#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -১৬
খুব সাবধানে গোধূলির হাতটা দীপ্ত ওর বুকের সাথে আলতো করে চেপে ধরে।গোধূলির ফ্যাকাসে মুখপানে অশ্রু ভরা নয়নে তাকিয়ে আছে দীপ্ত।ওর মনে হাজারো প্রশ্নের ঝড় উঠে গেছে।
– গোধূলি যদি আমার মুখ আর দেখতে না চায়? আমাকে যদি আর সহ্য করতে না পারে?আমার কাছ থেকে যদি দূরে সরে যায়?তখন আমি কি করবো?
নিজে নিজে বিড়বিড় করে কথা গুলো বলছিল দীপ্ত।গোধূলির হাতটা দীপ্ত সামান্য উঁচু করে রাখায় গোধূলি ঘুমের মধ্যে হাতটা হালকা টান দেয়।ফলে দীপ্ত বেডের দিকে একটু এগিয়ে বসে।গোধূলি ঘুমের ঘোরেই বার বার হাতটা টানছে তবে সময় ব্যবধানে।গোধূলির কান্ডে দীপ্ত শব্দহীন হেঁসে উঠে।অতীতের কথা মনে পড়ে যায়।
ফ্ল্যাশব্যাক _____
– সাজি এই নে তোর আইসক্রিম আর চকলেট।
– বড়দাভাই তুমি এতো ভালো কেন?
গোধূলি আহানের গলা জড়িয়ে কথা বলল।
– আমি যদি ভালো না হতাম তাহলে কি বেশি ভালো হতো?
– একদম না।তুমি আমার কাছে পৃথিবীর বেস্ট ভাই!তুমি অলওয়েজ এরকমই থাকবে ঠিক আছে!
আহানও বোনকে জড়িয়ে ধরে মাথায় একটা চুমো দিয়ে বলে,
– ওকে মাই ডেয়ার লিটিল সিস্টার।যা এখন গিয়ে অংক করতে বস।একটু পর আমি এসে তোর অংক গুলো দেখবো ঠিক আছে।
– ওকে।
দুই ভাই বোনের আলাপন আড়াল থেকে শুনছিল দীপ্ত।যদিও ইচ্ছাকৃত নয়।গোধূলির সব ভাইবোনদের রুমগুলো পাশাপাশি।দীপ্ত যেহেতু আহান এর সাথে থাকে তাই ওই রুমের উদ্দেশ্যেই যাচ্ছিল।গোধূলির রুম ডিঙ্গিয়ে আহানের রুমে যেতে হয়।তাই দীপ্ত যখন আহানের রুমে যাচ্ছিল তখনই ওদের আলাপ শুনতে পেয়ে থেমে যায়।গোধূলি টেবিলে বসে মনের সুখে এক হাত দিয়ে চকলেট খাচ্ছিলো আর অন্য হাত খাতায়!সে অংক করছিল।তাও আবার যে সে অংক না এক্কেবারে পাটিগণিত। যা গোধূলির মাথায় একদম ঢুকে না।আহান বলেছে যেটা বেশি কঠিন লাগবে সেটাই বেশি বেশি করে করবি।তার জন্যই গোধূলির এই প্রচেষ্টা।
– আমাকে পদে পদে হেনস্তা করা না!দাঁড়া আমি তোকে এমন হেনস্তা করে ছাড়বো যে আমার পিছনে আর লাগতে আসবি না।
কথাগুলো ভেবেই দীপ্ত গোধূলির রুমে গিয়েই ছুঁ মেরে গোধূলির হাত থেকে চকলেটটা নিয়ে খেতে শুরু করে দেয়।
– ছোটদাভাই তুই আবার আমার চকলেট নিয়েছি….
দীপ্তকে দেখে গোধূলি পুরো কথা শেষ করতে পারলো না।চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে দীপ্তের দিকে।যে ছেলে আসার পর থেকে ওর সাথে একবারও কথা বলে নি।এখন সোজা ওর রুমে ঢুকে পড়েছে?
গোধূলি নিচ দিকে তাকিয়ে মনোযোগসহকারে খাতায় অংক খসছিল।হাত থেকে চকলেট নিয়ে নেওয়ার ও ভেবেছিল হয়তো ইহান নিয়েছে।কারণ ওকে জ্বালানোর জন্য ইহান প্রায়ই এমন করে থাকে।এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কত্ত টম এন্ড জেরির ফাইট হয়েছে!শক্ত গলায় বললো,
– দীপ্ত ভাইয়া তুমি আমার চকলেটটা নিয়ে নিলে কেন?
বেশ খানিকটা ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
– আর শুধু নিয়েই ক্ষান্ত হও নি এক্কেবারে খেয়ে ফেলছো।
– গোধূলি এই চকলেটটা এত মিষ্টি কেন রে?
দীপ্তের কথায় গোধূলি বেশ বিরক্ত হয়ে বলে,
– চকলেট কোনো দিন তেঁতো হতে শুনেছো?
দীপ্ত চোখ রাঙিয়ে বলে,
– একদম ত্যাঁড়াত্যাঁড়া উত্তর দিবি না।যা জিজ্ঞাস করলাম শুধু তার উত্তর দে।
– এমনি!
দাঁত চেপে উত্তর দেয় গোধূলি।
দীপ্ত কপাল কুচকে তাকায় গোধূলির দিকে।বললো,
– এমনি!এমনি কি?এমনি আবার কোন ধরনের উত্তর?ভালো ভাবে যৌক্তিক বিশ্লেষণ দিয়ে বল।
– রাগে আমার সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে।একে তো আমার চকলেট খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে আবার যৌক্তিক বিশ্লেষণও চাইছে যত্তসব উটকো ঝামেলা!এই এলিয়েন কি জানে না নাকি চকলেট কেন মিষ্টি হয়!
– কি হলো?কি বিড়বিড় করছিস?
দীপ্ত গোধূলির দিকে সন্দিহান চোখে তাকিয়ে থেকে বলে।
– এইরে শুনে ফেললো নাকি?
মনে মনে বলল গোধূলি।পর পরেই গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
– না ভাইয়া আসলে…
গোধূলি বলতে না দিয়ে দীপ্ত রেগে গিয়ে বলে,
– তুই কি বলবি নাকি বাকি চকলেট গুলা খেয়ে আমি নিজেই উত্তর টা খুঁজে নেবো?
দীপ্ত হাত বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে বাকি চকলেট গুলো ধরতে নিলেই গোধূলি চিৎকার করে উঠে।
– না!আমি বলছি!
– তাহলে বল!এত সময় নিচ্ছিস কেন?
গোধূলি একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে কিছু একটা ভেবে বলতে শুরু করে,
– আসলে ভাইয়া আমার মনে হয়, চকলেট মিষ্টি হয় কারণ চকলেটে মিষ্টি জাতীয় উপাদান যেমন চিনি,গুড়,মধু ইত্যাদি দেওয়াতে।আর যে ফ্যাক্টরিতে চকলেট তৈরি করা হয় সেখানকার লোকেরাও অনেক ভালো হয়।আমাদের মতো ছোট ছোট বাচ্চাদের কথা চিন্তা করে তা চকলেট গুলো তৈরি করে।তাই চকলেট তৈরি করার সময় মিষ্টি বেশি দেয় কারণ বাচ্চারা তো ঝাল খেতে পারে না।যদি ঝাল বেশি হয় তাহলে বাচ্চারা চকলেট কিনবে না আর খাবেও না।আর বাচ্চারা যদি চকলেট না কিনে তাহলে তাদের অনেক টাকার ক্ষতি হবে।তাই তারা চকলেটে মিষ্টি বেশি দেয় যাতে বেশি বেশি বিক্রি হয় আর তাদের লাভ হয়।
গোধূলির কথা শুনে দীপ্তের মাথা বনবন করছে!দীপ্ত এতক্ষণ গালে হাত দিয়ে ‘”চকলেট কেন এত মিষ্টি”‘? এই প্রশ্নের যৌক্তিক বিশ্লেষণ শুনছিল!
– বাহ বাহ গোধূলি কি সুন্দর বিশ্লেষণ দিলি রে তুই?
দীপ্ত গোধূলিকে বাহবা দিচ্ছে হাতে তালি দিয়ে।
কিন্তু মনে মনে বলে,
– আর কিচ্ছুক্ষণ থাকলে এই মেয়ে আমাকে ওই চকলেট ফ্যাক্টরির দারোয়ান বানিয়ে দেবে!আমি এখান থেকে বেড়োতে পারলে বাঁচি!
দীপ্ত একটা হাই তুলে বলে,
– তোর কথা শুনতে শুনতে আমার একেবারে ঘুম পেয়ে গেছে।আমি ঘুমাতে গেলাম!এই অবেলায় এত ঘুম পাচ্ছে কেন কে জানে!ও হে ভুলেই গেছিলাম তোর চকলেট ফ্যাক্টরির গল্প শুনে!লাভ ক্ষতির হিসাব করতে তো ভালোই শিখেছিস।
দীপ্ত কোনোমতে নিজের অট্টহাসি সংবরণ করে বলে,
– চিন্তা করিস না এই এই বছর তুই পাটিগণিতেই বেশি মার্ক পাবি দেখে নিস।
দীপ্ত চলে যেতেই গোধূলি এক লাফে বিছানায় উঠে লুঙ্গি ডান্স দেওয়া শুরু করে দিয়েছে।নাচানাচি শেষ করে একটু শান্ত হয়ে বিছানা মাঝখানে বসে একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,
– কি দীপ্ত এলিয়েন!কেমন বিশ্লেষণ দিলাম হে?আমাকে বেকায়দায় ফেলা!আমি বেশ বুঝতে পেরেছি তুমি..
গোধূলি আরো কিছু বলার আগেই আহান রুমে ঢুকে পড়ে।আহান অবাক হয়ে বললো,
– গোধূলি তুই বিছানায় বসে কি করছিস?অংক করা শেষ?
গোধূলি মুখ ফুলিয়ে বলে,
– না!করছিলাম তো!জানো বড়দাভাই তারপর কি হয়েছে?
– না বললে কিভাবে জানবো?
গোধূলি আহানের হাত ধরে টেনে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে বলে,
– তুমি এখানে বসো তো আগে তারপর বলছি।
দীপ্তের সাথে কি করছে সবটাই গোধূলি আহানকে বলল।গোধূলির কথা শুনে আহানের মাথায় হাত।আহানের রুমে গিয়ে দীপ্তের মনে পরলো ও কেন গোধূলির রুমে গিয়েছিল।চকলেটের চক্কেরে পড়ে তা বেমালুম ভুলে গেছে।তাই আবার গোধূলির রুমে যাবে বলে আসছিল তখন দরজার কাছ থেকে আহানকে বলা গোধূলির সব কথা শুনে নেয় দীপ্ত!এই মুহূর্তে দীপ্তের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তবে নিজের উপর!
– বার বার ওই মেয়েটা আমাকে গোল খাওয়াচ্ছে?যতটা বোকা ভেবেছিলাম ততটাও বোকা না দেখছি।তখন তো আমি ওর কথাগুলো সত্যিই ভেবেছিলাম! আমি মনে করেছিলাম এটা হয়তো ওর ধারণা থেকেই বলেছে!নেহাতি এখনো অনেক ছোট!কিন্তু না এ তো দেখছি ধানি লঙ্কা!
#পর্ব-১৭
– যা বলেছিস,বলেছিস আর কারো কাছে বলতে যাস না।
– কেন দাভাই বললে কি হবে?
– দীপ্ত খুব রেগে যাবে!
– রেগে যাক তাতে আমার কি!আমার চকলেট কেন খেলো?
– বেশ করেছি খেয়েছি।
দীপ্তের গলা শুনে আহান আর গোধূলি দুজনেই চমকে উঠে দরজার দিকে তাকায়।গোধূলির এবার ভিষণ রাগ হচ্ছে।
– দেখেছো দাভাই?একে তো আমার চকলেট খেয়ে নিয়েছে আবার গলাবাজিও করছে!
– আহ সাজি!তুই একটু চুপ কর!
আহান একটু গলা ঝেড়ে বলে,
– আরে দীপ্ত তুই এখানে?
– বাআ রে আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে আর আমি থাকবো না?সেটা একটু কেমন দেখায় না?
– তোকে নিয়ে কথা হচ্ছে মানে?
– উম আহান ভাই আমার দিস ইজ নট ফেয়ার!আমার সাথে চালাকি করা চলবে না হে!আর গোধূলি তুই কি বলছিলি আমি তোর চকলেট খেয়ে নিয়েছি?আমি তো তোর চকলেট খাই নি।আমি আমার ভাগেরটা খেয়েছি!
গোধূলি অবাক হয়ে বললো,
– তোমার ভাগেরটা মানে?
– বুঝলি না তো?দাঁড়া আগে তো বসি তারপর না হয় তোকে এক্সপ্ল্যাইন করছি!ওই দোলনাটা কার রে?
– আমার ঘরে যেহেতু তো আমারই হবে।
কর্কশভাবে বললো গোধূলি।
– দেখেছিস আহান তোর এই বোন কেমন ঘাড়ত্যাড়া?সোজা কথা সোজাসাপ্টাভাবে বলবে না!ও যেমন উত্তরটাও তেমনি দেবে!
– তুইও তো দীপ্ত!ওর ঘর যেহেতু ওরই হবে এটা আবার জিজ্ঞাস করার কি আছে?
দীপ্ত গম্ভীরমুখে বলে,
– আহান বোনের সাইড নিচ্ছিস?
– বোনের সাইড নিবে না তো কি তোমার মতো একটা এলিয়েনের সাইড নিবে?
– কি বললি তুই?আমি এলিয়েন?
– তা নয় তো কি!নিজের চেহেরাটা কোনো দিন ভালো করে আয়নায় দেখেছো?মনে তো হয় না!দেখে থাকলে তো আর আমাকে জিজ্ঞাস করতে না!
– আহান তোর বোনকে চুপ করতে বল নইলে কিন্তু আমার হাতে মার খেয়ে যাবে বলে দিলাম!
গোধূলির কথা শুনে আহান ঠোঁট টিপে হাসছিল!দীপ্তের কথায় গলা ঝেড়ে বলে,
– আহ সাজি তুই একটু চুপ কর না!এইভাবে বলতে নেই। ভাইয়া হয় না তোর!
– ভাইয়া?আমার এতো ভাইয়ের দরকার নাই!তুমি আছ ছোটদাভাই আছে আলিফ-আলবী আছে!
আর কোনো ভাইয়ের দরকার নাই আমার হু।
মুখ মুচড়ে কথাটা বলল গোধূলি!
– তোর মতো বাচাল মেয়ের ভাই হতে আমার বয়েই গেছে।যাইহোক,আসল কথায় আসি!
“আমার ভাগ মানে “এইটাই তো তোরা দুই ভাইবোন বুঝতে পারছিলি না?তাহলে শুন,স্পেশালি গোধূলি তোর উদ্দেশ্য বলা,সকালে তুই আমাকে নানা কথা বলেছিস!আমি নানাজানকে ঠকাচ্ছি,আমি বিশ্বাসঘাতক,নানাজানের প্রতি অন্যায় করছি, মিথ্যাবাদী আরো কত কি।কিন্তু আমি তো দেখছি ঘরের শত্রু বিভীষণ!
গোধূলি বোকার মতো দীপ্তের দিকে তাকাতেই বলে,
– মানেটা বুঝলি না তো?মানেটা হলো গোধূলি তুই!
তুই নানাজানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস!আমাকে যখন তুই দেখেই নিয়েছিলি তাহলে নানাজানকে বললি না কেন?কারণ তোকে আইসক্রিম আর চকলেট দেবে বলে।তুই ঘুষ নিয়েছিস!এখন তুই চিন্তা কর আসল বিশ্বাসঘাতক কে? আমি না তুই?
তুই।কারণ তুই সত্যিটা জেনেও নানাজানকে বলিস নি!শুধু মাত্র কয়েকটা চকলেট আর আইসক্রিম এর লোভে?তোর চকলেট খেয়েছি কারণ,তুই যে নানাজানের সাথে অন্যায় করেছিস সেটা নানাজানকে না বলার প্রতিদান হিসেবে আমি তোর থেকে চকলেট নিয়ে খেয়েছি!বেশি বেশি বকবকানি করলে নানাজানকে সব বলে দিবো।
– যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর! এই প্রবাদটিকে মনে করিয়ে দিলো না দাভাই?কোথায় আমাকে থ্যাংক্স দিবে তা না উল্টে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে আসছে!যাও বলে দাও গিয়ে!দাদাজান তোমার কথা বিশ্বাসই করবে না।নিজে দোষ করে এখন এসেছে শাঁক দিয়ে মাছ ঢাকতে!
গোধূলি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল।দীপ্ত রুদ্ধ গলায় বলে,
– এই মেয়ে এই,তুই ননস্টপ এত বকবক করিস কিভাবে রে?মুখ ব্যাথা করে না?আমরা তো এত কথা বলি না!
– এলিয়েনরা কি কোনো ভাষা জানে যে কথা বলবে!
– আহান!
দীপ্ত বেশ চিল্লিয়ে ডাক দেয় আহানকে।আহান দীপ্তের চিৎকারে ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে বলে,
– কি হয়েছে?
দীপ্ত অবাক হয়ে বললো,
– সিরিয়ালের আহান!তুই শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছিস?
– কি করবো?তোদের বকবক শুনতে শুনতে আমার ঘুম পেয়েছে গেছে রে দীপ্ত!
– পাবেই তো দাভাই! এমন বোরিং পারসন থাকলে ঘুম পাওয়াটাই স্বাভাবিক!
– আহান!
এবার বেশ জোরেই চিৎকার করে দীপ্ত।পাহাড় সমান রাগ হচ্ছে দীপ্তের।হবে নাই বা কেন? গোধূলি যে একটা কথাও মাটিতে পড়তে দিচ্ছে না।সব কথার উত্তর দিচ্ছে।আহান বিরক্ত হয়ে বলে,
– কি হয়েছে এমন ষাড়ের মতো চিল্লালি কেন?
– তোর বোনকে চুপ করতে বলবি।নইলে এবার কিন্তু আমি ওর মুখ সেলাই করে দেবো।এই মেয়ের কি ভয় ডর নেই।
– তুইও তো কম যাস না।এইটুকু একটা মেয়ের সাথে এইভাবে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছিস।
– বা বা বা এখন আমি ঝগড়া করছি? হে রে তোর বোন কি ধোয়া তুলসীপাতা?ও কি ঝগড়া করছে না?এবার আমি….
– কি হয়েছে দীপ্ত এইভাবে চিৎকার করছো কেন?
দীপ্ত আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে গোধূলির রুমে আনোয়ার সাহেব চলে আসবেন বুঝতে পারে নি।দীপ্ত হকচকিয়ে যায়। আমতা-আমতা করে বলে,
– এমনি নানাজান!মজা করছিলাম আমরা।কি রে আহান বল।
আহানকে কনুই দিয়ে গুতো দেয় দীপ্ত কথা বলল।
– আব্ হে দাদাজান মজা মজা! আমরা তো মজাই করছিলাম।
আনোয়ার সাহেব শান্ত স্বরে বললো,
– চিৎকার করেও মজা করা যায় আজ শুনলাম!যাইহোক সবাই নিচে চল একসাথে ডিনার করবো!
দীপ্ত নরম গলায় বললো,
– হুম নানাজান তুমি যাও আমরা আসছি।
– দাদাজাআআন….
আনোয়ার সাহেব চলে যাচ্ছিলেন গোধূলির ডাকে পিছনে ফিরে বলেন,
– কিছু বলবি দাদুভাই?
আহান গোধূলির মুখ চেপে ধরে রেখেছে সেটা আনোয়ার সাহেব দেখার আগেই দীপ্ত ওদেরকে আড়াল করে আনোয়ার সাহেব এর সামনে এসে বলে,
– ও আর কি বলবে?তোমাকে যেতে বলেছে। হে না রে আহান।
দীপ্ত গলাটা একটু বাড়িয়ে আহানকে জিজ্ঞাস করে।
– হে দাদাজান।তুমি যাও।
– ঠিক আছে তোরা তাড়াতাড়ি আয় আমি গেলাম।
– আচ্ছা নানাজান।
গোধূলি উম উম শব্দ করছে।আনোয়ার সাহেব চলে যেতেই আহান গোধূলির মুখটা ছেড়ে দেয়।মুখ ছাড়া পেয়ে গোধূলি নিষ্পাপ কণ্ঠে বলে,
– বড়দাভাই তুমি!তুমি আমার মুখটা এইভাবে চেপে ধরতে পারলে?
দীপ্ত কর্কশভাবে বললো,
– ও তো তাও ভালো তোর মুখ চেপে ধরেছে।আমি হলে তোর গলাটাই টিপে দিতাম!
– শুনলে দাভাই কি বলল?শুনলে তুমি?
হতাশার সুর টেনে আহান বললো,
– আমি তো এতক্ষণ ধরে শুনেই চলেছি!আর কোনো শুনাশুনি না!অনেক হয়েছে এবার নিচে চল আয়।দেরি করে গেলে দাদাজান বকবে।
আহান দীপ্ত আর গোধূলি দুজনকেই নিয়ে নিচে চলে গেল।
#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -১৮
ডিনার করে সবাই যার যার ঘরে চলে যায়।কিন্তু দীপ্ত ঘরে যায় নি।আহান দীপ্তকে রুমে না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে চলে যায়।আহান গিয়ে দেখে ছাদে রাখা দোলনাটায় নির্বিকার দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে দীপ্ত।এতটাই বেখেয়ালি মনে বসে আছে আহান যে ওর পাশে গিয়ে বসেছে সেটা ও খেয়ালই করে নি।আহানও দীপ্তের দৃষ্টি অনুসরণ করে আঁকাশের দিকে তাকালো কিন্তু সে তেমন কিছুই দেখতে পেলো না।দেখবেই বা কি করে!চাঁদহীন আকাশে যে আজ মেঘ জমেছে।থেকে থেকেই ওই দূরের আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।চারদিকে কনকনে শীতল হাওয়া বইছে।
দীপ্তের গতিবিধির কোনো পরিবর্তন দেখতে না পেয়ে আহান এবার খুব বিরক্ত হয়ে মনে মনে বলে,একটা মানুষ কিভাবে এতটা বেখেয়ালি হতে পারে?সেই কখন থেকে এসে বসে আছি তার কোনো খবরই নাই
– বড়দাভাই!
আহান দীপ্তকে ডাক দিতে যাচ্ছিলো কিন্তু গোধূলির ডাকে ওর দিকে তাকায়।গোধূলির ডাকে দীপ্তেরও হুশ ফিরে।গোধূলিকে দেখে দীপ্তের কপালে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে।কিছুটা কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
– দিলি তো আমার মুডটা নষ্ট করে!আর কে তোর বড়দাভাই?এখানে আহান আসে নি দেখতে পাচ্ছিস না।এতো রাতে তুই এখানে কি করিস?যা বাসায় যা।
গোধূলি দীপ্তকে আর ওর কথাটা পাত্তা না দিয়ে মুখ ভেঙচিয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়ে আহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– দাভাই!আমার সাথে একটু নিচে চলো তো।
গোধূলিকে অনুসরণ করে ওর পাশে তাকিয়ে আহানকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠে দীপ্ত।দীপ্ত আহানের দিকে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছে।আমি তো এতক্ষণ ছাদেই ছিলাম তাহলে আহান কখন এসেছে?মনে মনে কথাগুলো আওড়ালো দীপ্ত।
– দেখছো দাভাই দীপ্ত ভাইয়া কেমন মিথ্যে কথা বলে?আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি এখানে বসে আছো তাও সে বলছে তুমি নাকি এখানে নেই!আবার আমাকে ধমকও দিয়েছে।
মুখটা মলিন করে কথাটা বলে গোধূলি।আহান বোনের মুখ দেখে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
– দীপ্ত তুই এতটাই অন্যমনস্ক হয়ে বসে ছিলি যে আমি যে সেই কখন থেকে তোর সাথে বসে আছি তুই সেটা টেরই পাস নি।আর তুই সাজিকে তখন ওইভাবে ধমকালি কেন?
– উমমম বোন অন্ত প্রান এক্কেবারে!তা বোনের জন্য যেহেতু এতই দরদ তাহলে বোনকে নিয়েই বসে থাকতি আমার সাথে এখানে কি করিস?
টেনে টেনে কথাটা বলল দীপ্ত।দীপ্তের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে গোধূলি বলে,
– তা বোন অন্ত প্রান হবে নাতো তোমার মতো একটা এলিয়েন অন্ত প্রান হবে?আমার ভাই আমার সাথে থাকবে না তো তোমার সাথে থাকবে?দাভাই চলো আমার সাথে।এখানে আর এক মুহূর্তও তুমি থাকবে না।
গোধূলি আহানের হাত ধরে নিয়ে চলে যাচ্ছছিল হঠাৎ করে দীপ্ত খপ করে আহানের হাতটা ধরে ফেলে।আহানকে নিয়ে দুজনের মধ্যে তুমুলযুদ্ধ বেধে গেছে।গোধূলি আহানের হাত ধরে তার দিকে টানছে আর দীপ্ত ওর দিকে।দীপ্তের টানাটানি দেখে গোধূলি বলছে,
– দীপ্ত ভাইয়া!তুমি দাভাইয়ের হাতটা ভালোয় ভালোয় ছেড়ে দাও বলছি।
– কেন?না ছাড়লে কি করবি শুনি?আর ও কি তোর একার ভাই?
– হে আমার একারই ভাই।
বলেই গোধূলি আবার আহানের হাত ধরে টান দেয়।
– ও আমারও ভাই।
– না আমার ভাই।
– আমি যে বলছি ও আমারও ভাই
– না দাভাই শুধু আমার ভাই।
দুজনের এই হাত ধরে টানাটানির চক্করে আহানের হাত খুলে যাওয়ার উপক্রম প্রায়!আহান জোরে চিল্লিয়ে বলে,
– আআআ!স্টপ ইট।কি শুরু করেছিস দুজনে মিলে?আমার হাতের তো বারোটা বাজিয়ে দিলি।সাজি এটা কোন ধরনের বিহেভিয়ার?দীপ্ত তুইও?ও না হয় ছোট বুঝলাম কিন্তু তুইও কি ওর মতো ছোট?
আহানের চিৎকারে দীপ্ত আর গোধূলি দুজনেই ভড়কে যায়।দীপ্ত স্বাভাবিক থাকলেও গোধূলি তো কেঁদেই দিয়েছে!তবে শব্দ করে কাঁদছে না।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে গোধূলি আর চোখ বেঁয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
– সাজি আমি তো তোকে কিছু বলছি শুনতে পাচ্ছিস না?
…..
– কি হলো কথা বলছিস না কেন?
…..
আহানের কথা যেন গোধূলির কানে পৌঁছাচ্ছেই না।গোধূলি তখনও নির্বিকার দৃষ্টিতে নিচেই দিকে তাকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতেই ব্যস্ত!আহান গোধূলির কোনো সাড়া না পেয়ে গোধূলির কাছে এসে ওর বাহুদ্বয় ধরতেই অশ্রুসিক্ত নয়নে আহানের দিকে তাকায় গোধূলি! বোনের চোখে পানি দেখে আহানের বুকটা ধক করে উঠে।আহান ব্যস্ত হয়ে গোধূলির গালে হাত রেখে বলে,
– সাজি তুই কাঁদছিস!কি হয়েছে?কাঁদছিস কেন তুই? লক্ষ্মী বোন আমার এইভাবে কাঁদিস না!আমি কি তোকে বকেছি বল?
আহানের কথা শুনে এবার দীপ্তও গোধূলির দিকে তাকায়।দীপ্ত গোধূলির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,
-সত্যিই তো এই মেয়ে কাঁদছে!কাঁদোক তাতে আমার কি?অনেক জ্বালিয়েছে আমাকে!
গোধূলির কান্নাতে দীপ্তের চোখেমুখে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে নি বরং গোধূলির কান্না দেখে দীপ্ত কোনো পৈশাচিক আনন্দই পাচ্ছে!আহানের দিকে তাকিয়ে থেকে কোনো কথা না বলে চোঁখের জল মুছতে মুছতে ছাদ থেকে দৌঁড়ে চলে যায় গোধূলি।আহান বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে।ভেবেছিল গোধূলি হয়তো ওকে কিছু বলবে।কিন্তু না ওকে ভুল প্রমান করে দিয়ে গোধূলি এখান থেকে চলে গেছে?গোধূলি চলে যেতেই দীপ্ত হেঁসে দিয়ে বলে,
– তোর বোন আমার সাথে জিততে পারে নি বলে এখানে নাটক করে এখন পালিয়েছে!
দীপ্তের কথায় আহান রেগে গিয়ে কঠিন গলায় বলে,
– দীপ্ত সব সময় নিজের মনগড়া কথা অন্যকে শুনাতে আসবি না!গোধূলি কষ্ট না পেলে সহজেই কাঁদে না!
আহান হনহনিয়ে ছাদ থেকে চলে যায়।দীপ্ত আহানের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার গিয়ে দোলনায় বসে পড়ে।ছাদে আরো কিচ্ছুক্ষণ একা একা বসে ছিল দীপ্ত। আকাশে ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।বারী বর্ষনের আভাস পেয়ে দীপ্তও বাড়ির ভিতরে চলে যায়।
★
গোধূলির রুমের দরজায় এক নাগাড়ে দাঁড়িয়ে থেকে বিরতিহীনভাবে আহান ডেকে চলেছে।
– সাজি বোন আমার দরজা খুল।আমি আর কোনো দিন তোকে বকবো না! এই দেখ কান ধরছি। তুই চাইলে তোর সামনে কান ধরে উঠবসও করবো। প্লিজ বোন আর দরজাটা খুল।গোধূলি ভেতর থেকে সব শুনতে পাচ্ছে কিন্তু কোনো কথাই বলছে না।দীপ্ত দূর থেকে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল।আহান দীপ্তকে দেখতে পেয়ে রাগে ফুঁসতে থাকে!গোধূলির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে শেষে ভাবে এত রাতে এইভাবে ডাকাডাকি করলে সারা বাড়ির মানুষ চলে আসবে। সকালে না হয় ওর রাগ ভাঙ্গানো যাবে।আহান গোধূলিকে আর ডাকাডাকি না করে ওর রুমে চলে যায়।
.