তোর মায়ায় আবদ্ধ পর্ব ১০

#তোর_মায়ায়_আবদ্ধ
#পর্ব_১০
#আঁধারিনী(ছদ্মনাম)

ঘুম ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সাতটা বেজে গেছে।আজকে একটু তাড়াতাড়ি উঠার কথা ছিলো তাও লেট হয়ে গেছে কি আর করার!আড়মোড়া ভেঙ্গে খোলা চুল গুলো হাত খোঁপা করে বিছানা ছেড়ে উঠলাম।প্রতিদিনের মতো আছো শুভ্রকে সোফার উপর এলোমেলো ভাবে হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে।দেখেই ভেতর থেকে একটা দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো।

সবাই উপর উপর আমাদের সম্পর্ক একটু একটু স্বাভাবিক দেখলেও মোটেও আমাদের সম্পর্ক টা স্বাভাবিক নয়।শুভ্র হয়তো আমায় কোনোদিনও মেনে নিতেই পারবে না।প্রথম রাতে তো বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলো।পরদিন থেকে শুভ্র সোফায় আর আমি বিছানায় ঘুমাই।শুভ্রকে অনেক বার বলেছিলাম আমি সোফাতেই ঘুমাতে পারবো কিন্তু উনার জেদের কাছে জিততে পারিনি।শুভ্র হয়তো আমাকে কোনোদিনও মেনে নিতে পারবে না বাবার কথায় বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছে আর এখন বাধ্য হয়েই আমার সঙ্গে কাগজে কলমে সম্পর্ক টা বয়ে বেড়াচ্ছে। কি করা উচিৎ আমার এখন?শুভ্রের কাঁধে বোঝা হয়ে না থেকে উনার জীবন থেকে চলে যাওয়া?নাকি আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা?

হ্যাঁ এটা ঠিক আমাদের বিয়েটা এক্সিডেন্টলি হয়েছে।শুধুমাত্র এই কারণেই কি আমাকে মেনে নিতে পারছে না।নাকী সত্যি সত্যি উনার জীবনে অন্য কেউ আছে যার জন্য আমাকে মেনে নিতে পারছেন না।এই মুহূর্তে কি করবো বুঝতে পারছি না তবে যাই করি না কেনো তা খুব তাড়াতাড়িই করতে হবে।আমি যে দিনে দিনে এ বাড়ির মায়ায় আবদ্ধ হয়ে পরছি।পুরোপুরি মায়ার বাঁধনে আবদ্ধ হওয়ার আগেই যা করার করতে হবে।তাই সিদ্ধান্ত নিলাম শুভ্রকেই সরাসরি কথা বলতে হবে এই ব্যপারে।এভাবে তো আর কোনো মিথ্যে সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না!

ফ্রেশ হয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেড়িয়ে শুভ্রকে আর দেখতে পেলাম না। হয়তো ড্রয়িং রুমের ওয়াশ রুমে গেছে।ওখান থেকে ফ্রেশ হয়েই জগিং করতে বেরিয়ে পরবে।এটা নতুন নয় প্রতিদিনই তাই করে।আমি নিচে নেমে আসলাম।

রান্না ঘরে আসতেই দেখলাম রোকেয়া চা বসাচ্ছে।এটা ওর প্রতিদিনের অভ্যেস রান্না ঘরে টুকে প্রথমেই চা বসাবে।এ বাড়ির মানুষ গুলো প্রচুর চা খোর।ডেইলি চার বার করে চা তাদের লাগবেই লাগবে।সকালে একবার চা তারপর বেলা এগারো বাজার সাথে সাথে আরেকবার।বিকেলে তারপর আবার সন্ধ্যার পর। আবার মাঝে মাঝে চার বারের জায়গায় পাঁচ ছয়ও হয়ে যায়।মানে সারাক্ষণই তাদের চা লাগবে।আমি বুঝিনি না প্রতিদিন এতোবার করে এক জিনিস খেতে এক ঘেয়েমি লাগে না?আমার তো আবার এক জিনিস এক দিনেই দুইবার খেতেই বিরক্ত লাগে। এবাড়িতে আসার পর ওই একদিনই চা খেয়েছি আর খাইনি।বিরক্ত লাগে এখন চা দেখলে।

রোকেয়ার সাথে হাতে হাতে আধা ঘন্টার মধ্যে কোনোরকমে হালকা কিছু সকালের নাস্তা বানিয়ে নিলাম।এর মধ্যে শাশুড়ী মাও একবার এসে দেখে গেলেন। আমার সাথে এখনো তেমন কোনো কথা বলেন না প্রয়োজন ছাড়া।গম্ভীর গম্ভীর ভাব নিয়েই থাকেন।

ফারহান আংকেল ড্রয়িং রুমে এসে কালকের পুরোনো খবরের কাগজ নিয়ে বসলেন।যেই ছেলেটা খবরের কাগজ দেয় সে আসতে আসতে বেলা নয়টা বাজায় আর ফারহান আংকেল খেয়ে দেয়ে তখন অফিসে বেরোন।তাই সকালে আর নতুব পেপার পড়ার সুযোগ হয় না।বিকেলে অবশ্য পড়তে পারেন তবে আংকেলের মতে খবরের কাগজ পড়ার মুড হচ্ছে সকাল বেলা।অন্য সময় পড়ার মুড আসে নাকি।তাই তিনি আগের দিনের দিয়ে যাওয়া কাগজ টাই পড়েন।

আংকেল দেখে বাবার কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছে। বাবাও সব সময় বলতো খবরের কাগজ পড়ার সময় হলো সকালবেলা ধোঁয়া উঠা গরম গরম চায়ের সাথে তাজা তাজা খবর ফিলিংস টাই আলাদা।তবে ফারহান আংকেলের মতো বাবার টা কিন্তু আবার পুরোনো খবরের কাগজ না।বাবা এসব ব্যবপারে খুত খুতে স্বভাবের।তাঁর প্রতিদিন তাজা খবরই চাই।আর বাবার অফিস ছিলো বেলা দশটায় তেমন কোনো সমস্যা হতো না সময় মতোই খবরের কাগজ পড়তে পারতো।

হাতের কাজ সব শেষ করে ফারহান আংকেলের আরেক কাপ চা নিয়ে রান্নার থেকে বেরিয়ে গেলাম।আংকেলকে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার চা দিচ্ছি।চায়ে চুমক দিয়েই বললেন,

” আলমুন কয়টায় বেরোবে তোমরা?”

” আটটার দিকে।”

” আমি তোমার আগের কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে রেখেছি তোমার ট্রান্সফারের সব কিছু রেডি করে রেখেছে এখন শুধু তোমরা গেলেই হবে।”

” আচ্ছা বাবা।” বলেই আমি তাড়া দেখিয়ে উপরে চলে এলাম।হাতে সময় নেই রেডি হতে হবে তাই। আসার সময় সিড়িতে মিথিলা আপুর মুখোমুখি হতে হয়েছে।আমাকে দেখেই মুখ গম্ভীর করে ফেললো।আমিও আর সেই তেমন পাত্তা দেইনি।

হিজাবের শেষ পিন টা গেঁথে আরেকবার আয়নাতে নিজেকে ভালোভাবে দেখে নিয়ে নিচে নেমে আসলাম।এরমধ্যে শুভ্রও রেডি হয়ে আমার আগে নিচে এসে বসে আছে।আমাকে নিচে নামতে দেখে সোফা থেকে উঠে সদর দরজা দিয়ে বাইরে চলে গেলো।মুখে কিছু না বললেও বুঝিয়ে গেলো আমাকে বেরতে।তাই আমিও উনার পিছু পিছু বেরিয়ে গেলাম।ভাগ্যিস রোকেয়া আজকে আমার ব্রেকফাস্ট টা ঘরে দিয়ে গেছিলো তাই এখন আর খাওয়ার প্যারা নাই।

শুভ্র একটা বাইকের সাথে হেলান দিয়ে ফোন টিপছিলো।আমি আসতেই ফোন পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বাইকে উঠে বসলো।তা দেখে আমিও গিয়ে দুরত্ব বজায় রেখে উঠে বসলাম।হয়তো তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্যই আজকে গাড়ির পরিবর্তে বাইক নিয়েছে।

বেশ স্পিডেই বাইক চালাচ্ছে শুভ্র।যে একটু আলগা ভাবে বসেছি তাই স্পিডে চলাতে অসুবিধা হচ্ছে খুব। তাও কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়েছি।তিন থেকে আড়াই ঘন্টার পথ আমরা দেড় ঘন্টাতেই পৌঁছে গেছি।কলেজে এসে প্রিন্সিপালের রুমে আসতেই উনি সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিলেন।আগে থেকে যেহেতু বলা ছিলো তাই আর কোনো অসুবিধা হয়নি।

কলেজ থেকে বেড়িয়ে আবার উল্টো পথে রওনা হতে হলো আমাদের। এখানে আসতে আসতে দেড় ঘন্টার মতো লেগেছে।একটা অনেক বড়ো ভার্সিটির সামনে এসে আমরা থামলাম।আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো ভার্সিটিতে পড়ার কিন্তু আমাদের ওখান থেকে এতোদূর এসে ভার্সিটিতে আসা যাওয়া সম্ভব ছিলো না।তাই আর ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া হয়নি।তবে বাবা একবার বলেছিলো হোস্টেলে থেকে পড়তে পারি কিন্তু আমার আর বাবাকে ছেড়ে বাড়ির সবাই কে ছেড়ে হোস্টেলে থাককে ইচ্ছে করলো না।

ভার্সিটিতেও ফারহান আংকেল আগে থেকে কথা বলে রেখেছেন তাই এখানেও তেমন কোনো সমস্যা হয়নি ভর্তি হতে।শুভ্র এই ভার্সিটিতেই পড়েছে তাই উনার পরিচিত সবাই।ভর্তির কাজ শেষ হলে আমাকে নিয়ে ক্লাস রুমের দিকে এগোতে লাগলেন।এই এতোক্ষণ সময় ধরে একটা কথাও হয়নি আমাদের মাঝে।একটু হাঁটতেই দুটো মেয়ে আমাদের সামনে এসে দাড়ালো।শুভ্রকে দেখেই একজন বললো,

” শুভ্র ভাই আপনি এখানে?কোনো কাজে আসলেন নাকি?”মেয়েটার চোখে মুখে উত্তেজনা কাজ করছে।

” হ্যা একটু কাজ ছিলো।” শুভ্র উত্তর দিলো।

আমাকে পাশে দেখেই মেয়েটা আবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে আঁড়চোখে দেখে জিজ্ঞেস করলো “এই মেয়েটা কে শুভ্র ভাই?”

এবার শুভ্র আমার দিকে একবার তাকালো তারপর দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে শান্ত গলায় জবাব দিলো ” পরিচিত ”

শুভ্রের এই উত্তরটা জেনো আমার বুকে তীরের মতো ঘাতলো।আমি কি শুধুই পরিচিত।আর কোনো পরিচয় নেই?সত্যিই তো সামান্য পরিচিত কেউ ছাড়া তো আমি সত্যিই কেউ না।আশা আমি এতো ভাবছি কেনো উনাকে নিয়ে?আমার ভাবনার মাঝেই শুভ্র বলে উঠলো,

” তোমরা ওকে একটু থার্ড ইয়ারের ক্লাসে দিয়ে আসতে পারবে?”

মেয়ে দুটো সাচ্ছন্দে মাথা দুলিয়ে হ্যা বোধহয় উত্তর দিলো।তাতেই যেনো শুভ্র হাফ ছেড়ে বাচলো।

” তুমি ওদের সাথে যাও ওরা তোমার ক্লাস দেখিয়ে দেবে।” আমাকে উদ্দেশ্য করে এইটুকু বলেই উল্টো ঘুরে চলে গেলো শুভ্র।

শুভ্রের যাওয়ার দিকে শুধু এক পলক তাকিয়ে ছিলাম।শুভ্র যেতেই মেয়ে গুলো আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আবারো জিজ্ঞেস করলো,

” তুমি কি হও শুভ্র ভাই?”

” ওই যে বললেন না পরিচিত। ” মলিন হেঁসে উত্তর দিলাম।আমার উত্তরে মেয়ে দুইটা তেমন একটা সন্তুষ্ট হলো না।আমার দিকে এখনো তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছে।ওদের আমাকে ক্লাস রুমে নিয়ে যাওয়ার কোনো লক্ষ্মণই দেখতে না পেয়ে বুঝলাম এরা নিয়ে যাবে না।তাই জিজ্ঞেস করলাম,

” আমার ক্লাসরুম টা কোন দিকে যদি বলতে উপকার হতো।”

চিবিয়ে চিবিয়ে একজনে উত্তর দিলো ” তিনতলার দুই সিঁড়ির ডান পাশের কোনার রুমটা।”

বলেই চলে গেলো। আমিও আর না দাড়িয়ে ওদের কথা অনুযায়ী তিনতলার উঠে কোনার রুম টায় ঢুকলাম। ভেবেছিলাম ভুল বলবে হয়তো কিন্তু না ঠিকঠাকই বলেছে।একজন স্যার ক্লাস করাচ্ছিলেন।আমাকে দেখেই ভিতরে আসতে বললেন তারপর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।প্রথমদিন তাও একা একা তাই খুব নার্ভাস ছিলাম।অনেকেই নিজ থেকে এসে পরিচিত হলো।তবে আজ বন্ধত্ব পাতানোর মতো তেমন কারো সাথে আলাপ হয়ে উঠেনি।একের পর একজন স্যার ক্লাস করিয়ে গেলেন।

ক্লাস শেষ হলো একটায়। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু কোনো রিকশা পাচ্ছি না তাই বিরক্ত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।হঠাৎ সামনে চোখ পড়তে চমকে উঠলাম।আমার সামনের মানুষ টাকে আমি কোনোভাবেই এই মুহুর্তে এখানে আশা করিনি।

চলবে,,,,,,

রাতে আরেক পার্ট দিবো ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here