিষন্ন মনে আমি বাড়ির গার্ডেনের বরাবর আমার রুমের জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়াতেই নারকেল গাছের সাথে ড্যাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পরশ ভাইয়ার হাসোজ্জল মুখটা প্রদর্শিত করলাম। অতি আশ্চর্যিত দৃষ্টিতে আমি পরশ ভাইয়ার পাশের ব্যক্তিটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই শুকনো ঢোক গিললাম। কি আশ্চর্য! হিমেশ এই বাড়িতে কি করছেন? বাড়ির কোনো কর্তারা কি হিমেশকে এখনো দেখেন নি? পাশে তো দেখছি পিয়াস ভাই ও আছেন। হায় আল্লাহ্! এই লোকটা নিশ্চয়ই বড় সড় একটা ভেজাল পাঁকাতে এই বাড়িতে এসেছেন। নির্ঘাত আপুর কু-কীর্তি ফাঁস করতে এসেছেন। কি হবে এবার? আপু বুঝি এবার সত্যি সত্যি ফেঁসে যাবেন? সংসারটায় বুঝি এবার ভাঙ্গন ধরল আপুর! তবে একটা ব্যাপার বুঝলাম না, পিয়াস ভাই কেনো এভাবে আমাদের পরম শত্রুর সাথে এতোটা হেসে হেসে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছেন? আর পরশ ভাই? পরশ ভাইকে ও তো দেখছি দিব্যি দাঁত কপাটি কেলিয়ে হাসছেন। মানুষটাকে তো সকালের দিকেই যা তা বলে অপমান করলাম। এই মুহূর্তে তো মানুষটার কষ্টে, আঘাতে জর্জরিত হয়ে এটোম বোমাকৃতির হয়ে থাকার কথা। কিন্তু না, মানুষটা তো রীতিমতো দুঃখ, আঘাত ভুলে দিব্যি হেসে চলছেন!

ঘর্মাক্ত শরীরে রুমে পায়চারী করছি প্রায় দশ মিনিট যাবত। নখ কাঁমড়ে বুদ্ধি বের করার চেষ্টায় আমি অটল প্রায়। ক্ষনে ক্ষনে শুকনো ঢোক গিলে আমি মগজে বুদ্ধি সঞ্চার করে অহেতুক দুঃশ্চিন্তাকে মস্তিষ্ক থেকে অপসারন করতে চাইছি। এর মধ্যেই যেনো মনে হলো রুমের দরজা ঠেলে কেউ আমার রুমে প্রবেশ করল! আগ্রহ নিয়ে আমি পিছু ফিরে তাকাতেই পরশ ভাইকে মলিন মুখে দেখতে পেলাম। প্রথমে খানিকটা অবাক হলে ও পরিশেষে লজ্জায় মাথা নুঁইয়ে নিতে আমি বাধ্য হলাম। মানুষটার মুখাপেক্ষী হতে বড্ড অনীহায় ভুগতে হচ্ছে আমায়। জড়তা, অস্বস্তি, সংকোচবোধ কাজ করছিলো বিপুল পরিমানে। তবে এটা ভেবে অন্তত একটু স্বস্তি হচ্ছে যে, মানুষটা এতো কিছুর পরে ও পরিশষে আমার রুমে এসেছেন, আমার সম্মুখীন হয়েছেন, হয়তো আমার সাথে কথা বলতে ও এসেছেন। আমার অপ্রত্যুল ভাবনা চিন্তায় বিরাম চিহ্ন টেনে পরশ ভাই খানিক ইতস্ততবোধ করে আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“এখনো রেডি হও নি কেনো? শরীর ঠিক আছে তো?”

ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে আমি পরশ ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই পরশ ভাই ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ উঁচিয়ে পুনরায় আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“কি দেখছ এভাবে?”

আমি রীতিমতো উজবুক গলায় অর্নগল বলতে আরম্ভ করলাম,,

“এতো অপমানিত হওয়ার পরে ও আমার রুমে এলেন? আমার প্রতি বিন্দু পরিমান ও ক্ষোভ জন্ম নেয় নি?”

“নিয়েছিলো! তবে সাময়িক ভাবে। পরে মনে হলো… তুমি অবশ্য ভুল কিছু বলো নি! আমার স্বভাবটা আমি তোমার কাছে ঠিক যেভাবে প্রেজেন্ট করি তুমি ও আমাকে ঠিক সেভাবেই নিবে ইট’স নরমাল। আমি তোমার দৃষ্টিতে হাজার বর্বর হলে ও মায়ের মমতা ভরা দৃষ্টিতে আমি ততোটাই সরল, সহজ, নম্র, ভদ্র এবং খুব ভালো প্রকৃতির ও বটে। বুঝে শুনে কথা বলতে হয় বুঝেছ? তুমি অন্য ভাবে ও আম্মুকে আমার সম্পর্কে বলতে পারতে, বিয়েটাতে অমত পোষণ করতে পারতে। সরাসরি বলতে পারতে পরিবার থেকে এই সম্বন্ধে রাজি হবে না। তাহলেই আম্মু বিষয়টা নরমালি নিতেন। কিন্তু না, তুমি তো অনেক বড় এক মন্তব্য করে বসলে আমার বিরুদ্ধে৷ যার প্রেক্ষিতে আম্মু খুব চটে গেছেন।”

ফুসফুসে দম সঞ্চার করে মানুষটা পুনরায় বললেন,,

“আমাকে তোমার খারাপ মানুষ মনে হতেই পারে। বর্বর, বিবেকহীন যা তা ভাবতেই পারো। কিন্তু, বিশ্বাস করো আমি তোমার উপর কখনই জোরপূর্বক শর্ত জুড়ে দিবো না যে, আমাকেই তোমার বিয়ে করতে হবে! আমার সাথেই তোমার সংসার বাঁধতে হবে। আমাকেই তোমার স্বামী হিসেবে মেনে নিতে হবে। তোমার মতামত সম্পূর্ণ তোমার। অন্তত তোমার এই বাক স্বাধীনতায় আমি হস্তক্ষেপ করতে পারি না!”

“আন্টি যদি অন্য কারো সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করেন? পারবেন আন্টির কথা মতো অন্য একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিতে? তার সাথে সংসার করতে?”

“এই জন্যই মেয়ে মানুষদের বেশি প্রশ্রয় দিতে নেই! প্রশ্রয় পেলেই তারা মাথায় উঠে নাচবে। কে বলেছে তোমায়? এসব আজগুবি প্রশ্ন করতে?”

“যখন সত্যি সত্যিই নিজের জীবনে ঘটবে না? তখন ঠিকই বুঝবেন। টয়া আদৌ আজগুবি কথা বলেছিলো নাকি সত্যিটাই বলেছিলো!”

“কি বলতে চাইছ তুমি?”

“কিছু না। আপনি এখন রুম থেকে বের হোন। আমি রেডি হবো।”

পরশ ভাই অতি ক্ষুব্ধ হয়ে হেচকা টানে আমাকে ঠিক দেয়ালের সাথে চেঁপে ধরলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি তাজ্জব দৃষ্টিতে পরশ ভাইয়ার লাভার রূপ ধারন করা দুচোখে ভয়ার্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই পরশ ভাই চোয়াল শক্ত করে আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,,

“বলো? কি বলতে চাইছ?”

অনবরত শুকনো ঢোক গিলে আমি কম্পিত দৃষ্টিতে আমতা আমতা করে বললাম,,

“হিহিহিমেশ ভাই কেকেকেনো এসেছেন এই বাড়িতে?”

রাগটা যেনো তড়তড় করে পরশ ভাইয়ার মাথায় চড়ে বসল। রক্তিম মুখের আদলে পরিপূর্ণ ভাবে ভয়ঙ্কর রাগ ফুটে উঠতেই পরশ ভাই উচ্চ আওয়াজে বললেন,,

“ফর দ্যা গড সেইক টয়া। আমার মাথা গরম করো না। বলো ঐ সময় তুমি কি বলতে চাইছিলে?”

ভয়কে এবার বাধ্য হয়ে প্রশ্রয় দিতেই হলো। কম্পিত কন্ঠে আমি প্রত্যত্তুরে লোকটাকে বললাম,,

“মিলি আপু আপনাকে পছন্দ করেন!”

“তো? কি করব আমি?”

“বিয়ে করবেন। মিলি আপুকে আপনি বিয়ে করবেন!”

সামান্য দম নেওয়ার সুযোগটা কুলাতে পারলাম না পর্যন্ত। আচমকা পরশ ভাই আমার ঘাঁড়ের বাঁ দিকটায় কুটুস করে সজোরে এক বাইট বসিয়ে তটস্থ কন্ঠে বললেন,,

“তোমার বদলে অন্য কাউকে বিয়ে করার অতিপূর্বেই যেনো আমার মৃত্যু হয়! মৃত্যুকে আমি অতি স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করে নিবো। তবু ও তোমার বিপরীতে অন্য কাউকে গ্রহন করতে পারব না। যখন আমি থাকব না, তখন আমার অপূর্ণ ভালোবাসারা পুরনো বইয়ের ভাঁজে শীত ঘুম যাপন করবে। শুধু তোমার স্মৃতিরোমন্থন করে!”

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here