তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৪৩
দিন কাটতে লাগলো।অরূণী প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো রুদ্রর সাথে যোগাযোগ করার। কিন্তু কোনো ভাবেই পারে নি। এক সময় অরূণী তীব্র হতাশ হয়ে যায়। জীবনে নেমে আসে বড্ড ক্লান্তি।ধীরে ধীরে বিশাল পরিবর্তন হতে লাগলো অরূণীর। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না, সারাক্ষণ রুমে নিঃশব্দে বসে থাকে। হাসতে ইচ্ছে হয় না,মাঝে মাঝে অতি প্রয়োজনে জোরপূর্বক ম্লান হাসে।রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে অরূণীর একাকিত্বের আর্তনাদ তীক্ষ্ণ হতে থাকে।চোখের কোটর বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকতে নিভৃতে। রুদ্রর সাথে প্রথম দেখা, পরিচয়,প্রেম সব কিছুই ছিলো পাগলামিময়।সে দিন গুলো এখন শুধু সোনালী অতীত।
অরূণী ভার্সিটি থেকে ফিরে ঢকঢক করে তিন গ্লাস পানি খায়।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে ছিলো। পানি খেয়ে অবসন্ন শরীর নিয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসে থাকে খানিকক্ষণ। সেলিনা আহমেদ অরূণীর দিকেই এগিয়ে আসছিলো। সেলিনা আহমেদ’কে দেখার সাথে সাথে অরূণী বলল, “আম্মা আমি দুই’টা টিউশনি করবো।”
সেলিনা আহমেদ পরম আশ্চর্যে চোখ কপালে তুলে অরূণীর দিকে তাকায়।বলে, “মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন তোর?”
– “মনে হয়।”
সেলিনা আহমেদ আবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো।অরূণী ব্যস্ত থাকতে চায়।ভার্সিটি, টিউশনি সব মিলিয়ে ব্যস্ততার সাথে দিন কেটে যাবে। সাহেদ আহমেদ এই ব্যাপার নিয়ে বলল, “খারাপ কী? ওঁর হচ্ছে হলে ও করবে টিউশনি।”
ভার্সিটি, টিউশনি সব মিলিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে অরূণী। নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে।মাঝে মাঝে বুক চিরে যন্ত্রণাপূর্ণ একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।
রাত তখন বেশ গভীর।অরূণী আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের প্রতিবিম্বর দিকে গভীর মনোযোগে তাকিয়ে থাকে। চেহারায় অদ্ভুত পরিবর্তন! বিষাদের ছাঁয়া।চোখের নিচ’টা কালো হয়ে গেছে খানিক।অযত্নে দিন দিন কালো হয়ে যাচ্ছে মুখ’টা।চোখের চাহনি’তে আগের মত চঞ্চলতা নেই। অকারণেই অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে আয়নার দিকে।মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসে, “রুদ্র।” কতদিন কথা হয় না,দেখা হয় না। শুধু ই অপেক্ষা।যদি বদলে যায় রুদ্র?অরূণীর মনে কাঁপন ধরে এই শঙ্কায়। রুদ্র যখন কাছাকাছি আসতো তখন অরূণীর মনে তোলপাড় শুরু হয়ে যেতো।আর আজ যখন রুদ্র বহুদূরে, আজও অরূণীর মনে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।তখন ভালোবাসার আর এখন কষ্টের। রুদ্রর কঠিন সিদ্ধান্ত গুলো হঠাৎ করেই নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে না?সব ভুলে দিশেহারা হয়ে ফোন দিবে অরূণীর কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলবে, “আমি তোমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারছি না অরূণী। আমার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ।” হয়ত এমন’টা কখনো হবে না। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে ভালো করেই জানে রুদ্র।অরূণীর এই ইচ্ছে পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বছর দেড়েক কেটে গেল।অরূণীর শূন্যতা সেই আগের মতই আছে।যন্ত্রণা গুলো কিছুটা সময়ের সাথে চাপা পড়েছে। আর ছয় মাস?ছয় মাস পরেই ফিরে আসবে রুদ্র?অরূণীর মনের ভিতর হাজারো অভিমান, অভিযোগ। ভালোবাসা কি বাঁধাধরা নিয়মে চলে? রুদ্র কেন বাঁধাধরা নিয়মে বাঁধলো? রুদ্রর ভালোবাসা এমন অদ্ভুত কেন?সকল নিয়ম-কানুন ভেঙে রুদ্র অরূণীর সাথে কথা বলতে পারে নি?এই এলোমেলো ভাবনা গুলো অরূণীর অভিমানের পাল্লা আরো ভারী করে।
একদিন টিউশনি থেকে ফেরার পথে হঠাৎ এক কিরণের সাথে দেখা হয়ে গেল অরূণীর। কিছুটা দূর থেকে কিরণ ডাকলো অরূণী’কে। অরূণী পিছনে ফিরে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।কিরণ’কে চিনতে পারলো না। চিনতে না পারার কারণ হলো কিরণের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।আগে দাঁড়ি ছিলো না।অরূণী চিনতে না পারায় কিরণ যেন খানিক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লো।কিরণ হালকা হেসে বলল, “আমি কিরণ। রুদ্রর বন্ধু।”
অরূণী এবার হতবিহ্বল হয়ে তাকালো, “কিরণ ভাইয়া আপনি!আরে আমি আপনায় চিনতে পারলাম না কী আজব ব্যাপার।”
– “চিনতে না পারার অবশ্য কারণ আছে।”
অরূণী একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “হ্যাঁ।”
অরূণীর মাথায় এখন অন্য কোনো কথা আসছে না। রুদ্রর কথা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কোথায়ও যেন বাঁধা পড়ছে।বুকের ভিতর জমানো অভিমান গুলো হয়ত বাঁধা দিচ্ছে। সব ছেড়েছুড়ে অরূণী জিজ্ঞেস করলো, “ভাইয়া রুদ্রর সাথে আপনার কথা হয় তাই না?প্লীজ মিথ্যা বলবেন না।আমি জানি আপনি সব জানেন।আমি কত খুঁজেছি আপনায়।”
কিরণ খেয়াল করলো অরূণীর চোখে পানি চিকচিক করছে।কিরণ সাত-পাঁচ না ভেবেই বলল, “হ্যাঁ কথা হয়।মাত্রই তো রুদ্রর সাথে কথা বলছিলাম আর হাঁটতেছিলাম।তোমায় দেখে ফোন রাখলাম।”
সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল অরূণীর।বুকের ভিতর হু হু করে ওঠছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।কোনো রকম ঠোঁট নেড়ে বলল, “আমার সাথে কথা বলিয়ে দিতে পারবেন?উনি কবে ফিরবেন?”
কথা’টা বলে সাথে সাথেই অরূণীর পুনরায় বলল, “না,না আমি কথা বলবো না।আপনি কথা বলবেন আমি শুনবো।”
কিরণ মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।বলল, “কয়েক মাস পরেই ফিরবে। চলো কোনো কফিশপে গিয়ে বসি।”
কফিশপে গিয়ে বসার পর কিরণ জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কথা বলবে?”
অরূণীর গলা কাঁপছে। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে বলল, “না।আপনি কথা বলুন আমি শুনবো।”
– “ফোন নম্বর নিবে? রুদ্রর ব্যাপারে তোমার কাছে কিছু বলা সম্পূর্ণ নিষেধ।অনেক সময় কিছু কিছু নিষেধ ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করে।”
অরূণীর চোখ ভিজে যাচ্ছে।ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে সন্তপর্ণে চোখ মুছে বলল, “না ভাইয়া ফোন নম্বর নিবো না।আপনি কথা বলুন, আমি শুনবো।”
কিরণ বেশ কয়েকবার বলল অরূণী’কে রুদ্রর সাথে কথা বলতে, রুদ্রর ফোন নম্বর নিতে।অরূণী নারাজ।ভিতর থেকে কেউ একজন বাঁধা দিচ্ছে। জমে থাকা অভিমান গুলো আজ শক্ত গলায় ধমকাচ্ছে অরূণী’কে। রুদ্র এই দেড় বছরে সব কঠিন সিদ্ধান্ত ভেঙেচুরে একবার যোগাযোগ করতে পারতো না?কি হতো যদি যোগাযাগ করতো?কিরণ ফোন দিলো রুদ্রর কাছে। রুদ্র ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “ঘুমে ডিস্টার্ব করতেছিস কেন রে ভাই?”
অরূণীর বুকের ভিতর কাঁপন ধরছে।কেউ টের পাচ্ছে না সেই কাঁপুনি।মনে হচ্ছে কয়েক যুগ বাদে শুনেছে রুদ্রর গলা।সেই প্রিয় কণ্ঠস্বর! টপটপ করে পানি পড়ছে অরূণীর গাল বেয়ে। কিরণের হাত থেকে ফোন’টা নিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, “আপনি স্বার্থপর রুদ্র।”
কিরণ হাতের ইশারায় বার বার অরূণী’কে বলছে কথা বলার জন্য।অরূণী মাথা ঝাঁকিয়ে না বলছে। রুদ্র ওপাশ থেকে বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, “কি সমস্যা কি তোর?”
কিরণ হেসে বলল, “তুই কেমন আছিস রুদ্র?ধর,এই প্রশ্ন’টা অরূণী করেছে। তুই কি জবাব দিতি?”
রুদ্র কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়। কিরণের এমন কথা অদ্ভুত লাগলো। রুদ্র খানিক সময় বাদে বলল, “অরূণী যদি জিজ্ঞেস করতো তাহলে বলতাম আমি ভালো থাকার চেষ্টা করছি তুমিও চেষ্টা করো।এই তো কয়েকটা মাস।”
অরূণীর শ্বাস দ্রুততর হচ্ছে।নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রুদ্র ফের বলল, “অরূণীর টিউশনি করার কি দরকার?মেয়েটা এত বেশি বুঝে। ভার্সিটি,টিউশনি চাপ হয়ে যায় না?”
কিরণ উত্তর না দিয়ে অরূণীর দিকে তাকালো।অরূণী কিছুক্ষণ থ হয়ে রইল। রুদ্র তাহলে ওঁর সব খোঁজ রাখছে?এতসব কষ্টের মাঝেও কেমন একটু প্রশান্তি।এত অভিমানের মাঝেও এক রাশ ভালোলাগা।কিরণ কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, “অরূণীর সাথে একবার কথা বলতে পারিস না?”
রুদ্র ব্যস্ত গলায় বলল, “কিরণ রাখ।কাজ আছে একটু।”
কিরণ ফোন রাখার আগেই রুদ্র ফোন রেখে দিলো।অরূণী কফিশপ থেকে বেরিয়ে পড়লো।মনের ভিতর আবার সেই উথালপাতাল যন্ত্রণা।ঘন ঘন দীর্ঘ নিঃশ্বাস আপনাআপনি বেরিয়ে আসছে। চোখ দুটো’তে আষাঢ়ের ধারা প্রবাহমান!
বাসায় গিয়ে অরূণীর বার বার মনে হতে লাগলো ফোন নম্বর’টা নিলো না কেন?পরক্ষণে আবার মনে হলো না নিয়ে ঠিক করেছে। কোনো দরকার নেই এভাবে কথা বলার। অভিমানের অরূণীর চোখ দুটো ছলছল করছে।
সূর্যের বিয়ের অনুষ্ঠান।বেশ ধুমধাম করে অনুষ্ঠান।এ্যাংগেজমেন্ট তো হয়েছিলো প্রায় বছর দুয়েক আগে।অরূণীর কোনো আনন্দ হচ্ছে না। বরংচ বাসায় এত মানুষের শোরগোল অরূণী’কে বিরক্ত করে তুলছে। সূর্যের সাথে অরূণীর মোটামুটি একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে।এই দূরত্ব একদিন-দু’দিনে হয় নি।ক্রমশ হয়েছে। যথাসম্ভব সূর্য’কে এড়িয়ে চলে অরূণী।তবে এই এড়িয়ে চলার বিষয়’টা সবার চোখে স্বাভাবিক।কারণ অরূণীর চুপচাপ হয়ে গেছে।হয়ত এই চুপচাপ স্বভাবের কারণেই এমন’টা। সূর্যর প্রতি অরূণীর চাপা কিছু রাগ রয়েছে।সকল কাছের মানুষের সাথেই কেমন একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে অরূণীর। সূর্যর বিয়ের অনুষ্ঠানেও অরূণীর এভাবে চুপচাপ রুমে বসে থাকা’টা সবার চোখে বিঁধলো।সেলিনা আহমেদ এসে শাসিয়ে গেল অরূণী’কে।অরূণী কোনো প্রত্ত্যুতর করলো না।অরূণী ওঁর মত ভার্সিটিতে যাচ্ছে, টিউশনি’তে যাচ্ছে।বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে অরূণীর মাঝে তেমন উদ্বিগ্নতা দেখা গেল না।বাসার কেউ কিংবা কোনো আত্মীয়-স্বজন এই বিষয় নিয়ে অরূণী’কে কিছু বললে এক রাশ বিরক্ততে নাক-মুখ কুঁচকে বলে, “এত শোরগোল আমার ভালোলাগে না।”
বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। পরিবারে একজন সদস্য বাড়লো।মিলা আর অরূণীর ভাবী-ননদের সম্পর্ক’টা তেমন জমে ওঠছে না। সেলিনা আহমেদ অরূণী’কে গোপনে জিজ্ঞেস ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “মিলার সাথে তোর কোনো ঝামেলা-টামেলা হয়েছে না-কি?”
– “না আম্মা।আমার আজকাল কারো সাথে কথা বলতে ভালোলাগে না কেন জানি।”
– “কেন কি হয়েছে তোর?কি আজব!মেয়েটা কি মিষ্টি, মিশুক। ভালো লাগবে না কেন তোর?”
– “আমি কী বলছি মিলা ভাবী’কে আমার ভালোলাগে না?আমি বলছি আমার কারো সাথে ভালোলাগে না।সব ভালো না লাগার ব্যাখ্যা নেই আম্মা,কারণও নেই।”
অরূণীর কথা দুর্বোধ্য ঠেকে সেলিনা আহমেদের কাছে।ভুত-পেতনির আচর লাগে নি তো অরূণীর শরীরে?কি অদ্ভুত আচরণ করে! সেলিনা আহমেদ একা একা ভাবতে থাকে।
রুদ্র কানাডা গিয়েছে আজ একদম দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। তারিখ’টা ডায়েরি’তে লিখে রেখেছিলো অরূণী। রুদ্র বাংলাদেশে ফিরে আসবে?দেখা হবে,কথা হবে।অরূণী আর কিছু ভাবতে পারছে না। প্রতীক্ষিত দুই’টা বছর। হাজার কষ্ট নিয়ে অতিবাহিত করা দুই’টা বছর। নিভৃতে চোখের জল ফেলে বালিশ ভেজানোর দুই’টা বছর আজ পূর্ণ হলো। বেহিসেবি কত রাত কেটেছে নির্ঘুম! ইয়ত্তা নেই তাঁর।কত হাজার চোখের জল ঝড়েছে হিসেব নেই। কবে ফিরবে রুদ্র?অরূণীর তৃষ্ণার্ত,ক্লান্ত মন’টা উতলা হয়ে ওঠছে।কয়েকদিন পর ফিরবে রুদ্র?অরূণী কিছুই জানে না।
(চলবে)