দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-৫১
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
মিতালী দরজা খুলে যাকে দেখল, তাকে এ অসময়ে সে কল্পনাই করেনি।
সামনে যিনি দাঁড়ানো, দেখে মনে হচ্ছিল হলিউডের কেউ,ওয়েষ্টার্ন ড্রেস,টাইট জিন্স,কানে লম্বা দুল,ঠোঁটগুলোয় কড়া লিপষ্টিক।
আর মিতুর দেখা সেই ছবির মতো টি শার্টের সামনে বুকের দু,তিনটা বোতাম খোলা।
চল্লিশ উর্ধ্ব বয়স তবুও নিজেকে যতটা সম্ভব আবেদনময়ি করে টিন এইজ ক্রেজ ধরে রাখার অবিরাম চেষ্টা…।বুকের মাঝখানটা স্পট বোঝা যাচ্ছে তাতে হার্ট শেড এর দামী লকেট ঝুলছে।
গা ভর্তি পারফিউম,গালগুলোতে ছোট ছোট গর্তের মতো তার দুপাশে ব্লাশন,বিশাল বড় নখগুলোয় নেইলপ্যান্ট যেমনটা এ যুগের ইয়াং জেনারেশন মেয়েদের সেনসেশন।আংগুল গুলোয় বাহারি আংটি, অন্য একটা হাতে,পুরো আংগুল জুড়ে বিশাল ত্রিকোনাকার আংটি হাতে ব্রেশ লেট সহ।এক হাতের উপর আরেক হাত দিয়ে চকচক করা তার জিনিসগুলোয় আভিজাত্য দেখিয়ে যাচ্ছে ভদ্রমহিলা।
কিন্তু আসলেই সে কি ভদ্রমহিলা?মিতু খেয়াল করল,তার ডান হাতের আংগুলের মাঝখানে ধোয়া বের হচ্ছে।
কাঁধের এক পাশটায় দামী লেদারের ব্যাগ,চোখে দামী গগলস।গগলস এর গ্লাসে মিতুর প্রতিবিম্ব ভেসে উঠেছে।যেখানে প্রথম দর্শনে যে সে এতটা হতবাক হয়েছে সেই ফ্রেমেও তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
“জ্বি আপনি?’মিতুর জিজ্ঞাসা।
মিতুকে ভড়কে দিয়ে পুরোই মহিলা তার কর্কশ কন্ঠে জবাব দিল,
“আমি কে সেটা পরে হবে…সো ইয়াং লেডি,ইউ আর মিতালী,আই মিন মিতু রাইট?’
“জ্বি আই এম মিতু,মিসেস মিতালী আহমেদ,ওয়াইফ অফ বন্ধন আহমেদ,কিন্তু আপনি?এত সকালে?কাকে খুঁজছেন?’
“শোন মেয়ে আমি কাকে খুঁজতে পারি, সেটা তো গত রাতেই জানিয়েছি।’ ফের মহিলার বাঁকা জবাব।
“ও তো আপনিই পাপিয়া?যাকে খুঁজছেন তাকে বুঝি খুঁজে পাচ্ছেন না?তাই একেবারে বাসা অব্দি চলে এসেছেন তাকে খুঁজতে….?’মিতুরও পাল্টা জবাব।
“হাহাঃ হাঃ আমার বাবুর বাসা আর আমি আসবো না?’
“এক্সকিউজ মি কি বলছেন আপনি? বাবু আপনার মানে?ডু ইউ হ্যাভ লষ্ট উইর মাইন্ড?’
“ইয়েস আই হ্যাভ লষ্ট মাই মাইন্ড….বিকজ অফ ইউ,আই লষ্ট মাই লাইফ,এভরিথিং অনলি জাষ্ট বিকজ অফ ইউ ওকে….’
চিৎকার দিয়ে উঠল পাপিয়া,তার শরীরটাও কেঁপে উঠল,প্রচণ্ড ক্ষোভে হাতের সিগারেটটা ঠোঁটে দিয়ে মিতুর দিকে ধোঁয়া উড়াতে লাগলো।মিতু বুঝতে আর বাকি নেই,এই মহিলা মাতাল,তার হাত গুলিও কাঁপছিল,আর মুখ থেকে উৎকট গন্ধ বের হচ্ছে।তারমানে গত রাতে বন্ধনের সাথে হয়তো কথা কাঁটাকাঁটি হয়েছে,আর আজ মদ খেয়ে মাতালের মতো এখানে ছুটে এসেছে বন্ধনকে খুঁজতে।
কিন্তু মিতু আর কথা বাড়াতে চায় না,একটা মদখোর,মাতাল, উন্মাদের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় মিতুর কাছে নেই।
মিতুও প্রচণ্ড স্নায়ুচাপে আছে,তদুপরি পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্যে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।
মিতু ঠান্ডা মাথায় বলে,
“দেখুন আপনি যার কাছে এসেছেন,তিনি বাসায় আসছেন।আপনি বরং সোফায় বসে অপেক্ষা করুন।’
চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে ফেলে পাঁপিয়া।অনবরত সিগারেট টানতে থাকে।মিতু শাড়ীর আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে।পেট গুলে বমী আসছে ওর।
মনে মনে আল্লাহকে ডাকে,বিড়বিড় করে মিতু,
“এই অসুস্থ ঝামেলাটাকে নিয়ে এখন কি করি,বাবুও এখনো আসছে না কেন,আর বাড়ীর সিকিউরিটি গার্ড কোথায় মরেছে এটাকে বাসার ভেতর ঢোকালোই বা কি করে…’
ফের সিন ক্রিয়েট করে পাঁপিয়া,পাজি হিংস্র হায়েনার মতো আচরন করতে থাকে অসহায় মিতালীকে একা পেয়ে…।(চলবে)দ্বিতীয় বাসর(গল্প),পর্ব-৫২
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
মিতুর অস্থিরতা বেড়েই চলেছে।হাসপাতালে বাবা,আর ভাইটা জেলে এর ভিতর এই উটকো ঝামেলা এসে জুড়েছে।
বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে মিতালীর কপালে।তার উপর পাঁপিয়ার মুখ থেকে বাজে রকম গন্ধ,সিগারেটের বিশ্রী ধোঁয়া।আজকাল হাই সোসাইটি খ্যাত কিছু মেয়েদের মধ্যে সিগারেট ফুঁকতে দেখে মিতু খুবই অবাক হয়ে যাচ্ছে।পাঁপিয়া তাহলে সে ধরনের।মা, বাবার বখে যাওয়া মেয়ে,নীবিড় অনেক আগে জানিয়েছিল মিতুকে,পাঁপিয়ার বাবা নাকি মন্ত্রী ছিলেন।সেই সুবাদে পাঁপিয়াও পরে এমপি হয়েছে।টক শোতে নাকি মাঝে মাঝে দেখায় তাকে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া,সুন্দরী,অতি স্মার্ট কিন্তু কি কারনে বন্ধনের মনঃপুত হয়নি?বন্ধনের নাকি ক্লাসমেট ছিল,বন্ধন ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো।কেয়াও পড়তো।তবে কি পাঁপিয়া কেয়াকেও এভাবে জ্বালাতন করতো?আর এতদিন হয়ে যাবার পরও বন্ধনের পিছুই বা কেন ছাড়ছে না?বন্ধনের কোন ইন্ধন নেই তো?
কিছু সময়ের জন্যে হলেও মিতালীর ভাবনায় এসব অগোছালো প্রশ্ন ভীড় করতে থাকে।তবে এখন এসব ভাবার সময় নেই।ফের ঘড়ী দেখে মিতু পৌনে দশটা বেজে গেছে।
ফের বলে,
“আপনি যার কাছে এসেছেন তাকে বরং ফোন করুন,আমি উপরে যাচ্ছি।’ডুপ্লেক্স বাসা মিতুদের।উপরে মিতুর শোবার রুম,সেটাই জানালো পাঁপিয়াকে।
“ন্যাকামি করছো আমার সাথে?’উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে পাঁপিয়া।
“আমি কেন ন্যাকামি করবো আপনার সাথে?’
“ন্যাকামি নয় তো কি?আমার নাম্বারটা ব্লক করিয়ে আমার নামে বাবুর কাছে নালিশ করে এখন সাধু সাজা হচ্ছে?’
পাঁপিয়ার মুখ থেকে ওর বাবুর নামটা শুনে বুকটা যেন কেমন করে মিতুর।
এমপি বলে মাথা কিনে নিয়েছে নাকি এমন অশালীন আচরন? প্রচণ্ড উদ্বেগ মিতুর,ফের বলে,
“দেখুন আমি ভদ্রভাবে আপনাকে সোফায় বসে অপেক্ষা করতে বলছি আর আপনি তখন থেকে অভদ্র আচরন করে যাচ্ছেন….।তাও আমার বাসায় এসে।’
“আমি সোফায় বসতে আসিনি।আর এটা তোমার বাসা কবে থেকে?তোমার আগে এ বাসা আমার ছিল তুমি যদি জানতে তবে এত স্পর্ধা দেখাতে পারতে না।’
মিতু কথাটা শুনে পুরোপুরি থতমত খেয়ে ওঠে।
“আপনার মানে?এখানে তো কেয়া থাকতেন।’
“হ্যা আমার।কেয়া তো আরেকটা,ও আমার বাবুকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল,এখন তো মরে ভুত হয়ে গেছে।ওকে দেখে শিক্ষা হয় না তোমার?ও কিছু করতে পারেনি,তুমি কি করে পারবে?এখন এসেছো আমার বাবুকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে?হ্যাহ্…
শোনো মেয়ে তোমারও একই দশা হবে…।’
মহিলার অসংলগ্ন কথা আর আচরন ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে মিতুর কাছে।মিতু চুপ করে সোজা উপরের ঘরে যেতে গিয়েও পারেনি,পাঁপিয়া তাকে কি বোঝাতে চাচ্ছে ও শেষটা জানতে চায়।শাড়ীর আঁচল দিয়ে বিন্দু ঘাম গুলো মোছে ফের।
ঠান্ডা মাথায় মিতালী জবাব দেয় এবার,
“এতই যদি বাবু আপনার আর এই ঘর আপনার তাহলে মিসেস আহমেদ আপনি হতে পারলেন না কেন?যদি কেয়া আপনার পথের কাঁটা ছিল,তাকে আল্লাহ নিয়ে গেছেন।কিন্তু বন্ধন তাকেও ভালোবেসেছিল আপনাকে নয়?’
“কি? কি বল্লে তুমি বন্ধন আমাকে ভালোবাসে না?তুমি কি জানো হ্যা ভার্সিটিতে এই বন্ধন সারাক্ষন আমার পেছনে ঘুরতো,আমাকে পাবার জন্যে ও আমার বাসার কাছে বসে থাকতো,আমি যেখানেই থাকতাম হাজির হয়ে যেত…আমাদের সম্পর্ক বিশ বছরের উপরে এমন অনেক ঘটনা আছে তুমি জানো না,তাই একথা বলছো।’
“জানতেও চাই না,কারন তখন আপনারা দুজনেই তরুন,এরকম ব্যাক্তিগত ভালোলাগা,পাগলামী থাকতেই পারে বর্তমানের দিকে তাকান।’
“পাগলামি হলে তাই ই,ও শুধু আমার ওকে..।’
হেসে ওঠে মিতালী এবার,
“বারবার আমার আমার করছেন,অথচ কি আশ্চর্য বন্ধন আপনাকে ব্লক মেরে দিলো?সত্যি হাস্যকর।’
কথাটা যেন হজম করতে পারলো না পাঁপিয়া, আচমকাই মিতালীর হাতের কব্জিটা ধরে সজোরে টেনে ধরল।
“কি? কি বল্লে তুমি?আমাকে নিয়ে উপহাস… এত বড় স্পর্ধা? তুই জানিস আমি কে?আমি একজন এমপি তুই জানিস আমার কত পাওয়ার…।আমি তোর কি করতে পারি তুই টেরও পাবি না।’
ব্যাথায় শিউড়ে ওঠে মিতু।তবু দমে যায় না,
“এমপি আর যতবড় নেতাই হোন,ছাড়ুন বলছি,বন্ধন যদি এ অবস্থায় দেখে আল্লাহই জানে ও আপনার কি করবে ….'(চলবে)