দ্বিরাগমন পর্ব ৪

#দ্বিরাগমন
#পর্ব_৪

“সন্তান পেটে আসতেই নুপুর তার আসল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে। সাথে সাথেই বাসার দলিল তার নামে করে দিতে বলেছে।”
বললো তারানা।
সুলতানা বললো,
” হ্যাঁ তাই তো দেখছি। এই ছিলো আমার নিয়তি।”
“আমাদের নিয়তি। অথচ নুপুরকে কতো আপন করে নিয়েছি আমরা।”
তারানা আর সুলতানা কথা বলতে বলতে শুনতে পেলো, নুপুর সালমানকে বলছে,
“কী দলিল দিবা আমার নামে করে?”
“না এখন না।”
“অহ আচ্ছা। ঠিক আছে।”

আমি তারপর সালমানের রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে চলে আসলাম। তারানা আর সুলতানা ভাবী আমাকে বললো,
“এতোই যখন লোভী তখন সেটা আগে বললেই হতো।”
আমি তাদের কথায় অবাক হলাম। আমি বুঝতে পারলাম, তারা আসলে আমার কথার ভুল অর্থ বুঝেছে। আমি তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবীকে আমার পেটে হাত দিয়ে বললাম,
“এই আমার পেটের বাচ্চা কসম খাচ্ছি ভাবী, আমি এই নিয়তে সালমানের কাছে বাসায় দলিল আমার নামে করে দিতে চাইনি। আমার সন্তান হওয়ার আগেই আমার শাশুড়ি আর স্বামীর কদর দেখে আমার ভয় হচ্ছে। যদি আমার ঘরে ছেলেমেয়ে আসে তাহলে তারা তোমাদের ভুলে যাবে। এই ঘরে তোমাদের আর ঠাই হবে না। তাই আমি আগে ভাগেই বাসাটা তোমাদের নামে করে দিতে চেয়েছিলাম।”

আমার কথাটা শুনে তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবী আমাকে জড়িয়ে ধরলো। তারানা ভাবী বললো,
“তোকে আর সন্ধেহ জীবনেও করবো না রে নুপুর। তুই আসলেই খুব ভালো।”
সুলতানা বললো,
“তুই থাকতে আমাদের চিন্তা নেই। আমাদের একটা বাচ্চা আসলে কেউ ই আর আমাদের কটু কথা বলবে না।

তারপর থেকে আমার জীবনে পরিবর্তন আসা শুরু করলো। আমার উপর আমার শাশুড়ির যত্ন বেড়ে যেতে থাকলো। শাশুড়ি বারবার বলতেন,
“আমার নাতি চাই। নাতি ছাড়া হবে না।”
উনার কথা শুনে আমি ভয় পেতাম। তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবী আমাকে সাহস দিতেন। বারবার বলতেন, ভেঙ্গে গেলে হবে না। শক্ত হতে হবে আমাকে।
গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন সময়ে আমার ভাবীরা আমার খুব যত্ন নিতো। তাদের আমার সতীন এইটা আমি কখনোই ভাবি নাই। এই ঘরে আসার পর থেকে আমার কখনো ভালোবাসার অভাব হয়নি। দিনকেদিন আমার যখন অসহায়ত্ব নিয়ে কাটতো, ঠিক তখনই ভাবীরা আমাকে সময় দিয়েছে, ভালোবেসেছে, বুঝিয়েছে। তারা আমাকে নিজের বোনের মতো দেখে।
সালমান বাইরে থেকে রোজ রোজ আসার সময় আমার জন্য দামীদামী চকোলেট নিয়ে আসতো। আমার চকোলেট খুব পছন্দের। তবে খারাপ লাগতো যখন দেখতাম, তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবীর জন্য কোনকিছু নিয়ে আসতো না। সকালে তারানা ভাবীকে নিয়ে আমি চকোলেট দিলে তারানা ভাবী হেসে হেসে বলতো,
“এই ভাগ্য আমার হয়নিরে নুপুর। তুই ই খা। ”
আমার নিজের কাছে কষ্ট লাগতো তখন । দেখতাম তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবী নিজেদের মনের মধ্যে চাপা কষ্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কখনো মুখ ফুটে অবশ্য বলতেন না সেই কথাগুলো।

সালমান একদিন রাতে বললো,
“তোমার ছেলে হবে তো?”
আমি বললাম,
“জানি না।”
সালমান তেড়ে আসলো আমার দিকে। রাগের কন্ঠে আমাকে বললো,
“জানি না মানে? আমার ছেলে চাই। ছেলে ছাড়া কোন কথা নাই। এতো এতো যত্ন এমনি এমনি করছি?”
এমন সময় শাশুড়ি আমার রুমে আসলেন। সালমানকে বললেন,
“তুই বাইরে যা একটু।”
“কেনো?”
“আমার দরকার আছে নুপুরের সাথে ”

সালমান বাইরে গেলো। শাশুড়ি একটা তাবিজ এনে আমার বাম হাতের বাহুতে লাগিয়ে দিলেন। তারপর আমাকে বললেন,
“এইটা পরে থাকবি সবসময়। আমার নাতি চাই আমার ছেলের ছেলে চাই। এই নাতি না দিলে তোর হবে না।”
শাশুড়ি একদিন দেখলাম আমার সারা ঘরের দেয়ালে ছেলে বাচ্চার ছবি টাঙিয়ে দিয়েছেন। আমাকে বললেন,
“ছেলে বাচ্চার মুখ দেখবি। তাহলে ছেলে হবে। নাহলে হবে না।”

এদিকে একদিন আমার ননদ মুনা এসে শাশুড়িকে বললো,
“ছেলে না মেয়ে সেটা তো আগেই জানা যায় এখন।”
শাশুড়ি বললেন,
“তাহলে জানবি?”
“হ্যাঁ। ভাইয়াকে আজই বলবোম”

রাতে শুনলাম আলটাসনোগ্রাফি করানোর কথা মুনা সালমানকে বললো। সালমানের মাও সালমানকে বললেন। সালমান রাজি। আমাকে রুমে এসে বললো,
“কালকেই ডাক্তারে যাবা। বুঝছো? আমার কিন্তু ছেলে চাই।”
আমি কান্না করতে লাগলাম। ভেতর ভেতর আমার প্রচণ্ড ভয় শুরু হতে লাগলো। যদি ছেলে না আসে রিপোর্ট এ তাহলে আমার কী হবে!
রাতে সেদিন আমি তারানা ভাবীর কাছে শুলাম। তারানা ভাবী বললো,
“কোন চিন্তা করিস না। আল্লাহ আমাদের এবার ছেলে দিবে।”
“যদি না হয়?”
“সেটাও ভালো। নিয়তি।”
“তারা যদি কিছু করে?”

আমার এই কথাটা শুনার পর দেখলাম তারানা ভাবী একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো। আমার মাথায় হাত দিয়ে বললো
“বোনরে ছেলে না হলে তোরও জীবন শেষ।”

সেদিন রাতটা আমার ভয়ে ভয়ে কাটলো। সন্ধ্যায় আমি, সালমা ভাবী আর মুনা একসাথে ডাক্তারের চ্যাম্বারে গেলাম। একসাথে চ্যাকআপ করালাম। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললো,
“মা ও বাচ্চা দুজন’ই সুস্থ আছেন।”
সুলতানা ভাবী বলল,
“তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। আর টেস্ট করানোর দরকার কী!”
ডাক্তার বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ। এখন আর টেস্ট না করানোই ভালো হবে।”
মুনা পাশ কাটিয়ে বললো,
“না না। টেস্ট করাতে এসেছি টেস্ট করিয়ে যাবো। বাচ্চা ছেলে না মেয়ে সেইটা দেখতে হবে তো।”
ডাক্তার আর মুনার কথার শেষে কথা বললেন না। আলটাসনোগ্রাফি করিয়ে বাসায় ফেরার পথে মুনা সুলতানা ভাবীকে বললো,
“টেস্ট তোমার বাপের টাকায় করিয়েছি নাকি আমার ভাইয়ের টাকায়?”
সুলতানা ভাবী কোন কথা বললো না।
মুনা তারপর বললো,
“হিংসা লাগে? আর ডাক্তারে কেনো গিয়েছি আজকে? বাচ্চা ছেলে না মেয়ে এইটা জানার জন্য নয় কি?
“হ্যাঁ।”
“তাহলে কেনো বললা যে টেস্ট করানো লাগবে না।”
“ডাক্তার বললো যে…”
“ডাক্তার বললো, বাচ্চা ভালো আছে। বাচ্চাটা ছেলে না মেয়ে এইটা তো বলেনাই। তাইনা?
“হ্যাঁ।”
“বাচ্চা মেয়ে হলে তো তারানা ভাবীর মতোই পেটে মেরে ফেলে দেওয়া হবে। তাই জানতে হবে না এইটা ছেলে না মেয়ে?”
মুনার সেই কথা শেষে সুলতানা ভাবীর আর কোন উত্তর আমি শুনলাম না।
আমি এই প্রথম শুনলাম, তারানা ভাবীর বাচ্চাটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি আতকে উঠলাম। মুনা আমাকে বললো,
“ছোট ভাবী, যদি ছেলে না হয় তাহলে তোমার কপালে দুঃখ আছে।”
রাতে শাশুড়ি আমাকে বললেন,
“কালকের টেস্টের রিপোর্ট আসার পর তোকে ঘরের চাবি দিয়ে দিবো। আমার নাতি চাই শুধু। বুঝেছিস?”
আমি ভয়ে হ্যাঁ না কোন কিছু বললাম না।
শাশুড়ি ধমকিয়ে বললেন,
“বুঝেছিস?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম,
“হ্যাঁ।”

বিকেলে তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবী আমায় বুঝালো। এই অবস্থায় আমাকে এসব নিয়ে চিন্তা করলে হবে না।বাচ্চার ক্ষতি হবে। আমি অন্যদিকে ভয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছি। কী হবে কী হবে না। তারানা ভাবী আমাকে কান্না করতে কর‍তে বললো,
“মেয়ে পেটে এসেছে বলে মেয়েটাকে ওরা মা ছেলে মিলে শেষ করে দিলো আমার!”
সুলতানা ভাবী তারানা ভাবীকে সামলাতে লাগলেন। তারানা ভাবীর মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
“দোয়া কর এবার যাতে আমাদের নুপুরের সাথে এমন না হয়।”
আমি কান্না শুরু করে দিলাম। সুলতানা ভাবী আমাকে আর তারানা ভাবীকে বললো,
“তোরা তো মা হওয়ার স্বাদ টা নিয়েছিস। আমিতো কখনো গর্ভেই কাওকে ধরিনি।”
তারানা ভাবী বললো,
“গর্ভে মেরে ফেলার চেয়ে না ধরাই ভালো।”

পরের সেদিন সন্ধ্যায় রিপোর্ট আসলো। সালমান দুপুরে বলে গিয়েছে, সে সন্ধ্যায় রিপোর্ট জানতে হাসপাতালে যাবে। বিকাল থেকেই আমার মন কেমন জানি করছে। শাশুড়ি বারবার কানের কাছে এসে বলতে লাগলেন
“আমার নাতি চাই বউ। নাতি চাই। অন্যকিছু আমি চাই না।”

সুলতান ডাক্তারের চ্যাম্বারে রিপোর্ট নিয়ে ঢুকলো। ডাক্তার রিপোর্ট হাতে নিলেন। সালমানকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হলে খুশি আপনি?”
সালমান রেগে গিয়ে ডাক্তারকে বললো,
“রিপোর্ট বলতে বলেছি রিপোর্ট বল। আমার কী শুনলে খুশি সেটা তোকে বলবো কেনো?”
ডাক্তার সাহেব রেগে গিয়েও রাগলেন না। সালমানকে বললেন,
“কুল ডাউন কুল ডাউন।”
“কুল ডাউন না। রিপোর্ট কী বলে? ছেলে তো? নাকি মেয়ে?”
ডাক্তার বললেন,
” আপনি একটা………. ”

লেখা: Midhad Ahmed

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here