দীপ্ত গোধূলি পর্ব -৩৫+৩৬

#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -৩৫

গোধূলির সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।ওর সামনে কেউ হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বাড়িয়ে দেয়া হাতের বিপরীতে থাকা মানুষটিকে দেখবে বলে মুখটা উপরে তুলতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে।আস্তে আস্তে পুরো শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে।ওর সামনে যে মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে সে আর অন্য কেউ নয়,দীপ্ত!

মিহিরের এনাউন্সমেন্ট শুনার পর বেশ অবাকই হয়েছিল গোধূলি।আরো একটি কাপল?রায়ান আদিবার মাঝে অন্য কাপল কি করে এলো?কে বা কারা হতে পারে?এইসব প্রশ্ন গোধূলির মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।নিজের কৌতূহল মেটাতে সবটা দেখবে বলে মনস্থির করলো।কিন্তু সবকিছু থমকে যায় যখন ওই বড় লাইটের আলোটা নিজের গায়ে এসে পড়ে।

যথাসম্ভব নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে গোধূলি।অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজের বাবা দিকে তাকায় গোধূলি।সাজ্জাদ সাহেব মেয়ের চাহনির কারণ বুঝতে পেরে চোখ বন্ধ করে মাথা নাড়ান।বাবার মাথা নাড়াতে দেড়ি হয়েছে অবাধ্য চোখের জল গড়িয়ে পড়তে এক মুহূর্তও দেরি হয় নি।বাবার উপর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আহসান সাহেবের দিকে তাকালে সেখানেও একই উত্তর পেয়ে গোধূলির বুঝতে বাকি নেই সবটা আগে থেকেই ঠিক করা।শুধু ওই জানতো না!এই সব কি ঘটছে?কেন ঘটছে?গোধূলির বোধগম্য হলো না!মাথাটা ঝিমঝিম করছে।
দীপ্ত তখনও হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।গোধূলির চোখ বেঁয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে সেই প্রসারিত হাতের তালুতে!দীপ্তের হৃৎপিণ্ডে মুচড় দিয়ে উঠে।ব্যাতিব্যস্ত হয়ে পড়ে দীপ্ত।

– গোধূলি আ…..

দীপ্ত কিছু বলতে যাচ্ছিল।দীপ্তের গলা শুনতেই কান গরম হয়ে আসে গোধূলির।দীপ্তের দিকে না তাকিয়েই হাত উঁচিয়ে দীপ্তকে চুপ থাকতে বুঝায়।দীপ্ত অসহায় দৃষ্টিতে গোধূলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।এই মুহূর্তে গোধূলিকে ওর ঠিক কি বলা উচিৎ আর কি নয় বুঝতে পারছে না।আদৌ কি কিছু শুনার বা বলার অবস্থাতে আছে ও!দীপ্তের সব কথা যেন গলায় দলা পাকিয়ে আসছে।এই মুহূর্তে নির্বাক থাকা ছাড়া আর কোনো পথই দীপ্তের জানা নেই।গোধূলি হাতের পিঠে চোখ মুছে নিজের কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখে দীপ্তের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের উপর।

রিসোর্টে উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষ মুগ্ধ নয়নে দীপ্ত-গোধূলি যুগলবন্দীর দিকে তাকিয়ে আছে।গোধূলিকে দেখে মনে হচ্ছে ঠিক যেন কোনো অপ্সরা।গোল্ডেন গাউনের উপর মেরুন ফতোয়া আর তার ঠিক পাশেই মেচিং সুটে দীপ্ত।দেখতে কি অপূর্ব সুন্দর লাগছে দুজনকে।দীপ্তের হাত ধরেই সিঁড়ি বেঁয়ে নিচে নেমে আসে গোধূলি।রায়ান এতক্ষণে বুঝে গেছে এত সাসপেন্সের মূল সারপ্রাইজ দীপ্ত গোধূলি!কিন্তু শুধু রায়ানেই নয়!রায়ানের মতো আহান, ইহান,আদিবা গোধূলি, লাজুক, মোটকথা বাড়ির বড়রা ছাড়া এই ডিসিশনের কথা কেউই জানতো না!ইনফ্যাক্ট মিহিরও জানতো না।ওকে শুধু এনাউন্স করতে বলা হয়েছে।যখন গোধূলিকে দেখতে পায় তখন মিহিরও বেশ অবাকই হয়।আহান বোনের অবস্থা বুঝতে পারছে।এই এনাউন্সমেন্টে যতটা না আহান শক্টড তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি শক্টড গোধূলির লেগেছে।আহান সাজ্জাদ সাহেব আর আহসান সাহেবকে এসে জিজ্ঞাস করলো,

– চাচ্চু!আব্বু!এই কাজটা কি ঠিক হলো?

ছেলের কথায় আহসান সাহেব খুব জোড় গলায় বলে,

– দীপ্ত আমাদের সাজিকে খুব ভালো রাখবে দেখিস!

– আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এটা না আব্বু!দীপ্ত সাজিকে খুব ভালো রাখবে সেটা আমিও জানি।কথাটা ভালো বা খারাপ রাখার নয়।মানলাম আমাদের বলা হয় নি!কিন্তু সাজি?ওকেও কি জানানোর প্রয়োজনবোধ করো নি তোমরা?

– আমাদের সিদ্ধান্তই ওর সিদ্ধান্ত!আমরা যেটা ঠিক বলে মনে করেছে সেটাই করেছি।আর আমার মনে হয় না সাজি আমাদের কথার অবাধ্য হবে!

– আর সেই সুযোগটাই তোমরা নিলে?

– আহান!

– সরি চাচ্চু!তোমাদের বলতে এসে হয়তো আমারই ভুল হয়েছে।তোমাদের মেয়ের উপর তোমাদের অধিকার,জোড় থাকবে এইটাই স্বাভাবিক।ভাই হিসেবে আমার অধিকার নাই থাকতে পারে!

আহানের কথায় সাজ্জাদ সাহেব বলেন,

– আহান তুই এইভাবে বলছিস কেন?সাজির উপর তোর অধিকার থাকবে কেন হাজারবার আছে।তোদেরকে সারপ্রাইজ দেবো বলে কিছু জানানো হয় নি!

সাজ্জাদ সাহেবের কথায় আহান রুদ্ধকন্ঠে বলে,
– আর সারপ্রাইজ!

– সাজ্জাদ আমার মনে হয় আহান ঠিকই বলছে।হটকারিতায় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না! সাজি আদৌ এই এনগেজমেন্টটা করতে চায় কিনা একবার জেনে নিলে ভালো হতো না?

আহসান সাহেবের কথায় আহান তাচ্ছিল্যে হাসি দিয়ে বলে,

– তোমাদের কি মনে হয়!তোমরা যদি এখন সাজিকে এই এনগেজমেন্টটা করতে না করো তাহলে ও শুনবে?

– অবশ্যই!

– শুনবে না!

– মানে?

– কারণ ও তোমাদের মাথা নিচু হতে দেবে না!
ইউ নো হোয়াইট চাচ্চু,সব কিছুতেই না জোড় কাটানো যায় না।সো, এখন কিছু করতে যেও না।যা করার তো করেই ফেলছো তোমরা!এখন না হয় যেটা হওয়ার কথা সেটাই হোক!

____________________

যথা সময়ে দীপ্ত গোধূলির এনগেজমেন্ট সম্পূর্ণ করা হয়।ফটোগ্রাফি ভিডিওগ্রাফি সবই করা হয়।চারদিকে সবার চোখে মুখে খুশির আমেজ।তবে এত আনন্দ উল্লাসে ভরপুর আয়োজনের মধ্যেও কারো মন বিষাদে রূপান্তরিত হয়েছে!আর কেউ প্রিয় মানুষটিকে ওই অবস্থাতে দেখে হৃদয় দহনে পুড়ছে!

গোধূলিকে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকতে দেখে লাজুক এসে জিজ্ঞেস করলো,

– গোধূলি তোর কি শরীর খারাপ লাগছে?তোকে এতটা উদাসীন দেখাচ্ছে কেন?

লাজুকের প্রশ্নে গোধূলি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,

– সেটা কি স্বাভাবিক নয় লাজুবু!মিথ্যে কৃত্রিম হাসি কতক্ষণই বা ধরে রাখা যায়!

……….

লাজুককে নীরব থাকতে দেখে গোধূলি আবারো তাচ্ছিল্যে হেসে বলে,

– তোমার কাছেও এর উত্তর নেই!

লাজুক কোনোমতে ওর কান্না সংবরণ করছে।কি বলে গোধূলিকে সান্ত্বনা দিবে ও?সত্যিই তো!ওর কাছে গোধূলির করা প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।গোধূলি যে সবার এই সিদ্ধান্তে স্তম্ভিত ব্যথিত সেটা লাজুক আন্দাজ করতে পারছে।কারণ এই এনাউন্সমেন্টে গোধূলি যতটা অবাক হয়েছে ঠিক ততটাই অবাক লাজুকও!ইনফ্যাক্ট সবাই।লাজুকের পক্ষে আর এক মুহূর্তও এইখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব না!মুখ চেপে স্টেজ থেকে নেমে চলে যায়।হয়তো সবার অগোচরে নোনা জলের বিসর্জন করতেই চলে গেছে!

– এটেনশন এভ্রিওয়ান!

স্টেজে মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকা রনিত সাহেবের দিকে সবাই তাকিয়ে আছে তিনি কি বলেন তা শুনবে বলে।

– আজকের এই আনন্দ উল্লাসে ভরপুর আয়োজনের মধ্যে আপনাদের উদ্দেশ্যে আমি আরেকটি খুশির সংবাদ ঘোষণা করতে চাই!আর সেটি হলো সামনের মাসের দশ তারিখেই আদিবাকে আমার ছেলের বউ করে আমাদের ঘরের লক্ষ্মীকে ঘরে তুলবো।

এনগেজমেন্ট পার্টিতেই রনিত সাহেব আদিবা আর রায়ানের বিয়ের ঘোষণা করায় পার্টির আনন্দের রেশ যেন আরো কয়েকগুন বেড়ে গেছে।রংবেরঙের ফানুস উড়িয়ে সারা শহর আলোয় ভরিয়ে তুলেছে।সবাই এসে রায়ান আর আদিবাকে অভিবাদন জানাচ্ছে।
সবাই যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখনই সুযোগ বুঝে গোধূলি সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে রিসোর্ট থেকে বেড়িয়ে যায়।

#চলবে…..#দীপ্ত_গোধূলি
#লেখনীতে -স্বর্ণালী তালুকদার
#পর্ব -৩৬

কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছে গোধূলি। গন্তব্য জানা নেই!যেদিকে দুচোখ যাচ্ছে সেদিকেই হেটে চলেছে।ঝলমলে চাঁদনী রাত হঠাৎ করেই অন্ধকারে ছেয়ে গেছে!ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।ক্ষনে ক্ষনেই দূরের আকাশ হতে বজ্রপাতের শব্দ শুনা যাচ্ছে।রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে মেঘের গর্জনও বেড়ে চলেছে।চারদিকে ঝড়ো হাওয়া বইছে।হিল জুতো জোড়া হাতে নিয়ে হাটতে হাটতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাটু ভাঁজ করে মাঝ রাস্তায় বসে পড়ে গোধূলি।মাথা তুলে তাকিয়ে আছে সীমাহীন ওই আকাশ পানে।মুখের উপর এক ফোঁটা বৃষ্টির পড়তেই মাথা নিচু করে নেয় গোধূলি।পুনরায় মাথা উপরে তুলে গলা ফাটিয়ে দেয় এক গগনবিদারী চিৎকার!আজ হয়তো এই প্রকৃতিই ওর সঙ্গী।ওই চাঁদহীন মেঘময় আকাশ এই বাতাস ওকে তারই জানান দিচ্ছে।প্রকৃতির বৈরী আবহাওয়া ওর কানে কানে সুর তুলে বলছে, তুমি কাঁদো,মন খুলে চিৎকার দিয়ে কাঁদো!আমরা আছি!তোমার কান্নার আওয়াজ আমাদের মাঝে বিলীন হয়ে যাবে।তোমার যত অভিযোগ উগলে দাও।উগলে দাও মনের যত ক্ষোভ আছে!কিন্তু গোধূলির তো কোনো কথাই বলতে পারছে না।সব কথা গলায় আটকে যাচ্ছে।চিৎকার করে কান্না ছাড়া আর সদকিছু যেন ভুলেই গেছে ও। তীব্রভাবে বাতাস বইতে শুরু করেছে।রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজ পাতা উড়ে এসে গোধূলির পায়ের কাছে জড়ো হচ্ছে।আকাশের বুক ছিড়ে বৃষ্টি নামবে যেকোনো সময়।চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় গোধূলি।আবারও ছুট লাগায় অজানা গন্তব্যে!মিনিট দশেক হাটার পরেই পিছনে কারো অস্তিত্ব বুঝতে পেরে থমকে দাঁড়ায় গোধূলি।বৈরী আবহাওয়ার জন্য পুরো শহর অন্ধকারে তলিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই।পিছনে ফিরে তাকায় গোধূলি।অন্ধকারে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।বিদ্যুৎ চমকাতেই আতঁকে উঠে গোধূলি।চার পাঁচটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ওর পিছনে!এরা মোটেও ভালো মানুষ না!সেটা ওদের চোখ মুখের চাহনি দেখেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে গোধূলির।ছেলেগুলোর মাঝখান থেকে একটা ছেলে বলে উঠলো,

– সুন্দরী তুমি এই মাঝরাতে একা একা কোথায় যাচ্ছো?

ওদের মাঝখান থেকেই আরেকটি ছেলে বলে উঠলো,

– আরে মামা বুঝতে পারছিস না?দেখতে পাচ্ছিস না মামুনিটা বিয়ের সাজে সেজে আছে!

– দেখে তো মনে হচ্ছে বিয়েটা না করেই আদর সোহাগ করে মাঝরাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে!

কথাটা কানে আসতেই গোধূলির মাথায় রক্ত উঠে যায়।রাগে সারা শরীর থরথর করে কাপছে। কিন্তু ও নিরুপায়।কথাগুলো হজম করা ছাড়া ওর কোনো উপায় নেই!এত গুলো ছেলের সাথে লড়াই করার শক্তি বা ক্ষমতা কোনোটাই ওর নেই।গোধূলি পিছন ঘুরে পা বাড়াতে যাবে ওমনি আরেকজন ওর পথ আগলে দাঁড়িয়ে বললো,

– তা মামুনি চললে কোথায়!আমাদেরও না হয় আদর সোহাগ করার একটু সুযোগ দাও!প্রমিজ করছি আমি নিজে তোমাকে তোমার গন্তব্যে পৌঁছে দেবো।

শিউরে উঠে গোধূলি। হাতে থাকা জুতো জোড়া বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে পাশ কাটিয়ে আবার হাটা শুরু করে দেয়।আড়চোখে পিছনে তাকিয়ে দেখে ছেলেগুলো আবারও ওর পিছু নিয়েছে।হাটার গতি বাড়িয়ে দেয় গোধূলি!কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না।জানোয়ার গুলোর সাথে কিছুতেই পেরে উঠছে না।এক সময় চোখ বুজে দৌঁড় লাগায় গোধূলি।সাথে ওই জানোয়ার গুলোও।একটা মেয়ে কখনই এতগুলো ছেলের সাথে দৌঁড়ে কুলোতে পারবে না।একজন এসে গোধূলিকে ধরে ফেলে।গোধূলির হাত ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে।গোধূলি কোনো উপায় না পেয়ে অন্য হাতে থাকা জুতো দিয়ে ওই ছেলের মাথায় আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দেয়।গোধূলির হাত ছেড়ে দিয়ে নিমিষেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মাথা চেপে ধরে বলতে থাকে,

– ও মা গো….. মেরে ফেললো গো।

অন্যছেলে গুলো এসে ছেলেটাকে মাটি থেকে তুলতে চাইলে ও রেগে গিয়ে বলে,

– আমাকে ছাড়!আগে মেয়েটাকে গিয়ে ধর।একদম ওকে ছাড়বি না!

গোধূলি নিজের করা কাজের জন্য বোকা বনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভুলেই গিয়েছিল ওকে এখান থেকে পালাতে হবে। মেয়েটাকে ধর – কথাটা কানে আসতেই আঁতকে উঠে গোধূলি।ভয়ে সারা শরীর শীতল হয়ে আসছে। হাতে থাকা জুতো জোড়া স্বশব্দে নিচে পড়তেই অদূরে বসে থাকা ছেলে গুলো উঠে দাঁড়ায়।আবারও গোধূলির দিকে এগোতে থাকে।গোধূলি কোনদিন না তাকিয়ে পিছন ফিরে আবার ছুটতে শুরু করে দেয়।খালি পায়ে এই কংক্রিটের শহরের অন্ধকার রাস্তায় গোধূলির নিজের সর্বস্ব দিয়ে কতক্ষণ এমন দিশাহীন হয়ে ছুটেছে তার কোনো হিসেব নেই।ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে।বৃষ্টিতে ভিজে পড়নে থাকা কাপড়ের ওজন বেড়ে গেছে কয়েক গুন।খুব কষ্ট হচ্ছে দৌঁড়াতে।

ছুটতে ছুটতে কারো বুকের সাথে ধাক্কা খেয়ে কিছুটা টালমাটাল হয়ে পিছিয়ে যায় গোধূলি।স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে ওর সামনে হয়তো দাঁড়িয়ে আছে ওকে তাড়া করা ওই ছেলেগুলোর মধ্য থেকেই কেউ একজন।আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে দৌঁড়ে গিয়ে তাকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে গোধূলি। গোধূলি ভুল ভেঙে গেছে!গোধূলির সামনে আর কেউ নয় স্বয়ং দীপ্তই দাঁড়িয়ে আছে।অন্ধকারে গোধূলি যেমন দীপ্তকে চিনতে পারে নি তেমনি দীপ্তও গোধূলিকে চিনতে পারে নি।আকাশে বিদ্যুৎ চমকানোর ফলেই দুজন দুজনকে দেখতে পায়।গোধূলি খুব শক্ত হাতে দীপ্তকে জড়িয়ে ধরে আছে।পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে।দীপ্ত ওর বাম হাতটা গোধূলির মাথার উপর রাখে।ধীরে ধীরে আলগা হতে থাকে গোধূলির হাত।কপাল কুঁচকে আসে দীপ্তের।মৃদুস্বরে বলে,

– গোধূলি!

..……

গোধূলি কোনো সাড়াশব্দ নেই।বুকের মাঝে গোধূলির উষ্ণ শ্বাস খুব ধীরে ধীরে পড়ছে।দীপ্ত গোধূলির দুই বাহু ধরে সোজা করে দাঁড় করায়।গোধূলি চোখ বুজে আছে।বাহুদ্বয় ছেড়ে দিয়ে গোধূলি গালে হাত রাখতে যাবে ওমনি গোধূলি ওর গা হাত পা ছেড়ে দিয়ে পরে যেতে নেয়।ভড়কে যায় দীপ্ত।কিন্তু গোধূলিকে মাটিতে পড়তে দেয় নি।মাটিতে পড়ার আগেই গোধূলিকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়।

হাটু ভাঁজ করে বসে আছে দীপ্ত।আধশোয়া হয়ে ওর কোলে শুয়ে আছে গোধূলি।দীপ্ত গোধূলির গালে হাত রেখে মৃদু নাড়া দিয়ে ডাক দেয়,

– গোধূলি!গোধূলি!এই গোধূলি!

– থ্যাংক গড।পাখিটা পালাতে পারে নি তাহলে!ও ভাই পাখিটাকে আমাদের হাতে তুলে দাও।আমরা আগে একটু যত্ন আত্তি করি!তারপর না হয় তুমি নিয়ে যেও!

ওই ছেলে গুলোর মধ্যে একজন এসে হাপাতে হাপাতে বলল কথাটা।কথাটা কানে যেতেই হাত মুষ্টি বদ্ধ করে নিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয় দীপ্ত।ওর আর বুঝতে বাকি নেই গোধূলির এই অবস্থার জন্য কারা দায়ী।

– কিরে পেলি?

আরেকজন এসে জিজ্ঞাস করলো।

– হুম!ওই যে পাখিটা আমাদের সামনেই আছে।

– তাহলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?শা*লী নিজামের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।এর মাশুল তো ওকে দিতেই হবে!নিয়ে চল শা……

ওকে পুরো কথা শেষ করতে দেয় দীপ্ত!কথাটা শেষ করার আগেই দীপ্ত তড়িৎ বেগে এসে ওর নাক মুখ বরাবর এক ঘুষি দিয়ে মুখ ফাটিয়ে দেয়।ঘটনাটা এতটাই দ্রুত ঘটেছে তাল সামলাতে না পেয়ে ছিটকে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়!নাক মুখ দিয়ে অরঅর করে রক্ত পড়ছে।

– বাস্টার্ড কি বললি তুই?আরেকবার বল শুনি।বলেই ওই ছেলেটার কলার চেপে ধরে মুখে অনবরত ঘুষি মারতে থাকে।এক সময় ছেলেটা অজ্ঞান হয়ে যায়।ওকে ছেড়ে দিয়ে অন্যজনের দিকে এগোতে এগোতে বলল,

– আর তুই কি বললি!তোকে দিয়ে দেবো!

দীপ্তের কথায় মাঝেই আরেকজন এসে বললো,

– আরে ভাই তুমি এতো হাইপার হচ্ছো কেন!বেশি না, মাত্র এক ঘন্টা!তারপর তুমি সারারাতের জ…..

ওকেও পুরো কথা শেষ করতে দেয় নি দীপ্ত।ওরা কিছু বুঝে উঠার আগেই দীপ্ত ওদের এলোপাতাড়ি পিটাতে থাকে।একে একে সবগুলো মেরে রাস্তায় ফেলে রেখেছে।পকেট থেকে ফোনটা বের করে কাউকে কল দিয়ে লোকেশন সেন্ট করে দেয়।ওদেরকে পিটাতে পিটাতে যে হাল বানিয়ে এখান থেকে এক চুলও নড়ার শক্তি অবশিষ্ট নেই।
ফোনটা পুনরায় পকেটে রেখে দৌঁড়ে গোধূলির কাছে যায়।এখনো ওর জ্ঞান ফিরে নি।বৃষ্টিতে ভিজে সারা শরীর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে।দীপ্ত আর এক সেকেন্ডও দেড়ি না করে গোধূলিকে কোলে তুলে নিয়ে হাটা শুরু করে।

ঘন্টা দুয়েক আগে______________________

গোধূলি যখন বেড়িয়ে আসে তখন দীপ্ত ওখানে উপস্থিততেই ছিল না।দীপ্তের ফোনে কল আসায় একটু দূরে চলে যায় কলটা রিসিভ করবে বলে।কারণ এখানে প্রচুর হৈ হুল্লোড় হচ্ছিল।কথা শেষ করে এসে দেখে গোধূলি ওর জায়গায় নেই।দীপ্তের মনের ভিতর ধক করে উঠে।কোনো দিক না তাকিয়ে সোজা হোটেলের রুমে চলে আসে।প্রত্যেকটা রুম তন্নতন্ন করে খুঁজে কিন্তু কোথাও গোধূলি নেই।মাথার চুল উল্টে খামচে ধরে দিশেহারার মতো করিডরে পাইচারি করছে দীপ্ত।বুঝতে পারছে না কি করবে।হঠাৎ করেই আলিফ আলবীকে এইদিকে আসতে দেখে দীপ্ত ছুটে গিয়ে ওদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে হাটু ভাঁজ করে বসে পড়ে,অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে জিজ্ঞাস করে,

– গোধূলিকে দেখেছিস?

– হে তো!

চমকে উঠে দীপ্ত।তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

– ক্ কোথায়?

আলিফ সাবলীলভাবে জবাব দেয়,

– সবাই যখন ফানুস উড়াচ্ছিল তখন আমি,আলবী ফানুস উড়ানোর জন্য ছাদে গিয়েছিলাম।তখন সাজিবুকে দেখলাম গেইট দিয়ে বেড়িয়ে যেতে।আলবীও দেখেছে।তাই না রে আলবী।

দীপ্ত আলবীর দিকে তাকাতেই,

– হে দীপ্ত ভাইয়া আমিও দেখেছি।আর আমরা এটা বলল বলেই নিচে যাচ্ছিলাম।

দীপ্ত বুঝতে পারছে গোধূলি ঠিক কতটা অভিমান নিয়ে এখান থেকে বেড়িয়ে গেছে।আলিফ আলবীকে জড়িয়ে ধরে দীপ্ত বলল,

– তোরা কাউকে কিছু বলিস না।অনেক চকলেট দেবো তোদের!

– ঠিক আছে দীপ্ত ভাইয়া।

রিসোর্ট থেকে বেড়িয়ে আসে দীপ্ত। কাউকে কিছু বলে আসে নি।শুধু আহানকে বলে এসেছে সবটা সামলে নিতে।আর গোধূলির কথা কেউ জিজ্ঞাস করলে যেন বলে,ও দীপ্তের সাথেই আছে!

চৌরাস্তাটার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্ত।কোন রাস্তায় গোধূলি যেতে পারে বুঝতে পারছে না।সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে দীপ্তের।ধপ করে হাটু ভাঁজ করে বসে পড়ে মাঝরাস্তায়।নির্লিপ্তভাবে সামনের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে ছিল।হঠাৎ করেই ল্যাম্পপোস্টের আলোয় কিছু একটা ঝিলিক দিয়ে উঠে!দীপ্ত হামাগুড়ি দিয়ে ওটা হাতে নিয়ে দেখে,এটা তো কানের দুল!হ্যাঁ এটা গোধূলিরই! আজকে এটা গোধূলি কানে দেখেছে ও।কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই দুল পাওয়া রাস্তাতেই হাটতে শুরু করে দীপ্ত।

আর এইদিকে অন্ধকারে গোধূলিকে যখন ওই ছেলেগুলো তাড়া করেছিল তখন গোধূলি বুঝতে পারে নি যে,ও আবার উল্টো পথেই দৌঁড়াচ্ছে।উল্টো পথে দৌঁড়াচ্ছিল বলেই দীপ্তের সাথে ওর ধাক্কা লাগে আর দীপ্তও ওকে পেয়ে যায়।

#চলবে

.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here