তোলপাড় পর্ব ২

তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২
_____________
গেঁজ দাঁতওয়ালা’কে কিভাবে খুঁজে পাবে এই চিন্তায় বিবশ হতে হতে ঘুমিয়ে পড়ে অরূণী। সকাল বেলা দরজা ধাক্কাধাক্কির শব্দে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই ধাঁ করে অরূণীর ঘুম ভেঙে যায়। আচমকা ঘুম ভাঙার ফলে প্রথমে কৌতূহলে চারদিকে তাকায় পরবর্তী’তে দরজার সামনে সূর্যের গলা শুনে ভীতিগ্রস্ত হয়ে গেল। সকাল সকাল যমদূত এসে দুয়ারে হাজির। অরূণীর দরজা খুলতে ভয় করছে, দরজা খোলার সাথে সাথে বিকট আওয়াজের এক ধমকে অরূণীর কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে। গালে দুই-চার ঘা মেরে বসতে পারে।দরজায় ক্রমগত আঘাত করেই যাচ্ছে, অরূণী দরজা খুলে।মাথা নিচু করে দুই হাতে দুই গাল চেপে রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। গালে চড় খাওয়া বড্ড কষ্টের। আর চড়’টা যদি কোন রকম কানে লাগে মনে হয় সবকিছু তব্দা লেগে গেছে। সূর্য শক্ত গলায় বলল, “কিরে আরূণী? কোথায় গিয়েছিলি তুই কাল?”
অরূণীর বুক ভয়ে দুরুদুরু করছে। দুই হাত শক্ত করে গালে চেপে রেখেছে। অনুশোচিত হয়ে নিচু স্বরে বলল, “সূর্যদা আর কখনো যাবো না কোথায়ও।”
– “এই কথা তো সেই ছোট বেলা থেকে বলে আসছিস। আর তুই আব্বা-আম্মার কথা শুনিস না কেন?”
অরূণী নিচু স্বরে বলল, “শুনি তো কথা।”
অরূণীর দুই চোখ পলকমধ্যেই অশ্রুপূর্ণ হয়ে গেল। সূর্য বেশ বিরক্ত হয়ে তাকালো, “কিছু বলার আগেই কেঁদে ভাসিয়ে দিস।এসব ন্যাকা স্বভাব বাদ দে।”
সূর্যের গলার স্বর নরম হয়ে এসেছে। অরূণী যে ঝড় ঝঞ্ঝাটের আশা করেছিল তা কিছুই হয়নি। আজকে সূর্যের মেজাজ মনে হয় খুব ফুরফুরে। গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া লাগেনি বোধ হয় আজ। অরূণী কথা’টা বলতে গিয়েও চড় খাওয়ার ভয়ে বলল না। সূর্য রুম থেকে বের হতে উদ্যত হলে অরূণী মেনিমুখো গলায় বলে, “দাদা শিপন স্যার নাকি পড়াবে নাকি আমায়।একটু সুপারিশ করে দিও।”
সূর্য পিছনে ফিরে বলে, “তোর জন্য আমি সুপারিশ করব? পাগলা কুত্তায় কামড়াইছে আমারে?”
অরূণী জানে সূর্য ঠিকই সুপারিশ করবে।সূর্য চলে যাওয়ার পর আরূণী রুমের দরজা-জানালা বন্ধ করে হাই তুলতে তুলতে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়। ঘুম ভালো হয়নি, আবার ঘুমোতে হবে। আলোতে অরূণীর ঘুম আসে না।‌‌‌তাই দিনের বেলায়ও রুমের দরজা-জানালা আটকিয়ে অন্ধকার রুম বানিয়ে ঘুমাবে।
কলেজের সময় হয়ে এলে ঝট করে বিছানা ছাড়ে। লুক অ্যালাইক আল্লু আর্জুন’কে খুঁজতে হবে। সেই সুদর্শন পুরুষের হাসি’টা ধারাল ছুরির মত অরূণীর বুকে বিঁধছে। গেঁজ দাঁতের হাসি! অরূণীর চোখের সামনে পর্দার মত ভাসছে। ছেলেটার হাসির উপর কারফিউ জারি করা হোক। যেখানে- সেখানে হাসা নিষিদ্ধ করা হোক। হেসে কারো ঘুম হারাম করার অধিকার তাঁর নেই। ছেলেটার চেহেরায় অদ্ভুত মায়া। যেসব ছেলেদের চেহারায় এমন মায়া তাদের কি বলা যেতে পারে? মায়াবতী শব্দ’টা শুধু মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য কেন?
অরূণী কলেজের উদ্দেশ্যে রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে যায়। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে পাউরুটি আর কলা দ্রুত খাচ্ছে। সূর্য সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় চোখ যায় অরূণীর দিকে।
– “তোর কলেজ কয়টায়?এত তাড়াতাড়ি বের হচ্ছিস কেন?আর চেয়ারে বসে ধীরস্থির ভাবে নাস্তা কর।”
কথা’টা বলতে বলতে টেবিলের কাছে এসে চেয়ার টেনে বসে অরূণীর দিকে তাকায় সূর্য। সূর্যের রাগের ভয়ে অরূণীও বসে পড়ে। এক এক টা বড় ভাই না যেন সুন্দরবনের বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার। খাওয়ার মাঝে সূর্য বলল, “আমি তোকে পৌঁছে দিবো কলেজে।”
– “উঁহু না। আমার গাড়িতে যেতে ভালোলাগে না।আমি হেঁটে যেতে পারবো। তোমার গাড়িতে তো তোমার লাল চুলওয়ালা বান্দরের মত দেখতে গার্লফ্রেন্ড’টা থাকবে।তোমার গার্লফ্রেন্ডের শরীর থেকে যা গন্ধ আসে। যাস্ট বমি করে দিতে ইচ্ছে করে।”
অরূণীর কথা শুনে সূর্য খাবার গিলতে ভুলে যায়। সূর্যের চোখ চড়কগাছ। বিস্ময় আর রাগ মিশ্রত গলায় বলল, “অরূণী কি বললি তুই? মিলা দেখতে বান্দরের মত? ওঁর শরীর থেকে গন্ধ আসে?”
– “তো কি ঘ্রাণ আসে?কি রকম ঘ্রাণ আসে? তোমার গার্লফ্রেন্ড কি পারফিউম ব্যবহার করে দাদা? পারফিউম তো তুমিই কিনে দেও। নাম’টা ঝটপট বলে ফেলো। আমারো একটা সেরকম পারফিউম লাগবে।”
সূর্যের মুখ গুরুগম্ভীর হয়ে যায়। চোখ লাল করে অরূণীর দিকে তাকিয়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। অরূণী ভয় পায় সূর্যের এমন খেপাটে চাহনি। গালে কি চড় মেরেই বসবে এবার?কথার স্রোতে কি বলতে কি বলে ফেলল। সূর্য বলল, “তোকে কে বলেছে আমি মিলা’কে পারফিউম কিনে দিই? দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস অরূণী। আর মিলা’কে তোর এত অপছন্দ কেন?”
– “সত্যি বলবো?চড় মারবে না তো?”
অরূণীর মুখ থেকে সত্যি’টা শোনার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে সূর্য, “বল। মারবো না চড়।”
– “একে তো চুল গুলো স্ট্রেট করতে করতে গরুর লেজের মত হয়েছে।তার উপর বান্দরের মত লাল রং করা। খালেদা জিয়ার মত চিকন ভ্রু গুলো আর্ট করে তিন ইঞ্চি মোটা বানায়। ঠোঁটে সারাক্ষণ টকটকে বাহারী রঙের লিপস্টিক তো থাকেই। ত্বকে পাঁচ ইঞ্চি মোটা মেকাপ। সকাল-বিকাল পার্লারের দুয়ারে গিয়ে কপাল ঘঁষে। বাম হাতেও দশ ইঞ্চি লম্বা লম্বা নখ।খবিশের মত ডান হাতেও নখ।”
অরূণী একটু থেমে আক্ষেপ করে বলল, “বিশ্বাস করো দাদা তোমার গার্লফ্রেন্ড যদি টানা একমাস পার্লারে না গিয়ে আসল রূপ নিয়ে তোমার সামনে আসে ,তুমি এতদিন তাঁর যে রূপের আগুনে জ্বলে-পুড়ে বার্ন ইউনিটে ছিলে তখন তাঁকে দেখার পর আইসিউ’তে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়বে।”
সূর্যের গার্লফ্রেন্ড’কে নিয়ে এতদিনের জমানো কথা গুলো বলতে পেরে অরূণীর মুখে হৃষ্টতা। অরূণী ভেবেছিল এসব বলার মাঝে সূর্য ও’কে পুরানো সেই রাজা-বাদশার মত চিৎকার করে খামোশ বেয়াদব বলে থামিয়ে দিবে। কথা গুলো শুনে সূর্যের কেমন প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা দেখার জন্য অরূণী তাকায় সূর্যের দিকে।ভয় ভয় গলায় বলে, “দাদা তুমি কিন্তু বলেছো চড় দিবে না।”
সূর্যের মুখ থমথমে।কথায় পরাস্ত হয়ে সূর্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে গম্ভীর গলায় আদেশ করল, “যা তুই কলেজে যা।”
অরূণী পৈশাচিক এক আনন্দ নিয়ে টেবিল ছাড়ে। রাস্তায় হাঁটছে আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। কোথায় পাবে সেই গেঁজ দাঁতওয়ালা কে? প্রথম দেখেছিল বাসস্ট্যান্ডে। মেরুন রঙের একটা শার্ট পরা ছিলো। কাঁধে ছোট-খাটো একটা ব্যাগ প্যাক। সেই বাসস্ট্যান্ড থেকে অরূণী ছেলে’টা কে ফলো করতে করতে কার্তিক কর্মকারের বাসার গেট পর্যন্ত যায়।
কার্তিক কর্মকারের বাসায় এখন গিয়ে লাভ হবে না।‌ কার্তিক কর্মকার অরূণী’কে নিয়ে তাঁর বাসায় বসিয়ে রাখবে। সঞ্জিতা কর্মকার এক পা ও বাসা থেকে বের হতে দিবে না। দুপুর ভালো-মন্দ খেয়ে বিদায় নিতে হবে। পাঁচ-সাত দিন হয়ে গেলেও অজ্ঞাত সেই গেঁজ দাঁতওয়ালার সন্ধান মিলে নি।
______________
ক্লাসের ফাঁকে কলেজ ক্যান্টিনে বসে তাইতির সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে অরূণী।অরূণীর মুখে দুশ্চিন্তায় ছাপ।তাইতি অরূণীর কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বিরক্ত গলায় বলল, “একটা ছেলে’কে একবার দেখলি। কোন কিছু জানিস না ছেলেটার সম্পর্কে। খারাপও তো হতে পারে, বউও তো থাকতে পারে? আর অমন একটা সুদর্শন যুবক সে কি সিঙ্গেল?”
অরূণী দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বলল, “সব কিছু’তে নেগেটিভ চিন্তা না করলে তোর হাঁসফাঁস লাগে না? ওই বাড়ি’তে সব ব্যাচেলর ছেলেপেলে থাকে।”
– “এমন হতে পারে না বিয়ে করে বউ বাসায় রেখে এসেছে?”
অরূণী চোখ-মুখ কুঁচকে তাকায় তাইতির দিকে, “তোর মত এমন নেগেটিভ চিন্তা ভাবনার মানুষ সাথে থাকলে জীবনে অনুপ্রেরণা বলতে কিছু থাকবে না‌‌। তাইতি তুই যা তো আমার কাছ থেকে।”
অরূনীর ধমকেও দমলো না তাইতি। ফের বলল, “এসব যদি সূর্য ভাইয়া জানে তাহলে তোর হাত-পা ভেঙে বাসায় বসিয়ে রাখবে। খবরদার! কার্তিক কর্মকারের বাসায় আর যাস না। এতসব মিথ্যে বলেছিস ধরা পড়লে সঞ্জিতা কর্মকার তাঁর নিচে ফেলে তোকে পিষে ফেলবে।”
সঞ্জিতা কর্মকারের কথা মনে পড়তেই অরূণীর বাঁধ ভাঙা হাসি শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে চিন্তান্বিত হয়ে বলল, “আমি তো শ্যামলা। আমায় পছন্দ করবে উনি?”
– “অদ্ভুত কথা বলিস না। মানুষ ফর্সা হলেই কি সুন্দর হয়? তুই তো…”
অরূণী তাইতি’কে থামিয়ে দিয়ে বলল, “শত্রুর নিন্দা আর বন্ধুর প্রশংসা দুটোই মূল্যহীন।চুপ থাক।”

কলেজ ড্রেস পড়া, মাথার দুই পাশে দুই’টা বেনী গাঁথা, কলেজ ব্যাগ’টা কাঁধে ,রাস্তার এক পাশ দিয়ে বাসার দিকে হাঁটছে অরূণী। কাঁধ বরাবর ছোট ছোট সিল্কি চুলের বেনী হাঁটার তালে তালে দুলছে। অরূণীর হাঁটতে ভালোলাগে। বাসা থেকে কলেজ বিশ মিনিটের রাস্তা। সাহেদ আহমেদের গাড়ি আছে, সূর্যের গাড়ি আছে তবুও অরূণী প্রতিদিন হেঁটে কলেজে যাবে-আসবে। অদ্ভুত সব ইচ্ছা, অদ্ভুত সব ভালোলাগা অরূণীর।
সহসা অরূণীর চোখ যায় একটু সামনে অবস্থিত টং দোকানের দিকে ‌‌‌‌‌‌‌। সেই গেঁজ দাঁতওয়ালা দোকানের বেঞ্চিতে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। অরূণীর হৃৎপিণ্ড এমন ভাবে ধ্বক করে ওঠল যেন বিকল হয়ে যাবে। উত্তেজনায় শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। বিস্ময়ের অতল গহ্বরে যেন হাবুডুবু খাচ্ছে অরূণী। স্থান-কাল ভুলে তড়িৎ গতিতে ছুটে যায় দোকানের দিকে। অরূণী সেখানে পৌঁছতে না পৌঁছতেই ছেলে’টা দোকানদারের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে, দোকানের সামনে থামিয়ে রাখা নীল রঙের বাইক’টা সার্স্ট করলো। রকেটের গতিতে ভোঁ করে দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল নীল রঙা বাইক’টা।
হাতের নাগালে এসেও যেন সাপের মুল্যবান মনি’টা হারিয়ে গেল।অরূণীর চোখে-মুখের অবস্থা সংকটজনক। নিচের দিকে ঝুঁকে হাঁটুতে হাত রেখে হাঁপাচ্ছে। আফসোস হতে লাগলো অরূণীর। আর এক মিনিট আগে দেখলেই হত।এমন আফসোস কখনো হয়নি অরূণীর। তীব্র হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ মনে পড়ল ছেলে’টা দোকানদার কে টাকা দেয় নি। শুধু চায়ের কাপ’টা দিয়েই চলে গেছে। এর মানে দোকানদারের রেগুলার কাস্টমার। অরূণী কয়েক পা এগিয়ে দিয়ে দোকানদার’কে খুব সুললিত কণ্ঠে বলল, “চাচা।”
দোকানের বেঞ্চিতে কয়েকজন কাস্টমার বসা।মাঝ বয়সী দোকানদার,দাঁড়ি-গোঁফে হালকা পাক ধরেছে।ব্যস্ত হাতে চা বানাচ্ছে। অরূণীর ডাক শুনলো না। অরূণী দোকানদারের ব্যস্ততা কমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে এক পাশে। খানিক বাদে দোকানদার অরূণীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপা চা দিমু?”
অরূণী একটু আগে দোকানদার’কে চাচা বলে সম্বোধন করল। আর এখন দোকানদার আপা বলছে। ভাই বলা ছাড়া উপায় নেই। অরূণী একটু ইতস্তত বোধ করে বলল, “আচ্ছা ভাই, একটু আগে সাদা রঙের শার্ট পরা একটা ছেলে যে চা খেলো দোকানের সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে রেখে। সে ছেলে’কে আপনি চিনেন?”
দোকানি বিরক্ত হয়ে তাকালো অরূণীর দিকে। দোকানি আশা করেছিল অরূণী চা দিতে বলবে‌। দোকানির মুখের অভিব্যক্তি দেখে অরূণী সেটা বুঝতে পারলো, “দেন ভাই,এক কাপ চা দেন।”
দোকানের পাশের বেঞ্চিতে বসলো অরূণী।দোকানের সামনের দিকে যে বেঞ্চ আছে সেখানে কয়েকজন ছেলে বসা। একটু আগের প্রশ্নে দোকানি অরূণীর প্রতি যত’টা বিরক্ত হয়েছিল, চা দিতে বলায় তত’টা খুশি হলো। অরূণীর দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলল, “পোলা’ডা রুদ্র, রুদ্র আকন। ভারছিডি’তে লেহাপড়া করে। তিন বছর ধইরা আমার দোকানে চা খায়।”
রুদ্র, রুদ্র আকন শব্দ তিন’টা অরূণীর কানে টেপ রেকর্ডের মতো বাজতে লাগলো।এর আগেও অনেক বার রুদ্র নাম’টা শুনেছে তখনও কি এত ভালো লেগেছে? হঠাৎ করে রুদ্র নাম’টা এত চমৎকার লাগলো কেন? অরূণী উল্লাসিত হয়ে চোখ বুঁজে অস্ফুট স্বরে বলতে লাগল, “রুদ্র, রুদ্র আকন।”
অরূণী চা-কফি কিছুই খায় না। দোকানির মুখের অভিব্যক্তি দেখে চা নিয়েছে। চায়ের কাপ অনাদৃত ভাবেই পড়ে রইল। গরম ধোঁয়া উড়া চায়ের কাপের চা ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।অরূণী দোকানির দিকে তাকিয়ে তীব্র আগ্রহী গলায় বলল, “ভাই ,রুদ্র আকন কি কার্তিক কর্মকারের বাসায় ভাড়া থাকে?”
দোকানি তাকালো অরূণীর দিকে। দোকানি কিছু বলার আগেই অরূণী বলল, “দরকার হলে চা আরেক কাপ নিবো তবুও বলুন।”
– “হ কার্তিক কর্মকারের বাসায় থাহে।”
– “উনার ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে?”
দোকানি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো।ব্যঙ্গাত্মক ‌‌‌স্বরে বলল, “দুইন্নার তোন লজ্জা সরম সব উইঠা যাইতাছে। পোলা মাইষের ফোন নম্বর খুঁজতে আইছে।”
দোকানির কথায় দোকানের সামনের বেঞ্চে বসা ছেলে গুলো খ্যাক করে হেসে ওঠে। অরূণীর কঠিন দৃষ্টি সেদিকে। দোকানদারের মুখের দিকে শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, “আপনার কাছে ফোন নম্বর থাকলে দিবেন, না থাকলে নাই। ছেলেরা যদি মেয়েদের ফোন নম্বর খুঁজতে পারে, মেয়েরা কেন পারবে না?লজ্জা-সরম সব মেয়েদের জন্য? আমি সাহেদ আহমেদের মেয়ে, ছাত্রলীগ নেতা সূর্যের বোন। ফোন নম্বর থাকলে তাড়াতাড়ি দেন।নয়ত দোকান উড়িয়ে দিবো।”
দোকানির মুখের ভঙ্গি মুহূর্তেই পরিবর্তন হয়ে গেল। যেন একটু আগে বলা কথা’টার জন্য অনুতপ্ত সে। সন্দিহান হয়ে মোলায়েম গলায় বলল, “আপনে সত্যি সূর্যের বইন?”
– “সূর্য দাদা’কে খবর দিবো?”
দোকানদার’কে ভয় দেখাতে সূর্যের কথা বলেও বিপাকে পড়ে গেল অরূণী। যদি সূর্যের কাছে এসব বলে দেয় দোকানি? সূর্য জানলে অরূণীর অবস্থা খারাপ হবে। অরূণীর এসব ভাবনার সুতো ছিঁড়ে দোকানি হতবিহ্বল হয়ে বলল, “আপনারে দেখলে বোঝন যায় না যে আপনে সাহেদ আহমেদের মাইয়া।”
– “আমি কি এখন কপালে বড় বড় অক্ষরে লিখে রাখবো আমি সাহেদ আহমেদের মেয়ে?”
দোকানি দ্রুত তাঁর মোবাইল’টা অরূণীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “দেহেন আপা, রুদ্রর নম্বর নাই মোবাইলে। আমি কাল আপনের লাইগা ফোন নম্বর রাখমু রুদ্রর থেইকা।”
– “কি অদ্ভুত! আমি কি রুদ্র আকনের নম্বর চিনি? আমি বুঝবো কিভাবে আপনার ফোনে নম্বর আছে নাকি নেই? ফোন নম্বর যদি কাল আমায় দিতে না পারেন তাহলে আমি কিন্তু সূর্য দাদার কাছে বলল।”
অরূণী এই বলে ওঠে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দোকানির দিকে টাকা এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই নিন টাকা।”
দোকানি টাকা নিতে নারাজ।অরূণী জোর করে টাকা দিয়ে চলে আসলো।
______________
পরেরদিন দোকানে এসে জানতে পারে রুদ্র আসেনি আজ। অরূণী জেরা করতে লাগলো দোকানি’কে। দোকানি বলল, “বিশ্বাস করেন আপা আয় নাই রুদ্র।”
– “আগে কি প্রতিদিন আসতো?”
– “মাঝে মধ্যে দুই এক দিন আসে না।আবার আসে।”
– “কালকে কি আসবে?”
দোকানি মৃদুগামী গলায় বলল, “তা আমি কইতে পারি না। যদি আয় তাইলে আমি ফোন নাম্বার রাখমু।”
অরূণী ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়। টানা দুই-তিন ধরে আসলো দোকানে। রুদ্রও দোকানে আসেছে না দুই-তিন দিন ধরে। অরূণী ছটফট করতে লাগলো। কি অদ্ভুত ব্যাপার! এগুলো কেমন বাড়াবাড়ি রকমের অনুভূতি?অরূণী নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছে।রুদ্রর সম্পর্কে আদৌ কিছুই জানে না,চিনে না। এগুলো কি ভালোবাসা? ভালোলাগা? নাকি খামখেয়ালির কিংবা বয়সের পাগলামি?
অরূণী দুই দিন বাদে আবার আসে সেই দোকানে। অজ্ঞাত শঙ্কা নিয়ে দোকানি’কে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করে, “আজও আসে নি রুদ্র আকন?”
দোকানি না বলে। অরূণী যথারীতি বিফল হলো। ভয়ংকর কালবৈশাখীর সময় আকাশে বিচরণ করা জলমুক্ এর মত হয়ে গেল অরূণীর মুখ। অরূণীর অদ্ভুত এক কারণে কান্না পাচ্ছে। দুই-এক বার দূর থেকে দুই পলক দেখা একজন ছেলের জন্য এমন পাগলামী বাড়াবাড়ি বৈ আর কি? অরূণী কষ্টে কিংবা হতাশায় ভার হয়ে আসা গলায় দোকানি’কে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা রুদ্র আকনের বউ কিংবা ভালোবাসার মানুষ টানুষ আছে?”
দোকানির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন’টা ছুঁড়ে ভয়চকিত হয়ে উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলো। অরূণীর এমন কাণ্ডে দোকানি অবাক হলেও তা প্রকাশ করল না।‌‌‌‌‌‌বলল, “বউ নাই। তবে ভালোবাসা মানুষ আছে নাকি কইতে পারমু না।”
এই দোকানি’কে বড্ড সন্দেহ হচ্ছে অরূণীর। এতদিন আসতো আর অরূণী খোঁজ করার পর থেকে আসে না। অরূণীর খটকা লাগলো। কথা না বাড়িয়ে কার্তিক কর্মকারের বাসার উদ্দেশ্যে রওনায়া হলো। মাঝপথেই বৃষ্টিতে পেলো অরূনীকে। বৃষ্টির গায়ে তেমন তেজ নেই, ক্লান্ত ভাবে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে আকাশ থেকে। অরূণী কোথায়ও দাঁড়ালো না। কার্তিক কর্মকারের বাসায় পৌঁছার আগেই বৃষ্টি কমে গেল। অরূণীর পুরো শরীর স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেল। গেটের সামনে দারোয়ান’কে দেখেই জোর গলায় বলল, “কি আজও ঢুকতে দিবেন না? আজ বাড়াবাড়ি করলে চাকরি সত্যি খেয়ে দিবো।”
দারোয়ান আন্তরিকতার সহিত বলল, “আপনে কার্তিক মশাইয়ের আত্মীয় তা তো সেদিন কন নাই। কইলে কি ঝামেলা হইত?”
– “আমার ঝামেলা ভাল্লাগে। এখন বলুন রুদ্র আকন কোন রুমে থাকে?”
দারোয়ান একটু ভেবে বলল, “রুদ্র?উঁচা-লম্ফা সুন্দর একটা পোলা?”
অরূণী হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়। দারোয়ান হাত দিয়ে দেখিয়ে বলে, “ওই তিন তলার দক্ষিণ পাশের রুমে।”
অরূণী চারদিকে তাকিয়ে খুব সাবধানে গেটের ভিতর ঢুকলো। কার্তিক কর্মকার বাসার উত্তর পাশে দাঁড়িয়ে কি যেন করছে দূর থেকে ঠিক বুঝা গেল না।কিছুতেই কার্তিক কর্মকার কিংবা সঞ্জিতা কর্মকারের সামনে পড়া যাবে না খুব সতর্কতার সাথে উপরে ওঠতে থাকে। অরূণী আবেগকম্পিত হয়ে পড়ল। রুদ্র আকন’কে কি খানিক বাদেই দেখতে পারবে? অরূণী তিন তলায় উঠে দক্ষিণ পাশের রুমে ডোর বেল বাজালো। অরূণীর বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। এখুনি কি রুদ্র বেরিয়ে আসবে? হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ আসলো। সদ্য গোসলখানা থেকে বের হওয়া কোমড়ে তোয়ালে পেঁচানো আর গলায় ভেজা লুঙ্গি’টা, এক যুবক দরজার সামনে দাঁড়ানো। অরূণী এক নজর তাকালো। না,এটা তো রুদ্র না। অজ্ঞাত এক তরুণীর সামনে এমন অবস্থায় দাঁড়িয়ে কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল দরজায় দাঁড়ানো যুবক। অরূণী ঝটপট জিজ্ঞেস করল, “রুদ্র আকন আছে?”
যুবক বলল, “ওয়েট।”
অরূণী বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে রইল। উনি কি রুদ্র’কে ডেকে আনতে গিয়েছে? অরূণীর ভাবনা মিথ্যে হলো। দুই-তিন মিনিট পর সেই যুবক ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরে এসে অবাক গলায় বলল, “কে আপনি?আর এখানে এসেছেন কিভাবে?”
যুবক অরূণীর দিকে তাকালো।শ্যাম বর্ণের অরূণীর চোখ-মুখে অদ্ভুত মায়া। গায়ের কাপড় কিছু’টা ভেজা। সেলোয়ার টাকনু থেকে একটু উপরে তোলা। আর পায়ের জুতা জোড়া হাতে। কাদা-বালি আর পানি’তে লেপ্টানো জুতা জোড়া পরে সিঁড়ি বেয়ে ওঠতে খুব অসুবিধা হচ্ছিলো অরূণীর। অরূণী জবাব দিলো, “ যেভাবে আসার আসছি। রুদ্র আকন’কে একটু ডেকে দেন?”
যুবকের চোখে-মুখে বিস্ময়।বলল, “একটা ব্যাচেলর বাসায় এভাবে ঢুকে পড়লেন? আর রুদ্র’কে কেন খোঁজ করছেন?”
– “আমিও তো ব্যাচেলর মেয়ে, ব্যাচেলর ছেলের খুঁজে ঢুকেছি।”
অরূণীর এমন ঝটপট অদ্ভুত অদ্ভুত উত্তরে যুবকের বিস্ময়ের পাল্লা ভারি হচ্ছে ক্রমশ। অরূণী ফের বলল, “আরে ভাই রুদ্র আকন’কে একটু ডেকে দেন না।”
– “রুদ্র’কে কেন খুঁজছেন? রুদ্রের সাথে আপনার কি সম্পর্ক?”
– “রুদ্র আমার বয়ফ্রেন্ড। রুদ্রর সাথে আমার শারীরিক, মানসিক সম্পর্ক। এত কিছু দিয়ে আপনার কি দরকার?একটা প্রশ্নেরও সোজাসাপ্টা উত্তর দিচ্ছেন না।”
এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে থামলো অরূণী। যুবক বিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে রইল।কপালে ভাঁজ পড়ল কয়েক’টা। শারীরিক, মানসিক সম্পর্ক? রুদ্রর গার্লফ্রেন্ড?অরূণীর মুখের দিকে ভ্রু কুঁচকে ভালো করে তাকালো। অরূণীর আচরণে বিচলিত হয়ে গেল।
– “আমি কিরণ। রুদ্রের রুমমেট। রুদ্র রাজশাহী গেছে, ওঁর বাসায়। আর আপনি রুদ্রের গার্লফ্রেন্ড সেটা আমি জানবো না?”
অরূণী আবার আশাহত হলো।গলার স্বর মুহুর্তেই পরিবর্তন করে বলল, “ভাইয়া আমি মিথ্যে বলেছি, আমি রুদ্রুর গার্লফ্রেন্ড নই।আমার একটু দরকার উনাকে জরুরি। উনি কবে নাগাদ আসবে?উনার ফোন নম্বর’টা দেওয়া যাবে?”
অরূণীর এমন চঁচলতায় কিরণ উত্তর দিতে ভুলে গেল।অরূণী ফের একই কথা জিজ্ঞেস করল। কিরণ রুদ্রর ফোন নম্বর টুকে দিলো। আরূণীর বাঁধ ভাঙা আনন্দ। কিছুক্ষণ পর করুণ স্বরে বলল, “ভাইয়া একটা সত্যি কথা বলবেন?”
– “কি কথা?”
– “রুদ্রর কি গার্লফ্রেন্ড আছে?প্লীজ ভাইয়া সত্যি বলবেন। গার্লফ্রেন্ড থাকলেও কি সিরিয়াস প্রেম? ভাঙার মত না? ভাঙলে কষ্ট পাবে?”
অরূণীর প্রতি’টা প্রশ্ন কিংবা উত্তরে কিরণ স্তম্ভিত হয়ে গেল।আশ্চর্যান্বিত ভাব’টা প্রকাশ না করে চুপচাপ হজম করে বলল, “সেগুলো আপনি রুদ্রের কাছ থেকে জেনে নিয়েন। আপনি কিভাবে এখানে এসেছেন আপনি জানেন। সঞ্জিতা কর্মকার আপনায় দেখে নি?আর রুদ্র’কে কেন খুঁজছেন এভাবে?”
অরূণী এসবের উত্তর না দিয়ে বলল, “সঞ্জিতা কর্মকার আমায় দেখে নি। এখন যদি এতসব প্রশ্নের উত্তর দিতে যাই তাহলে নির্ঘাত দেখে ফেলবে।”
অরূণী সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে কিরণের দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “ভাইয়া আপনি আমার কত বড় উপকার যে করেছেন! আপনায় জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে। আপনি মেয়ে হলে শুধু জড়িয়ে ধরতাম না চুমুও খেতাম।”
কিরণ বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরূণীর দিকে। কি অদ্ভুত! কি আশ্চর্য রকমের মেয়ে!
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here