“দ্বিতীয় বাসর ‘ (গল্প),পর্ব-১০১
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
বন্ধন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় পবিত্র স্থানে তাকে যেতে হবে।
পাঁপিয়ার যা শাস্তি হবার তাতে তার মেয়ে তন্নী, এখন যা তাকে বলেছে তাই যথেষ্ট। বাকি হিসাব আল্লাহতায়ালার উপর ছেড়ে দেয় বন্ধন বাবু।
কাজেই সময় নষ্ট করার মতো সময় এখন তার নেই।
তার ছেলে, তার প্রিয়তমা স্ত্রীর কাছে ফিরে যাবে বন্ধন যত দ্রুত।
তার পূর্বে আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে হবে ভাবে বন্ধন।
পবিত্র নগরী মক্কায় যখন পৌঁছায় বন্ধন তখনও ফাগুন চলছিল।তবে ঐ নগরী তখনও বেশ গরম।
বন্ধন বাবু পৌঁছে ওমরাহ্ পালন করার উদ্দেশ্যে প্রস্তুতি নেয়।
নফল ইবাদত সহ নানান ইবাদত,পবিত্র কাবা শরীফ তাওয়াফ করা, দূরদ শরীফ পাঠ সবই ধীরে ধীরে পালন করে বন্ধন একাগ্র চিত্তে।
এর ভিতর একদিন তার ভীষন খারাপ লাগে শরীরটা।
মাথাটা চক্কর দিয়ে পড়ে যাচ্ছিল বন্ধন।
হঠাৎ কেউ যেন তাকে ধরে ফেলে।সামনে ফিরে তাকাতেই বিস্মিত বন্ধন।
যিনি তাকে ধরে আছেন তিনি আর কেউ নন,বন্ধনের পরিচিত পীর বাবা সুলেমান সাদিক।
পবিত্র কাবা শরীফ, আল্লাহর ঘর যেদিন তাওয়াফ করে বন্ধন, সেদিন ছিল শুক্রবার।
বড় হজ্জ পালন করার সময় শুক্রবারে হজ্জ পালন করা হলে তাকে বলা হয় আকবরি হজ্জ।
বন্ধন মনে মনে ভীষন খুশি।রোজা রাখে ঐদিন বন্ধন।
ভীষন কষ্ট হয় তার এ অবস্থায় কাবা শরীফ তাওয়াফ করার উদ্দেশ্য এতবার পুরো কাবা শরীফ চক্কর দিয়ে হেঁঠে আসতে।
পীরবাবা সুলেমান সাদিক ও ভক্ত খাদেমরাও ছিল সাথে।
সুলেমান সাহেব বেশ অবাক হোন বন্ধনের এতো ধৈর্য্য দেখে।
শুধু তাই নয়,শতশত বান্দা আল্লাহতায়ালার মার্জনা পাবার আসায় কাবা ঘরকে ঘিরে ক্রন্দনরত।
বন্ধন এসকল অজস্র ভীর ঠেলে পবিত্র কাবা শরীফ ধরে শিশুর মতো কেঁদে ফেলে।
কায়মনোবাক্যে আল্লাহতায়ালার নিকট আর্জি পেশ করে বন্ধন বাবু,
“হে আল্লাহ আপনি তো সব জানেন,আমার সাথে কত ঝড় ঝঞ্জা গিয়েছে,আমাকে উদ্ধার করেন।
মিতুকে উদ্ধার করেন।আমার সদ্য অনাগত সন্তানকে হারিয়েছি, আমার প্রথম স্ত্রী কেয়াকে হারিয়েছি এসবই আপনার ইচ্ছা।আমার ভুলের কারনে মিতালীকে আপনি শাস্তি দিয়েন না….আল্লাহ আমি আপনার গোলাম,আমার কিছুই নাই সবই আপনার আমি বড় আশা নিয়ে আপনার পবিত্র ঘরে এসেছি আমাকে খালি হাতে ফেরাবেন না।হে আল্লাহ আমার স্ত্রী মিতালী মিতু বড় অসহায়।দুনিয়ায় সেও আমার মতো এতীম হয়ে গেছে।সন্তান আর পিতৃ শোকে অসুস্থ হয়ে আছে তার উপর দয়া করেন। ও সব ভুলে গেছে,আমি তার হতভাগা স্বামী তাও ওর মনে নেই।ওর সব স্মৃতি আবার ফিরিয়ে দিন।ওর খালি কোল আবার ভরিয়ে দিন।তাকে সব রকম কষ্ট ও অসুস্থতা থেকে মুক্তি দিন।আমরা পাপী আপনি দয়ার সাগর আমাদের মাফ করে দিন…
আমার ছেলে বাবাই এর প্রতি দয়া করেন,নানুকে শান্তি দিন আমার দুভাই, ভাই এর পরিবারকে ভালো রাখেন।
আমার মা, বাবা মিতালীর মা, বাবার আত্মার শান্তি দিন।তাদের জান্নাতে নসীব করেন…..।’
“দ্বিতীয় বাসর’ (গল্প),পর্ব-১০২
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
মোবাইলের টুনটুন শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় মিতুর।
একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে।
এই নাম্বার থেকে আগেও একবার কল এসেছিল।ওপাশ থেকে অপরিচিত কোনো মহিলার কন্ঠ ছিল সেটি।
“কেমন আছো মিতালী…? ‘এটুকু বলেই রেখে দিয়েছিল।
আজও একই কথা।
“কেমন আছো মিতালী?’
“জ্বী ভালো।আপনি?’
“আমি রূপা…।’
“কোন রূপা?’
“হীমেলের স্ত্রী।’
“ও আপনি?কি ব্যাপার বলেন?’
“মিতু… আমি তোমার কাছে ঋনি হয়ে গেলাম।’
“ঋনি! কি বলছেন ভাবী?আমি কখন কি করলাম?’
“কি বল্লে মিতু?আমাকে ভাবী বল্লে?’
“সম্পর্কে তো আপনি তাই হোন তাই না?’
“আসলে…। ‘
“আসলে?’
“তুমি অনেক ভালো মনের একটা মানুষ মিতু।না বুঝে সেই কবে অবুঝের মতো তোমাকে আমি না জানি কত কি বলে ফেলেছিলাম। এতকিছুর পরও তুমি আমার প্রতি বিদ্বেষী হও নি। চাইলে হীমেলের সাথে আমার ছাড়াছাড়ি হওয়ার ব্যাপারে তুমিও সায় দিতে পারতে, আমি যে দূর্ব্যবহার করেছিলাম উপযুক্ত জবাব দিতে পারতে।এসব কিছুই তুমি করোনি। বরং আমার শ্বাশুরিকে তুমি গিয়ে বুঝিয়ে এসেছো।এখন আবার আমায় ভাবী ডেকেছো…..।আমি মনেপ্রানে তোমার জন্যে দোয়া করবো…।’
ধরা গলায় কথাগুলো বলে ফেল্ল রূপা।
সেই কবে ধনীর দুলালি অতি অহংকারী রূপা তার সাথে যে ব্যবহার করেছিল তা চাইলেই মিতু ভুলতে পারবে না তবু কিছু বলে না মিতু।
ফের বলে,
“আপনি কি হীমেল ভাই এর সাথে এখন?’
“হ্যা মিতু।আমার ভাঙা সংসার ভেবেছিলাম আর বুঝি জোড়া লাগবে না।কিন্তু আবার আমি সব ফিরে পেলাম এসবই তোমারি কারন….।’
“কি বলছেন এসব?দেখুন আমাকে এতটা মহান করবেন না।সবই আল্লাহতায়ালার ফয়সালা, শুধু এতটুকু বলবো হীমেল ভাইকে ধরে রাখুন,বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে সব ভুলে যান আবার সব শুরু করুন এইতো….।’
“তুমিও সব ভুলে যেও মিতু আর আমাকে তুমি মাফ করে দিও প্লিজ….।’
“আমি এসব মনে রাখিনি… ।’
“সে আমি জানি….তবু?’
“ঠিক আছে ভাবী,শুনে ভালো লাগলো,মামীর দিকে খেয়াল রাখবেন,আপনাদের চিন্তায় সে অনেক কষ্ট পেয়েছে। আর আমার জন্যে দোয়া করবেন….।’
“অবশ্যই।’
মিতুর বুকটা বেশ হালকা লাগছে রূপার সাথে ফোনে কথা বলার পর।
হীমেল আর রূপার একটা গতি হয়েছে শুনে খুব ভালো লাগে তার কিন্তু মনে মনে বেড়ে যায় তার সেই আকুলতা।
“সবার সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে…. কিন্তু আমি কবে কাছে পাবো…?’
সব জানার পর সেতারা আর এক মুহুর্ত স্থির থাকতে পারে না।মিতুকে ফোনের পর ফোন করে সব জানতে চায়।কখন কিভাবে এমন হলো মিতুর সাথে ঘাবড়ে যায় যেন সেতারা।আর যত দ্রুত ঢাকায় চলে আসতে বলে তাকে।
তার উপর স্বামী আরিফের সাথে রীতিমতো ঝগড়া লেগে যায় তার।মেয়ে সিমলার পড়াশোনা,দেখাশোনা সব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।আরিফ তার রিসার্চের জন্যে ইউএসএ যাবে এদিকে সিমলার স্কুল ফাংশন।এই মাসের বারো তারিখের ভিতর ওর গার্ডিয়ান থাকতে হবে।
শেষমেশ রাগ করে আরিফ সেতারাকে জানিয়ে দেয়,
“তুমি বাংলাদেশেই থাকো তোমার সংসার উচ্ছন্নে যাক,আর আর্মি অফিসার বলে এত লাফালাফি করে মিতালীকে বিয়ে দিলা,বাট এরকম ইররেসপনসিপল হ্যাজবেন্ড আমি আজতক দেখি নাই।যার বউ যার বাচ্চা তার মাথাব্যাথা নাই? তোমার কেন এত মাথাব্যাথা?’
“আহা নওশাতের বাবা,মিতু আমার বোন তুমি জানো যে মিতু, মুহিনের কি অবস্থা, আমি ওদের এ অবস্থায় ফেলে কিভাবে আসবো বলো?’
“মিতু, মুহিন তোমার ভাইবোন আর নওশাত সিমলা ওরা কি?চার মাস ধরেই তো শুনছি?ধ্যাৎ দেখেশুনে বোনের বিয়ে দিতে পারোনা আবার কথা বলো?থাক তুমি তোমার ভাই বোনকে নিয়ে,এখানে আসার দরকার নাই….।’
বলেই খট করে ফোন রেখে দেয় আরিফ।
সিমলা মনে মনে ভাবে,আরিফের রেগে যাওয়াটা আলবৎ জায়েজ আছে।সেই ডিসেম্বরে সে এখানে এসেছে আর এখন মে মাস চলছে।অথচ ওর চলে যাওয়ার কথা ছিল জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে।
ক্যালেন্ডার দেখে সেতারা যেভাবে হোক দশ তারিখের আগে তাকে বাংলাদেশ ছাড়তে হবে।আরিফ এর ভেতর এমেরিকা চলে যাবে।এদিকে মিতু দ্বিতীয় বারের মতো প্রেগন্যান্ট। হীমেল বলেছিল, বন্ধনকে দেখে ছিল তাদের বাবার ঘরে আর মিতু সে ঘর থেকেই এসেছিল, তাছাড়া রহিমা খালাও ঐদিন এতোরাতে বন্ধনকে ঘরে ঢুকতে দেখে ঘরে এসেছিল।কিন্তু তাদের বাবার ঘরে সিটকানি দিয়ে দরজা লাগানো ছিল।
রহিমা খালা বেশ অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে চলে গিয়েছিল সেদিন।হীমেলের মুখে শুনে পরে বুঝেছিল যে,বন্ধন এসেছিল। লজ্জায় সে কথাও পরে বলতে পারেনি কাউকে রহিমা খালা।
“বন্ধনের কি আর কোনো কাজ নাই?নাকি লজ্জা শরমও চলে গেছে এই বয়সে?তুই এলি তো এলি আমার বোনের এ অবস্থা করে দিয়ে গেলি কেন?আর যাবি যদি মিতুকে নিয়ে গেলি না কেন ?মরার ঝামেলা শুধু আমার উপর দিয়ে।কোথায় মরেছে বন্ধন কে জানে?ঠিকই তো বলেছে নওশাতের বাবা….কার কাছে যে মিতুকে বিয়ে দিলাম?’
সেতারা আপুর মালয়েশিয়া যাবার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।
মে মাসের নয় তারিখে সেতারার ফ্লাইট।
জামান যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেয় অগত্যা।পারুলের বিয়ের অনুষ্ঠান ঈদের পরে।
আর কিছুদিন পরই রোযা শুরু হয়ে যাবে।সেতারাকে আর এতোদিন আটকে রাখা যাবে না এখানে।পারুলের মন খারাপ হয় তাতে।
অবশ্য সেতারার চিন্তা মিতুকে নিয়েই বেশী।বন্ধন বেশী বাড়াবাড়ি করলে বোনকে তার সাথে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে ভাবে সেতারা।
সেতারা, পারুলের বিয়েতে আবার আসবে কিনা এ ব্যাপারে কিছু জানায় না।
তাই জামান পারুলের হয়ে অনুরোধ করে কক্সবাজারে ছোটখাট একটা বাগদান পরবর্তি আর একটা অনুষ্ঠান করবে। সেতারা আর মিতুকে অবশ্যই থাকবে।
মিতু এ অবস্থায় কিভাবে যাবে আশংকা প্রকাশ করে সেতারা।
জামান চুপচাপ হাসে এক গাল।
মনে মনে বলে ফের,
“মিতু ভাবীকে তো যেতেই হবে। এ আয়োজন একজন বিশেষ মানুষের না হলে যে সব বৃথা ….!’ (চলবে)
(চলবে)