দীপ্ত গোধূলি পর্ব -১৯+২০

#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -১৯

গোধূলির রাগ ভাঙানোর জন্য সেই ভোর বেলা থেকে দারজার বাহিরে বসে আছে আহান।যথাসময়ে গোধূলি ঘুম থেকে উঠে মর্নিংওয়াক করতে যাবে বলে।দরজা খুলতেই সামনে বড়সড় একটা সাইনবোর্ড দেখে কিছুটা হকচকিয়ে যায় গোধূলি।একটা স্যাড ইমুজির সাথে সরি বোনু লিখাটাই সবার আগে চোখে পড়ে গোধূলির।মুখের সামনে ধরে রাখা সাইনবোর্ডটা রেখে দিয়ে কান ধরে গোধূলিকে সরি বলে আহান।এতে গোধূলির ভাবাবেগের কোনো পরিবর্তনই হয় নি।ইনফ্যাক্ট আহানের সাথে কথাও বলে নি।আহানকে পাশ কাটিয়ে চলে যায় গোধূলি।নিচে এসে জানতে পারে আজকে খুব ভোরেই রাবিয়া বেগম আর আদিবা মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়ে গেছে।তাই আজকে গোধূলিকে একাই যেতে হবে।অবশ্য পার্কে গিয়ে দাদু আর বোনের সাথে তো হবেই এটা ভেবে গোধূলিও মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়ে পরে।বাড়ি থেকে বেড়িয়ে কিছু দূর যেতেই গোধূলির মনে হলো কেউ ওর পিছন পিছন আসছে।গোধূলি দৌঁড়ানোর মধ্যেই পিছনে তাকিয়ে দেখে ওর পিছন পিছন আহান আসছে।আহানকে দেখে গোধূলির দৌঁড়ের গতি বাড়িয়ে দেয়।তাতেও লাভ হয় নি।আহান ওকে ধরে ফেলে।আহান ওর পাশে পাশেই দৌঁড়াচ্ছে আর যপ করার জন্য নিয়েছে দুটি শব্দ সরি আর বোনু।গোধূলির সাথে সাথে দৌঁড়াচ্ছে আর সরি বোনু,সরি,বোনু সরি যপ করছে।গোধূলির কোনো হেলদোল নেই।আহানের দিকে ও তাকাচ্ছেই না।সারা রাস্তায় এমন করতে করতে অবশেষে পার্কে এসে পৌছায়।কিন্তু এখানে এসে দেখে আদিবা বা রাবিয়া বেগম কেউই নেই।

গোধূলি আর সময় নষ্ট না করে বাসার উদ্দেশ্য চলে যায়।আবার সেই আহান ওর পিছু নিয়েছে আর সরি বোনু সরি বোনু যপছে।এবার গোধূলি বিরক্ত হয়ে বলে,আহ এক কথা বার বার শুনতে ভালো লাগে না!হটাৎ করেই আহান দাঁড়িয়ে যায়।গোধূলি ওর নিজের মতো করেই দৌঁড়াচ্ছে।অনেকক্ষণ আহানের সাড়াশব্দ না পেয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে আহান মাঝরাস্তায় পড়ে আছে।গোধূলি আহানের দিকে না গিয়ে আবারও নিজের মতো করেই দৌড়ে গিয়ে একটা বড় গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।গোধূলি মনে মনে ভাবছে আহান বোধহয় নাটক করছে ওর রাগ ভাঙাবে বলে।আহান যদি দেখে ও চলে গেছে তাহলে হয়তো উঠে যাবে।কিন্তু না অনেকক্ষণ হয়ে গেছে আহান তো উঠছে না!এবার গোধূলির কপালে চিন্তার ছাপ।আর কোনো দিক না তাকিয়ে সোজা আহানের দিকে দৌড়াতে থাকে।আহানের কাছে গিয়ে গোধূলি ওকে অনেক ডাকাডাকি করে কিন্তু আহান কোনো রেসপন্স করছে না।মাথায় হাত দিতেই গোধূলির হাত রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়।ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠে গোধূলি।এত রক্ত দেখে গোধূলির মাথা কাজ করছিল না। উপায় না পেয়ে শেষে আশেপাশের লোকজনকে ডেকে নিয়ে এসে তাঁদের সাহায্যে আহানকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য।গাড়ি থেকে রাস্তায় ইহান আর দীপ্তকে দেখতে পায় গোধূলি পরে ওদেরকেও সাথে করে নিয়ে যায়।গোধূলি তো সারা রাস্তা কাঁদতে কাঁদতেই গেছে তার সাথে ইহানও।
হাসপাতালে গিয়েও ইহান আর গোধূলি দুই ভাইবোন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে সে কি কান্নাকাটি। সারা হাসপাতালের মানুষ এসেছে ওঁদের কান্না করার কারণ জানতে।দীপ্ত ডাক্তারের সাথে কথা বলছিল।ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে এসে ইহান আর গোধূলিকে ঘিরে এত মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছু ভয় পেয়ে যায়।কাছে এসে পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে,

– স্টপ ইট!

আচমকাই দীপ্তের এমন চিৎকারে গোধূলি ইহান দুজনেই কিছুটা থতমত খেয়ে উঠে।দীপ্ত দাঁড়িয়ে থাকা জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

– আপনাদের কি খেয়ে দেয়ে আর কোনো কাজ নেই।দুই পাগলের বিলাপ শুনতে এখানে এই ভাবে ভীড় জমিয়েছেন কেন?যান সবাই নিজেদের কাজে যান।

– গোধূলি!

আহান ডাক দেয় গোধূলিকে।আহানকে দেখতে পেয়ে গোধূলি দৌঁড়ে গিয়ে জাপ্টে জড়িয়ে ধরলো।ভাইকে কাছে সে কি কান্না!ইহানও গিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরলো।গোধূলি আর ইহান অনেকটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

– আরে পাগলি তুই এইভাবে কাঁদছিস কেন?এই দেখ আমার কিচ্ছু হয় নি।আমি একদম ফিট আছি।শরীরটা একটু দূর্বল প্রসারটাও লো তাই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম এই আরকি।ডাক্তার বলেছে ঠিক হয়ে যাবে।

– দাভাই তুমি বাসায় চলো।টেনশন করবে বলে বাসার কাউকে কিছু জানানো হয় নি।তার আগে তোমার কাছে কিছু টাকা থাকলে আমাকে দাও তো।

– আমার কাছে কার্ড আছে ক্যাশ টাকা নেই।

— দাও হসপিটালের বিলটা পে করে আসি।

– আমি করে দিচ্ছি!

– থাক দীপ্ত ভাইয়া!তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না।তুমি অনেক সাহায্য করেছ আমাদের!এবার আমাদেরকে করার সুযোগ দাও!বড়দাভাই তুমি একটু এখানে বসো কেমন আমরা এক্ষুনি আসছি।এই ছোটদাভাই তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমাকে কাউন্টারে নিয়ে যাবি তো নাকি!

– চল

গোধূলির কথা গুলো আহানের কাছে স্বাভাবিক লাগলেও দীপ্তের কাছে মোটেই সুবিধার মনে হয় নি!কথার মধ্যে ঝাঁঝ ছিল।যাইহোক দীপ্ত এতটাও মাথা না ঘামিয়ে আহানের পাশে গিয়ে বসে।

আহানকে গোধূলি আর ইহান দুইদিক থেকে ধরে নিয়ে বাসায় ঢুকেছে।জাকিয়া বেগমের চিৎকারে সবাই আঁতকে উঠে। সবাই জাকিয়া বেগমের দৃষ্টি অনুসরণ করে দরজার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় গোধূলি আর ইহান আহানকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। পিচ ঢালা রাস্তায় ওইভাবে পড়ে যাওয়ায় আহানের মাথায় একটু লেগেছে বিধায় রক্তক্ষরণ হয়েছে।তাই মাথায় ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়েছে।আর সেটা দেখেই জাকিয়া বেগম ভয় পেয়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠেন।
ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে জাকিয়া বেগম।সাথে যোগ হয়েছে আদিবাও। বাডির সবাই এত এত প্রশ্ন করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছে।সবার সব প্রশ্নের উত্তর দেয় দীপ্ত।যারা আহানকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছিলো তারাই সবটা দীপ্তকে বলেছে, যে গোধূলি কিভাবে সবাইকে ডেকে নিয়ে এসে আহানকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলো।

আহান সহ বাড়ির সবাই দীপ্তের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।জাকিয়া বেগম এসে গোধূলিকে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছেন।

– সাজি মা তুই যদি আজকে না থাকতি তাহলে আমার ছেলেটার কি হতো একবার ভাবতে পারছিস?মাঝরাস্তায় ওইভাবে পড়ে ছিল ওর যদি কোনো এক্সিডেন্ট…….

– আহ বউমা!কি আবোলতাবোল বকছো তুমি?দেখতে পাচ্ছো না আহান ঠিক আছে ছোট গিন্নি থাকতে ওর কিছু হতে দিতো?

শ্বশুরের কথায় থেমে যান জাকিয়া বেগম।

– মা তুমিও না!এইসব কথা এইভাবে বলতে আছে!সাজি তুই তোর ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।অনেক কেঁদেছিস।ইহান দীপ্ত তোরাও যা!আহান তুই আমার সাথে আয় তোর শার্টটাও তো দেখছি চেঞ্জ করতে হবে।তারপর আদিবা আর জাকিয়া বেগম আহানকে নিয়ে ওর ঘরে যায়।

রাতের খাবার খাওয়ার জন্য আহানকে নিচে নামতে দেয় নি গোধূলি। তার আদেশ আহান বিছানা থেকে এক পাও নামাতে পারবে না।বোনের আদেশ মেনে পেটে প্রচন্ড খিদে নিয়ে পেট চেপে ধরে বসে আছে আহান।পরক্ষণেই দেখতে পেলো গোধূলি হাতে করে খাবারের ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকছে।নিজের হাতেই ভাইকে খাইয়ে দেয় গোধূলি। আহানকে খাইয়ে দিয়ে গোধূলিও নিচে গিয়ে নিজের খাবারটাও খেয়ে নেয়ে রুমে চলে আসে।ঘুমানোর আগে আরেকবার আহানকে দেখতে ওর ঘরে যায়।আহানের রুমে গিয়ে বুঝতে পারে দীপ্ত আহানকে হসপিটালে ওইভাবে কান্নাকাটি করার কথাটাই কোনো কারণে আবার রিপিট করছে!

গোধূলি আহানের রুমে ঢুকে শান্ত সুরে বলে উঠে,

– আমার ভাই আমাদের ভাই অসুস্থ ছিল!দীপ্ত ভাইয়া।তখন আমাদের উপর দিয়ে কি যাচ্ছিল সেটা তুমি বুঝবে না।তোমার নিজের কোনো ভাই বোন নেই তো তাই তুমি তার মর্মটা বুঝতে পারছো না।যাদের আমরা মন থেকে ভালোবাসি তাদের হারানোর ভয়টাও বেশিই পেয়ে থাকি দীপ্ত ভাইয়া!আমরা যে শুধু রক্তের সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রেই কাতর হয়ে পড়ি তা কিন্তু নয়! অনেক সময় রক্তের সম্পর্ককেও হাড় মানিয়ে দেয় আমাদের চারপাশের পাতানো সম্পর্কগুলো।রক্তের সম্পর্ক নেই বলে কি সেখানে ভালোবাসা থাকে না?আজ তুমি যেটাকে সবার সাথে পাগলের বিলাপ বলে পরিচয় করিয়ে দিলে?যেদিন তুমি তোমার প্রিয় কাউকে হারানোর ভয়ে থাকবে সেই তুমি নিজেকে আমাদের মতোই পাগল বলে চিহ্নিত করবে।আল্লাহ না করুক তুমি যাদের মন থেকে ভালোবাসো তাদের যদি কিছু হয় তাহলে সেই দিন তুমি বুঝতে পারবে প্রিয় জনকে হারানো কষ্টটা ঠিক কতখানি গভীরে গিয়ে আঘাত করে! বুকটা ঠিক কতটা শূন্যতায় হাহাকার করে উঠে।আমি চাইলে তোমায় এই গুলো হসপিটালে সবার সামনেই বলতে পারতাম!কিন্তু সেটা করা উচিৎ হবে না বলে আমার মনে হয়েছে।তাতে তোমার মুখটাও খুব বড় হয়ে যেত বলে অন্তত আমি মনে করি না।

দীপ্তকে কথা গুলো বলেই গোধূলি ওইখান থেকে চলে যায়!কথাগুলো বলতে বলতে ওর গলা ধরে এসেছিল।তাই হয়তো কান্নাটা আটকানোর জন্য বেরিয়ে গেছে।

– আমার বোনটা কবে এত বড় হয়ে গেল রে দীপ্ত?কি সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে শিখে গেছে!

এতক্ষণ আহান এক ধ্যানে গোধূলির মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।আর দীপ্ত মাথা নিচু করে বসে ছিল।হয়তো তখন সবার সামলে ওইভাবে বলাটা উচিৎ হয় নি ভেবে অনুশোচনা হচ্ছে!

বর্তমান_____

আহানের ডাকে অতীত থেকে বেড়িয়ে আসে দীপ্ত।দীপ্ত এতক্ষণ গোধূলির হাতটা ধরেই বসেছিল।দীপ্তের এখন গোধূলির বলা ওইদিনের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে!নিজের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যে হেসে দেয় দীপ্ত!নিয়তি আজ ওকে কোথায় নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে!

বাড়ির সবাই চলে আসায় গোধূলির কাছ থেকে কিছুটা দূরত্বে চলে যায় দীপ্ত।গোধূলিরো ঘুম ভেঙ্গে যায় বাড়ির সবার আগমনে।গোধূলি এখন তাও একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় কথা বলতে পারছে।

শিখা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাস করে,

– মা আমাদের বল তো তুই বাথরুমে কিভাবে পড়ে গেয়েছিলি?

মায়ের কথায় গোধূলি মনে করার চেষ্টা করে আসলে কি হয়েছিল!
#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -২০

ফ্ল্যাশব্যাক_

গোধূলি কাঁদতে কাঁদতে ছাদ থেকে চলে আসার পর সোজা গিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ে।দীপ্তের এমন রিয়েক্ট করার কারণ ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।সাধারণ একটা কারণে দীপ্ত ওর গায়ে হাত অব্দি তুলেছে।শাওয়ারটা ছেড়ে দিয়ে দেওয়াল ঘেঁষে নিচে বসে পড়ে।শাওয়ারের পানি যত গড়াচ্ছে গোধূলির কান্নার পরিমাণও তত বৃদ্ধি পাচ্ছে।কতক্ষণ ওইভাবে শাওয়ারের পানিতে ভিজেছে তা বলা মুশকিল।হাটুর ভাঁজে মুখ গুজে কান্না করছিল গোধূলি।এক সময় লক্ষ্য করে বাথরুমের ফ্লোরটা রক্তে ভরে গেছে।পরক্ষণেই মনে পড়ে ওর কপালে আঘাত পাওয়ার কথা।কোথায় কেঁটেছে দেখার জন্য গোধূলি বাথরুমের আয়নাটায় তাকাতেই কপালের রক্ত দেখে মাথাটা হালকা চক্কর দিয়ে উঠে। ক্রমশই শরীরটা দূর্বল হয়ে আসছিল।আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো গোধূলি।ধপ করে নিচে পড়ে। কিছু বুঝে উঠার আগেই জ্ঞান হারায় গোধূলি।অবশ্য জ্ঞান হারানোর আরেকটা কারণও আছে আর সেটা হলো এই রাতের বেলায় অতিরিক্ত ভেজার কারনে শরীর মাত্রাতিরিক্তভাবে ঠান্ডা হয়ে গিয়ে শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। ফলে গোধূলি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

ওইদিকে আদিবার ঘর থেকে গোধূলি চলে আসায় সবাই মনমরা হয়ে বসে ছিল তাছাড়া কারেন্টও চলে যাওয়ায় সবাই চলেও এসেছিল।অবশ্য সবাই চলে আসার আরেকটি কারণও ছিল।সেটা হলো মিহির-লাজুক আর দীপ্ত-আহান বাসায় ছিল না আর ওদেরকে ছাড়া প্ল্যানিং করাও পসিবল না।তাই শুধু গোধূলির ভার্সিটির কথাই শুনলো।সবাই চলে আসার পর আদিবার ফোনে রায়ানের কল আসে।আদিবা রায়ানের সাথে কথা বলা শেষ করে যখন ঘুমাতে যাবে তখন দেখতে পায় গোধূলির ফোনটা ওর রুমে রয়ে গেছে। আদিবা ওর ঘর থেকেই গোধূলিকে ডাক দেয় কিন্তু গোধূলি শুনতে পায় নি বলে আদিবাই গোধূলির ঘরে যায়।কিন্তু ঘরে গিয়ে দেখে গোধূলি ওর রুমে নেই।ব্যালকনিতে চেক করে ওইখানেও নেই। তারপর বাথরুম থেকে পানির শব্দ শুনতে পেয়ে আদিবা কাছে গিয়ে গোধূলিকে ডাক দেয়। কয়েকবার ডাকার পরেও যখন গোধূলির কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছে না তখন দরজার নক করে আদিবা।জোড়ে জোড়ে দরজা ধাক্কাচ্ছে আদিবা কিন্তু গোধূলির কোনো রেসপন্সই আসছে না।

আহান দীপ্তের গাড়িটা রিপেয়ার করতে দিয়ে বাড়িতে আসতে একটু দেরি হয়।বাড়িতে এসে সোজা ওর রুমের দিকে যাচ্ছিল তখন গোধূলির রুমে আদিবার গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে গিয়ে দেখে আদিবা এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে গোধূলিকে ডেকেই চলেছে।আহান আদিবার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করলে আদিবা বলে ও অনেকক্ষণ যাবৎ গোধূলিকে ডাকছে কিন্তু গোধূলি কোনো কথাও বলছে না দরজাও খুলছে না।বোনের কথা শুনে আহানও বারকয়েক ডাকে গোধূলিকে।আহানের ডাকেও গোধূলি কোনো উত্তর দেয় নি।সেটা আদিবা আহান দুজনের কাছেই অবাক লাগে।কারণ আহান গোধূলির চোখের মনি!সেই ভাইয়ের ডাকেও সাড়া দেয় নি!এখন দুশ্চিন্তা হচ্ছে আদিবার। আদিবা আহানকে দরজা ভাঙ্গতে বলে।আহানও তাই করে।দরজা ভাঙ্গতেই গোধূলিকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে আদিবা চিৎকার করে উঠে।আহান গোধূলিকে কোলে করে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দেয়।গালে হাত দিয়ে অনেক ডাকাডাকি করে।কিন্তু গোধূলির কোনো রেসপন্সই করছে না।আহান গোধূলির পালস চেক করে কিন্তু পালস পায় নি।আদিবার চিৎকারে ইহান সবার আগেই চলে আসে কারণ ও সজাগ ছিল।ইহান এক মুহূর্তও দেরি না করে এম্বুল্যান্সকে কল করে।বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পরেছিল তাই তাদের সবটা বুঝতে একটু সময় লাগে।গোধূলির রুম থেকে আদিবার গলার স্বর অস্পষ্ট শুনা গেলেও ওটা যে আদিবার আওয়াজ সেটা সবাই বুঝতে পেরে গোধূলির রুমে এসে দেখে গোধূলির সারা শরীরে রক্ত মাখা।শিখা বেগম চিৎকার দিয়ে ওইখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।সবাই আদিবা আহানকে জিজ্ঞাস করছে গোধূলির কি হয়েছে?কিন্তু ওরাও তো জানে গোধূলির আসলে কি হয়েছে!কাউকে আর কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে এম্বুল্যান্স এর শব্দ পেয়েই আহান গোধূলিকে কোলে করে নিয়ে বেরিয়ে যায়।

— সাজি!তোর কি মনে করতে খুব কষ্ট হচ্ছে মা?

দীপ্ত নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে গোধূলির দিকে।শিখা বেগমের প্রশ্নে নিজের দিকে তাকিয়ে শব্দহীন তাচ্ছিল্যের হাসিও দিয়েছে বারকয়েক।দীপ্ত দুচোখ ভরে দেখে নিচ্ছে গোধূলিকে।হয়তো আজই গোধূলির জীবনে ওর শেষ দিন হতে চলেছে!হয়তো এই দেখাই ওর শেষ দেখা হতে চলেছে!কোনো মা বাবাই তাঁদের মেয়ের জীবনে বা তাঁদের পরিবারে কোনো ঘাতকের অস্তিত্ব রাখতে চাইবে না!তাদের মেয়ের যে এই অবস্থা করেছে,তাদের মেয়েকে হয়তো সেই নির্দয় নিষ্ঠুরতম মানুষের ছাঁয়াও মারাতে দেবে না।কথাগুলো ভাবতেই দীপ্তের নয়নযুগল অশ্রু জলে ভরে উঠে!চোখের পাতা নড়লেই সেই জল চোখ বেঁয়ে নিচে গড়িয়ে পড়বে!যথাসম্ভব নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করছে দীপ্ত।

মায়ের কথায় ধ্যান ভাঙ্গে গোধূলি।নিজেকে সামলে নিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে,

— আমি পড়ে গিয়েছিলাম!আম্মু আমি পা স্লিপ করে পড়ে যাই।আমি পড়ে যাওয়ার পর উঠেও দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই আবার মাথা ঘুরে পড়ে যাই!তারপর কি হয়েছে আমার কিছু মনে পরছে না।

গোধূলির কথা শুনে মাথা তুলে বিস্ফোরিত চোখে তাকায় দীপ্ত!অবাধ্য চোখের জল সব বারণ অমান্য করে নিজের কার্য সম্পূর্ণ করতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে!কেউ দেখে ফেলার আগেই বৃদ্ধা আঙ্গুলের সাহায্যে সেই জল মুছে নেয় দীপ্ত।

সাজ্জাদ সাহেবের কাছে গোধূলির উত্তরটা এতটাও যুক্তিসঙ্গত মনে হলো না।তিনি ভাবছেন বাথরুমে পড়ে গিয়ে আঘাত পেলে তা কোমড়,হাত-পা বা মাথায় লাগার কথা তাহলে গোধূলি কপালে আঘাত পেলে কি করে?নিজের সন্দেহকে উড়িয়ে দিয়ে মেয়ের কথাই বিশ্বাস করলেন।কারণ গোধূলিকে তো বাথরুমেই পাওয়া গিয়েছিল।ভেতর থেকে দরজা লকও ছিল তাই বিশ্বাস না করার কোনো উপায় নেই।সাজ্জাদ সাহেব মেয়ের কপালে চুমো দিয়ে মেয়েকে সাহস দেওয়ার জন্য বলে উঠেন,

— আমার সাজি মা অনেক সাহসী!তাইনা সাজি মা?কিচ্ছু হয় নি ওর আমরা আজকেই বাড়ি ফিরে যাব। তোকে এখানে রাখার মতো অসুস্থও তুই হোস নি মা।যারা ভীতু দূর্বল তারা হসপিটালে থাকে!তুই কোনো চিন্তা করিস না।আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি।ডাক্তার বলেছে তোকে আমরা বাড়ি নিয়ে যেতে পারি আর তোর দেখাশোনোর জন্য উনারা নার্স পাঠিয়ে দেবেন।

— আব্বু তুমি!তুমি সত্যি বলছো?

বাবার কথা শুনে খুশিতে গোধূলির চোখ চকচক করে উঠে।সাজ্জাদ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রেখে আশ্বাস দেন যে তিনি সত্যি বলছেন।

— দীপ্ত তুই এবার বাসায় যা।কাল থেকে অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছিস বাবা।সকাল থেকে সবাই কত করে বলল বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে আসতে।কারো কথায় তো শুনলি না!সকাল থেকে কিছু খাসও নি।আহান তুই ওকে নিয়ে বাসায় যা।আমরা একটু পরেই বাসায় চলে আসবো।

এতক্ষণে গোধূলি দীপ্তকে লক্ষ্য করে।চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে কপালের উপর লেপ্টে রয়েছে।চেহারায় মলিনতার ছাপ।শার্টের বোতলগুলোও অগুছালো ভাবে লাগানো।উনার মাথায়,হাতে ব্যান্ডেজ কেন?কি হয়েছে উনার?গোধূলি দীপ্তকে পর্যবেক্ষণ করছিল আর মনে মনে কথাগুলো ভাবছিল!

সাজ্জাদ সাহেবের কথা মতো রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার আগে গোধূলি দিকে আরেকবার তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়।গোধূলি ক্ষানিকটা অপ্রস্তুতই ছিল।তাড়াতাড়ি ওর নজর অন্য দিকে ফিরিয়ে নেয়।
দীপ্ত ভেবেছে গোধূলি হয়তো ঘৃণার ওর দিক থেকে চোখ সড়িয়ে নিয়েছে।

— সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?এত কিছুর পর তোকে ঘৃণা করাটাই স্বাভাবিক দীপ্ত!মনে মনে বলে আবার তাচ্ছিল্যে হেসে দেয় দীপ্ত।আর এক মুহূর্তও দেরি না করে বেড়িয়ে যায় দীপ্ত। আহানও গোধূলি কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে আসে।

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here