গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:২৫(১ম খন্ড)
শপিং মলের সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লো সাদ। পুরো মার্কেট ঘুরে ঘুরে চারটা শাড়ি কিনলো। একটা মায়ের জন্য, একটা মমতাময়ী মামুনীর জন্য আর দুইটা সাজির।সাজির জন্যে কেনা শাড়ি দুটোর সাথে ম্যাচিং করে চুড়ি , ঝুমকো নিলো। রায়হান সাদের সাথে হেঁটে হেঁটে তার শপিং করা দেখছে এতক্ষণ। চুড়ি আর ঝুমকো কেনার সময় রায়হান হেসে কুটিকুটি হওয়ার অবস্থা। সাদ একটা একটা করে ঝুমকো হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ড করে চোখ বুজে রাখছে। রায়হান এই ভেবে হাসছে তার স্যার ঝুমকো পরিহিতা ম্যামকে কল্পনা করেই শপিং করছে। রায়হানের দাঁত কে*লা*নো দেখে সাদ দাঁতে দাঁত চেপে শাসালো । কিন্তু তেমন একটা কাজ হলো না। রায়হান বে*সরমের মতো হেসেই চলেছে। শেষে সাদ রায়হানের উপর গিবআপ করে দিলো।সাদ জানে এখন হাজার বকলেও কাজ হবেনা। সাদের কেনাকাটা শেষ হতেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
শহর জুড়ে সন্ধ্যা নেমেছে । শহরের মানুষ গুলোর নীড়ে ফেরার ভীষণ তাড়া। গাড়ি গুলো একটা অন্যটাকে ওভারটেক করে ছুটে চলেছে। সাদ বাইরের দিকে তাকিয়ে ভীষণ বিরক্ত হলো। এমন করে ড্রাইভ করলে হয়তো সময় বাঁচবে ঠিকই, কিন্তু একটু এদিক ওদিক হলে জিবন হা*রাবে। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে মোবাইলে চোখ রাখলো সাদ।
বেশকিছুটা সময় পর রায়হান হুট করেই গাড়ি থামিয়ে দিলো। সাদ মোবাইলে দিকে চোখ রেখে বলল,, কি হলো গাড়ি থামালে কেন?
রায়হান সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,, স্যার আমাদের সামনের দুটো গাড়ির সামনেরটা এক*সি*ডেন্ট করেছে ।
সাদ তৎক্ষণাৎ মুখ তুলে সামনে দিকে চাইলো।
~ কি ভাবে কি হয়েছে?
~ একটা ট্রা*ক এসে পাশ থেকে মে*রে দিয়েছে। ড্রাইভারের স্পট ডে*থ আর যে দুইজন মহিলা ব্যাকসিটে ছিলো তাদের অবস্থা মনে হয় তেমন ভালো না। বাঁ*চ*বে কিনা সন্দেহ।
~এক*সিডে*ন্ট হয়েছে কতক্ষনে!এখনো কোনো এ*ম্বু*লেন্স এলো না কেন। রায়হান আমি বের হচ্ছি তুমি গাড়ি সামনে নাও। বাই এনি চান্স এ*ম্বু*লেন্স আসতে দেরি হলে আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাবো।
সাদ চিন্তিত ভঙ্গিতে মোবাইল হাতে নিয়ে তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। রায়হান সাদের কথায় হা সূচক মাথা নেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
সাদ দৌড়ে এগিয়ে গেলো। মানুষের ভিড় ঠেলে গাড়ির সামনে দাড়াতেই থমকালো সাদ। গাড়িটা তার খুব বেশি পরিচিত। এই গাড়ির নাম্বার প্লেটের নাম্বারটা সাদ হাজার বার দেখেছে যার দরুন এই নাম্বারটাও মুখাস্ত। সাদ কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে কাঁপা কাঁপা পায়ে গাড়ির কাছে যেতেই চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে উঠলো। গাড়ির সামনের পাশটা চ্যা*পটা হয়ে গেছে। যা দেখার পর যে কেউ বলবে ড্রাইভারের স্প*টডে*থ হওয়াটা স্বাভাবিক ।
সাদ উ*ন্মা*দের মত জানালার কাঁচে আ*ঘা*ত করতে লাগলো। সাদের এমন পা*গ*লামো দেখে একটা ছেলে এসে ইট দিয়ে বাড়ি মে*রে গাড়ির জানালার কাঁচ ভে*ঙ্গে দিলো।
সাদ মোবাইলের ফ্লাশলাইট অন করে গাড়ির ভেতরে তাকাতেই চুপসে গেল। সেকেন্ডের মধ্যে বুকটা ভারি হয়ে এলো। মনে হচ্ছে কেউ গ*লা চে*পে ধরে রেখেছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। সাদের চোখ বেয়ে জল উপচে পড়ছে।কাঁপা কাঁপা হাতে অনিলা রহমানের র*ক্তা*ত্ত মাথায় হাত রেখে ধীর গলায় ডাকলো ,, ম,মা!
অনিলা রহমান নিভু নিভু চোখে সাদের দিকে তাকালো। অনিলা চোখ দিয়ে ইশারা করে সাজিকে দেখালো। সাজি মাথা চু*ই*য়ে র*ক্ত পড়ছে যা অনিলা রহমানের ধুসর রঙের শাড়ি র*ক্তি*ম বর্ণ করে দিয়েছে। সাজির দিকে তাকাতেই ঠোঁট কামড়ে কা*ন্না আটকালো সাদ। যাদের ঘিরে তার সাজানো পৃথিবী তাদের এই অবস্থায় দেখে সাদ কি করবে বুঝতে পারছে না।দাঁত মুখ খিচে গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করছে কিন্তু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। কয়েকজন লোক মিলে দরজা খোলার জন্য টা*না হে*ছ*ড়া শুরু করে দিয়েছে। সবাই চাইছে বাকি দুজন যেন বেঁ*চে ফিরে। তাই যে যার মতো চেষ্টা করে যাচ্ছে।
রায়হান সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছুটে এলো। গাড়ির ভেতরে থাকা মানুষ গুলোকে দেখে পা জোড়া বরফের ন্যায় জমে গেলো। সাদের মতো রায়হান নিজেও স*কের মধ্যে আছে।
এম্বু*লেন্স আসতেই কিছু ছেলে মিলে রাস্তা ক্লিয়ার করে দিলো। অনেক চেষ্টার পর গাড়ির দরজা খুলতে পেরেছে। অনিলা রহমানের সেন্স থাকলেও সাজি সেন্সলে*স,পালস্ রেটো ধীরে ধীরে কমে আসছে। অনিলা রহমানকে এম্বুলেন্সে তোলা হলো। সাদ পুরোই হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়েছে। পা*গ*লের মতো একবার এম্বুলেন্সের কাছে যাচ্ছে, আবার গাড়ির কাছে যাচ্ছে ।
সাজিকে এ*ম্বু*লেন্সে তোলার পর রায়হান সাদকেও তাদের সাথে দিয়ে দিলো। ড্রাইভারকে এখনো গাড়ি থেকে বের করা যায়নি। ড্রাইভারকে বের করার চেষ্টা চলছে। রায়হান ড্রাইভারের ডিটেল্স দিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
সাদ এম্বুলেন্সে ভেতরে অনিলা রহমান আর সাজির হাত ধরে ছোট বাচ্চাদের মতো ডু*ক*রে কাঁ*দছে। খুব প্রিয় দুটো মানুষকে এই অবস্থায় দেখে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা সাদ। অনিলা রহমানের চোখের কোন বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। ক*ষ্টের ছাপ চোখে মুখে স্পষ্ট। বারবার সাদকে কিছু বলতে চেয়েও পারছেনা।
রায়হান স্পিড বাড়িয়ে এম্বুলেন্সের সামনে গিয়ে রাস্তা ক্লিয়ার করতে লাগলো। মনে মনে শুধু একটাই দোয়া দুইজনের যেন কিছু না হয়। দুইজনের মধ্যে একজনের কিছু হলে সাদ কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না। তার বাঁ*চা দু*স্কর হয়ে পড়বে। তাই রায়হান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছে দুইজনেই যেন সুস্থ হয়ে ফিরে।
পাঁচ মিনিটের রাস্তা সাদের কাছে পাঁচ ঘণ্টার মতো লাগছে। বার বার ড্রাইভারকে স্পিড বাড়াতে বলছে।
গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:২৫(২য় খন্ড)
এশার নামাজ শেষ করে জায়নামাজে বসে আছে সেঁজুতি। চোখ মুছে জায়নামাজ গুটিয়ে উঠে পড়লো। জুবায়েরের ফোন এখনো ওবদি বন্ধ। লোকটাকে সেঁজুতি চেনে যার দরুন ফোন বন্ধ দেখে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে । দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে তাকালো সেঁজুতি। ঘড়িতে তখন আটটা বেজে বিশ মিনিট,মেয়েটা ফুপ্পিকে পেলে ঘরদোর ভুলে বসে।না জানি কোথায় কোথায় ঘুরতে গেছে। কল না দিলে আজ ফিরবেই না। সেঁজুতি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে অনিলার নাম্বারে ডায়েল করলো। কল গেলো না বরং একজন নারী ভরাট কন্ঠে বলছে” ডায়েলকৃত নাম্বার এই মুহূর্তে বন্ধ আছে”। বিরক্তে সেঁজুতির ললাট কুঁচকে এলো। বিড়বিড় করে বলে উঠলো,, মেয়েটা আপার মোবাইলটা রাখলো না।ছবি তুলে তুলে চার্জ সব খেয়ে ফেলেছে। আজ ঘরে আসুক!ঘুরাঘুরি বের করবো।
রেনু চাঁদকে কোলে নিয়ে নিচে নামতেই সেঁজুতি বিড়বিড় করে বলা কথা গুলো শুনে ফেললো।
চাঁদকে সোফার উপর বসিয়ে সেঁজুতি শিয়রে বসে বললো,, খালা এতো টেনশন কিসের? ড্রাইভারকে কল দিলেই হয়। সাজি আপা নিশ্চই ড্রাইভারের মোবাইল দিয়ে ছবি তুলবে না!
রেনুর কথা শুনে সেঁজুতি খুশিতে রেনুর হাত ধরে গদগদ কন্ঠে বললো,,রেনু তুই পড়ালেখা করলে শিওর কোনো সিক্রেট ইন্টেলিজেন্ট টিমের হেড হতি। এতো বুদ্ধি তোর।
রেনু সেঁজুতির কথা পুরো না বুঝলেও তাকে বুদ্ধিমতী বলেছে এইটা ঠিকই বুঝেছে।তাই দাঁত বের করে হেসে উঠলো।
সেঁজুতি ড্রাইভারের নাম্বারে কল দিবে এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠল। সেঁজুতি মোবাইল রেখে বললো,, কল দিতে হবেনা। চলে এসেছে যা গিয়ে দরজা খোল।
সেঁজুতির কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই রেনু হড়বড়িয়ে দরজার কাছে চলে গেলো। তড়িগড়ি করে দরজা খুলে হা করে তাকিয়ে রইল রেনু।
সেঁজুতি রেনুর ছুটাছুটি দেখে বরাবরের মতো মাথা চাপড়ালো।
রেনু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে সামনাসামনি কখনো না দেখলেও অনেকবার ভিডিও কলে দেখেছে। যার দরুন চিনতে অসুবিধা হলোনা। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা আর কেউ না সাজি আপার বাবা।
জুবায়ের রেনুকে অবাক হতে দেখে বললো,, কি হয়েছে রেনু?
রেনু তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,, খালু !খালাম্মা আপনার জন্য টেনশন করছে আর আপনি মোবাইল না ধরে বাড়িতে চলে এসেছেন?আজ আপনার খবর আছে।
রেনুর কথা শুনে জুবায়ের শব্দ করে হেসে উঠলো।
সেঁজুতি ঠিকই বলেছে,রেনু অন্য সবার থেকে আলাদা। সরল মনের অধিকারী মেয়েটা।
সেঁজুতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। রেনু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কি করছে সেটাই বুঝতে পারছে না। সেঁজুতি চাঁদের হাতে মোবাইল ধরিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। রেনুকে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,, রেনু! তুই মানুষ হবি না। দরজার সামনে দরজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে মানুষ ঘরে ঢুকবে কি করে?
সেঁজুতির গলা পেয়ে রেনু সরে দাঁড়ালো। জুবায়ের মুচকি হেসে সেঁজুতির দিকে তাকিয়ে আছে। সেঁজুতির কোনো নড়চড় নেই। সেঁজুতি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইতিমধ্যে চোখ জোড়া অশ্রু জলে শিক্ত হয়ে উঠেছে, শুধু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়।
জুবায়ের তার প্রেয়সীর অভিমানী চোখ জোড়ার অভিমান পড়তে দেরি হয়নি। জুবায়ের সেঁজুতির সামনে দাঁড়াতে সেঁজুতি হাউমাউ করে কেঁ*দে জুবায়েরের বুকে ঝাঁ*পি*য়ে প*ড়লো।
রেনু দরজা আটকে চাঁদকে কোলে নিয়ে মুচকি হেসে রুমে চলে গেল।
সেঁজুতি কাঁ*দতে কাঁ*দতে হেঁচকি উঠে গেছে। জুবায়ের সেঁজুতির মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করতে করতে বললো,, এতো কাঁদলে আসলাম কেন? তোমার মেয়ে রে*গে*মে*গে একাকার!মেয়ে বউকে কেন দেখতে আসলাম না। এখন এসে যখন এইসব দেখছি তখন থাকার মানেই হয় না। ছাড়ো চলে যাচ্ছি।
~~~~
সাজি আর অনিলার অবস্থা ক*রুণ। হাসপাতালে আনার পর পরই পরীক্ষা নীরিক্ষা শুরু হয়।,সাজির মাথায় আ*ঘা*তটা গ*ভীর। মস্তিষ্কের র*ক্ত*ক্ষ*রন হলে কর্টেক্স এবং ব্রেন স্টোম সম্পর্ন ভাবে ন*ষ্ট হয়ে ব্রেন ডে*ড হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাছাড়া সাজির একটা পা বা*জে ভাবে ফ্রে*ক*চার হয়েছে । সাজির অতিসত্বর সার্জারি দরকার।। অন্যদিকে অনিলা রহমানের মাথার ডান পাশ দরজার সাথে জোরে বা*ড়ি খাওয়ার দরুন থেঁ*ত*লে গেছে,সার্জারিতে দেরী হলে ওনার একটা চো*খ কর্মক্ষমতা হারাবে বলে ধারণা করছে, সাথে ডান হাতে ফ্রে*কচার হয়েছে। সব মিলিয়ে দুইজনের অবস্থান শো*চ*নীয়।চিফ সার্জন দুইজনের ইসিজি রিপোর্ট এবং এক্স-রে দেখে OT-1 আর OT-2 তাড়াতাড়ি রেডি করার জন্য বলেছে।
সব শোনার পর সাদ বুঝতে পারছিলো না কি করবে। সাদ কোনো প্রকার ফর্মালিটি পূরন না করেই বসে ছিল। সাদকে হাসপাতালের ফর্মালেটি পুরন করতে বলার পর সাদ তার ক্রেডিট কার্ড আর পিন নাম্বার দিয়ে সরে আসে। সাদের অবস্থা বুঝতে পেরে রায়হান সকল প্রকার ফর্মালিটি পুরন করে দেয়। রায়হান জানে এই মুহূর্তে সাদের কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই।
OT-1 আর OT-2 মুখামুখী, দুইরুমে দুইজনের অপারেশন চলছে। সাদ মাঝখানে করিডোরে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর ডুকরে কেঁদে উঠছে। ঠিক কি করা দরকার, কোথায় গেলে সব ঠিক হবে সেটাই বুঝতে পারছেনা সাদ। নিজের মাথার চু*ল নিজে টা*নছে বসে বসে।
রায়হান সাদের মোবাইল নিয়ে সরে এসে মোবাইলে লক খুললো। রায়হান জানে সাদ ওই অবস্থায় নেই যে ফোন করে সবটা জানাতে পারবে। রায়হান কনট্রাক নাম্বার গুলো থেকে মামুনী লেখা নাম্বারটা খুঁজে নিয়ে ডায়েল করলো।
সেঁজুতি তখন চোখ মুছে জুবায়েরকে কিছু বলতে নিবে তার আগেই মোবাইল ফোন বে*জে উঠলো। সেঁজুতি ফোন হাতে নিয়ে দেখে সাদের নাম্বার থেকে কল এসেছে।
সেঁজুতি তড়িগড়ি করে করে মোবাইল রিসিভ করতেই।অপর প্রান্ত থেকে রায়হান বলে উঠলো,,
ম্যাম আমি সাদ স্যারের পিএ রায়হান বলছি।
সেঁজুতি ভ্রু কুঁচকে বললো,, সাদের পিএ? সাদ কোথায়?
সেঁজুতির কথা শুনে জুবায়ের মোবাইল হাতে নিয়ে লাউড স্পিকার অন করলো।
রায়হান কয়েক সেকেন্ড থেমে বললো, উনিও আছে। কিন্তু কথা বলার অবস্থায় নেই। আপনারা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসুন।
রায়হানের কথা কথা কর্ণগোচর হতেই সেঁজুতি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,, হাসপাতালে মানে? ক
কি হয়েছে সাদের?
জুবায়েরের উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল,, কথা বলছনা কেন রায়হান! সাদ ঠিক আছে?
রায়হান ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বললো,, স্যার ঠিক আছে, কিন্তু স্যারের মা আর সাজি ম্যাম ঠিক নেই। ওনাদের এ*ক্সি*ডেন্ট হয়েছে। আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন প্লিজ!
রায়হানের কথা শুনে সেঁজুতি বোবা চোখে জুবায়েরের দিকে তাকালো। মুখ খুলে কিছু বলতে নিয়েও বলতে পারলো না। কেউ যেন গ*লা চে*পে ধরে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। জুবায়ের নিজেকে সামলে দাঁত মুখ শক্ত করে লাউড স্পিকার বন্ধ করলো। অতঃপর রায়হানের কাছ থেকে হাসপাতালে ঠিকানা জেনে নিলো। সেঁজুতি আ*হা*জারি করে কাঁ*দছে।কি থেকে কি হচ্ছে মাথায় ধরছে না। সেঁজুতির এমন আ*হাজা*রিতে রেনু হড়বড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সেঁজুতি বুক থা*ব*ড়ে চিৎ*কার করে কাঁ*দছে। জুবায়ের চোখ মুছে সেঁজুতিকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। রেনু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চাঁদকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। রেনুর কান্না দেখে রাফি আর চাঁদ কান্না শুরু করে দিলো।
ঘন্টা পার হয়েছে অপারেশন থিয়েটার থেকে এখনো বেরোয়নি ডাক্তাররা। শুধু দুই জন নার্স বেরিয়ে দুই ব্যাগ রক্ত নিয়ে আবার ভেতরে চলে গেলো।
সেঁজুতি ইতিমধ্যে দুইবার সে*ন্সলে*স হয়ে গেছে। জুবায়ের না নিজেকে সামলাতে পারছে না সেঁজুতি আর সাদকে পারছে।
রায়হান অফিসে কল দিয়ে সবটা জানিয়ে দিলো।
সাদ নিঃ*প্রাণ প্রায়। দৃষ্টি জোড়া স্থির হয়ে গেছে সেই কখন। এখনো ওবদি চোখের পলক ফেলেনি। সেই নিঃপলক চোখ জোড়া থেকে অনবরত নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। একটা ঘন্টা পার হয়নি সাদের মনে হচ্ছে যেন একশত বছর পার হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা কি স্থির হয়ে আছে!না কি ঘড়ি সময় ভুল বলছে! বুঝে পায় না সাদ, আর না সেটা বুঝার সেই ক্ষমতা আছে এখন। সাদের কাছে মনে হচ্ছে রাত গভীর নয় বরং দীর্ঘ হচ্ছে। চারজন মানুষের দীর্ঘ শ্বাস যেন এই দীর্ঘ রজনীতে বি*ষাদের সুর গাইছে। সাদ জানে এই বি*ষা*ক্ত রজনী আজ দীর্ঘ হবে,এই অপেক্ষার রজনী আজ দীর্ঘ হবে। এমন দীর্ঘ রজনী যেন কারো জিবনে না আসুক। যে রজনী প্রিয় মানুষ হা*রা*নোর ভ*য়ে পার করতে হবে সেই দীর্ঘ রজনী যেন কারো জিবনে না আসুক।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,
(ভুল গুলো সুধরে দিবেন।)গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:২৬
সেই বি*ভী*ষিকাময় দীর্ঘ রজনীর প্রভাব এতোটাই প্রখর ছিলো যে প্রতিটা মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে। বদলে গেছে ড্রাইভারের পরিবারের জিবন।
বদলে গেছে সাজিকে ঘিরে থাকা আর সবার জিবন।
সেই রাতে প্রায় চার ঘণ্টা পর অনিলা রহমানকে সাকসেসফুলি OT থেকে বের করা হয়। ডাক্তার অনিলা রহমানকে ২৪ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। তখনও সবাই থমথমে অবস্থায় বসে ছিল। অনিলা রহমানের জন্য খুশি হবে নাকি সাজির জন্য দুঃ*খ প্রকাশ করবে কিছুই কারো বোধগম্য হলো না।
সাদ ধীর পায়ে উঠে মায়ের শিয়রে বসলো। অনিলার পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ আর ডান হাতে প্লাস্টার করা। সাদ মায়ের দিকে তাকিয়ে আলতো হাতে মায়ের মুখে হাত ছুঁইয়ে ডুকরে কেঁ*দে উঠলো। বাবার পরে এই একজনই আছে যার কোলে মাথা রেখে জগতের সব সুখ দুঃখ প্রকাশ করা যায়। আর সে কিনা তাকে ছেড়ে যেতে চাইছে! সাদ মায়ের বাম হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,, সবাই কেন আমাকে একা করে দিতে চায় মা? কেন সবাই একা করে দিতে চায়?সাদ ছোট বাচ্চাদের মতো করে কাঁদতে শুরু করলে ডাক্তার এসে সাদকে বাইরে নিয়ে যায়।
অনিলার সার্জারিতে চার ঘণ্টা লাগলেও সাজির সার্জারির সময় কাল ছিলো দীর্ঘ। OTথেকে ডাক্তার বের হওয়ার পর সাদ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে ডাক্তারের চেহারার দিকে তাকিয়ে ছিল। না হাসি, না আত্মবিশ্বাস আর না ছিলো সফলতার ছিটে ফোটা, যা ছিল তা এক রাশ হতা*শা ব-ই কিছুই না। জুবায়ের হড়বড়িয়ে ডাক্তারের সামনে গেলেও সাদ থেমে থাকা পা জুগল বাড়ালো খুব বেশি ধীর গতিতেই। সাদ জানে কিছুটা সময় পর ডাক্তারের বলা কথা তাকে ভে*ঙ্গে গু*ড়ি*য়ে দিবে।
জুবায়ের উদ্বিগ্ন হয়ে ডাক্তারের কাছে সাজির কথা জিজ্ঞেস করতেই ডাক্তার চশমা খুলে মাথা নিচু করে ফেললো। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো,, ডাক্তাররা কখনোই চায় না অপারেশন থিয়েটার থেকে হ*তা*শ হয়ে বের হতে। আমরা সব সময় চাই আমাদের কাছে আসা প্রতিটি পেশেন্ট সুস্থ সবল হয়ে ফিরুক। আজকেও তাই চেয়েছিলাম। আমরা আমাদের বেস্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছি। বাট ২৪ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞা*ন না ফিরলে কো*মা*য় চলে যাওয়ার সম্ভবনা বেশি। আপাতত ICU তে শিফ্ট করা হবে।প্লিজ প্রে ফর ইউর ডটার ।
দীর্ঘ সাত ঘণ্টা পর সাজিকে OT থেকে ICU তে শিফ্ট করা হয়। সাজির অবস্থার কথা শোনার পর জুবায়েরের কাঁ*দতে শুরু করলেও অন্যদিকে সেঁজুতি অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে পড়ে। তবে সাদের তেমন একটা ভাবাবেগ হলো না। সাদ জানে ডাক্তারের কথায় ঠিক কতটুকু সত্যতা ছিলো।
ভারোরের আলো ফুটতেই ড্রাইভারের ম*রা দে*হ তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘরে তার একমাত্র মেয়ে ছাড়া কেউই ছিলনা, আর না আছে দুকুলে কেউ। ড্রাইভারকে দা*ফ*ন করার পর তার মেয়েটাকে রায়হান সাথে করে সাজিদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় সাদ।
দা*ফ*ন শেষে হাসপাতালে ফিরে আসে জুবায়ের আর সাদ। ততক্ষণে অনিলার জ্ঞান ফেরে। কিন্তু সাজির জ্ঞান ফেরার অপেক্ষার সময় ২৪ ঘন্টা গড়িয়ে বারো মাসে পদার্পন করলো। সেইদিন মায়ের শিয়রে বসে কেঁদেছিলো সাদ এরপর আর একবারও চোখের জল ফেলেনি। বরং তার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হলো। তার সাথে দীর্ঘ হলো চেহারার মলিনতা।
অনিলা রহমান পুরোপুরি সুস্থ হতে হতে দুমাসের ও বেশি সময় লেগেছে। তখনও সাজি নি*র্জী*ব হয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল তার শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রক্রিয়া ভেন্টিলেশনে মধ্যেই চলছিলো । এইদিকে আত্মীয় স্বজনদের অপ্রাসঙ্গিক কথা বার্তার ফলে জুবায়ের সবার প্রবেশ এই বাড়িতে নি*সি*দ্ধ করে দেয়।কারন তাদের কথা শুনে শুনেই সেঁজুতি অ*সুস্থ হয়ে পড়ে। অনিলা রহমান সেঁজুতির অবস্থা দেখে নিজ বাড়ি ছাড়লেন।তিনি জানেন এখন সেঁজুতির পাশে তাকেই দাঁড়াতে হবে। অনিলা রহমান তার বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে জুবায়েরের বাড়িতে এসে উঠলেন।
সেঁজুতি সাজির ফেরার আশায় ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলো। সাজির মুখ চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুহাত তুলে মেয়েটার সুস্থতার দোয়া কামনা করতে ভুললো না সেঁজুতি।
সবার জিবনের গতি সময়ের সাথে বাড়লেও সাদ সেই রাত্রিতেই আটকে রইলো।বছর পেরুতে দেরী নেই তবে একটা বছর সাদকে কেউ হাসতে দেখেনি না দেখেছে কারো সাথে প্রাণ খুলে কথা বলতে।
সেই দিনের থেকে প্রায় একমাস পর সাজিকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে শিফ্ট করা হয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সাজির প্রয়োজনীয় সব ইকুইপমেন্ট বাড়িতে আনা ব্যবস্থা করে সাদ। সাথে একজন নার্স রাখা হয়েছিল।
যদিও সেই নার্সের সময়কাল একমাসের বেশি স্থায়ী হয়নি।সাজির বেডশিট চেন্জ করার সময় ভুল বসতো সাজির হাতে চাপ লাগে,যা দেখে সাদ পুরোবাড়ি মাথায় তুলে ফেলে ।পরে সাদ নিজেই তাকে বের করে দেয়।
এই একটা বছরে সেঁজুতি অবাক নয়নে শুধু মাত্র সাদের কার্যক্রম দেখে আসছে। সেঁজুতি সব দেখে অবাক হলেও অবাক হলোনা জুবায়ের। জুবায়ের জনে সাদ সাজির ক্ষেত্রে ঠিক কতটা ডেস্পারেট।
সাজির এই অবস্থা সাদের জিবনে কঠিন প্রভাব ফেলেছে। এখন সাদ অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া কারো সাথেই কথা বলেনা। না ঠিক করে কারো দিকে তাকায়। সাদের গম্ভীর মুখায়বব দেখে কেউ দুইকথা বলার সাহস করে উঠে না। রায়হান মাঝে মাঝে সাদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।সাদকে এইভাবে দেখতে তার খুব বেশিই কষ্ট হয়।
অফিসে থাকা অবস্থাতেও সাজিকে দেখতে ভোলে না সাদ। সাজির সেফটির জন্য সাজির পুরো রুম জুড়ে ক্যামরা লাগানো হয়েছে। যার দরুন অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে মোবাইল কিংবা ল্যাপটপ দুটিতেই সাজিকে মনিটর করে সাদ।
তাছাড়া অফিস থেকে যতক্ষনেই ফিরুকনা কেন,নিয়ম করে সাজির পাশে বসে ঘন্টা খানেকের গল্প জুড়ে দেওয়া তার রেগুলার রুটিনের মধ্যে অন্যতম একটি কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়ম করে নিজের ইচ্ছে, অনিচ্ছে,ভালো লাগা মন্দ লাগা সবটাই সাজির কাছে ব্যাক্ত করে সাদ। সাদ জানে না এই অপেক্ষার সময় ঠিক কতোটা লম্বা হবে। শুধু জানে সে অপেক্ষা করবে।তার সাজবাতির জন্য অপেক্ষারত থাকবে সাদ। হোক না পুরো জিবন।
_____
ভোরের আলো ফুটতেই বেরিয়ে পড়লো। অফিসের কাজে শহরের বাইরে যেতে হবে।যার দরুন রায়হান সহ ভোরেই রওনা দিলো। জানালার কাঁচ ভেদ করে বাইরে দৃষ্টি রাখলো সাদ। বসন্ত ঋতু আগমন ঘটেছে আজ অনেক দিন। বছর খানেক আগেও ছিল বসন্ত। তবে সেই বসন্তে আর আজকের বসন্তের পার্থক্য অনেক। সেই বসন্ত ঋতুর পুরোটা সময় জুড়ে সাদের কাছে সাজি ছিলো। প্রানচ্ছল সাজিঁ ,যে স্থীর হয়ে এক জায়গায় থাকতো না। কিন্তু এই বসন্তে সাজি প্রাণচ্ছল নয় বরং ঘুমন্ত। যার ঘুম আধো ভা*ঙ্গ*বে কিনা সন্দেহ। সাদ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে দৃষ্টি সরিয়ে ফাইল গুলো চেক করতে লাগলো।
রায়হান সাদের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো, তার স্যার যে ভালো নেই,একদম ভালো নেই।
অফিসের কাজ শেষ করে গাড়ি নিয়ে বাড়ির গেইটে প্রবেশ করতেই সাজিঁর ডাক্তারের গাড়ি দেখতে পেলো।সাদ যতক্ষনে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে ততক্ষণে গাড়িটা নাগালের বাইরে চলে গেল। রায়হানকে গাড়ি থামাতে বলে তৎক্ষণাৎ ডোর আনলক করে বেরিয়ে হড়বড়িয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো। সবাই সাজির রুমের বাইরে জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।
রেনু সাদকে দেখে মুচকি হেসে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো। ইতিমধ্যে ঘেমে গেছে সাদ। কপালে হাত দিয়ে ঘাম মুছে নিলো। অতঃপর ধীর পায়ে রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো।সবাই সাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার মধ্যে বোহু প্রতিক্ষিত একজোড়া চোখ সাদকে দেখছে। সেই চোখ জোড়া দেখে থমকালো সাদ। কথা বলার শক্তির সাথে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছে।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,
(