‘সবসময় মনে হয় কেউ যেনো আমাকে সর্বক্ষন অনুসরণ করে, অদৃশ্য কেউ!রোজ মাঝরাতে যখন আমি গভীর ঘুমে মত্ত থাকি তখনও আমাকে কেউ নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষন করে, অথচ চোখ খুলতেই আমি কাউকে দেখতে পাইনা। কিছুদিন যাবৎ আমি ব্যাপারটা লক্ষ্য করছি, এসব ভাবনা আমাকে সবসময় তাড়া করে বেড়াচ্ছে।’
তন্দ্রার কথা শুনে ছেলেটি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো, তারপর বললো,
‘আপনি তো গভীর ঘুমে মত্ত থাকেন, তাহলে বুঝলেন কি করে আপনাকে কেউ দেখছে?’
তন্দ্রা ছেলেটির হাসি দেখে বললো,
‘হাসছেন হাসুন কিন্তু আমি একটুও মিথ্যা বলছি না, প্রথম প্রথম আমিও এটাকে তুচ্ছ একটা বিষয় মনে করতাম কিন্তু একদিন যখন…’
কথাটা পুরো শেষ না হতেই তন্দ্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলো। ছেলেটি তন্দ্রাকে চুপ করতে দেখে বলে উঠলো,
‘কি ব্যাপার চুপ করে গেলেন যে, পুরো কথাটা তো শেষ করলেন না।’
তন্দ্রা ছেলেটির প্রশ্নত্তরে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আমি ওসব এখন মনে করতে চাইছিনা, আমার মনে হচ্ছে সেই অদৃশ্য কেউ আমার আশেপাশেই আছে, হয়তো খুব কাছে!’
তন্দ্রার এই কথায় ছেলেটির কোনো প্রতিত্তর না পেয়ে তন্দ্রা পাশে তাকালো, পাশে তাকাতেই তন্দ্রা চিৎকার করে উঠলো, তন্দ্রার পাশে কেউ নেই, একটা মরা শেয়ালের অর্ধেক দেহ তন্দ্রার পাশে পড়ে আছে, সেই দেহ দেখতেই তন্দ্রা নিজের চোখদুটো বন্ধ করে ফেললো। কি বীভৎস সেই মৃতদেহ!
‘তন্দ্রা!’
কারও কণ্ঠে নিজের নাম শুনতেই তন্দ্রা চোখ মেলে তাকালো। তাকাতেই দেখে আগের সেই ছেলেটা যার সাথে তন্দ্রা কথা বলছিলো, তন্দ্রা বলে উঠলো,
‘কিছুক্ষন আগে কোথায় গেছিলেন আপনি?’
ছেলেটি নিজের ঠোঁট প্রসারিত করে বলে উঠলো,
‘নিজের ক্ষুধা নিবারণ করতে গিয়েছিলাম, খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম তো!’
‘এতো তাড়াতাড়ি আপনার খাওয়া হয়ে গেলো?’
‘এতো তাড়াতাড়ি আবার কোথায় হলো, আমার যাওয়ার তো কুড়ি মিনিট পার হয়ে গেছে তাহলে এতো তাড়াতাড়ি আমার খাওয়া কিভাবে হলো?’
তন্দ্রা আঁতকে উঠে বললো,
‘কি বলছেন এসব, আপনি তো তিন মিনিট আগেও আমার সাথে কথা বলছিলেন, এরই মধ্যে কুড়ি মিনিট হয়ে গেলো?’
‘আমাকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হলে নিজের হাতঘড়িটা একবার দেখুন।’
তন্দ্রা হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, রাত ৩.২৫ বাজে, তারমানে লোকটা ঠিকই বলছে। কিন্তু তন্দ্রার তো ব্যাপারটা ঠিক লাগছেনা, তন্দ্রার তো এরকম ভুল হওয়ার কথা না, কুড়ি মিনিটকে পাঁচ মিনিট বানিয়ে দেবে, এও সম্ভব? তন্দ্রা নিজেকে সামলে নিলো, তারপর বললো,
‘আসলে বুঝতে পারিনি এতোটা সময় পার হয়ে গেছে। আচ্ছা আপনি এই মাঝরাস্তায় খাবার কোথায় পেলেন বলুন তো? চারপাশে তো জঙ্গল!’
ছেলেটি বাঁকা হেসে বললো,
‘জঙ্গলে তো পশুপাখির অভাব নেই!’
‘মানে?’
‘মজা করছিলাম, আসলে আমার গাড়িতে কিছু খাবার ছিলো।’
‘ওহ!’
‘আপনি তো দেখছি খুব ভয় পেয়ে গেছেন তন্দ্রা?’
ছেলেটার কথা শুনতেই তন্দ্রার মনে পড়লো, তন্দ্রা তো ছেলেটাকে এখনো অবধি নিজের নাম বলেনি তাহলে ছেলেটা তন্দ্রার নাম জানলো কিভাবে? তন্দ্রা বলে উঠলো,
‘আপনি আমার নাম জানলেন কিভাবে, আমি তো আপনাকে একবারও আমার নাম বলিনি!’
‘আপনি তো ভারী আজব মানুষ দেখছি, নিজেই তো আমাকে আপনার নাম বললেন আবার নিজেই ভুলে গেলেন?’
‘ওহ বলেছি বুঝি, আসলে ইদানিং আমার সাথে যে কি হচ্ছে আমি নিজেই বুঝতে পারছিনা।’
‘ব্যাপার না, এমন হওয়া স্বাভাবিক।’
তন্দ্রা মুখে কথাটা বললেও তন্দ্রার স্পষ্ট মনে আছে তন্দ্রা ছেলেটিকে নিজের নাম বলেনি, তাহলে ছেলেটি কিভাবে তন্দ্রার নাম জানলো? তন্দ্রা এসব ভাবতে ভাবতে বললো,
‘আচ্ছা আপনার নাম তো বললেন না।’
‘আমার নাম আঁধার!’
‘আঁধার!মানে হলো অন্ধকার!’
‘অন্ধকারে থাকি তো ওই জন্য নাম আঁধার!’
‘আপনি কিন্তু দারুণ মজা করেন।’
তন্দ্রার কথা শুনে আঁধার হালকা হাসলো। তন্দ্রা এক রিলেটিভের বাড়িতে গেছিলো, সেখানে তন্দ্রার এক আত্মীয় মারা গেছে, তাকে দেখতেই তন্দ্রা এসেছিলো। তন্দ্রার কিছু ইম্পরট্যান্ট কাজ থাকায় তন্দ্রাকে আজকেই সেখান থেকে চলে আসতে হয়, ফেরার সময় মাঝরাস্তায় তন্দ্রার গাড়িটা খারাপ হয়ে যায়, তন্দ্রার গাড়িটা যেখানে খারাপ হয়ে যায় সেই রাস্তার একপাশ ঘন জঙ্গলে আবৃত, আর আরেকপাশ ধু ধু মাঠ , দূর-দূরান্ত পর্যন্ত কোনো মানুষের বসতি সেখানে নেই, জঙ্গলের পাশটায় ঝিঁ ঝিঁ পোকা আর শেয়ালের ডাক ভেসে আসছে। ঠিক রাত ২.৪৫মিনিটে তন্দ্রার গাড়িটা এখানে খারাপ হয়ে যায়, তন্দ্রা সাথে করে ড্রাইভার না নিয়ে আসায় বিপদে পড়ে যায়, অনেক চেষ্টা করেও গাড়িটা ও নিজে ঠিক করতে পারেনা, তার ওপর তন্দ্রা যেখানে অবস্থান করছে সেখানে মোবাইলের নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ করে তন্দ্রার চোখে পড়ে একটা সাদা গাড়ি ঘেঁষে দাঁড়ানো এক সুন্দর পুরুষ, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জঙ্গল দেখছে। সেই ছেলেটিই হলো আঁধার!তন্দ্রা আঁধারের কাছে গিয়ে ডাকে,
‘শুনছেন?’
আঁধার তন্দ্রার ডাকে তন্দ্রার দিকে তাকায়, তারপর বলে,
‘বলুন!’
‘আমার গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে, আমাকে গাড়িটা ঠিক করতে একটু সাহায্য করবেন।’
আঁধার তন্দ্রার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় বলে উঠলো,
‘এখানে যাদের গাড়ি নষ্ট হয়, তাদের গাড়ি নাকি কখনো ঠিক হয়না, আর তারা বাড়িতেও ফিরতে পারেনা।’
তন্দ্রা ভয় পেয়ে যায়, আর বলে,
‘এসব কি বলছেন আপনি?’
তন্দ্রার ভয় পাওয়া দেখে আঁধার হাসতে হাসতে বলে ওঠে,
‘ডোন্ট প্যানিক, আই ওয়াজ জাস্ট কিডিং!আসলে আমার নিজের গাড়িটাও খারাপ হয়ে গেছে, আমিও নিরুপায়!’
‘সিরিয়াসলি! ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন পুরো।’
‘টেনশন করবেন না, ভয় পাওয়ানোই আসলে আমার কাজ তো, তাই লোকজনকে ভয় না দেখিয়ে থাকতে পারিনা।’
‘ভয় পাওয়ানোই আপনার কাজ মানে?’
‘আমি একজন আর.জে। আর সেই সুবাদে ভৌতিক শো তো করতেই হয়, তাই বললাম ভয় পাওয়ানোই আমার কাজ!’
‘কি একটা বাজে পরিস্থিতি বলুন তো, গাড়িটা খারাপ হয়ে গেলো।’
‘আজকে দুজনকে হয়তো এখানেই রাত কাটাতে হবে।’
‘তাছাড়া আর কি করার, কোনো উপায়ও তো নেই।’
‘চলুন ওই বেঞ্জটাতে গিয়ে বসি।’
‘হুম চলুন!’
আঁধারকে দেখে আর আঁধারের ব্যবহার দেখে তন্দ্রার মনে হলো ছেলেটা খারাপ না, ভালোই!
দুজন বসে এটা-সেটা বলতে শুরু করলো। এ কথা সে-কথা বলতে বলতেই তন্দ্রা আঁধারকে জিজ্ঞাসা করলো,
‘এখানে কি কাজে এসেছেন?’
আঁধার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘প্রেমিকার সন্ধানে এসেছি, আমার বহু যুগের হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা! আমি তাকেই এখানে খুঁজতে এসেছি।’
আঁধারের কথা শুনে তন্দ্রার কৌতূহল জাগে, তন্দ্রা বলে ওঠে,
‘আচ্ছা আপনি কি আপনার হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে খুঁজে পেয়েছেন?’
আঁধার তন্দ্রার কথা শুনে তন্দ্রার দিকে মোহনীয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তন্দ্রা তখন নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো, আঁধার সেই মোহনীয় দৃষ্টি সচল রেখেই বলে ওঠে,
‘পেয়েছি, কিছুদিন আগেই পেয়েছি। তাইতো বার বার তাকে দেখার ইচ্ছা জাগে, বার বার তার কাছে ছুটে ছুটে যাই, তাকে যতই দেখিনা কেনো তাকে দেখার সাধ যেনো আমার মেটে না, তাকে যতই দেখি তাকে দেখার তৃষ্ণা আরও বেশি করে বৃদ্ধি পায়। ওর ঘুমন্ত মুখটা আরও বেশি স্বস্তি দেয় আমাকে, তাইতো সবসময় তার কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করি।’
আঁধারের কথা শোনার সময় থেকেই তন্দ্রার মনে হতে থাকে কেউ যেনো তন্দ্রাকে দেখছে, তন্দ্রা ভাবে হয়তো আঁধার ওর দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু তন্দ্রা আঁধারের দিকে তাকাতেই দেখে আঁধার অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তন্দ্রার মনে হচ্ছে ওর আশেপাশে সেই অদৃশ্য মানুষটা আছে, যার কারণে তন্দ্রার ভেতরে ভয় আর অস্বস্তি কাজ করছে। তন্দ্রা সেই অদৃশ্য মানুষটার কথা ভাবতেই চিন্তায় পড়ে যায়। তন্দ্রাকে এভাবে চিন্তা করতে দেখে আঁধার জিজ্ঞাসা করে,
‘আপনাকে দেখে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে, কোনো চিন্তার বিষয় আছে কি?’
তখনি তন্দ্রা আঁধারের প্রশ্নের উত্তরে আনমনে বলে ওঠে সেই প্রথম বাক্য, অর্থাৎ সর্বক্ষন কেউ তন্দ্রাকে অনুসরণ করছে।
বর্তমানে,
তন্দ্রা আর আঁধার চুপচাপ বসে আছে। তন্দ্রার হঠাৎ করে মনে পড়লো সেই শেয়ালের মৃতদেহর কথা।
চলবে…!
গল্প: #দুর্বোধ্য_ইন্দ্রজাল
লেখিকা: #স্বর্ণা_সাহা_রাত
||পর্ব ১||