“দ্বিতীয় বাসর’ (গল্প),পর্ব-৯৪
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
মোবাইলের টিনটিন শব্দ শুনে ফোনটা রিসিভ করেন
খাদিজা বেগম।
সকাল ন’টা থেকে হসপিটালে রিসেপশনিস্ট এর চেয়ারে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা নানা ধরনের রোগীর এন্ট্রি নিতে হয়।বেশী রোগী থাকলে হিমশিমও খেতে হয়।
আজকাল খুব তাড়াতাড়ি হাপিয়ে উঠছেন তিনি।বারো বছরের উপরে বেসরকারি এ হাসপাতালে রয়েছেন।
স্বামী আবদুল্লাহ গত হবার পর তার বোনের চিকিৎসক স্বামীর হস্তক্ষেপে এখানে চাকরীটা জুটে যায়।
বেতন আগের তুলনায় বেড়েছে কিন্তু তাতেও সংসারে টানাটানি কাঁটেনি।চার চারটা সন্তান। তিনটাই মেয়ে।আর ছেলে সবার ছোট।
আঁখি সবার বড়।ওর বিয়ে হয়ে গেলে আরও দুটো মেয়েরও বিয়ের চিন্তা।
একবার তার কলিগ পরামর্শ দেয় তাকে ছুটি নিয়ে আঁখিকে রিসেপশনে বসিয়ে দিতে।বড় সাহেবকে বল্লেও সে ব্যবস্থা করা যাবে।খাদিজাও তাই চাচ্ছিল মনে মনে।
তবে মেয়ের বয়স এখনও কম।
ডাক্তার রায়হান এ হসপিটালে থেকেই ডাক্তারি পাশ করেছে। বিসিএস রিটেন হয়ে গেছে খুব ভালো ভাবে।
ভাইভাও হয়ে যাবে আশা তার।সম্পর্কে খাদিজা বেগমের ভাসুরের শালীর ছেলে।অর্থাৎ আঁখির চাচাতো ভাইয়ের খালার ছেলে।
মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাবছিলেন তিনি। ফোনটা কানে নিতেই সুরেলা কন্ঠে কেউ বলে ওঠে,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি?’
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।কে বলছেন?’
“আন্টি আমি মিতালী,মুহিনের বোন।’
“কোন মুহিন?’
“জ্বী আঁখির বন্ধু মুহিন।ওরা যে একসাথে এবার সিটি কলেজ থেকে ইন্টার পাশ করলো?’
“ও আচ্ছা। তা কি ব্যাপার মিতালী?এন্ট্রি করাতে হবে?কাউকে দেখাতে চাও?’
“না না আন্টি ওসব কিছু না।আসলে আপনার সাথে আমার জরুরী কিছু আলাপ ছিল।যদি একটু সময় দিতেন?’
“জরুরী আলাপ কি ব্যাপারে মা?আচ্ছা এখন তো আমি ব্যস্ত আমাকে দেড়টার পর ফোন দাও।’
মিতু দেড়টার পর ফোন দিয়ে দেখা করতে চায় খাদিজা বেগমের সাথে।
খাদিজা বেগমের তিনটা পর্যন্ত ডিউটি।
তিনটার পরই আসতে বলে মিতুকে তার বাসায়।
মিতালী আঁখির কাছ থেকে আগেই তার মায়ের ফোন নাম্বার আর ঠিকানা নিয়ে রেখেছিল।
আঁখিদের বাসা লালমাটিয়ায়।মিতালী ঠিকানা মোতাবেক পৌঁছে যায়।
নীচতলা অনেকগুলো কলোনির মতো বাসা প্রায় একসাথে।সেখানে একটি বাসায় ঠিকানা অনুযায়ী ঢুকে গেইটে বাড়ি দেয় মিতু।
মিতু যখন আসে তখন বিকেল চারটা বেজে গেছে।
ভেতর থেকে ১৬/১৭ বছর বয়সী একটি মেয়ে দরজা খোলে।
প্রায় আঁখির মতোই দেখতে।
ছিমছাম পরিষ্কার গোছানো ঘর,জিনিস তেমন না থাকলেও সবকিছু বেশ পরিপাটি। ঘরে ঢুকে বিছানার একপাশে সোফাটায় বসে।
আঁখির মা এবার আসেন ভেতর থেকে সাথে করে এগারো, বারো বছরের একটি ছেলে।আঁখির ভাই জুনায়েদ।
মাঝ বয়সী হাসিখুশী সাধারন চেহারার মানুষ।
সোফার পাশে ছোট্ট টুলে একটি পারিবারিক ছবি।আঁখির মা খাদিজা বেগমকে অবিকল আঁখির মতো লাগে।সাথে চার ভাইবোন সব ছোট।আর পিচ্চিটা আঁখির মায়ের কোলে।
বাবা বোধহয় অনেক ফরসা হবেন।আঁখির ভাই জুনায়েদ বাবার মতো পরিষ্কার গায়ের রঙ।
মিতু হাত দিয়ে ধরে ছবিটা দেখছিল।
খাদিজা বেগম ঘরে ঢুকতেই ছবিটা রেখে, সালাম জানালো উঠে দাঁড়িয়ে।
ভীষন রকম রোগা আর চোখে চশমা উনার।
হেসে সালামের জবাব দিলেন খাদিজা বেগম।
“তা মা কেমন আছো?আঁখি তো তোমার খুব প্রশংসা করে।’
ভেতর থেকে আঁখির বোন নাস্তাও নিয়ে আসে।
“মিতু আপু চা খাবেন না শরবত দিবো?’
জানতে চায় মেয়েটি।
হাতে বানানো পিঠা আর দই নিয়ে এসেছে সে ।
মিতু ভীষন মুগ্ধ তাদের আতিথিয়তা দেখে।
“বাব্বা তুমি আমার নামও জানো? আর এখুনি ব্যস্ত হয়োনা আমি তো মাত্রই এলাম…? ‘
“আসলে আমি ফোন করে ছবিকে বলে দিয়েছিলাম তুমি আসছো।’ খাদিজা বেগম জানান।
“তাই বুঝি?আঁখি নেই বাসায়?’
“না মা ওতো গ্রামে বিক্রমপুরে,ওর দাদার বাড়িতে গেছে?’
“তাই? কবে গেছে আন্টি?একাই গেছে?’
“ওর বড় চাচা এসে নিয়ে গেছে।না মা লিপিও গেছে।’
“ও আচ্ছা?লিপি কি ছোটটা মানে তিন নাম্বার জন?’
“হ্যা মা….আল্লাহ আমাকে তিনটা মেয়ে দিয়েছেন?’
মিতু এবার অপেক্ষারত ছবির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।ফের বলে
“চা দিতে পারো আপু।’
ছবি চা আনতে চলে যায়।
মিতু বলে ফের,
“আন্টি আপনার মেয়েরা তো ভীষন লক্ষী আর পরী!আর শুধু মেয়ে কই ফুটফুটে ছেলেও তো দিয়েছে? ‘
হাস্যজ্জ্বল জিজ্ঞাসা মিতুর।
“তা দিয়েছে তবে ছেলেটাকে আগে পাঠালে আরও ভালো হতো।মেয়েগুলোকে তো আগে আগে বিদাই দিতে হবে।ছেলেটা বড় থাকলে সংসারটার হাল ধরতে পারতো,সেওও হলোনা ওর ভবিষ্য নিয়ে আমাকে আর ওর বোনদেরকেই ভাবতে হবে এখন।’
মিতু খুব মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে আঁখির মায়ের আর মাথা নীচু করে কি যেনো ভাবে তখন।
“এই দেখো কথা বলেই যাচ্ছি,তুমি তো কিছুই খাচ্ছো না?তা তোমার শরীর কেমন মা?আঁখি বলছিল শরীর থেকে খুব রক্ত গিয়েছিল তোমার আবার শরীরটাও নাকি বেশ দূর্বল ….?মুহিন তো সারাক্ষন তোমার কথা বলে।ও তো এখন আসেই না?’
কথা বলতে বলতে দই এর বাটিটা এগিয়ে দেয় খাদিজা বেগম ঠিক যেন তার মমতাময়ী মায়ের মতো।
“না আন্টি আপনি বলেন।আপনার কথা শুনতেই বেশ ভালো লাগছে।আর আমার শরীর আগের চাইতে অনেক ভালো আন্টি।আঁখি মুহিন যে আমার কথা এতো ভাবে সত্যি আমি ভাগ্যবতী।’
“ভাববেনা?মা চলে যাবার পর তাকে কোলেপিঠে করে তুমিই তো মানুষ করেছো,তোমার বড় বোন কিযেনো নামটা… তার বোধহয় তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়েগেছিলো?আর আঁখি মুহিনের খুব ভালো বন্ধু আসলে মা মেয়েদের মনে মায়ামমতা একটু বেশীই থাকে।আঁখি তো বুঝবেই….?’
“আন্টি আপনার শরীরটা এখন কেমন? আমার মনে হয় আমি এ সময়টা এসে আপনাকে বিরক্ত করে ফেলেছি?আপনার রেস্টের সময় ছিল….।’
“আহা বাছা ওসব নিয়ে ভেবো নাতো?রেস্ট পরেও নেয়া যাবে, তাছাড়া আঁখি,ছবি ওরাই এখন রসুই সামলায়।আমাকে আর তেমন যেতে হয় না….পিঠাটা খেয়ে দেখো আঁখি নিজে বানিয়েছে।’
হাতে বানানো সেমাই পিঠা মুখে দিতেই মিতু বুঝে যায়, আঁখিটার গুনের শেষ নেই,দইটাও নাকি ওই বানিয়েছে।মায়ের সংসার সে গুছিয়ে দেয়,এই বয়সে টিউশনী করে মাকে সাহায্য করে।ভাইবোন গুলোকেও সেই বড় করে তুলছে ঠিক তাদের আরেক মায়ের মতোই।
আঁখির কথা ভেবে হারিয়ে যায় মিতালী কিভাবে ওর কথা বলবে ভাবনায় পড়ে যায়।
“কিছু ভাবছো মা?কি যেনো বলবে বলছিলে?’
“জ্বী আনটি আসলে আঁখির কথাই ভাবছিলাম…. এত লক্ষী একটা মেয়ে! যে ঘরেই যাবে সেই ঘরেরই মুখ উজ্জ্বল করবে আপনার এই মেয়ে!’
“তাই যেনো হয় মা, দোয়া করো তুমি,মেয়েটার বাবা মারা যাবার পর ওর শখ আল্লাদ সেভাবে পূরণ করতে পারিনি।কলেজে আবার অনার্সে ভর্তি হয়েছে।নিজের খরচ নিজে বহন করতে চায়, টিউশনী করে।চাকরী করে আমি যা পাই পুরোটাই বাড়ী ভাড়া আর বাকিগুলির খরচে চলে যায়।আঁখি সেদিনও বল্ল,মা তোমার আর চাকরী করা লাগবে না আমি এখন থেকে তোমার অফিসে যাবো।এর মাঝে আল্লাহ মুখ তুলে চাইলেন। ডাক্তার ছেলে ওকে পছন্দ করে ফেল্লো।’
“ছেলে কোথাকার আনটি?’
“বিক্রমপুরেরই ছেলে, আমার ভাসুরের শালীর ছেলে।খুবই ভালো ছেলে মা।ওর মায়ের স্বপ্ন ছিল ওকে ডাক্তারি পড়াবে।সরকারিগুলোতে যখন চান্স পায়নি আমি তখন আমার হসপিটালে পরীক্ষা দিতে বল্লাম।টিকেও গেল আর খরচাপাতির ব্যাপারে আমি সুপারিশ করেছিলাম তাই তার মা খুব খুশি।আর রায়হান বাবাও আমার মেয়েকে আগে থেকে পছন্দ করতো।বাড়ীতে ওদের অবস্থাও বেশ ভালো।তাছাড়া ছেলেটার বিসিএস হয়ে গেছে ভাইভাটাও হয়ে যাবে আল্লাহ চাইলে।আঁখির জন্যে আর কি চাই?’
মিতুর বুকের মধ্যে একটা শীতল স্রোত বইতে লাগলো।
“একজন মা তার এতীম মেয়ের জন্যে এমন সুপাত্র পেয়েছেন রীতিমতো স্বপ্ন দেখছেন আর এজন্যেই তিনি এতো খুশী আমি কি করে মুহিনের কথা তাকে বলবো?কোন মুখে বলবো স্বার্থপরের মতো?’
“আনটি ডেইট কি ফাইনাল হয়ে গেছে আঁখির বিয়ের?’
“বিয়ে বলতে ছেলের মা,বাবা চাইছে কিছুদিনের ভেতর আকদ করিয়ে দিবে আর উঠিয়ে নিবে ঈদের পর….।কেন মা আঁখির ব্যাপারে এতকিছু জানতে চাইছো?কিছু হয়নি তো? কি যেনো বলবে বল্লে না যে?’
মিতালী কি বলবে বুঝতে পারে না এবার।খুব অস্বত্তিতে পড়ে যায় সে।খাদিজা বেগম সম্পূর্ণভাবে ডাক্তার ছেলের সাথে আঁখির বিয়ে দিবেন বলে মনস্থির করে ফেলেছেন। তাছাড়া এখন সময় ও সুযোগ কোনোটাই নেই, মুহিনের কথা উনাকে জানানোর।একজন মা যতখানি অাবেগী ততখানি বাস্তববাদী তার সন্তানের ভালোর জন্যে তিনি সর্বোচ্চ ভালোটাই করবেন।আর সময়টা এমন নয় যে মুহিন সে পরিমান উপযুক্ত পাত্র। যে নির্দ্বিধায় এমন ডাক্তার সুপাত্র ছেড়ে মুহিনের সাথে তার বিয়ে দেয়ার প্রস্তাবে রাজী হয়ে যাবেন।মিতু শতভাগ নিশ্চিত তিনি এ প্রস্তাব নাকোচ করে দিবেন।সে অধিকার তার পুরোই আছে।
মিতু আর কিছু বলে না এবার।চুপচাপ তার ব্যাগটা খুলে একটা সুন্দর মখমলা লাল রঙা ছোট্ট থলে বের করে।
সেখান থেকে একটা চুড়ীর কৌটা বের করে।
কৌটা খুলে সুন্দর ডিজাইনের ভারী একটা কঙ্কন বের করে।এবার মুখ খোলে সে,
“আনটি দেখুন তো এটা….. কেমন?আঁখিকে মানাবে না?’
“এটা কি মা?আর কেন বলছো এসব?’
মিতু এবার খাদিজা বেগমের হাতটা ধরে অনুনয় জানায়,
“আনটি মিথ্যে বলবো না,আঁখিকে আমি যতদিন দেখেছি মুহিনের জন্যে পছন্দ করে ফেলেছি।তখনও বুঝতে পারিনি আঁখির এত ভালো সমন্ধ আসবে।আমি আসলে এ ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছিলাম।’
“কিন্তু মা ওরা তো অনেক ভালো বন্ধু আর মুহিন তো অনেক ছোট….?’
“ভয় নেই আনটি আপনার মেয়েকে সেই ছেলের সাথেই বিয়ে দিবেন যাকে আপনারা ঠিক করে রেখেছেন।এই কঙ্কনটা আমার মায়ের।পুরো তিন ভরি খাঁটি সোনার।মুহিন প্রায়ই ঠাট্টা করে বলতো আপু তোমার এই কঙ্কনটা আমার অনেক পছন্দের আমার বউকে কিন্তু বানিয়ে দিতে হবে?’
খাদিজা বেগম প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, হাত সরিয়ে ফেলে বাঁধা দেন উনি কঙ্কনটা নিতে।
“তুমি এসব কি বলছো মিতু?এটা তুমি মুহিনের বউ এর জন্যে রেখেছো?তাছাড়া এটা তোমার মায়ের স্মৃতি…..নানা আমি এটা নিতে পারবো না মা আমায় ক্ষমা করো।’ (চলবে)”দ্বিতীয় বাসর’ (গল্প) পর্ব-৯৫
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
ঘরে ফিরে এসে আলমারিটা খোলে মিতু।
গোপন লকারটা খোলে এরপর গয়নার বাক্সটা বের করে।
যদিও বিয়ের সমস্ত গহনা এখনও তার স্বামীর ঘরেই নির্দিষ্ট স্থানে তুলে রাখা আছে।সেজন্য তেমন আফসোস হয় না তার।বাসাটা খালি পড়ে আছে আর ওগুলো কি অবস্থায় আছে সেতারা আশংকা করে।
“আমার আসল অলংকার যে মানুষটা তাকেই বারবার হারিয়ে ফেলি আর গয়না দিয়ে আমি কি করবো…?’
মনে মনে বড় কাতরতা মিতালীর।
গয়নার বাক্সটা খুলে সেই কঙ্কনটা তুলে রাখে।
তার মায়ের বড় প্রিয় ছিল এই কঙ্কন জোড়া।একটি আজ আঁখিকে দিতে গিয়েছিল।
লাল মখমলের থলেটাও তার মায়ের।
কঙ্কনটা রাখতে গিয়ে ভাবে মিতু,মুগ্ধ হয় আঁখির মায়ের সরলতাময় ব্যক্তিত্বে।
মিতু কঙ্কনটা তাকে নিতে সাধলে কিছুতেই রাজী হয় না খাদিজা বেগম ।
মিতু বলেছিল,
“আমি জানি আনটি এভাবে কঙ্কণটা দিলে আপনি নিতে চাইবেন না?তবে সত্যি আজ একটা কথা বলি, যেদিন থেকে আঁখিকে আমি মুহিনের জন্যে পছন্দ করে ফেলেছি সেদিন থেকে মনে মনে এ কঙ্কনটা আপনার মেয়ের জন্যেই ঠিক করে রেখেছিলাম….।’
“মা মিতু এটা তোমার উদারতা আর আমার মেয়ে আসলেও ভাগ্যবতী যে তুমি তাকে এতো স্নেহ করো।তবু এটা আমি কিছুতেই নিতে পারবো না মা।আঁখি মুহিনের বিয়ে না হলেও মুহিনের একদিন বিয়ে হবে।আর তুমি মুহিনের বউ এর জন্যেই এই কঙ্কনটা রেখে দিয়েছিলে।আমি কেমন করে সেটা নেবো?আর তাছাড়া এটা তোমার মায়ের স্মৃতি সেখানে তুমি,তোমার বোন অথবা মুহিনের যে বউ হবে তার অধিকারই বেশি…তুমি রেখে দাও মা এটা তোমাদের জিনিস।’
“ঠিক আছে আনটি আমি আর জোর করবো না….তবে…’
এবার মিতু নিজের কানে পড়া ঝুমকো জোড়া খুলে দেয়।
বারো আনা স্বর্নের, তিন তাকের মাঝারি থেকে একটু ছোট ঝুমকো সদৃশ দুল জোড়া খাদিজা বেগমের হাতে তুলে দেয়।
“দেখুন আনটি এটা অন্তত নিতে না করবেন না।মুহিনের সাথে ওর নাইবা হলো বিয়ে,আমি কি ওর বড় বোনের মতো নই,প্লিজ এটা রাখুন।’
মিতুর বারবার অনুনয় দেখে খাদিজা বেগম বিস্মিত হয়ে পড়েন।
কানের দুল জোড়া মিতু তার বিয়েতে উপহার হিসেবে পেয়েছিল।ঘরেই পড়তো।আঁখি একবার তাকে বলেছিল দুল জোড়া খুব সুন্দর।
এবার সযতনে কঙ্কনটা জায়গামতো রেখে বেগে ভরে চলে যাবার জন্যে প্রস্তুতি নেয়।
যাবার বেলায় খাদিজা বেগম মিতুর কপালে আলতো করে চুমু খায় মমতাময়ী মায়ের মতোন।
“মা গো আল্লাহ তোমায় কোন মাটি দিয়ে বানিয়েছে? এত মায়া তোমার অন্তরে…! আমায় ক্ষমা করে দিও মা আমি মুহিন আর তোমার জন্যে কিছু করতে পারলাম না…।’
দুজনের গলার সুর ভারী হয়ে আসে আবেগপূর্ণ মুহুর্তে।
“মা কি কখনও মেয়ের কাছে ক্ষমা চায়?আনটি আমার হৃদয়ে আজ যে মায়া দেখছেন সেও আপনার আর আঁখির কারনে।আমার বিয়ে হয়ে যাবার পর, আর আমি যখন অসুস্থ আব্বুর বাসায় পড়ে আছি আঁখি প্রতিবার আমার খোঁজ নিয়েছে।আমাদের জন্য মজার মজার খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন আপনি আঁখিকে দিয়ে।
মায়ের স্নেহ হারিয়েছি সে তো সেই কবে…?আর আজ আমায় এভাবে চুমু খেলেন নিজের মেয়ের মতো করে।
জানি না আবার এমন করে মায়ের মমতা পাবো কি না…?’
“এভাবে বলো না মা?কেন পাবে না?আজ থেকে আমার চারটা মেয়ে…. আর শুনো আকদ ও বিয়েতে কিন্তু তোমার থাকা চাই মা।বড় বোন যখন বলেছো তুমি সবসময় আঁখির অনুষ্ঠান গুলোতে থাকবে….।’
আঁখির আকদে থাকা হলো না মিতালীর।
মিতালী দিনাজপুর যাবার আগে খাদিজা বেগমকে ফোনে জানিয়ে দেয় যে তার শ্বশুরবাড়িতে অনেক বিপদ তাকে যেতে হবে।
সিনজি থেকে রেলষ্টেশনে আসা অব্দি এসব কথাই ভাবছিল মিতু।
খাদিজা বেগমকে এও জানিয়ে আসে,যে সে আঁখির বাসায় গিয়েছিল এটা যেন আঁখি আর মুহিন এখন না জানতে পারে।তাতে করে দুজনে আবার ইমোশনাল হয়ে যাবে,নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে….যেটা সফল হবার আর কোন পথ নেই এখন।
মুহিনকে আমসত্ত্ব আনতে পাঠিয়ে মিতু ট্রেনের জানালার ধারে বসে থাকে।সিএনজি চালু করার কিছু পর থেকেই ওর কেমন যেন লাগছিল।সাধারনত যাত্রাপথে ওর কোনো বমী হয়ে যাবার ঘটনা আজ পর্যন্ত হয়নি।শুধু হয়েছিল তখনই যখন সে প্রথমবারের মতো অন্তসত্ত্বা।কিন্তু এখন কেন এমন হবে?
তাই ব্যাপারটা তার মনের ভুল ভেবে আর আমলেও নেয়নি।
অবশেষে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারেনা মিতু।
ট্রেনের জানালা থেকে মাথাটা বাড়িয়ে গলগল করে বমী করতে থাকে সে।রশিদ চাচা ততক্ষনে উঠে এসেছে কামরায়।
“কি হয়েছে মা মিতু?’বলে রশিদ চাচা।
মুহিন আমসত্ত্ব কেনার সময়ই টের পায় মিতু জানালা দিয়ে অনর্গল বমী করছে।
তাড়াতাড়ি আমসত্ত্বের প্যাকেটটা নিয়ে টাকাটা কোনমতে দিয়ে দৌড়ে যায় বোনের কাছে।
“কি হয়েছে আপু?এত বমী করছো কেন শরীর খারাপ হলো নাকি?বাসায় ফিরে যাবে?’
মিতু মাথা নাড়ায় একটু চুপ করে ফের বলে,
“আরে না,তেমন কিছু না,বদহজম হয়েছে বোধহয়।’
খাবারের সাথে থাকা পানির বোতলটা এগিয়ে দেয় মুহিন।
“বদহজম হলো কি করে?সকালে কি খেয়েছিলে?’
” গাজরের হালুয়া আর রুটি তোদের সামনেই তো খেলাম।’
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষনে যাত্রাপথে।
মুহিন এবার হাতে পানির একটু দলা করে নিয়ে মিতুর মাথার চাঁদিতে ঘষতে থাকে।
মাথাটা বেশ গরম ওর,তাছাড়া বিন্দু বিন্দু ঘাম মিতুর কপাল জুড়ে।চিন্তায় পড়ে যায় মুহিন।
“আপু ঠিক বলছো তো?আমার কিন্তু চিন্তা হচ্ছে, পরের স্টেশনে কিন্তু নেমে যেতে পারি চাইলে।’
“আহা মুহিন তোর সবটাতেই শুধু বাড়াবাড়ি? তুই নেমে যেতে চাইলে নেমে যা পরের স্টেশনে…..।’
বেশ রেগে যায় এবার মিতু মুহিনের কথায়।রশিদ চাচা হাত দিয়ে আভাস দেয় আর কোনো কথা না বাড়াতে।
অবশেষে পৌঁছে যায় মিতু তার নির্দিষ্ট গন্তব্যে।
ট্রেন থেকে নামার পর মিতু এপাশ ওপাশ তাকিয়ে একগাল হেসে নেয়।
ওর বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে যেন,
মনে হচ্ছে এই শহরটা তার কতো চেনা আর কিছুদূর পার হলেই পৌঁছে যাবে তার আসল গন্তব্যে, প্রিয় কিছু মানুষের খুব সানিধ্যে? বড় আশা মিতালীর দুচোখ জুড়ে….।(চলবে)”দ্বিতীয় বাসর'(গল্প),পর্ব-৯৬
হাসিনা সাঈদ মুক্তা
অতঃপর নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যায় মিতালী তার ভাই মুহিন ও রশিদ চাচাকে নিয়ে।
ঢাকা থেকে দিনাজপুর ট্রেনযোগে সাত আট ঘন্টা লেগে গেছে।সেখান থেকে পার্বতীপুর আসলো তারা অটোতে করে।
পৌঁছাতে গিয়ে প্রায় রাত।এর ভিতর রানুকে ফোন করে করে দিকনির্দেশিত হয়েছিল।
নিজের শ্বশুরবাড়ী দেখে মুগ্ধ মিতালী।
পার্বতীপুরের নির্জন গাঁয়ে বেশ বড়সড় টিনের চালা দিয়ে নির্মিত অনেকটায় রাজকীয় ব্যাপারস্যাপার মনে হয় বন্ধনের দাদা বাড়ী।
আর তার কাছেই বন্ধনের নানা বাড়ী।
মিতালী আসছে শুনে নানু সকাল থেকেই এখানে অপেক্ষা করেছিল।
মিতু আর সবার পায়ের আওয়াজ পেয়েই রানু দৌড়ে চলে আসে।
হঠাৎ আবারও মিতালীর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে।
উঠোনের পাশ দিয়ে বিশাল নীম গাছটার পাশেই মিতালী বমী করে দেয়।
আর পারে না মিতু ঘুরে পড়ে যায় সাথে সাথে।
রানু তাকে ধরে ফেলে ফের।
“বুবু বুবু….’বলে উতলা হয়ে ওঠে নানু।
মিতু চোখ মেলে তাকিয়ে নানুকে দেখেই জড়িয়ে ধরে।
“কি হইলো তোর মিতু?আইতে না আইতেই ঘুরায়া পড়লি?শরীরটা ঠিক হয় নাই তোর?আর সোনাবরণ গায়ের রঙটা ওমন ময়লা হইলো কেন রে বুবু?এত পাতলা হয়ে কি হইছিস….কি হইসে বলতো? ‘
মিতুর কথাগুলো শুনে বেশ ভালো লাগে।
মনে হলো কতোদিন পর নানু তাকে এভাবে বল্লেন।
মাঝে তো নানু তাকে কতো ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দিয়েছিলেন?সেকথাও ভাবে মিতু।
রানু শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দেয় এবার।
“তুমি ওত ভাইবো না নানু?মিতু মিতু কইরা তো পাগল হয়ে গেসিলা দেখো মিতু ভাবী আসছে এখন সব ঠিক হয়া যাইবো….তাই না ভাবী? ‘
মিতু শুধু “হুম ‘বল্ল।
শরবতটা ওর খেতে ইচ্ছে করে না।প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে তার।
সেই সকালে ট্রেনে উঠে বমী করার পর কিছুই খায়নি।
তারপরও দুপুরের কিছু পরে হট পটে সেতারার রান্না করা খিচুরী মাত্র দুচামচ খেয়েছিল।
একটা ছোট বাটিতে একটু ভেজিটেবল স্যুপ ছিল সেতারা দিয়ে দিয়েছিল মিতুর জন্যে সেটা খেয়েছিল সে যাতে বমী না হয়।তবু হয়ে গেল এখানে এসে।
মিতু বল্ল ফের,
“রানু আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে আমাকে খাবার দাও প্লিজ।’
ঘরে মুরব্বীর মতো এক মহিলা দাঁড়ানো ছিল রানু তার সাথে বেশ গল্প করছিল দেখে নানু এবার রেগে যায়।
“ঐ রানু,মিতু খাবার চাইতেসে কথা কানে যায় না?আর মেহমান যারা আইসে ওরা কই?ওগো কই বসাইছোস?ওগো খাওনের বন্দোবস্ত করছোস?খালি সুযোগ পাইলেই গল্প শুরু কইরা দেস কোনোদিকে কোনো মন নাই ছেমরীর….’
নানু ভীষন রেগে যায় এবার।
“দেখছেন ভাবী? আপনেরে পাইয়া নানু কেমন শুরু করসে?আমার বলে কোনোদিকে মন নাই?আমি সংসার ফালায়া এইখানে পইরা আসি আর বুড়ী….?’
রানুও গাল ফুলিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।
মিতুর খারাপ লাগলো রানুর বলা শেষের কথাগুলো শুনে।
নানুর দিকে তাকিয়ে মিতু খেয়াল করে বেশ শুকিয়ে গেছে নানু,আর ফকফকা গায়ের রঙটাও ফিঁকে হয়ে গেছে তার।
“তুমিও তো শুকিয়ে গেছো নানু?’
“আমার কথা বাদ দে বোইন,তুই নিজে বাঁচ,আমার বাবু সোনারে বাঁচা….’
“কি হয়েছে তোমার বাবু সোনার?কোথায় সে?’
মিতুর ব্যাকুলতা।
“আমার বাবু সোনা কি আর আমার আসে?কত আশা কইরা তোর লগে তার বিয়া দিলাম।ভাবসিলাম কেয়া মইরা যাবার পর তুই ওরে সামলায়া রাখবি,কিন্তু কি হইলো,পোলাডা আজীবন বুকে কষ্ট নিয়াই থাকলো,নিজে তো শান্তি পাইলই না আমাগোরেও শান্তি দিলো না….!’
মিতু নানুর হাতটা চেপে ধরে বলে,
“নানু কি হয়েছে বাবুর?কিসের কষ্ট?আমাকে বল প্লিজ?’
“কি হইসে,কই গেসে হেইডা আমিও জানিনা,তয় আমার কাসে মাফ চায়া গেসে।সেই আবার আগের মতো হয়া গেসে বাবু।কেয়ার মরনটা চোখের সামনে দেইখ্যা যেমন পাগলের মতো হয়া গেসিল,তোর পেটের বাচ্চা পইড়া যাওয়ার পর আর তোর অসুখের পরও আবার ঐরকম হয়া গেসে।আগেরবার বহু কষ্টে তারে আমি সামাল দিসি এইবার আমি আর পারুম না মিতু।আরও আগে কেন আছোস নাই…. তোর সয়ামী তুই বাঁচা এইবার….!’
“আমার ভুল হয়ে গেছে নানু….আমার আরও আগে আসা উচিত ছিল, কিন্তু তুমিই বলো তোমরা কে কোথায় ছিলে তা আমি জানতাম না, কেউ তোমরা আমাকে জানাওনি পর্যন্ত, বলো আমার কি দোষ?’
“তোর কোনো দোষ না বোইন, যা হবার হইসে ওরে তুই খুইজ্যা বাইর কর মিতু,তোর স্বামী,তোর সংসার যা করার সব তোরেই ওখন করা লাগবো….।’
মিতু চুপ হয়ে যায় এবার।
মনে মনে দৃঢ়চিত্তে ভাবে মিতু,
“বাবু এটা কেমন খেলা শুরু করেছেন আপনি?এতদিন পর এতদূর আমি আপনার খোঁজে চলে এসেছি, আপনাকে যে আমার খুঁজে বের করতেই হবে….কিন্তু কিভাবে?’
আজকের তারিখটা খেয়াল করে মিতালী।তিনদিন হয়ে গেছে সে এখানে এসেছে।গতপরশু তার প্রতি মাসের শরীর খারাপের তারিখ ছিল।এখনও কিছু হয়নি।
তাছাড়া হবার আগে কোমড় ব্যাথা একটু আধটু মাথা ব্যাথাও করে তারও কোনো আলামত নেই।আজকাল ভীষনরকম স্মৃতিভ্রম হয়েছে তার কোনোকিছুই আগের মতো মনে রাখতে পারেনা।মিতালী মনে মনে সন্দেহ করে,কিন্তু সন্দেহের কারন কি করে সত্যি হবে ভীষনরকম ভাবনায় পড়ে যায় সে।
তাদের এখানে বাড়ী থেকে ডিসপেনসারি খানিকটা দূরে।
একবার ভাবে রানুকে দিয়ে টেস্ট করানোর জন্য নিয়ে আসবে যেটা তার এখন দরকার।পরে আর সেটা না করে নিজেই সাহস করে কিনে আনে নানুর একটা বোরখা পড়ে কিনে আনে সেটা, যেটা তার দরকার।কেনার পথে মিতালী দেখে এক গ্রাম্যবধু কোলে ফুটফুটে বাচ্চা নিয়ে ভীষন মজা করছে,তাকে কবিতা গেয়ে শোনাচ্ছে।তা দেখে বেশ ভালো লাগে তার।
অজান্তে আবারও তার হাত চলে যায় পেটে।যেখান থেকে সদ্য তার প্রিয় শিশুটিকে সে হারিয়ে ফেলেছে।এতদিন থাকলে সাত মাস হয়ে যেত।
ফের কি যেন ভেবে মনটা তার অস্থির হয়, অজানা সে আশংকায়….?
অতঃপর কিনে আনে মিতু টেস্ট করার জন্যে ফর মাদার স্ট্রাইপ।
ওয়াশরুমের দরজা লাগিয়ে আগেই সরবারহকৃত কৌটায় পরীক্ষা করে এবার।
স্ট্রাইপের পরিবর্তন লক্ষ্য করে মিতু একাগ্রচিত্তে।
চোখের সামনে যা দেখলো তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য।
কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে মিতালীর….
“পজিটিভ! কিন্তু কেমন করে?কি করে সম্ভব এটা…!’ (চলবে)