গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৮
,
,
,
,
,
,
পুরো রাত জেগে কাজ কমপ্লিট করলো সাদ। নিজের সাথে আরো কয়েকজনের ঘুম হা*রা*ম করে চেয়ারে গা এলিয়ে ঘড়ির দিকে তাকলো। ঘড়িতে তখন সাড়ে চারটা। চোখ বুজে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো।
____
সকালে সাজিকে পরীক্ষা কেন্দ্রে ড্রপ করে দিয়ে সোজা অফিসে চলে গেলো সাদ। কনফারেন্স রুমে মিটিং এরেন্জ করা হয়েছে। সাদ কনফারেন্স রুমে সবাইকে আসতে বলে নিজেই কেবিনে বসে রইল।
এই দিকে রায়হান নিজের মাথা নিজে ফা*টা*নোর উপক্রম।
সাদ প্রায় মিনিট বিশেক পর বিন্দাস হয়ে হেলে দুলে কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করলো।
রায়হান AK কম্পানির এমডির দিকে তাকিয়ে দুঃখজনক হাসি হাসলো। এমডি রাগে গজগজ করছে।
সাদ ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজেদের প্রোজেক্ট পুরোটা ডিসক্রাইভ করতে লাগলো।
সাদের এই হেয়ালিপনা দেখে দরদর করে ঘামছে রায়হান। স্যার কি করছে এইটা! ম্যানেজারের বাচ্চা এতক্ষণে ওই খা*টা*সের বাচ্চা চেয়ারম্যানকে সব বলে দিয়েছে নিশ্চই! হে আল্লাহ বাঁচাও।
এই দিকে ম্যানেজার বাঁকা হেসে মোবাইল নাড়াচাড়া করছে।
সাদ পুরো প্রোজেক্ট হেয়ালিপনা দিয়ে বুঝানোর পর ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো। দুই আঙ্গুলের মধ্যে কলম ঘুরিয়ে টেবিলে রাখলো। রায়হান সাদের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,, স্যার কি করছেন?
সাদ দুই ভ্রু নাচিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,, পোলাইটলি ডিল ছেড়ে দিচ্ছি। মুখের উপর মিটিং ক্যানসেল করলে খারাপ দেখাবে।
রায়হান কাশতে কাশতে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।
সাদ AK কম্পানির এমডিকে উদ্দেশ্য করে বলল,, তা মিস্টার নাইম ডিল ফাইনাল করবেন?
নায়িম জোর পূর্বক হেসে বলল,, অফকস হোয়াই নট!
সাদ দুই আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে বলল,, সাইন করার আগে পেপার পড়ে নিন। এর পর ভেবে বলবেন।
নাইম পেপার পড়ে হাত মুঠ করে ফেললো। পেপার খুবই স্পষ্ট করে লেখা আছে, ইনভেস্ট করার পর সকল প্রকার সমস্যা কিংবা লোকসান হলে সব কিছুর দায়ভার AK কম্পানি বহন করবে।
সাদ বাঁকা হেসে বলল,, চলুন ডিল ফাইনাল করি।
নাইম দাঁতে দাঁত চেপে বললো,, হোয়াট ইজ দিস মিস্টার সাদ?
সাদ সোজা হয়ে বসলো, বোতলের ঢাকনা খুলে পানি পান করে বোতল টেবিলের উপর রেখে রায়হানের দিকে ঢাকনা দিয়ে বললো,, রায়হান বোতলের ঢাকনা লাগাও তো,আমি পারছি না।
রায়হান ঢাকনা তড়িৎ গতিতে হাতে নিয়ে বোতলে আটকালো।
নাইম রেগে টেবিলে হাত থা*ব*ড়ে বললো,, আর ইউ ম্যাড অর হোয়াট?
সাদ বাঁকা হাসলো,
,, মিস্টার নাইম ! আমার সামনে গলা উঁচু করে কথা বললেই আমার মেজাজ বি*গ*ড়ে যায়। সেখানে আপনি হাত থা*ব ড়ে কথা বলছেন! ভেরি ইম্প্রেসিভ।
সাদ এক ভ্রু উঁচিয়ে পুনরায় বললো,,আপনি জানেন আপনার অবস্থা টাইটানিক জাহাজের মতো হয়ে আছে, তাও এতো তেজ কোথা থেকে আসে?
নাইম দাঁতে দাঁত চেপে বললো,, কি বলতে চাইছেন?
,, খুব সহজ একটা কথাই বলতে চাইছি।
বোতলের ঢাকনা লাগানো খুবই সহজ কাজ, কিন্তু আমি সেটা আমার পিএকে দিয়ে কেন করাচ্ছি!
কি বোকার মতো কাজ তাইনা?
এইটা কেউ দেখলে আমাকে বলবে আমি ঘাস খেয়ে একটা কম্পানির এমডি পদে দায়িত্ব পালন করছি। আসলে কি বলুন তো! এই দুইদিন আপনার মতো লোকের কথা ভাবতে ভাবতে আমিও আপনার মতো হয়ে গেছি। পুরাই ব্রেইন লেস ফেলো।
তা না হলে ভেবে দেখুন না! আপনাদের কম্পানির সাথে মিটিং ফিক্সড করি? তাও আবার এতো বাকোয়াছ বাজেট নিয়ে!
যেখানে আপনার কোম্পানীর অবস্থা খা*রাপের চাইতেও খারাপ।
তার উপর যেখানে কম্পানির পেছনে আমার ছোটাছুটি করার কথা, সেখানে আপনারা ছুটছেন। আমার কম্পানিতে ইনভেস্ট করার এতো সখ যে লোন নিয়েছেন তার উপর নিজের বাড়ি বিক্রি করে ইনভেস্ট করছেন? ও মায় গড এতো ভালোবাসা? সে যাইহোক এই ভালোবাসার জন্য মিথ্যা তথ্য দেয়ার অপরাধটা ক্ষমা করে দিলাম।
নাইম রেগে উঠে দাঁড়ালো। তার সাথে তার পিএ আর ম্যানেজারও দাঁড়িয়ে গেলো। তাদের অবস্থা যু*দ্ধে*র ময়দান থেকে পা*লি*য়ে যাওয়া সিপাহীর মতো হয়ে আছে।
সাদ গুরুত্ব সহকারে ফাইল দেখতে দেখতে বললো,, এখনো সময় আছে। চলুন ডিলটা সাইন করেই ফেলি।
এতো অপমানের পর ডিল তো দুরের কথা কেউ মুখ ওবদি দেখাতে চাইবে না। তাই নাইম রেগে হনহন করে বেরিয়ে গেল। তার সাথে বেরিয়ে গেলো তার দুই সিপাহী।
রায়হান মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যানেজার নিজেও অবাক। তবে সেটা চেহারায় ফুটিয়ে তুলতে নারাজ। এতো চাল চেলেও ঠিক ফল পেলো না সে। তার সব চালের উপর সাদের ছোট একটা চালও ভারী পড়বে। তাই উঠে নিজের কেবিনে চলে গেল।
সাদ রায়হানের তাকানো দেখে গলা খাকিয়ে বললো,, এইভাবে তাকাচ্ছো কেন? অড লাগছে। চোখ ঠিক করো।
,, লাগলে লাগুক। তবে আজ আমি আপনার উপর ফিদা স্যার। মেয়ে হলে হাত ধুয়ে আপনার পেছনে পড়ে যেতাম। প্রয়োজনে কিডন্যাপ করে কাজি অফিসে নিয়ে যেতাম।
সাদ গলার টাইয়ের নট ঢিলে করে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,, যার এমন করার কথা সেই পাত্তা দিচ্ছে না।
,, কিছু বললেন স্যার?
রায়হানের কথায় হকচকিয়ে গিয়ে বললো,, হুম! চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলতে হবে । সেটাই বলছিলাম। তুমি বরং ফাইল গুলো একবার চেক করে আমার কেভিনে নিয়ে এসো। আর হ্যা! এই AK কম্পানির সাথে আমাদের কম্পানির কোনো সম্পর্ক যেন না থাকে।
,, ঠিক আছে স্যার।
সাদ কেবিনে ঢুকে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো। কপালে হাত রেখে রাতের কথা ভাবছে। AK কোম্পানির ডিটেল্স বের করা সাথে চেয়ারম্যানকেও ঠিক করা সব মিলিয়ে একটা রাত নির্ঘুম পার করা। আপাতত চোখ বুঝলেই যেন শান্তি। এই ব্যাস্ততম জিবনে একরত্তি সুখ চায় সাদ। কিন্তু বাবার মৃ*ত্যু*র পর পরই জিবনটাত কোলাহল বেড়ে গেলো। প্রতিটা পদে ভ’য়ং’ক’র সব পরীক্ষা দিতে হয়েছিল তাকে। সেই পরীক্ষা গুলো থেকে শিখেছে আপন,আর পর শব্দের পার্থক্য।
সাদ এখন বুঝতে পারছে তার বাবা ঠিক কি ভাবে সামলাতো সবটা। কাজে সময় দিতে দিতে নিজের খেয়াল ওবদি রাখতো না। শুধু টাকার পেছনে ছুটেছে, নিজের শ্রম দিয়ে উপার্জন করে সবাইকে মাথা উঁচু করে বাঁ*চা*র রাস্তা করে দিয়েছে।
নিজের বউ ,বাচ্চার থেকেও আত্মীয় স্বজনের জন্য করেছে বেশি। কিন্তু দিন শেষে তু*চ্ছ তা*চ্ছিল্য ছাড়া কিছুই পায়নি সেই তথাকথিত আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে।
সাদের চোখের কোনে জমে থাকা জল গড়িয়ে পড়লো। মনে পড়ে গেল সেই দিনের কথা, যেই দিন সাদের বাবা মা*রা গেছিলো। ঘুমের মধ্যেই ব্রে*ন স্ট্রো,ক করে মা*রা গেছিলো। সবাই তার বাবাকে দেখতে এসেছে কম , বরং তার মাকে বাবার মৃ*ত্যুর জন্য দায়ী করতেই এসেছিল বেশি।
স্বামী ভক্ত স্ত্রীকে তার স্বামীর মৃ*ত্যু*র জন্যই দায়ী করে গেছিলো সবাই। একজন স্ত্রী, যে সবে মাত্র তার সর্বস্ব হারিয়ে বিছানায় পড়ে আছে তাকে ওবদি ছা*ড়ে*নি ওই মানুষ গুলো।
একেতো বাবার মৃ*ত্যু দ্বিতীয়ত তার মায়ের উপর লাগা অপবাদ সব মিলিয়ে বি*ভৎ*স দিন ছিল সাদের জন্য। সেই বি*ভৎ*স সময়টাতে তার পাশে বন্ধু কিংবা বাবার প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো জুবায়ের। সেই দিন গুলোতে ছোট মামা নামক মানুষটা না থাকলে যে কি হতো তা ভেবে পায় না সাদ। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চোখ মুছে নিলো।
মোবাইল বের করে সময় দেখে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট গুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলো। এর মধ্যে রায়হান কিছু ফাইল এনে সাইন করিয়ে পুনরায় বেরিয়ে পড়লো।
সাদ আসফাস করতে করতে চেয়ার ছেড়ে কোট গায়ে দিয়ে মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আপাতত তার একরত্তি শান্তি দরকার। সেই শান্তি খুঁজতে বেরিয়ে পড়লো।
সাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রায়হান তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো,, আর কতকাল এইভাবে নিজেকে আড়াল করে রাখবেন স্যার! এইবারতো সেই রমনিকে বুঝতে দিন আপনার তাকে ঠিক কতটা প্রয়োজন।
____________
গাড়িতে বসে বার বার সময় দেখছে সাদ। ছুটি হতে আরো বিশ মিনিট বাকি আছে। গাড়ির স্টেয়ারিংএ ঘু*সি মে*রে দাঁত কিড়মিড় করে বললো,সময় যাচ্ছে না কেন!! রাগে কোট টাই খুলে গাড়ির পেছনে ছুড়ে মারলো। শার্টের হাতা গুটিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে রায়হানকে কল দিয়ে জরুরি তলব করলো।
রায়হান বেচারা বুঝতে পেরে গেছে আজ তার তেরোটা বাজবে। তাড়াতাড়ি উবার ডেকে বেরিয়ে পড়লো। আপাতত ম্যামের কলেজের সামনেই তার লোকেশন সেট করা।
সাদ গাড়ির ব্যাক সিটে বসে আছে। ড্রাইভিং সিটটা আজ রায়হানকে দেওয়া হয়েছে। সাদ ঘড়ি দেখে সামনে তাকায়।
সাজি হাঁসি মুখে হেলে দুলে আসছে। ঠোঁটে লেগে থাকা চওড়া হাসি বলে দিচ্ছে আজ তার পরীক্ষা ফাটাফাটি রকমের ভালো হয়েছে।
সাজি আসছে দেখে রায়হান মাথা নিচু করে হাসলো। স্যারে নীড় এলো বলে।
গাড়ির ভেতরে উঁকি মেরে রায়হানকে দেখে মুখ বেঁকিয়ে বললো সাজি,, কি ব্যাপার! চেলা এসে গেছে কিন্তু আজ গুন্ডা কই গেলো? রায়হান ভাই! সত্যি করে বলেন ঘটনা কি?
রায়হান ঠোঁট কামড়ে হাসি আটকাতে ব্যাস্ত।
,,”চেলা আজ ড্রাইভ করবে তাই সামনে বসেছে। আপাতত গুন্ডা পেছনের সিটে বসেছে। তাকে দেখতে হলে আপনাকে পেছনের সিটে এসে বসতে হবে ম্যাম।” দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো সাদ।
সাদের গলা শুনতেই পেছনের সিটের দিকে তাকিয়ে জমে গেলো সাজি। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। ঢোক গিলে রায়হানের দিকে অসহায় দৃষ্টি ফেললো।
রায়হান ইশারায় বুঝালো”ভ’য়ং’ক’র রেগে আছে। তাড়াতাড়ি উঠে বসুন।”
সাজি কাঁদো কাঁদো মুখ করে পেছনের সিটে বসে পড়লো। সাদের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই। তাই হাতের নখ দেখছে ।
*
,,” শোনো রায়হান বেশি তাড়াহুড়ো করে গাড়ি চালানোর দরকার নেই আস্তেধীরে চালাবে। আমি এখন ঘুমাবো । বাই এনি চান্স তোমার জন্য যদি আমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, তো ম্যানেজার আর তোমাকে দুটোকেই একসাথে নর্দমার পানিতে ডু*বি*য়ে মা*র*বো।
সাদের কথায় রায়হান বুঝে গেলো তাকে কি করতে হবে। কিন্তু সাজি ভয়ে ভয়ে হাত-পা কাঁপা কাঁপি অবস্থা।
সাদ পায়ের জুতা মোজা খুলে নিলো। অতঃপর সাজির কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মে*রে সুয়ে পড়লো।
সাদের এমন কাজে চমকে উঠলো সাজি। হৃদস্পন্দন তড়িৎ গতিতে বেড়ে গেছে। ঢিবঢিব শব্দ বাইরে ওবদি শুনা যাচ্ছে। হয়তো সাদ ভাইও শুনে ফেলছে! অস্বস্তিতে নড়েচড়ে সাদের মাথা সরাতে গেলেই ধমকে উঠলো সাদ।
,, আর একবার নড়াচড়া করবি থা*প্প*ড় মে রে দাঁত ফে*লে দিবো। তোর জন্য আমি কাল থেকে আজ ওবদি ঘুমোতে পারিনি। তাই আমার ঘুম না হওয়া ওবদি বসে থাকবি। আর হ্যা !এইটা একটু আগে করা অপরাধের শাস্তি। শুধু নড়ে দেখ তোকেও রায়হানের সাথে ডু*বি*য়ে মা*রবো।
রায়হান মুখ টিপে হেসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তার স্যার সুধরাবে না। খামোখা মাসুম মেয়েটাকে ভয় দেখাচ্ছে। যা বলে তা করতে গেলে সবার আগে নিজেই হা*র্ট ফে*ইল করবে।
সাদের ধমক শুনে সোজা হয়ে বসে আছে সাজি। লোকটাকে তার চিনতে বাকি নেই।যা বলে তা করেই দম নিবে। আপাতত চুপ থাকাই শ্রেয়। নয়তো থা*প্প*ড় খেয়ে নর্দমায় পড়তে হবে।
হাত গুটিয়ে বাইরের দিকে চোখ রাখলো সাজি। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে তাকাবে না এই লোকটার দিকে।
সাদ চোখ বুজে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে কোমলমতি গলায় বলল,, প্লিজ সাজঁবাতি মাথায় হাত বুলিয়ে দেনা একটু, প্রচন্ড ব্যাথ্যা করছে। একটু ঘুম দরকার।
চমকালো সাজি। চমকে উঠে সাদের দিকে তাকালো। চেহারা মলিন হয়ে আছে। সাদ ভাইয়ের এমন গলা শুনে বুকটা ধ*ক করে উঠল।রাগী গম্ভীর লোকটা ভালো নেই। কি হয়েছে তার? আজ হঠাৎ এমন আচরণ? এই ভাবে তাকে একটুও মানায় না। অদ্ভুত খা*রাপ লাগা ঘিরে ধরলো সাজিকে। তার খারাপ লাগার সাথে সাদ ভাইয়ের এই কোমলমতি গলায় করা আবদার ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত।
আলগোছে সাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো সাজি। সাদের মুখের আদলে তাকিয়ে এক অদ্ভুত মায়া অনুভব করলো। টেনে নিঃশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলে উঠলো,, সুস্থ হয়ে উঠুন সাদ ভাই। আপনাকে এইভাবে মোটেও ভালো লাগছেনা। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,,
(ভুল গুলো সুধরে দিবেন। )গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৯
,
,
,
,
,
,
সাজির পরীক্ষা শেষ হলো আজ দুদিন। শুধু একটা ব্যবহারিক পরীক্ষাই বাকি । যদিও সেটা নিয়ে তেমন একটা মাথা ব্যাথ্যা নেই। তাই সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছে। তার সাথে যোগ দিয়েছে রেনুর দুই ছেলে মেয়ে রাফি আর চাঁদ। নামের মতই তার ছেলেমেয়ে দুটো সুন্দর।
দুইজনই সাজিকে খুব পছন্দ করে। রাফির বয়স পাঁচ হলেও সে পাকনা বুড়োর মতো কথা বলে। চাঁদ সবে হাঁটতে পারে আর আধো আধো বুলিতে কথা বলে। সব মিলিয়ে সাজির দিন ভালোই কাঁটছে।
সকাল হতে না হতেই সেঁজুতি হাসান তড়িঘড়ি করে ব্যাগ প্যাক করতে লাগলো। সাজি আধ খোলা চোখ কচলাতে কচলাতে মায়ের ঘরের দিকে যায়।
সেঁজুতি একপ্রকার কাঁদতে কাঁদতে ব্যাগে জামা কাপড় নিচ্ছে।
সাজি মায়ের কান্নায় বিচলিত হয়ে ছুটে গেলো।
,, কি হয়েছে আম্মু? কাঁদছ কেন??ব্যাগ গুলোই বা নিচ্ছো কেন?
সেঁজুতি কান্নারত গলায় বলল,, তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নে। তোর দাদীর অসুস্থ তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
সাজি কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। দাদী ভক্ত নাতনী সাজি।
বাড়িতে গেলেই দাদির আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ানোই তার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। রাতে দাদিকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমালে দাদি বাড়ি যাওয়াটা বৃথা মনে করে সাজি।
তেমনি সাজির দাদি জুবায়েদা খাতুনও সাজিকে চোখে হারায়। তার ছোট ছেলে জুবায়েরের একমাত্র মেয়ে বলে কথা। সাজির নামটাও তিনি রেখেছেন।বড্ডো বেশি আদর করেন তিনি। বাড়ি গেলেই সাজিকে বুকে জড়িয়ে চুপটি করে বসে থাকতেন। সাজি আসার সময় লুকিয়ে চুরিয়ে সাজির হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতো,, সেঁজুতিকে বলবিনা বুড়ি। বললেই নিয়ে যাবে। এই গুলো দিয়ে ফুচকা কিনে খাবি ঠিক আছে!
দাদির কথা গুলো মনে করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সাজি। তাড়াতাড়ি করে ব্যাগে জামা কাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বোরখা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লো।
সেঁজুতি হাসান রেনুকেও নিয়ে নিলো সাথে করে। একা বাড়িতে রেনু আর তার বাচ্চাদের রেখে যাওয়া মোটেও ঠিক না। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে কি ভাবে থাকবে! এই ভেবেই তৈরি হতে বললো।
,
,
এই দিকে অনিলা রহমান কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। সাদ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বললো,, আর কতো কাঁদবে মা! নানুর তেমন কিছু হয়নি তো। যাষ্ট প্রেশার লো হওয়াতে অ*জ্ঞান হয়ে গেছে।
অনিলা রহমান ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললো,, তোর মা সুস্থ আছেতো তাই বুঝতে পারছিস না।
সাদ চুল ঠিক করতে করতে বিরবির করে বলে উঠলো,, ইন্টারন্যাশনাল ইমোশনাল ব্ল্যা*ক*মে*ইল করছে। না জানি মামুনির কি অবস্থা।
সাদ সাজিদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো।
দুইবার হর্ন দিতেই দারোয়ান গেইট খুলে দিলো।
সেঁজুতি কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে উঠে বসলো। তার সাথে রেনু আর তার দুই বাচ্চা।
সাজি ইতি মধ্যে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে। গুটি গুটি পায়ে সামনের সিটে বসে পড়লো।
একটা গাড়িতে সাদ আর রেনুর দুই বাচ্চা ছাড়া চার মহিলাই গুনগুনিয়ে কাঁদছে। সাদ লম্বা দম নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তাড়াতাড়ি এই চার নারীকে নানু বাড়ির সামনে ঢেলে দিয়ে আসলেই মুক্তি।
*
*
জুবায়েদা খাতুন সোফায় বসে টিভি দেখছে। আর কিছুক্ষণ পর পর চানাচুর মুখে পুরে চিবোচ্ছে। আজ অনেক দিন পর মনে হচ্ছে জিবনে একটা ভালো কাজ করেছে।
জুবায়েদা খাতুনের পাশে বসে আছে তার বড় ছেলের বউ রাজিয়া। জুবায়েদা খাতুন মেয়ে আর ছোট ছেলের বিয়ে নিজে পছন্দ করে দিয়েছেন। তবে বড় ছেলেটা নিজের পছন্দ মত বিয়ে করে।
পছন্দের বিয়ে বলেই বড় ছেলে ঠকে গেছে বলে মনে করেন জোবায়েদা খাতুন।
“বউ না এনে সাক্ষাৎ রিনা খান নিয়ে এসেছে আমার হাবলা ছেলেটা!” আড় চোখে রাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো জুবায়েদা খাতুন।
চানাচুর মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে রাজিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,, মুখটা বাংলার পাঁচ করে বসে আছো কেন? যাও রান্না ঘরে যাও! আমার দুই মেয়ে আর নাতি নাতনি আসছে। খাতিরদারিতে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে। এমন ভাবে আপ্যায়ন করবে ঠিক যেমনটা তোমার মা বোন আসলে করো। রান্না গুলোও যেন তেমন মজা হয়।
রাজিয়া দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বললো,, বুড়ি সুধরাবে না। নিজের মিথ্যা রো*গের কথা রটিয়ে পুরো গুষ্টি ডেকে আনছে। এখন আমাকেই সবার কাজের বেটি হতে হবে।
জুবায়েদা খাতুন আড় চোখে রাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,, আমাকে মা*রা*র প্ল্যান না করে। রান্না বসাও আর হ্যা আমার নাতিটা ঝাল খেতে পারে কম। সব রান্নায় মরিচের পরিমাণ কম দিবে।
রাজিয়া জোর পূর্বক হেসে বলল,, ঠিক আছে আম্মা।
রাজিয়া চলে যেতেই জুবায়েদা খাতুন মুখ বেঁকিয়ে বললো,, এমন ভাবে বলছে যেন এই আম্মাকে মনে মনেও আম্মা ডাকে। নাতি নাতনি গুলোর জন্য ,নয়তো আমার আনিসকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে দিতাম। রিনা খানের বংশধর কোথাকার। আমার সাজানো সংসারটাকে ছি*ন্ন*ভি*ন্ন করে আমার স্বামীর ভিটেমাটি কামড়ে বসে আছে।
____________________
সাদ গাড়ি থামাতেই অনিলা রহমান, সেঁজুতি আর সাজি দৌড়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো। রেনু চোখ মুছে সাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,, ভাইয়া এইটা কার বাড়ি?আর কার কি হয়েছে?
সাদ কয়েক সেকেন্ড অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,, সত্যি জানিস না?
রেনু চাঁদকে কোলে নিতে নিতে বলল,, না ভাইয়া। শুধু খালাম্মা বলেছে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে তাইতো তৈরি হয়ে চলে এসেছি।
সাদ দুই আঙ্গুলে কপাল ঘষতে ঘষতে বলল,, তাহলে কাদছিস কেন??
,, খালাম্মা আর আপা কাঁদছিল তাই।
সাদ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, রাফি আর চাঁদকে নিয়ে ঘরে যা। আমি ব্যাগ গুলো নামিয়ে আসছি।
,, ভাইয়া আমি সহ নেই,?
,, দরকার নেই। তুই ঘরে গিয়ে রাফিকে সাজির কাছে দিয়ে চাঁদকে বিছানায় সুইয়ে দে।
রেনু মাথা নেড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো। সাদ ভাই রাগি হলেও তার বাচ্চা দুটোকে খুব আদর করে।প্রতিবার আসার সময় দুইটার জন্য চকলেট কিনে আনে। তাইতো শতবার ধমক দিলেও মন খারাপ করেনা রেনু। ভয় পেলেও শ্রদ্ধাটা মন থেকেই করে।
*
বাড়ির ভেতরের দৃশ্য অন্যরকম। জুবায়েদা খাতুন মেয়ে,বউ আর নাতনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। চোখ মুছে খুশির ঝিলিক দেখা যাচ্ছে। চেহারায় অসুস্থতার রেশ মাত্র নেই। তার ঠিক সামনে বসে আছে রেনু। তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। বরং সে জুবায়েদা খাতুনের দিয়ে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সাদ ব্যাগ পত্র নিয়ে সোফায় বসলো।
শার্টের বোতাম দুটো খুলে বুকের ভেতর ফু দিতে দিতে জুবায়েদা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলল,, বুড়ি এতো নাটক করার কি দরকার ছিল? খামোখাই তিন রমনীর চোখের পানি গুলো অপচয় হলো।
জুবায়েদা খাতুন টিপ্পনি কেটে বললো,, তিনজনের চিন্তাই করছিস! নাকি একজনের কথা ইঙ্গিত করে বলছিস ভাই?
নানির কথা শুনে কাশি উঠে গেলো। সাদ কাশতে কাশতে তাড়াতাড়ি উঠে বাইরের দিকে চলে গেলো। নানি তার একটু বেশিই চালাক। ওইখানে বসে থাকলে বে*ফাঁ*স কথা বার্তা দিয়ে এতো বছরের লুকিয়ে রাখা সব কিছু ফাঁ*স করে দিবে নিশ্চিত। সাথে মান সম্মান সব যাবে।
*
*
*
সেঁজুতি আর অনিলা, রাজিয়ার সাথে হাতে হাত মিলিয়ে রান্নার কাজ করছে।
জুবায়েদা খাতুন প্রথমেই ঘোষণা করে দিয়েছে,রেনু এই বাড়ির মেহমান তাই এই বাড়িতে তার কাজ করা নিষেধ । এতে সবাই সহমত পোষণ করলো। আপাতত রেনু তার মেয়ে চাঁদকে ঘুম পাড়াতে ব্যাস্ত।
সাজি রাফিকে নিয়ে বাড়ির উঠোনে লাগানো গাছ গুলো দেখছে। আর অপেক্ষা করছে কখন ইরিনা আসবে।
ইরিনা সাজির জেঠাতো বোন। তার জেঠার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে নাম ইহান আর মেয়ের ইরিনা। ইরিনা সাজির এক বছরের ছোট হলেও ইহান গুনে গুনে সাজির দুই বছরের বড়।
সাদ তার বড় মামা আনিসের সাথে বাজারে গেছে। মায়ের আদেশ তাই এক মাত্র ভাগ্নেকে নিয়ে বাজার করার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল।
বাজার শেষে দুইজন বাড়ি ফেরে। দুই হাতে ব্যাগ আর ব্যাগ ভর্তি বাজার। এলাহি কারবার সব।
বাড়ির উঠোনে সাজিকে দেখেই আনিস ডাক দিলো। বাজারের ব্যাগ গুলো কাজের লোকের কাছে দিয়ে হাত খালি করলো ততক্ষণে।
সাজি জেঠুর ডাক শুনেই ছুটে এলো।
আনিস পকেট থেকে চকলেট বের করে সাজির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,
,, এইগুলো আমার মায়ের জন্য।
সাজি খুশিতে গদগদ। তার জেঠু সেই ছোট বেলা থেকেই তার জন্য এমন করে চকলেট নিয়ে আসে। জেঠু বাইরে থেকে ফিরেছে মানেই তার পকেটে ভর্তি চকলেট।
চকলেট গুলো নিয়ে মুচকি হেসে বলল,, তুমি কখনোই ভুলো না জেঠু। সব সময় কি ভাবে মনে থাকে?
আনিস সাজির মাথায় হাত বুলিয়ে মুচকি হেসে বলল,, সময় আর সম্পর্ক যেমনই হোক।কিছু জিনিসের কথা কখনোই ভোলা যায় না মা।
সাজি মনিল হেসে আনিসকে জড়িয়ে ধরলো। আনিস দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সাজির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,, মন খারাপ করিস না মা। হাসি খুশি থাক।
আনিস যেতেই সাজি দুটো চকলেট রাফির দিকে এগিয়ে দিলো।
রাফি চকলেট গুলো নিয়ে ঘরে চলে গেল।
এতক্ষণ পেছনে দাঁড়িয়ে সব কিছু শুনছিলো সাদ। তার বড় মামার কথার অর্থ বুঝতে দেরী হলো না।লোকে বলে” সংসার সুখে হয় রমনীর গুনে।” কিন্তু কিছু রমনীর করেন সংসারের সুখ ধুলিসাৎ হয়ে যায়। তার একটা জলজ্যান্ত প্রমাণ তার বড় মামুনী।
সাজি চকলেটের প্যাকেট খুলে মুখে পুরবে এমন সময় সাদ চকলেট কেড়ে নিয়ে নিজের মুখে পুরে দিয়ে বললো,, একা একা আর কতো খাবি! আশে পাশে মুরুব্বি আছে তাদেরকে সাধলেও তো পারিস।
সাজি থমথমে খেয়ে বললো,, আপনি!
সেই দিনের গাড়ির ঘটনার পর থেকে সাজি সাদের দিকে সরাসরি তাকায়নি। সাদের দিকে তাকাতেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়।সাদ ঘুমের ঘোরে সাজির হাত জড়িয়ে ধরে কিছু বুলি আওড়ালো। যা শুনেই চমকেছিলো সাজি। নিজের মনকে বুঝিয়েছিলো ভুল শুনেছে কিন্তু মস্তিস্ক মানতে নারাজ। সব মিলিয়ে বি*শ্রী একটা অবস্থা। তাইতো সাদের থেকে নিজের অবাধ্য নজর লুকাতে ব্যাস্ত সাজি।
,, হ্যা আমি! কেন তুই আর কাকে আশা করেছিস? বাই এনি চান্স ইহানকে নয়তো?
সাজি আমতা আমতা করে বলল,, না মানে তা বলিনি।
,,না বললেই ভালো। বাইদা ওয়ে তোকে ইহানের আশে পাশে যেন না দেখি। ইহান থেকে দুরে থাকবি।আই হোপ বুঝিয়ে বলতে হবে না।
সাজি মাথা নেড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সাদ ইহানকে পছন্দ করে না। কি সেই কারন আজ ওবদি খুঁজে পেলো না সাজি । তবে সব সময় সাদ ভাইয়ের মুখ থেকে একটা কথাই শুনেছে, “” ইহান থেকে দুরে থাকবি”।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,,
(ভুল গুলো সুধরে দিবেন।)