#দ্বিরাগমন
#পর্ব_৫
ডাক্তার সালমানকে বললো,
“আপনি একটা ছেলে সন্তানের বাবা হতে চলেছেন।”
কথাটা শুনে সালমান খুশি হলো ভীষণ। ডাক্তারের হাতে তখনই এক হাজার টাকার দুইটা নোট ধরিয়ে দিলো সালমান।
ডাক্তার ইতস্তত বোধ করলেন। সালমানকে বললেন,
“রিপোর্ট দেখার জন্য আমি আলাদা কোন চার্জ নেই না।”
সালমান ডাক্তারকে বললো,
“আরে চার্জ না ডাক্তার। নেক দিলাম নেক। ছেলের বাপ হবো। এতোদিন চার চারটা বিয়ে করেও বাপ হতে পারিনাই। এবার ছেলের বাপ হবো শুনেই আমার মনটা খুশিতে ভরে উঠলো।”
সালমান তখন মানিব্যাগ থেকে আরও দুইটা এক হাজার টাকার নোট বের করে ডাক্তারের হাতে ধরিয়ে দিলো। তারপর বললো,
“রাখেন। না করবেন না। আমার জীবনের সবচাইতে বড় খুশির সংবাদ আপনি শুনিয়েছেন আমাকে।”
ডাক্তার সালমানের এই কাজ-কারবার দেখে থ বনে গেলেন। সালমান ডাক্তারের চ্যাম্বার থেকে বের হলো। বের হওয়ার সময় ডাক্তারের চ্যাম্বার থেকে আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট নিতে ভুলে গেলো সালমান। ডাক্তার তখন তার সহকারীকে ডেকে সালমানকে রিপোর্ট নিয়ে যেতে বললে সালমান বললো,
“না না। এই কাগজ দিয়ে আমি কী করবো আর? ছেলে হবে শুনেছি এতেই হলো। আর কোন কাগজের দরকার নাই।”
সালমান বের হয়েই মিষ্টির দোকানে গেলো। দোকানদারকে বললো,
” বিশ কেজি মিষ্টি প্যাক কর। আলাদা আলাদা প্যাকেটে করিস।”
দোকানের ছেলেটা নরমাল মিষ্টি কার্টুনে প্যাক করতে লাগলো। সালমান চট করে একটা ঘাড়ে হালকা মতো থাবা দিয়ে বললো,
“এই মিষ্টি কেনো? দামী মিষ্টি দে। ছানার টা। চারশো টাকা কেজি দরের যেটা সেটা দিবি।”
দোকানদার মিষ্টি প্যাক করতে লাগলো। টাকা দেওয়ার সময় মিষ্টির দোকানের ম্যানেজার সালমানকে জিজ্ঞেস করলো,
“আজকে আপনাকে অনেক খুশি খুশি লাগছে ভাই। কারণটা কি বিশেষ কিছু?”
“আমি ছেলের বাপ হবো। ছেলের বাপ। ”
“অহ আচ্ছা। খুশির সংবাদ।”
সালমান তারপর আরও এক কেজি মিষ্টি প্যাক করতে বললো। প্যাক করে ম্যানেজারের হাতে দিয়ে বললো,
“আপনারা সবাই মিষ্টিমুখ করে নিবেন। ”
দোকানের অন্য কর্মচারীকে ডেকে একে একে সবার হাতে পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিলো সালমান। তারপর মুখে বিড়বিড় করতে করতে বের হলো মিষ্টির দোকান থেকে। মুখে মুখে বলছিলো,
“আমি ছেলের বাপ হবো। ছেলের বাপ।”
এদিকে সন্ধ্যার পর থেকে আমার শাশুড়ি আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছেন,
“ছেলে হবে তো? যদি ছেলে না হয় তাহলে মুখ আমাকে দেখাইস না। মরে রক্ষা করিস আমাকে।”
মুনা শাশুড়ির সাথে সাথে বলতে লাগলো,
“কাল তো তারানা ভাবী টেস্টের পক্ষেই ছিলো না। পাছে যদি ছেলে হয়ে যায় রিপোর্টে! সেতো আর ছেলে জন্ম দিতে পারেনি। জন্ম দিয়েছে মরা মেয়ে ”
তারানা ভাবী তেড়ে আসলো মুনার দিকে। মুনাকে বললো,
“আমি মরা মেয়ে জন্ম দিয়েছি নাকি তোমরা আমার মেয়েকে মেরেছো?”
শাশুড়ি এসে তারানা ভাবীর গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় দিয়ে বসলেন । তারানা ভাবীকে বললেন,
” বাজা মেয়ে মুখ বন্ধ কর। মেয়ে পয়দা দিবি কেনো? ছেলে দিলে তোকে মাথায় তুলে রাখতাম।”
তারানা ভাবীর চোখ দিয়ে দেখলাম পানি পড়ছে। আমি ভয়ে ভয়ে কাঁপছি। সালমান এসে রিপোর্টের কী কথা জানাবে। যদি রিপোর্টে মেয়ে আসে? যদি আমার ছেলে না হয় তখন?
শাশুড়ি আবার আমাকে অভয় দিলেন,
“দেখো মেয়ে, যদি ছেলে পয়দা না হয় তাহলে নিজের অলক্ষ্মী মুখ আমাদের দেখিও না। কেমন?”
আমি নিশ্চুপ থাকলাম। কোন কথা বললাম না। উত্তর দেয়ার মতো ভাষা আমি তখন হারিয়ে ফেললাম।
রাত তখন আটটা বাজে। কলিংবেল বাজলো। শাশুড়ি উপর থেকে মুনাকে ডাক দিয়ে বললেন,
“দরজা খুল দেখ কে এসেছে।”
মুনা দরজা খুলতেই আমি সালমানের গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। সালমান মুনাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
“আমি ভীষণ খুশি রে বোন। আমি ভীষণ খুশি। তুই কী চাস আমার কাছে? বল”
আমি, তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবী একসাথে আমাদের রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে শুনতে পেলাম সালমান মুনাকে বলছে,
“আমি ছেলের বাবা হচ্ছি। তুই ফুপু হচ্ছিস।”
মুনা চিৎকার করে উঠলো। শাশুড়িকে ডেকে বললো
“মা মা শুনতে পেয়েছো? নুপুর ভাবীর পেটে ছেলে বাচ্চা এসেছে।”
মুনা তারপর আমাকে এসে ধরলো। সিঁড়ি দিয়ে উপর তলা থেকে নিচে নামতে ছিলাম। সাথে তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবী ছিলো। মুনা তাদেরকে পাশ কাটিয়ে বললো,
“ছাড়ো ছাড়ো। নুপুর ভাবীকে ছাড়ো তোমরা। কখন কী করে বসবা জানি না বাপু! কার মনে হিংসা কেমন বুঝা তো যায় না।”
সালমান নিচ থেকে হুংকার দিলো মুনাকে। মুনাকে বললো,
“আজকের দিনটায় কাওকে কিছু বলিস না তুই। আজ আমি ভীষণ খুশি। তারপর তারানা ভাবী আর সুলতানা ভাবীকে ইশারা করে সালমান বললো,
“তোমরা দুই বাজা বউ। তোমাদের ঘরে রাখাটাই পাপ। তবে আজ আমি ভীষণ খুশি। আর যাই হোক আমিতো তোদের বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসা স্বামী ও বটে। তোদের কিছু চাওয়া থাকলে বলতে পারিস আমাকে।”
মুনা আমাকে ছেলে তার ভাইয়ের কাছে চলে গেলো। সালমানকে বললো,
“ভাইয়া বাজাদের কিছু দেওয়া লাগবে না। তাদের ছায়াও খারাপ। আমাকে তুমি পঞ্চাশ হাজার টাকা দাও। আমার দরকার আছে।”
সালমান তখনই তার এটিএম কার্ড আর পাসওয়ার্ড মুনাকে দিয়ে দিলো। মুনাকে বললো,
“পঞ্চাশ কেনো, লাখ লাগলেও নিয়ে নিস। আমি আজ ভীষণ খুশি।”
আমার খারাপ লাগতে লাগলো। আমার সামনে আমার বোনের মতো দুইজনকে তাদেরই স্বামী অপমান করেই চলছে। মুখে কোন কিছু বলতেও পারছি না। সালমান মুনাকে বলতেই কার্ড দিয়ে দিলো। অথচ আমার অভাবী ভাবা লাখ টাকা পেলে তার মাথার উপর থাকা বোঝা কিছুটা হলেও হালকা হতো।
তারানা আর সুলতানা ভাবী সেখান থেকে চলে গেলেন। শাশুড়ি আমাকে এসে জড়িয়ে ধরলেন। আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
“মারে আজ আমি ভীষণ খুশি তোর উপর। অনেক অনেক খুশি আমি। তুই আমাকে নাতি দেখাবি রে।”
সালমান শাশুড়িকে বললো,
“মিষ্টি এনেছি বিশ কেজি। ধরো।”
“এতো মিষ্টি দিয়ে কী করবি?”
“বাসায় পাঁচ কেজি রেখে দাও। আর বিল্ডিং এ পনেরোটা ফ্লাটেই তো ভাড়াটেরা আছে। তাদের সবার ফ্ল্যাটে এক কেজি করে দিও।”
মুনা পাশ কাটিয়ে শাশুড়িকে বললো,
“চার তলার বাম পাশের সাদিয়াদের বাসায় দিও না। সাদিয়া ভাড়াটের মেয়ে হয়ে মালিকের মেয়ের সাথে টক্কর দিতে আসে।”
সালমান মুনাকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোর সাথে কীসের টক্কর দিতে আসে?”
“আমি যেই ড্রেসটা কিনেছিলাম বসুন্ধরা থেকে, ওইযে এগারো হাজার দিয়ে। তুমি সাথে ছিলে তো!”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। তো কী হয়েছে?”
“সেই একই ড্রেস ওর ও আছে। সে আমার দেখে কিনেছে।”
সালমান তারপর বললো,
“অহ আচ্ছা তাহলে চার তলার বাম পাশে মিষ্টি দিও না। আর মা শুনো, আমি মিষ্টি চল্লিশ কেজির মতো কালকের জন্য অর্ডার করে এসেছি। ড্রাইভার দিয়ে রিলেটিভ যারা যারা আছেন তাদের বাসায় পাঠিয়ে দিও। কেমন?”
“আচ্ছা আচ্ছা।”
তারপর শাশুড়ি তার হাত থেকে সোনার চুড়ি খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিলেন। হাতে পরিয়ে দিতে দিতে শাশুড়ি বললেন,
“আমার বাবা পাকিস্তান থেকে স্বর্ণের বিস্কুট এনেছিলেন সেই ব্রিটিশ আমলে। আমার বোনের জন্য একজোড়া আর আমার জন্য একজোড়া গড়িয়ে দেন তিনি। আমার এই জোড়ায় স্বর্ণ আছে পাঁচ ভরি। শখ ছিলো, নাতি আসলে নাতবউকে দিবো। নাতি দেখতে দেখতেই বুড়া হয়ে গেলাম। বড় বউ বাজা হলো। সেই বউ ছেলে দিলে নাতি আমার আজ অনেক বড় হয়ে যেতো। তোর হাতে দিলাম এই চুড়ি জোড়া। আমার নাতিবউকে দিস। কেমন?”
“আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালাম।”
সালমানের হাতে একটা বক্স ছিলো। মুনা সালমানকে বললো,
“এইটা কীসের বক্স ভাইয়া?”
সালমান বক্সটা খুললো। বক্সের ভেতরে একটা হীরের হার ছিলো। সালমান সেই হারটা আমার হাতে দিয়ে বললো,
“এইটা তোমার নেক। আমার ছেলে চাই। ছেলে দিয়েছো।”
আমার ভেতর ভেতর কষ্টের পাহার গড়ে উঠলো তখন। আমি মা হতে চলেছি, আমি সন্তান পেটে নিয়েছি এর জন্য আমাকে নেক দেওয়া হলে আমি খুশি হতাম অথচ আমাকে যা দেওয়া হচ্ছে সব ছেলে সন্তান পেটে আসার জন্য! আজ যদি মেয়ে সন্তান আসতো!
মুনা হীরার হারটা দেখে বললো,
“অনেক সুন্দর হয়েছে।”
তারপর মুনা সেই হারটা তার গলায় লাগালো। আমাকে বললো,
“কেমন দেখাচ্ছে ভাবী?”
আমি বললাম,
“সুন্দর।”
তারপর আমি মুনাকে বললাম,
“হারটা রেখে দাও তুমি।”
“সত্যি বলছো?”
“হ্যাঁ।”
“ভাবী তুমি অনেক ভালো।”
মুনা হীরার হারটা নিয়ে উপরে চলে আসতে লাগলো। সালমান পেছন থেকে হুংকার দিয়ে মুনাকে বললো,
“এইটা তোকে পরতে বলেছি? এইটা তোর জন্য এনেছি?”
(লেখাটার এই মুহূর্তে ১০/১০/২০২০ এ সময় রাত এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিটে ভূমিকম্প হচ্ছে। সিলেটে আছি আমি। বিছানায় শুয়ে আছি। ভূমিকম্প লেখায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারেনি।)
মুনা কাছুমাছু খেয়ে বসলো। সালমান বললো,
“দে নুপুরকে ফিরিয়ে।”
মুনা বললো,
“ছেলে পেটে আসায় তার কদর বেড়ে গেছে? যদি মেয়ে আসতো তাহলে কুত্তার মতো বের করে দিতা তাকে।”
সালমান চটে গিয়ে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো মুনাকে। আমি বললাম
“ভুল বলেছে মুনা?”
শাশুড়ি আমাকে বললেন,
“এসবে তুমি এসো না বউ। বাইরে থাকো এসবের।”
আমি রেগে গিয়ে বললাম,
“হারটা মুনার নিতেই হবে। নাহলে হবে না।”
শেষমেশ সালমান বললো,
“ঠিক আছে। মুনা রেখে দিক হীরার হারটা।”
এদিকে উপরে সুলতানা আর তারানা বসে আছে। সুলতানা তারানাকে বললো,
“সত্যকে লুকানো কি ভালো হলো? কিছুদিন পরই তো সত্য সবার সামনে বেরিয়ে আসবে। তখন?”
তারানা বললো,
“সত্য কেমন হবে জানি না, তবে আমি আমার মেয়ের মতো আরও কোন মেয়ে তার সন্তান জন্মের আগেই হারিয়ে বসুক এইটা আমি চাই না। আমি যা করেছি তা ভালো না মন্দ একমাত্র আমার খোদা জানেন!”
লেখা: #মিদহাদ_আহমদ
(চলবে)