দেশলাই পর্ব ১৪+১৫

দেশলাই – ১৪

সকাল ছয়টা পয়তাল্লিশে ইলির ঘুম ভেঙে গেল। সচরাচর এতো ভোরে ঘুম থেকে উঠে না সে৷ বাঁ হাতে ব্রাশ করতে করতে দরজা খুলে বাইরে যায়। প্রতিদিন ডান হাতেই ব্রাশ করে। আজ ব্যতিক্রম হওয়ার কারণ আছে। কাল একটা বইয়ে পড়েছে ঘুম থেকে উঠে ব্যতিক্রমভাবে দাঁত ব্রাশ করলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ে। তাই আজ বাঁ হাতে ব্রাশ করা। বাইরে কুয়াশা অনেক। শীতের আগমন ঘটেছে। ইলি বাড়ির উত্তরে গেল। সেখানে ফুলের বাগান। পাতায় পাতায় শিশির চিকচিক করছে। আঙুলের ডগা দিয়ে শিশির ছুঁয়ে চারদিকে তাকায় ইলি। আজ কোনো পাখির নড়াচড়া নেই। ঘটনা কি? পাখিরা হরতাল ডেকেছে না-কি? অন্যদিন চড়ুই পাখির কিচিরমিচির ছাড়াও নানান পাখিদের ডাক শোনা যায়। শীতে বোধহয় তারা গৃহ ত্যাগ করে বের হয় না। ‘উফ’ করে আর্তনাদ করলো ইলি। বাঁ হাতে ব্রাশ করতে যেয়ে মাড়িতে লেগেছে। রক্ত বেরুল কি-না কে জানে। ইলি পুকুরে চলে গেল। শানবাঁধানো পুকুরে পরিষ্কার পানি। চারপাশে সারি সারি সুপারি আর নারিকেল গাছ। আচ্ছা, প্রায় সকল পুকুর পারে এই দুই ধরনের গাছ থাকবেই কেন? পুকুরের কোণায় বাঁশঝাড়। কয়েকটা সাদা বক সেখান থেকে উড়ে গেল। ইলির ভালো লাগছে। ভোরে ঘুম থেকে এর আগে একদিন উঠে পুরো দিন মেজাজ খিটখিটে ছিল। কিন্তু আজ ফুরফুরে লাগছে। মুখ ধুয়ে ইলি উঠে দাঁড়ায়। বাউন্ডারিতে এখন একটা কাক দেখা যাচ্ছে। মন খারাপ করে বসা সে। কাক হচ্ছে পুরুষ মানুষদের মতো গুমরা মুখো প্রাণী৷ সারাক্ষণ গম্ভীর মুখে বসে থাকবে। ইলি ঘরে ফিরে এলো। রাফসান ভাই আজ শ্রীমঙ্গল যাবে তো? কে জানে। মোবাইল বের করে রোজকার মতো একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত ছেড়ে তাল মিলিয়ে গুনগুন শুরু করল। রবীন্দ্র সঙ্গীত হচ্ছে মন প্রশান্তি আর শীতল করার এন্টিবায়োটিক ওষুধ। স্রষ্টা প্রথমে পৃথিবীর সৌন্দর্য বাড়ালেন চাঁদ, বৃষ্টি, পাখি, পাহাড়, গাছগাছালি আর নদী দিয়ে। তারপর মানুষের মধ্যে দিলেন কবি-সাহিত্যিক আর গায়ক। যারা মানুষকে মূল জিনিসটাই দিয়ে দেয়। সেটা হচ্ছে, মনের শান্তি, আনন্দ। কারণ মানুষ পৃথিবীতে যতকিছুই করে সবই এই চিত্তের জন্য। সুখ, শান্তি আর আনন্দের জন্য। টাকা-পয়সা সকল কিছুর প্রয়োজন এই মনের জন্য। দেহের জন্য।
তবে চিত্ত বিনোদনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রশংসার দাবিদার লেখকরা। তাদের উপর সকল চিত্ত বিনোদন নির্ভরশীল। সিনেমা, নাটক, গান, গল্প, কবিতা, উপন্যাস সবকিছুর পেছনে একজন লেখক থাকেন। ইলির ধারণা লেখক এবং গায়করা আল্লাহর এক অপরুপ সৃষ্টি। এরা এই পৃথিবীকে আরও বেশি উপভোগ্য করে তুলেছেন। দুঃখ-কষ্ট আর ব্যস্ততার চাপাকলে খানিক শান্তির জন্য মানুষ যেমন ছুটে যায় প্রকৃতির কাছে। ছুটে যায় কক্সবাজার, শ্রীমঙ্গল, সিলেট। বিশ্বাসীরা ছুটে যায় মসজিদ, মন্দির, গির্জায়। তেমনই মনের খোরাকের জন্য ছুটে যায় লেখকের কাছে, লেখকেরই গল্পের সিনেমা, নাটকের কাছে। ডুব দেয় কবিতা, গল্প, উপন্যাসে। কবির কথায়, গায়কের সুরে গান শুনে ক্ষনিকের জন্য হলেও সবকিছু ভুলে হারিয়ে যায় সুখ শান্তির এক বিচ্ছিন্ন ভুবনে।
ইলি উত্তরের জানালাটা খুলে দিলো। ঘরে মৃদু সাউন্ডে চলছে, ‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে…।’

ইলি হঠাৎ গানটি বন্ধ করে দেয়। এখন ঘড়ি সাতটা ছাব্বিশ। রান্নাঘরে চলে যায় সে। নাস্তা কি বানাবে কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ রাধুনি সাজতে গেলে যা হয়। চা বসালো একপাশে। বয়ামে নুডলস আর ডিম পাওয়া গেল। কুচিকুচি করে কাঁচা মরিচ পেঁয়াজ কেটে নেয়। টমেটো দরকার। কিন্তু কোথাও টমেটো পাওয়া গেল না। এক মিনিট হাঁটলে সবজি ক্ষেত আছে। উঠে গেল ইলি। সবুজ ঘাসে শিশির জমেছে। চটিজুতোর উপর দিয়ে পা ভিজে পরিষ্কার ঝকঝকে হয়ে গেছে। লাল টকটকে কয়েকটি টমেটো নিয়ে এলো। ক্ষেতে শসাও আছে। কিন্তু নুডলসে শসা দেয়া যায় কি-না মনে করতে পারছে না। টমেটো নিয়ে চলে এলো ইলি। খুব যত্ন করে নুডলস বানিয়ে মা-বাবাকে ডেকে চা-নাস্তা দিল। বাকি সব টিফিনে ভরে ফ্ল্যাক্সে চা নিয়ে কালো পলিথিনে ভরে
মা’কে গিয়ে বলল, ‘রাফসান ভাইদের বাড়িতে যাচ্ছি। রাগ করে বসে আছে কি-না দেখি। শ্রীমঙ্গলও যাবে বলেছিল।’

– ‘তোর অশান্তি শুরু হইছে কেন বলতো?’

– ‘নুডলস কেমন হইছে?’

– ‘লবণ কম।’

– ‘কম বেশি যাইহোক। এমনিতেই যেতাম তাই নিচ্ছি।’

ইলি হাঁটতে লাগল। বাচ্চারা মক্তব থেকে ফিরছে। বাড়ির সামনে গিয়ে ইলি বিব্রতবোধ করছে। চাচিরা কি বলবে কে জানে! বলতে হবে মা নুডলস পাঠিয়েছে।
কিন্তু তার কিছুই হলো না৷ বাইরে কেউ নেই। রাফসান ভাইয়েরও দরজা বন্ধ। দরজায় কয়েক বার ডাক দিলো। ছোট চাচি তাদের ঘর থেকে হাঁক ছেড়ে বললেন, ‘ইলি না-কি রে?’

– ‘হ্যাঁ।’

হাই তুলতে তুলতে দরজা খুলে দিলো রাফসান।

– ‘কিরে ইলি তুই?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘ভেতরে আয়।’

ইলি ভেতরে গেল। কেমন একটা গন্ধ। পলিথিনের ব্যাগ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘মা পাঠিয়েছেন।’

– ‘কি এটা?’

– ‘খুলে দেখো।’ কথাটি বলে ইলি ঘরের জানালাটি খুলে দিলো।

– ‘ঝাড়ু কোথায় রাফসান ভাই?’

– ‘কেন, তুই ঝাড়ু দিবি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তুই না কোনো কাজ-কাম পারিস না৷ মামী একা একা সব করেন।’

– ‘এখন অল্প অল্প পারি।’

– ‘শ্বশুর বাড়ির জন্য প্রস্তুতি না-কি?’

– ‘কচু, ঝাড়ু কোথায় বলো।’

– ‘জানি না। চাচিকে জিজ্ঞেস কর।’

– ‘লাগবে না।’

– ‘কেন?

– ‘মানে চাচিকে গিয়ে আমি যদি বলি ঝাড়ুটা দাও রাফসান ভাইয়ের ঘর ঝাড়ু দেবো তাতে চাচি অপমানবোধ করবেন।’

– ‘কেন?’

– ‘এসব বুঝবে না। এখন তুমি দাঁত ব্রাশ করে আসো। আমি প্লেট আর কাপ আনি। আমিও খেয়ে আসিনি দেরি হবে ভেবে।’

– ‘ও আচ্ছা।’

রাফসান ব্রাশ হাতে বাইরে গেল। ইলি বিছানা বালিশ খানিক ঝেড়েঝুড়ে আলনার কাপড় গুছিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দু’টা কাপ আর প্লেট ধুয়ে নিয়ে এলো। গতকাল যা ভেবেছিল সেরকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রাফসান ভাই খুব বেশি রাগ করেনি। করলেও ভুলে গেছে।
প্লেটে নুডলস আর কাপ দু’টাতে চা ঢেলে নেয়। রাফসান এসে আলনায় রাখা লুঙ্গিতে মুখ-হাত মুছে নিচ্ছে দেখে ইলি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। কিন্তু কিছু বলতে যেয়েও আঁটকে যায়৷ সন্ধ্যার মতো আবার রাগারাগি হোক সে চায় না। ইলি চা নিয়ে পালঙ্কে বসে বলল, ‘তুমি টেবিলেই বসো। টিফিনে আরও নুডলস আছে তুমি না নিলে পিচ্চিকে ডেকে দিয়ে দাও।’

– ‘না আমার আর লাগবে না৷ দাঁড়া দিয়ে আসি।’

রাফসান বাইরে গিয়ে খানিক পর আবার ফিরে এলো।
ইলি চা’য়ে চুমুক দিয়ে বলল,
– ‘কখন বেরুবে?’

– ‘আমি রেডি হয়ে আসছি তোদের বাড়ি। তারপর তোর যতক্ষণ লাগবে।’

– ‘আচ্ছা।’

– ‘মামা কি আমার উপর রেগে আছেন রে?’

– ‘থাকারই কথা।’

– ‘কেন?’

– ‘বললে তোমার অযথাই মন খারাপ হবে। কিছু মানুষ আছে নিজের ভুল দেখতে পায় না। তুমিও তার মাঝে একজন।’

– ‘হুম, ঠিকই বলেছিস। তবে এখন একটু মনে হয় বুঝি।’

– ‘সেই বোঝাটা ভুলের তুলনায় খুব কম।’

– ‘তুইও আমার উপর রেগে আছিস মনে হয়।’

– ‘দুঃখজনক হলেও সত্য। মামাতো বোন হিসেবে তোমার অবনতি দেখে তো আমার রাগ হতেই পারে।’

– ‘রাগ হবে কেন। দুঃখ হতে পারে।’

– ‘তুমি নিজেই নিজের অবনতির কারণ তাই রাগ হয়, দুঃখ না।’

– ‘তুই সত্যিই অনেক বড়ো হয়ে গেছিস ইলি। এখন ‘তুই’ করে বলতেও নিজের মুখে বাঁধে।’

ইলি ফিক করে হেঁসে বলল,
– ‘তাইলে তুমি করেই বলবে। আপু ডাকবে।’

– ‘ভালোই তো। তোর বরকে দুলাভাই ডাকবো।’

– ‘আচ্ছা।’

ইলি নিজের খাবার শেষ করে রাফসানের চাচির ঘরে গেল। দু’জন চাচি রান্নাঘরে বসে গল্প করছেন।
ইলি যেতেই বড়ো চাচি নাহেরা বেগম বললেন, ‘কি গো ইলি। পাগলের অবস্থা দেখেছো?’

পাগল শুনে ইলির মেজাজ খারাপ হলেও স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘এখন তো পাগল না৷ ভালোই আছে দেখলাম।’

– ‘পাগল থেকে ভালো হয়ে গেছে দেখে তো চাচারা বিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু হলো কি? বউ রেখে কোথায় গেল খুঁজ-খবর নাই। বলি সে কি মরে গেছিল বলো? একটা দিন তো ফোন দিয়েও মায়ের লগে ভালো-খারাপ কথা বলতে পারতো, বলো পারতো না?’

– ‘হ্যাঁ তা ঠিক।’

– ‘এইখানে বসো। দুই-একটা কথা বলি। দুঃখ লাগে বঝছো ইলি? দুঃখ লাগে৷ এই পোলার জন্য চাচারা কি না করলো, বলো? এই অভাবের সংসারে তাকে সিলেট রেখে পড়তে দেয়া হলো। এই অঞ্চলের কলেজে নবাবজাদার ভালো লাগে না। কথামতো চাচারাও দিলেন সিলেট। দুইটা বছর প্রতি মাসে সাত হাজার করে টাকা দিতেন। থাকা-খাওয়া আর কত কি লাগে। কিন্তু ওই পোলা করলো কি? কোন এক মাগীর লগ পাইয়া পড়ালেখা ছাইড়া পাগল হয়ে গেলো। সবই আমরা বুঝি মা। বাতাসে চুল পাকেনি। মাও মরছে পোলার যন্ত্রণায় বুঝলে? বাপ নাই ছেলে সে কি বুঝবে না চাচারা টাকা দিয়ে পড়াইচ্ছে মনযোগ দিয়া পড়ি। চাচারা বিয়ে করাইছে। এখন বউয়ের বাচ্চা হবে না। কি করা যায় মুরব্বিরা দেখবে৷ সে বাড়ি ছেড়ে যাবে কেন?’

ইলি কি বলবে ভেবে পেল না৷ এসব কথায় কি বলতে হয় সে জানে না৷ তবে এটা ঠিক, চাচি সবই সত্য বলেছেন।

ছোট চাচি মারিয়া বেগম বললেন, ‘বাদ দাও ভাবী৷ সে কি করবে। তাকে শুনিয়ে লাভ নাই।’

– ‘এমনিতেই বললাম। পোলারে গিয়ে তো বলা যায় না৷ আবার যদি পাগল হয়ে যায়৷ আচ্ছা ইলি মা, তুমি কিছু মনে করো না।’

– ‘না চাচি৷ ঠিক আছে। আচ্ছা আমি যাচ্ছি।’

ইলি বাইরে এলো। তার খারাপ লাগছে। সে জানে রাফসান ভাইয়ের এই ছোট্ট জীবনটা ভুলে ভরা। তবুও কেউ তাকে কিছু বললে ইলির ভালো লাগে না। টিফিন আনতে আর রাফসানের রুমে গেল না ইলি। বাড়ি থেকে নেমে মাঠের দিকে হাঁটতে লাগল।দেশলাই – ১৫ পর্ব

ঢালু পথ দিয়ে মাঠে নেমে খানিকটা হেঁটে যেতেই ইলির চটিজুতো ছিঁড়ে গেল। দাঁত কটমট করে জুতো ছুড়ে ফেলে আবার হাঁটা ধরবে তখনই পেছন থেকে হাঁক এলো,
– ‘এই ইলি হয়েছে কি, চলে যাচ্ছিস যে।’
পেছন ফিরে তাকায় ইলি। রাফসান ভাই বাড়ি থেকে নেমে এদিকে আসছে। ইলি কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। রাফসান কাছাকাছি এসে আবার বলল,
– ‘কি রে, কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিস যে, টিফিনও নিলি না।’

– ‘টিফিন তো তুমিও নিতে পারবে।’

– ‘বল তো কি হয়েছে? কেউ কিছু বলছে?’

– ‘না৷’

– ‘আর তুই রাস্তা দিয়ে না গিয়ে বন দিয়ে যাচ্ছিস কেন?’

– ‘এদিকে ক্ষেত দেখে যাব। আখের ক্ষেত, সূর্যমুখী ফুলের বাগানও আছে।’

– ‘কিন্তু এখন তো মুখ বাঁকা করে ফুলের সঙ্গে সেল্ফিও তুলতে পারবি না।’

ইলি ফিক করে হেঁসে বলল,
– ‘কেন?’

– ‘তোর মন মেজাজ তো খারাপ মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় মুখ বাঁকা করা যায় না।’

– ‘আমার মন অযথা খারাপ হয় না।’

– ‘তাইলে বল যথার্থ কারণটা কি?’

– ‘কিছু না। এখন যাই।’

– ‘এই দাঁড়া, জুতা তো ছিঁড়ে ফেললি। আইলে-টাইলে ভাঙা শামুক থাকলে পা কাটবে আমার চটিজুতা পরে নে।’

– ‘এই আলিশান জুতা আমি পরবো?’

– ‘হ্যাঁ পরবি, এখানে তো কেউ দেখবে না। রোদ উঠেছে, নে তাড়াতাড়ি ফিরে যা। আমি একটু পরেই রেডি হয়ে আসছি।’

– ‘আচ্ছা।’

ইলি আখ ক্ষেত পেরিয়ে সূর্যমুখী বাগানের সামনে গেল। আকাশে ঝকঝকে রোদ। সূর্য কপালে এসে পিছলে পড়েছে। সেল্ফি তুলতে গিয়ে হচ্ছে বিরাট ঝামেলা। সূর্যকে পেছনে রেখে তুলতে গেলে অন্ধকার আসছে সব। আবার সূর্যের দিকে তাকিয়ে বাগানকে পেছনে রেখে তুলতে গিয়ে ওর কপাল কুঁচকে যাচ্ছে রোদে। তবুও ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে কয়েকটি ছবি তুলে দেখলো একটাও ভালো হয়নি, নিজেকে পেত্নী লাগছে।
হাঁটতে লাগলো। জুতো বড়ো হলেও খুব বেশি অসুবিধা হচ্ছে না। সোজা এসে তাল গাছের নিচ দিয়ে কবর গলিতে উঠে গেল। বাড়ির গেইট খুলে দেখলো মা উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছেন।
তাকে দেখে বললেন, ‘কি রে, পেঁচা মুখ করে ফিরলি যে।’

– ‘আজ মেহমান বাড়ি যাব তো মা, তাই মুখটা আরও কত রূপ ধরবে।’

– ‘তোর আরও কত কি থাকবে।’

– ‘কত কি না মা। আমি প্রায়ই খেয়াল করে দেখেছি৷ কোথাও যাওয়ার আগে আমার মুখ পেত্নী, পেঁচা কত কি হয়। কিন্তু বাড়িতে থাকলে বিশ্ব সুন্দরী।’

– ‘যা যা সর। আর টিফিন কোথায়?’

– ‘রাফসান ভাই আনবে। কিন্তু তুমি পায়ের দিকে তাকালে না যে মা?’

– ‘এ কি রে? তোর পায়ে কার জুতা?’

– ‘আমার জুতা ছিঁড়ে গেছে।’ কথাটি বলেই ইলি হনহন করে নিজের রুমে চলে গেল।

ফ্যান ছেড়ে উত্তরের জানালা খুলে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ইলি। মন কিছুতেই ভালো হচ্ছে না। একটা মানুষ পদে পদে শুধু ভুল করে গেল। ভুল সিদ্ধান্ত নিল। এখন তার জীবনটা বিলের ভাসমান পানার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেদিকে বাতাস দেবে সেদিকেই পানা যাবে। নিজের হাতে কিছুই নেই। কোনো লক্ষ্য উদ্দেশ্য নেই। অথচ সমস্তকিছু নিজেরই ভুলে হলো। ইলির চোখ জলে ভরে এলো। স্পষ্ট মনে আছে। প্রাইমারি স্কুলে থাকতে হেড স্যার রাফসান ভাইকে নিয়ে খুব গর্ব করতেন। ছোট ক্লাসে পাঠাতেন ক্লাস নিতে। শুধু কি ছোট ক্লাসে? একবার তারা কয়েকজন অযথাই প্রস্রাব করার নামে বাইরে ঘুরাঘুরি করছে। হঠাৎ দেখলো হেডস্যার রাফসান ভাইকে ডেকে ফাইভের ক্লাসে নিচ্ছেন। ইলিরা উঁকিঝুঁকি মারে।
স্যার ব্লাকবোর্ডে ইংলিশে “international”
লিখে ফাইভের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন উচ্চারণ কি?
প্রায় সকলে বলল, “ইন্টারনেটিওনাল”
স্যার সব শেষে বললেন, ‘রাফসান, বলো এখানে কি লেখা।’
রাফসান ভাই বলল, ‘ইন্টারন্যাশনাল।’
স্যার সবাইকে অনেক্ষণ ঝাড়ি দিলেন, ‘ক্লাস থ্রি পড়ুয়া একটা ছেলে পারে তোরা পারিস না। দু’দিন পর তোরা গিয়ে বোর্ড পরিক্ষা দিবি। অথচ তোদের ক্লাস থ্রিতে পড়ারও যোগ্যতা নেই।’
জানালার পাশে তাদেরকে দেখেও একটা ধমক দিলেন। দৌড়ে তারা ক্লাসে চলে গেল। এসএসসিতেও জিপিএ ফাইভ পেল মানুষটা। তারপর? বিলের ভাসমান পানা। লোকজন এখন পাগল বলে। ইলির খারাপ লাগে। ওর শৈশবের হিরো যে রাফসান ভাই।

– ‘ইলি গোসল করবি না?’

পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ মা করবো।’

– ‘তুই এতো ভাবিস কি বল তো? কপালে যা আছে তাই হবে, বুঝলি? আল্লাহ কাউকে না খাওয়াইয়ে মারবে না। তাছাড়া রাফসানের এখন মা-বাবা না থাকলেও চাচারা আছে।’

– ‘থাকলেও মা। আজ বুঝলাম ওরা বিরক্ত হয়ে উঠেছে৷ তাদেরও বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে অভাবের সংসার। তবুও পড়ালেখা বিয়ে-শাদি করালো। আর কি করবে? ভাত না হয় খাওয়ালো। আর তো কিছু করবে না।’

– ‘বিদেশ-টিদেশ পাঠাবে।’

– ‘তোমারে বলছে। কয়েক লাখ টাকা খরচ করে তাকে এখন বিদেশ পাঠাবে? তাদের সংসারই টানাটানিতে চলে।’

– ‘কাজকর্ম করে খাবে। পুরুষ হয়ে জন্মাইছে হাত থাকলে ভাত আছে। যা গোসল কর।’

– ‘হ্যাঁ করবো।’

– ‘আর কি দেখলি। এখন মাথায় সমস্যা-টমস্যা তো মনে হয় নাই।’

– ‘না এখন ঠিকই আছে।’

– ‘মাথা ঠিক থাকলেই হলো।’

ইলি কাপড় সাবান নিয়ে গোসল করতে ঘাটে চলে গেল।

***
ইলিকে বিদায় করে মাঠ থেকে ফেরার পর রাফসান রুমে এসে বসে আছে। তখন বড়ো চাচি নাহেরা বেগম এসে বললেন, ‘রাফসান বাবা, করোনার কারণে স্কুল তো বন্ধ। বাচ্চারা পড়ালেখা বাদ দিয়া খালি টই টই করে ঘুরে বেড়ায়। ওদেরকে একটু পড়া দেখিয়ে দিয়ো তো। এই যাও, ভাইয়ের কাছে পড়তে যাও।’

তারপর দুই চাচার পাঁচজন ছেলে-মেয়ে পড়তে এলো। আরেকজন চাচি একটা মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি থাকেন। নাহেরা বেগম নিচে মাদুর বিছিয়ে দিয়ে গেছেন। সবাই গোল হয়ে পড়তে বসেছে।

রাফসান বারংবার মোবাইলে সময় দেখছে। এখন বাজে সাড়ে বারোটা। ইলি নিশ্চয় গোসল করে নিয়েছে।
– ‘তোমরা চলে যাও এখন।’

সবাই এক সঙ্গে হুড়াহুড়ি করে চলে গেল। ছোট চাচি এলেন তখনই একটা কাগজ নিয়ে।
– ‘এই বাজারগুলো একটু আনো তো। মুদির দোকানটাতেই সব পাবে।’

আচ্ছা দাও নিয়ে আসছি। রাফসান টাকা আর কাগজ নিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে লাগলো। বিল পাড়ের দোকানটা বন্ধ। খাটো রাস্তা ধরে তাড়াতাড়ি হেঁটে গেল রেললাইনের পাশের দোকানটিতে। বাজার নিয়ে ফিরেছে একটা দশে। কাপড় নিয়ে দ্রুত চলে গেল পুকুর ঘাটে। গোসল সেরে খেতে গিয়ে দেখলো রান্না চলছে। খেতে না বলে বলল, ‘ছোট চাচি এক হাজার টাকা হবে?’
– ‘না, এতো টাকা তো হবে না। দেখো তোমার বড়ো চাচিকে জিজ্ঞেস করে।’

বড়ো চাচিকে গিয়ে বলতে হলো না। ঘর থেকেই জবাব দিলেন, ‘টাকা কই পাব? বিদেশ বাড়ি ওরা করোনার লাগি রুজিরোজগার করতেই পারছে না আর টাকা।’

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে৷ আমি শ্রীমঙ্গল যাচ্ছি চাচি। কয়েকদিন পর ফিরবো।’

– ‘খেয়ে যাও। মারিয়া রান্না হয়ে গেলে ভাত দাও তাকে।’

– ‘হয়ে যাচ্ছে৷ রাফসান একটু অপেক্ষা করো নামিয়ে ডাকছি তোমাকে।’

– ‘না চাচি। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। সমস্যা নাই ইলিদের বাড়ি খেয়ে নেবো।’

– ‘এরকম করো না তো রাফসান। ওদের বাড়ি গিয়ে খেলে আমাদের কি বলবে? চাচিরা খেতে দেয়নি তাই সেখানে গিয়ে খাচ্ছ। একটু দেরি হলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।’

– ‘আচ্ছা। আমি অপেক্ষা করছি।’

খানিক পরেই খানার ডাক এলো। গরম গরম ভাত তরকারি। ফ্যান ছেড়ে দিলেন ছোট চাচি। দ্রুত খেয়ে নিল সে। তারপর ব্যাগটা পেছনে ফেলে বেরিয়ে গেল সে।

ইলি খাওয়া-গোসল শেষ করে রেডি হয়ে বসে আছে। জোহরের আজান হয়ে ঘড়ি দু’টা ছুঁইছুঁই করছে এখনও রাফসান আসার নামগন্ধ নেই। আরেকটু দেরি হলে মা-বাবা আজ যেতেই দিবেন না৷ ইলি রাস্তা থেকে একটু পর পর উঁকি দিচ্ছে। লিয়াকত মিয়া ক্ষেত থেকে দুই হালি শসা নিয়ে এসে বললেন, ‘কি রে রাফসান আসেনি এখনও?’
– ‘না বাবা।’
– ‘গর্দভের লগ ধরেছিস। ওর কি কোনো ঠিক আছে। আচ্ছা দেখিস তো দুইজনের ব্যাগে ভরে শসাগুলো তোর ফুপুদের জন্য নেয়া যায় কি-না।’
– ‘তুমিও না বাবা। শসা কি ফুপুর বাড়ির ওদিকে কিনতে পাওয়া যায় না?’
– ‘আরে পাওয়া যায়। তারপরও ক্ষেতের জিনিস বইন-ভাগ্নীকে দিতে হয়। আগে তো মানুষ প্রথম আম, প্রথম ধানের পিঠাও বইন-ভাগ্নী রেখে খেতো না।’
– ‘আচ্ছা রাখো ঘরে নিয়ে৷ ব্যাগে ভরা যায় কি-না দেখবো।’
– ‘ওই তো রাফসান আসছে।’
– ‘হ্যাঁ, ওই দেখা যাচ্ছে।’

‘চল ঘরে সে আসুক।’ ইলি আর তার বাবা ঘরে গেলেন। রাফসান খানিক পর ইলির ঘরে এসে বলল, ‘ফ্যানটা ছাড় গরম লাগছে।’

ইলি ফ্যান ছেড়ে দিয়ে তাকিয়ে দেখলো খানিকটা ঘেমে গেছে রাফসান। এলোমেলো চুল। কালি পড়া চোখ। পোড়া ঠোঁট। দাড়ি-গোঁফে জঙ্গল মুখ। গায়ে একটা ফুলহাতা পুরোনো শার্ট৷ গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। পায়ে কবেকার কেডস। কি বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে।

– ‘এতো দেরি হলো কেন?’

– ‘পিচ্চিরা পড়তে এলো তাই দেরি হয়ে গেছে।’

– ‘ও, খাওয়া-দাওয়া করে এসেছো?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তোমার ব্যাগে কি দুই হালি শসা ভরা যাবে। ফুপুকে দিতে চাচ্ছেন বাবা।’

– ‘হ্যাঁ ভরা যাবে নিয়ে আয়। পলিথিনের কোনো ব্যাগে করে আন।’

ইলি শসা এনে দিলো।
রাফসান শসা ভরতে ভরতে ফিসফিস করে বললো, ‘আমার কাছে তো টাকা-পয়সা তেমন নাই ইলি। তুই মামার কাছ থেকে টাকা বাড়িয়ে নিতে পারবি?’

– ‘তোমার টেনশন করতে হবে না।’

খানিক পরেই তারা রেডি হয়ে বেরিয়ে গেল। রিকশায় উঠার সময় লতিফ মিয়া রাফসানকে এক হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই টাকা নে। দেখেশুনে যাবি। আর শ্রীমঙ্গল গিয়ে বেড়াতে গেলে বাড়িতে সন্ধ্যার আগে আবার ফিরে আসবি ওরে নিয়ে।’

– ‘টাকা লাগবে না মামা। আমার কাছে আছে।’

– ‘টাকা নিতে বলছি নে।’

রাফসান টাকা নিল। রিকশা চলছে মধুশ্বরী বাজারের দিকে। মধুশ্বরী থেকে তারা শেরপুর গেল একটা সিএনজি করে। সেখান থেকে বাসে উঠলো ঠিক আড়াইটায়।
—চলবে–
লেখা: MD Jobrul Islam
—চলবে—
লেখা: MD Jobrul Islam

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here