দেশলাই – ১৬ পর্ব
বাস শাঁ শাঁ করে এগিয়ে চলেছে। দু’জন ব্যাগ কোলে নিয়ে বসা। ইলি জানালার পাশটায়। রাফসান একবার ওর দিকে তাকায়, খুব বেশি সাজগোজ নেই। বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। ঘন কালো ভ্রু। রোজকার মতো একাপাশের চুল কানে গুঁজে অন্যপাশের চুল কপাল বেয়ে বুকে এসে পড়েছে৷ চটপটে স্বভাব, কিছুতেই জড়তা নেই। কৃত্রিমতা নেই।
– ‘কি রে চুপচাপ বসে আছিস যে?’
– ‘কি কথা বলবো?’
– ‘সারাক্ষণ বকবক করা তো তোর অভ্যাস। এখন কথা খুঁজে পাচ্ছিস না?’
– ‘আমার বকবকানির অভ্যাস আছে জানি বলতে হবে না।’
– ‘আচ্ছা আমি চলে যাওয়ার পর কি হয়েছিল সেদিন?’
– ‘বুঝিনি কথাটা।’
– ‘আমি বিয়ের রাতে চলে যাওয়ার পর নববধূকে কীভাবে বিদায় করা হলো? কোনো ঝামেলা হয়নি?’
– ‘বিয়ের রাতেই বর যদি বধূকে গ্রহণ না করে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তাহলে কীসের ঝামেলাটাই হবে?’
– ‘এভাবে কথা বলছিস কেন?’
– ‘তুমিই বা এই কথাগুলো বাসে জিজ্ঞেস করছো কেন? বাড়িতে তো জিজ্ঞেস করোনি?’
– ‘আমি মাত্র গত কাল এলাম। তোকে জিজ্ঞেস করবো করবো করে করা হয়নি। আচ্ছা এগুলো এখন থাক পরে জানা যাবে। এখন বল তো হুট করে তোর মেজাজ খারাপ হলো কেন?’
– ‘কেন খারাপ হয়েছে বলবো?’
– ‘বল।’
– ‘আমাকে বাসে বসিয়ে তুমি বাইরে গিয়ে তাড়াহুড়ো করে সিগারেট টেনে এসেছো। এখন গন্ধে আমার বসতে অসুবিধা হচ্ছে তাই মেজাজ খারাপ।’
– ‘ওরে আল্লাহ। তুই এতো খেয়াল করিস কেন সবকিছু?’
– ‘তার আগে বলো তোমার যদি সিগারেট খেতেই হয় বুঝেশুনে খেলে না কেন? তুমি তো জানো সিগারেট টেনেই আরেকজনের পাশে গিয়ে বসবে।’
রাফসান আর কোনো কথা না বলে ম্লান মুখে বসে রইল।
ইলি তাকিয়ে বলল, ‘তুমি রাগ করোনি আমি জানি। রাগ করলে সীট ছেড়ে চলে যেতে। কি বলবে খুঁজে না পেয়ে ভারি মুখ করে বসে আছো।’
– ‘আমি অযথা রাগ করবো কেন? আচ্ছা যা, আমি দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। তবে রাগ করে না। এমনিই।’
– ‘না, বসো। তোমার বউয়ের কথা জানতে চাইছিলে।’
– ‘আমার বউ মানে?’
– ‘ওমা এখনও তো সে তোমার বউ।’
– ‘উল্টাপাল্টা কথা বলবি না তো।’
– ‘আচ্ছা শোনো কি হয়েছিল। তুমি চলে যাওয়ার পর ফুপু অনেক ভেঙে পড়েছিলেন। তিনিও বউ রাখবেন না। কিন্তু মুরব্বিরা তোমার অপেক্ষায় ছিলেন। তুমি এলে কনেপক্ষকে ডেকে আলোচনা করে কিছু করা যাবে। কিন্তু তুমি আসছিলে না। বধূও লজ্জা-অপমানে নিজ থেকে বলে ওর অবিভাবকদের ডাকতে সে চলে যাবে। তারপর আর কি। আব্বা ঘটকের মাধ্যমে ওর অভিভাবকদের ডেকে জানালেন মেয়ের অসুখ গোপন রেখে বিয়ে দেওয়ায় বর কনেকে মেনে নিচ্ছে না। বাড়ি থেকেও কোথায় চলে গেছে খোঁজ-খবর নেই। ওরা অবশ্য নানান কথা তুলেছিল। আইন-কানুন দেখাচ্ছিল। কিন্তু কনে পরিষ্কার ভাষায় বলেছে থাকবে না। তারপর ওরা নিয়ে গেল।’
– ‘বুঝেছি। মা শেষদিকে অনেক ভেঙে পড়েছিলেন তাই না?’
– ‘হুম। তোমার জন্য অনেক দুশ্চিন্তা করতেন।’
দু’জন অনেক্ষণ চুপচাপ থাকে। খানিক্ষণ পর ইলি নীরবতা ভেঙে বলল, ‘আচ্ছা রাফসান ভাই। আমি না-কি ফুপুর মতো হয়েছি?’
– ‘কোন ফুপু?
– তোমার আম্মা।
– আমার কাছে লাগে না তো।
– বাবা বলেন।
– ও আচ্ছা।
– যেদিন ফুপু মারা গেলেন তার আগেরদিন আমি রাতে স্বপ্নে দেখলাম সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে বাঁশ কাটছে। কেউ কেউ মাটি খুঁড়ছে।
– তাই না-কি?
– হ্যাঁ। আমি এরকম দেখি। যেমন তোমার মৃত্যুর আগেও স্বপ্নে দেখতাম কত কি।
– আমার মৃত্যুর আগে মানে? তুই পাগল হয়ে যাচ্ছিস না-কি।
– তুমি জীবিত?
– কি বুঝাতে চাচ্ছিস?
– কিছু না।
– তোর একটা অভ্যাস কি জানিস?
– কি?
– ছোট থেকেই তোর অভ্যাস ছিল খালি বড়দের মতো ভাব নেয়া। যেমন ছোট বেলায় শাড়ি পরে মামীর মতো ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাজ করা। কথা বলা।
– মিথ্যে।
– সত্য। গিয়ে জিজ্ঞেস করিস মামীকে।
– তার মানে কি দাঁড়াল। আমি এখন মুরব্বিয়ানা করছি। তাইতো?
– সব সময়ই করিস।
– করতেই পারি। ফোর্থ ইয়ারে পড়ি৷ দু’দিন পর গ্রাজুয়েশন কম্পেলেট হবে। মুরব্বিয়ানা করলে বেমানান লাগার কিছু নাই।
– বাবা।
ইলি ম্লান মুখে বাইরে খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার বলল, ‘আমার মুরব্বিয়ানায় তুমি বিরক্ত তাই না?’
– ‘সিরিয়াস হচ্ছিস কেন? আমি এমনিতেই বললাম।’
– ‘বিরক্ত হলেও মুরব্বিয়ানা করবো।’
রাফসান হেঁসে বলল, ‘আচ্ছা করিস।’
– ‘শ্রীমঙ্গল টাউনে নেমে অনেক মুরব্বিয়ানা করবো। সব বাধ্য ছেলের মতো শুনতে হবে।’
– ‘কি করবি?’
– ‘নামার পর দেখা যাবে।’
– ‘আচ্ছা।’
তারপর আবার দু’জন নীরব। ঘন্টা দুয়েকের ভেতরেই তারা শ্রীমঙ্গল পৌঁছে গেল। ব্যস্ত শহর। ব্যস্ত মানুষ। রিকশার টুংটাং শব্দ। গাড়ির সাইরেন। তারা বাস থেকে নেমে গেল।
ইলি চারদিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘হোটেল একটা দেখা যাচ্ছে। চলো চা খেতে খেতে বলি।’
– ‘কি এতো বলবি? শুধু ঢংই করছিস।’
দু’জন হোটেলের ক্যাবিনে গিয়ে বসে। ওয়েটার চা দিলো।
ইলি চুমুক দিয়ে বলল, ‘একটা কথা রাখবে তো?’
– ‘কি?’
– ‘সেলুনে চলো। তুমি সিলেট থাকতে যেভাবে চুল আর দাড়ি কাটছাঁট দিয়ে রেখেছিলে সেরকম কাটবে।’
– ‘ও বাবা কতবার কতভাবে কেটেছি মনেই তো নাই।’
– ‘ওই যে একদিন আমি পড়ার টেবিলে ছিলাম। তুমি এলে। গালে কাটছাঁট মেরে রাখা দাড়ি। চুল স্টেইট করা। বাম হাতে কালো ঘড়ি। পরনে পানপাতা রঙের গেঞ্জি। কালো ট্রাউজার।’
– ‘সব মনে আছে তোর? কিন্তু এখন চুল স্ট্রেইট দেবার সময় নাই।’
– ‘স্ট্রেইট লাগবে না, সামনের চুল লম্বা রেখে সেরকম কাটবে। তারপর বাজার থেকে ঘড়ি, গেঞ্জি কিনবো।’
– ‘এতো টাকা তো নেই আমার কাছে।’
– ‘আমার কাছে আছে।’
– ‘কই পেলি?’
– ‘আমি তো করোনা আসার আগে লাগাতার টিউশনি করিয়েছি। কিন্তু টাকা খরচ হয় না কিছুই। পড়ালেখা সহ সব খরচ তো খালারা পাঠিয়ে দেন।’
– ‘তাহলে টিউশনি কষ্ট করে করতে যাস ক্যান?’
– ‘আমার ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগে।’
রাফসান খানিক হেঁসে বলল,
– ‘ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগে এটা কেমন কথা?’
– ‘থাকুক কেমন কথা। এখন চা খেয়ে সেলুনে চলো।’
– ‘বাদ দে। পরে কাটবো। তোর টাকা খরচা করার দরকার নাই।’
– ‘শোন রাফসান ভাই, ঘাড়ত্যাড়ামি অভ্যাসটা ছাড়ো। তুমি কিন্তু নিজের ভুলে লাইফটা নষ্ট করেছো। পড়ালেখা সবকিছু বাদ গেছে। ইন্ডিয়া গিয়েও এক বছর নষ্ট হয়েছে। বিধবা মাও তোমার চিন্তায় তিলে তিলে শেষ হয়েছেন। বিয়ে একটা করেও ঝামেলা হলো। লোকে এখন তোমাকে পাগল বলে জানো সেটা? এই অবস্থায় তুমি মেহমান বাড়ি গেলে সবাই দেখে কি বলবে? আমার কথা শোন। শ্রীমঙ্গল এসেছো, এখন রিফ্রেশ হও। আমারও বেড়ানোর ইচ্ছা৷ এই কয়দিন তুমি আমার কথামতো চলতে পারবে না? আমি শ্রীমঙ্গলে সব জায়গা তোমাকে নিয়ে ঘুরবো। আমি যেভাবে বলবো সেভাবে চলবে।’
– ‘তারপর কি হবে? রিফ্রেশ হয়ে গেলে আমার সবকিছু কি ফিরে আসবে?’
– ‘না, কিন্তু নতুন করে ভাবতে হবে তো তোমাকে। মনটা সতেজ হোক। তাছাড়া হঠাৎ করে এসে শুনেছো ফুপু মারা গেছেন। সবকিছু মিলিয়ে তোমার কিছু ভালো মুহূর্ত কাটুক। চুল-দাড়ি কেটে সেলুনে মাথা ধুয়ে-মুছে নেবে। তারপর শপিং করে ট্রায়াল রুমে গিয়ে সব পরে নিবে।’
– ‘তুই নিজেই ঘাড়ত্যাড়া। আমাকে উল্টো বলিস।’
– ‘তোমার মাথা। উঠো। আর এই টাকাগুলো তোমার কাছে নাও। সব জায়গায় তুমিই বিল দেবে।’
চা বিল চুকিয়ে তারা সেলুনে যায়। ইলি সেলুনের বাইরের সোফায় বসে মোবাইল টিপে। কোনো বিব্রতবোধ নেই। চুল-দাড়ি কেটে রাফসান বেরুল। ইলি তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বলল,
– ‘এবার অনেকটা ভালো লাগছে।’
– ‘তাই না-কি?’
– ‘হুম। আচ্ছা চলো। তোমার শপিং করবে।’
তাদের কেনা-কাটা শেষ হতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। শীতের কারণে ইলি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলো শপিংমলে গিয়ে। গেঞ্জি না কিনে শার্ট নিল। রাফসানের ব্যাগেই ছিল গোল গলার কালো গেঞ্জি। সেটির উপর শার্ট। বাম হাতে ঘড়ি। শার্টের হাত গুটানো। প্যান্ট আগেরটাই চলার মতো আছে। কিন্তু টাকায় টান পড়তে পারে ভেবে কেডস পরিবর্তন করা হলো না। তারা রাস্তায় বেরিয়ে এলো। শহরজুড়ে নানান রঙের বাতি জ্বলছে। ইলি তাকিয়ে রসিকতা করে বলল,
– ‘পুরাই হিরো লাগছে।’
– ‘পাম দিস না।’
– ‘সত্যি বলছি। তোমার নিজেকে ফ্রেশ লাগছে না?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘চলো মেহমান বাড়ির জন্য কিছু নিই।’
দু’জন গেল একটি দোকানে। এরমধ্যেই হৃদ কল দেয় ইলিকে। ফুপুর বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে বলে রেখে দেয় ইলি।
দোকান থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে তারা চললো বাসার দিকে। চারপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলছে সিএনজি।
– ‘যা শালা। সীম তোলা হয়নি।’
– ‘কাল বেরুলে তুলে নেয়া যাবে। আমারও মনে পড়েনি।’
– ‘হ্যাঁ কাল তুলতে হবে।’
মিনিট বিশেক পরেই তারা পৌঁছে গেল। ব্যাগ-প্যাক নামিয়ে ভাড়া চুকিয়ে তারা বাড়ির দিকে যাচ্ছে। ইলি তাকিয়ে দেখলো গাড়ির শব্দ শুনেই ফুপু আর ফুফা উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন৷ তারা যেতেই রোগাটে ফুপু দু’জনকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘সেই কখন লতিফ মিয়া কল দিয়ে বললো তোরা বেরিয়েছিস। এতো দেরি হলো কেন রে? চলো ঘরে চলো।’
ঘরে গেল। তাদের দেখে পর্দার আড়ালে লুকোচুরি করছে বাচ্চা একটি মেয়ে। ইলি এগিয়ে গিয়ে তাকে টেনে বের করে কাছে নিয়ে বলল, ‘ফুপু ও মিনহাজ ভাইয়ের মেয়ে তাই না?’
– ‘চিনবি কেমনে? এসে দেখেছিস ওর জন্মের পর?’
– ‘পড়ালেখার জন্য আসা হয়নি। আব্বা তো এসেছিলেন। ওর নাম লিজা তাই না?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘আমার এক বান্ধবীর নামও লিজা। আচ্ছা মিনহাজ ভাই কোথায়?’
– ‘দোকানে আছে। দশটার পর চলে আসবে।’
লিজার মা এলেন। তাদের সঙ্গে কথা হলো।
মিনহাজের সঙ্গে রাতের খাবার টেবিলে দেখা হয়।
ভদ্রতার বাক্য বিনিময়ের পর ইলি জিজ্ঞেস করল, ‘মিনহাজ ভাই, হামহাম জলপ্রপাতের রাস্তা এখন কেমন?’
– ‘ওদিকের রাস্তা সব সময়ই খারাপ। এখন কিছুটা ভালো আছে। তবে বর্ষাকালে জায়গাটা বেশি ভালো লাগে। যাবি না-কি?’
– ‘হ্যাঁ, কালই যাবো।’
— চলবে—
লেখা: MD Jobrul Islam
রাতের খাবার শেষে সবাই পারভীন বেগমের (ইলির ফুপুর) রুমে বসে গল্পে মেতে উঠলেন। ভদ্রমহিলা ভীষণ মিশুক। কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিশতে অত্যন্ত পছন্দ করেন। খানিক পর মিনহাজের বাবা গিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাকীরা চেয়ার আর পালঙ্কে বসে পারভীন বেগমের গল্প শুনছে। সব গল্পই অতীতের দুঃখ-সুখের গল্প। এক সময় এই জগত-সংসারে দাপিয়ে বেড়ানো বিয়োগ হওয়া আপন মানুষগুলোর স্মৃতিচারণের গল্প।
ইলি হঠাৎ মিনহাজকে বলল,
– ‘মনে আছে আপনি আর ঈশী আপু বকুল পুর বেড়াতে গেলে রাফসান ভাই সহ আমরা সকলে চোর-পুলিশ খেলতাম?’
– ‘হ্যাঁ মনে আছে। কিন্তু এখন এগুলো কেউ খেলে না-কি? মাত্র সাত-আট বছর আগেও মানুষ বৃষ্টির দিনে বা মেহমান বাড়িতে এলে লুডু আর চোর-পুলিশ খেলে সময় কাটাতো। এখন মোবাইল, টিভি সবার হাতে হাতে, ঘরে ঘরে তাই কেউ খেলে না।’
রাফসান রসিকতা করে বলল, ‘সবার সবকিছুই মনে আছে খালি মনে নাই সব খেলায় কে রেগুলার জিততো।’
সকলেই ‘হু-হু’ করে হেঁসে উঠলেন।
ইলি মিনহাজের দিকে ফিরে বলল,
– ‘আচ্ছা মিনহাজ ভাই, এক দিনে শ্রীমঙ্গলের কতটা জায়গা ঘুরে দেখা যাবে?’
– ‘কেন তুই এর আগে শ্রীমঙ্গল ঘুরে দেখিসনি?’
– ‘ছোটবেলায় দেখেছি। মাধবপুর লেক আর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের কথা মনে আছে।’
– ‘আর কোথায় যাবি? একদিনে হামহাম জলপ্রভাত ছাড়া সবই ঘুরতে পারবি।’
– ‘তাহলে হামহাম জলপ্রভাতে কাল চলে যাই।’
– ‘শ্রীমঙ্গলে দর্শনীয় স্থানের কি অভাব? হামহাম জলপ্রপাতের রাস্তা ভালো না৷ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ছোট ছোট খাল দিয়ে লাঠি হাতে নিয়ে হেঁটে যেতে হয়। পানিতে জোকও অনেক। লাঠি হাতে থাকলে অবশ্য পা পিছলেও পরবি না। আরেকটা রাস্তা আছে পাহাড়ের উপর দিয়ে। সেদিকে বেশি কষ্ট।
– ‘উফ কি এডভেঞ্চার হবে।’
– ‘যা গিয়ে মর।’
– ‘হুদাই ভয় দেখাইও না তো মিনহাজ ভাই। তুমি কি ভাবছো আমি এগুলোর খবর রাখি না? ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকেও পুরুষ-মহিলারা দেখতে যায়। তারা পারলে আমরা বাড়ির পাশে থেকেও পারবো না কেন?’
– ‘আচ্ছা যা ইচ্ছে হইলে। কিন্তু আমি যেতে পারবো না।’
– ‘তুমি যেতে হবে না। শুধু দোকানে গেলে পরিচিত একটা সিএনজি দশটার আগে পাঠিয়ে দিয়ো।’
– ‘আচ্ছা। তাইলে শোন৷ অন্যরা যদিও মোবাইল-ব্যাগ নিয়েও যায়। পরিচিত সিএনজি হওয়ায় তোমরা সবকিছু রেখে যেতে পারবে। ছবি তুলতে হলেও দু’জনের মধ্যে একজনের মোবাইল নিবি। রাফসান শর্ট প্যান্ট পরে নিস। একটা স্কুল ব্যাগ পেছনে ফেলে নিবি। সেটায় মোবাইল আর জোক ছাড়ানোর জন্য লবণ রাখতে পারবি।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে৷ কিন্তু লবণ লাগবে না। জোক এতো ভয় পাই না আমি।’
– ‘ইলি ভয় পাবে।’
– ‘সমস্যা নাই আমি তো আছিই।’
রাত বারোটার দিকে সবাই যার যার রুমে ঘুমোতে চলে গেল। রাফসানকে বারান্দার লাগোয়া রুমটিতে দেয়া হয়েছে। ইলি ঘুমিয়েছে পারভীন বেগমের সঙ্গে।
ভ্রমণের আমেজ আর উত্তেজনায় ইলির ভোর ছ’টায় ঘুম ভেঙে গেল। ইলি দাঁত ব্রাশ করতে করতে রান্নাঘরে গিয়ে পেল লিজার মা ঘরদোর ঝাড়ু দিচ্ছেন। সে পেছনের পুকুরে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে এসে বলল,
– ‘ভাবী চলো তোমার দেবরের সঙ্গে দুষ্টামি করবে আমি আড়াল থেকে দেখবো।’
– ‘বুঝিনি, কার সাথে?’
– ‘রাফসান ভাইয়ের সঙ্গে। সে তো মিনহাজ ভাইয়ের ছোট।’
– ‘যাও তো আমি পারবো না। ওর সাথে সেরকম কথাবার্তাও হয়নি।’
– ‘তাইলে চলো আমি দুষ্টামি করবো তুমি দেখবে।’
– ‘না না। আমি যেতে পারবো না। তুমিই দুষ্টুমি করো গিয়ে।’
– ‘ধুরো, তুমি কচুর ভাবী। রাফসাইন্নার ভাবী আমি। দেখো কি করি।’
ইলি হনহন করে চলে গেল। পারভীন বেগমের এখান থেকে সামনের রুমের দরজায় শুধু পর্দা টানানো, বারান্দার দিকে দরজা। ইলি চুপিচুপি পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয়। রাফসান শর্ট প্যান্টের সঙ্গে গেঞ্জি পরে ঘুমিয়েছে। পালঙ্ক একেবারে এই দরজার পাশেই। ইলি পর্দার ফাঁক দিয়ে আস্তে করে হাত বাড়িয়ে চুলে টান দিয়ে একচোখে দেখে।
রাফসান মাথা তুলে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে কিছু বুঝতে না পেরে আবার ঘুমায়৷ ইলি আবার চুলে টান দিতে গিয়েও দিলো না। কাল চুল কেটে শ্যাম্পু করায় কেমন সিল্কি লাগছে। ইচ্ছে করছে চুলে আঙুল ডুবিয়ে নেড়ে দিতে। ইলির অকারণ আর জ্বালাতন করতে ইচ্ছে হলো না। গিয়ে দেখলো লিজা ঘুম থেকে উঠে গেছে। তাকে নিয়ে বাইরে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাতে লাগলো। এ বাড়ির পশ্চিমেই বিরাট একটা পাহাড়। চারপাশে হেঁটে দেখে খানিক্ষণ পর ইলি আবার ফিরে এলো। রাফসান এখনও ঘুমোচ্ছে। ইলির কেন যেন ভালো লাগছে না। তবুও ফুপুর পালঙ্কে শুয়ে মোবাইল বের করে টিপাটিপি শুরু করলো। হঠাৎ তাকিয়ে দেখে আটটা হয়ে গেছে। আস্তে করে নেমে রাফসানের রুমের পর্দা সরায়। এখনও ঘুমোচ্ছে৷ ইলি ভেতরে গেল। চুল-দাড়ি কাটায় একদিনেই যেন অনেকখানি পাল্টে গেছে মানুষটা। ইলি বালিশে ধাক্কা দিয়ে আস্তে করে ডাকে, ‘রাফসান ভাই উঠো।’
রাফসান চোখ মেলে তাকায়।
– ‘উঠো আটটা বেজে গেছে।’
রাফসান হাই তুলে উঠে বসে বলল, ‘ভোরে তুই আমার চুল ধরে টান দিয়েছিলি কেন?’
ইলি চমকে উঠলো৷ ধরা পড়ে গেল কি-না কে জানে। আমতা-আমতা করে বলল,
– ‘কই না তো।’
– ‘মিথ্যা বলিস না।’
– ‘দিলে দিছি, এখন উঠো।’
নাস্তা করার পর সাড়ে ন’টায় সিএনজি এলো। বাড়িতে ভাত খেয়ে যেতে বললেও তারা খেলো না। পারভীন বেগম টিফিনে খাবার দিতে চাইলেও ইলি নিষেধ করলো। বাইরে খাওয়াও না-কি ভ্রমণের অংশ।
ব্যাগ-প্যাক নিয়ে তারা সিএনজিতে উঠে। কাঁচা-পাকনা দাড়ি-গোঁফ ওয়ালা মধ্যবয়স্ক ড্রাইভার। পাহাড়ি এলাকার আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে সিএনজি চলছে। বাড়ি থেকে শহর কাছেই। খানিক পরেই তারা শহরে চলে এলো।
ড্রাইভার পেছনে তাকিয়ে বলল, ‘পানসি রেস্টুরেন্টের দিকে নেব না-কি? এখানে কি নাস্তা-টাস্তা কিছু করবেন?’
ইলি রাফসানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কি করবে?’
রাফসান ড্রাইভারকে বলল, ‘মামা হামহাম যেতে কি খাওয়ার কিচ্ছু পাবো না?’
– ‘একেবারে কলাবন গিয়ে পাইবেন। সেখানে আগে বইলা গেলে আসার সময় খেতে পারবেন।
– ‘ইলি তাহলে আমরা এখান থেকে খিচুড়ি নিয়ে চলে যাই। কলাবন গিয়ে আগে খেয়ে নিতে হবে। হাঁটার রাস্তা তো। একেবারে না খেয়ে পারা যাবে না।’
– ‘তাহলে খেয়েই যাই। পার্সেল নিয়ে সেখানে গিয়ে খেলে শরীর ভারী লাগবে।’
– ‘তাহলে চল। মামা আপনিও আসুন খেয়ে নিই।’
– ‘না ভাই, আমি মাত্র খেয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছি।’
রাফসান আর ইলি পানসিতে খাওয়া শেষ করলে সিএনজি কলাবনের দিকে ছুটে। শহর থেকে বের হতেই সুরো রাস্তা। খানিক এগুতেই তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখে যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজের হাতছানি। চা বাগানের সারি সারি টিলা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর ঘন সবুজ অরণ্যের অপরূপ সৌন্দর্য। উঁচু-নীচু পাহাড়ের চা গাছের দিকে তাকালে ইলির কখনও মনে হচ্ছে সমুদ্রের জলের মতো সবুজের ঢেউ। কখনও মনে হচ্ছে উঁচু-নীচু পাহাড়ের গায়ে কেউ সবুজ চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। আবার কখনও মনে হচ্ছে ছোট ছোট চা গাছ কিলবিল করে যেন পাহাড় বেয়ে উপরে উঠা শুরু করেছে।
খানিক এগুতেই আর দূরে তাকাতে হলো না৷ রাস্তার দুই পাশ থেকেই চা বাগানের শুরু। চা বাগানের মাঝখান দিয়ে চলছে সিএনজি। বাগানের মাঝে মাঝে নাম না জানা আরও অসংখ্য গাছগাছালি৷
দিনের প্রথমভাগের সূর্যের নরম আলোকে গাছগাছালি ভেঙে ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলেছে। সূর্যের সোনালি আলোয় চিকচিক করছে সবুজ চা পাতা। চা বাগানগুলো যেন বারংবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তোমরা ঢুকে পড়েছো দুটি পাতার একটি কুঁড়ির দেশ সিলেটের চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গলে।
ইলি বুঁদ হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকেই। রাফসান পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে নিয়েছে সে টেরই পায়নি। কিন্তু যখনই সিগারেটে আগুন ধরাতে মাথা নুইয়ে হাত সিগারেটের কাছে তুলেছে। ইলি দেখে ফেলে ক্রোধান্বিত নয়নে দাঁত কটমট করে তাকায়। রাফসান সিগারেট হাতে নিয়ে মুচকি হেঁসে বলল, ‘জল্লাদের মতো তাকাচ্ছিস কেন?’
– ‘তুমি এটা কি করছো।’
– ‘কি আবার। সিগারেটে আগুন ধরাচ্ছিলাম।’
– ‘দেশলাই আমার কাছে দাও।’
– ‘কেন?’
ইলি চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি বলছি তাই।’
– ‘তুই বললেই দিয়ে দেবো কেন?’
ইলির মুখটি ম্লান হয়ে গেল। সিএনজির বাইরে চোখ রেখে অস্ফুটে বলল,
– ‘তাও ঠিক। আমি বললেই কেন দেবে।’
– ‘ইলি একটা খাই?’
এদিকে না তাকিয়েই বলল, ‘আমি না করলেও তুমি শুনবে না। সুতরাং জিজ্ঞেস করার মানে নেই।’
– ‘আচ্ছা এখন একটা ধরাচ্ছি। আজ আর খাব না।’
ইলি কোনো কোথা বললো না। রাফসান সিগারেট ধরিয়ে টানছে। ইলি বাইরের বিস্তৃত সবুজের সমুদ্রে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে।
নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য ইলির কাছে এখন আর উপভোগ্য মনে হচ্ছে না।
রাফসান সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া সিএনজির বাইরে ছেড়ে ফুরফুরে মেজাজে বলল, ‘চা বাগানগুলো দারুণ দেখতে, তাই না ইলি।’
ইলি কোনো জবাব দিলো না। রাফসান বুঝতে পারে ইলি রেগে আছে। তবুও ড্রাইভারের জন্য এখন আর কথা বলতে গেল না।
খানিক পরেই তারা পৌঁছে গেল কলাবন পাড়ায়। ড্রাইভার একটা বাঁশের বেড়া দেওয়া বাড়ি দেখিয়ে বলল, ‘এখানে খাবার অর্ডার দিয়ে গেলে ওরা রান্না করে রাখবে। আসার পর খাওয়া গোসল করে কাপড় পাল্টে নিতে পারবেন।’
ইলি ভারী মুখে কাপড় আর ওড়না ঠিকঠাক করে হাঁটার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে।
– ‘ইলি কি করবো। খাবার অর্ডার দিয়ে যাই।’
ইলি মলিন মুখেই জবাব দিলো,
– ‘দাও।’
রাফসান খাবার অর্ডার দিয়ে এলো। এক ঝাঁক বাচ্চা-কাচ্চারা কাঁচা লাঠি নিয়ে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বিক্রির জন্য। কারণ এখান থেকে দু’টা রাস্তা দিয়েই হামহাম যেতে হয়। একটা উঁচু-নীচু পাহাড় আর টিলা দিয়ে। সেদিকে যেতেও পিচ্ছিল পথে লাঠি প্রয়োজন। অন্যটি হচ্ছে ঝিরি পথ। সেদিকে যেতেও লাঠি লাগবে। তারা দশ টাকায় দু’টা লাঠি এবং তিনশো টাকা দিয়ে একজন গাইড নেয়। কারণ গহীন জঙ্গলের ভেতরে প্রায় আড়াই ঘন্টা হাঁটতে হবে, বনের প্রায় সাড়ে সাত কিলো ভেতরে হামহাম ঝর্ণা।
জঙ্গলের এতটাই ভেতরে যে দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর অন্তরালে নিজের মহিমা লুকিয়ে রেখেছিল এই জলপ্রপাত। দূর্গম পথ আর লোকালয়ের বেশ বাইরে থাকার কারণে এতদিন এই জলপ্রপাতটি কারও চোখে পড়েনি। মাত্র দুই হাজার দশ সালে প্রথমে হামহাম জলপ্রপাত আবিষ্কার হয়।
ঝিরিপথে প্রায় হাঁটু অবধি পানি থাকায় অনেকেই জোকের ভয়ে লবণ বা গুল নিয়ে যায়।
গাইডের পিছু পিছু রাফসান আর ইলি লাঠি হাতে খালি পায়ে হাঁটতে থাকে। রাফসান উপরের প্যান্ট খুলে গাড়িতে রেখেছে৷ নিচেই শর্ট প্যান্ট ছিল। পেছনে স্কুল ব্যাগ। ইলি চুল খোঁপা করে ওড়না কাঁধ থেকে বুক দিয়ে আড়াআড়িভাবে পেঁচিয়ে বেঁধে নিয়েছে। হাঁটছে ম্লান মুখে।
—চলবে–
লেখা: MD Jobrul Islam