তোলপাড় পর্ব ৪২

তোলপাড়
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৪২
________________
অরূণী বাসার উদ্দেশ্যে গাড়ি নেয়। চোখের জল লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা বার বার করে যাচ্ছে।চোখ দুটোর বেহাল দশা। নিষ্প্রভ চোখের দৃষ্টি। চারদিকে শুধু শূণ্যতা আর হাহাকার।এই বিষাক্ত যাতনা অরূণীর সহ্য হচ্ছে না‌।বাসার গেটের সামনে আসতেই দেখে একটু তফাতে দাঁড়ানো সাহেদ আহমেদ।অরূণী অতি সন্তপর্ণে চোখের পানি মুছে চেহারা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।কোনো রকম কান্না চাপিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়। সাহেদ আহমেদ জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অরূণীর দিকে।অরূণী অপ্রস্তুত ভাবে হেসে বলে, “কী করছো আব্বা এখানে?”
– “এত দেরি হলো কেন তোর?”
সাহেদ আহমেদ একটু থেমে আবার বলল, “কিছু করি না।বের হবো একটু।”
দেরি কেন হলো এই প্রশ্নে উত্তর না দিয়েই বাসার ভিতর ঢুকে পড়লো অরূণী।সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় সেলিনা আহমেদের কণ্ঠস্বর কানে আসে, “ঝটপট ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।সকালেও খেয়ে যাস নি।”
অরূণী কোনো প্রত্যুত্তর করলো না।রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে হুড়মুড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।মর্মযন্ত্রণায় অস্ফুট আর্তনাদ করতে লাগলো অরূণী।জাগতিক কোনো খেয়াল নেই।কান্না থামিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে রুদ্রর ত্তষ্ঠ চুম্বনের সেই মুহূর্ত আবার অনুভব করার চেষ্টা করে। কান্নাকাটি ভুলে ঘোরগ্রস্তের মতো হয়ে যায় অরূণী। জীবনের প্রথম ঠোঁটে চুমুর ঘোর কি সহজে কাটে? কিছুক্ষণ পর অরূণীর কান্না আবার বাড়ে। রুদ্রর সাথে দুই বছরে আর দেখা হবে না!ছোট এই বাক্য’টা অরূণীর কাছে যে কত’টা দহনকর তা অরূণী কাউকে বুঝাতে পারবে না। সেলিনা আহমেদ অনারবত দরজা নক করে যাচ্ছে, “অরূণী,এ্যাই অরূণী।কি সমস্যা কী তোর?খেতে আয়। আমি খাবার বেড়ে বসে আছি কতক্ষণ ধরে।”
কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। সেলিনা আহমেদ ফের বলে, “দরজা খোল।ফ্রেশ হচ্ছিস তুই?”
সেলিনা আহমেদের অচেতন মনে শঙ্কা জাগে অরূণী আত্মহত্যা করে নি তো আবার? সেলিনা আহমেদের অন্তর আত্মা কেঁপে ওঠে।দ্রুত জানালার কাছে গিয়ে রুমের দিকে উঁকি দেয়।অরূণী এলোমেলো ভাবে বিছানায় শুয়ে আছে। সেলিনা আহমেদ লম্বা এক শ্বাস ফেলে। জানালার কাছে সেলিনা আহমেদের উপস্থিতি টের পেয়ে অরূণী বালিশ থেকে মুখ না তুলেই মৃদু স্বরে বলল, “মাথা ব্যথা করে আম্মা।যাও পড়ে খাবো।”
সেলিনা আহমেদ উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “মাথা ব্যথার ওষুধ খেয়ে নে তাহলে।”
অরূণীর অমনোযোগী কণ্ঠস্বর, “আচ্ছা।”
সেলিনা আহমেদ চলে যাওয়ার পর অরূণী ওঠে বসে।কপালে লেপ্টে থাকা অবিন্যস্ত চুল গুলো গুঁজে নেয়।কষ্ট মিশ্রিত ভারী শ্বাস ফেলে ঘনঘন। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে।নিজের মন’কে প্রবোধ দেয়।রুদ্রর সাথে ফোনে কথা হবে,ভিডিও কলেও দেখা যাবে রুদ্র কে।এত কষ্ট পাওয়ার কী আছে?কত মানুষের প্রিয়জনই তো বছরের পর বছর দেশের বাইরে পড়ে থাকে। হঠাৎ অরূণীর মনে পড়লো রুদ্র চিঠি দিয়েছে।অরূণী তড়াক করে বিছানা ছাড়ে।কী লেখা আছে চিঠিতে?অরূণী ব্যগ্র হয়ে ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে। চিঠি নিয়ে বারান্দায় যায়।চিঠি’টা খুলে খুব মনোযোগী ভাবে পড়তে শুরু করে।
অরূণী,
প্রথমেই বলে দিচ্ছি চিঠি’টা পড়ে পাগলামি করবে না। প্রবাহমান জীবন মাঝে মাঝে আমাদের এমন তিক্ত বাস্তবতার মুখোমুখি করে যে শত কষ্ট চাপিয়ে রেখেও কখনো কখনো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।হঠাৎ এই চিঠি দেওয়ার কারণ হলো এই কথা গুলো তোমার সামনাসামনি বসে বলে তোমার যন্ত্রণায় কাতর মুখ আমি দেখতে চাই নি।
দুই বছর আমাদের মাঝে কোনো যোগাযোগ হবে না।দুই বছর পর দেশে ফিরে তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিবো। তোমায় হারানোর কষ্টের কাছে,এই দুই বছর যোগাযোগ না থাকা নিতান্তই তুচ্ছ!তোমার সাথে যোগাযোগ থাকলে তোমার বাসায় কোনো না কোনো ভাবে জেনে যাবে।তোমার বাসার মানুষ বিশ্বাস করেছে যে আমার সাথে তোমার সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটেছে।আমি চাই এই বিশ্বাস আরো দুই বছর থাকুক।
অরূণী বাস্তবিক হও।আবেগ দিয়ে ভাবতে গেলে তোমায় হারাতে হবে।তাই আমি এরকম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।তুমি তো এতদিনে বুঝতে পেরেছো তোমার পরিবারের মানুষদের আমার পরিবারের ওপর কত বিতৃষ্ণা।পারিবারিক এই রেষারেষির কারণে আমি তোমায় হারাতে চাই না।দুই বছর পর দেশে ফিরে আমি আমার আগের সেই অরূণীকেই দেখতে চাই। যে আবেগ আর পাগলামিতে টুইটম্বুর।যার চোখে মুখে সারাক্ষণ চঞ্চলতা লেগে থাকবে।
তোমার সামনে বসে এসব কথা বলার সাহস আমার ছিলো না।আমার চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে অরূণী।তোমার আবেগ আবেগ রোগ’টা আমায়ও পেয়ে বসেছে।চিঠি’টা ছিঁড়ে ফেলে দিও।আবারও বলছি তুমি কোনো রকম পাগলামি করো না।
দুই বছর পর দেশে ফিরে তোমায় চোখ ভরে দেখে তৃষ্ণা মেটাবো। রাতভর সজাগ থেকে তোমার রিনরিনে গলার স্বর শুনবো। তোমার আবেগে রং মিশাবো। দুই বছর অপেক্ষা করো শুধু।মাত্র দুই বছর’ই তো পাগলি।দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তোমায় আমি কখনো কষ্ট দিতে চাই নি।না চাইতেও অনেক বড় কষ্ট দিয়ে ফেললাম। কিন্তু বিশ্বাস করো আমিও সমান কষ্ট পাচ্ছি।
রুদ্র
অরূণীর কপোল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়া নোনাজলে চিঠির অর্ধেকাংশ ভিজে গেছে।কি করলো এটা রুদ্র?দুই বছর যোগাযোগ থাকবে না!অরূণী নিস্তেজ শরীর নিয়ে বারান্দায় ফ্লোরে বসে রইলো। অনুভূতিশূন্য দৃষ্টি। কিছু সময় পর কান্না আপনাআপনি থেমে গেল। তীব্র ক্ষোভে চিঠি’টা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিলো অরূণী। অরূণীর সান্ত্বনাতীত মন ডাঙায় তুলে রাখা মাছের মত তাড়পাতে লাগলো শুধু। মস্তিষ্ক’টা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কিছু ভাবতে পারছে না অরূণী।এমন’টা সম্ভব না,দুই বছর যোগাযোগ বিহীন থাকা কিছুতেই সম্ভব না।অরূণী তড়িৎ বেগে ছুটে রুমে গেল। বিছানার ওপর রাখা ফোন’টা হাতে নেয়।হন্তদন্ত হয়ে ডায়েল করে রুদ্রর নম্বরে। ফোন বন্ধ।অরূণী দিশেহারা হয়ে ভাবে রুদ্র এখন প্লেনে তাই হয়ত ফোন বন্ধ। কিন্তু তিন‌ দিন কেটে গেল রুদ্রর ফোন আর অন হয় না।
__________________
অরূণীর কাছে দিন-রাত এখন সব সমান।দরজা-জানালা বন্ধ করে বসে থাকে অন্ধকার চার দেয়ালে আবদ্ধ রুমে । বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায় অরূণী গোসল কিংবা খাওয়ার কথা ভুলে বসে থাকে।অরূণী সন্দিহান হয়ে সেলিনা আহমেদের কাছে প্রশ্ন করে, “আম্মা আমি কী পাগল হয়ে গেছি?”
মেয়ের এমত প্রশ্নে হকচকিয়ে ওঠে সেলিনা আহমেদ।চোখে-মুখে তীব্র ভয় তাঁর। সেলিনা আহমেদ ছুটে যায় সাহেদ আহমেদের কাছে। আহত গলায় বলে, “অরূণীর কি হয়েছে বুঝতে পারছি না।রুম থেকেই বের হচ্ছে না। ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্ট…”
ধমকে ওঠে সাহেদ আহমেদ। বিরক্ত মুখে বলে, “বুঝ-জ্ঞান আর হলো না তোমার।মেয়ের প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটেছে,মেয়ে কষ্ট পাবে না?রুদ্র শুয়োরের বাচ্চা!বস্তি একটা ফ্যামিলি।অরূণী’কে একা থাকতে দেও। ঘটনা আরো দূরে গড়াতে পারতো।এখানেই সমাপ্ত হয়েছে শোকরিয়া আদায় করো। ওঁর কষ্ট ও কাটিয়ে ওঠুক।”
সাহেদ আহমেদ থেমে বিড়বিড় করে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে লাগলো রুদ্র’কে। সাহেদ আহমেদের এই অস্ফুট স্বর সেলিনা আহমেদের কান পর্যন্ত পৌঁছে না।তবে সাহেদ আহমেদের মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝা যাচ্ছে ভয়ঙ্কর ভাবে রেগে আছে সে রুদ্রর ওপরে।
.
এতদিন খুশিতে অরূণীর গায়ে জ্বর আসতো।আজ জ্বর এসেছে কষ্টে।যে কষ্ট কাউকে বলতে পারছে না অরূণী।কষ্ট গুলো অরূণীর বুকের বাঁ পাশ’টা অবশ করে রেখেছে। রুদ্র ভালো আছে তো? প্রবাসে একাকী কেমন কাটছে রুদ্রর জীবন?অরূণী’কে মিস করছে না? মানুষ বদলায়!সময়ের সাথে সাথে মানুষের চাহিদা, ভালোবাসা,ভালোগালা বদলায়।এই দুই বছরে রুদ্র যদি বদলে যায়?জড়িয়ে যায় যদি অন্য কারো মায়ায়,অন্য কারো ভালোবাসায়? রুদ্র কী টের পাচ্ছে না অরূণীর মনের এই তোলপাড়?মাসে কিংবা সপ্তাহে একদিন কথা বললে কী হতো রুদ্রর? রুদ্র কী জানে না অরূণীর বাড়াবাড়ি পাগলামির কথা? বাড়াবাড়ি রকমের আবেগ, ভালোবাসা, অনূভুতির গল্প তো রুদ্র জানে।তবুও রুদ্র কেন এমন স্বার্থপরের মতো আচরণ করছে?অরূণীর এই কষ্টের কাছে সমস্ত যুক্তি পরাস্ত। ক্ষণে ক্ষণে তীব্র অভিমান জমতে লাগলো অরূণীর মনে। সেলিনা আহমেদ অরূণীর শয্যার পাশে বসে অরূণীর কপালে জলপট্টি দিচ্ছে।অরূণীর এই দুর্দশা দেখে ক্রমশ উতলা হয়ে ওঠছে সেলিনা আহমেদ। সূর্য আর সাহেদ আহমেদের মতবাদ, “সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যাবে সব।”
বেশ কয়েকদিন পর অরূণী রুদ্রর খোঁজে কিরণের নম্বরে ফোন দেয়। কিরণের ফোন নম্বর বন্ধ।অরূণী বেশ হতাশ হয়। রুদ্র যে মেসে থাকতো সে মেসে যায় অরূণীর। কলিং বেল বাজাতেই এক ভদ্রলোক দরজা খুলে দেয়।অরূণী মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো, “এই মেসে রুদ্র আকন নামে একজন থাকতো না?উনি তো এখন কনাডা চলে গেছে।উনার সাথে আপনাদের যোগাযোগ আছে?”
ভদ্রলোক বেশ আন্তরিকতার সহিত উত্তর দেয়, “না যোগাযোগ নেই।রুদ্রর ফোন নম্বর টাও বন্ধ।”
রুমের ভিতর থেকে আরেকজন আক্ষেপ করে বলে ওঠলো, “কত বড় ভাই,ছোট ভাই আসলো গেলো। কেউই মনে রাখলো না।”
অরূণী আর কিছু জিজ্ঞেস না করে বেড়িয়ে পড়ে।অরূণীর চালচলনে বেশ পরিবর্তন হয়েছে!প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। এমনকি প্রয়োজনীয় কথা বলতেও বিরুদ্ধ বোধ করে। চেহারায় গাম্ভীর্য ভাব পরিলক্ষিত হয়। সচরাচর হাসতেও দেখা যায় না। কিরণের ফোন নম্বর’টাও বা কেন বন্ধ?কিরণ যে বাসায় থাকতো অরূণী সে বাসা চিনে। সেখানে যাবে কি যাবে না সেই নিয়ে মিনিট পাঁচেক দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগলো।সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে শেষে কিরণের বাসায় গেল। গিয়ে জানতে পারলো কিরণ বেশ কিছু দিন আগে বাসা ছেড়েছে।অরূণী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here