তোর শহরে মেঘের আনাগোনা পর্ব -০২

#তোর_শহরে_মেঘের_আনাগোনা (২)
#Rawnaf_Anan_Tahiyat

‘সিমরান,আরেকটু থাকো না প্লিজ।’

রায়হানের এমন আবেদনে যারপরনাই বিরক্ত হয়ে ওর হাত টা ঝাড়ি দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো সিমরান। সেই কখন খালামনির বাসায় যাবে বলে বাসা থেকে বেড়িয়েছে,এখন না পৌঁছালে সন্দেহ করবে সবাই সেটা রায়হানের হুশে নেই। তানহা আর নিদ্রা ওর সাথেই আসতে চেয়েছিল কিন্তু ও নিয়ে আসেনি।বাই এনি চান্স একবার ধরা খেলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। গলায় এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,

‘কি হচ্ছে টা কি রায়হান? তুমি খুব ভালো করেই জানো আজকে সাকিব দেশে ফিরছে। আমি যদি ও বাসায় ফেরার আগে ওদের বাসায় উপস্থিত না থাকি তাহলে সবাই সন্দেহ করবে আমাকে, তখন আর আমাদের কিছুই করার থাকবে না। এখন যেতে দাও আমাকে।’

নিতান্তই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিমরান কে যেতে দিতে হলো রায়হানের। যথার্থই বলেছে সে, একবার কেউ সন্দেহ করা শুরু করলে সবকিছু ফাঁস হয়ে যেতে পারে। এরচেয়ে ভালো সাময়িক কষ্ট ভোগ করা।সাইড ব্যাগ টা কাঁধে ঝুলিয়ে চট জলদি রায়হানের থেকে বিদায় নিয়ে সাকিবদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো সিমরান।

সবে মাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। রাতের রুমে সব খালাতো মামাতো ভাই বোন মিলে আড্ডা দিচ্ছে, হাসাহাসি করছে। শুধু রাত খাটের এক কোণে অন্ধকার মুখ করে বসে আছে, হাতের যন্ত্রণা টা বাড়ছে খুব। খালামনি নিজেই একটু আগে পেনিসিলিন লাগিয়ে দিল হাতে, তারপরও যন্ত্রণা কমছে না। এমন সময় নিচ থেকে সাকিব ভাইয়া চলে এসেছে সাকিব ভাইয়া চলে এসেছে বলে বাচ্চাদের রব উঠলো। এতোক্ষণ ধরে যারা রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিল তারা সবাই ছুটলো বাইরে।সবার সাথে সাথে রাত ও হুড়মুড় করে বাইরে ছুটলো সাকিব ভাইকে দেখবে বলে,যেই মাত্র চৌকাঠের বাইরে পা রাখতে যাচ্ছে সে অমনি পিছন থেকে ওর হাতে হেঁচকা টান পড়লো।পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে খালামনির হাতে টান পড়েছে ওর হাতটা।

‘এতো তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছিস রাত?’

‘খালামনি এতো দিন পরে সাকিব ভাই আসছে, দেখতে যাচ্ছি।ছাড়ো না আমার হাত টা,আর সবার আগে আমি আমার সাকিব ভাই কে দেখতে চাই।’

রাতের কথা শুনে মুচকি হাসলেন নাসিমা রহমান। পরক্ষণেই দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

‘আমার ছেলে কে দেখতে যাচ্ছিস যা, কিন্তু ওর আশপাশে যদি তোকে একটু ও ঘুরঘুর করতে দেখেছি তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে রাত। তুই এটা ভুলে যাস না যে আমার ছেলে সিমরান কে ভালোবাসে, ওদের মাঝখানে তুই যদি দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিস তাহলে তোকে আমি….. আমার মুখ দেখছিস কি,যা এখন।’

হাত টা ছাড়া পেয়ে বিস্ফোরিত চোখ মুখ নিয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলে বাসার বাইরে গেল রাত। নাসিমা রহমান এই মাত্র কি বললেন তাকে, সিমরান আপুকে সাকিব ভাই ভালোবাসে? বাসার বাইরেই পিছন দিকে একটা বড় রেইনট্রি গাছ, তার নিচে বেঞ্চ পাতা রয়েছে। সাকিব ভাই কে দেখতে আর গেটের বাইরে না গিয়ে বেঞ্চের কাছে এসে ধীরে ধীরে বসে পড়ল। মাথা টা ঝিমঝিম করা শুরু করলো রাতের।যেই সাকিব ভাইয়ের জন্য এতো গুলো দিন অপেক্ষা করে ছিল সেই সাকিব ভাই তার নয়ই।দু হাতে মাথা চেপে ধরলো,আর কিছু ভাবতে পারছে না এই মুহূর্তে।

‘ কে এটা,রাত বুড়ি নয়তো আবার?’

প্রায় আধ ঘন্টা পর একটা পুরুষালী কন্ঠ শুনে মাথা তুলে সামনে তাকালো রাত। সেই বহু প্রতীক্ষিত মানুষটি এখন হাসিমুখে তার সামনে দাঁড়িয়ে।এক হাতে রাতের মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে কথাটা বললো সাকিব।আধো আলো আধো অন্ধকারের মাঝে সাকিব কে দেখতে অপূর্ব লাগছে।যাকে দেখার জন্য তার মনে এতো তৃষ্ণা জমেছিল সেই তাকে এই রূপে দেখে আজ কেন জানি খুশি হতে পারছে না রাত। কোনোরকমে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুললো,,

‘ এতো দিন পরে ও আমাকে চিনতে পারলে সাকিব ভাই?’

‘চিনতে পারবো না কেন, পৃথিবী হঠাৎ করে একবার উল্টে গেলেও আমার তোকে চিনতে ভুল হবে না কখনো।তোর ছবি আমার মনের মধ্যে গেঁথে আছে, বুঝতে পারলি?’

চমকে উঠলো রাত, এই মাত্র সাকিব ভাই কি বললো তাকে? উৎফুল্ল হয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই সাকিব ভাইয়ের ফোন চলে এলো আর ও ফোনে কথা বলতে বলতে চলে গেল সেখান থেকে। সিমরান-সাকিব ভাই এটা ভাবতে ভাবতে মাথা জট পাকিয়ে গেছে তার, চোখের কোণে হালকা একটু পানি এসে জমেছে। হাতের টিস্যু পেপার টা দিয়ে চোখ মুছে বাসায় চলে এলো। বাসায় পা রেখেই বুঝতে পারলো সিমরান আপুকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সাকিব ভাই এসেছে অথচ তার হবু বউ সিমরান এখনো তার সাথে দেখা করতে আসেনি এই বিষয় টা নিয়ে সবাই বলাবলি করছে।এসবে মাথা না ঘামিয়ে রাত রান্নাঘরে মায়ের কাছে গেল।আসমা রহমান তখন রান্নাঘরে প্রচুর ব্যস্ত, দুই বোন মিলে সাকিবের পছন্দের সব আইটেম রান্না করছেন। অসময়ে রাত কে রান্নাঘরে দেখে নাসিমা রহমান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে, আসমা রহমান অবশ্য কিছু বললেন না। তিনি জানেন রাত এখন কেন এসেছে রান্নাঘরে, সহাস্য গলায় বললেন,

‘কিরে মা, সাকিবের সাথে কথা হলো তোর? সাকিব তো এসেই তোকে খুঁজছিল, কোথায় গিয়ে বসেছিলিস বলতো তুই? সাকিব ভাই কবে আসবে এটা বলে তো আমাদের সবাইকে জালিয়ে মা’র’তি এতো দিন। এখন তো এসেছে,প্রাণ খুলে কথা বলে নে নাহলে কিছুদিন পর আর কথা বলার সুযোগ পাবিনা।’

এটুকু বলেই হেসে উঠলেন আসমা রহমান, কৌতুকের ছলে মেয়ে কে কথাটা বলে বেশ মজা পাচ্ছেন তিনি। মায়ের কথা শুনে ধক করে একটা ধাক্কা লাগল বুকে,

‘আর কিছু দিন পর কথা বলার সুযোগ পাবো না কেন?’

‘আরে আর কিছু দিন পরেই তো আমাদের সাকিব ঘরবন্দি হতে চলেছে। বাসায় যে রোজ এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তুই কি কিছু শুনিস না নাকি? ছেলে টা দেশে ফিরেছে, এবার আর কিছুদিন পরেই সিমরানের সাথে ওর বিয়ে। কোথাও যে পড়ে থাকিস তুই?’

‘বিয়ে?’

দু মিনিট লাগলো সম্পূর্ণ কথাটা বুঝতে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল,এরপর খুব সহজ স্বাভাবিক ভাবেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো।নিদ্রা ওকে ওদের সাথে আড্ডা দিতে ডাকলো,নিত্যান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাত ওদের মাঝখানে গিয়ে বসলো। সিমরান এবং সাকিব এদের দুজনের কেউই এখন ওদের মাঝে নেই তাই ওদের প্রেমপর্ব গুলো নিয়ে খুব হাসাহাসি করছে সবাই।রাত অবাক চোখে সবার মুখ থেকে ঘটনা গুলো শুনছে, তার অগোচরে এতো কিছু হয়েছে আর সে কিছুই জানে না। আজকের দিনটাই শক খাওয়ার দিন, একের পর এক শক খেয়ে যাচ্ছে। আগে খালামনি পছন্দ করতেন না তাকে কিন্তু আজকে তার সাথে সাথে শুধু শুধুই শাস্তি দিলেন, এরপর খবর পেল সাকিব ভাই আসছে, সাকিব ভাই এলো, আবার জানতে পারলো সাকিব ভাই আগে থেকেই সিমরান আপুকে ভালোবাসে। মনটা অসম্ভব রকমের খারাপ হয়ে গেল, তার অনুভূতি গুলো বোঝার ক্ষমতা সাকিব ভাইয়ের হলো না।

‘এখানে কি আমাকে নিয়ে গবেষণা চলছে গাইস?’

এমন আওয়াজ পেয়ে সবাই একদম চুপ, পিনপতন নীরবতা বিরাজ করলো। সবার সামনে এসে পায়ের উপর পা তুলে পা নাচাতে নাচাতে প্রশ্ন করল সাকিব। ওদের সবার অলক্ষ্যে পিছনে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিল বেশ কিছুক্ষণ ধরে, কেউই খেয়াল করেনি তাকে। সবাই কে চুপ হয়ে যেতে দেখে নিদ্রা হাসিহাসি মুখ করে বললো,

‘তুমি তো আর কিছু দিন পরেই বিয়ে করে সংসারী হতে চলেছো, তখন যদি তোমাকে নিয়ে আর গবেষণা করতে না পারি তাই এখনই সবকিছু সুদে আসলে আদায় করে নিচ্ছি।’

‘আমাদের সাকিব সংসারী ‘এটুকু বলে সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। সবার সাথে হাসতে গিয়েও কেন জানি হাসতে পারলো না রাত,ঝিম মেরে বসে রইল। বিষয় টা সবার দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও সাকিবের দৃষ্টি এড়ালো না,ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো মন খারাপের কারণ।

চলবে………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here