#দ্বিরাগমন
#পর্ব_১৩
সত্যকে নিয়ে সেদিন রাতে চুরের মতো আমি পালিয়ে এলাম। কমলাপুর রেলস্টেশন এসে একটা চলন্ত ট্রেইনে চড়ে বসলাম। ট্রেইনটা কোথায় যাবে জানা নেই। শীতের রাতে আমি ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছি। ট্রেন চলতে শুরু করলো, ঝক ঝক ঝক ঝকাঝক…
ট্রেইনের যে বগিতে আমি উঠেছি, সেই বগিটা ট্রেইনের নাস্তার বগি। ট্রেইনে কর্মরত কয়েকজন সেখানে নাস্তা রেডি করছে, কেউ ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। পাশে কেউ দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুকছে। আমি আমার মতো পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম।
রাত তখন একটা হবে। আমি জানি না কখন আমি ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। ঘুম ভাঙ্গে আমার মেয়ের কান্নায়। ঠিক কান্নায় নয় মেয়েটা আমার কখন থেকেই নাকি কান্না করে যাচ্ছিলো।আমি ঘুমে ছিলাম। একটা আধবয়সী লোক তার পা দিয়ে আমাকে ঠেলে জাগিয়ে দিলো। আমি হকচকিয়ে উঠলাম। লোকটা কেমন জানি নজরে আমার দিকে তাকালো। তারপর অশ্রাব্য ভাষায় বললো,
“কত লাগবে?”
আমি লজ্জায় চোখ নিচের দিকে নামিয়ে দিলাম। মেয়েটা আমার কোলে। কান্না করেই চলছে।
লোকটা আবার আমাকে ইশারায় ডেকে বললো
“কী? কত চাই?”
আমি উঠে ঘুমটা টেনে সেখান থেকে চলে আসলাম। লোকটা শুনলাম পেছন থেকে বলছে,
“কীরে? কত লাগবে বল?”
কেউ একজন লোকটার সাথে সাথে বলে বসলো,
“মালটা খাসা কিন্তু”
পেছনের লোকজন হুহু করে হেসে উঠলো। আমি বাথরুমের সাইডের কামরায় মাটিতে হেলান দিয়ে বসে গেলাম। আমার মেয়েটার শরীরে অসম্ভব রকমের জ্বর। শরীর মনে হচ্ছে গরমে পুড়ে যাচ্ছে। সকাল থেকে আমি কিছু খাইনি। হঠাৎ দেখলাম “পানি এই পানি লাগবে পানিইইইই….”
বলতে বলতে একটা লোক এগিয়ে এলো। আমার গলা কেমন জানি শুকিয়ে গিয়েছে। আমি লোকটাকে ডাক দিলাম এই বলে,
“এদিকে আসো।”
লোকটা আমার কাছে আসলো। এসেই বলতে শুরু করলো,
“না আমার কাছে বাপু এসব কুকামের কাস্টমার নাই। আমি এসবে ব্যবসা করি না। দালাল লাগবো?”
আমি হতবাকের মতো চেয়ে থাকলাম লোকটার দিকে। তারপর লোকটা তার হাতের ইশারায় সামনের দিকে তাক করে বললো,
“ঝ নাম্বার বগিতে দালাল আছে। হলুদ জাম্পার পরা। তার কাছে যান, ট্রেনের রুমে মস্তি মজা করবার লোক লাগে।”
আমি লোকটাকে কী বলবো খুঁজে পেলাম না। লোকটা আমার এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে আমাকে বললো,
“তয়, আমি করলে পঞ্চাশের বেশি দিতে পারবো না। রাজি হলে পেছন পেছন আসো।”
আমি লোকটাকে বললাম,
“আমার পানি চাই।”
লোকটা আমার কথা শুনে অবাক হলো, হাসলো। তারপর বললো,
“তয় আগে কইবেন না যে আপনের পানি চাই? আমি আরও কী না কি ভাবতে বসছিলাম।”
লোকটা একটা হাফ লিটারের পানির বোতল আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“পঞ্চাশ টাকা”
আমি আমার হাতে থাকা হাজার টাকার নোট লোকটার দিকে এগিয়ে দিলাম। লোকটা বললো,
“না না ভাংতি দেন। আমার কাছে ভাংতি নাই।”
আমি বললাম,
“আমার কাছেও নাই ভাংতি।”
লোকটা বললো,
“তাইলে নোটটা দেন, আমি ভাংতি আইনা দিতাছি।”
আমি লোকটার হাতে হাজার টাকার নোট দিয়ে দিলাম।
পানি খেলাম। মেয়েটার মাথায় হাত দিলাম। জ্বর কিছুটা কমেছে। শীতের রাত, কনকনে ঠান্ডা পড়েছে এখন। শরীর হিম হয়ে আসছে। দরজার পাশে বসে বসে প্রহর গুণছি, কখন সকাল হয়। শুনেছি ট্রেন নাকি সিলেট যাবে। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আমার খুঁজে কেউ সিলেট পর্যন্ত আসতে পারবে না। জীবনে আর যাই করি সেই ঘরমুখো আর আমি হবো না।
আধঘন্টা কেটে গেলো কিন্তু সেই লোকটা যে আমাকে পানি দিয়ে হাজার টাকার নোটের ভাংতি দিবে বলছিলো, সে আর আসলো না। আমার হাতটা খালি। আমার টাকার দরকার এখন।
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। খুঁজতে লাগলাম সেই লোকটাকে। আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম সেই পানিওয়ালা লোকটাকে দেখেছে কী না!
একজন মাঝবয়সী চাচা আমার হুলস্থুল হাঁটাহাঁটি দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“কী হয়েছে মা?”
আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,
“আমার কাছে ভাংতি ছিলো না। লোকটার কাছ থেকে পানি কিনেছিলান হাফ লিটার। বললো পঞ্চাশ টাকা।”
“তারপর…”
“তারপর ভাংতি এনে দিচ্ছে বলে আমার হাজার টাকার নোট নিয়ে গেলো, আর এক ঘন্টা গেলো তবুও তার খোঁজ নাই।”
চাচা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“খোঁজ পাবা না মা। সে টাকা মেরে চলে গিয়েছে। এভাবে ট্রেইনে কাওকে টাকা দিতে নেই।”
চাচা চলে গেলেন। আমি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।মাথায় কোনো কাজ করছিলো না আমি কোথায় যাবো কী করবো, কোথায় করবো!
শুধু এক বুক আশা ছিলো, আমার সত্যকে আমার বড়ো করতেই হবে। যেকোনো ভাবেই হোক সত্যকে মানুষ করতেই হবে।
কিছুক্ষণের পর টিকিট চ্যাকার টিকেট চ্যাক করতে এলো। আমি যে বগির বাথরুমের সাইডে ছিলাম, সেই বগি থেকে সরে এসে এর পরের বগিতে গেলাম। টিকিট চ্যাকার তারপর সেই বগিতে আসলো। আমি কী করবো ভেবে উঠতে পারলাম না। একবার ভাবলাম, যখন টিকিট চ্যাকার আসবে তখন বাথরুমে ঢুকে যাবো। কিন্তু হায়! আমার ভাগ্য আমাকে পক্ষ দিলো না। আমি যখন হুলস্থুল করে বাথরুমে ঢুকতে গিয়েছিলাম তখনই পেছন থেকে টিকিট চ্যাকার আমাকে ডাক দিলো।
“দাঁড়ান”
আমি দাঁড়িয়ে গেলান। জোর করে সত্যকে জড়িয়ে ধরলাম। টিকিট চ্যাকার বললো,
“যেখানে আছেন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকুন আপনি।”
কিছুক্ষণ পর টিকিট চ্যাকার আমার সামনে এলো। আমি তখন দুই বগির মাঝখানে যে বাথরুমের খোলা জায়গা সেখানে দাঁড়িয়ে আছি। টিকিট চ্যাকার আমাকে বললো,
“টিকিট দেখান।”
আমি কোনো জবাব দিলাম না। নিচের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
টিকিট চ্যাকার আমার বললো,
“টিকিট দেখান।”
আমি এবারও কোনো জবাব দিলাম না।টিকিট চ্যাকার বললো,
“কানে যাচ্ছে না কথা?”
আমি তখন আমতা আমতা করে বললাম,
“টিকেট নাই স্যার।”
“হুয়াট? নাই?”
“না।”
“আপনি জানেন না টিকেট ছাড়া ট্রেইনে উঠা বেয়াইনি?”
আমি মিনমিন করে জবাব দিলাম,
“হ্যাঁ স্যার।”
“তাহলে আপনি উঠেছেন কেনো?”
আমি কান্না শুরু করে দিলাম। টিকিট চ্যাকার ধমক দিয়ে বললো,
“কান্না করলে হবে না। ইউ আর রঙ এন্ড ইটস ইউর মিস্টেক। ইউ সুড বি আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যট”
আমি বললাম,
“আমার ভুল হয়ে গিয়েছে।”
টিকিট চ্যাকার বললো,
“না না। এভাবে বললে তো হবে না। ফাইন দিতে হবে।”
আমি নিরুপায় হয়ে বললাম,
“আমার কাছে কোনো টাকা নেই।”
টিকিট চ্যাকার হুহু করে আসলো। আমার হুমকির সুরে বললো,
“রেলওয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিতে হবে। নাহলে তোর মতো চুরের শাস্তি হবে না।”
লজ্জায় যেনো আমার মাথা হেট হয়ে আসছিলো। ট্রেইনে উঠার আগে টিকিট করতে হবে এইটা আমার মাথায় ছিলো না। চলন্ত ট্রেইনে আমি আমার সত্যকে নিয়ে উঠে পড়ি সেই সময়। টিকিট চ্যাকারের সাথে থাকা ট্রেইনের কর্মরত একজন লোক আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো,
“রেলওয়ে পুলিশের কাছে যাওয়ার চেয়ে স্যারের সাথে চলে আসেন। তারাও একই কাজ করবে।।এরচেয়ে বরং দুজনেই মস্তি করলেন। হা হা হা।”
আমি ভয় পেয়ে গেলাম লোকটার কথায়। টিকিট চ্যাকার আমার সত্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ইশারায় আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“কী হবে?”
তারপর দেখলাম তারা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে তামাটে দাঁত বের করে হাসছে। আমি চরম মাত্রায় ভয় পেয়ে গেলাম। মধ্যরাতের ট্রেইনে আমি একা আর আমার সত্য, কেউ পাশে নেই আমাদের। লোকটা আবার আমাকে বললো,
“কী হবে?”
আমি ভয় পেয়ে গেলাম। টিকিট চ্যাকার তেড়ে এসে বললো,
“এই, এই চুরকে পুলিশের হাতে তুলে দাও।”
পাশে থাকা লোকটা আমাকে বললো,
“পুলিশও একই কাজ করবে। তারচেয়ে স্যারের সাথে চলুন।”
টিকিট চ্যাকার আবার হাক পেড়ে বললো,
“ওকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে ফেলো।”
লোকটা আমাকে ইশারায় তার বুড়ি আঙুল আর তর্জনি আঙুল এক করে ইশারায় টাকার মতো করে বললো,
“পাবেন। সমস্যা হবে না।”
সত্য আমার কোলে কান্না করে উঠলো। অস্থিরতা আমাকে গ্রাস করলো। চলন্ত ট্রেইনের দরজা খোলা। ইচ্ছে হচ্ছে, চলন্ত ট্রেইনের নিচে ঝাপ দিয়ে দেই। চিন্তা হলো সত্যকে নিয়ে। ট্রেইনে ফেলে যাবো তাকে? নাকি একসাথে মা মেয়ে দুজনেই চিরতরে চলে যাবো এই ধরাধাম থেকে। মরতেও রাজি, তবে শরীর আমি বিসর্জন দিবো না। হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করো। তোমার দেয়া জীবন আর আমি রাখতে পারলাম না….
দ্বিরাগমন
মিনহাদ আহমেদ
পর্ব_১৪
আমি ট্রেইন থেকে ঝাপ দিবো দিবো এমন সময় কেউ একজন টিকিট চ্যাকারকে বললেন,
“ফাইন কত টাকা দিতে হবে?”
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। সেই বৃদ্ধ চাচা যিনি আমাকে বলেছিলেন, “পানি ওয়ালা লোকটা আমার টাকা মেরে চলে গিয়েছে”
টিকিট চ্যাকার চাচাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কে আপনি?”
চাচা বললেন,
“আমি যেই হই না কেনো, আপনাদের ফাইন কত দিতে হবে বলুন সেইটা।”
টিকিট চ্যাকার বললো,
“লিগ্যাল গার্জিয়ান আপনি না। তাহলে আপনি এখানে জড়াচ্ছেন কেনো?”
বৃদ্ধ চাচা এবার কড়া সুরে বললেন,
“আপনাকে যা জিজ্ঞেস করেছি সরাসরি এইটার উত্তর দিবেন?”
টিকিট চ্যাকার জোর গলায় বললো,
” আপনার কথাকে সংযত রাখুন আর এখান থেকে চলে যান এইটা আমার আর এই মেয়ের ভেতরকার ব্যাপার।”
“না কখনোই না। আপনি টিকিট চ্যাকার আর মেয়েটা যাত্রী। আমিও যাত্রী যাত্রী যাত্রীর ভেতরকার ব্যাপার হয়তো মানা যায়, তবে টিকিট চ্যাকার আর আর যাত্রীর ভেতরকার ব্যাপার মানা যায় না।”
আমি ঠায়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আল্লাহকে স্মরণ করতে লাগলাম। আমার সত্যের মাথায় জ্বর এখন আরও বেড়েছে। টিকিট চ্যাকারের সাথে থাকা লোকটা তার তামাটে দাঁত বের করে চাচাকে বললো,
“আপনাকেও ভাগ দিতে হবে নাকি? শক্তি আছে? খাড়ায়?”
অশ্রাব্য এই কথাটা শুনে আমি আমার হাত আমার কানে চেপে ধরি। বৃদ্ধ চাচা সেই লোকটার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসালেন। লোকটাকে বললেন,
“বেয়াদব আমি তোর বাপের বয়সী।”
লোকটা হেসে হেসে অবলীলায় বললো,
“তাতে কী? বাপ করে না বুঝি?”
লোকটার সাথে টিকিট চ্যাকার ও হেসে উঠলো। বৃদ্ধ চাচা দেখলাম উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছে। তার শরীর কাঁপছে। আমি তাকে এগিয়ে গিয়ে ধরলাম। বললাম,
“আপনি শান্ত হোন।”
উনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“মারে আমি সব শুনেছি। এরা নিজেও তো কোনো মায়ের পেট থেকে দুনিয়ায় এসেছে। এরা অন্য মেয়েদের নিয়ে এরকম চিন্তা করে কীভাবে?”
টিকিট চ্যাকার বললো,
“হয়েছে হয়েছে।”
তারপর হুট করে এসে আমার হাতে ধরে বললো,
“চলো সুন্দরি। আজ বাসর হবে আমাদের।”
চাচা সেই টিকিট চ্যাকারের হাত থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,
“এতো বড়ো সাহস? আমার মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে ধরেছো?”
টিকিট চ্যাকার আবার হাসলো। বললো
“মেয়ে?”
চাচা বললেন,
“হ্যাঁ।”
“হু হু হু। তাহলে দশ হাজার টাকা দাও, আমি অন্য মেয়ে খুঁজি ট্রেইনে। তুমি তোমার মেয়ে নিয়ে চলে যাও।”
চাচা দেখলাম আর কোনো কথা বাড়ালেন না। টিকিট চ্যাকারের হাতে দশ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে আমার হাত ধরে বললেন,
“চলো মা।”
টিকিট চ্যাকারের সাথে থাকা লোকটা পেছন থেকে বললো,
“তোকে দশ হাজারে কিনে নিয়েছে। তুই বুঝলি না।”
আমি আরেক উৎকন্ঠায় পড়ে গেলাম। লোকটা কী বললো এসব? বৃদ্ধ চাচার মনে কি এরকম কোনো মতলব আছে?
উনি সামনে এগিয়ে চললেন। আমি পেছন পেছন যাচ্ছি যাবো বলে আমার হাঁটার গতি কমিয়ে নিচ্ছিলাম। উনি পেছন ফিরে তাকিয়ে বললেন
“কী হলো? হাঁটছো না কেনো?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
“আসছি।”
একবার ভাবলাম উনি কেনো আমাকে বাঁচাতে গেলেন? আমি নাহয় ট্রেনের নিচে ঝাপ দিয়ে মরতাম। তবুও ভালো ছিলো আমার জন্য।
উনি আবার হাক দিয়ে বললেন,
“কোনো সমস্যা মা?”
এবার আমি যেনো স্বস্তি খুঁজে পেলাম। আমাকে মা বলে সম্বোধন করছেন। হয়তোবা উনি আমাকে নিজের মেয়ের মতো ভাবছেন। উনাকে সন্দেহ করা আমার ঠিক হবে না হয়তো।
পরক্ষণে আবার চিন্তা এলো, এভাবে অজানা অপরিচিত একজন লোক কেনো আমাকে বাঁচাবে? কেনো আমার জন্য দশ হাজার টাকার লোকসান করবে? নিশ্চয়ই কোনো স্বার্থ আছে এর মধ্যে!
শীতের মধ্যরাতে শীত ঝেপে পড়েছে অথচ আমি ঘামছি। আমার দিকে আবার পেছন ফিরে তাকালেন উনি। এবার আমাকে জিজ্ঞেস করেই বসলেন,
“তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছো?”
আমি সাথে সাথেই জবাব দিলাম,
“না না। ভয় পাবো কেনো।”
আমার মুখে নিয়ে আসলাম কৃত্রিম হাসি। উনিও হাসি দিলেন। বললেন,
“চলো।”
একটা বগির পর অন্য একটা বগি, হেঁটেই চলছি। হঠাৎ আমি সেই লোকটাকে দেখতে পেলাম যেই লোকটা আমার হাজার টাকার নোট মেরে ভাংতি এনে দিবে বলেছিলো, কিন্তু মেরে চলে গিয়েছিলো আর এদিকে আসেনি। আমি লোকটাকে দেখতেই বলে উঠলাম,
“এই সেই লোকটা, এই সেই লোক আমার এক হাজার টাকার ভাংতি এনে দিবে বলে পালিয়েছিলো।”
লোকটা আমাকে দেখেই উলটো পথ হাঁটতে শুরু করলো। চাচা পেছন ফিরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন
“এই সেই লোক?”
আমি বললাম,
“হ্যাঁ হ্যাঁ।”
চাচা সাথে সাথে লম্বা পায়ে হেঁটে লোকটাকে পাকড়াও করলেন। অবশ্য পাকড়াও করা সম্ভব হতো না যদি না সামনের বগির দরজা লাগানো থাকতো। থাবা মারলেন লোকটার ঘাড়ে। লোকটা কাছুমাছু হয়ে বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দিন, আমার ঘরে আমার দুধের মেয়ে আছে। মা, মেয়েটাকে জন্ম দিয়েই মরে গেছে, মেয়েটা দুধের জ্বালায় কাদে রোজ রোজ।”
চাচা গরম গলায় লোকটাকে বললেন,
“তাই বলে চুরির টাকা দিয়ে বাচ্চা খাওয়াবা?”
লোকটা চাচার পায়ে পড়ে গেলো। চাচা লোকটাকে তুললেন। গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললেন,
“চুরির টাকা মাসুম মেয়েটাকে খাওয়াতে পারবা?”
লোকটা মাথা নিচু করে কান্না করতে লাগলো। নাসিক্য তার বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। কান্না জর্জরিত গলায় বললো,
“আমি যে বাপ, দুনিয়া মারে নিয়া নিলেও আমি আমার মেয়েটাকে ছাড়তে পারবো না।”
আমার চোখে তখন পানি টলমল। আমার সালমানের ও তো একটা মেয়ে হয়েছে। মেয়ে বাচ্চার বাপ হয়েছে সে। অথচ সে কী অবলীলায় তার মেয়েকে অস্বীকার করে চলছে। এই অস্বীকার করার মধ্যে কারণ একটা, আমার সত্য মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে। এই হওয়াটা যেনো ওর অপরাধ। আর এদিকে আরেকটা বাবা তার মেয়ের জন্য চুরি পর্যন্ত করছে। যদিও তার পথটা খারাপ, তবে উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো খারাপি আমি দেখি না।
চাচা লোকটাকে বললেন,
“কখনো চুরি করবা না।”
তারপর লোকটার কাছ থেকে সেই হাজার টাকার নোট নিয়ে এসে আমার হাতে ধরিয়ে দেন। আমি বললাম
“লোকটার ঘরে বাচ্চা আছে। সে নিয়ে নিক টাকাটা।”
চাচা বললেন,
“বাচ্চা তো তোমার কোলেও আছে।”
এই বলে আমার হাতে টাকা গুজে দিলেন। তারপর উনি আমার সামনে তার পকেট থেকে টাকা বের করে লোকটার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি দেখলাম, সেখানে হাজার টাকার দুইটা কিংবা তিনটা নোট হবে। টাকা ধরিয়ে দিয়ে চাচা লোকটাকে বললেন,
“মেয়ের দুধ কিনে নিয়ে যাবা। আর সদ্য জন্মজাত বাচ্চার জন্য বাইরের দুধ ভালো না। তবুও অল্প করে খাওয়াবা। কেমন?”
লোকটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে কান্না করে দিলো। চাচার হাত ধরে কান্না করতে করতে বললো,
“আপনি মানুষ না আব্বা আপনি ফিরিশতা। আমার মেয়ের জন্য আল্লাহ আপনাকে ফিরিশতা রূপে পাঠিয়েছেন।”
চাচা বললেন,
“আজেবাজে বকো না। আর যাই করবা সরল সহজ পথে করবা আজীবন।”
লোকটা মাথায় তার ঠান্ডা পানির ঝুলা উঠিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে।
তারপর চাচা সামনে চললেন। আমিও চললাম উনার পিছুপিছু। উনি ট্রেইনের তিনটা বগি পার হয়ে আমাকে নিয়ে চললেন কেভিনের ওদিকে। একটা কেভিনের দরজা খুলে আমাকে বললেন,
“ঢুকো।”
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
“এখানে?”
উনার চোখ আমার কাছে কেমন জানি লাগলো। উনি গলা উচিয়ে বললেন,
“আমি ঢুকতে বলেছি না? ঢুকো।”
আমি বললাম,
“কেনো?”
উনি আবার কড়া গলায় বললেন,
“যা বলেছি তাই করো।”
উনার কথা শুনে একটা লোক এই মধ্যরাতে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু হয়েছে?”
চাচা লোকটাকেও কড়া গলায় বললেন,
“ম্যানার জানেন না? এইটা রিজার্ভ কেভিন আপনি এদিকে আসলেন কেনো?”
লোকটা “আই এম সরি” বলে চলে গেলো। চাচা একটা সিগারেট ধরালেন। আমাকে বললেন,
“ঢুকো আমি আসছি এইটা খেয়ে।”
আমি মুহূর্তেই যেনো অবাক হলাম। কী করবো ভেবে উঠতে পারছিলান না। ইঞ্জিনের শব্দ কেভিনের এদিকে বেশি জোরে হয়। আওয়াজ করলেও কেউ শুনতে পারবে না।
কাঁপতে কাঁপতে কেভিনে ঢুকলাম। সত্যের মাথায় হাত রেখে আল্লাহকে বললাম,
“খোদা আমার সাথে যদি ভুল কোনোকিছু হয়, তাহলে আমাকে বাঁচিয়ে রেখো না। আমি বাঁচতে চাই না। লোকটা আমার বাবার বয়সী। তাকে আমি বিশ্বাস করে এসেছি। আমার বিশ্বাসের ক্ষত ধরিয়ে দিও না মালিক। আমাকে রক্ষা করো।”
কিছুক্ষণ পর বৃদ্ধ চাচা কেভিনে এলেন। বিছানায় রাখা ব্যাগ থেকে একটা নতুন শাড়ি বের করে বললেন,
“এইটা পরে নাও এখন।”
আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম। আর বারবার আমার কানে ধ্বনিত হতে লাগলো টিকিট চ্যাকারের সাথে থাকা সেই লোকটার কথা, সেই লোকটা পেছন থেকে বলেছিলো,
“লোকটা আমাকে উদ্ধার করে না, দশ হাজার টাকা দিয়ে কিনে নিতে এসেছে।”
মুহূর্তেই আমার চোখ দিয়ে কান্না চলে আসলো।
#দ্বিরাগমন
#পর্ব_১৫
বৃদ্ধ চাচা আমাকে আবার বললেন,
“শাড়িটা পরে নাও। তোমার শাড়িতে ময়লা লেগে আছে।”
আমি থরথর করে কেঁপে উঠলাম। কান্না জর্জরিত চোখ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কি.. কি…কি….ন…ন্তু কেনো?”
“পরতে বলেছি পরো। আমি বাইরে আছি। তুমি ঘুমিয়ে যেও।”
আমি অবাক হলাম ওনার কথায়। বাইরে আছি এর মানেটা বুঝলাম না। আমি কাঁপতে থাকলাম। চাচা আমার চোখের সামনে কেভিন থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আমি রুমের কোণে বসে কান্না করতে লাগলাম। সত্য ঘুমিয়ে গিয়েছে। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি।
আমার যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন ভোর ছয়টা হবে। চাচা রুমে চা নিয়ে এসে ঢুকলেন। আমাকে জাগিয়ে তুললেন। ডাকলেন,
“মা উঠো ঘুম থেকে। সকাল হয়ে গিয়েছে।”
আমি হকচকিয়ে গেলাম। উনি যে শাড়িটা আমাকে পরতে বলেছিলেন সেই শাড়িটা পাশেই মাটিতে পড়ে আছেন। চাচা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কাপড় চেইঞ্জ করলা না যে। ভয় পেয়েছিলা রাতে?”
আমি কোনো কথা বললাম না। আমার উত্তর না শুনেই চাচা হাসি বললেন,
“মা রে আজকালকার দিনে বিশ্বাস জিনিসটার মূল্য অনেক। লোকে সেই বিশ্বাস রাখতে জানে না। আমি জানি তুমি আমাকে ভয় পেয়েছিলা কাল রাতে। শাড়িটা আমার বউয়ের জন্য। মেয়ের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ঢাকা যাত্রাবাড়ী। মেয়ে তার মাকে দিয়েছে এইটা নিয়ে দেওয়ার জন্য তোমার কাপড় নোংড়া আর শীতের রাত, ভাবলাম তাতের শাড়ি আছে গায়ে দিলে শীত কিছুটা নিবারণ হবে।”
আমি চাচার কথা শুনে তার চোখে চোখ তুলে তাকাবার সাহস হারিয়ে ফেললাম। চাচা আমার দিকে প্লাস্টিকের একটা ওয়ান টাইম কাপ ভর্তি চা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“খাও।”
আমি কাছুমাছু হয়ে কাপটা হাতে নিলাম। চাচা বলতে লাগলেন,
“সারাটা রাত আমি বাইরে ছিলাম। একবার ভেবেছি রুমে এসে ঘুমাবো তবে আসিনি। ভাবলাম বিশ্বাস অর্জন করে নেই আগে। আর তুমিতো আমার মেয়ের বয়সী।”
আমি কান্না করতে করতে বললাম,
“আমার বাবা নেই আমি আপনাকে বাবা বলে ডাকতে পারি বাবা?”
চাচা হেসে উঠলেন। মুখ ভরে আমাকে বললেন,
“তুইতো আমার মেয়ে রে পাগলি। আর তোর কুলে আমার নাতনী। কী সুন্দর ফুটফুটে নাতনি হয়েছে আমার।”
এই বলে উনি আমার মেয়েকে তার হাতে তুলে নিলেন। ঝাকি দিতে দিতে বললেন,
“কী নাম রেখেছিস আমার নাতনির?”
আমি বললাম,
“সত্য”
“সত্য?”
“হ্যাঁ বাবা সত্য।”
“নামটা আমার পছন্দ হয়েছে। সত্য তার নিজের প্রতিভা দিয়ে সত্যের মতো চিরস্থায়ী হোক। এই দোয়া করি।”
আমি উনার পায়ে ধরে বসলাম। কান্না করে বললাম,
“আমাকে ক্ষমা করে দেন বাবা আমি বুঝিনি।”
উনি আমাকে তুলে ধরলেন। ধমক দিয়ে বললেন,
“চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। আগে চা খাও।”
আমি চায়ের কাপ হাতে নিলাম। বাবা চা খেতে খেতে আমাকে বললেন,
“মারে এইযে তুই আমাকে বাবা বলে ডেকেছিস, তখন আর তোর উপর আমার কোনো রাগ থাকতে পারে? পৃথিবীর সবচাইতে বেশি সৌভাগ্যবান কারা জানিস?”
আমি বললাম,
“কারা?”
“মেয়ের বাবারা।”
আমি অবাক হলাম উনার কথায়। জিজ্ঞেস করলাম,
“তাহলে ছেলের বাবারা?”
“হতভাগা রে মা। ছেলের বাবারা হতভাগা।”
আমি খেয়াল করলাম উনার চোখ দিয়ে কান্না চলে এসেছে। আমি বললাম,
“কান্না করছেন যে?”
উনি বললেন,
“এইযে আমি ছেলের বাবা তাই। আজ আমার মেয়ে থাকলে হয়তোবা আমার এই কান্না করা লাগতো না।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“কী হয়েছে আপনার?”
“তিনটা ছেলে আর একটা মেয়ের বাবা আমি। আমার গার্মেন্টস, বাসা বাড়ি সব বিক্রি করে ছেলেরা দেশের বাইরে পাড়ি জমিয়েছে। বিয়ে করেছে, বাচ্চা হয়েছে। তাদের নিয়ে সুখে আছে। কিন্তু অভাগা বাবা মায়ের খবর রাখে ওরা? রাখে না। একমাত্র মেয়ে ঢাকায় বিয়ে দিয়েছি। সেই মেয়ে উত্তরাধিকার সুত্রে যে বাসা পেয়েছে, আজ আমি সেই বাসায় আছি। মেয়ে আমার অসহায়ত্ব দেখে বাসাটা আমার নামে লিখে দিয়েছে। বাসা ভাড়া দিয়ে চলি আলহামদুলিল্লাহ। তাই বলি রে মা, ছেলের বাবাদের সুখ নাই সুখ হলো মেয়ের বাবাদের।”
বাবার কথা শুনে আমি অবাক হলাম। মনে মনে ভাবলাম, কেউ কেউ মেয়ের বাবা হতে চায় আর আমার অভাগা সত্যের বাবা, মেয়ের বাবা হতে চায় না। বাবা আমার আকস্মিক চুপ হয়ে যাওয়া দেখে জিজ্ঞেস করলেন
“কী হয়েছে? চুপ কেনো?”
আমি বললাম,
“এমনিই।”
বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় যাবা?”
আমি বললাম,
“জানি না। কোথায় যাবো কিচ্ছু জানি না। শুধু জানি আমার সত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এই বাঁচানোর সংগ্রামে আমাকে একাই হাঁটতে হবে।”
তারপর সব ঘটনা বাবাকে খুলে বললাম। উনি শুনলেন। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ ট্রেইন এসে সিলেট রেলস্টেশন থামলো। সবাই নামছে একে একে। বাবা আমাকে বললেন,
“নেমে যাও, স্টেশনে এসে গেছি।”
আমি সত্যকে কুলে নিয়ে নামলাম। ফাকা স্টেশনে আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। কোথায় যাবো জানি না। বাবাকে সালাম দিলাম। উনি দোয়া করলেন। বললেন,
“আল্লাহ তোর ভালো করুক মা।”
এদিকে ঢাকায় নুপুরের শাশুড়ির জ্ঞান ফিরেছে। বাসায় এসে সুলতানা চিঠি পড়ে জ্ঞান হারিয়েছে। সালমান বলেছে, “ভালোই হয়েছে। সে গেছে তো আপদ থেকে মুক্তি পেয়েছি।”
সালমানের এসব কথা সুলতানা আর সহ্য করতে পারলো না। সালমানকে বললো,
“বাসা থেকে বের হয়ে যাও তুমি।”
সালমান সুলতানার কথা শুনে সুলতানার চুল ধরে সুলতানাকে মারতে লাগলো। অসুস্থ শাশুড়ি এসে সুলতানার মুখে থু থু ফেলে বললেন,
“মুখপুড়া, এখনও এই ঘরে বসে আছিস? তুই ও যা চলে।”
সুলতানা তেড়ে এসে বললো,
“এই ঘরটা আমার। দোকানও আমার।সব আমার।”
সালমান হাসলো। হেসে বললো,
“মাথায় পাগল চেপে বসেছে?”
সুলতানা সালমানের কথার কোনো উত্তর দিলো না। সরাসরি পুলিশকে কল দিলো সে। পুলিশকে ইনফোর্ম করলো, নুপুরকে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর পুলিশের সামনে উকিল এনে সালমান আর তার মাকে বুঝিয়ে দিলো, এই ঘরটা দলিল হিসেবে এখন তার আর তারানার। এখানে তাদের কোনো অধিকার আর নেই।
সালমান হকচকিয়ে গেলো। সুলতানার পাশে এস দাঁড়িয়ে সুলতানাকে বললো,
“তুমি না আমার বউ? এখন সব জায়গা জমি আমার নামে করে দেউ।”
সুলতানার শাশুড়ি পাশ থেকে বলে উঠলেন,
“বউ বউ করিস না। থাপ্পড় দে। এগুলো সব আমাদের ছিলো আমাদের আছে।”
সালমান কথাটা শুনে তার মাকে গিয়ে একটা থাপ্পড় দিলো। বললো,
“তুমি চুপ করো। তুমি চলে যাও আমার ঘর থেকে।”
সালমানকে তার মা কান্না করতে করতে বললো,
“পেটে ধরেছিলাম তোকে,আর আজ তুই পেটের সন্তান আমার গায়ে হাত তুললি?”
সালমান আবার তেড়ে আসলো। মায়ের চুল ধরে বললো,
“চুপ করবি তুই? আমার জায়গা জমি যায় যায়। ”
তারপর মায়ের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“সুলতানাকে এখন ভালোয় ভালোয় বুঝিয়ে জায়গা জমি আমার নামে করে নিতে হবে।”
এমন সময় পেছন থেকে কে জানি হাততালি দিলো। সুলতানা, সালমান আর সালমানের মা পেছন ফিরে তাকালো। তারানা এসেছে। তারানার পরনে কাতান শাড়ি, গলায় স্বর্ণের জড়োয়া হার। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেনো গহনা চিকচিক করছে।
শাশুড়ি তারানার সামনে গিয়ে বললেন,
“এগুলো তো আমার। লকার থেকে তুলে আনলি কেনো?”
তারানা তার কোমর থেকে চাবির গুছা বের করে হাত উচিয়ে বললো,
“এই ঘর এখন আমার। আর অভিশাপ দিয়েছিলাম না, সবকিছু একদিন আমার হবে? তোমার পাপ তোমাকে ছাড়বে না? তোকে ছাড়েনাই। দেখেছিস?”
সুলতানা, তারানার এই অদ্ভুত পরিবর্তন আর নতুন রূপ দেখে অবাক হলো। সুলতানা তারানার পাশে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“তুই এমন আচরণ করছিস কেনো? আর এই নতুন রূপ? আম্মার সাথে তুই তুকারি করে কথা বলছিস কেনো?”
তারানা হাসলো। হাসতে হাসতে বললো,
“আম্মা? শাশুড়ি? এসব বুঝি না আপা।”
তারপর তারানা শাশুড়ির সামনে গিয়ে শাশুড়ির গলা থেকে চেইন খুলে নিলো। তারপর হাত উচিয়ে বললো,
“ইচ্ছা করছে তোর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় দেই”
সালমান উত্তেজিত হয়ে গেলো। চিল্লিয়ে বললো,
“তারানা আমার মায়ের সাথে কথা বলছো তুমি। সাবধান!”
তারানা বললো,
“কী কী? সাবধান? হা হা হা”
তারপর শাশুড়িকে বললো,
“এই ছেলেই তো কিছুক্ষণ আগে তোকে মারলো। এখন আবার এই ছেলেই কদর দেখায়?”
সুলতানা সামনে এসে তারানাকে কড়া গলায় বলল,
“কী হচ্ছে এসব তারানা?”
তারানা বললো,
“খেলা দেখোনি এতোদিন, তারানা চিনতে ভুল করেছো। এই ঘর, এই সংসার এই সম্পত্তি আমার আমার আমার। সব আমার। হা হা হা। সব আমার, আমার, আমার। আমি এখন এই ঘরের একমাত্র অধিকারিণী। ”
লেখা: Midhad Ahmed
#দ্বিরাগমন
#পর্বঃ১৬
আমি অসহায়ের মতো রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে রইলাম। কোথায় যাবো আমার মেয়েকে নিয়ে? কী করবো? কী করবো না কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। ট্রেইন থেকে সবাই নেমেছে। সাইনবোর্ডে বড়ো করে লেখা দেখলাম, “সিলেট”
একজন মহিলা আমাকে এভাবে দাঁড়িয়ে দেখতে থেকে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“খই যাইতায় রেগো সোনাছান্দ ইকানো উবাইয়া উফরেদি ছাইয়া কিতা দেখো?”
আমি মহিলার মুখের দিকে তাকালাম। কথার মানে বুঝতে পারলাম না। উনি হয়তো সিলেটী ভাষায় কিছু একটা বলেছেন আমাকে। আমি হা করে থাকিয়ে থাকলাম। তারপর সেই মহিলা আমাকে ভেংচি কেটে সামনে এগিয়ে গেলেন। আমি প্লাটফর্মের এক কোণায় বসে রইলাম সত্যকে নিয়ে। মাথা কাজ করছে না আমার। তবে সেই ঘরমুখো আর হবো না। সত্যকে নিয়ে আমি আমার জীবন সত্য অন্বেষণ করতে এসেছি। আমাকে জীবনে জয়ী হতেই হবে।
এদিকে তারানার অদ্ভুত রকমের পরিবর্তন দেখে সুলতানা অবাক হলো। তারানাকে সুলতানা কাছে নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো
“তোর হয়েছেটা কী?”
তারানা সুলতানার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“কিছু হয়নি। আর তোমাকে আমি সাবধান করে দিলাম তুমি এর পর থেকে আমার কথার উপর কথা বলবা না।”
তারানার কথা শুনে সুলতানা যেনো আকাশ থেকে পড়লো। তারানার সামনে গিয়ে সুলতানা বললো
“আমি তোর আপা হই রে তারানা। এই তারানা? ভুলে গিয়েছিস আমাকে? আমি না তোর বড়ো সতীন?”
তারানা মুখ ভরে হাসলো এবার। হাসতে হাসতে বললো,
“সতীন”
হা হা হা।
আবারও হাসলো তারানা। তারপর সুলতানার চারিদিক ঘুরতে ঘুরতে আর হাতে রাখা চাবির গুছা নাড়াতে নাড়াতে তারানা বললো,
“সতীন ই ভালো। আমরা দুই সতীন। ভালোয় ভালোয় দুই সতীন ঘর করবো। আর নাহলে তুমি কাট আউট! ওকে?”
“কী বলছিস এসব? তোর মাথা ঠিক আছে রে তারানা?”
সুলতানার কথা শেষ হতে না হতেই শাশুড়ি পাশ থেকে বলে উঠলেন,
“বেয়াদব শাঁকচুন্নি শুকরের বাচ্চার মাথায় সমস্যা হয়েছে।”
তারানা সাথে সাথে শাশুড়ির গলায় হাত চেপে ধরলো। সুলতানা আর সালমান আটকালো তারানাকে। তারানার হাত ছাড়াতে পারলেও, মুখ বন্ধ করতে পারলো না সুলতানা আর সালমান। তারানা এক বলায় বলেই যাচ্ছে,
“আমার মেয়ে খেয়েছিস তুই। আর এখন আমি তোকে খাবো”
সুলতানা তারানার গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিলো। থাপ্পড় দিয়ে তারানাকে ঝেকে ধরে বললো,
“তুই মানুষ? তোর মাথা ঠিক আছে রে বোন?”
সুলতানার কথা শুনেও যেনো তারানার মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা গেলো না। তারানা আবার হাসলো। হেসে হেসে সুলতানাকে বললো,
“আমি আর কিছু হলে ভুলে যাবো যে তুমি আমার বড়ো সতীন।”
“ভুলে যা। আমার দরকার নেই এমন সতীনের। আমরা না বোন?”
“বোন? হাসালে তুমি আপা।”
“এইতো আপা বলে ডেকেছিস। আমরা দুই বোন রে।”
“ভুল করে ডেকেছি। আমরা দুই আপা না আমরা দুই সতীন।”
সুলতানা এবার রেগে বললো,
“ঘরটা শুধু তোর একার না তারানা।”
তারানা জবাব দিলো,
“ঘরটা তোমারও না। ঘরটা আমারও। এই বাসা, পাঁচটা দোকান সব তোমার আর আমার সমান সমান।”
শাশুড়ি এসে সুলতানাকে বললেন,
“মারে বাসা দোকান আমার ছেলের নামে করে দে তুই।”
তারানা হাসলো। হেসে হেসে সুলতানাকে বললো,
“দেখেছো বড়ো সতীন? এখন তোমাকে মা বলে ডাকছে শাশুড়ি। অহ না এইটা শাশুড়ি না শাঁকচুন্নি। আর আগে? তোমাকে আমাকে নুপুরকে কী বলতো ডায়নি? সারাক্ষণ গালাগালি করতো সে। আমার জীবনটা অসহ্য করে তুলেছিলো সে।”
তারপর তারানা কান্না করতে করতে বললো,
“আমার পেটের মেয়েকে এই ডায়নি মেরেছে। এই ডায়নির মেয়ে মেরেছে। তারা আমার মেয়েকে মেরেছে।
পেছন থেকে এমন সময় আওয়াজ আসলো,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও ভাবী। আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
সবাই পেছন ফিরে তাকালো। মুনা দরজার দাঁডিয়ে। হাতে একটা ব্যাগ। ভগ্ন স্বাস্থ্য। চোখের নিচে কালি।
তারানা মুনাকে দেখে হেসে উঠলো। শাশুড়ির সামনে গিয়ে বললো,
“তোর মেয়ে শুনেছি ক্যান্সার আক্রান্ত। মরে যাবে। সময় হাতে নেই। জামাই তাকে ছেড়ে দিয়েছে। আমেরিকা থেকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে যে!”
তারপর তারানা মুনার সামনে গিয়ে মুনার পেছনে সামনে ঘুরঘুর করতে করতে শাশুড়িকে বললো,
“এইটার বিয়েতে আমাকে, বড় সতীনকে অস্বীকার করেছিলি না? দেখ! আমাকে ঘর থেকে বের করেছিলি না? এখন আমার ঘর, আমার হয়েছে। আজ এই ঘরের মালকিন আমি। তোর মেয়ের ঘর না। সে ঘরছাড়া হয়েছে। ইতিহাস শুধু সময় নেয়। সব সময় মতো ফিরিয়ে নেয়।”
তারানার কথায় মুনা দরজায় দাঁড়িয়ে শব্দ ছাড়া কান্না করছে। সুলতানা এসে তারানাকে তার দিকে ফিরিয়ে বললো,
“ওসব কী বলছিস তুই?”
মুনা সুলতানাকে বললো,
“ভাবী, তারানা ভাবীকে আজ বলতে দাও। আমি ভুল করেছি। আমার শাস্তি আজ আমি পাচ্ছি।”
শাশুড়ি এমন সময় তারানার সামনে এসে তারানাকে বলতে লাগলেন,
“মারে, আমার মেয়েকে এভাবে বলিস না। আমার মেয়েটা কষ্টে আছে রে মা”
তারানা হাসলো। হেসে হেসে বললো,
“কষ্টে আছে? আমার মাকে একদিন অপমান মনে আছে তোমার? আমি বাজা মেয়ে, আমার মা বাজা মেয়েকে তোমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে এই কথা বলেছিলে তুমি। মনে আছে তোমার? ”
শাশুড়ি তারানার কথার কোনো জবাব দিলেন না। শুনলেন শুধু।
সুলতানা মুনাকে ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। তারানা বললো,
“শুধু নুপুরের বলে যাওয়া, নাহলে এই স্বামীর ঘর ফেরত ক্যান্সার রোগীর মতো অপয়াকে আমার ঘরে জায়গা দিতাম না।”
এতোক্ষণ সালমান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারানার কথা শুনে যাচ্ছিলো। এবার সালমান চটে গিয়ে তারানার গালে পেছন থেকে এসে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়।
মুহূর্তেই ঘটে যায় অঘটন। তারানা পুলিশকে কল দেয়। পুলিশ আসলে গৃহবধূ নির্যাতনের কথা বলে পুলিশের হাতে সালমানকে ধরিয়ে দেয় তারানা। সুলতানা, তারানাকে বারবার নিষেধ করলেও তারানা সুলতানার কোনো কথা শুনেনি। সুলতানা তারপর তার নিজের ক্ষমতা দেখাতে যায়। কড়া গলায় তারানাকে বলে,
“এই ঘর যেমন তোর, ঠিক তেমনি আমার ও। বাসাও আমার নামে, দোকানও আমার নামে। ঠিক যেমনটা তোর নামে করা।”
তারানা হাসলো। হেসে হেসে বললো,
“তারানাকে এক যুগ দেখেও চিনোনি তুমি? আসলেই তুমি বোকা।”
তারপর বাসার দলিল মেলে ধরলো সুলতানার সামনে। হাসতে হাসতে বললো,
“সাধে তো আর নুপুরকে ভালো বাসিনি আমি। নুপুরও জানে না, আমাকে দিয়ে করানো দলিলে শুধু আমার নাম লেখা। এই বাসা, দোকানে তোমার কোনো অধিকার নেই। দলিল বলে, এসব শুধুই আমার।
হা হা হা। তারানাকে তোমাদের চিনতে ভুল হয়েছে। সবকিছু আমার। শুধুই আমার।
লেখা: Midhad Ahmed
চলবে,,,,,,,,
(চলবে)
(চলবে)
লেখা: Midhad Ahmed
(চলবে)