দেশলাই পর্ব ১২+১৩

দেশলাই – ১২ পর্ব

বিশাল পাহাড়ের ওপরে মন্দির। সেখান থেকে চারপাশে তাকালে গাছগাছালিকে মনে হয় সবুজ রঙের লোমশ চাদরে ঢাকা।
সপ্তাহ খানেক খুবই কষ্টে থাকতে হয়েছে তাদের। রাতে ঘুমোতে পারলেও দিনে মন্দিরে থাকা যায় না। এদিকে লক ডাউনের কারণে রাস্তায় গেলে বিপদ।
সুতরাং দিনে তারা জঙ্গলে কাটায়। মোবাইলে চার্জ থাকে না। মন্দির থেকে বের হয়ে পাড়ার সম্মুখের মুদির দোকানে বাবলা দা’র সঙ্গে ফোনে কথা বলানোর পর থেকে মোবাইলে অল্প চার্জ দিয়ে দেয়।
সেখান থেকেই কেবল কলা পাউরুটি জাতীয় খাবার খেয়েই কাটাতে হয়েছে পুরো সপ্তাহ। তবে আশার ব্যাপার হলো অনিমেষ খানিক আগে কল দিয়ে জানিয়েছে, সাত দিনের লকডাউন আজ শেষ হয়েছে। আবার দিয়ে দিতে পারে। সুতরাং অটো নিয়ে হাওড়া যেন চলে যায়। সেখান থেকে বাসে করে বনগাঁ।’

অনিমেষের কথামতো তারা অটো নিয়ে হাওড়া যায়। সেখান থেকে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে বনগাঁর বাস খুঁজে বের করতে হয়েছে। অনেক ঝুকিপূর্ণ ছিল। কারণ হাওড়া থেকে দালালরা দেখেশুনে লোক আনে এবং নেয়। অথচ তারা নিজে গাড়ি খুঁজে বের করে যেতে হয়। বনগাঁ এসে অনিমেষ দেখা না করলেও দালালরা তাদেরকে রিসিভ করে। অনিমেষ শেষ কল দিয়ে শুধু বলল,
– ‘জানে বেঁচে গেছিস মাইরি। করোনার মাঝে তোরা এতোদিন বেঁচে আছিস এটাই অনেক ভাগ্য বাড়া। সবই ভগবানের কৃপা আর মা-বাবার আশীর্বাদ, বুঝলি? আমি দেখা করতি পারলাম না। করোনার সময় বুঝিস তো। তোদের বৌদি যেতি দিচ্ছে না। তা ভালো থাকিস, রাখছি। ভগবান তোদের মা-বাবার কাছে ভালোভাবে পৌঁছাক।’

রাফসান আর শফিকের চোখ জলে ভরে গেল। ভাষা আর আদি বন্ধনের কারণে বাংলাদেশীদের প্রতি তাদের সীমাহীন ভালোবাসা। অনিমেষের এতটুকু উপকারের জন্য তারা চির কৃতজ্ঞ থাকবে।

দালালরা তাদেরকে দু’দিন জঙ্গলের খুপরি ঘরটিতে রাখে। সেখানে আরও ছয়জন পাওয়া গেল। তারা কলকাতায়ই ছিল। এখন বাংলাদেশে যাবে। কিন্তু লাইন ক্লিয়ার হচ্ছে না। অন্যদিকে বাংলাদেশে লকডাউন পুনরায় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশী দালালদের চাপে তারা ঝুঁকি নিয়ে আটজনকে নিয়ে যায় নদীয়ার দিকে। দিনে একটা বাড়িতে রেখে রাতে হাঁটিয়ে সীমান্তে নেয়। কিন্তু কাঁটাতারের পাশে যেতেই বিএসএফরা দৌড়ানি দেয়। সবাই দৌড়ে জঙ্গলের নানান দিকে ছুটে গিয়ে হারিয়ে যায়। দালালরা আবার সকলকে খুঁজে এনে একত্র করে। একপর্যায়ে গালাগালি করে জানায়, বিএসএফ কখনও জঙ্গলের ভেতরে আসবে না। শুধু সীমান্তের পাশে পেলে ধরবে। সুতরাং দৌড়ে হারিয়ে যাওয়া যাবে না। পুরো রাত রক্ষীদের সঙ্গে লুকোচুরি করে তিনটার দিকে কাঁটাতার কেটে দিল। লাইন ধরে পার করছে। সবার পেছনে শফিক তার আগে রাফসান। আচমকা বিএসফরা চলে এলো কোত্থেকে। রাফসানের আগের সবাই বাংলাদেশ ঢুকে গেছে। সেও দৌড়টা দিল বাংলাদেশের দিকেই। কিন্তু শফিক দ্বিধাদ্বন্দের কারণে ধরা পড়ে গেল বিএসএফের হাতে। রাফসান যেদিকে চোখ যায় খানিকক্ষণ দৌড়াল। তার সামনের ছয়জনের কাউকে পেল না। দৌড়ে কে, কোনদিকে ছুটে গেছে বুঝা যাচ্ছে না৷ রাফসান একা চুপচাপ গহীন জঙ্গলে বসে হাপাচ্ছে। ক্ষুদার্ত নিদ্রাহীন ক্লান্ত বিধস্ত শরীর। এখন সে কোন জায়গায় আছে ঠিক বুঝতে পারছে না। মোবাইলে এখনও ভারতের নেটওয়ার্ক দেখাচ্ছে। অনিমেষকে কল দেয়। অনিমেষ লাইনের লোকদেরকে রাফসানের নাম্বার দিচ্ছে বলে ফোন রাখে। ঘন্টা খানেক পর লাইনের লোকেরা তাকে ফোনে কথা বলতে বলতে বের করে। রাফসান তখনও জানে না শফিক কোথায়। তার ধারণা ওপারে রয়ে গেছে হয়তো।
দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইনের লোকদের বলল, ‘আমার সাথের জন কোথায়?’
তারা জানায় লাইনের দু’জন লোক সহ শফিক বিএসএফের হাতে ধরা পড়েছে।
রাফসানের মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল।
আমতা-আমতা করে বলল, ‘এখন কি হবে ওর?’
– ‘ক্যাম্পে আমাদের লোক গিয়ে কথা বলবে। যদি বিএসএস টাকা চায়। শফিককে বলা হবে মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে টাকা আনতে। কিছুই হবে না।’

তারপর মোবাইল হাতে অন্যদেরও ফোন দিয়ে একত্র করে। সীমান্ত থেকে হাঁটিয়ে নিয়ে যায় একটা বাজারে। দালালদের মাধ্যমে মানিব্যাগের সকল রুপি দিয়ে টাকা এনেছে। সেখান থেকে রাফসানকে বাসে তুলে দেয়। হঠাৎ বাস থামিয়ে পুলিশ সবার ব্যাগ-প্যাক চেক করে। রাফসানের কাছে কোনো ব্যাগ নেই। কেবল মোবাইলে জিও সীম ভরা। কিন্তু কিছুই হলো না। বাস আবার ছেড়ে দেয়। দেশে ফিরেছে অবশেষে৷ হাফ ছেড়ে বেঁচেছে৷ আহা নিজের দেশ। মুক্ত বাতাস। কিন্তু শফিক? শফিকের জন্য খারাপ লাগছে। মনটা বারংবার হু-হু করে কেঁদে উঠছে। তবে ওর ব্যাগে মোটামুটি সব টাকাই রয়ে গেছে। এই টাকা দিয়ে ছুটে আসতে পারলেই হলো। খানিকটা ঘুম পায়। এক সময় ঢাকা আসে। খাওয়া-দাওয়া করে ঢাকা থেকে বাসে উঠে পরেরদিন ভোরে সিলেট। পুরো রাস্তা ঘুমিয়েছে। বকুল পুর ঢুকতেই রাস্তাঘাটে মানুষের প্রশ্নের নির্যাতনে রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে গেল সে। প্রশ্ন করারই কথা৷ কেউ জানতো না এতোদিন সে কোথায় ছিল। স্কুল, ট্রেনের রাস্তা, এই মাটি, মানুষ সবকিছুর প্রতি অন্য এক নয়নে তাকাচ্ছে আজ। কবরগলি পেরিয়ে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। পাকা দালান ঘরের উপরে সবুজ রঙিন টিন ওয়ালা বাড়ি। আহা ইলি। এই একমাত্র মেয়ে। যে কি-না তাকে প্রথমেই মুখের ওপর বলে দিয়েছিল ইন্তিশা ভালো মেয়ে মনে হচ্ছে না। সেদিন যদি সে ওর কথা শুনতো তাহলে তার জীবনটা আজ এমন হতো না। রাফসান পরবর্তীতে সবই জেনেছিল। ইন্তিশার বিয়ের আলাপ-টালাপ কিছুই আসেনি। সবই ছিল ওর ছলনা, প্রতারণা। রাফসান গেইট খুলে ইলিদের ঘরে ঢুকে। দরজা ভেজানো। ধাক্কা দিয়ে খুলেই প্রথমে পেল রহিমা বেগমকে। তিনি চমকে উঠার আগেই সে ঠোঁটে আঙুল নিয়ে বলল, ‘চুপ মামী, ইলি কোথায়?’
তিনি হা করে তাকিয়ে রইলেন। কিছুই বলতে পারলেন না। রাফসান ধীরে ধীরে ইলির রুমে গেল। ‘খ্যাঁক’ করে দরজা খুলতেই ইলি মুখের সামনে থেকে উপন্যাস সরিয়ে তাকায়। তারপর আর কোনো কথাই যেন বলতে পারছে না। নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। এ কোন রাফসানকে সে দেখছে? এ কি অবস্থা হয়েছে ওর?

– ‘কেমন আছিস ইলি?’

– ‘তুমি কোথা থেকে? কোথায় ছিলে এতোদিন?’

– ‘বলবো। সবই পড়ে বলবো। শুধু এটা জানতে পারিস৷ আমি এখন পুরোপুরি সুস্থ। এখন আমাদের বাড়ি চল। আম্মা অনেক বকাঝকা দেবেন জানি। তুই থাকলে একটু সামলে নিবি। হা-হা-হা। চল।’

রাফসানের আচমকা মনে হলো ইলির চেহারা ধপ করে নিভে গেছে। ধীরে ধীরে মুখ লাল হলো। তারপর ঠোঁট নড়তে নড়তে নাক ফুলে গেল। অস্ফুটে বলল,
– ‘দাঁড়াও আসছি।’

রাফসান কিছুই বুঝতে পারলো না। ইলি কি কাঁদছে? কিন্তু কাঁদার কারণ কি?

রহিমা বেগম ম্লান মুখে রাফসানের কাছে এসে বললেন, ‘বাবা গোসল করে আমাদের এখানে খাওয়া-দাওয়া করে যাও।’

– ‘না, বাড়িতে চলে যাই মামী। ভয়ে আছি আম্মাকে কি বলবো। আর মামা কোথায়? দেখছি না যে?’

– ‘তোমার মামা বাজারে বাবা। আর তুমি এখানে গোসল করে খেয়ে নাও। আমিও যাবো তোমাদের বাড়িতে।’

রাফসান কিছু বুঝতে পারছে না। তবে কেমন ভয় ভয় করছে তার।

রহিমা বেগম লুঙ্গি আর গামছা এনে দিলেন। রাফসান সাবান হাতে পেছনের শানবাঁধানো পুকুর ঘাটে যায়। খানিক সাঁতার কাটে। বেশ আরাম লাগছে। তবুও মনের ভেতর কীসের আশংকায় ভয় করছে। গোসল করে সে খেতে বসে। রহিমা বেগম টুকটাক কথা বললেন। ইলিও একটা কামিজ পরে ওড়না পেঁচিয়ে বসেছে পালঙ্কে।
রহিমা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি?’

– ‘ভারত।’

চমকে উঠলেন রহিমা বেগম। ইলিও পালঙ্ক থেকে বলল,
– ‘ভারত মানে? ভারত তুমি হঠাৎ কীভাবে গিয়েছিলে?’

রহিমা বেগম বাঁধা দিলেন,
– ‘বাদ দাও, খাওয়ার সময় এতো কথা বলা ভালো না।’

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রাফসান উঠে দাঁড়ায়। রহিমা বেগম ইলিকে বললেন,
– ‘তুই বাড়িতে থাক মা। আমি যাচ্ছি। বাড়ি খালি রেখে দু’জন যাব না-কি?’

– ‘আচ্ছা তুমি যাও।’

রহিমা বেগম রাফসানকে নিয়ে গেলেন তাদের বাড়িতে। রাফসান নিজেদের ঘরে গিয়ে মা’কে খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে তার চাচি আর মামীরা কীভাবে বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। ছেলেটি আবার বাড়ি থেকে যদি চলে যায়? আবার যদি মাথায় সমস্যা আসে? রাফসান নিজে থেকেই ছোট চাচীকে এসে বলল,
– ‘আম্মা কোথায় গেছেন?’

তিনি রহিমা বেগমের মুখের দিকে তাকান। রহিমা বেগম বললেন, ‘এখানে বসো বাবা। মাথা ঠান্ডা করে বসো। সব বলছি তোমাকে।’

রাফসান আঁজলা করে মুখ ঢেকে পালঙ্কে বসে। সে যেন খানিকটা বুঝে গেছে। তার জন্য হয়তো কোনো বড়ো দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। রহিমা বেগম রাফসানের পিঠে এক হাত রেখে বললেন, ‘তোমার মা দুই সাপ্তাহ আগে স্ট্রোক করে মারা গেছেন রাফসান।’

সে মুখ তুলে তাকালো না। মুখ ঢেকেই কেঁপে কেঁপে উঠলো কান্নায়। মায়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে তার৷ ছোট্ট জীবনে সে একটু বেশিই ভুল করে ফেলেছে। বিধবা মা’কে রেখে সেদিন বেরিয়ে যাওয়াটা ঠিক হয়নি৷ এখন সে কি করবে? কি করার আছে? তার জীবনটা এমন হয়ে গেল কেন? মাথা তুলে বলল,
-‘আম্মার কবর কোথায়?’

– ‘তোমার বাবার পাশেই।’

ছুটে গেল পশ্চিমের পারিবারিক কবরস্থানে। তাকিয়ে দেখলো বাবার পাশেই নতুন আরেকটি কবর৷ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সবাই গিয়ে টেনে আনেন বাড়িতে।

—চলবে—
লেখা: MD Jobrul Islam
শলাই – ১৩ পর্ব

বুকে মায়ের বিয়োগ ব্যথার ভার নিয়ে শুয়ে আছে রাফসান। জানালায় খয়েরী রঙের পর্দাটা মৃদু কাঁপছে। তাকে ঘুমোতে বলে চলে গেছে সবাই। কিন্তু ঘুম আসছে না তার। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। সে চলে যাবার পর কী হয়েছিল খুব জানতে ইচ্ছে হয়। মা কি খুব ভেঙে পড়েছিলেন? নববধূরই বা কি ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভাবতে ভাবতে একপর্যায়ে তার চোখবুঁজে ঘুম এলো। সেই ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যা সাতটায়। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। পুরো শরীরে ব্যথা করছে। এতোদিনের অনিদ্রা আর অধিক হাঁটা তার কারণ। কিন্তু এখন সে কি করবে? হাত বাড়িয়ে আলনা থেকে একটা গেঞ্জি নেয়। এতোদিন অব্যবহৃত থাকায় কেমন একটা গন্ধ বেরুচ্ছে। তবে দেখে মনে হচ্ছে ধোয়া। মা হয়তো ধুয়েছিনেন। রাফসান গেঞ্জিটা পরে বাইরে যায়। পা ফেলা যাচ্ছে না। গোড়ালিতে পর্যন্ত ব্যথা করছে। চাচাতো ভাইবোনরা জোরে জোরে পড়ছে। উত্তর পাড়া থেকে হাততালির শব্দ ভেসে আসছে। কারও বিয়ে হয়তো। এখন সে কি করবে? অবশ্য একটা কাজ আছে। আইডি কার্ড নিয়ে তার সিম তুলতে হবে। মোবাইলে ইন্ডিয়ান সিম ঢোকানোর সময় ওইটা শফিকের ব্যাগে রেখেছিল। নিজের মানিব্যাগে অবশ্য রাখা যেতো, কিন্তু টাকা বের করার মুহূর্তে বাংলাদেশী সিম কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা। এখন কি মধুশ্বরী বাজারে আইডি কার্ড নিয়ে চলে যাবে? আবার ঘরে ফিরে গেল। আলমারিতে একটা ফাইলে আছে কার্ড। চাবি কোথায় কে জানে। সমস্তকিছু খুঁজেও পেল না। ছোট চাচিকে গিয়ে বলতেই চাবিটা বাড়িয়ে দিলেন। আলমারি খুলে কার্ড নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
হাঁটতে হাঁটতে কবর গলির সামনে এলো। ইলিদের বাড়িতে কি উঠবে? চা-টা খেয়ে না হয় যাবে? গেইটটা খুলে ভেতরে গেল। দরজায় নক দিতেই মামা দরজা খুলে দিলেন। সে সালাম দেয়৷ কিন্তু কোনো জবাবই দিলেন না। গম্ভীরমুখে চলে গেলেন। রেগে আছেন হয়তো। ইলির রুমে গেল সে। ইলি টেবিলে বসে মোবাইল টিপছে৷ তাকে দেখে ওড়নাটা ঠিক করতে করতে বলল,
– ‘রাফসান ভাই করোনার সময় ইন্ডিয়া থেকে এসেছো। তোমার বাড়িতে থাকা উচিত। কেউ জানলে পুলিশকে খবর দিতে পারে।’

রাফসানের হঠাৎ মনে হলো তাইতো। সে আগেও এসে ডায়রেক্ট এখানে ঢুকে পড়েছে। তারা প্রথম সাক্ষাতের বিস্ময়ে হয়তো কিছু বলতে পারেনি।

– ‘হ্যাঁ রে আমার খেয়ালই ছিল না। তোদের বাড়িতেও আগে ডায়রেক্ট ঢুকে পড়েছি। আচ্ছা আমি এখন যাই।’

– ‘চলেই এসেছো যেহেতু বসো।’

– ‘আমি বের হয়েছিলাম বাজারে যাওয়ার জন্য। ভাবলাম উঠি।’

– ‘হ্যাঁ, উঠছো ভালো করছো৷ কিন্তু বাজারে যেও না। তুমি ইন্ডিয়া থেকে এসেছো লোকজন জানলে সমস্যা আছে।’

– ‘হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস।’

– ‘চা খাবে?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তাইলে বসো, আমি মা’কে চা বসাতে বলি। আর গেঞ্জি উল্টো পরে আছো কেন? ওটা ঠিক করো।’

ইলি চেয়ার থেকে উঠে হেঁটে বাইরে গেল। পায়ে চটিজুতা। পরনে হলদে কামিজ। মাথায় জর্জেটের ওড়না। বারংবার মাথায় টেনে তুলে হাঁটছে। ডানপাশের চুল কানে গুঁজে অন্যপাশের একগোছা চুল কপাল বেয়ে বুকে পড়েছে। কি দারুণ দেখতে হয়েছে ইলি। খানিক পরে আবার ফিরে এসে টেবিলে বসে বলল,
– ‘বড়ো ফুপু অসুস্থ। বিকেলে ফোন দিয়েছিলেন।’

– ‘কি অসুখ?’

– ‘এই বয়সকালে যা হয়। কত রোগ উঁকি মারে। হাই প্রেসার মনে হয়।’

– ‘আম্মা মারা যাওয়ার পর খালা এসেছিলেন?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘খালাকে দেখতে যাবে তোমরা কেউ?’

– ‘করোনায় তো স্কুল-কলেজ সবকিছু বন্ধ। বাড়িতে ভালো লাগছে না। তাই এমনিতেই শ্রীমঙ্গল যেতে চাচ্ছিলাম। এখন ফুপুও অসুস্থ। আব্বাকে বলেছিলাম নিয়ে যেতে। আজ না কাল করছে।’

– ‘আমিই নিয়ে যাবো। কোনদিন যাবি?’

– ‘তুমি এতোদিনে বাড়িতে এসেছো৷ চেহারা-ছবির অবস্থাও খারাপ, কয়েকদিন রেস্ট নাও।’

– ‘না, বাড়িতে ভালো লাগছে না। শ্রীমঙ্গল গেলে ভালো লাগবে। খালাকেও কতদিন দেখি না।’

– ‘তুমি যেদিন বলবে সেদিনই যেতে পারবো। আমার তো ভার্সিটি বন্ধ।’

– ‘কালই যাই।’

ইলি চেয়ার থেকে উঠে গেল৷ চা আনার জন্য রহিমা বেগম ডাকছেন। খানিক পর ট্রে করে দুই কাপ চা আর বিস্কিট নিয়ে ফিরে এলো। ট্রে রাখার পর আবার ওড়নাটা ঠিক করে এক কাপ নিজেই নিল।

– ‘কিরে আমারে দেওয়ার আগে তুই চা নিয়ে নিলি?’

– ‘এহ তোমার কি হাত নেই? পাশেই তো ট্রে রাখা।’

রাফসান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

– ‘তুই একটু তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে গেছিস।’

– ‘হুম, তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ। আর আমি একটু বড়ো হব না?’

– ‘আমি বুড়ো হয়ে গেছি?’

– ‘হ্যাঁ অনেকটাই। তবে তোমার প্রেমিকার বিরহে যে দেবদাস হয়েছিলে তার থেকে ভালো।’

– ‘বুঝিনি। দেবদাস থেকে ভালো কীভাবে? আবার বলছিস বুড়ো হয়ে গেছি।’

– ‘মানে এখন মানসিকভাবে শুধু সুস্থ আছো। ইন্ডিয়া কোথায় ছিলে, কি করছো কে জানে। পুরাই গরু রাখাল হয়ে আসছো।’

কথাটি শুনে রাফসানের হাত থেকে বিস্কিট ভেঙে চায়ের কাপে পড়ে গেল। কেউ এভাবে মুখের উপর গরু রাখাল বলে?
সে আহত নয়নে তাকিয়ে বলল,
– ‘গরু রাখাল লাগছে? এভাবে বলতে পারলি?’

– ‘লাগছে তাই বললাম। তাছাড়া গরু রাখাল বললে অপমানিত হওয়ার কিচ্ছু নাই। ওরা কি মানুষ না?’

– ‘হ্যাঁ মানুষ, চাকরানীরাও মানুষ। তোকেও অন্যেরা বাসার চাকরানীদের মতো লাগে।’
কথাটি বলেই ভাবলো ঠিক হয়নি। কথার কথায় বাজেভাবে বলে ফেলেছে।
ইলির মুখ নিমিষেই ম্লান হয়ে গেল। তবুও সে চায়ে চুমুক দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার জন্য বলল, ‘ও তাই?’

রাফসানের অস্বস্তি লাগছে। ইলিকে এভাবে বলা মোটেও ঠিক হয়নি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মুখ কেমন হয়ে গেছে ওর। এরকম কখন হয়? লজ্জায় না-কি অপমানে? চা শেষ করে কি বলবে, কি করবে সে ভেবে পেল না। ইলি বিব্রতকর ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে টেবিলের দিকে মুখ ফিরিয়ে চা খাচ্ছে।
রাফসান কিছু না বলে উঠে দাঁড়ায়। মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে এলো। মেয়েটি তাকে ইন্ডিয়া গিয়ে চেহারা খারাপ হয়েছে বুঝাতে মজা করে হয়তো বলেছে গরু রাখাল লাগছে। তাই বলে সে অন্যের বাসার চাকরানীর মতো লাগছে বলে ফেলবে? রাত ন’টায় তাকে খেতে ডাকলেনে ছোট চাচি। খেতে গেল সে। তাকে চাচি বললেন, ‘তোমার চাচারা তো ফোনে পাচ্ছেন না। একবার কল দিয়ে কথা বইল।’
– ‘আমার সিম তুলতে হবে চাচি। তারপর কল দেবো। না হয় তোমাদের সঙ্গে কথা হলে ডাক দিয়ো। আর হ্যাঁ, খালাকে দেখতে কাল শ্রীমঙ্গল চলে যাব।’

– ‘আচ্ছা।’

**
রাফসান বের হয়ে যেতেই ইলি দৌড়ে গেল মায়ের কাছে। রহিমা বেগম রান্নাবান্না করছেন। মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
– ‘আম্মা একটা ভুল করে ফেলেছি। রাফসান ভাই রাগ করে চলে গেছে।’

– ‘আমাকে ছাড়। কি করেছিস বল?’

– ‘আমি বলে ফেলেছি ইন্ডিয়া গিয়ে গরু রাখালের মতো হয়ে গেছে। বিশ্বাস করো আমি এমনিতেই মজার ছলে বলেছিলাম। সে রাগ করে ফেলেছে।’

– ‘হ, বড়ো তো বাতাসে হইছো৷ পড়ালেখা করে মানুষকে কি বলতে হয় না বলতে হয় তাও এখনও শেখনি।’

– ‘আমি জানতাম না-কি সামান্য এই কথায় রাগ করবে?’

– ‘আচ্ছা যা, সর এখন।’

– ‘রাফসান ভাই বলেছিল ফুপুকে কাল দেখতে যাবে।’

– ‘তাইলে তো ভালো৷ তুইও যা। ভার্সিটি বন্ধ আছে দেখে আয়। ছেলেটারও মা-বাবা কেউ নাই এখন। বেড়াতে গেলে মন ভালো হবে।’

– ‘কিন্তু রাগ করে যে চলে গেল?’

– ‘ধুরো যা সর। এতো রাগ করার কিছু হয়নি।’

– ‘রাগ করেছে মা। রাগ করে আমাকেও বলেছে অন্যের বাড়ির চাকরানী লাগে।’

– ‘কি?’

– ‘আমি বলছি রাখালের মতো লাগে৷ তাই সে রাগ করে কিছু না বলে চলে গেছে।’

– ‘বলিস কি৷ সামান্য এই কথায় এভাবে রেগে চলে গেল কেন? আজ দিনে তো কথাবার্তায় মনে হলো ঠিক আছে। মাথার সমস্যা আবার ফিরে এলো কি-না কে জানে।’

– ‘জানি না।’

ইলির ফোন বেজে উঠলো৷ মামাতো ভাই হৃদ কল দিয়েছে। রুমে চলে গেল। মাঝে মাঝেই কল দেয়। ইলি স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে। আজ মিনিট বিশেক কথা বলার পর রাতের খাবার খেয়ে বেডে যায়। ফেইসবুক ইন্সটাগ্রামে খানিক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে। আজ দিনটা আসলে শুভ। আচমকা রাফসান ভাই চলে এলো। মনটায় কেমন আনন্দ লেগে আছে। সঙ্গে একটু মন খচখচ করছে সন্ধ্যায় গরু রাখাল বলায়। মানুষটা এমনিতেই হঠাৎ এসে জানলো মা আর নেই। আর সে কি-না কি বলে দিলো।

—চলবে—
লেখা: MD Jobrul Islam

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here