নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৩৯
জুবায়ের চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভাবীর দিকে তাকালো। রাজিয়া সেই কখন থেকে আসফাস করে যাচ্ছে।কিছু বলবে বলবে ভাব, কিন্তু ঠিক যেন সুযোগ হয়ে উঠছে না। ভাবীর এমন আচরণ দেখে জুবায়ের ইশারায় সেঁজুতিকে মায়ের কাছে যেতে বলে। সেঁজুতি প্রথমে মানা করে,পরে ঠিকই চলে যায়। সেঁজুতি ডাইনিং রুম ছেড়ে বের হয়ে যাওয়ার পর রাজিয়া মুখ খোলে। মিনমিনে গলায় বলল,, বিয়েটা সত্যি হবে? জুবায়ের চায়ের কাপে আরেক চুমুক দিয়ে গলা খাকিয়ে বললো,, জ্বী ভাবী আপনারা গোছগাছ করে কালকে আপার বাড়িতে চলে যাবেন। আপার শ্বশুর বাড়ির দিক থেকে মনে হয় শুধু ছেলে মেয়েরা আসবে। আমার ধারণা বড় কেউ আসবে না। আপনারা গেলে আপার মনে জোর পাবে।আমি মাকে বলেছি আপার কাছে গিয়ে থাকতে।
রাজিয়া মুচকি হেসে বলল ঠিক আছে ভাই তুমি যা বলো। কিন্তু,,,
জুবায়ের ভাবীর মুখে কিন্তু শুনে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো। জুবায়ের চাইছে ভাবীর মুখে এমন কিছু না শুনুক যাতে করে ভাবীর প্রতি থাকা সম্মান টুকু
ক্ষুন্ন হয়।চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বললো,, কিন্তু কি ভাবী?
রাজিয়া একটা চেয়ার টেনে বসলো। আশেপাশে তাকিয়ে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,, আমার মনে হয়না সাদের সাথে সাজি মায়ের বিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে। দেখো ভাই তুমি আমার কথা শুনে কি মনে করবে তা আমি জানি না। তবে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেও উচিত হয়নি। তোমার এক মেয়ে, তারউপর জায়গা-জমি,টাকা পয়সা তো আর কম নেই!বিদেশেও শুনলাম কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।সব কিছু তো সাজি পাবে। যে কেউ টাকার জন্য তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে। সাদ যে এই সব দেখে বিয়ে করছে না তার কি গেরান্টি? হতে পারে সাদের এমন কোনো উদ্দেশ্য আছে?
ভাবীর এমন মন্তব্যে জুবায়ের অবাক হলো না। জুবায়ের আগ থেকেই আন্দাজ করেছে রাজিয়া এমন কিছুই বলবে।যদিও মনের মধ্যে একটা ক্ষীন আশা ছিল ,তার ভাবী বদলেছে। এখন খারাপ লাগছে এই ভেবে এতো বছর হলো,মহিলাটা না বদলেছে ,না মানুষ চিনতে শিখেছে। এই মহিলার জন্য ভাইয়ের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। ভাতিজা ভাতিজির সাথেও দূরত্ব তৈরি হয়েছে। একটা মহিলা পুরো একটা সংসার শেষ করে খান্ত হয়নি।বয়সের সাথে তার বিধ্বংসী জগন্য রূপটা আরো বেশি বেড়ে গেছে। আগে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতো আর এখন সরাসরি বলছে। জুবায়ের জানে কি করে এই মহিলাকে দমাতে হবে তাই স্বভাব সুলভ মুচকি হেসে বলল,, তা থাকতেই পারে ভাবী তবে কি বলুন তো! আমার অবস্থা আগের মতো নেই। কোটি কোটি টাকা লস হয়েছে। সেই ক্ষতিপূরণ দিতে গিয়ে জায়গা জমি অনেকটা বিক্রি করে দিয়েছি। আপাতত বাড়ি আর গাড়িটা ছাড়া তেমন কিছু নেই। বরংচ সাদের একটা ভালো চাকরি আছে। অন্তত আমার মেয়েটাকে খাওয়াতে পরাতে পারবে। তাই সাদের কাছে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছি।
রাজিয়া জুবায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে বললো,, কি বলছো ভাই? ব্যবসায় লস? কিভাবে?
জুবায়ের বেদনাদায়ক হাসি দিয়ে বলল,, মেয়েটা অসুস্থ থাকা কালীন দেশে ছিলাম সেই জন্য।
আফসোসের চাইতে রাজিয়ার চেহারায় খুশিটা বেশি লক্ষ্য করছে জুবায়ের। রাজিয়ার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মনে মনে খুশির জোয়ারে ভাসছে রাজিয়া।জুবায়ের নিচের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো,, এখনো ওরমই আছো ভাবী। অন্যের সুখে নজর দিতে দিতে নিজের সংসারের কি হাল করেছো তুমি? না জানি আমার ভাইটা কি ভাবে সব সয্য করছে।
রাজিয়া আফসোস করে বললো,,থাক ভাই টেনশন করো না। আল্লাহ সব ঠিক করে দিবে।
জুবায়ের মাথা নেড়ে বললো,, হ্যা ভাবী উনিই একমাত্র ভরসা।
রাজিয়া চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে আফসোস করতে করতে কিচেনের দিকে গেলো। রাজিয়া যাওয়ার পর জুবায়ের হেসে উঠে বললো,, এখনো সেই পরশ্রীকাতরতা! কবে ভালো হবে তুমি!
অনিলা মায়ের জামা কাপড় গুছিয়ে নিচ্ছে। অন্যদিকে ইরিনা সেঁজুতিকে নিজের রুমে নিয়ে গেছে। আজ সে তার দাদির সাথে ফুপ্পির বাড়ি যাবে। সেই সুবাদে ব্যাগ প্যাক করা। ইরিনার মতে চাচির পছন্দের সাথে কারো পছন্দের তুলনা হয় না।বিয়েতে যা পরবে তা চাচি পছন্দ করে দিতে হবে। সেঁজুতিও আহ্লাদে আটখানা হয়ে ইরিনার সাথে গেলো। ইহানকে খুব একটা পছন্দ না করলেও ইরিনা সেঁজুতির অল টাইম ফেবারিট। সেঁজুতির মতে ইরিনা পুরোটাই তার বাবার মতো। শান্ত,ভদ্র আর সাফ দিলের।
আনিস জুবায়েরকে বিয়ের ডেকোরেশনের খরচাপাতির হিসেব করে দিচ্ছে। দুই ছেলের পাশে বসে জুবায়েদা খাতুন সবটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।
রাজিয়া সবাইকে একপলক দেখে জুবায়েদা খাতুনের রুমের দিকে গেলো। যেখানে অনিলাকে একা পাওয়া যাবে। অনিলা শাড়ি গুলো ভাঁজ করে ব্যাগে পুরে নিলো। রাজিয়া ধীর পায়ে রুমে ঢুকে বিছানার কোন চেপে বসে। অনিলা রাজিয়ার এমন চিকন চালচলন দেখে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, কিছু বলবে ভাবী?
রাজিয়া চোরা চোখে চারদিকে তাকিয়ে শান্ত হয়ে বসে। মুচকি হেসে কটুক্তি করে বলল,, শুনলাম জুবায়েরের ব্যাবসায় হেবি লোকসান হয়েছে! দেশের সব জায়গা-জমি বিক্রি করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।
অনিলা রাজিয়ার মুখে এইসব কথা শুনে চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,, ওমা তাই নাকি? কই আমিতো শুনলাম না!
অনিলার কথা শুনে রাজিয়ার চোখ মুখ চকচক করে উঠলো। এই বুঝি বিয়ে ভাঙ্গার অ*স্ত্র পাওয়া গেছে।রাজিয়া চোখ মুখ শক্ত করে বললো,, দেখো অনিলা আমার মনে হয় লোকসানের কারনে তোমার ছেলের ঘাড়ে তার মেয়ে চা*পিয়ে দিচ্ছে। তা না হলে তার আগেতো এইসব কথা বলেনি! স্বার্থের জন্য এখন তোমার ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে। ভেবেছে ছেলের ভালো চাকরি আছে নিজে না পারলে কি হয়েছে, সাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে সব সমস্যা শেষ। তোমার ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে চিন্তা মুক্ত হচ্ছে।
অনিলা রাজিয়ার মুখে দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অনিলার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে এই মহিলার সংসারের আধা ভার জুবায়ের বহন করে। অনিলা চাইলে অনেক কিছু বলতে পারতো কিন্তু আনিসের কথা ভেবে চুপ রইলো। ভাবীর সাথে সম্পর্ক যেমন হোক না কেন অনিলা আর জুবায়ের আনিসকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে। তারা জানে আনিস মাটির মানুষ তার মতো বড় ভাই পাওয়া মুশকিল।
অনিলা বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে রাজিয়া দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। রাজিয়া এই বিয়েতে মোটেও খুশি নয়,তা তার হাবভাব দেখে বুঝেছিলো ঠিকই। এখন তো পুরো পুরি শিওর রাজিয়া বিয়ে ভাংতে উঠে পড়ে লেগেছে। অনিলা কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে বিছানার উপর থেকে ব্যাগ নিচে নামিয়ে রেখে বললো,, আসলে ভাবী জুবায়েরের লাভ লোকসানের কথা কিছুই জানি না।
তবে এইটাও ঠিক সাদের ভালো চাকরি ছিলো সামনে যে থাকবে তার কোনো গেরান্টি নেই। এমনিতেই অফিসে অনেক রকম সমস্যা হচ্ছে। কম্পানির চেয়ারম্যানের সাথে সাদের সম্পর্কটাও ভালো যাচ্ছে না। চাকরি থাকতে থাকতে ছেলের বিয়ে সেরে ফেলতে চাইছি। পরে বেকার ছেলের জন্য কোনো মেয়ে জুটে কিনা সন্দেহ।
অনিলার কথা শুনে রাজিয়ার চোখ কপালে। রাজিয়া অনিলার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,, দুই পক্ষই ডুবছে। ডুবে যাওয়া নৌকাকে আরো ডুবানোর চেষ্টা করাটা বোকামি। একে অপরের সাথে আত্মীয়তা পেতে একসাথে ডুবো তাতে আমার কি।
অনিলা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, কিছু বলবে ভাবী? রাজিয়া মেকি হেসে বলল,,না না আমি আর কি বলবো অনিলা। তোমরা যা ভালো বুঝো। রাজিয়া কথা বলে আর দাড়ালো না। হেলে দুলে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
ভাবীর যাওয়ার দিকে চেয়ে অনিলা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, ভাগ্যিস সেঁজুতি নেই। নয়তো তোমাকে কোন কথার জবাব কি দিয়ে দিতো সেটা আল্লাহ ভালো জানেন। এমনিতে বেচারি তোমাকে পাহারা দিতে দিতে শেষ।
——
বিয়ের কার্ড ছাপানো শেষ। ইতিমধ্যে রায়হান সব গুলো কার্ড জায়গা মতো পৌঁছে দেওয়ার কাজে লেগে পড়েছে। সাদ কয়েকটা কার্ড হাতে নিয়ে পুনরায় রেখে দিলো। খুব কাছের আত্মীয়-স্বজনের কাছে বিয়ের কার্ড মূল্যহীন। সাজ কাবার্ড থেকে কোট নিয়ে বিছানায় রাখলো। কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে কোট রেখে বেরিয়ে পড়লো। যেখানে মাকে নিয়ে যাওয়ার কথা সেখানে সাদ একা যাচ্ছে। বাবা মারা যাওয়ার পর সাদ ওয়াদা করেছে তার মাকে কখনো ওবাড়ির চৌকাঠ মাড়াতে দেবে না। সাদ তার কথা রেখেছে। এতো বছর পেরুলো অনিলা এখনো ওবদি সাদের দাদার বাড়িতে পা রাখেনি।
জুবায়ের এক গাড়ি জিনিসপত্র নিয়ে তার শ্বশুর বাড়ির দিকে রওনা দিলো। এইদিকে সেঁজুতি সাদের টেনশনে শেষ। বিয়েতে নিশান আসলে সাদ কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিবে। সেঁজুতি মনে মনে আল্লাহকে ডাকছে যাতে করে নিশান বিয়েতে না আসতে পারে।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,,
(ভুল ত্রুটি সুধরে দিবেন। সবাইকে বিয়ের দাওয়াত 🙄।)নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:৪০
সাদ তার ফুফু রুবিনা আর চাচা শফিকের সামনে বসে আছে। তার ফুফু আর চাচা এতক্ষণ ইনিয়ে বিনিয়ে নানান কথা বললেও শফিক মুখ ফুটে বলে উঠলো,, তা কি এমন ধরাবাঁধা ছিলো যার জন্য ওই মেয়েকে বিয়ে করতে হচ্ছে। এমনিতেই তোর নানার বাড়ির মানুষেরা আমার ভাই ভাতিজা সবাইকে আমাদের থেকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে। যেটুকু যোগাযোগ আছে ওই মেয়ে বউ হয়ে আসলে সেটাও থাকবে না।
সাদ নড়েচড়ে বসল।সাদের চাচি চায়ের কাপ সাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,, তোমার চাচ্চু ঠিক বলেছে সাদ। আরেকবার ভেবে দেখো।আমি নিজে দেখেছি তোমার বাবা মা*রা যাওয়ার পর কিভাবে তারা তোমাদের হাত করে নিয়েছে।
চাচির কথা শুনে সেই দিন গুলোতে ফিরে গেলো সাদ। মনে পড়ে গেল এই মানুষ গুলোর স্বার্থপরতার কথা। সেই দুর্বিষহ দিন গুলোর তিক্ততম স্মৃতি।
সাদ চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো।চায়ের কাপ টেবিলের উপর রেখে মুচকি হেসে তাচ্ছিল্য করে বললো,, হ্যা চাচি আমিও তাই ভাবছি। আমার বাবার টাকা যারা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে শিখেছে তারা আমার বাবার চলে যাওয়ার পর পায়ে ঠেলে দিয়েছিল। যারা বাড়ি আসলে আমার মা আপ্যায়নের জন্য একপায়ে খাড়া থাকতো তারা তাকে অপয়া বলতে দুবার ভাবেনী। তাতেও তারা খান্ত হয়নি! বাবার মৃত্যুর জন্য আমার মাকে দায়ী করেছিল তারা। কি করে ভুলব সে সব চাচি?
সাদের কথায় শফিক চোখ সরিয়ে নিল। রুবিনা আর সাদের চাচির মুখে অন্ধকার ছেয়ে গেছে।সাদ যে সব কথা তাদের উদ্দেশ্য করে বলেছে তা ঠিকই বঝেছে।
সাদ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো, আমি আমার বাবার মত নই। আমি খারাপ ভালোর পার্থক্য করতে পারি । যে যেমন তাকে তেমন ভাবে বুঝানোর মতো ক্ষমতা , সাহস দুটোই আমার আছে। তোমাদের ভাইয়ের ছেলে হলেও কিছু গুন তোমাদের পেয়েছি। রইলো বিয়ের ব্যাপারে,মেয়ে আমি নিজেই পছন্দ করেছি। কেউ জোর করেনি। এই বংশের বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা আশা করি সবাই সময় মতো পৌঁছে যাবে। আজকের মতো আসছি।আল্লাহ হাফেজ।
সাদ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গট গট করে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসলো। এই বাড়িতে এলে নিঃশ্বাস নেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।বাবা থাকা কালীন সব কিছুই সুন্দর ছিল। বাবা মারা যাওয়ার পর সবাই তাদের চেহারার উপর থেকে মুখোশ সরিয়ে ফেলেছে। এখানে ভালোবাসা বাবার টাকা পয়সা দিয়ে মাপা হয়। যার বাবার টাকা বেশি,তার ভাগে ভালোবাসাটাও বেশি। বার কয়েক চুলে আঙুল চালিয়ে সিটবেল্ট বেঁধে নিলো। অতঃপর গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।
অনেক চেষ্টার পর রিমির খোঁজ পাওয়া গেছে। রিমিকে নিয়ে আসার গুরু দায়িত্ব রায়হানকে দেওয়া হলো।
রায়হান রিমির বাড়ির ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। প্রায় সারে তিনঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে রিমিদের বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায়। সাততলা ভবনের মধ্যে রিমিরা থাকে পাঁচতলায়। রায়হান ভেবে রেখেছে লিফ্ট না থাকলে বাড়ির সামনে থেকে কেটে পড়বে। গাড়ি পার্কিং এরিয়াতে রেখে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো রায়হান। ওয়াচম্যানকে জিজ্ঞেস করলে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে লিফ্ট দেখিয়ে দেয়।
লিফ্টের সামনে দাঁড়িয়ে সাদকে কল দেয়। রায়হানের কথা বলার মাঝে পেছনে থেকে কেউ এসে আচমা ধাক্কা দেয়। যার ফলশ্রুতিতে রায়হান হুমড়ি খেয়ে লিফ্টের ভেতরে গিয়ে পড়ে।ভ্যাগিস চিৎপটাং হয়ে পড়েনি তার আগেই কেউ শার্ট ধরে আটকে দেয়। রাগে রায়হানের পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। হাত মুঠ করে ঘুসি মারার জন্য হাত উঠিয়ে পেছনে ফিরে চমকে উঠে। রায়হান ভেবেছিলো কোনো ছেলে হবে। কিন্তু না ছেলে নয় , রায়হানকে ধাক্কা দেওয়া ব্যাক্তিটা একটা মেয়ে।
রায়হান হা করে তাকিয়ে আছে। কোমরে হাত গুজে রাগি চোখে তাকিয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখে শান্ত হয়ে গেছে রায়হান। মুঠ করে রাখা শক্ত হাত দুটো সিথিল হয়ে এলো। রায়হান কিছু বলবে তার আগে বাজখাঁই গলায় রিমি বলে উঠলো,, যখন যানেন দুই প্রোগ্ৰাম এক সাথে কাজ করে না তখন চেষ্টা করতে যান কেন?
রায়হান চমকে উঠে বললো,, মানে!
রিমি দাঁতে দাঁত চেপে হিস হিস করে বলে উঠলো,, মানে! ফোন কানে নিয়ে হা করে লিফ্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। পেছনে একটা মানুষ এতক্ষণ ধরে ডাকছে শুনতে পাননি? তার থেকে বড় কথা ফোনে কথা বলতে বলতেও লিফ্টে চড়া যায়। কিন্তু আপনি তো ফোন নিয়েই ম*রছেন। যত্তসব আজাইরা পাবলিক।
রিমি সামনের দিকে তাকিয়ে ফুঁসছে।
রায়হান আচম্বিত নয়নে রিমির দিকে তাকিয়ে বলল,, একটুর জন্য এতো কিছু শুনিয়ে দিলেন? আপনি যে ধাক্কা মে*রে*ছেন তার বেলায়?
রিমি ফু দিয়ে সামনে আসা চুল গুলো উড়িয়ে বললো, কখন দিলাম ধাক্কা ?কোনো প্রমাণ আছে?
রায়হান অবাকতার শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে। মেয়েটা যতোটা কিউট তার থেকে বেশি ডেইন্জারাস।কেমন পাল্টি বাজ মেয়ে।
রিমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,, কত তলায় যাবেন? রায়হান বিড়বিড় করে উত্তর দিলো, পাঁচতলায়।
রিমি সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,, মনে হয়না পাঁচতলায়। দেখে আত্মীয় আত্মীয় ফিল আসছে না। সত্যি করে বলুন?
রায়হান কিছু বলবে তার আগেই পাঁচতলায় এসে থামলো লিফ্ট। রায়হান লিফ্ট থেকে বেরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখে এই পাঁচ তলায় শুধু মাত্র একটা ইউনিট। বুঝতে বাকি নেই এই ইউনিটে শুধু রিমিরা থাকে। রায়হান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজাবে তার আগে রিমি সামনে দাঁড়িয়ে হড়বড়িয়ে বলে উঠলো,, আপনি কে আগে সেটা বলুন!বাই এনি চান্স বিয়ের জন্য আসেন নিতো! যদি সেই সুবাদে এসে থাকেন তাহলে বলে রাখছি আমি এই ঘরের এক মাত্র মেয়ে। তবে বিয়ে করতে একটুও ইন্টারেস্টেড নই। তাড়াতাড়ি কেটে পড়ুন নয়তো খবর আছে!
রায়হান রিমির এমন কথায় না হেসে পারলো না। ভয়ে রিমির মুখটা এটুকুন হয়ে আছে। এতক্ষণে রায়হান বুঝতে পারলো এই রাগী মেয়েটা সাজির বেষ্ট ফ্রেন্ড রিমি। রায়হানের হাসি দেখে রিমি মুখ কাচুমাচু করে বললো,, প্লিজ চলে যান!!
রায়হান মনে মনে পন করে বসলো সামনের বার সত্যি বিয়ের জন্য আসবো। আপাতত কাজ সেরে যাই। রায়হান হাতে থাকা কার্ড রিমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, রিলেক্স!বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসিনি বরং দাওয়াত দিতে এসেছি। আপনার বান্ধবীর বিয়ের।
রিমি অবাক হয়ে রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল,, সাজির?
রায়হান মাথা নেড়ে হ্যাঁ বুঝালো। রিমি টলমল চোখে কার্ড হাতে নিয়ে সুধালো,, সাজিঁ সুস্থ হয়ে গেছে?
রায়হান মুচকি হেসে বলল, অনেক আগেই সুস্থ হয়ে গেছে।
রায়হানের কথা শুনে রিমি ঠোঁট এলিয়ে হেসে ওঠে তার সাথে দুফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। রিমি কতোটা খুশি তা রিমির চোখের জল বলে দিচ্ছে। রায়হান অবাকচিত্তে রিমির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন বুঝতে পারছে কেন সাজি ম্যাম তার বান্ধবীর জন্য মন খারাপ করে ছিলো।
রিমি বিয়ের কার্ড খুলে সাদের নাম দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলো। রায়হান প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে। রিমি কলিং বেল চেপে বললো,, শেষে বদরাগী সাদ ভাই সাজির বর হচ্ছে! ওয়াও।
______
সন্ধ্যায় সাজি আর সাদের এংগেইজমেন্ট। সকাল থেকে দুই বাড়িতে বিয়ের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। সাজিদের বাড়ি এখন মেহমানে ভরে উঠেছে। সাজির নানার বাড়ির মানুষেরা এসেছে, সাথে সেঁজুতির বাল্য কালের দুজন বান্ধবী আর তাদের পরিবার। সবাই হই হই করে বাড়িতে উপস্থিত। জুবায়ের এংগেইজমেন্ট অনুষ্ঠানের জন্য হল বুকড্ করার কথা বললে সাদ সাফ মানা করে দেয়। সাদের মতে বাইরের কেউ যখন নেই তখন হল বুকড্ করানোর কি দরকার। বাড়িতে সাদামাটা আয়োজন করলেই হবে। তাই সাদের কথা মতো সবটা সাজিদের বাড়িতে হচ্ছে। যার সম্পূর্ণ দায় ভার সাদ নিয়েছে। বাড়ির বাগানে বড় করে প্যান্ডেল করা হয়েছে। ওয়েডিং প্ল্যানার এসে স্টেজ থেকে শুরু করে বাড়ির গেইট ওবদি পুরো সাজিয়ে ফেলেছে। সাদামাটা বললেও ঠিক সাদামাটা লাগছে না।এখন বাকি রয়েছে কনে আর বর।
সাদের দাদার বাড়ি থেকে বড়রা কেউ আসেনি। তবে ছেলে মেয়ে গুলোকে আটকে রাখা যায়নি। সাদের কল পেয়ে শেফালী,বিন্দু, আজাদ, জিহাদ আর রশনি ব্যাগ পত্র গুছিয়ে হাজির। রশনি প্রথমে আসতে চায়নি,পরে শেফালী আর বিন্দু জোর করে নিয়ে এসেছে। অন্যদিকে এমডি-র এংগেইজমেন্ট বলে কথা। অফিসের স্টাফরা সবাই সেজে গুঁজে হাজির। মেহমানদের আপ্যায়নে কমতি রাখছে না অনিলা। হেঁটে হেঁটে সারভেন্টদের দেখিয়ে দিচ্ছে কাকে কি দিতে হবে। আনিস বোনকে সব কিছুতে সঙ্গ দিচ্ছে। জুবায়েদা খাতুনও কম নয়। সবাই নাতি নাতনির বয়সী হওয়াতে তিনি চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে।
পার্লার থেকে দুজন মহিলা এসেছে সাজিকে সাজাতে। সাজি মোবাইল হাতে নিয়ে রিমির নাম্বারে বারবার ডায়েল করে যাচ্ছে। এইদিকে রিমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সাজির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে। সাজি মোবাইল পাশে রেখে মহিলা দুটোকে উদ্দেশ্য করে বলল,, কিভাবে সাজাবেন বলে দিয়েছে? মহিলা দুটো মাথা নেড়ে না বুঝালো।
সাজি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, এইবার কি হবে?
পেছন থেকে রিমি বলে উঠলো,, আমি আছি না? কি হবে তা আমি বুঝে নিবো।
রিমির গলার আওয়াজ পেয়ে তৎক্ষণাৎ ফিরে তাকায় সাজি। অনেকটা সময় পর দুজন দুজনকে দেখছে। সাজি ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠে বললো,, বের হ ঘর থেকে!
~ বর বলেছে তার বউ আমার জন্য হা হুতাশ করে ম*র*ছে। এখন দেখছি ঘর থেকে বের হতে বলছে।
সাদি দৌড়ে রিমিকে জড়িয়ে ধরে বলে,
~এই তোর আসার সময়? বে*য়া*দব মেয়ে! কোথায় ছিলি তুই? মিস করেছি না!
রিমি সাজির পিঠ জড়িয়ে ধরে বললো,, সেসব কথা পরে বলা যাবে। অলরেডি ছয়টা বেজে গেছে। তোকে তাড়াতাড়ি রেডি করাতে বলেছে। তা না হলে সাদ ভাই কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিবে।
বরের বাড়ি থেকে একটা একটা করে গাড়ি এসে থামলো গেইটে। একে একে নেমে এলো সবাই। দুই পক্ষের মানুষের মেলবন্ধনে জমে উঠেছে অনুষ্ঠান।
সাদা শার্টের সাথে কালো কোট ,প্যান্ট। হাতে সিলভার কালারের ওয়াচ। চুল গুলো বরাবরের মতই সেট করা। এই লুকে সাদকে দেখতে রাজকুমার থেকে কোনো অংশে কম লাগছে না। সেঁজুতির বান্ধবীর মেয়ে দুটো সেই কখন থেকে হা করে তাকিয়ে আছে। তা দেখে সেঁজুতি মুচকি মুচকি হাসছে। তার মেয়ে জামাই বলে কথা। আশেপাশের মেয়েরা জ্ব*লে পু*ড়ে ছাই না হলে কিসের জামাই!
এতক্ষণ সাদ বেশ খোশ মেজাজে থাকলেও নিশানকে দেখে মূহুর্তে সাদের মেজাজ বিগড়ে গেলো।
শেফালীর সাথে দাঁড়িয়ে আছে নিশান। টালবাহানা করে কথা বলার চেষ্টা চালাচ্ছে। সাদ বুঝতে পারছে না এতো কিছু হওয়ার পর মামুনী কি করে এই কালপ্রিটকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়। দাঁতে দাঁত চেপে মায়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। নিশানকে দেখে অনিলা ভয়ে জড়সড় হয়ে যাওয়ার জোগাড়।
না জানি ছেলে তার কোনো কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দেয়।
সাদ স্টেজ থেকে নামতে নিবে এমন সময় রায়হান হাত ধরে আটকে সামনে ইশারা করে। সাদের থমকানো পা দুটো আরো থমকে গেলো। সামনে থেকে এগিয়ে আসা রমনিতে দু’চোখ আটকে গেছে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে সাদ। এই রমনিকে তার কল্পনার চাইতেও বেশী সুন্দর লাগছে। সাদ বিড়বিড় করে,, এতোকাল পু*ড়ি*য়ে খান্ত হওনি মেয়ে! এখন আবার নতুন করে পো*ড়াতে এলে।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,
(ভুল গুলো সুধরে দিবেন।)