সৎমায়ের কারনে বাড়িতে এসেও শান্তি পাচ্ছে না শায়োরী। সকালবেলায় বলতে লাগলেন ওমন বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে ওটা তোর বড় কপাল। মা খেয়েছিস, তোর মত মুখ পুড়ি কেমন করে গেলি তাই বুঝলাম না।তাই সকাল থেকে মধ্য দুপুর পর্যন্ত না খেয়েই পুকুর পাড়ে এসেছে শায়োরী, পুকুর পাড়ে অনেক বাতাস, খোলামেলা তার উপর দক্ষিণমুখী, গাছের ছায়ায় পুকুর পাড়টা তার খুব ভালো লাগে।
কিন্তু আজ তার এই পুকুর পাড় ভালো লাগছে না
বারাবার মনে হচ্ছে আবির না চলে আসে। শায়োরীর চিন্তার মাঝেই আবিরের প্রবেশ। আবির শায়োরীর সামনে এসে বসেছে। শান বাধানো ঘাট পুকুরের এই ঘাটের সিড়িতে শায়োরী তো অন্যটাতে আবির।
— “কেমন আছো? স্বামী নিয়ে নিশ্চয় ভালোই আছো?”
— “হুম, খুব ভালো আছি আবির ভাই,’
— “আমাকে ভাই বলবে না কত বলব তোমাকে আমি?”
— “কি বলবো?”
— “আবির বলবে! আবির! এসব ভাই! ডাকতে পারবে না।”
–” আমার পক্ষে সম্ভব না।”
— “কেন সম্ভব নয়? ”
–“আপনি আমার বড় ভাইয়ের মত!”
–“শায়োরী! কিসের ভাই আমি তোমার?”
— ‘আপনি বুঝতে পারছেন না আমার বিয়ে হয়েগেছে?
–” না! কিছুই বুঝতে চাই না! আমার শুধু তোমাকে চাই!!”
শায়োরী “উঠে পরল, চলে আসবে এমন সময় আবির তার হাত ধরে ফেলল।
–” শায়োরী এমন করো না প্লিজ! তুমি যদি একবার চাও আমরা আবার এক হবো!”
–“কিছু ঠিক হওয়ার নেই! আর আবার এক হবো মানি? আমরা কখনো কি এক ছিলাম?
না আপনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক ছিল?
আপনি আমাকে পছন্দ করতেন। আমি তো করতাম না!”
আবির– “আমি তোমার চোখে সেই আড়ালে ভালোবাসা দেখেছি,”
শায়োরী কেদেদিল, সম্ভব না আবির! আপনার আর আমার কখনো এক হওয়া যাবে না। আমার বিয়ে হয়েগেছে, আমি এখন অন্যকারো স্ত্রী!
এসব কথা মাথায় আনা ও পাপ।”
আবির শায়োরীর হাত টেনে একটা গাছের নিচে নিয়ে গেল। শায়োরীর মুখের দিকে তার মুখ রেখে বলল –
–“আমার চোখে চোখ রাখো! তাকাও আমার দিকে!
শায়োরী নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখো আমার চোখে চোখ রাখো। একবার তাকিয়ে বলো আবির আমি নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে এসব করেছি, বলো! বলো আমি যা করেছি বাধ্য হয়ে করেছি।
আমি আপনাকে ভালোবাসি!”
শায়োরীর দুচোখ জোড়ায় অজর ধারায় জল গড়িয়ে পরছে
— “ছাড়ুন আবির! কেউ দেখে ফেলবে।এমন কিছু নেই আমার মাঝে!”
— “আমি তোমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবো।
নিজের আলাদা ছোট্ট একটা সংসার গড়বো।
শুনছো? ছোট্ট একটা সংসার যেখানে রবে তুমি আর আমি। কেউ রবে না আমাদের মাঝে।”
— “তা হওয়ার নয়! অনেক দেরী হয়েগেছে।’
আবির- শায়োরীর চুলের মুঠি ধরে তার গাল চেপে ধরে বলে উঠলো –
–” বড়লোক ছেলে পেয়ে বাড়ি পেয়ে আমাকে তোর মনে ধরে না? কি নেই আমার মাঝে।ঐ ছেলের থেকে আমি কম কিসে? বলতে পারিস?”
আবির আবার হাত চেপে ধরেছে!শায়োরী ব্যাথায় কুকিয়ে উঠেছে, আর আবির তার হাত ছেড়ে দিয়েছে। নিজেই নিজের চুলে হাত দিয়ে বিরবির করে বলে উঠল–“আমি হার মানবো না! আমি তোকে যে করি হোক নিয়ে যাবো!”
“কোনদিন কারোর কাছে আমি মাথানত করিনি আজ করবো অসম্ভব! বলেই উনি চলেগেলেন।”
_______________________________________
শায়োরী বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে দেখে শায়োরীর মা তার দিকে চেয়ে আছে। রুমে ঢুকতে যাবে তার আগেই শায়োরীর হাত ধরে উনার রুমে নিয়ে গেলেন, দরজা বন্ধ করে তার গালে ঠাস করে চড় মেরে দিলেন তিনি।
–“নাগর নিয়া পুকুর পাড়ে ঘুরোছ! ”
‘ঠাস’ করে আরেক গালে চড় দিয়ে।
–“মানসম্মান সব ধুইয়া খাইছোত নাকি?
আইজ যদি কারোর নজরে পরতো? কি সর্বনাশ হইতো!
সর্বনাশি ঘরে ছোট একটা বইন আছে সেইদিকে খেয়াল আছে? নাগর নিয়া পাড়ায় পাড়ায় মাঠেঘাটে গুরোছ!
বুছঝি **** তোরে আর এই বাড়িতে আইতে দেওন যাইবো না। আইজই তোরে তোর শশুর বাড়িতে পাঠামু!কত বড় নির্লজ্জ মাইয়া! আইজ আসুক তোর বাপ!মাইয়া নিয়া গর্বে বাচে না। আইজ আমি হের গর্ব শেষ কইরা দেমু।
ছি! ছি! পরপুরুষের লগে বইয়া রইছিলো কেমনে!
আবার…… এসব কতা কইতেও শরম লাগে। যা চোখের সামনে থাইকা যা! যাইবি তুই মুখপুড়ি!”
মায়ের কাছ থেকে এতগুলো কথা শুনে চলে আসলো শায়োরী। সৎমায়ের গালি শুনতে শুনতে অভ্যেস হয়েগেছে তার। এ আর নতুন কি! কথাটা অবশ্য মন্দ বলেননি উনি মুখপুড়িই বটে প্রথমে মা মারা গিয়েছে আর এখন স্বামী থেকেও নেই।
বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় পনেরো দিন, এই পনেরো দিনের একদিন ও তার স্বামীকে সে পুরোপুরি দেখতে পারেনি।
সবার মুখ থেকে শায়োরী শুনেছে শশুর মশাই নাকি স্বামীকে বাধ্য করেছেন এই বিয়ে করতে।শায়োরীর শশুর শায়োরীর বাবাকে কথা দিয়েছিলেন উনি ওনার ছেলের জন্য উনাদের ঘরে তুলে নিবেন।হলো ও তাই,, একজন শহুরে জীবনে ব্যাস্ত এবং ধনী পরিবারের লোক হয়েও বন্ধুকে দেওয়া কথা তিনি রেখেছেন। তাই তো এতবছর পর তিনি তা বাস্তবায়ন ও করে ফেললেন।শায়োরীর শশুর কড়া রাগি হলে ও মনের দিক থেকে খুবই ভালোমানুষ। শাশুড়ি ও ভালোই পেয়েছে সে তবে স্বামীর দিক থেকে হয়তো অপূর্ণ শায়োরী।
বিয়ের দিন নিজের স্বামীকে একবার দেখেছিল শায়োরী তাও আবার কবুল বলার সময়।এরপর আয়নায় যখন মুখ দেখার পালা তখন একবার।পুরোপুরি না দেখে ও বুঝতে পারলো সে রেগে আছে। ঠিক হলো ও তাই সেদিন সেই বিয়ের মঞ্চ থেকে উঠেগেল। বাসর সজ্জায় সজ্জিত রুমটিতে সবাই যখন হইহুল্লর করছিলেন তখন ও শায়োরীর স্বামী রুমে আসেনি, রাত বারোটায় এসেছিলো সে। শায়োরী কাপাঁকাপাঁ হাতে তাকে দেখে সালাম করবে। তার আগেই সে দূরে সরেগেল। এরপর থেকে সে শায়োরীর ঘরে আর আসেনি। শাশুড়ি মা এই পনেরো দিন একটানা চেষ্টা করেছেন তাদের দুজনকে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য।অত্যন্ত ভালো মানুষ তারা,কখনো শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে বসে গল্প করতো তো কখনো চুলে বিলি কেটে দিত। কিন্তু শায়োরীর স্বামী একদিন ও তার সঙ্গে ভালো করে কথা বলতো না।ঐ বাড়িতে থেকে যেন শায়োরীর দম বের হয়ে যাচ্ছিল।
ডায়েরি….
………
“দিন গুলি যেন আমার কেমন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে।
এই বাড়িতে থাকা যেন আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠে পরেছে। এই বাড়ির সবাই খুব ভালো, তবুও কেন যেন আমি তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে চলতে পারছিনা।কাজ করতে নিলে আমার শাশুড়ি সবসময় বলেন – জিরিয়ে নে সামনে অনেক কাজ আছে, অনেক কাজ বাকি তোর পুরো সংসার একাহাতে সামলাতে হবে! তাই এখন জিরিয়ে নে, এখন আমি আছি আমি সামলাবো।
তাই বাধ্য হয়ে আজ শশুর মশাইকে বললাম আমাকে যেন অনার্সে ভর্তি করিয়ে দেয়। উনি আমার কথা শুনে রাজি হয়েগেলেন ভর্তির ব্যাবস্থা ও করে দিলেন।প্রাইভেট একটা ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম আমি দেখা যাক কি হয়! ডায়েরির পাতায় নিজের গল্প ফুটিয়ে তুলেছে শায়োরী।লিখে শেষ করেই উঠেগেল সে, এতদিন ডায়েরি লিখতে পারেনি সে, বিয়ের ঝামেলা রিতিনীতি পেরিয়ে এখন এসেছে বাবার বাড়ী বেড়াতে এসেছে সে।শশুর মশাই নিজে এসে দিয়ে গেছেন তাকে।”
শায়োরী শুয়ে পরল বিছানায়। সকাল হতেই এপাড়ার ওপাড়ার সবার ডাকাডাকি শুরু।কেউ কেউ শায়োরীকে আর তার স্বামীকে দেখতে চাইছে। শায়োরী ঘরেই বসে আছে বেড় হয়নি ভালো লাগছে না তার শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে খানিকটা।তাই সে ঘর থেকে বেরোয়নি। অনেক লোকই আসে তাকে দেখার জন্য।মাঝে মাঝে মনে হয় স্বামী নামক ব্যাক্তিটাকে সামনে দাড় করিয়ে প্রশ্ন করতে, কেন সে শায়োরীকে অপছন্দ করে?
শায়োরীর ভাবনার মাঝেই দরজায় করাঘাত হলো প্রবলভাবে। দরজা খুলেই দেখলো তার স্বামী আরাফ দাড়িয়ে আছে।
#দূরে নয় কাছেই আছি!
#লেখিকাঃতামান্না
#পর্বঃপ্রথম
চলবে।