দহন পর্ব ১৭

#দহন
#পর্ব_১৭
#লেখা_মিম

ভোর ৫.১০ বাজে। দূর থেকে আযানের আওয়াজ ভেসে আসছে। মুহিব সিঁড়ির পাশের জানালায় দাঁড়িয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। গতরাতে তার বাবা এসেছিলো হসপিটালে। তিনি চেয়েছিলেন ছেলের সাথে রাতটা হসপিটালেই কাটাবেন। মুহিব অনেকটা ধরে বেঁধেই তাকে গাড়িতে তুলে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। মাথায় তার এখন অনেককিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। নদীর বলা কথাগুলো বারবার মনে পড়ছে। একটা ভুল সিদ্ধান্ত… তিনটা জীবন জ্বলে পুড়ে শেষ হবে। সাথে করে পাশের মানুষগুলোও জ্বলবে। সত্যিই…. সিদ্ধান্তটা ছিলো জীবনে নেয়া সবচেয়ে জঘন্য একটি সিদ্ধান্ত। আচ্ছা অনিম এখন কি করছে? শিমুলের তো একটা খোঁজও নিলো না সে। নীলার বুকে মুখ গুঁজে বোধহয় শিমুলকে ভুলে গেছে। কিভাবে পারে মানুষ? শিমুলের ভাই মুকুলের ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো মুহিবের। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো সে।
-” আযান দিয়ে দিছে তো। নামাজ পড়বা না?”
-” হ্যা পড়বো।”
-” চলো।”
-” সৈকত আর নদী আপার হাজবেন্ড যাবে না?”
-” হ্যা ওরা বেরিয়ে গেছে। তুমি আমার সাথে চলো।”
হসপিটালে বৃষ্টি আর নদীকে রেখে মসজিদে গিয়েছে ওরা। কিছুক্ষন পর একজন নার্স এসে তাদের জানালো পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। আপনারা একটু ভেতরে আসুন। আপনাদের খুঁজছে সে। বৃষ্টি আর নদী কথাটা শুনে লাফিয়ে উঠলো। অবজারভেশন রুমে নার্স নিয়ে এসেছে তাদের। নদী আর বৃষ্টি দুজনই শিমুলের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। নদী শিমুলের মাথায় হাত রেখে বললো,
-” কেমন লাগছে এখন?”
-” আপা অনিম….. ও কোথায়?”
-” আছে কোথাও।”
-” একটু ডেকে দাওনা।”
-” এখানে নেই ও।”
-” তাহলে ফোন করে আসতে বলো।”
-” শিমুল, তুই চোখটা বন্ধ করে রাখ। এখন এত কথা বলিস না। শরীর আরো খারাপ লাগবে।”
-” লাগবে না আপা। তুমি ওকে আসতে বলো। ওকে কিছু বলার আছে আমার।”
নদী ভালোই টের পাচ্ছে এই মূহূর্তে হাজার বারন করলেও শিমুল মানবে না। তাকে এখন নদী ধমকও দিতে পারছে না। তাই সে আর কথা না বাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। বের হওয়ার সময় অবজারভেশন রুম থেকে একজন নার্স কেও সাথে করে নিয়ে এসেছে সে । বাইরে এসে সে নার্সকে বললো,
-” ওকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিন। যাতে ও একদম টানা ৮-৯ ঘন্টা ঘুমাবে।”
-” কি বলেন এগুলা? মাত্রই তো রোগীর জ্ঞান ফিরলো। গতরাতে উনাকে নিয়ে পরিমান চাপে যে আমরা সবাই ছিলাম তা আপনি আমাদের ওখানে থাকলে টের পেতেন। সার্জারি ডক্টর গত রাতে বাসায় যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনবার ফোন দিয়েছেন পেশেন্টের খবর নেয়ার জন্য। স্যার গতকাল রাতে ঠিকমতো ঘুমায়নি এই চিন্তায় যে রোগীর জ্ঞান ফিরবে কিনা। আর এখন যখন জ্ঞান ফিরেছে আপনি বলছেন উনাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে!”
-” এছাড়া কিচ্ছু করার নেই। ও ওর হাজবেন্ডকে খুঁজছে। এখন ওর হাজবেন্ডকে কোথায় পাবো আমি? ও চুপ করে থাকবেনা। যতক্ষন জ্ঞান থাকবে ততক্ষন এই এক গান গাইতেই থাকবে। এরচেয়ে ভালো ওকে ঘুম পাড়িয়ে রাখেন।”
-” আচ্ছা, আমি স্যারের সাথে কথা বলে দেখি।”
দশ মিনিট পর নার্স এসে জানালো শিমুলকে ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। তবে তিনঘন্টার জন্য। এখনই হাই ডোজ দিতে বারন করেছে ডাক্তার। পরবর্তীতে পেশেন্টের মানসিক, শারিরীক অবস্থা দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নামাজ পড়ে ফিরে এসেছে ওরা। তাদেরকে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দেখে বৃষ্টি বেশ উচ্ছলভাবে ওদের জানিয়েছে শিমুলের জ্ঞান ফেরার কথাটা। মুহিবের চোখে মুখে এতক্ষন যে বিষাদের ছায়া দেখা যাচ্ছিলো তা অনেকটাই কেটে গেছে। মনে হচ্ছে কিছুটা বোঝা বোধহয় ঘাড় থেকে নেমেছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে শিমুলকে একটা নজর দেখতে। কিন্তু মুখে আনার সাহসটা সে পাচ্ছে না। এত বছরের গোপন কথাটা তো শুধু নদী আপাই জানে। এখানে উপস্থিত আর তো কেউ জানে না। যদি মুহিবের এমন ইচ্ছায় কেউ কিছু মনে করে! নাহ্ যেভাবে আছে সেভাবেই ভালো। এতবছর ধরে তো এমন হাজারও ইচ্ছা সে মাটি চাপা দিয়ে আসছে। আজ নাহয় আরো একটা দিলো। নদী অবজারভেশন রুমে শিমুলের বলা কথাগুলো সবাইকে বলছে। শিমুলকে এখন ওরা কিভাবে সামাল দিবে সেই চিন্তাতেই দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। মুহিব ভাবছে অনিমকে জোর করে শিমুলের সংসার করাবে। এছাড়া আর কোনো অপশন নেই। শিমুল কিভাবেথাকবে অনিমকে ছাড়া? কোনোকিছু না ভেবেই হুট করে সে তার ভাবনার কথা সবার সামনে বলে দিলো। কথাটা শুনে মেজাজ বেশ খারাপ হচ্ছে নদীর। চোখে মুখে তীব্র বিরক্ত ভাব ফুটে উঠেছে তার।
-” কথা বলার আগে মেপে নেয়া উচিত কথাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত। অযৌক্তিক কথা বলে মাথা খারাপ করার কোনো মানে হয়না মুহিব।”
-” এছাড়া আর কোনো অপশন তো দেখছি না আপা। শিমুল কিভাবে বাঁচবে?”
-” অনিম যেভাবে বেঁচে আছে শিমুলকে ছাড়া তেমনি শিমুলও বাঁচবে। ওকে আমরা বাঁচতে শিখাবো। শিমুল দুনিয়াতে একা না। উপরে আল্লাহ আছে, মাটিতে আমরা আছি। শক্ত হয়ে কিভাবে বাঁচতে হয় সেটা শিখাবো। ভাগ্যকে মেনে নিয়ই আগাতে হবে ওকে। শোনো মুহিব, ধরে বেঁধে দুনিয়ার সব কাজ করনো গেলেও সংসার করানো যায় না। জোর করে ভালোবাসা যায় না। অনিমের সাথে সংসার করতে পাঠালে শিমুল আজীবন মিনমিনিয়ে চলাফেরা করবে ওর সাথে আর অনিম যা তা অাচরন করবে। কোনো দরকার নেই এসব করার।”
নদীর কথা শুনে সবাই কিছুটা ভরসা পাচ্ছে। চারঘন্টা পর শিমুলের ঘুম ভেঙেছে। কথা ছিলো তিনঘন্টা ঘুমুবে। কিন্তু সে আরও এক ঘন্টা বেশি ঘুমিয়েছে। হতে পারে শরীরের দুর্বলতার জন্য।অবজারভেশন রুম থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে ওকে কিছুক্ষন আগে। মুহিবকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় কাছে ডাকলো ওকে। মুহিব এগিয়ে এসে শিমুলের মাথার কাছে চেয়ার টেনে বসেছে।
-” মুহিব ভাই…..”
-” হুম……”
-” মনে আছে? বিয়ের পরদিন সকালে আপনি আমাদের ছবিতে কমেন্ট করেছিলেন কৌশলে টানতে জানলে সব সুতাই ছিড়ে যায়?”
-” হুম আছে।”
-” টান লেগে গেছে মুহিব ভাই। কৌশলের টান…..”

-” নীলা কৌশলে টান দিয়েছে মুহিব ভাই। পুরুষ মানুষ বশ করার কৌশল। জানেন মুহিব ভাই, আমাকে আপা অথবা ভাবীরা কখনো কৌশলে টান দিতে শিখায়নি। এই ব্যাপারে আমার কোনো ধারনাই নেই। সত্যিই নেই। বিয়ের দিন সন্ধ্যার পর ওরা বাসায় এসে বলেছিলো অনিম আর আমি কাছাকাছি কেনো নেই। দূরে কেনো আছি? ওরা বলেছিলো যা রোমান্স করার এখনই করে নে, বাচ্চা হওয়ার পর আর পারবিনা। ওরা আমাকে বলেনি সর্বক্ষন অনিমের সাথে আঠার মতো লেগে না থাকলে ও আমাকে ফেলে চলে যাবে। অন্য কেউ এসে আমাদের সুতায় টান দিবে। কৌশলের টান……। আচ্ছা মুহিব ভাই ওরা আমাকে এসব কেনো বলেনি? আমাকে তখন ওরা সতর্ক করে তো আমিও কৌশল গুলো শিখে নিতাম।”
শিমুলের কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলতে পারছে না মুহিব। ওর দু চোখে পানি ছলছল করছে। হালকা করে শিমুলের কপালে হাত রেখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে সে। বৃষ্টি অঝোরে কাঁদছে শিমুলের কথা গুলো শুনে। নদীর চোখের কোনেও সামান্য পানি চিকচিক করতে দেখা যাচ্ছে। শিমুল খুব শান্ত গলায় কথাগুলো বলেছে। শান্ত কন্ঠের পিছনে একরাশ কষ্ট, অভিমান অনুভব করতে পারছে উপস্থিত সবাই। কিছুক্ষন দম নিয়ে শিমুল আবার বলতে লাগলো।
-” নিজেকে কিভাবে ভালোবাসার মানুষের সামনে মেলে ধরতে হয় আমি কখনো শিখিনি মুহিব ভাই। কেউ আমাকে শিখায়নি। কেনো শিখায়নি কেউ আমাকে?”
-“……………………”
-” আমি তো ভাবতাম ও আর আমি একই। আমরা তো ভিন্ন না। ভেবেছিলাম ও আমাকে প্রতি ঘন্টায় ফোন করে, আমি আবার নতুন করে কি ফোন করবো? ভেবেছিলাম একজন ফোন দিলেই হয়। আমি কখনো চাইনি ওকে বন্দী করে রাখতে। সবসময় ওকে স্বাধীনতা দিতে চেয়েছি। আমার দুইভাই যখন বাসার বাহিরে থাকতো ভাবীরা কিছুক্ষন পরপরই ভাইদের ফোন দিতো। বারবার ফোন করে তাড়া দিতো, জলদি বাসায় আসো। প্রায়ই ভাবীরা ভাইয়াদের জোর করতো যেনো সবকাজ ফেলে আজকের দিনটা শুধুমাত্র তাদের সাথে কাটায়। ভাইয়াদেরকে দেখতাম খুব বিরক্ত হতো ভাবীদের এমন কথা বার্তায়। প্রায়ই বকাঝকা করতো। বন্ধুদের কাছে বসে ভাবীদের এসব অাচরন নিয়ে নালিশ করতো। তখন ভাবতাম আমি এমন হবো না। আমি চাইতাম অনিম আমাকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুক। কোনো ধরনের বিরক্তির কারন আমি ওর জন্য হতে চাইনি মুহিব ভাই। ওকে ভালো রাখতে চেয়েছিলাম আমি। কত বোকা ছিলাম আমি তাইনা? তখন আমি বুঝিনি আসলে ওগুলোই কৌশলের টান। স্বামীকে নিজের আয়ত্ত্বে রাখার কৌশল। পুরুষ মানুষ মুখে যতই বলুক এই ব্যাপারগুলো তাদের অসহ্য লাগে আসলে এটা মনের কথা না। মনে মনে তারা এই ব্যাপারগুলো ঠিকই পছন্দ করে। আমি বুঝিনি এই ব্যাপারগুলো মুহিব ভাই। কেউ আমাকে বুঝায়নি।”
-“…………………..।”
-” আহ্লাদ করে কথা কিভাবে বলে আমি কখনো শিখিনি। কেউই আমাকে শিখায়নি। অনিমও কখনো এতবছরে এসব ব্যাপারে নালিশ করেনি। ও যদি শুরুতে এসব বিষয়ে নালিশ করতো তাহলে আমি কখনোই নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখতাম না। ওর পছন্দ অনুযায়ী নিজেকে সাজাতাম। ওর সামনে যখন যেভাবে যেয়ে দাঁড়াতাম, যেভাবে কথা বলতাম সেভাবেই ও আমাকে আপন করে নিেছে, ভালোবেসেছে। কখনও ওর চোখে মুখে আমি অভিযোগের ছাপটুকু দেখতে পাইনি। আমি বুঝতে পারিনি ওর মনে এত অভিযোগের পাহাড় জমে আছে। অভিযোগ জমতে জমতে পাহাড়টা এত বড় হয়ে গিয়েছে যে ও আমাকে মূহূর্তে ওর জীবন থেকে সরিয়ে দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি। আচ্ছা অভিযোগ গুলো ও আগে কেনো করেনি? এত বছর পর এসে কেনো করলো? তাও আবার শেষ মূহূর্তে এসে। যে মূহূর্তে ও আমাকে ওর জীবন থেকে মুছে ফেলে দিয়েছে। যে মূহূর্তে আমাকে একটু শোধরানোর সময়টুকু দেয়নি। আমার ভুলগুলো যেহেতু দেখিয়েছে সেহেতু ও আমাকে একটা সুযোগ দিলে পারতো নিজেকে শোধরানোর। কিন্তু ও দেয়নি। মুহিব ভাই আপনি কি কাঁদছেন?”
মুহিব নিঃশব্দে কাঁদছিলো। ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে সে এতক্ষন যাবৎ। হাতটা এখনও শিমুলের কপালের উপর। শিমুলকে বলার মতো কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না সে। শিমুলের মুখে ” মুহিব ভাই আপনি কি কাঁদছেন ?” প্রশ্নটা শোনা মাত্রই ঝট করে গালের উপর লেগে থাকা চোখের পানিগুলো দ্রুত মুছে মুহিব নিচের দিকে তাকিয়েই উত্তর দিলো
-” নাহ্, কাঁদি না তো।”
-” অনিমের মতো আপনিও দেখি মনের কথা লুকাতে শুরু করেছেন। লুকিয়ে লাভ নেই। আমি দেখেছি আপনি কাঁদছেন। কাঁদবেন না মুহিব ভাই।”
-“…………………..”
-” মুহিব ভাই….”
-” হুম…..”
-” একটা কথা রাখবেন?”
-” বলো।”
-” অনিম তো আসবেনা আমার সামনে। ওকে কিছু কথা বলার ছিলো। ও তো আমার সাথে এখন ফোনেও কথা বলতে চাইবে না। তাই ভাবছি একটা চিঠি পাঠাবো ওকে। চিঠিটা আপনি দিয়ে আসবেন। পারবেন তো?”
-” হুম।”
-” আরেকটা কথা….. চিঠিটা আপনি লিখবেন। আমি বলবো আর আপনি লিখবেন।
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মুহিব উত্তর দিলো
-” ঠিকাছে লিখবো।”

চেয়ার ছেড়ে হসপিটালের নার্সদের কাছ থেকে একটা খাতা আর কলম ম্যানেজ করে নিয়ে এসেছে মুহিব। চিঠি লিখবে সে। অনিমের উদ্দেশ্যে। শিমুল বলবে আর সে লিখবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here