#দ্বিতীয়_বসন্ত-২৭
Zannatul Eva
নিজের ভুল শুধরে নেয়ার সময় হয়েছে। একজনের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আছে আমার। জানিনা সে আমাকে ক্ষমা করবে কিনা কিন্তু তাও দু’হাত জোর করে আমি তার কাছে ক্ষমা চাইবো। আর আমার নাতবউকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবো।
মাহির খুশি হয়ে বলল, তুমি ডায়েরিটা পড়েছো বড় দাদাভাই!!
হ্যাঁ পড়েছি। এতো বছর এই ডায়েরিটা একদিনের জন্যও আমি খুলে দেখিনি। কারন এই ডায়েরি আমাকে সায়েদা দিয়েছিলো। অথচ বাবা ভেবেছেন নিজের ভালোবাসার মানুষের দেয়া উপহার কখনও না কখনও ধরে দেখবোই। সেই জন্যই সমস্ত কথা এই ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন। রাগে, অভিমানে কখনও ডায়েরিটা খুলিনি কিন্তু ফেলেও দিতে পারিনি৷ মনের গহীনে ওর জন্য একটা জায়গা রয়েই গিয়েছিলো। তাই হয়তো আজ এই দিনটা এসেছে। সবটা ঠিক করে নেয়ার এই সুযোগ আমি হাত ছাড়া করতে চাই না।
ঠিক আছে বড় দাদাভাই আমি তোমাকে নিয়ে যাবো দাদিজানের কাছে। আর তুমি তখন জানতে চাইছিলে না আমি সারারাত কোথায় ছিলাম?
আমি জানি তুমি কোথায় গিয়েছিলে এবং কার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে।
তুমি জানো!!
সদ্য বিবাহিত পুরুষ রাত বিরাতে নিজের বউ ছাড়া আর কার সাথে দেখা করতে যাবে!
মাহির খানিকটা লজ্জা পেলো। বলল, জানো বড় দাদাভাই রুহিই আমাকে এই ডায়েরির সন্ধান দিয়েছে। আর ওই তো সবটা প্ল্যান করেছে কিভাবে ডায়েরি খুঁজে বের করে পড়বো কিভাবে তোমাকে আর দাদিজানকে দেখা করাবো।
তালেব আহমেদ মাথা নাড়িয়ে বললেন, প্রথম দিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার নাতবউ ভীষণ বুদ্ধিমতি। মেয়েটাকে কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে এ বাড়িতে এসে। তবে এখন আর কেউ কষ্ট পাবে না। সব কষ্টের শেষ হবে এখন। চলো এখন ঘুমিয়ে পরো।
তালেব আহমেদ নিজের ঘরে চলে গেলেন৷ মাহির মোবাইলটা হাতে নিয়ে রুহিকে ফোন করলো।
হ্যালো কে বলছেন?
আপনি কী মিস রুহি?
না আপনি ভুল লোকের কাছে ফোন করেছেন।
কিন্তু আমি তো আমার বউয়ের কাছে ফোন করেছি। এটা তো আমার বউয়েরই নাম্বার।
কিন্তু এটা তো মিস রুহির নাম্বার নয়। এটা মিসেস রুহি আহমেদের নাম্বার।
ও আচ্ছা! তাহলে বোধহয় রং নাম্বারে ডায়াল করেছি।
তাই না! খুব মজা হচ্ছে!!
মাহির জোরে হেসে দিলো। কিন্তু রুহি যে নিজেকে মিসেস আহমেদ বলল তাতে মাহিরের বেশ ভালো লাগছে।
মাহির বলল, আচ্ছা শোনো বড় দাদাভাই ডায়েরিটা পড়েছে। আর আমার মনে হলো সবটা পড়ার পর দাদাভাইর সমস্ত ভুল ধারনা গুলো ভেঙ্গে গেছে। তাই তো সে দাদিজানের সাথে দেখা করতে চাইছে। এখন দাদিজানের সাথে কিভাবে দেখা করাবে বলো। কাল সোজা তোমাদের বাড়িতে চলে আসি দাদাভাইকে নিয়ে।
এই না না। বাড়িতে! দাদিজান তো দেখেই রেগে যাবে। আমি বরং আগে দাদিজানকে বলি যে দাদাভাই তার সাথে দেখা করতে চায়। তারপর আমি তোমাকে জানাচ্ছি।
রুহি নিজের অজান্তেই মাহিরকে তুমি বলে ফেলল। ব্যাপারটা রুহি খেয়াল না করলেও মাহির ঠিকই খেয়াল করেছে।
কী হলো চুপ করে আছেন কেনো?
তুমিটাই তো বেশ ছিল। তুমি থেকে আবার আপনিতে কেনো চলে আসা হলো?
আমি তুমি কখন বললাম!
নিজের অজান্তে।
মানে?
ঠিক যেভাবে তখন নিজের অজান্তেই নিজেকে মিসেস আহমেদ বললে তেমনি এই মাত্র তুমি আমাকে তুমি করে বলেছো। আর একবার যখন বলেই ফেলেছো তাহলে আবার আপনি আজ্ঞে করার কোনো দরকার নেই। নিজের হাসবেন্ডকে আপনি আপনি বললে কেমন পরপর লাগে।
পর থেকেই মানুষ আপন হয়। আপনি বলায় অভ্যস্ত আমি। সবসময় তুমি করে বলতে একটু সময় লাগবে।
আর কত অপেক্ষা করাবে তুমি আমাকে?
অপেক্ষা সুন্দর জানেন তো। যখন মানুষটা একান্ত আপন হয়ে যায় তখন তার জন্য অপেক্ষা করতেও ভালো লাগে৷ আর অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয় জানেন না?
মাহির গুনগুন করে বলল,
না রে না আর তো পারে না মন আমার নাস্তানাবুদ একজনেরই দায়…..না রে না কারো ধার ধারে না, দিন আমার যাচ্ছে ভালোই মিষ্টি যন্ত্রনায়……..
বাহ আপনি গানও গান! আমি তো জানতাম আপনি শুধু মারপিট আর সিগারেট খাওয়া ছাড়া কিচ্ছু জানেন না। এই ভালো কথা আপনার প্রথম প্রেমিকার (সিগারেট) কী খবর? এখনও সিগারেট খান নাকি?
হুম।
কীহ! আপনি এখনও সিগারেট খান!
দ্বিতীয় প্রেমিকা তো ব্রেকআপ করে দিয়েছে। তাই প্রথম প্রেমিকার সাথেই প্যাচআপ করে নিয়েছি।
আমি ফিরবো না।
মানে?
আমি আপনার কাছে ফিরবো না। সিগারেটের গন্ধে আমার মাথা ঘুরায়। আমি একদম সহ্য করতে পারিনা।
কত মেয়েই তো সতীনের ঘর করছে। আর তুমি মাত্র একটা সিগারেটকে তোমার সতীন হিসেবে মানতে পারছো না!!
না পারছি না। পারবোও না। যেটা আমার সেটা একদমই আমার। সিগারেট কেনো পৃথিবীর কারো সাথেই আমি আমার জিনিস শেয়ার করতে পারবো না। ফিরবো না আমি আপনার কাছে। ডিসিশন ফাইনাল।
টুট………..
এই রে রেগে গেল! উফফ মাহির শুধু শুধু কেনো রাগাতে গেলি! সিগারেটের সাথে তো তুই সেই কবেই ব্রেকআপ করে দিয়েছিস। শুধুমাত্র রুহি পছন্দ করে না বলে। তাহলে রাগানোর কী দরকার ছিল! সবে মাত্র মেয়েটা তোর প্রেমে পড়তে শুরু করেছিলো ওমনি তোর নিজেরই নজর লেগো গেল।
মাহির আবারও ফোন করলো রুহিকে। কিন্তু রুহি ফোন তুললো না। কয়েলবার ট্রাই করার পর অবশেষে রুহি ফোন তুললো।
কী চাই?
তোমাকে।
সরি রং নাম্বার।
এই রুহি রুহি প্লিজ কেটে দিও না। সরি….. আমি মজা করছিলাম। বিশ্বাস করো আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। বিলিভ মি। আচ্ছা তুমি দাদাভাইকে জিজ্ঞেস করো দেখা হলে।
রুহি ভারী গলায় বলল, হুম করলাম বিশ্বাস। কিন্তু পুরোপুরি নয়। দাদাভাইকে জিজ্ঞেস করবো আমি। দাদুর নাতির সব কীর্তি তখন দাদুই ফাঁস করবে। রাখছি এখন।
কাল কখন আসবো তাহলে?
একটু পরে জানাচ্ছি।
ওকে।
_____________________
সায়েদা বেগম আলমারি থেকে শাড়ি বের করে সেগুলো গোছাচ্ছিলেন। এমন সময় রুহি দরজার সমানে এসে বলল, দাদিজান আসব?
ওইহানে দাঁড়ায় থাকার কী হইছে! আয় ভিতরে। আমার লগে শাড়ি গুলা ভাঁজ কর। রুম্পারে কইলাম একটু হাতে হাতে সাহায্য করতে। হের নাকি মাথার ব্যামো হইছে। কামে কইলেই হের এই ব্যামো ঐ ব্যামো। ভাবছিলাম এইহান থেইকা কয়েকটা শাড়ি তোরে আর রুম্পারে দিমু। কিন্তু এহন ভাবতাছি ঐ বান্দর ছেমড়িরে দিয়া লাভ নাই। ওয় এহনো জিনিসের যত্ন আত্তী করা শিখে নাই। কো দেহি কোন শাড়িডা তোর পছন্দ?
রুহি লাল রঙের একটা শাড়ি বেছে নিলো। তারপর আমতা আমতা করে বলল, একটা কথা বলবো দাদিজান?
কী? এতো ম্যানম্যান করতাছোস ক্যান?
ইয়ে মানে বড় দাদাভাই মানে মাহিরের দাদু তোমার সাথে দেখা করতে চান।
সায়েদা বেগম আড় চোখে তাকিয়ে বললেন, ক্যান! তোর উপর যেই অন্যায় করছে তার লেইগা ক্ষমা চাইবো? চাইয়া লাভ নাই। ঐ বাড়িতে তোরে আর পাঠাইম না৷ আর হের লগে দেখা করোনের কোনো ইচ্ছাও আমার নাই কইয়া দিছ। হ্যাঁ রে তুই ঐ পোলার লগে এহনও যোগাযোগ রাখছোস নাকি? ঐ মাইয়া খবরদার কইলাম তুই আর কোনোদিনও ঐ বাড়িতে যাওয়ার চিন্তা করিছ না। কী ভাবছে হেরা! মাইয়ারা খেলার পুতুল! মন চাইলে বিয়া করবো আবার মন না চাইলে অপমান কইরা বাইর কইরা দিবো। কথা দিয়া কথা তো রাখতে পারে না হেরা। মাইনষের জীবন নিয়া ছিনিমিনি খেলাই তাগো কাম। তুই ভাবিছ না। আমি তোরে ভালো ঘরে বিয়া দিম। সবাই তোরে মাথায় কইরা রাখবো।
রুহি মনে মনে বলল, যা ভয় পাচ্ছিলাম সেটাই হলো। দাদিজান তো ঐ বাড়ির নাম শুনলেই রেগে যাচ্ছে। আমি কী বলবো ডায়েরির ঘটনাটা?
দাদিজান আমার মনে হয় দাদাভাই তোমাকে কিছু বলতে চান। মানে এমন কোনো কথা যেটা আমরা কেউ জানিনা। না মানে আমি তো বলেই দিয়েছি আমি আর ও বাড়ি ফিরবো না। তাহলে আর কী নিয়ে কথা বলতে পারে? আমার মনে হলো আর কী এমনটা।
না না আমার আর কোনো কথা বলার নাই। যা বলার যা শোনার তা বহুবছর আগেই শেষ হইয়া গেছে।
বহু বছর আগে কী হয়েছিলো দাদিজান?
মুখে মুখে কথা বলিস না ছেমড়ি। যা নিজের ঘরে যা। আর ঐ ব্যাডার কথা কইতে আইবি না কহনও আমারে বুঝছোস তুই?
এবার কী করবো! দাদিজান তো দেখাই করতে চাইছে না।
হুট করেই রুহির মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো। মোবাইলটা এমনি এমনি কানে নিয়ে বলল, কী!! কী হয়েছে দাদাভাইর! স্ট্রোক! হায় আল্লাহ দাদাভাইর স্ট্রোক হয়েছে! খুব খারাপ অবস্থা? কাকে দেখতে চাইছে? সায়েদা সায়েদা বলছে? কিন্তু দাদিজান তো বলে দিয়েছে সে দেখা করবে না। কী! অনেক বেশি খারাপ অবস্থা! এমন সময় লোকটা তার মনে জমা থাকা কথা গুলো বলতে পারবে না! যদি কিছু হয়ে যায়!!
সায়েদা বেগম আতকে উঠে বললেন, কী হইছে রে? কী সব জানি বলতাছিলি তুই। কার কী হইছে।
দাদাভাইর শরীর ভীষণ খারাপ। তোমার সাথে একটু দেখা করতে চাইছে। অসুস্থ মানুষটার সাথে রাগ করে কী হবে বলো? যদি কিছু একটা হয়ে যায়! তখন তো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
সায়েদা বেগম মনে মনে বলল, কী হইছে মানুষটার!! এতো গুলা বছরে একবারও তার মনে পড়ে নাই আমার কথা। আমার দিন গুলা কেমনে কাটছে কোনোদিন জানতেও চায় নাই। এই মানুষটার জন্য সারাটা জীবন একলা কাটায় দিলাম। প্রত্যেকটা দিন মনে হইতো হয়তো মানুষটা আসবো। নিজের ভুল শুধরায়া নিবো। কিন্তু না হেয় তো আসে নাই। কিন্তু আইজও হের অসুখের খবর পাইয়া আমার ঠিক আগের মতোই কষ্ট হইতাছে ক্যান!
সায়েদা বেগমের চোখের কোনে জল ছলছল করছে।
রুহি শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, কী বলবো দাদিজান?
কইয়া দে আমি যাইমু তারে দেখতে। অরশি পরশি অসুস্থ হইলেও আমি দেখতে যাই। আর হের লগে যহন একটা আত্মীয়ের সম্পর্ক হইছেই তহন একবার যাইয়া দেইখা আসি কী অবস্থা।
রুহি প্রচন্ড খুশি হয়ে মাহিরকে ফোন করে জানালো সবটা। আর বলল, দাদাভাইকে যেনো অসুস্থ হওয়ার নাটক করতে বলে। নয়তো দাদিজান যদি গিয়ে দেখে সব মিথ্যে তাহলে ভীষণ রেগে যাবে।
মাহির রুহির কথা মতো দাদাভাইকে আগে থেকেই সবটা বলে রেখেছে। সায়েদা বেগম একাই গেলেন তালেব আহমেদকে দেখতে।
সায়েদা বেগম বাড়িতে ফিরে আসার পর মাহির রুহিকে ফোন করলো দাদিজানের রিয়েক্টশন জানার জন্য।
রুহি ফোন ধরে বলল, এতো কষ্ট করে দাদিজানলে পাঠালাম আর এটা কী হলো! দাদিজান ফিরে এলো আরও রেগে। আর এসে থেকেই বলছে উনি নাকি আমার বিয়ে ঠিক করেছে। কাল আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।
আরে!! এটা কী করে হতে পারে! তুমি তো এখনও আমার বউ। আমাদের তো ডিভোর্স হয় নি। তাহলে উনি কী করে আমার বউকে অন্য কারো সাথে বিয়ে দিতে পারে!
জানিনা আমি কিচ্ছু জানিনা। সব দোষ আপনার। আপনি একটু দাদাভাইকে বুঝিয়ে বলতে পারলেন না যেনো আর কোনো ঝামেলা না বাঁধে। এখন তো সব উলট পালট হয়ে গেল।
ইতোমধ্যেই তালেব আহমেদ এসে গম্ভীর স্বরে বললেন, মাহির তেমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। একবার আমার ঘরে এসো।
চলবে……….