দ্বিরাগমন পর্ব ১৭+১৮+১৯+২০

#দ্বিরাগমন
#পর্ব_১৭

তারানার কথায় পুলিশ সালমানকে ধরে নিয়ে গেলো। তারানা সুলতানাকে দলিল নিয়ে আসতে বললো। সুলতানা উপরে উঠলো। নুপুরের আলমারি থেকে বাসার দলিল বের করলো। বের করে সুলতানা যা দেখলো তা দেখার জন্য সুলতানা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। দলিলে নামের জায়গায় শুধু তারানার নাম লেখা। তারপর সুলতানা দোকানের দলিল বের করলো। সেখানেও শুধুমাত্র তারানার নাম লেখা। সুলতানা নুপুরের রুম থেকে বের হয়ে নিচে আসতে যাবে এমন সময় দেখতে পেলো নুপুর মুনার চুল ধরে বলছে,
“টান দেই একটা? তোর মা তো আমার চুল কম টানেনি।”
শাশুড়ি তারানার কাছে গিয়ে কান্না করে বলছেন,
“ওসব করিস না মা। আমার মেয়েটা অসুস্থ!”

তারানার এই রূপ দেখে সুলতানা মনে কষ্ট যতটুকু না পেলো তারচেয়ে বেশি অবাক হলো তারানার এই পরিবর্তন দেখে। সুলতানা নিচে নামলো। নিচে নামতেই সুলতানাকে তারানা জিজ্ঞেস করলো,
“সতীন, দেখেছেন? বাসা, দোকান সব আমার নামে করা।”
তারপর তারানা গাল ভর্তি হাসি দিলো। আঙুল দিয়ে গোল করে উপর থেকে নিচ ইশারা করে শাশুড়িকে বললো,
“এই বাড়ি-ঘর আমার। সব আমার। বুঝেছেন?”

সুলতানা তারানার কাছে গেলো। তারানার হাত ধরে এক পাশে নিয়ে এসে বললো,
“বোনরে জানি তোর মনের মধ্যে ক্ষোভ জমেছে তবে দোহাই লাগে আল্লাহর, তাদের অপরাধের শাস্তি তুই দিতে যাস না।”
তারানা নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো সুলতানার হাত থেকে। সুলতানাকে বললো,
“আমি শাস্তি দিবো না? তাই কি হয়? তুমি ভুলে গিয়েছো আপা তারা মা মেয়ে-ছেলে মিলে আমাদের সাথে কী করেছে?”
“কিচ্ছু ভুলিনি।”
“তাহলে কেনো আমাকে নিষেধ করছো তুমি? আর আমি ইচ্ছে করেই জায়গা বাসা সব আমার নামে করিয়েছি যাতে করে তুমি তোমার অধিকার খাটিয়ে আমাকে দমিয়ে রাখতে না পারো।”

সুলতানা এবার তারানার আসল উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারলো। তারানা শাস্তি দেবার জন্য ফিরে এসেছে। তারানামার মাথায় প্রতিশোধের আগুন তার ভেতরটাকে জ্বলিয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। এই অগ্নি স্পৃহা খুব সহজে দমে যাবার নয়।
সুলতানা তারানাকে বললো,
“পুলিশকে কল দিয়ে বল সালমানকে ছেড়ে দিতে।”
“কেনো বলবো? আগে এখানে তার মা বোনকে সাইজ করি। তারপর তাকে এনে সাইজ করবো।”
সুলতানা এবার রেগে গেলো। সুলতানার চোখের কোণে পানি চলে আসলো। সুলতানা তারানাকে বললো,
“চিহ! তুই না এক যুগ আগে যখন এই বাড়িতে এসেছিলি তখন আমাকে নিজের বোন মেনেছিলি, তাহলে আজ কেনো তুই এরকম আচরণ করছিস? তুই ভুলে যাস না দিনশেষে সালমান আমাদের স্বামী। আমরা তার বউ।”

তারানা এবার হাতে তালি দিলো। তারপর শাশুড়ির সামনে গিয়ে জোরে জোরে বললো,
“কী বলেছিলা সতীন? আমার বলো। আমরা সালমানের কী?”
সুলতানা কান্না করতে করতে বললো,
“আমরা সালমানের বউ”
তারানা শাশুড়ির সামনে গিয়ে সুলতানাকে দেখিয়ে বললো,
“এই দেখো! এই ভালো মানুষ এরকম হয়। তুমি আর তোমার ছেলে কখনো তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলে? বাজা মেয়ে বলে কম অপমান করোনি।”

শাশুড়ির চোখ দিয়ে তখন কান্না চলে আসলো। তারানা বললো,
“ওসব কান্না দেখিয়ে লাভ নেই। সব ফন্দি ফিকির আটছো আমি দেখেই বুঝতে পারছি। এখন বের হও আমার ঘর থেকে। বের হও।”

সুলতানা তারানার সামনে এসে দাঁড়ালো।তারানাকে বললো,
“তারা কোথাও যাবে না।”
“যাবে। এই ঘরটা আমার।।আমি ঠিক করবো কে থাকবে আর কে থাকবে না।”
সুলতানা বললো,
“বেশ! তাহলে এই বড় বাড়ি-গাড়ি-দোকান সব নিয়ে তুই একা থাক। আমিও গেলাম তাদের সাথে।

সুলতানা বাইরের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তারানা হাত আটকে ধরলো সুলতানার। জড়িয়ে ধরলো সুলতানাকে। জড়িয়ে ধরে বললো,
“তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে আপা। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না।”
সুলতানা তারানার কান্নায় কোনো উত্তর দিলো না। সে শক্ত পাথরের মতো হয়ে গেলো। তারানা হাত চেপে ধরলো সুলতানার। সুলতানা বললো,
“আমার হাত ছাড়”
“ছাড়ব না”
“ছাড় বলছি। আমার এই ঘরে থাকা আর সম্ভব না।”
তারপর সুলতানা শাশুড়ি আর মুনাকে বললো,
“আমরা তিনজন যেদিকে চোখ যায় চলে যাবো। তবুও এখানে থাকবো না। এই মেয়েটাকে সম্পত্তির লোভ অন্ধ করে ফেলেছে।”
“সম্পত্তির লোভ? এই তুমি আমাকে চিনলে বড় সতীন?”
“তোর মুখে বড় সতীন ভালো মানায়। আমাকে আর কখনোই আপা ডাকবি না।”
“সম্পত্তি আমাকে অন্ধ বানায়নি।”
“বানিয়েছে। আমরা চলে যাচ্ছি। তুই খুব করে ভালো থাকিস।”

তারানা কান্না করে উঠলো। সুলতানাকে বললো,
“শাশুড়ি, মুনা থাকুক এখানে। তবুও তোমাকে আমি হারাতে চাই না।”
সুলতানা বললো,
“যে মেয়ে সম্পত্তি পেয়ে তার খারাপ ব্যবহার করতে পারে সে আর যাই হোক বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।।অপমান নিয়ে এই বাড়িতে আমি আর একদিনও না। কাছের কেউ অপমান করলে এই অপমানটা বুকে লাগে বেশি। আর আজ তুই সেই বুকে লাগানো কষ্ট দিলি।”

সুলতানা সামনের দিকে এগিয়ে চললো। সুলতানার হাত পেছন থেকে শাশুড়ি টেনে ধরলেন। সুলতানাকে বললেন,
“মারে এখান থেকে আমরা কোথায় যাবো বল?”
সুলতানা বললো,
“জানি না। তবুও এই অপমান নিয়ে এখানে থাকা যাবে না।”

অসুস্থ মুনা পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। তারও চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। তারানা এগিয়ে গিয়ে সুলতানার হাত ধরলো আবার। সুলতানা তারানার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। কোনো কথা বললো না। তারানা বললো,
“আমাকে ভুল বুঝলা আপা?”
সুলতানা পেছনে ফিরলো। হাত উপরে তুলবে তুলবে করে মুষ্টিবদ্ধ করলো সুলতানা। তারপর তারানাকে বললো,
“আমাকে আপা বলার যোগ্যতা তুই হারিয়েছিস। সম্পত্তি তোকে লোভী করে তুলেছে। আমার কোনো বোন নেই, কেউ নেই। সতীনকে আপন করে নিয়েছিলাম। আঁকড়ে ধরেছিলাম বাঁচবো বলে। আর আজ সেই মেয়েটা, যেই মেয়ের বাচ্চাকালের সংসার করানো আমি শিখালাম, সেই মেয়ে আমাকে সতীন বলে ডাকে? তুই আমাকে আপা বলার যোগ্যতা হারিয়েছিস। আর কখনোই তুই আমাকে আপা বলে ডাকতে পারবি না।”

সুলতানা এগিয়ে চললো। পেছনে পেছনে তার শাশুড়ি ও মুনা। তারা আর এই বাড়িতে থাকবে না।

এদিকে স্টেশনের প্লাটফর্মে বসে থাকা নুপুর ও তার মেয়ে সত্যকে সেই চাচা ফিরে এসে নিয়ে গেলেন। নুপুর ওনার সাথে যেতে চাইছিলো না। উনি বললেন,
“মারে, এই বাজে শহরে তুই এই বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে কোথায় থাকবি বল? আমার বাসায় আয়।আমি দেখি কোনো ব্যবস্থা করতে পারি কী না”

এক মুহূর্ত ভেবে নুপুর রাজি হয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলো, বিধাতা হয়তোবা সবার জন্যই ভালো কিছু একটা ঠিক করে রেখেছেন।
দ্বিধাগমন
মিদহাদ আহমেদ
#পর্ব_১৮

তারানা তখন সুলতানা, মুনা আর শাশুড়ির পথ আটকিয়ে ধরলো। সুলতানাকে বললো,
“তুমি যেতে পারবে না আপা। এই ঘরটা তোমার আমার, আমাদের নুপুরের।”
সুলতানা বললো,
“ঘরটা এখন তোর তারানা। এই ঘরে আমাএ নুপুর নেই। আজ নুপুর থাকলে এই দিন আমাদের দেখতে হতো না।”
তারানা বললো,
“শাশুড়ি, মুনা আর সালমান কি আমাদের কম কষ্ট দিয়েছে আপা?”
“দিক। তবুও সালমান আমাদের স্বামী। মুনা অসুস্থ আর উনি আমাদের শাশুড়ি হলেও আমাদের মাতৃতুল্য।”
তারানা নিশ্চুপ থাকলো। তারানা কিছুক্ষণ পর আবার বললো,
“তোমরা এই ঘর থেকে যেতে পারবে না।”
সুলতানা হাসলো। হেসে বললো,
“আমরা যেতে পারবো না? হাসালি তুই। এক মুহূর্তে রূপ পালটে যায় তোর?”
তারানা সুলতানার পায়ে পড়ে গেলো। তারপর শাশুড়ির পায়েও জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও আম্মা। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে”
শাশুড়ি তারানাকে তুলে ধরলেন। জড়িয়ে ধরে বললেন
“মারে তোর সাথে অনেক অবিচার করেছি। তোর মেয়েকে মেরেছি। জানি কখনো আমাকে ক্ষমা করতে পারবি না তুই। তবুও রে মা আমাকে ক্ষমা করে দে। আমাকে ক্ষমা করে দে।”
তারানাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে তারানার শাশুড়ি যুক্ত করলেন,
“আজ আমার মেয়ে অসুস্থ। আমি এসবের ফল ভোগ করছি রে মা।আমার শাস্তি হয়েছে।”

সুলতানা এসে শাশুড়িকে ধরে বললো,
“আম্মা এখন এসব বলার সময় না। আসেন আমরা চলে যাই।”

তারানা এসে পথ ধরে বসলো। সুলতানাকে বললো,
“আপা তুমি অন্তত আমাকে রেখে যেও না। আমি আমার বেয়াদবি বুঝতে পেরেছি।”
তারপর মুনার সামনে গিয়ে মুনার হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে মুনাকে বললো,
“বোন আমার, তুইতো আমাকে ভুল বুঝিস না। আমাকে ক্ষমা করে দে।”
মুনা তারানার মুখের উপর হাত এনে মুখ বন্ধ করতে বললো। তারপর বললো,
“ভাবি আমাকে আর লজ্জা দিও না। আমি তোমার সাথে, সুলতানা ভাবির সাথে আর নুপুর ভাবির সাথে যা যা করেছি তা ঠিক করিনি।”
সুলতানা পাশ কাটিয়ে মুনার হাতে ধরে টান দিয়ে বললো,
“মুনা চল। আমরা এখানে থাকবো না।”

হঠাৎ শাশুড়ি সুলতানাকে বললেন,
“মারে এখানে আমরা তারানাকে একা ফেলে গেলে সে থাকবে কীভাবে?”
সুলতানা বললো,
“থাকবে তার সম্পত্তি নিয়ে। থাকবে।”
তারানা বললো,
“না আপা এভাবে বলো না। আমি তোমাদের ছাড়া এক মুহূর্তও কল্পনা করতে পারবো না।”
সুলতানা রেগে বললো,
“কল্পনা তো অনেক আগেই আমি যা করেছি তার উলটো হয়েছে। নতুন আর কী দেখতে হবে আমাকে?”
শাশুড়ি সুলতানাকে চুপ করতে বললেন। তারপর বললেন,
“আমরা এখানেই থাকবোন”
সুলতানা না করলো। বললো,
“যেই ঘরে আমার স্বামীর,আমার শাশুড়ির আর আমার অসুস্থ ননদের অপমান হয় সেই ঘরে আমি থাকতে পারবো না।”
তারানা শাশুড়ির পায়ে পড়ে গেলো। পা ধরে বললো,
“আম্মা আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
শাশুড়ি তারানাকে তুলে ধরলেন। সুলতানাকে বললেন,
“মারে এভাবে মেয়েটাকে একা ফেলে যাস না।”
সুলতানা বললো,
“একটা শর্তে আমি এই ঘরে থাকতে পারি।”
তারানা বললো,
“কী শর্ত?”
“আম্মা ও মুনাকে সম্মান করতে হবে। সালমানকে ফিরিয়ে আনতে হবে।”

তারানা সাথে সাথে মোবাইলে কার জানি নাম্বার টিপলো। কল করে বললো,
“সুলতানকে এখনই ছেড়ে দিন।”
মোবাইলের ওপাশ থেকে কীসের শব্দ আসলো শুনা গেলো না। তারানা বললো,
“ঠিক আছে, আপনি নিয়ে যান। আর তাকে ছেড়ে দিন।”
সুলতানা, তারানার কল রাখতেই তারানাকে বললো,
“কথা দিলে হবে না শুধু, রাখতে হবে।”
সুলতানার চোখেমুখে আগুন। মুনা এসে সুলতানাকে ধরলো। বললো,
“ভাবি এভাবে আর কথা বলো না। আমি আর মা তো কম কষ্ট দেইনি তোমাদের।”
সুলতানা বলল,
“এসব কষ্ট না।”

তারপর সুলতানা মুনাকে ধরে উপরে উঠে গেলো। শাশুড়ি সুলতানার পিছুপিছু উপরে উঠলেন। তারানা নিচে দাঁড়িয়ে রইলো।

এদিকে ওই চাচা নুপুরকে তার বাসায় নিয়ে আসলেন। উনার প্রকাণ্ড বাসা। শহরের মধ্যেও একটা শীতল পরিবেশ। পাঁচ তলা বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় থাকেন উনি। উপরের তালা ভাড়া দেওয়া। নুপুরকে নিয়ে বাসা ঢুকতেই একজন মোটা, বেটে করে মহিলা সামনে এসে দাঁড়ালো। বৃদ্ধ চাচাটাকে মহিলা কিছু বলার আগেই উনি আমাকে দেখিয়ে বললেন,
“রুনার মা, এই দেখো আমাদের নতুন মেয়ে।”
“নতুন মেয়ে? মানে?”
তখন আমার সামনে চাচা সব ঘটনা উনার স্ত্রীকে খুলে বললেন। আমার কুলে থাকা সত্য কান্না করে উঠলো। চাচার স্ত্রী আমার কুল থেকে আমার মেয়েটাকে নিজের কুলে নিয়ে কথা বলতে লাগলেন।আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“আসো মা ভেতরে আসো।”

আমি যেনো হুট করে আকাশ থেকে পড়লাম। এসবের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার জীবন যেখানে অনিশ্চিত ছিলো, সেখানে আমি যেনো এক নবজীবন লাভ করলাম। উনার স্ত্রী আমাকে নিয়ে সোফায় বসালেন। আমার গালে হাতের পরশ ছুইয়ে দিয়ে আমাকে বললেন,
“মারে তোর সত্য আর তুই আজ থেকে আমাদের দায়িত্ব। ছেলেমেয়ে মানুষ করেছিরে মা তবে এই বৃদ্ধ বয়সে কাওকে পাশে পাই না। বাসার ভাড়া যা পাই, তাতে মা ভালোমতেই চলতে পারি। যখন শরীর খারাপ থাকে তখন পানি এনে দেওয়ার মতো কেউ পাই না। বয়স হয়েছে, রান্নাবাড়া করতে ভালো লাগে না। এমন কেউ নাই যে আমাকে রান্নাবাড়া করে খাওয়াবে রে মা।”
এই বলে উনার চোখের কোণে পানি চলে আসলো। আমি খেয়াল করলাম টপাটপ পানি টপকে বের হতে পারছে না শুধু। উনি নিজেকে শক্ত প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। আমি উনার চোখে কোণে হাত দিতেই উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। কান্না শুরু করে দিলেন আমাকে ধরে। আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারলাম না।
এমন সময় চাচা এসে পেছন থেকে ডাক দিলেন,
“চা রেডি। সকাল সকাল বাসায় চা না থাকলে হয় না।”
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেকি চাচার গায়ে এপ্রোণ পরা। উনি চা বানিয়ে নিয়ে এসেছেন। চাচি মুচকি এসে আমাকে বললেন,
“আমাদের বুড়াবুড়ির জীবন এভাবেই চলে রে মা”

আমি উঠে গিয়ে চায়ের কাপ চাচির দিকে এগিয়ে দিলাম। বললাম,
“চাচি চা খান।”
উনি আমার হাতে ধরে বসলেন। আমাকে বললেন,
“একটা জিনিস চাইবো। দিবি?”
আমি অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম,
“কী?”
উনি বললেন,
“আমাকে মা বলে ডাক না রে?”
দরদমাখা গলা শুনে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। আমার হাতে থাকা চায়ের কাপ মাটিতে পরে গেলো। ভেঙ্গে গেলো মুহূর্তেই। চাচা ধমক দিয়ে চাচিকে বললেন,
“যে কাওকে মেয়ে বানাতে ইচ্ছা কেনো এতো? দেখলে সে ভয় পেয়ে গেলো?”
আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,
“মা”
চাচির চোখ ছলছল করে উঠলো। আমাকে বললেন,
“কী ডাকলি? আবার ডাক!”
আমি বললাম,
“মা!”
তারপর পেছনে ফিরে বললাম,
“বাবা”

উনারা দুজনের চোখ দেখলাম জলে ছলছল করছে। আমার সত্য মায়ের কুলে। উনি বাবাকে বলছেন,
“আল্লাহ আমাদের একা রাখতে দিলেন না শেষ পর্যন্ত। দেখলে আমরা মেয়ে, নাতিন দুই ই পেলাম?”
বাবা আমার মাথায় হাত রেখে বললেন
“মারে, এই বাবা ডাকটা ডেকে আমাকে দায়িত্ববান করে ফেললি।”
আমিও কান্না করে দিলাম সাথে সাথেই।

এদিকে তারানার ফোনে কার যেনো কল আসলো। তারানা এপাশ থেকে বললো,
“এগুলোর দরকার আছে। নাহলে আমি নাটক করতাম না। ফকিন্নি শাশুড়ি, ননদ আর সতীনের পায়ে ধরে তাদের ঘরে তুলতাম না আবার। আর তোর দেওয়া দলিল যে নকল সেইটা ওই সতীন ধরতে পারেনি। বাসা, জায়গা, দোকান সব আমাদের দুজনের নামে। আমার একার না। এখন কৌশলে সব আমার নামে করে নিতে হবে। জাল দলিলে আর কত!”

তারানার কথাগুলো দরজার আড়াল থেকে সব শুনতে পেলো মুনা।

(চলবে)#দ্বিধাগমন
#পর্বঃ১৯

এদিকে তারানার ফোনে কথা আড়ালে সব শুনে ফেলে মুনা। এই কথা শুনার জন্য মুনা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। মুনা দরজার আড়াল থেকে কথা শুনে রান্নাঘরে ঢুকে যাওয়ার সময়, মুনাকে সামনের গ্লাসে দেখে ফেলে তারানা। তারানা পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো, মুনা রান্নাঘরে ঢুকে গেছে। তারানা কলে বললো,
“আমি রাখছি এখন।”
তারপর তারানা রান্নাঘরে গেলো। পেছন থেকে মুনাকে ডাক দিলো,
“মুনা…মুনা…”
তারানার গলার আওয়ার শুনে মুনা কেমন জানি আৎকে উঠলো। মুনা পেছন ফিরে তাকালো। তারানা মুনাকে জিজ্ঞেস করলো,
“শরীর কেমন রে বোন? আমার তোর জন্য কেমন জানি করছে এখন।”
মুনা তারানার এক হুট করে বদলে যাওয়া রূপ দেখে ভড়কে গেলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“শরীর আর তেমন ভালো না ভাবি”
মুনার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখতে পেলো তারানা। মুনার কপালে হাত দিলো তারানা। মুনা চমকে গেলো। তারানা হেসে বললো,
“কিছু শুনেছো?”
“কি…কী শুনবো… কি কি…”
হুট করে সুলতানা চলে আসলো এমন সময় রান্নাঘরে। সুলতানা মুনাকে ডেকে বললো,
“এখানে কী?”
মুনা আমতা আমতা করে বললো,
“পানি খেতে এসেছিলাম।”
সুলতানাকে দেখে তারানা মুনাকে বললো,
“আরেহ একবাদ আমাকে ডাকলেই তো হতো। আমি পানি এনে দিতাম।”
মুনা বললো
“না এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম তো, তাই চলে আসছি নিজেই।”
সুলতানা মুনাকে ধরে বললো,
“আর কখনো কোনকিছুর প্রয়োজন হলে আগে আমাকে বলবা। কেমন?”
মুনা মাথা নাড়লো হ্যাঁ সূচক।
কলিংবেল বাজলো। সুলতানা গিয়ে দরজা খুলে দিলো। সালমান বাসায় এসেছে। তারানা রান্নাঘর থেকে আড়চোখে সালমানের দিকে তাকালো।

অন্যদিকে নুপুর তার নতুন বাবা মা পেলো। তারা দুজন নুপুরের মেয়ে সত্যকে নিজের আপন করে নিলেন। নুপুরের মাথায় এখন একটাই চিন্তা, কীভাবে কিছু একটা করা যায়, সত্যকে মানুষ করা যায়। যে সত্যকে নিয়ে চোরের মতো ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলো নুপুর, সেই মেয়েকে এখন বড় করতে হবে। অনেক বড় করতে হবে যেই বড় একদিন সমাজে নুপুরকে সফল মা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। সত্যকে একজন প্রতিষ্ঠিত মেয়ে রূপে সম্মান করবে। আর সেদিন নুপুর তার মেয়েকে নিয়ে আবার সালমানের বাসায় যাবে। সালমানের সামনে দাঁড়াবে। সালমানকে উপলব্ধি করাবে যে মেয়েরাও সমাজের একটা বিড়াট অংশ। তাদের অবহেলার কোনো জায়গা নেই।

পনেরো দিনের মাথায় মুনা মারা গেলো। সারা বাড়িতে একটা শোকের ছায়া নেমে এলো। কৌশলে দোকানের একটা কাগজে ব্যাংকের সিগনেচার লাগবে এইটা বলে বাসা, দোকান সব জেনুইন ভাবে নিজের করে নিলো তারানা।

মুনার মৃত্যুর চারদিনের মাথায় সালমান এসে সুলতানাকে বললো,
“চারদিনের শিন্নি করতে হবে যে!”
বিমূর্তভাবে দাঁড়ানো ছিলো সুলতানা। সে বললো,
“করো। আর এতিম খানায় ও একবেলা খাবার দিও।”
সুলতানার শাশুড়ি পাশে থেকে কান্নায় ভেঙ্গে গেলেন।কান্না করতে করতে বললেন,
“এভাবে এতো সকাল আমাদের ছেড়ে চলে গেলো আমার মেয়েটা। আমিতো মা, এই মেয়েকে আমার পেটে ধরেছিলাম। মেয়টা আমার আগে কেনো গেলো আল্লাহ”
এই বলে কান্নায় ভেঙ্গে গেলেন তিনি। তারানা সামনে এসে বললো,
“আমিও মেয়ে পেটে ধরেছিলাম। সেই মেয়েকে আপনি মেরে ফেলেছিলেন জন্মের আগেই।”
সুলতানা ধমক দিয়ে তারানার হাত ধরে তারানাকে সরিয়ে নিয়ে আসলো রুমের বাইরে। তারানাকে বললো,
“এসব কী হচ্ছে এই সময়ে?”
তারানা বললো,
“জীবন এই খেলাই খেলে আপা।কারো জন্য কোনোকিছু বাকি থাকে না। আল্লাহ তার ফল জন্মেই দিয়ে দেয়।”

সুলতানা দেখলো, পেছনে সালমান দাঁড়িয়ে সব শুনছে। সালমানক দেখে সুলতানা কাশি দিলো একটা। যাতে তারানা মুখ বন্ধ করে। তারানাকে চোখ দিয়ে ইশারাও দিলো সুলতানা। তারানা বললো,
” ইশারা দিচ্ছো কেনো?”
সুলতানা আবার তারানাকে চেপে যেতে বললো। তারানা পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলো, সালমান দাঁড়ানো। তারানা হাসলো। হেসে বললো,
“ভয় পাও নাকি? সে কী করবে আমাকে?”
সালমান তারানার কথা শুনেও না শুনার বাহানা করে চলে গেলো।
সুলতানা রুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো, শাশুড়ি মাটিতে বসে কান্না করে যাচ্ছেন। সুলতানা তারানাকে বললো,
“এভাবে বলিস না বোন আমার।”
তারানা বললো,
“আমার দরদ নাই আপা। যা সত্য আমি তাই বলি।
সুলতানা বললো,
“চারদিনের শিরনির জন্য টাকা দরকার। সালমানকে দিয়ে দে।”
তারানা আবার হাসলো। বললো,
“কীসের জন্য?”
“চারদিনের শিরনি।”
“কার?”
“মুনার।”
“দেওয়া যাবে না।”
সুলতানা তারানার কথায় অবাক হলো। তারানাকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেনো?”
তারানা কোনো উত্তর দিলো না। রুমে গিয়ে দশ টা হাজার টাকার নোটের দশ হাজার টাকা এনে ধরিয়ে দিলো সুলতানার হাতে। তারপর গলার স্বর ঝাঝিয়ে বললো,
“ছোটখাটটো এতিম খানায় এক দিনের এক বেলার খাবার হয়ে যাবে। আর ঘরে লোক খাওয়ানোর দরকার নাই। মরার জন্য খরচ করা যাবে না।”

এই বলে তারানা চলে গেলো।

নুপুর সিলেটে থেকে জানে না মুনা কেমন আছে।।আল্লাহর কাছে বারবার দোয়া করে যেখানেই থাকুক মুনা যেনো ভালো থাকে। নুপুর তার মাকে তার সতীনদের কথা শুনায়। নুপুরের নতুন মা গল্পগুলো শুনে অবাক হন। নুপুরকে জিজ্ঞেস করেন, এসব সত্যি কী না! সতীনদের মধ্যে এরকম মিল ভালোবাসা পাওয়া যায় না সচরাচর।
নুপুর মুখ ভরে বলে,
“আমি বোন পেয়েছি, সতীন পাইনি। যা অপ্রাপ্তি ছিলো সব পূরণ হয়ে গিয়েছে বোনের মতো সতীন পেয়ে।”
নুপুর মনে মনে চিন্তা করে, একদিন যখন আবার সে তার মেয়েকে নিয়ে ফিরে যাবে, তখন হয়তো দেখবে তার ফেলে আসা সংসারটা আবার সুন্দর হয়ে উঠেছে। হয়তো সালমান নতুন আরেকটা বিয়ে করবে। তবে নুপুর জানে সালমান বিয়ে করলেও সালমানের নতুন বউকে সুলতানা ও তারানা বোন করে নিবে। সতীন না!
মায়ের মোবাইলে কল আসলো। কিছুক্ষণ মা চুপ করে থাকলেন। নুপুর গিয়ে জিজ্ঞেস করলো
“কী হয়েছে মা?”
মা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
” আমার মেয়ে ঢাকা থেকে কল করে বললো, আমি নাকি ঘরে এখন নাতিন সহ মেয়ে পুষি।”
আমি বললাম
“আমরা মা মেয়ে এখানে থাকলে যদি আপনাদের সমস্যা হয় মা, তাহলে আমি চলে যাই। আমাকে কোথাও কাজের মেয়ের চাকরি দেন, আমি কাজ করে খাবো। তবুও আপনাদের অশান্তি আমি চাই না।”
বাবা পেছন থেকে বললেন,
“যেই মেয়ে বাসার জায়গার জন্য মামলা মোকাদ্দমা করতে পারে, যেই ছেলেরা বিদেশ গিয়ে ঈদের পার্বনেও ফোন দেয় না, তাদের জন্য তুই কেনো ঘরছাড়া হবি রে মা? তুই এখানেই থাকবি। আমাদের সাথে থাকবি। আমাদের সত্য আমাদের সাথে বড়ো হবে।
“কিন্তু…”
“কোনো কিন্তু নাই। ”
মা কিছু একটা বলতে চাইছিলেন তবে তিনি চুপ করে গেলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“কী বলবা মা?”
উনি শেষে আমার জোরাজুরিতে বললেন,
“ঢাকার মেয়েটাকে আমি পেটে ধরিনি। উনার আগের স্ত্রীর ঘরের একমাত্র মেয়ে সে।”
বাবা বললেন,
“মেয়েতো আমার। লজ্জাটাও আমার।”
বাবা হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বললেন,
“মারে ছেলেমেয়ে চারটা থাকার পরও এই কান বাবা ডাকটা শুনার জন্য ব্যকুল হয়। দাদা ডাকটা শুনার জন্য অপেক্ষা করে। কেউ নাই জীবনে কেউ নাই।”

আমি আর কোনো কথা বললাম না। সত্য কান্না করে উঠলো। বাবার কোলে দিয়ে বললাম,
“নাতনিকে সামাল দেন এখন। আমি রান্নাঘরে গেলাম।”

পেছনে বাবা আর মা বসে কী যেনো ফিসফিস করতে লাগলেন। যতটুকু বুঝলাম, তারা বলছেন,
“আল্লাহ আমাদের মেয়ে নাতনি দান করেছেন”
আমি আর সেদিকে কান দিলাম না। রান্নাঘরে চলে গেলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, আমার ফেলে আসা সংসারটা হয়তোবা নতুন করে সেজে উঠবে আবার। সেখানে হয়তোবা তারানা আপা আর সুলতানা আপা মিলে সামলে নিয়েছে আমার ঘর। আমার মা ভাইকেও হয়তোবা দেখে রাখছে তারা।

হায় ভাগ্যের পরিহাস, অন্যদিকে তারানা তার রূপ বদলিয়ে নতুন খেলা দেখাচ্ছে! যা হতে চলেছে তা কল্পনাকেও হার মানাবে।

সেদিন রাতে তারানা কার সাথে যেনো কলে কথা বলছে। তারানা বলছে,
“মুনা আমার সব কথা শুনে ফেলেছিলো। তাই আর তাকে বাঁচিয়ে রাখিনি। সেদিন আমতা আমতা করে কথা বলায় আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে মুনা আমার উপর বিরূপ ধারণা নিতে বসেছে। চিন্তায় ছিলাম যদি সে এসব বলে ফেলতো সুলতানাকে। রোজ রাতে তাই মুনাকে সাথে নিয়ে ঘুমাতাম। তোমাকে কল দেওয়া আর হয়ে উঠেনি। আজ কথা বলবো ভালো করে। মরেছে সে। আর অবুঝের মতো যে তুমি আমাকে পালিয়ে আসতে পালিয়ে আসতে বলো, এইটা কেনো করো? এভাবে পালিয়ে আসবো কেনো? তুমি সামান্য ফুডপান্ডার সার্ভিস ম্যান। তোমার রুজি কত? কত পাবা মাসে? সংসার চলবে?
আমার নামে নুপুর অর্ধেক বাড়ি দিয়েছে, দোকান দিয়েছে।কৌশলে সুলতানার অংশটাও নিজের করে নিয়েছি। মুনা বিপদ ডেকে আনতে পারতো, ভাতের মধ্যে বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছি। সবাই বুঝলো, ক্যান্সারে মরেছে বেচারি। কিন্তু কী আর করার বলো? এভাবে শত্রু বাঁচিয়ে রাখা যায়? আমিও তো মানুষ। কালকে মুনার চার দিনের শিরনি দিবে এতিম খানায়। দশ হাজার টাকা দিয়েছি ”

ফোনের অপাশ থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ বললো,
“দশ হাজার?”
তারানা বললো,
“হ্যাঁ। এগুলোতে হবেও না।”
ছেলেটা অবাক হলো। তারপর বললো,
“দশ হাজারে আমাদের মাস চলে যেতো।”

তারানা হাসলো। হেসে হেসে জবাব দিলো,
“দশ কোটির ও বেশি সম্পত্তির মালিক হয়েছি আমি। এসব আর চিন্তা করে লাভ নেই।”

ছেলেটা বললো,
“আমাদের প্রথম দেখার কথা মনে আছে?”
তারানা বললো,
“নুপুরদের বাসায়। এইতো দুই মাস আগে দেখা হলো আমাদের। নুপুরের ভাইর ফুডপান্ডার অর্ডার ডেলিভারি দিতে এসেছিলে। সাইকেলে করে। তাইনা?”

ছেলেটা হাসলো। তারপর হেসে হেসে বললো,
“লাভ ইউ সুইট হার্ট এন্ড আই নিড ইউ”
সুলতানা জবাব দিলো,
“আমিও তোমাকে ভালোবাসি। আমরা একটা স্বপ্নের পৃথিবী গড়ে তুলবো দুজনে মিলে।”
“আর তুমি সেই পৃথিবীর রানি। ওকে?”
“আমি রানি তবে তুমি রাজা না।”
“রাজা না? তাহলে কী?”
“আমার সর্বক্ষণের আদেশ পালন করার মতো একজন।”
তারপর তারানা আবারও একগাল হাসলো।

এরপর কেটে গেলো প্রায় পনেরো বছর….

[আগামীকালের পর্ব নতুন চমকে সাজবে। কাহিনী উলটো ঘুরতে শুরু করবে]

[নোট: গল্পটা দীর্ঘকায় জীবন সংশ্লিষ্ট উপন্যাস। আমি হুট করে শেষ করতে পারবো না। এই গল্পটার নায়িকা হলো “সত্য”। এতোদিন আপনারা গল্পের নায়িকার মা “নুপুর”, বাবা, সৎ মায়ের কাহিনী জেনেছেন। আপনাদেরকে সত্যের লড়াই করা জীবন ও জানতে হবে। সমাজে নারী চরিত্ররা যে কতটুকু শক্ত, আর লড়াকু হয়ে বেঁচে থাকে সেইটা জানতে হবে। আর এই লড়াই আমার না, এইটা আপনাদের লড়াই। আপনাদের নুপুর তার মেয়ে সত্যকে নিয়ে কীভাবে এগিয়ে যায় শেষ পর্যন্ত, সেইটা জানা চাই অবশ্যই? এজন্য গল্পের শেষ চাই শেষ চাই এভাবে বলবেন না। আর অবশ্যই নতুনত্ব আসবে সামনের পর্বে। তারানার কাহিনীও তো জানতে হবে। তাইনা? তাই অপেক্ষা করুন। ভালোবাসা]

লেখা: Midhad Ahmed
#দ্বিরাগমন
#পর্ব_২০

জীবন থেকে কখন যে পনেরো বছর কেটে গেলো সেটা কেউ টেরই পেলো না। সুলতানা, তারানা আর নুপুরের শাশুড়ি মারা গিয়েছেন। সুলতানা আর সালমান একসাথে থাকে। সুলতানা একটা স্কুলের বাংলার টিচার। সালমান একটা আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে সুপারভাইজার হিসেবে আছে। মোটামুটি তাদের ভালো দিন চলে যায়। তারানা নতুন বিয়ে করেছে আরেকটা। সে তার নতুন স্বামীর সাথে আছে সালমানের আলিশান বাড়িতে। বাড়ি থেকে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছে সালমান ও সুলতানা। নুপুরের অনেক খোঁজ করেছিলো তারা, তবে খুঁজে পায়নি তাকে।

সিলেটে আলতাফ চৌধুরী ও রুমানা বেগমের মেয়ে হয়ে ভালোই দিন যাচ্ছিলো নুপুরের। সত্য বড় হয়েছে। সে এবার এস এস সি দিবে। সিলেটের নামকরা একটা স্কুলের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সে। নুপুরের চোখ ভর্তি শুধু স্বপ্ন এখন। সত্যকে সে বড় করে তুলবে। মানুষের মতো মানুষ বানাবে। সত্যকে তার আপন সত্য উপলব্ধি করাবে।
আলতাফ চৌধুরী ও রুমানা বেগম যে সত্যের আপন দাদা দাদি নয় সেটা সে জানে না। সত্য জানে, তার বাবা নেই। মা আছেন। দাদা আর দাদি এই নিয়েই সত্যের পরিবার। সত্য সিলেটী ভাষায় কথা বলতে পারে তবে নুপুরের পুরোপুরি সিলেটী হয় না। সত্য দাদিকে জিজ্ঞেস করে,
“মা সিলেটী পারে না কেনো দাদি?”
সত্যের দাদি হেসে হেসে সত্যকে বলেন,
“মা না পারলে কী হয়েছে? আমার নাতনি তো পারে। তাইনা?”
সত্য হেসে হেসে দাদির কোলে লুটিয়ে পড়ে। তারপর জবাব দেয়,
“মাকে আমি শিখিয়ে দেবো সিলেটী ভাষা।”
নুপুর রান্নাঘর থেকে হাক দেয়
“এতো শেখানো লাগবে না তোর, তুই স্কুলের জন্য রেডি হয়ে নে।”
“বাহ রে, স্কুল তো দশটায়। এখন বাজে আটটা।”
নুপুর রান্নাঘর থেকে খন্তি হাতে ডায়নিংরুমে চলে আসে। তারপর সত্যের কানে ধরে টাক দিয়ে সত্যকে বলে,
“আজ থেকা না কোচিং শুরু? ভুলে গেলি?”
“ওরে বাবারে আমি গেলাম।”
বলেই সত্য উপরে উঠে গেলো। তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে নিচে নেমে আসলো সত্য। নুপুর বললো,
“খেয়ে নে।”
” না মা না, আজকের ক্লাসটা খুব জরুরি। মিস হয়ে যাবে যে!”
দাদি এসে সত্যকে তার দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে, মুখে পরোটা পুরে দিতে দিতে বললেন,
“খা, এই দাঁড়িয়েই খা তুই।”
নুপুর হাক ছাড়লো আবার। বললো,
“এই হলো সারা মা! আপনিও না সত্যকে মাথায় তুলে রেখেছেন। এতো আহ্লাদ কেনো দেখাতে যান বুঝি না। হতচ্ছাড়া মেয়ে, পড়ার খেয়াল নাই, আর খাবার মুখা তুলে দিতে হবে?”
সত্য মাকে ভেংচি কাটলো। দাদিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“তুমি পচা, দাদি ভালো। হুহ”
“হ্যাঁ হয়েছে হয়েছে, আমি খারাপ ভালো। এখন খেয়ে নে তাড়াতাড়ি ”
দাদি নুপুরকে বললেন,
“এই তুই বন্ধ কর এবার। আমার নাতনিটাকে খেতে দে তো”
উপর থেকে নুপুরের বাবা এসে বললেন,
“কী? দাদি আর নাতনি মিলে আমার নুপুরকে শায়েস্তা করা হচ্ছে বুঝি?”
নুপুর গিয়ে বাবার পাশে দাঁড়ালো। তারপর ন্যাকামো করে বললো,
“এই দেখো বাবা তারা দাদি নাতনি মিলে আচ্ছামতো আমাকে বকা দিচ্ছে।”
সত্য তার মাকে ভেংচি কাটলো। দাদি নুপুরের চুল ধরে টান দিয়ে বললেন,
“এই মেয়ে, মাকে ভেংচি কাটে না।”
সত্য বললো,
“বাহ রে, এখন দাদাকে দেখে মেয়ের পক্ষ নিয়ে নিলে?”
দাদা এসে সত্যের মাথায় হাত রাখলেন। বললেন,
“বোনরে তোকে বড় হতে হবে যে! মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবি তুই!”
সত্য বললো,
“হয়েছে হয়েছে। অল অফ ইউ আর দা মোস্ট ইমোশনাল পাব্লিক। আর ইমোশনাল হইও না ব্বাপ। আমি কান্না করে দিবো।”
দাদি সত্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। দাদা ড্রাইভারকে কল দিয়ে গাড়ি সামনে বের করতে বললেন। নুপুর মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললো,
“আমার সেই পিচ্চি সত্য আজ অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।”
নুপুরের মা বুঝতে পারলেন, নুপুরের চোখ দিয়ে জল চলে আসবে। সত্যের সামনে এখন স্কুলে যাওয়ার সময় নুপুর কান্না করুন সেটা তিনি চান না। ঝাপটে গিয়ে নুপুরকে পেছন থেকে ধরে বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ হয়েছে। তোর কিছু বলা লাগবে না। আমার নাতনি বড় হয়েছে আর তোর বাবা বুড়ো হয়েছে। নাতনিকে বিয়ে দিয়ে নাতজামাই নিয়ে আমি সিনেমা দেখতে যাবো। হুহ”
সত্য লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। দাদি সত্যকে বললেন,
“এই দেখো যা মেয়েটার মনে লাড্ডু ফুটে!”

ড্রাইভার এসে দরজার সামনে দাঁড়ালো। দাদা বললেন,
“এইতো ড্রাইভার চলে এসেছে। যাও সত্য চলে যাও। আর হ্যাঁ, পড়াশোনাটা মন দিয়ে করবা। কেমন?”
সত্য হাসি দিলো। দাদাকে বললো,
“লাভ ইউ। তোমার প্রেমিকা ভালো করে পড়াশোনা না করলে কেমনে হয় বলো?”
দাদি হাক ছেড়ে বললেন
“এই সত্য আমার জামাই তোর প্রেমিকা ক্যামনে হয়?”
সত্য গিয়ে দাদাকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু খেয়ে বললো,
“এমনে”
ওমনিই সবাই হেসে পড়লো। সত্য পেছন দিকে হাত নাড়িয়ে বিদায় দিয়ে গাড়িতে উঠলো।

গাড়িতে বসে সত্য তার বই খুলে পড়তে লাগলো। অথচ সত্য খেয়াল ই করছিলো না গাড়ির ড্রাইভার লুকিং গ্লাস দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সত্যের দিকে। সত্যের বাড়ন্ত শরীরের দিকে তার লুলোপ দৃষ্টি। চোখ দুটো দিয়ে যেনো গিলে খাচ্ছে কিশোরী মেয়েটাকে।

এদিকে তারানার দুইটা বাচ্চা হয়েছে নতুন স্বামীর ঘরে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরা স্বামীর ঘরে তারানা ধুকে ধুকে মরছে। বাসা-দোকান সব স্বামীর নামে করে দিয়েছে সে। সুলতানা, সালমানের সাথে প্রতারণা করে বাসা, দোকান যা যা নিজের নামে করে প্রেমিককে দিয়েছিলো তারানা, আজ তার সেই ফল সে ভোগ করছে। সেদিন রাতে মদ্যপ অবস্থায় বাসায় এসে তারানার নতুন স্বামী রাফি বাসার কাজের মেয়েকে নিয়ে উপরে যায়। রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। তারানা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে শুধু। রাফিকে একবার শুধু বলেছিলো,
“আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম রাফি, তার এই ফল পাচ্ছি আমি?”
রাফি মদ্যপ অবস্থায় আঙুল উঠিয়ে তারানার দিকে তাক করে বললো,
“তুই ও তো আরেক স্বামীর ঘর করেছিস, আমিতো বিয়ে করছি না, মেয়ে নিয়ে মস্তি করছি, তাতে তোর কীসের সমস্যা?”

তারানা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে নিলো। আর সেদিকে ফিরে তাকালো না। পরেরদিন সকালে কাজের মেয়ে কাজের ফাকে ঘুরঘুর করে তারানার সামনে এসে তারানাকে বলতে থাকে,
“পুরুষ বউ মিঠায়া সুখ না পাইলে কী আর করবো!”

তারানা মুখ ফুটে কিছু বলতে গিয়েও বলে না। রান্নাঘর থেকে চলে আসে। নিজের রুমে এসে কান্না করতে থাকে বিছানায় শুয়ে শুয়ে। তারানার ছেলেমেয়ে দুইটা স্কুলে। মনে মনে সে চিন্তা করে, এই জীবন তার রেখে লাভ নেই। সুখ নেই, শান্তি নেই। যেই সুখের আশায় সে রাফির সাথে সংসার পেতেছিলো, সেই রাফিই আজ তাকে ধোকা দিচ্ছে।

অন্যদিকে ড্রাইভার যে সত্যের দিকে তাকাচ্ছিলো সেই কখন থেকে, সেটা সত্য বুঝার আগেই গাড়ি এসে স্কুলে পৌছে যায়। সত্য গাড়ি থেকে নামতে যাবে ড্রাইভার বলে উঠে,
“দাঁড়াও আমি দরজা খুলে দেই।”
সত্য বললো,
“না আঙ্কেল, আমি নেমে যাবো আপনার কষ্ট করতে হবে না।”
ড্রাইভার বললো,
“আরে না। দাঁড়াও।”
তারপর ড্রাইভার নেমে এসে গাড়ির দরজা খুললো। সত্যকে আলতো করে বাহুতে ধরে নামিয়ে দিলো। জিব তার লকলক করছিলো তখন। সত্য পেছন ফিরে ড্রাইভারকে বললো,
“আঙ্কেল যাই আমি। আর হ্যাঁ, স্কুল ছুটি হবে তিনটায়। কেমন?”
ড্রাইভার মিষ্টি একটা হাসি দিলো। মনেমনে পঁয়তারা করলো, যে করেই হোক আজ এই মেয়েটাকে তার খেতে হবেই।

লেখা: Midhad Ahmed

(চলবে)
(চলবে)
লেখা: Midhad Ahmed

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here