দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা পর্ব -০১

“দেখেছি রূপ সাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা”
(স্বাগতা)

প্রথম অংশঃ
“আমি কিচ্ছু চাই না তোমার কাছে রোহান! শুধু তোমার জীবনে থাকতে চাই!… প্লিজ! একটু বোঝার চেষ্টা করো!… আমি তোমার কাছে সন্তান চাই না… সংসার চাই না!… কিচ্ছু চাই না… শুধু তোমাকে চাই… তুমি নীলাকে নিয়ে থাকো! আই প্রমিস, নীলার জায়গা আমি কখনও নিতে চাইবো না… আমার নিজের সন্তানও চাইবো না তোমার কাছে! আমার কোনও আপত্তি নেই! শুধু আমাকে দূরে ঠেলে দিও না!”, শায়নার কাতর কণ্ঠ করুণ ধ্বনি তুললো রোহানের কানে।
বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সের ফুড কোর্টে ওরা দু’জন বসা। সামনে দোসার প্ল্যাটার সাজানো। রোহান গম্ভীরভাবে শুনছে শায়নার কথাগুলো। শায়না রোহানের অফিসের একজন ইন্টার্ন এমপ্লয়ী। রোহানের টিমের আন্ডারেই এ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে ওর ৬ মাস আগে। রোহান বছর ৪৫ এর সুঠাম পুরুষ, আর শায়নার বয়স ২৩ মতো।
সুদর্শন রোহানের উপর অনেক মেয়েই ক্রাশ খায়। এটা বোধহয় এই যুগের ট্রেন্ড। সাময়িক সামান্য ভালো লাগাকে যখন তখন যার তার উপর ক্রাশ খাওয়ার নামে চালিয়ে দেয়া। বয়স, অবস্থান, সম্পর্ক, কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। ছেলেমানুষী বলে সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া রোহানের জন্য নতুন কিছু না। কিন্তু শায়না বাকিদের চাইতে এক কাঠি উপরে। গত কয়েক মাস ধরে রোহানের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে শায়না। ওর টিমে ঢুকবার পরেই রোহানের জন্য পাগল হয়েছে ও। ক্রমাগত স্টক করে চলেছে ওকে। যেখানে রোহান যাচ্ছে, সেখানেই শায়না উপস্থিত, দাঁড়িয়ে থাকছে রুমের সামনে, সোশ্যাল মিডিয়াতে রোহানের প্রতিটা পোস্টে ওর লাভ রিয়্যাক্ট, কমেন্ট আছেই, দিনে-রাতে মেসেজ আর ফোনের অত্যাচারে পাগল হয়ে উঠেছে রোহান প্রায়। এখনও সকলের সামনে আসে নি ব্যাপারটা, কিন্তু যেটুকু জানাজানি হয়েছে, তাতে আড়ালে আবডালে হাসাহাসি হচ্ছে, বুঝতে পারে রোহান। নেহায়েৎ ওর রেপুটেশন ভালো বলে এখনও পর্যন্ত কলঙ্ক লাগে নি ওর গায়ে। আজকে একেবারে অসহায় হয়েই ডেকেছে ও শায়নাকে শেষবারের মতো বোঝাপড়া করে নিতে। এখনও যদি ওকে বোঝাতে না পারে, তাহলে হয় ওর চাকরি ছাড়তে হবে, নাহলে অফিশিয়াল কোনও ব্যবস্থায় যেতে হবে শায়নার বিরুদ্ধে। শায়নার পরিবারকে জানাতে চায় নি রোহান, ও চায় না ওর কারণে শায়নার জীবনে কোনও বড় ধরণের ঝড় আসুক, কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে হলে এখন সেটাও জরুরী হয়ে গেছে।
বহুবার বহু ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে রোহান শায়নাকে। প্রথম প্রথম যথেষ্ট স্নেহ নিয়ে বোঝাতে গিয়েছিলো, ফল হয়েছে তার উল্টো। শায়না আরও পাগল হয়ে উঠেছে ওর নরম ভাবটাকে দুর্বলতা ভেবে নিয়ে। এতো বছরের ক্যারিয়ারে এই পর্যায়ে এসে কোনও দাগ লাগানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে রোহানের নেই। তবে নিজেকে যে কখনও জিজ্ঞেস করে নি এ কথা, যে শায়নাকে ওর ভালো লাগে কিনা, সেটা নয়। দুর্দান্ত সুন্দরী, উচ্ছ্বল তরুণী, জীবনরসে ভরপুর প্রাণবন্ত শায়নাকে ভালো না লাগার কিছু নেই। নিজের মনের কাছে জানতে চেয়েছে, উত্তর এসেছে, লাগে ভালো ওকে। ওর আকর্ষণ এড়ানো কঠিন। তার উপর যে নিজে থেকে এসে ধরা দিতে চায়, তাকে দূরে ঠেলা কঠিন বিষয়। মস্তিষ্কের কাছে জানতে চেয়েছে এই ভালো লাগা কি সাময়িক নাকি এর কোনও ভবিষ্যৎ আছে? মস্তিষ্ক বলেছে, কিছু হিসেব আছে।
মৃদু হাসলো রোহান। এমনিতেই ও স্বল্পভাষী, কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির, আর মৃদু স্বরে কথা বলা ওর অভ্যাস। শায়নার দিকে তাকিয়ে দেখলো গভীর আগ্রহে সে চেয়ে আছে ওর দিকে, ওর উত্তরের অপেক্ষায়। আজ ও পরে এসেছে কালো রঙের সালোয়ার-কামিজ। কামিজের উপরে রুপালি সুতোর কাজ। শিফনের কালো ওড়নার কিনারায় রুপালি চিকন লেসের পাড়। কানে বেশ ভারী একটা রূপার ঝুমকা। হাতে কালো আর রূপালি মিলিয়ে বেশ অনেকগুলো রেশমি চুড়ি। চোখে গাঢ় করে আইলাইনার টানা। ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক, ম্যাট না, গ্লসি। ওর ঈষৎ ফোলা ঠোঁট আরও আকর্ষনীয় করে তুলেছে ঠোঁটের ওই ভেজা রঙ। লম্বা, সিল্কি চুলগুলো ছেড়ে রেখেছে। হাতের আর পায়ের নখে লাল নেইল পলিশ। সদ্যই দেয়া বোঝা যাচ্ছে। দুই পায়ের মাঝের দুই আঙুলে ছোট্ট ছোট্ট দু’টো রুপালি আংটি। পায়ে রুপার নুপুর। পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতায় যোগ করেছে বাড়তি দুই বা আড়াই ইঞ্চি চিকন হাই হিলের জুতো। শায়না জানে ওর ধবধবে ফরসা গায়ের রঙে কালো রঙটা অসম্ভব মানায়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সেজেছে আজ যত্ন করে শায়না। আজ যে রোহানের জন্য ওর এই বিশেষ সাজ, সেটা ওকে খুঁটিয়ে না দেখেও রোহান বুঝতে পারছে।
এমনিতে শায়না নম্র, ভদ্র একটা মেয়ে হিসেবেই পরিচিত। শুধুমাত্র এই রোহানের ক্ষেত্রে এসে ওর যাবতীয় হিসাব নিকাশ ওলট পালট হয়ে গেছে বোধহয়। একই কথা বলেই চলেছে ও ক্রমাগত, রোহানকে চায় সে। দীর্ঘশ্বাস পড়লো রোহানের। চারদিকের এই হই-হট্টগোল ভালো লাগছে না ওর। এখানে কথা বলতে গেলেও ভীড়ের কারণে গলা একটু তুলে কথা বলতে হয়, যা ওর একেবারেই অপছন্দ। কিন্তু শায়নাকে নিয়ে কোনও মৃদু শব্দ, মৃদু আলো আর ভীড় ছাড়া ছিমছাম রেস্তোরাঁয় যেতে চায় নি ও। মেয়েটা ভুল মেসেজ পেতো।
যতোটা সম্ভব কণ্ঠস্বরকে নিয়ন্ত্রণ করে শুধুমাত্র শায়নার কান পর্যন্ত পৌঁছায় এমনভাবেই কথা বললো রোহান, “শায়না আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করবো…”
শায়না বোধহয় প্রস্তুত হয়েই ছিলো রোহান কি বলবে তার জন্য, রোহানের কথা শেষ হওয়ার আগেই হড়বড়িয়ে বলে উঠলো, “রোহান, আমাকে কিছু বোঝাতে এসো না প্লিজ!… আমার বন্ধুরা যারা জানে তারা আমাকে বোঝানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। তুমিও বুঝিয়েছো এর আগে… আমি নিজেও নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, রোহান!… ট্রাস্ট মি… আমি হেল্পলেস… আমি কিছুতেই পারছি না তোমার কাছ থেকে সরে আসতে!…”
রোহান ওর কথা শুনলো, তারপর আবার বললো, “আমি তো বলি নি আপনাকে আমি কিছু বোঝাবো, শায়না!… আমি বলেছি আমার কিছু প্রশ্ন আছে… আর প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর চাই আমি… আপনার কাছে উত্তর না থাকলে আপনি বলতে পারেন যে উত্তর আপনার জানা নেই… কিন্তু ‘এসব কিছু আমি জানি না… আমি শুধু আমারটুকু জানি’… এই ধরণের ‘তাল গাছটা আমার’ জাতীয় কোনও কথা আপনি বলতে পারবেন না… কারণ এই প্রশ্নগুলোর উপর নির্ভর করছে আমার আপনার উপর দুর্বল হওয়া উচিৎ নাকি উচিৎ না সেই প্রশ্নের উত্তর… আপনার আর আমার পথ এক হতে পারে কিনা সেই সংশয়ের সমাধান… আমি কি বোঝাতে পারলাম? আপনি যদি পারেন তাহলে আমার প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর দেবেন, নিজের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করবেন, আর আপনার কাছে যদি উত্তর না থাকে তাহলে সেটা স্বীকার করবেন যে উত্তর আপনার জানা নেই, এবং আপনার বক্তব্যের কোনও ভিত্তি নেই… কিন্তু এ্যাভয়েড করতে পারবেন না… রাজী?”
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত রোহানের দিকে চেয়ে থাকলো শায়না। মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে শায়না। এমন ঘরের ছেলেমেয়েদের সচরাচর নৈতিকতাবোধ প্রবল হয়, রোহানের প্রেমে পড়ার আগ পর্যন্ত শায়না নিজের ক্ষেত্রেও তাই জানতো। কিন্তু এই মানুষটার সামনে ওর সমস্ত যুক্তি, অ-যুক্তি, শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা, বিবেক, সবকিছু একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে গত কয়েক মাসে। বয়ফ্রেন্ডের সাথে ভেঙে গেছে সম্পর্ক। ওর পৃথিবীতে শুধুমাত্র জেগে আছে একটা নাম। আর রোহান যতো বার ওকে প্রত্যাখ্যান করছে, ততো বেশি দাবানলের মতো জ্বলে উঠছে ওর প্রতি প্রেম, আকর্ষণ। ও বাস্তবতা বোঝে, কিন্তু মানতে পারছে না। ও জানে রোহানের বয়স অনেক বেশি ওর চাইতে। ও জানে সে সংসারী মানুষ, নির্ঝঞ্ঝাট একটা পরিবার আছে তার। স্ত্রী আছে, সন্তান আছে। কিন্তু ও নিজেকে আটকাতে পারছে না। ওর বন্ধুরা বুঝিয়েছে ওকে। প্রথম প্রথম বিষয়টা নিয়ে ফাজলামি করলেও পরের দিকে ওর পাগলামি, ওর উন্মাদনা দেখে কয়েকজন বন্ধু নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে ওর কাছ থেকে, দূরত্ব তৈরি হয়েছে, পছন্দ করে নি বিষয়টা ওরা। বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু ওর যেন কিছুতেই কিছু আসে যাচ্ছে না! মা-বাবা জানলে কি করবেন জানা নেই। ওর মাথাতেও নেই এখন পরিবারের সম্মান, সামাজিক অবস্থান, কোনও কিছুই। সমাজ ওকে কি বলবে, সেটা ভাবতেও ও নারাজ। রোহান যদি ওর সাথে থাকে, সমাজ কোনও ব্যাপার না। ওর মন আর মস্তিষ্কে শুধু একটা কথাই এখন বেজে যাচ্ছে অহর্নিশ, কি করে এই পুরুষকে ও নিজের করে পাবে। নিজেকে তার পাশে চিন্তা করে অজানা আনন্দে শিহরিত হচ্ছে মন। বার বার শুধু রোহানের স্ত্রী নীলার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে চলেছে। বৃষ্টির দিনে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে বসে আছে দু’জন গাছের সবুজে সাজানো বারান্দায়, ওর মাথা রোহানের কাঁধে! রোহানের জন্য রান্নাঘরে রান্না করছে ও, কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে, সে পেছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে ওর চুলে নাক ডোবাচ্ছে! আলিঙ্গনে সিক্ত হচ্ছে ওর দেহ মন! হুড খোলা রিকশায় ঘুরছে ওরা রাজধানীর পথে পথে উদ্দেশ্যহীনভাবে! অথবা নদীর পাড়ে বসে দেখছে সূর্য ডোবা, নতুন এক রাতের সূচনা।
ওর এই সমস্ত কল্পনার কথা অজানা নয় রোহানেরও। জানিয়েছে শায়না নিজেই। দিনে-রাতে নানা সময়ে যখন ওর কল্পনায় যা এসেছে, সবই প্রায় লিখে লিখে পাঠিয়েছে ও। রোহান কখনোই ওর এ ধরণের কোনও কথার বা টেক্সটের উত্তর দেয় নি। কিন্তু তাতে ওর প্রতি আকর্ষণ কমে নি এক বিন্দু পরিমাণ! এটা যে অন্যায়, অনৈতিক, নিষিদ্ধ, এই বোধটাই যেন উবে গেছে শায়নার মাথা থেকে। রোহান ওকে সরাসরি মানা করেছে, সতর্ক করেছে বারবার। কিচ্ছু আসে যায় নি ওর। রোহানের কথা মেনে নিয়েই একই কথা বলে গেছে, নীলাও থাকুক নাহয় রোহানের জীবনে! ও শুধুমাত্র রোহানের জীবনের একটা অংশ হতে চায়। এই সমস্ত উদ্ভট প্রস্তাবের কোনও উত্তর কখনও আসে নি রোহানের কাছ থেকে। যতোটুকু যা বোঝানো সম্ভব, রোহান বুঝিয়েছে ওকে, কিন্তু যখন ওর কথাবার্তা এমন পর্যায়ে এসে ঠেকেছে যে সেগুলো নিয়ে আর কোনও আলাপ আগানোই চলে না, তখন রোহান ক্ষান্ত দিয়েছে বোঝানোতে।
আর এই কারণে, শায়নার ধারণা হয়েছে রোহান মুখে যতোই না করুক, মনে মনে সেও শায়নার প্রতি দুর্বল। সেও ভালবাসে শায়নাকে! আর ভালবাসবে নাই বা কেন? শায়না যতোটা সুন্দরী, স্মার্ট, যে কোনও পুরুষই চাইবে শায়নার মতো সঙ্গী! নীলাকে ও সামনা সামনি দেখে নি, কিন্তু ছবিতে দেখেছে, আর দেখে এটাও বুঝেছে যে নীলার চাইতে বেশি সুন্দরী ও। রোহান কি করে এড়াচ্ছে ওর আকর্ষণ? এই সবই সাময়িক, রোহানকে আত্মসমর্পণ করতেই হবে ওর কাছে। আজ যখন রোহান নিজেই ডেকেছে ওকে কথা বলার জন্য, আজ তাই সেই পণ নিয়েই ও এসেছে, রোহানকে দিয়ে স্বীকার আজ করিয়েই ছাড়বে যে শুধু রোহান ওর দুর্বলতা নয়, শায়নাও রোহানের দুর্বলতা। আজকে ওকে আপন করে নিতেই হবে রোহানকে। ও সত্যি ভাবছে না, বা ভাবতে চাচ্ছে না যে ওর এই চাওয়াটা কতোখানি প্রভাব ফেলতে পারে আরও অনেকগুলো মানুষের জীবনে। ও শুধু চাচ্ছে রোহান ওকে ভালবাসুক। বাকি সব কিছু ওর কাছে তুচ্ছ।
রোহানে কথায় নড়েচড়ে বসলো শায়না। রোহান আবার বললো, “আমি কি প্রশ্নগুলো করতে পারি?”
শায়না অনুরোধ করলো, “প্লিজ এমন কোনও কিছু বলো না যা আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে যেতে বলে!”
রোহানের কণ্ঠ কঠিন শোনালো, “আপনি আমার কাছাকাছিও নেই শায়না যে দূরে যেতে বলতে হবে স্পেসিফিক্যালি…”, শায়নার বোধে কুলালো না যে কতোটা অপমানজনক হওয়া উচিৎ এই কথাটা।
রোহান আর ওর কিছু বলার অপেক্ষা করলো না, “শায়না, আপনার আমাকে ভালো লাগে, বুঝলাম… কিন্তু আমি কি কখনও বলেছি যে আপনাকে আমার ভালো লাগে? এমন কি সেরকম কোনও ইঙ্গিত দিয়েছি কি?”
শায়না অধৈর্য্য হয়ে হাত নাড়ালো, “না বললেও আমি বুঝে নিয়েছি… আর কি করে বলবে!… ভালো লাগলেও তো তোমার পিছুটান আছে!… আমি তো বুঝি সেটা রোহান!… চাইলেও তুমি বলতে পারো না… পারছো না… কিন্তু তার মানে এই না…”
শায়নার কথা শেষ করতে দিলো না রোহান, “আমি আপনাকে একটা ইয়েস অর নো প্রশ্ন করেছিলাম, শায়না… আর সেটার উত্তর হচ্ছে, না!… আমি কখনোই আপনাকে এমন কোনও সাজেশন দেই নি যে আমি আপনাকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখছি, সরাসরি উত্তরটা না দিলেও আপনি কিন্তু বলতে পারলেন না যে আমি তেমন কিছু কখনও বলেছি বা করেছি… দ্বিতীয়ত, আপনি নিজেই বললেন, আমার পিছুটান আছে… সো, আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, আমার পিছুটান আছে বুঝেও আপনি জোর জবরদস্তি কেন করছেন?”
“আমি তো বলেই ছি যে আমার কোনও সমস্যা নেই ওদের…”
“আপনি বলছেন আমার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আপনার কোনও প্রবলেম নেই… কেন ধরে নিচ্ছেন যে আপনাকে নিয়ে তাদের কোনও প্রবলেম থাকবে না? আপত্তি থাকবে না?… নাকি তাদের আপত্তিটা আপনি ধর্তব্যের মধ্যে নিচ্ছেন না? ম্যাটার করে না সেটা আপনার কাছে!”
শায়না এবার ইতস্তত করে বললো, “আ… আমি দরকার হলে তাদের বোঝাবো…”
“আপনি কি নিজের বাবা-মা-ভাই-বোন পরিবারকে বোঝাতে পারবেন আপনার এই পরিকল্পনা অথবা ইচ্ছার ব্যাপারটা? আপনি যে বিয়ে করে বা না করে একজন অলরেডি বিবাহিত লোকের সঙ্গে সম্পর্ক করতে চাচ্ছেন, যার স্ত্রী-সন্তান আছে এবং বয়স প্রায় আপনার দ্বিগুণ… আপনার আপন মানুষ যাদের আপনি চিরদিন ধরে জেনে এসেছেন, আপনার কি মনে হয়, তারা হাসি মুখে এই বিষয়টা মেনে নেবে?”
শায়না চুপ।
“আপনি আপনার নিজের মানুষদের কিছু বলেছেন বলে আমার মনে হয় না… আর নিজের মানুষেরাই যে এটা বুঝবে এই গ্যারান্টি দিতে আপনি পারছেন না… কিন্তু আপনি আমার পরিবারকে বোঝাবেন বলে ধরে নিচ্ছেন… আচ্ছা বেশ… ধরুন আপনি তাদের বোঝাতে গেলেন… আমার পরিবারের কি প্রয়োজন যে আপনার কথা তারা মেনে নেবে? কোনও দায় আছে তাদের?”
উত্তর নেই শায়নার মুখে। এক দৃষ্টে চেয়ে আছে রোহানের মুখের দিকে। মাথায় ঘুরছে, এতো কিছু কেন বুঝতে হবে ওকে? একটু ভালবাসাই তো চেয়েছে ও! এমন কি কাউকে বঞ্চিত করেও নিজের জন্য সেই ভালবাসাটুকু আদায় করতে চায় নি। সেটাই কি যথেষ্ট না? তার জন্য এতো কিছু ভাবতে হবে?
ওর পুরো জীবন ও দেখে এসেছে ওর একটু সান্নিধ্য, একটু হাসি উপহার পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে সমস্ত পুরুষ, যে কোনও বয়সের পুরুষ। সেখানে এই রোহান এমন কেন? শুরু থেকেই রোহানের স্মার্ট আর ড্যাশিং লুক, দারুণভাবে কথা গুছিয়ে বলার গুণ আর ফিট ফিজিক ওকে ঘায়েল করেছে। কিন্তু অদ্ভূতভাবে রোহান আর সকলের মতো ওর সাথেও স্বাভাবিকভাবে হেসে কথা বললেও ও যেমন ধরণের মনোযোগ পেয়ে অভ্যস্ত, তা দেয় নি। অফিসে সবার সাথে আলাপ করে ধীরে ধীরে জেনেছে স্যার তাঁর স্ত্রী’র প্রতি, নিজের সংসারের প্রতি খুবই নিষ্ঠাবান। ঠিক সেই সময় থেকেই হিংসার জ্বলনটা টের পেয়েছে শায়না। ওর নিজের তেমন কোনও চারিত্রিক দোষ কোনকালেই ছিলো না, তবে পুরুষের বিশেষ মনোযোগ সে উপভোগ করেছে বরাবর। একান্ত নিজের একজন পুরুষের মধ্যে যে গুণটা সবচাইতে বেশি করে ও চেয়েছে তা হলো ওর প্রতি একনিষ্ঠ মনোযোগ, লয়্যালটি। সেই গুণটাই ও দেখলো, কিন্তু এমন একজন পুরুষের ভেতর, যে কিনা নিজের জীবন জুড়ে নিয়েছে অন্য এক নারীর সঙ্গে। এই জায়গা থেকেই শায়নার অবসেশনের শুরু। এই পুরুষটাকেই ওর চাই। একেই লাগবে ওর। ঠিক এইরকমভাবেই ওকে ভালবাসবে, ওর প্রতি নিবেদিত হবে।
“আরও প্রশ্ন আছে আমার… আমি আমার স্ত্রী’কে ভালবাসি, তাকে নিয়ে আমি আমার ম্যারেড লাইফে যথেষ্ট সুখী… কি কারণে আমি আমার স্বাভাবিক জীবনে এমন একটা ঘটনা ঘটাবো? আমি তো আপনার কাছে দায়বদ্ধ নই!… আপনার প্রতি আমার কোনও দুর্বলতা তো নেই!…”
“এ কথা বলো না প্লিজ! আমি তো বলছি আমি তোমার ফ্যামিলির সাথে এ্যাডজাস্ট করে নেবো!…”
“পরের প্রশ্ন… আমি আপনার জন্য আমার পরিবারকে কেন আঘাত করবো? আমার মা-বাবা আমাকে অনেক কষ্ট করে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করে বড় করেছেন, এই পর্যায়ে এনে দিয়েছেন… প্রায় বৃদ্ধ এই দুই জন মানুষকে আমি কেন আমার কারণে সামাজিকভাবে হেয় করবো? এমনকি যদি আমি আমার স্ত্রী’র সাথে সুখী নাও হই… সেটার জন্য একটা ভদ্রস্থ সমাধানে না এসে আমি আপনার মতো একজন… আমার অর্ধেক বয়সী একজন মেয়ের সাথে বিবাহ বহির্ভুত সম্পর্ক গড়বো কেন যেটা আমাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে আমার পরিচিতদের কাছে বার বার? আর আমার স্ত্রী? আপনি কি জানেন আমার আর আমার স্ত্রী কতোদিন ধরে এক সাথে আছি? বিয়ে করেছি ১৮ বছর, আর তার আগে আমাদের আরও ৪ বছরের সম্পর্ক… আমার মা-বাবার স্যাক্রিফাইস এক দিকে… আরেক দিকে আমার স্ত্রী… ওর ফ্যামিলি ভালো, ও নিজে গুণী একজন মেয়ে, বিয়ের আগে আমাদের দু’জনের মধ্যে ওরই আগে চাকরি হয়েছিলো… ও চাইলে আমার চাইতে আরও ধনী, আরও এস্ট্যাব্লিশড কাউকে বিয়ে করতে পারতো… কিন্তু সে আমার হাতটা ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যখন আমার নিজের কোনও পরিচয় তৈরি হয়নি, সেই সময় থেকে… কিছুই না থেকে শুরু করে আমি আজকে যা… তার প্রতি পদে পদে রয়ে গেছে ওর কন্ট্রিবিউশন… আমাদের যৌথ জীবনে পায়ে পা মিলিয়ে আমরা দুইজন যুদ্ধ করে এগিয়েছি… আগাচ্ছি আজ ২২ বছর ধরে… আমার মুখের কথা উচ্চারিত হওয়ার আগে সে বাকিটা বুঝে নেয়… প্রচুর লোকজনের মধ্যে ওর দিকে তাকালে আমি বুঝে যাই ও কি চাচ্ছে বা ওর কি প্রয়োজন… অভ্যস্ততায় কম্ফোর্ট থাকে… নিশ্চয়তা থাকে, জানেন তো? আমার এই কম্ফোর্ট জোন ছেড়ে আমি আপনাকে নিয়ে ভাববো কেন? আমার সংসারটা নিজের হাতে একটু একটু করে সাজিয়েছে ও… ওর আর আমার সেই সংসারে ওর যতোখানি কন্ট্রিবিউশন, তার অর্ধেকও আমার নেই… সেখানে আমি আপনাকে প্রবেশ করার অধিকার দেবো কেন? হু আর ইউ? ও ওর জীবনের ২২ বছর দিয়েছে আমাকে… আপনার কি কন্ট্রিবিউশন আমার জীবনে?”
“তুমি করতে দিচ্ছো কোথায়? আমাকে সুযোগ দিয়ে দেখো একবার… আমি নীলার কন্ট্রিবিউশন ভুলিয়ে দিতে পারি কিনা!” শায়নার চোখে-মুখে অধৈর্য্য। এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না ওর স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ওর কল্পনার প্রণয়ঘন মুহূর্তগুলির সাথে এই সমস্ত কথাবার্তার বিন্দুমাত্র মিল নেই। আর সেই অমিল ওকে অস্থির করে তুলছে।
চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো রোহানের, রুক্ষ্ম হয়ে উঠলো গলা, “জীবনে কেউ কারও কন্ট্রিবিউশন ভুলিয়ে দিতে পারে না মিস শায়না… হ্যাঁ, মানুষ নিজেই ভুলে যায়… আর সেই ভুলে যাওয়াকে বলে অকৃতজ্ঞতা… আমি আর যাই হোক, নিজেকে অকৃতজ্ঞ মনে করি না… আর আমি একটু আগেই বললাম যে একদম কিছু না থেকে শুরু করেছি আমি আর নীলা… সেখান থেকে আজকে আমরা এখানে… এখন আমার জীবনে আপনার কন্ট্রিবিউট করার সুযোগ খুবই কম… আমার দিকে হাত বাড়ালে আপনি এখন সব যার আছে, এমন কাউকেই পাচ্ছেন… সেখানে আপনার এফোর্ট দেয়ার কিছুই নেই… স্টেবল চাকরি, গোছানো ব্যাংক ব্যালেন্স, জমি, ফ্ল্যাট… এমনকি বাজারটাও যে দেখেশুনে করতে পারে তেমন একজন… অথচ নীলা যখন আমার সাথে জীবন শুরু করে তখন আমি মাছ-সব্জি কিছুই বেছে কিনতেও পারতাম না… আমি সংসার করতে শিখলাম ওর সাথে… একটা সংসারে কি কি লাগে, ডিটার্জেন্ট পাউডার থেকে শুরু করে ছোট-বড় পেরেক পর্যন্ত, এগুলো শিখতে আমার ১৮ বছর লেগে গেছে… সেখানে এতো সহজ সব কিছু পেয়ে যাওয়া? কোনও ইনভেস্টমেন্ট ছাড়াই পেতে চাচ্ছেন সব একেবারে রেডিমেড? একজন সংসারী পুরুষকে সংসারী করে তুললো একজন এতো বছর ধরে, আর আপনি এক নিমেষে কোনও পরিশ্রম ছাড়াই তাকে পেতে চাইছেন?… এ্যান্ড সরি টু সে মিস… আমার জীবনে ভালো কোনও কন্ট্রিবিউশন তো দুরের কথা… আপনি এই গত কয়েক মাসে আমাকে মাথাব্যথা আর পায়ে পায়ে অপমানিত আর অপদস্থ হবার ভয় ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেন নি… অশান্তি দিয়েছেন চূড়ান্তভাবে… ইজ্জত হারানোর ভয়ে কাঁটা হয়ে থেকেছি আমি এই ক’মাস… প্রেশার হাই হয়ে যাচ্ছে যখন তখন… আপনার কন্ট্রিবিউশনের সূচনাটাই ভয়াবহ আই হ্যাভ টু সে…”
ইগোতে আঘাত লাগা শুরু হয়েছে শায়নার। মেজাজ হারাচ্ছে, “কি আশ্চর্য্য রোহান! আজকে যদি তোমার স্ত্রী মারা যেতো, বা যদি কোনও কারণে তোমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যেতো, তুমি কি জীবনকে দ্বিতীয়বার একটা সুযোগ দিতে না! আবার বিয়ে করতে না তুমি? কিই বা এমন বয়স তোমার? এতো প্র্যাক্টিক্যালি চিন্তা যখন করছোই, তখন এটাও প্র্যাক্টিক্যালি বলো!… সেক্ষেত্রে কি তুমি সংসার জীবনে অভ্যস্ত, এক্সপেরিয়েন্সড কাউকে খুঁজতে? নাকি অবিবাহিত একটা মেয়েকেই খুঁজতে বিয়ে করার জন্য? সত্যি করে বলো… আমাদের দেশের বাস্তবতায় ছেলেদের বয়স বা পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, বিয়ে করার জন্য তারা অবিবাহিত আর অল্পবয়স্ক মেয়ে খোঁজে কিনা বলো তুমি? তখন যদি তুমি সেরকম কাউকে খুঁজতে পারো, তাহলে এখন নয় কেন? আমি না কেন, রোহান?”
মুখটা তিতে হয়ে গেলো রোহানের। এই মেয়ে নিজেও বোধহয় জানে না কি বলছে ও। কতো সহজে মৃত্যুকামনা করে ফেললো একজনের! উত্তর দিলো গুছিয়ে, “প্রথমত, আপনার কথামতো কোনও সিচুয়েশন আমার জীবনে তৈরি হয় নি, থ্যাঙ্ক গড! দ্বিতীয়ত, গড ফরবিড সেরকম কিছু হলেও আমার রুচি এতোটা নিচে নামে নি যে আমি প্রায় আমার নিজের ছেলের বয়সী কাউকে নিয়ে দাম্পত্য সম্পর্কের কথা ভাববো… যদি ভাবতেও হতো তাহলে, হ্যাঁ, আমি আমার মতোই জীবনে পোড় খাওয়া, অভিজ্ঞ কাউকেই খুঁজতাম যে সঙ্গী হারানো বা সঙ্গীর সাথে বনিবনা না হওয়ার ক্ষতটাকে বুঝবে, এবং সেই জায়গাটাকে শ্রদ্ধা করবে, আপনার মতো এইরকম নির্বোধের মতো সেই জায়গা নিয়ে খোঁচাখুঁচি করবে না… হ্যাঁ, আমি মানছি যে আগেকার দিনের পুরুষেরা মরার আগের দিন পর্যন্ত অল্পবয়সী, ছোট মেয়ে বিয়ে করতে চাইতো… এটা সেই যুগ না… আপনি এই জেনারেশনের মেয়ে হয়ে এমন মান্ধাতার আমলের ধ্যান-ধারণা নিয়ে বসে আছেন এটা ভাবতেই আমার অবাক লাগছে… কেউ যদি অসম বয়সী সঙ্গী খোঁজে এবং তাকে নিয়ে ভালো থাকে, সেটা তার ব্যক্তিগত রুচি এবং সিদ্ধান্ত… আমার সিদ্ধান্ত তেমনটা হওয়ার না…”
কিছু বলার জন্য মুখ খুললো শায়না, কিন্তু কথা চালিয়ে গেলো রোহান ওকে বলবার সুযোগ না দিয়ে, “তৃতীয়ত, আমি একটা ফুল অ্যান্ড কমপ্লিট লাইফ অলরেডি লিভ করেছি মিস শায়না… এটা বোধহয় আপনাকে বোঝানো সম্ভব না, কারণ আপনার জীবন কেবল শুরু, সময় এখনও সামনে পড়ে… আমি মা-বাবা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে, আমার চাকরি, সংসার, ইনকাম-খরচা, বাজার, দাওয়াত, সুস্থতা-অসুস্থতা, নিজের কাজ, শখ, ব্যস্ততা, ভ্যাকেশন… এই সমস্ত কিছু নিয়ে একটা ফুল লাইফ লিড করেছি এবং করছি… হ্যাঁ, এর মধ্যেও নিজের সঙ্গী হারিয়ে ফেললে মানুষের জীবনে অপূর্ণতা নিশ্চয়ই আসে… কিন্তু একে তো আমার সঙ্গী আমার পাশে উপস্থিত, তাছাড়াও, এই পূর্ণ জীবনের স্বাদ পাওয়ার পরেও আবার নতুন করে কিছু ভাবতে যাওয়াটা পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় না হলেও বাধ্যতামূলক না আমার জন্য…”
“অসম বয়সী প্রেম নিয়ে এতো আপত্তি তোমার! আর নিজেকে আধুনিক বলে দাবী করছো? এতো এতো লেখালেখি… এতো মুভি পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে এখন…”, ব্যঙ্গ ফুটিয়ে তুলে বললো শায়না বাঁকা স্বরে।
আবার হাত তুলে থামিয়ে দিলো রোহান শায়নাকে, “প্রেম এক জিনিস… প্রেম বয়স, অবস্থান এই সমস্ত কিছু দেখে হয় না… আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড… বাট আপনি যেটা বলেছেন সেটার অর্থ দাঁড়ায় হলো পুরুষ মানুষের একমাত্র কোয়ালিফিকেশন হলো সে পুরুষ, এটা… সোনার আংটি বাঁকা হলেই বা কি… এবং যে কোনও বয়সে, যে কোনও পরিস্থিতিতে পুরুষ মেয়েমানুষের নামে একটা ‘ফ্রেশ মাল’ ডিজার্ভ করে, এক্সট্রিমলি সরি ফর মাই ল্যাঙ্গুয়েজ… সেই কথাটাকেই এস্ট্যাব্লিশ করছেন আপনি… আপনার বক্তব্য আপনারই জেন্ডারের জন্য অত্যন্ত অফেন্সিভ ছিলো… সেটা আপনি নিজে না বুঝলে আমার পক্ষে বোঝানো সম্ভব না… আপনি অন্তত এইটুকু বুঝুন যে, আমি এক বিয়ে করেছি, আমার আব্বার একটাই বিয়ে… আমার দাদা এমন কি তাঁর দাদারও একটা করেই বিয়ে ছিলো… আমাদের বংশে পুরুষ মানুষ একটা করে বউ নিয়েই থেকেছে বরাবর আমার জানামতে… আমিও একটা বিয়ে করে একটা বউ নিয়েই সুখী আছি…”
ওর কথায় বাধা দিয়ে শায়না বলে উঠলো, “রোহান! মানুষ কি দ্বিতীয়বার প্রেমে পড়ে না!… এমনভাবে কথা বলছো যেন দুনিয়াতে কেউ কখনও দ্বিতীয় একটা সম্পর্কে জড়ায় না!”
“একবার বলেছি এখানে কোনও প্রেমের প্রশ্ন নেই, আমি আপনাকে সেই দৃষ্টিতে দেখিই না… তো আপনি কি তাহলে এটাই চাচ্ছেন যে আমি আপনার কারণে একটা অসামাজিক, অনৈতিক সম্পর্কে জড়াই? পূঙ্খানুপূঙ্খভাবে ধর্ম ফলো না করলেও ধর্মে অবিশ্বাসী আমি নই… আপনি শুধু আমাকে অকৃতজ্ঞ হতেই বলছেন না আমার পরিবারের কাছে… আপনি আমাকে ধর্মীয় দিক থেকেও অধর্মের কাজ করতে বলছেন… নৈতিকভাবেও স্খলিত হতে বলছেন, তাই তো?”
কঁকিয়ে উঠলো শায়না, “কেন! তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে পারো না? বিয়ে করলে তো আর অনৈতিক থাকছে না ব্যাপারটা, তাই না? বিয়ে করা তো ধর্মে পারমিটেড! কেন অস্বীকার করছো রোহান!… তুমি আমাকে ভালবাসো… আমি জানি!… প্লিজ এ কথা বলো না যে তোমার কোনও দুর্বলতা নেই আমার জন্য… আমি তোমার চোখে…”
হাত তুলে শায়নাকে থামিয়ে দিলো রোহান। বুঝতে পারছে যে ওকে আরও কড়া হতে হবে। অভদ্রতা করা ওর স্বভাবের সাথে যায় না, কিন্তু এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
“শায়না… স্পষ্টভাবে আবার বলছি… আপনার প্রতি আমার কোনও ধরণের কোনও দুর্বলতা নেই… ভালবাসা তো দূর!… আর আপনাকে আমি বলেছিলাম আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো শুধু দেয়ার জন্য… আপনার কথা বলার অনেক সময় আপনি পেয়েছেন… গত কয়েক মাস ধরে আপনার কথাই শুনে আসছি ক্রমাগত… আজ আপনাকে আমার কথা শুনতে হবে… এই সহজ সত্যটা যখন আপনি বুঝতে পারছেন না বা বুঝতে চাইছেন না যে আমি আপনার প্রতি আকৃষ্ট নই… তখন আমাকে এবার কিছুটা খারাপ ভাবেই আপনাকে বোঝাতে হবে… যেটা আমি কখনোই করতে চাই নি…”
ক্ষেপে উঠেছে শায়না। হিস হিস করে বললো, “কি আছে ওই নীলার মধ্যে? আমার রূপের ধারেকাছে লাগে ও? একটা আনস্মার্ট, খ্যাত! বুড়ী!…”
রোহানের ইস্পাত-শীতল দৃষ্টির সামনে থেমে যেতে বাধ্য হলো শায়না।
দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো রোহানের বক্তব্যের। জলদ্গম্ভীর স্বরে এবার রোহান বললো, “আপনি আমার স্ত্রী’কে কি ভাবেন সেটা শুনলাম… এবার আমি আপনাকে কি ভাবছি সেটা শুনুন… আপনি স্বার্থপর এবং আত্মকেন্দ্রিক… আপনার নিজের অনুভূতি, আবেগ নিয়ে আপনি এতোটাই অকুপায়েড যে অন্য কারও… এমনকি আমার আবেগ, অনুভূতির ব্যাপারেও আপনি উদাসীন… বারে বারে বলছি… আমি আপনাকে বিশেষ কোনও দৃষ্টিতে দেখি না… আপনি জোর করে নিজের ভালো লাগাটা আমার উপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন ক্রমাগত…”
মুখ অল্প হাঁ হয়ে গেছে শায়নার। রোহান যে এভাবে বলবে, এটা ওর ধারণার বাইরে ছিলো।
“আপনি অবিবেচক… একটু আগেই বললাম আমার পরিবারের কথা… আমার সন্তানদের কথা… শুধু নিজেরটুকু দেখেন বিধায়, আপনি একটা বারের জন্যও ভাবছেন না আপনার এবং আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের ফল ভুগবে কতোগুলো মানুষ… আমার সন্তানরা স্কুলে, বন্ধুবান্ধবের সামনে, আশেপাশের বাকি লোকজনের সামনে কি ফেস করবে… ওরা এখন আর একদম ছোট নয় যে এসব বিষয় বুঝবে না… ওদের সামনে আপনি আমাকে চরিত্রহীন প্রমাণ করতে চাইছেন… আপনার নাহয় সমাজের চিন্তা নেই… কিন্তু আমার সন্তানদেরকেও সামাজিকভাবে হেয় করতে আপনি দুইবার ভাবছেন না… একটু আগে যে বললাম আপনি স্বার্থপর… আপনি আমার প্রতি আপনার ভাল লাগাটুকুকেই বড় করে দেখছেন… সেখানে আমার সাথে, আমার জীবনে জড়িত আর যারা, তারা আপনার কাছে নগন্য… অথচ আমার সন্তান আমার অংশ… যদি ধরেও নেই যে আপনার সাথে আমার কোনও ভবিষ্যতের ন্যূনতম কোনও সম্ভাবনাও আছে… একজন বাবা হিসেবে আমার কাছে আপনি অত্যন্ত বাজে চয়েস… যে এখনই আমার সন্তানদের ভালোমন্দের বিষয়ে এতোখানি উদাসীন… সে ভবিষ্যতে আমার সন্তানদের কিভাবে দেখবে?… আমি মানুষ হিসেবে যেমনই হই না কেন… বাবা হিসেবে আমি নিজেকে আদর্শ এবং ভাল একজন বাবা বলে ভাবতেই পছন্দ করি…”
মুখ চোখ লাল হয়ে উঠছে শায়নার। অপমানিত হবে কিনা এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। কিন্তু বুঝতে পারছে যে ভুল করে ফেলেছে ও। যদিও ভুল কতোটা ওর, সেটা বোঝা তখনও বাকি ছিলো শায়নার। বলতে গেলো, “রোহান! আই এ্যাম সরি… আমি এতোসব ভেবে কিছু বলি নি…”
ওর কথার মাঝ দিয়েই বলে চললো রোহান, “আরও বলছি… আপনি অদূরদর্শী… আপনি সম্ভবত যখন বলছেন যে আপনি আমার পরিবারকে বোঝাবেন… আপনি শুধুমাত্র আমার স্ত্রী’কেই মিন করছেন… কিন্তু আমি তো শুধুমাত্র আমার স্ত্রী’কে আমার পরিবার বলছি না!… আমার মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, আমার ছোট ভাই, তার স্ত্রী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজন… আমার শ্যালক-শ্যালিকা… তারা প্রত্যেকে বিবাহিত… সুতরাং তাদের পরিবার… আমার মামা-চাচা-খালা-ফুফু কাজিন এবং তাদের সকলের পরিবার… একদম ইমিডিয়েট ফ্যামিলি বললেও তো এই এতোগুলো মানুষ এবং এতোগুলো পরিবারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক… এদের সবাইকে আপনি বোঝাবেন? এদের সবাইকে আপনি জনে জনে গিয়ে বলবেন যে আপনি আমাকে কতোটা পছন্দ করেন?…”
“আশ্চর্য্য!… এতো লোকের কথা কেন আসছে? তুমি কি তোমার জীবনের সমস্ত সিদ্ধান্ত এতো জনকে জানিয়ে নাও নাকি! আজব তো!”
“আমি আমার সিদ্ধান্ত এতোজনের সাথে পরামর্শ করে অবশ্যই নেই না… এটা যেমন ঠিক, তেমন এটাও ঠিক যে আজ পর্যন্ত জীবনে আমাকে এমন কোনও সিদ্ধান্ত নিতেও হয় নি যার কারণে এদের সামনে আমাকে ছোট হতে হয়, অথবা আমাকে নিয়ে এদেরকে লজ্জিত হতে হয়… এই সিদ্ধান্ত যদি এমন হতো যে আমি বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডাতে থাকা শুরু করবো কিনা, তাহলে এখানে এদের মতামতের প্রয়োজন হতো না… কারণ সেই সিদ্ধান্ত সবার মনঃপূত না হলেও কারও জন্য লজ্জাজনক হতো না… কিন্তু আনফরচুনেটলি, আপনি আমাকে যে জন্য উস্কাচ্ছেন… সেটা একটা লজ্জাজনক কাজ…”
এবার রাগে ফোঁস ফোঁস করছে শায়না, “ভালবাসা লজ্জাজনক? প্রেম হতে পারে না?”

(আগামীকাল সমাপ্য)
ধন্যবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here