তোর মনপাড়ায় পর্ব ১১

#তোর_মনপাড়ায়
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব:: ১১

— “কে! কে আপনি? কে হই আমি আপনার? কিসের এতো অধিকার আমার প্রতি? আমি কারো কিছু হইনা। আমি এই গোলাকার পৃথিবীতে একা, নিঃস্ব একজন মানুষ। যার আপন বলতে কেউ নেই। সবাই শুধু স্বার্থের পেছনে ছুটে। আশে পাশে অবুঝ বাচ্চাদের কেউ দেখে না, আদর করে না, ভালোবাসে না।”

ফাইলটা ছুড়ে ফেললো সাদাফ। চোখের সামনে বারবার ঈর্ষার মুখটা আর তার কথাগুলো ভেসে উঠছে। কি করা উচিত নিজেও জানে না। এক ধ্যানে রিপোর্টগুলো দিকে তাকিয়ে আছে সে। তাড়াহুড়ো করে যাওয়ার সময় রিপোর্ট গুলো নিয়ে যেতে পারেনি সে। দরজা নক করার শব্দে চমকে উঠলো সাদাফ। এসিস্ট্যান্ট এসেছে। দরজার ফোকর থেকে হালকা মাথা তুলে বলল.

— “মে এই কাম ইন স্যার।”

“হম” সংক্ষেপে উত্তর দিলো সে। এসিস্ট্যান্ট ভেতরে এসে সাদাফের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন.

— “স্যার একজন মধ্যবয়স্ক লোক এসে অথৈ ম্যামের খোঁজ করছেন! কিন্তু তিনি তো ঘন্টাখানেক আগে বেরিয়ে গেছেন।”

হালকা ঘাড় কাত করে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো সাদাফ। আটটা পঞ্চান্ন বাজে। অথৈর রোগী দেওয়া সময় ১০ টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল.

— “আজকে ভিজিটিং আওয়ার শেষ, তুমি তাকে কালকে আসতে বলে দাও।”

— “স্যার উনি ডাক্তার অথৈর খোঁজে আসেন নি। ওনি তার মেয়ের খোঁজে এসেছেন। আজ সকালে তার মেয়ে এখানে এসেছিলেন। তারপর কোথাও আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ”

চিন্তার ভাঁজ ললাটে ফুটে উঠলো সাদাফের। দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে সোজাসাপ্টা উত্তর দিলো.

— “তুমি তাকে ভেতরে পাঠিয়ে দাও। যা বলার আমি তাকেই বলছি।”

এসিস্ট্যান্ট ছেলেটি হ্যা বোধক মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর শাহিনুজ্জামান আর তার সাথে অনিক আহসান প্রবেশ করলেন। ফোন থেকে ঈর্ষার একটা হাসৌজ্জ্বল ছবি বের করে সাদাফের দিকে এগিয়ে দিলেন। ঈর্ষার ছবি দেখে কয়েকদফা চমকে উঠলো সাদাফ। তাহলে সাদাফের পরে আর খোঁজ পাওয়া যায়নি ঈর্ষার। শাহিনুজ্জামান মলিন কন্ঠে বললেন.

— “সেই সকাল থেকে ঈর্ষাকে খুঁজে পাচ্ছিনা। ক্লাব থেকে শুরু করে সব জায়গায় ঈর্ষাকে খুঁজেছি। কিন্তু পেলাম না। বন্ধুদের কাছে শুনছিলাম, আজকে হসপিটালে চেক আপ করতে আসবে। না পেয়ে এখানে খুঁজতে চলে এলাম।”

কপালের কোণে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে দেখা গেল সাদাফের। কিছুক্ষণের জন্য সামান্যতম বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। হুস ফিরতেই এক ছুটে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলো সে।

_____________________
খুঁজতে গিয়ে পার্কে চলে এসেছে সাদাফ। অনেকক্ষন যাবত বৃষ্টি হওয়াতে পার্কে গাছ থেকে ঝিরঝিরি জলকণা ঝড়ে পড়ছে। প্রতিটি বেঞ্চির উপর পানি ফোঁটা পড়ে আছে। বৃষ্টির পানিতে খানিকটা তলিয়ে আছে। বৃষ্টির পর আকাশ অনেকটা পরিষ্কার। দূর থেকে আবছা আবছা একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো বেঞ্চি ছাড়িয়ে পানি স্পর্শ করেছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে ওরনাটাও পানিতে ডুবে আছে। ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেল সাদাফ। ফোনের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো সাদাফ। ফর্সা শরীরের চামড়া গুলো অতিরিক্ত বৃষ্টিতে ভেজার কারণে কুঁচকে আছে। শরীরের চুরিদার এখনো অর্ধভেজা হয়ে আছে। চুলগুলো উস্কো খুস্কো হয়ে ছড়িয়ে আছে। ক্ষনেক্ষনে মৃদু মৃদু শরীরটা কেপে কেপে উঠছে তার। পাশে বসে কয়েকবার ডাক দিলো সে। ঈর্ষার ভেতরে কোনোরুপ প্রভাব পরলো না। নিজের বোধশক্তি হারিয়ে স্বল্প ঝুঁকে ঈর্ষাকে কোলে তুলে নিলো সাদাফ। অতঃপর হেঁটে বাড়িতে উদ্দেশ্য বেরিয়ে গেল সে।
________

ধীরে ধীরে রাত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। শেয়ালের ডাক ততটা প্রকট হচ্ছে। চারদিকে শুনশান নিরিবিলি হলেও সাদাফের বাড়িতে মৃদু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। ঈর্ষার হাত ধরে বসে আছে আদাফ। চোখের পানি চিকচিক করছে তার। ঈর্ষাকে ওমন অবস্থায় দেখে প্রায় কান্না করে দিয়েছিল সে। এখন একটু ভালো আছে। সাবিহা ঈর্ষার জামা কাপড় পাল্টে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে।
শর্ট প্যান্ট পড়ে রুমে প্রবেশ করলো সাদাফ। ঈর্ষাকে রেখে শাওয়ার নিতে গেছে সে। ঈর্ষা আর আদাফকে রুমে দেখে আশে পাশে চোখ বুলালো সে‌। তখনই খাবারের ট্রে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সাবিহা। ট্রে-টা টেবিলের উপর রেখে ঈর্ষার পাশে বসে পড়লেন তিনি। বেডের সাথে বালিশ রেখে তাতে হেলান দিয়ে বসালো ঈর্ষাকে।
ইতিমধ্যে সোফায় আসন দিয়ে খাবার খেতে বসেছে সাদাফ। খাবার স্পর্শ করতে নিলেই টেনে নিয়ে গেল সাবিহা। চোখ গরম করে বলল.

— “যা, নিচে যা। টেবিলের উপর খাবার রাখা আছে। বেড়ে খা। এই খাবারগুলো আমি ঈর্ষার জন্য এনেছি।”

সাদাফের মাথায় যেন বাজ পড়লো। নিত্যদিন সাবিহা নিজের হাতে খাবার সাজিয়ে সাদাফের রুমে নিয়ে আসে। আবার প্রায়দিন খাইয়ে দেয়। আর আজকে খাবার খাইয়ে দেওয়া তো দূর খাবার সাজিয়েও নিয়ে আসেনি। যেটা এনেছে, সেটা ঈর্ষার জন্য। মুখ কালো করে বললো.

— “মা ও ঠান্ডায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সকালের আগে ওর ঘুম ভাঙ্গবে না। সারাক্ষন ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে। তাহলে কিভাবে এই খাবার গুলো খাবে।”

— “মেয়েটা বৃষ্টিতে ভিজেছে তার উপর সারাদিন ভেজা জামা কাপড়ে ছিল। ওর জ্বর আসবে, তা কেউ থামাতে পারবে না। জ্বর আসলে কিছুই খেতে ইচ্ছে করবে না। তাই এভাবে দেখি দু লোকমা খাইয়ে দিতে পারি কি-না!”

সাবিহা অযথা সাদাফের সাথে তর্কে জড়ালো না। হাত ধুয়ে খাবারের প্লেট তুলে নিলো। অস্ফুট স্বরে ঈর্ষার দিকে তাকালো সে। ঈর্ষার গ্ৰথণ করা নয়ন যুগল থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মাঝে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। ফেকাসে অধর দুটি নাড়িয়ে বিরবির করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। ধীরে ধীরে অস্পষ্ট থেকে স্পষ্ট হতে শুরু করলো.

— “মা! ওমা। কোথায় আছো তুমি? তুমি এতোবড় স্বার্থপর হতে পারলে? কিভাবে পারলে তোমার ছোট প্রিন্সেস-কে ছেড়ে বহুদূরে চলে যেতে। অন্ধকার কবরের মাঝে আমাকে ফেলে কিভাবে আছো? সেদিন টার কথা খুব মনে পড়ে, যেদিন শেষবারের মতো তোমার মুখটা দেখেছিলাম। তারপর থেকে কাঁদতে ভুলে গেছি আমি। আজও গভীর রাতে তোমাকে দেখে চিৎকার করে উঠি আমি। খুব কষ্ট হয়, খুব। তোমার থেকে দুটো ওষুধ আমাকেও দিতে। অন্তত একসাথে থাকতে পারতাম। এই বৃহৎ পৃথিবীতে নিঃস্ব আমি। ভালো থেকো, খুব ভালো থেকো।”

আর শোনা গেল না ঈর্ষার কন্ঠস্বর। আঁচলে মুখ মুছে নিলেন সাবিহা। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন.

— “সাদাফ ঈর্ষার কি মা নেই। ”

–” জানি না আমি”

সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল সাদাফ।

______________
সূর্যহীন দিনের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। জানালার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা শরীর কাঁপানো হাওয়া গুলো ঈর্ষার কাছে বেশ লাগছে। তবে শরীরের প্রতিটি কোষ যেন আগুনের আঁচে বন্দী। এই বুঝি লোমগুলো পুড়ে এক মুঠো ছাইতে রুপান্তরিত হবে। মাথাটাও বেশ ভারী হয়ে আছে। নিভু নিভু চোখ মেলে তাকালো ঈর্ষা। চোখ মেলতেই মধ্যবয়স্ক একজন মহিলাকে নজরে এলো তার। তাকে চিনতে সক্ষম হলো না সে। একহাত মাথায় চেপে অন্যহাতে ভড় করে উঠে বসলো ঈর্ষা। ঈর্ষার উঠে যাওয়াতে তীর্যক রশ্মি সরাসরি মুখে এসে পড়লো সাবিহা। চোখ মেলে ঈর্ষাকে বসে থাকতে দেখে হাতের পিঠ ঠেকালো তার কপালে। বললেন.

— “ঈর্ষা শুয়ে পড়ো মা। রাতের প্রচুর জ্বর এসেছে এখনো যায় নি। ”

ঈর্ষা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো সাবিহা কে। সাবিহা কে কখনো দেখেনি আর না নাম বলেছে। তাহলে চিনলো কিভাবে। তবুও কোথাও একটা পরিচিত ঠেকছে তার কাছে।‌ ঠোঁট কামড়ে বলল.

— “আন্টি, কে আপনি। এখানে এলাম কিভাবে।”

মুঠোফোন টা ঈর্ষার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন.

— “তোমাকে জ্ঞানহীন অবস্থায় পার্কের ভেতর থেকে সাদু নিয়ে এসেছে। এর বেশী কিছু জানি না, তুমি বরং পরে সাদুর কাছ থেকে সবটা জেনে নিও।
এবার চট করে তোমার বাড়িতে ফোন‌ করে জানিয়ে দাও, তুমি ঠিক আছো! না জানি তারা কেমন আছে?”

হুসে ফিরলো ঈর্ষা। কালকে বিকেলে মাথা ব্যাথায় জ্ঞান হারিয়ে ছিলো। তারপর কিছু মনে নেই তার। নিশ্চয়ই তার মামা চিন্তায় আছে। ফোনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো.

— “মামা হয়তো চিন্তায় প্রেসার হাই করে ফেলেছে।”

— “আর তোমার বাবা-মা.

সাবিহাকে কথা কেড়ে নিয়ে উত্তর দিলো.

— “নেই। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ নেই। একটা মামা আছে আর আমার জানের বন্ধুরা আছে। ”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here