#দহন
#পর্ব_১৮
#লেখা_মিম
শিমুল বলতে শুরু করেছে। সে অনুযায়ী মুহিব কলম চালাচ্ছে।
প্রিয় অনিম,
আচ্ছা তোমাকে কি প্রিয় বলার অধিকারটুকু এখনো আমার আছে? বোধহয় নেই। কিন্তু কি করবো বলো? তুমি তো এখনও আমার প্রিয়। এত ভালোবাসার মানুষটাকে কি আর এমন হুট করে প্রিয় মানুষের লিস্ট থেকে সরিয়ে দেয়া যায়? সময় তো একটু লাগবেই। তারউপর তুমি আবার আমার পরম প্রিয় মানুষ। তোমার উপর থেকে টান টা সরাতে একটু তো সময় লাগবেই। জানি সময়ের তালে একটা সময় হয়তোবা টান টা কোথাও না কোথাও এসে কেটে যাবে। আবার নাও কাটতে পারে। অন্য কেউ হলে হয়তোবা তোমার প্রতি একরাশ ঘৃনা জন্মাতো। আমার ক্ষেত্রে এমনটা হবে বলে মনে হচ্ছে না। আদৌ কোনোদিন তোমার প্রতি ঘৃনা জন্মাবে বলে মনে হয়না। আমি কি এমন অপরাধ করেছিলাম যে আমার দোষগুলো শোধরানোর একটা সুযোগ তুমি আমাকে দিলে না? অপরাধ টা কি খুবই গুরুতর ছিলো? বোধহয় গুরুতরই ছিলো। তাইতো এমন ছুঁড়ে ফেলেছো। কতগুলো স্বপ্ন ছিলো আমাদের। পুরো চারবছর তিনমাস আঠারোদিনের স্বপ্ন। প্রতিদিন একটু একটু করে বোনা স্বপ্ন। কেমন মূহূর্তেই সব স্বপ্ন মন মস্তিষ্ক থেকে মিলিয়ে গেলো! ঠিক আমার মতো। আমি যেমন তোমার মন মস্তিষ্ক থেকে মিলিয়ে গেছি ঠিক তেমনি।কয়েকদিনের মাঝে কতটা দূরত্বে চলে এসেছি আমরা তাইনা অনিম? অনেকটা দূরত্ব…. যতটা দূরে আসলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও পাশের মানুষটাকে আপন করে নেয়া যায়না। ভালোবেসে তার দিকে তাকানো যায় না। তোমার মাঝে সর্বত্র বিচরন করার অধিকারটুকু শুধুমাত্র আমাকে দিয়েছিলে। অধিকারটা তুমি আজ আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে দিলে। অপরাধ টা কি খুব বড় ছিলো অনিম? আমাকে কি একটা সুযোগ দেয়া যেতো না? একটাবার মুখ ফুটে বলেই দেখতে শিমুল তোমাকে আমি আমার মনের মতো করে দেখতে চাই। তোমার খুশির জন্য সব করতে পারতাম আমি। সব…………। আমার সাথে কথা না বললে নাকি তোমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এমনটাই তো বলেছিলে তাই না? এখন কিভাবে তুমি নিঃশ্বাস নিবে অনিম? নাকি নিঃশ্বাস নেয়া ছাড়াই বাঁচতে শিখে গিয়েছো তুমি? আচ্ছা গতকাল তো তোমার বাসর রাত ছিলো তাই না? মাস দুয়েক আগেও তো তোমার বাসর রাত ছিলো। আমার সাথে বাসর সাজিয়েছিলে তুমি। তোমার বুকের বাম পাশটায় মাথা রেখে ঘুমিয়েছিলাম সেদিন। গতরাতে নীলা তোমার বুকের কোন পাশে ঘুমিয়েছে? বাম পাশে না ডান পাশে? অনুভুতি কেমন ছিলো? আমার বেলায় যেমন ছিলো তেমন নাকি এরচেয়ে আরো বেশি সুখের? আমার গিফট করা শার্ট, পান্জাবিগুলো কি তুমি পড়বে? নাকি ফেলে দিবে? বোধহয় পড়বে না। নীলা তো পছন্দ করবে না আমার দেয়া জিনিস তুমি গায়ে দিলে। বলেছিলে বিয়ের পর কখনো যদি রাত দুইটা তিনটা বাজে হুট করে বৃষ্টি নামে তাহলে আমাকে নিয়ে ছাদে যাবে বৃষ্টিতে ভিজতে। তুমি আর আমি হাত ধরে ছাদের এপাশ ওপাশ পায়চারি করবো। মাঝরাতে বৃষ্টি আসবে অনিম। তুমি বৃষ্টিতে হাত ধরে ছাদের এপাশ ওপাশ পায়চারী করবে। কিন্তু পাশের মানুষ টা আমি থাকবো না। থাকবে অন্য কেউ।চিংড়ি মাছের দোঁপেয়াজাটা তোমার খুব পছন্দের ছিলো। এই রান্নাটা খুব শখ করে শিখেছিলাম তোমার জন্য। তুমি প্রতিবারই খাবার শেষে বলতে শিমুলের মতো দোপেয়াঁজা কেউ রাঁধতেই পারেনা। নীলা কি আমার চেয়ে ভালো রাঁধতে জানে নাকি তোমার পছন্দের খাবারটাও বদলে গেছে? যে ভালোবাসার কথাগুলো আমাকে শোনাতে সেগুলো নীলাকে বলবে। গলায় এসে কাঁটার মতো বিধবে না কথাগুলো? তোমার সংসারে প্রতিটা জিনিসে আমার হাতের ছোঁয়া লেগে আছে। আমার সমস্ত স্পর্শগুলো ধীরে ধীরে নীলার হাতের স্পর্শে মুছে যাবে। তোমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে মুছে যাবে। আমার শরীরের যে জায়গাগুলোতে তুমি হাত দিয়েছো নীলারও সেই জায়গাগুলোতেই হাত দিচ্ছো।। তোমার হাত কাঁপে না অনিম? কি করে পারো তুমি? তোমাকে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার অধিকারটাও বোধহয় হারিয়ে ফেলেছি। জিজ্ঞেস করাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। আর বেশি কথা বাড়াবো না। কিছু কথা বলে চিঠিটার ইতি টানবো। সেই সাথে সম্পর্কেরও। ভালো থেকে অনিম। অনেক ভালো থেকে। নীলাকে নিয়ে ভালো থেকো, সুখে থেকো। তোমার সংসারে কানায় কানায় সুখ বিচরন করে বেড়াক। খুব শিঘ্রই তালাক্ব হয়ে যাবে আমাদের। খুব বেশি দেরী আমি করবো না। যত দ্রুত তালাক্ব হবে তত তোমার সংসারের জন্য মঙ্গল হবে। তোমার কাছ থেকে আমি কিছুই দাবী করবো না। যার সাথে সম্পর্কই থাকবে না তার উপর কিসের দাবী? আমার বাবার বাড়ি থেকে যে ফার্নিচারগুলো বিয়ের সম দিয়েছিলো সেগুলো ফেরত দিতে হবে না। সেগুলো তোমার কাছেই থাকুক। তোমার সংসারে কাজে লাগবে। তোমার সুখের সংসারে। দিন যাবে, মাস যাবে একটা সময় তুমি ভুলে যাবে শিমুল নামের কেউ ছিলো তোমার জীবনে। আমার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না তোমার জীবনে। তবুও আমি দোয়া করবো তোমার জন্য। হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে দোয়া করবো তোমার সুখের জন্য যে সুখ পাওয়ার আশায় তুমি আমাকে ছুঁড়ে ফেলেছো।। ভালো থেকো অনিম। সুখে থেকো। সুখের রাজ্যে যাতে আল্লাহ তোমাকে ডুবিয়ে দেয় সেই প্রার্থনা করবো। ।
ইতি
তোমার অপ্রিয় কেউ।
চিঠিটা লিখার সময় মুহিবের চোখের পানিতে কলমের কালি চিঠির কয়েক জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। মুকুল আর এসব সহ্য করতে পারছিলোনা। তাই সে বাইরে চলে গিয়েছে একটু মন খুলে কাঁদার জন্য। তার পিছন পিছন বৃষ্টিও গেছে। বাহিরে বসে দুজন দুনের হাত ধরে কাঁদছে। নদীর হাজবেন্ড মানুষটা অত্যন্ত নরম মনের। ভদ্রলোক ফুঁপিয়ে কাঁছেন নদীর হাত জড়িয়ে ধরে। নদী আর সৈকত দুজনই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কান্নাটাকে চেপে রেখেছে দুজন। বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটাকে শক্ত বানাতে তাদের। নিজের মতো করে বাঁচতে শিখাতে হবে। কান্নাকাটি করে বোনকে আরও দুর্বলবানাতে চায়না তারা।
-” মুহিব ভাই, চিঠিটা সযত্নে অনিমের হাতে তুলে দিয়ে আসবেন।”
-” হুম।”
-” এক্ষুনি দিয়ে আসেন।”
-” আরেকটু পর গেলে হয়না?”
-” না, হয়না। ওকে কথাগুলো বলার জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি। এক্ষুনি দিয়ে আসুন মুহিব ভাই।””
মুহিব দাঁড়িয়ে আছে অনিমের বাসার নিচে। শিমুলের কথামতো সে তখনই চলে এসেছে এখানকার উদ্দেশ্যে। অনিমকে ফোন দিয়েছে সে নিচে আসতে। দশ মিনিট হয়ে গেছে অনিমের আসার কোনো খবর নেই। কিছুক্ষন পর খানিকটা হেলে দুলে এসেছে সে মুহিবের সামনে। ওকে দেখামাত্রই চিঠিটা ওর দিকে এগিয়ে দিলো মুহিব।
-” এটা কি?”
-” চিঠি। শিমুল পাঠিয়েছে।”
-” ফোন থাকতে চিঠি কেনো?”
-” জানিনা। চিঠিটা পড়িস। মেয়েটার শেষ কথাগুলো এখানে আছে। চিঠির কথাগুলো হয়তো এখন অনুভব করতে পারবি না। অনুভব করতে পারবি আরো পরে। ততদিনে সময় শেষ হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ চিঠির শেষ কথাগুলো তোর জন্য কোনো দোয়া না, সেগুলো একেকটা অভিশাপ। শিমুলের অভিশাপ।”
দেড়মাস পর……….
সকাল থেকেই বেশ চিন্তিতো দেখাচ্ছে শিমুলকে। চিন্তাটা অনিমকে নিয়ে না। তার নিজেকে নিয়ে। হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ হওয়ার ২২ দিনের মাথায় তালাক্ব হয়েছে ওদের। তালাক্বের দিন পাশাপাশিই দাঁড়িয়ে ছিলো ওরা দুজন। শিমুল কয়েকবার তাকালেও অনিম একবারও শিমুলের দিকে তাকায়নি। ওর আচরনে মনে হয়েছিলো ২২ দিনের মধ্যে সে ভুলেই গেছে শিমুল নামে কেউএকজন তার জীবনে ছিলো।
ভালো আছে শিমুল। যতটুকু ভালো থাকলে বেঁচে থাকা যায় ততটুকু। প্রতিটা মূহূর্তে পরিবারের প্রতিটা সদস্য ওকে আগলে রাখছে। আর মুহিব ছেলেটা দুই একদিন পরপরই ওর খোঁজ নেয়। কখনো ফোন কলে কখনোবা মেসেন্জারে। ওদের কথোপকথনের স্থায়িত্ব। কখনো দশ সেকেন্ড হয় কখনোবা ত্রিশ মিনিট। সে মেন্টালি প্রচুর সাপোর্ট দিচ্ছে শিমুলকে। শিমুলের চোখে অনিমের জন্য আজকাল কেউ পানি দেখতে পায়না। শিমুল চায় না অনিমের জন্য ওর চোখ থেকে পানি ঝড়ুক। তবুও মাঝরাতে হুট করে বুকের ভেতর চিনচিন করে উঠে।নিজের অজান্তেই মাথার বালিশটা একটু একটু করে ভিজতে থাকে। অনিম আর এখন এই এলাকায় থাকেনা। মোটামুটি দূরে বাসা নিয়েছে ও। ভালোই আছে বোধহয়। ভালো তো তাকে থাকতেই হবে। শিমুলও খুব করে চায় সে নিজে ভালো থাকুক। অনিম নামে কেউ ছিলো তার জীবনে সে সেটা ভুলে যাক। কিন্তু চাইলেই কি আর সব সম্ভব? এতদিনের পরিচিত মানুষটাকে কিভাবে ভুলবে সে? তারউপর মনে করিয়ে দেয়ার জন্য তো আত্মীয় প্রতিবেশিরা আছেই। আজকাল শিমুলকে সবাই বেশ করুনার নজরে দেখে। পরিচিত লোকজনেরা ওর কাছে অনুভুতি জানতে চায় এ ব্যাপারে। অনিম নীলার সম্পর্কের কথা খুটিয়ে খুটিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে। শিমুল কখনো একটু আধটু উত্তর দেয়। কখনোবা দেয়না। লোকজনের এমন প্রশ্নে খুবই আপত্তি আছে শিমুলের ভাবীদের। বহুবার বহু লোকের সাথে কথা কাটাকাটিও হয়েছে তাদের। ভাবীদের সাথে পাড়া প্রতিবেশির কথা কাটাকাটি শেষে বেশ ক্ষীন গলায় শিমুল তাদের বলে
-‘ ঝগড়া করে কতজনের মুখ আটকে রাখবে তোমরা? মানুষ কৌতুহলি প্রানী। জানার জন্য জিজ্ঞেস করবে এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া আমার ডিভোর্সটা তো খুবই আনকমন ধাঁচের। চারবছর প্রেমের পর বিয়ের দুই আড়াই মাসই পরই ডিভোর্স। কতজনের কপালে এমন লেখা থাকে বলো?”
লোকজনের এ ধরনের প্রশ্নগুলো শিমুলের কাছে কাঁটা ঘায়ে নূনের ছিটা মনে হয়। প্রতি মূহূর্তে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় ব্যাপারগুলো ওকে। তবুও সে ভালো আছে। যতটুকু ভালো থাকলে বেঁচে থাকা যায় ততটুকু।
শিমুল ভাবছে সে দেশের বাহিরে চলে যাবে। নিজের মতো করে বাঁচতে শিখবে, পায়ে নিচের মাটি টাকে শক্ত করতে হবে। পড়াশোনাটা ওখানেই শেষ করবে। এখানে থাকতে চায় না সে। এখানে থেকে অনিমকে ভোলা সম্ভব না। কোনোভাবেই না। আশপাশের মানুষ আর অনিমের স্মৃতিগুলো ভুলতে দিবেনা ওকে। প্রতি মূহূর্তে মনে করিয়ে দিবে ওকে। বুদ্ধিটা গতরাত তিনটা বাজে তার মাথায় এসেছে। সেই থেকে ভেবেই চলছে সে। হিসেব একদিকে মিলছে তো অন্যদিকে মিলছে না। রাত পেরিয়ে, সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেছে। বেলা পৌনে দুইটায় এসে অবশেষে সব হিসেব মিলিয়ে ফেলেছে শিমুল। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেছে তার। দেশের বাইরে চলে যাবে সে। যত দ্রুত সম্ভব। কিন্তু কথা হচ্ছে ঘরের লোকজন কিভাবে রিয়েক্ট করবে? ঘরের লোকগুলো বরাবরই তাকে সাত বছরের ছোট মেয়ের মতো আগলে রাখে। অনিমও তো তাকে ছোট বাচ্চার মতোই আগলে রাখতো। দুনিয়ার কঠিন বাস্তবতা অনিমের সাথে বিয়ে হওয়ার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারেনি সে। বহু যত্নে শিমুলকে বড় করেছে তার পরিবার। আজ এত বড় হয়ে যাওয়ার পরও তার যত্নে এতটুকু অবহেলা করেনা ঘরের লোকগুলো। যে মেয়েকে সবাই এভাবে আগলে রাখে তাকে কি করে একা বিদেশ পাঠাতে সায় দিবে ওরা? এই প্রস্তাব রাখা মাত্রই ঘরে লঙ্কা কান্ড ঘটে যাবে। নাহ্ এতকিছু ভাবলে হবে না। ঘরের লোকজন যেভাবে খুশি রিয়েক্ট করুক কোনো লাভ হবে না। সে বিদেশ যাবেই। মেরুদন্ড সোজা করে বাঁচতে হবে তাকে। এখানে থেকে সেটা সম্ভব না। ভাবছে সর্বপ্রথম তার বাবাকেই সে এই ইচ্ছাটার কথা বলবে। ঘরের অভিভাবক এখনও বাবা, তাই বাবাকেই কথাটা বলা উচিত। মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে শিমুল বাবার সামনে যাওয়ার।
ভালো আছে অনিম। খুব সুখে আছে। যতটুকু সুখে থাকলে দুনিয়াদারীর আর কোনো খবর থাকে না ততটুকু। নীলা তার মনের সমস্ত খোড়াক পূরন করছে। তার চার বছরের তৃষ্ঞা মেটাচ্ছে। অনিম নীলাকে ফোন করে দুই ঘন্টা পরপর আর নীলা করে প্রতি ঘন্টায়। ঘন্টা তিন চারেকের জন্য অনিম ঘরের বাইরে থাকলে ফোনের পর ফোন করতেই থাকে নীলা। তার ভাষ্যমতে অনিমকে কিছুক্ষন না দেখলেই মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে যায় তার। ঘন্টা চার পাঁচেক পর যখন অনিম বাহির থেকে ঘরে ফিরে , বাসার মেইন ডোরটা খুলেই অনিমকে শক্ত করে জাপটে ধরে রাখে নীলা। বেশ অভিমানি গলায় তাকে বলতে শোনা যায়,
-” এতক্ষন কই ছিলা তুমি? হুমম? জানো না তোমাকে বেশিক্ষন চোখের সামনে না পেলে মাথা খারাপ হয়ে যায় আমার?”
নীলার এমন আহ্লাদী অভিযোগ শুনে অনিম আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নীলাকে। চার দেয়ালের মাঝে তাদের ভালোবাসাটা চরমে যেয়ে পৌঁছেছে। কোনো কমতি নেই ভালোবাসার এই ঘরটাতে। কোনায় কোনায় ভালোবাসা ছেয়ে আছে এই ঘরে। আজকাল অনিমকে বন্ধুমহলে দেখা যায়না। মুহিবের সাথে তো সেদিনের পর আর যোগাযোগই হয়নি। চিঠিটা আদৌ অনিম পড়েছিলো কি না সে খবর মুহিবের জানা নেই। জানার ইচ্ছাও নেই তার। বন্ধুমহলের অনেকেই আজকাল অনিমকে ঘৃনা করতে শুরু করেছে। কিন্তু তাতে অনিমের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। থাকবেই বা কি করে? যার ঘরে এত সুখ তার আবার বাহিরের লোকের ঘৃনায় কিছু আসে যায় নাকি?
আসরের নামাজ পড়ে নিজ রুমের বারান্দায় এসে বসেছেন শিমুলের বাবা রফিক সাহেব। বড় বউ চা নিয়ে আসবে কিছুক্ষন পর সেই অপেক্ষাতেই বসে আছেন। এদিকে শিমুল বাবার রুমে ঢুকবে কি ঢুকবে না সেই চিন্তাতেই রুমের বাইরে পায়চারী করছে। চোখে মুখে একরাশ স্পষ্ট চিন্তার ছাপ দেখা যাচ্ছে তার। আফসানা চা নিয়ে শ্বশুরের রুমে ঢুকার সময় শিমুলকে লক্ষ্য করলো।
-” কি রে? কি সমস্যা?”
-” কই সমস্যা?”
-” এভাবে কিছুক্ষন পরপর রুমে উঁকি দিচ্ছিস কেনো? কিছু বলতে চাস বাবাকে?”
-” তুমি কিভাবে বুঝলে?”
-” তোর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। চল ভেতরে। কথা পেটে চেপে না রেখে বলে ফেল বাবাকে।”
ভাবীর পিছন পিছন শিমুল বাবার কাছে গেলো। শ্বশুড়কে চা দিয়ে খানিকটা সরে দাঁড়িয়ে শিমুলকে ইশারা দিলো বাবাকে যা বলার বলতে। ওড়না আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বাবাকে বলতে লাগলো,
-” আব্বু একটা কথা…..”
-” কি কথা রে মা?”
-” আব্বু আমি এই দেশে আর থাকবো না।বিদেশে চলে যাবো। আর এটাই আমার শেষ সিদ্ধান্ত। আপনারা আপত্তি করবেন জানি। কিন্তু আমি এক চুলও নড়বো না এই সিদ্ধান্ত থেকে।”
বেশ দৃড় গলায় রফিক সাহেব এবং আফসানাকে কথাগুলো জানিয়ে দিলো শিমুল। দুজনই বেশ চমকে গেলো শিমুলের এমন প্রস্তাবে। তারা দুজন ভাবতেই পারেনি এই মেয়েটা হুট করে এমন এক কথা বলে বসবে যেটা কোনোভাবেই সম্ভব না। তাদের দুজনের কাছে এই মূহূর্তে মনে হচ্ছে শিমুল পাগল হয়ে গেছে। তাই সে এমন উল্টা পাল্টা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিছুক্ষন চুপ করে ভ্রু কুঁচকে শিমুলের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মুখ খুললো আফসানা।
-” কি উল্টা পাল্টা কথা বলিস এগুলা?”
-” দেখ মা আমি বুঝি তোর সাথে যাহয়েছে সেটা খুব অন্যায় হয়েছে। তোর খুব কষ্ট হচ্ছে এটাও আমি জানি। তাই বলে তো এভাবে নিজের ঘর পরিবার ছেড়ে বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারিস না।”
– ” আব্বু আমার কথাটা একটু ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করার চেষ্টা করেন।”
-” বাবা কি শুনবে তোর কথা? কোনো উল্টা পাল্টা কথা বলবি না বাবাকে তুই।”
-” ভাবী আমার কথা তো আগে শুনো।”
-” যা খুশি বল। সব শুনবো। কিন্তু তোর এসব উল্টাপাল্টা আবদার আমি শুনবো না।”
কথাটা বলেই আফসানা একরাশ বিরক্তি নিয়ে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিলো। এবার শিমুল আরো জোর গলায় সাফ জানিয়ে দিলো,
-” যে যা খুশি বলতে পারো। আমি কারো কথাই শুনবো না। আমি চলে যাবো। এটাই ফাইনাল।”
কথাটা শুনে কিছুক্ষন থমকে দাঁড়িয়ে রইলো আফসানা। শিমুলের গলার আওয়াজ পেয়ে বৃষ্টিও চলে এসেছে রুমে। রুমের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলো সে। শিমুলকে খুব জোরে কিছু বলতে শুনেছে সে। কিন্তু কি বলেছে সেটা পুরোপুরি বুঝেনি। রুমে ঢুকে পরিস্থিতি বুঝার জন্য কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো সে। কারো মুখেই এখন কোনো কথা শোনা যাচ্ছে না। শিমুল তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। রফিক সাহেব তাকিয়ে আছে আফসানার দিকে। আফসানা তাকিয়ে আছে শিমুলের দিকে। বৃষ্টি সবার দিকে চোখ ঘুরিয়ে যা বুঝলো তা হচ্ছে এখানে মোটামোটি ধরনের একটা ঝড় চলছে। ঝড়টা কি নিয়ে উঠেছে সেটা জানার জন্য আফসানাকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো বৃষ্টি
-” কি হয়েছে ভাবী?”
-” শিমুলের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”
-” বুঝলাম না।”
-” এই মেয়ে বলছে বিদেশ চলে যাবে। এইটুকু মেয়ে বিদেশ যাবে কিভাবে? ওকে আমরা আজ পর্যন্ত বাসার গলির মাথাতেই একা যেতে দেইনি। আর ও বলছে ওকে বিদেশ পাঠাবো আমরা?”
-” কি রে শিমুল? সত্যিই কি পাগল হয়ে গেলি নাকি?”
-” যা খুশি বুঝতে পারো….”
-” মানে কি এসবের? অনিমের সাথে রাগ করে তুই আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কেনো নিচ্ছিস?”
-” আমার কারো উপর রাগ নেই ভাবী। আমি আমার খুশির জন্য চলে যেতে চাচ্ছি। আমি একা থাকতে চাই, নিজের মতো করে বাঁচতে চাই।”
-” আমরাও চাই তুই সুখে থাক, খুশি থাক। তাই বলে আমাদের ফেলে খুশি থাকতে চাচ্ছিস তুই? তোকে একা বিদেশ পাঠালে ঘরের প্রত্যেকটা মানুষের রাতের ঘুম উড়ে যাবে চিরতরে। তোকে আমরা জীবনেও দূরে কোথাও একা যেতে দিয়েছি?”
-” দাওনি, এখন দিবা। দিতে হবে। আর কত জনম এভাবে আগলে রাখবে আমাকে?”
-” যতদিন বেঁচে আছি ততদিন।”
-” যখন মরে যাবা তখন কে আগলে রাখবে আমাকে?”
-” আল্লাহ দেখে রাখবে তোকে।”
-” একা বিদেশ গেলে তখনও আল্লাহই আমাকে দেখে রাখবে।”
-” এটা কোনো যুক্তি হলো না।”
-” এটাই যুক্তি। আব্বু আমি বিদেশ যাবোই। প্লিজ আমাকে না করবেন না। না করে কোনো লাভও হবেনা।”
রফিক সাহেব কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে আফসানাকে বললেন,
-” শোনো, আফসানা, নদীকে ফোন দিয়ে জামাই সহ আসতে বলো তো একটু। এটার সমাধান সেই এসে দিয়ে যাক। আমার মেয়ের মতিগতি কিছুই মাথায় ঢুকছে না। ”
আফসানা এক মূহূর্ত দেরী না করে নিজের রুমে চলে এলো নদীকে ফোন দিতে। রিং হচ্ছে নদীর নাম্বারে। তিনবার রিং বাজার পর রিসিভ করলো নদী।
-” হ্যালো….
– -” আপা, তুমি কি ব্যস্ত আছো?”
-‘ হ্যা। তোর দুলাভাই অফিস থেকে এসেছে। নাস্তা দিচ্ছি তাকে।”
-” দুলাভাইকে নাস্তা দিতে হবেনা। এখনই দুলাভাইকে নিয়ে বাসায় আসো।”
-” কেনো? কি হয়েছে?”
-” আরে আপা অনেক কথা। বাসায় আসো শিগগির।”
আফসানার গলার স্বরে নদী বুঝতে পারলো বড়সর কিছু হয়েছে। তাই বিশ মিনিটের মধ্যে স্বামীকে নিয়ে রওয়ানা হলো বাবার বাড়ির দিকে।
(চলবে)