ধূসর রঙের প্রজাপতি পর্ব ২৭+২৮+২৯+৩০

#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_27

ঝিলের শ্বাস বেড়ে গেছে সহস্র গুন। হসপিটালের মুমূর্ষু রোগীরা যেমন শ্বাস টানে ঠিক তেমনি ভাবে শ্বাস টানতে লাগলো। যেন এখনি শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবে। ঝিলের অবস্থা বুঝে অভিনব আলতো হাতে ঝিলের বাহু তে স্পর্শ করলো। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। অভিনব ঝিলের কম্পন স্পষ্ট অনুভব করছে।
সে বুঝতে পারলো ঝিলের অস্বস্তি আর ভয়ের কারন । তাই অধর কোনে হাসি ফুটিয়ে প্রস্থান করলো। অভিনব চলে যাওয়ার সাথে সাথে ঝিল স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। অভিনব একি প্রশ্ন করলো তাকে ?
এর উত্তর কি হবে ? হ্যাঁ নাকি না ? ঝিল শুকনো ঢোক গিলে নিলো। এ কেমন যন্ত্রণা হলো। যাহ থেকে মুক্তির ফর্মুলা ই নেই। ঝিলের খুব করে মনে হলো এ বিষাদ ময় যন্ত্রণা তাকে পাগল করে দিবে।
না অভিনব কে ঠিক ভাবে গ্রহন করতে পারছে । আর না তার পাশে কাউ কে সহ্য করতে পারছে।
এর কি নাম দেওয়া যায় ভালোবাসা ?
ঝিলের তো কলেজে বেশ কিছু ক্রাশ ছিলো। যাদের দেখলেই মনে হতো অনেক কিউট। যাই একটু গাল টা টিপে দিয়ে আসি। কিন্তু অভিনবর ক্ষেত্রে তো ক্রাশ বলা যায় না। তাহলে এই বিচিত্র অনুভূতির নাম ই কি ভালোবাসা ?
ঝিল মাথা টা চেপে ধরলো। না আর নেওয়া যাচ্ছে না। প্রেমে পরার থেকে প্রেমে পরেছে কি না সেটা বোঝা সত্যি ই কষ্টকর।
এই শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি আর টলারেট করা যাবে না। নাহলে আজ ই তাকে পটল তুলতে হবে।
যা কিছুতেই চাইছে না ওহ। এখন রিলাক্স নেওয়ার প্রয়োজন।
ঝিল আপন মনেই হাঁটতে লাগলো। অদূরে পাপড়ি কে দেখা যাচ্ছে।
এই মেয়েটা বড় বোনের মতো কেয়ার করে ওকে।
যেমন ভালো তেমনি সুন্দর। এই ট্যুরে এক মাত্র এর সাথেই ঝিল কমফার্টেবল। আর অভিনব তো ভিন গ্রহের অনুভূতি ।
ঝিল সেই দিকেই পা বাড়ালো।

অভিনব কিছুক্ষন ভাবলো। ঝিল কে কি আরেক টু সময় দেওয়া দরকার। মেয়েটার চোখে মুখে ভালোবাসা থাকলে ও মনের কোনে জমানো ভালোবাসা টা অস্পষ্ট। তাই অভিনব ঠিক করে নিলো ঝিল কে এই বিষয়ে আর কিছু বলবে না।

গাছের গুরি থেকে উঠে দাঁড়ালো। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো ঝিল পাপড়ির সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। সময় প্রায় চারটার কাছাকাছি। অভিনব মাহের এর দিকে এগিয়ে গেল। মাহের এজেন্সির কারো সাথে কোনো কিছু নিয়ে কথা বলছে।
চোখে মুখে সামান্য অসহায় ভাব। অভিনবর ভ্রু কুঁচকে গেল। কোনো সমস্যা হলো না তো। তাই সেটা দেখতে মাহের এর দিকেই পা বাড়ালো।

_ কোনো সমস্যা মাহের ?

_ না সমস্যা নেই ব্রো। বাট জামতলা সি বিচ এর বিভিন্ন জায়গায় নাকি চোরা বালি আছে। তাছাড়া ওনারা বলছেন এখানে লাইফ জ্যাকেট ছাড়া না নামাই ভালো।

_ হ্যাঁ সেটাই ভালো হবে। পর্যাপ্ত জ্যাকেট তো আছে তাই না ?

_ হুমমম। আমি আসলে একটা ফুটবল চাচ্ছিলাম। পানি তে খেলা যেত। বহু দিন হলো পানি তে ফুটবল খেলা হয় না।

অভিনব এক চিলতে হেসে বলল
_ আমার কাছে কিন্তু ফুটবল আছে।

মাহের চকচকে চোখে তাকিয়ে হাত দিয়ে শিষ বাজালো। হাসি মুখে চিৎকার করে বলল
_ অমিত , শাকীল ফুটবলের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি আয় , সময় কম।

মাহেরের ডাকে ছুটে আসলো দুজনে। অভিনব ব্যাগ থেকে মুরানো ফুটবল টা বের করে নিলো। পাম্প দিয়ে ফুটবল টাকে টুসটুসে করে নিলো।
তারপর ই সবাই পানির দিকে ভৌ দৌড়। ফুটবল নিয়ে পানি তে নেমে গেল। অভিনব সাঁতারে মোটামুটি ভালো। তবু ও বেশি জোড় দেখাচ্ছে না। কারন খেলা সমানে সমানেই মজা।

সবাই ধীরে ধীরে পানিতে নেমে যাচ্ছে। ঝিল ও নামতে চাচ্ছে কিন্ত ভয় হচ্ছে। সবাই তো যে যার পার্টনার এর সাথে নেমে যাচ্ছে । ওহহ এখন কি করবে ?
মন খারাপ করে গাছের গুরি তেই বসে রইলো। অভিনব টা ও ফুটবল নিয়ে ব্যস্ত। ঝিল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। অভিনবর গায়ের কালো শার্ট টা পানিতে ভিজে চুপচুপ। গাঁয়ে একদম ই লেপ্টে আছে। অতিরিক্ত ফর্সা শরীর টা বেশ আকর্ষিত লাগছে। এতো দিন পর ঝিল লক্ষ্য করলো ছেলে টা রোজ জিম করে। কারন তাঁর ফল ফুটে উঠেছে অভিনবর বডিতে।
ঝিল ফাঁকা ঢোক গিললো। এর এক হাতের সামনে ঝিল নেহাত ই বাচ্চা। এমন কেন হলো ?
ঝিল কি আরেকটু শক্তিশালী হতে পারতো না। এতে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত। সত্যি কি চন্দ্র সূর্য মিলে যেত ?
যদি নাই ই হয় তাহলে ওহ কেন অভিনবর সামনে পিচ্ছি একটা বাচ্চা । ওর তো শক্তিশালী হওয়ার খুব প্রয়োজন।

অমিনব দু বার ঝিল কে ডেকেছে। কিন্তু ঝিল গভীর ভাবনাতে মত্ত। এই দিকে সময় ও কম অভিনব ভেজা হাতেই ঝিলের বাহু তে স্পর্শ করলো। হালকা শীতে কনকনে শীতল পানি সাথে অভিনবর স্পর্শ মিলে যেন কারেন্ট সৃষ্টি করে ফেলেছে। ঝিল ছিটকে দূরে চলে গেল। আমতা আমতা করতে লাগলো।
অভিনব ছোট করে শ্বাস নিয়ে বলল
_ আসুন। এভাবে বসে আছেন যে পানিতে নামার ইচ্ছে নেই ? ধ্যান কোথায় থাকে ? এতো ডাকার পর ও কোনো রেসপন্স পাই না।

ঝিল কয়েক সেকেন্ড ভেবে লম্বা শ্বাস নিলো। অভিনব ভাবুক দৃষ্টিতে তাকাতেই ঝিল মেকি হাসি দিয়ে বলল
_ আসলে আপনি তো আমার আগেই নেমে গিয়েছেন।
আমি তো সাঁতার জানি না। তাই লাইফ জ্যাকেট সহ ও ভয় হচ্ছে খুব ।

_ আপনার কি পানি তে ফোবিয়া আছে ?

_উহহু

_ তাহলে সমস্যা কোথায়? আচ্ছা আসুন। আমি আছি তো ?

ঝিল মাথা ঝাঁকালো । অভিনব একটু আগে হাঁটতে লাগলো। কোমর অব্দি পানিতে নেমে বলল
_ আসুন। এখনো পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ? সবাই কতো মজা করছে।

_ অভিনব আমার খুব ভয় করছে। মনে হচ্ছে পানিতে নামলেই আমি পরে যাবো। আর সাথে সাথে তলিয়ে যাবো । এই বয়সে জীবন ত্যাগ করা কি ঠিক হবে?

_আরে কিছু হবে না আসুন। একটু পানিতে ই তো নামবেন ।

_ না নাহ আমি এখানেই ভালো আছি। আপনি থাকুন আমি যাই।

_ ঝিল আমার কথা শুনুন। আরে ঝিল

অভিনবর কথায় পাত্তা না দিয়েই ঝিল আরেকটু উপরে উঠে গেল। পচন্ড ভয় হচ্ছে। যদি ও পানি গুলো দেখতে বেশ লোভনীয় তবে প্রানের থেকে বেশি নয়।
অভিনব দাঁতে দাঁত চেপে রইলো। এই মেয়েটা খুব বেশি করছে । এভাবে একদম ই মজা করতে পারবে না। শেষে তাকেই দোষ দিবে।
অভিনব সাত পাঁচ না ভেবেই উঠে আসলো । এবার ঝিল কে টেনে নামিয়ে নিলো। ঝিল তো নামবেই না। প্রচন্ড ভয়ে বেচারির গলা শুকিয়ে কাঠ । শুষ্ক গলা তেই বার বার ফ্যাচ ফ্যাচ করে বলছে
_ আমি নামবো না । প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন।

_ উহহু নামতে হবেই। আমি একা একা নামছি না। সবাই যে যার বউ গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি কিনা দেবদাশ হয়ে বসে থাকবো ।
তা ও আমার বিয়ে করা বউ পাশে থাকতে।

শেষের কথা টা অভিনব চোখ টিপেই বললো। কথা টা ঝিলের কানে কর্নপাত হতেই ঝিল দমে গেল। অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। বউ কথা টা কারো মনের কোনো এমন সুখ এনে দিতে পারে তা জানা ছিলো না। কি অদ্ভুত এ দুনিয়া। আজ যেটা বিরক্তির কারন হয়ে আছে সেটা হয়তো কাল সব থেকে বেশি সুখ এনে দিবে।
ঝিল অদ্ভুত ভাবে অভিনবর দিকে তাকিয়ে আছে । অভিনবর দৃষ্টি সামনের দিকে। অভিনব যদি একবার পেছন ঘুরে তাকাতো তাহলে নির্ঘাত প্রান হারাতো ঝিল। উরু সমান পানিতে নামতেই ঝিলের ধ্যান ফিরলো। ভয়ে ফুটো বেলুন হয়ে অভিনবর সাথে লেপ্টে গেল। অভিনবর ভেজা শার্ট টাই খামছে ধরলো । যেন ছেড়ে দিলেই ওহ পরে যাবে।
অভিনব মৃদু হাসলো । দু হাত পেছনে নিয়ে ঝিলের হাত টা নামিয়ে দিলো । ঝিল অসহায় দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। অভিনব তার রাঙা ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি এনে ঝিলের দু বাহু চেপে ধরলো। ঝিল শিউরে উঠলো। অভিনব এক হাতে ঝিল কে জড়িয়ে ধরে খানিকটা উঁচু করলো। বুক সমান পানিতে এসে ঝিল কে ছেড়ে দিলো। ঝিলের নাক অব্দি পানি চলে এসেছে। ঝিল জাপটে ধরলো অভিনব কে। অভিনব একটু হাসলো। লাইফ জ্যাকেট থাকার পর ও ঝিল ভয় পাচ্ছে । অভিনব ধীর হাতে ঝিলের লাইফ জ্যাকেট খুলে ফেললো। ঝিল চমকে তাকালো। অভিনবর চোখে মুখে খুশির ঝলকানি। ঝিল বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।
_ ভরসা করতে পারবেন আমায় ?

ঝিল চমকে তাকালো। অভিনব উত্তর পাওয়ার আসায় রয়েছে। ঝিল আড়ষ্ঠতা কাটিয়ে মাথা ঝাঁকালো । অভিনবর ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি ফুটে উঠলো । সে সাঁতারে দু বার চ্যাম্পিয়ান হয়েছে। তাছাড়া পানির সাথে বেশ ভালো সখ্যতা তার। কত বড় বড় সাগরে ও সাঁতার কেটেছে। যদি ও সাথে সেফটির নানা জিনিস পত্র রেখেছে । তবু ও নিজের প্রতি এইটুকু নি ভরসা আছে।
অভিনব মুচকি হেসে ঝিল কে নিজের পায়ে নামিয়ে দিলো। ঝিল অবাক চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো
_ আপনার কষ্ট হবে না ?

অভিনব মৃদু হাসলো। এক হাতে ঝিলের নাক টিপে দিয়ে বলল
_ আপনি বোধহয় জানেন না পানি তে সব কিছুর ভর কমে যায়।
সেই হিসেবে একটু ও কষ্ট হচ্ছে না। তাছাড়া আপনার সামন্য ওজন বহন করার ক্ষমতা অভিনব রাখে মিসেস।

ঝিল লজ্জা পেল। আজকাল অভিনব তাকে বেশ লজ্জা দিচ্ছে। মিসেস বলার কারন টা সঠিক বুঝে উঠতে না পারলে ও অভিনব তার প্রতি যে দুর্বল তা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে । ঝিলের খুব লজ্জা হচ্ছে।

ঝিলের লজ্জা মাখা মুখ টা অভিনব কে অবাধ্য করে দিচ্ছে। নিজের কিশোর বয়স টা অনুভব করছে। যদি ও ঝিল তার স্ত্রী তবু ও তাঁদের সম্পর্ক যে স্বাভাবিক নয়।
তাই অভিনব নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না নিজেকে দমিয়ে রাখতে। অভিনবর এক হাত ঝিল কে জড়িয়ে আছে। অন্য হাতে ঝিলের কপালে পরা চুল গুলো কে গুছিয়ে দিতে লাগলো।
অভিনবর হাতের স্পর্শ কপালে লাগতেই ঝিল চোখ বন্ধ করে নিলো।
অভিনব একটু ঝুঁকে ঝিলের কপালের সাথে কপাল মিলিয়ে নিলো। ঝিল চমকালো, সাথে খামচে ধরলো অভিনবর শার্ট। অভিনবর নিশ্বাস গুলো ঝিলের মুখে এসে লাগছে । আর ঝিলের উষ্ণ নিশ্বাস আঁচড়ে পরছে অভিনবর গলায় । তাতেই অভিনব শিউরে উঠলো। এ কেমন প্রেম ময় অনুভূতি । এই সামান্য স্পর্শ গুলো কেন অসামান্য লাগছে। ঝিল হঠাৎ করেই অভিনব কে জরিয়ে ধরলো । চোখ বন্ধ করেই অভিনবর বুকে মাথা রাখলো। তার চোখের পাপড়ি গুলো কাঁপছে । অভিনব বুঝতে পারলো মেয়েটা তাঁর সাথে একদম ই লেপ্টে আছে। হয়তো নিজের ধ্যানে ই নেই।
অভিনব ঝিল কে ছাড়াতে চেয়ে ও ছাড়ালো না। শুধু ঝুঁকে মুখ টা ঝিলের কানের কাছে নিয়ে আসলো। ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া ঝিলের কানে পরতেই ঝিল যেন হারিয়ে গেল। নিজে কে পাগল মনে হচ্ছে। অদ্ভুত শিরশিরানি তে ছেয়ে গেছে শরীর। ভালো লাগার সাথে লজ্জার মিশ্র অনুভূতি নেশাক্ত করে তুলেছে।
অভিনব হঠাৎ করে ঝিলের গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। ঝিল চোখ মেলে তাকালো। অভিনব চোখ দুটো বন্ধ করে আছে। ঝিল নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো না তবে একটু উঁচু কন্ঠে বলল
_ অভিনব।

অভিনবর কানে সে ডাক পৌছালো নাকি সন্দেহ তবে ঝিল কে আরেকটু চেপে ধরলো। গালের সাথে গাল মিলিয়ে ফিস ফিস করে বলল
_ কখনো কেউ এভাবে পানিতে নেমে ভালোবাসার কথা বলেছে কি না জানি না। তবে আমার খুব ইচ্ছে করছে বলতে। খুব ইচ্ছে করছে দু একটা চুম খেয়ে নিতে।
আমি জানি না কখন তোমার প্রতি ঝুঁকে গিয়েছি। তবে জানি তুমি ছাড়া আমরা ভাবনা গুলো ক্রমশ দুর্বল হয়ে পরছে। ভাবনার এক অংশ জুড়ে শুধুই তুমি।
আমি তোমাকে ভালোবাসি ঝিল।
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_28

ঝিল নিরব হয়ে আছে। অভিনব ঝিলের রেসপন্স না পেয়ে তাকালো। ঝিল চোখ মুখ এমন ভাবে খিচে আছে যে তার কানে অভিনবর বলা শব্দ গুলো পৌছে নি।
অভিনব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালো। নিজের অনুভূতি গুলো বলে ও কোনো লাভ হলো না। ফোঁস করে দম ফেললো।আলতো স্বরে ঝিল কে ডাকলো । কিন্তু ঝিলের কান আপাততো বন্ধ হয়ে আছে। সে কিছুই শুনতে পেল না।
অভিনবর কপালে বিরক্তির রেখা ফুটে উঠলো। উপায় না পেয়ে শক্ত করে ঝিলের কোমর জড়িয়ে ধরলো।
তারপর ই পানি তে ডুব দিয়ে নিলো। হঠাৎ আক্রমনে ঝিল পানি খেয়ে ফেললো। অভিনব দাঁতে দাঁত চেপে বলল
_ ধ্যান কোথায় থাকে হুহহ ?

_ আপনি এটা কি করলেন ? এভাবে কেউ না জানিয়ে ডুব দেয় ? একটুর জন্য আমার প্রান টা যাচ্ছিলো। আর বকছেন কেন ?

অভিনব কিছু বললো না। মেজাজ টা প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। এতো কষ্ট করে মেয়েটা কে ভালোবাসি বললো। অথচ এই মেয়েটা কিছু ই শুনে নি।
অভিনব ঝিলের দিকে তাকাতেই কেমন নুইয়ে গেল। ঝিল কেমন বোকা বোকা হয়ে তাকিয়ে আছে। অভিনবর বেশ মায়া হলো। শুধু শুধু মেয়েটার উপর রাগ দেখালো। ঝিল হঠাৎ করেই ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদতে লাগলো। অভিনব কেন তার উপর রেগে গেল?
কখনো তো রেগে যায় নি। খুব কষ্ট হচ্ছে। অভিনব খানিকটা পানি নিয়ে ঝিলের মুখে ছিটিয়ে দিলো। ঝিল তাকালো না। অভিনব ফোঁস করে দম ফেলে বলল
_ এই ঝিল রাগ করেছেন ? নাকি অভিমান করেছেন ? আমার দিকে তাকান না একুট।

ঝিল কিছু বললো না। অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিলো। অভিনব ফিক করে হেসে বলল
_ বাচ্চা বাচ্চা লাগছে না তো। এতো আল্লাদ কেন করছেন ?

_ অভিনব।

_ ঝিল।

_ আপনি

_ আপনি

ঝিল মুখ ফুলিয়ে নিলো। এটার কোনো মানে হয় ? ওর সাথে সাথে কথার রিপিট করছে। অভিনব এক হাত উঁচু করে দিয়ে বলল
_ ওকে ওকে আর কিছু বলছি না। বাট গোমড়া মুখ করবেন না প্লিজ। একদম বিদঘুটে লাগে।

ঝিল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। তারপর ই ফিক করে হেসে দিলো। অভিনব ও হাসির তালে তাল মেলালো। অভিনব লাইফ জ্যাকেট টা ঝিল কে পরিয়ে দিলো। ঝিল তখন চোখ বুঝে নিয়েছে। অভিনবর স্পর্শ লাগতেই কেমন শিউরে উঠছে। ঝিল চোখ মেলে তাকালো।
ঝিলের এক হাত শক্ত করে ধরে মৃদু হাসলো অভিনব। ঝিল এক দৃষ্টি তে অভিনবর দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার এতোটা কাছাকাছি ভাবতেই ঝিলের অন্তরআত্মা ধুকপুক ধুকপুক করছে। অভিনব মৃদু হাসি ফুটিয়ে ঝিলের মুখে ফু দিলো। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো ঝিল। অভিনবর ভারী নিশ্বাসে ঝিল কেঁপে কেঁপে উঠলো। চোখ খোলার অবকাশ পেল না। তার আগেই ঝিল কে নিয়ে সাঁতার কাটতে লাগলো অভিনব। ঝিল ঝরা হাসলো । ছেলেটার আর কতো গুন দেখবে ওহ ?

অভিনব কে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই ঝিল কে লজ্জা দিতে অভিনব বলল
_ আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন না ভালোই লাগছে।

ঝিল মৃদু হাসলো। কোনো দিকে না তাকিয়ে অভিনবর বুকে মাথা রাখলো। অভিনব এক হাতে সাঁতার কেটে যাচ্ছে। ঝিল সে দিকে পাত্তা দিলো না। অভিনবর বুকে মাথা রেখেই পানির এলোমেলো ঢেউ উপভোগ করতে লাগলো। জীবনে প্রথম সাঁতার কাটছে ওহহ। ছোট সময়ে ভাইয়া রা সাঁতার কাটতো আর ওহহ পাড়ে বসে থাকতো। কারন পানিতে নামতে বেশ ভয় হতো। ধীরে ধীরে ভয় টা অনেক টাই কেঁটে গেছে।

অভিনব প্রায় ত্রিশ মিনিট পর ঝিল কে নিয়ে উঠে আসলো। সবাই ভিজে একাকার। ট্রাভেল এজেন্সি র লোকে রা আস্ত খাসির বারবিকিউ কেটেঅ সবাই কে প্লেটে করে দিয়ে দিলো। শীতের মাঝে গরম গরম বারবিকিউ । সবাই বেশ তৃপ্তি করেই খেল। একটু দূরে চেঞ্জিং সেন্টার এর মতো জায়গা তে গিয়ে একে একে চেঞ্জ করে নিলো। ( এটা আমার সঠিক জানা নেই )

ঝিল চেঞ্জ করছে দেখে অভিনব বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেই সুযোগেই মাহেরা এসে অভিনবর গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। অভিনব ভদ্রতার খাতিরে হাসলো। এবার সত্যি ই খুব বিরক্ত হচ্ছে ওহ। তবু ও মুখে হাসি ফুটিয়ে রাখলো।

_ ওয়াও অভিনব ইউ লুকিং সো কুল। ভেজা চুল গুলো আই কান্ট এক্সপ্লেইন।

অভিনব বিরক্তি টি ঠেলে অপ্রস্তুত হাসলো। ঝিল বের হতেই অভিনব সে দিকে পা বাড়ালো। মাহেরা খানিকটা মন খারাপ করে নিলো।
অভিনব তাকে একবার দেখলো ওহ না ? এতো সুন্দরী হওয়ার পর ও কি অভিনব তাকে পছন্দ করবে না ?

মাহেরার মুখ টা মলিন হয়ে গেল। মুহুর্তেই হাসি খুশি মুখে কালো মেঘ নেমে আসলো। কপালে পারলো দুটো সূক্ষ্ম ভাঁজ। অভিনব ঝিলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে । মাহেরা রাগ হলো খুব। নিজেকে সামলে নিয়ে চলে গেল। কোনো কিছু করতে হবে। না হলে অভিনব কখনোই তার হবে না।

_ অভিনব আমরা কি বাঘ দেখতে পাবো না ?

_ কেন পাবো না ? অবশ্যই পাবো। টাইগার হিলে বাঘ দেখার চান্স আছে।

_ সত্যি ?

_ হুমমম। একটু এদিকে আসুন তো।

ঝিল অভিনবর দিকে এগিয়ে গেল। অভিনব মৃদু হাসি ফুটিয়ে ডান হাতের আঙুল দিয়ে ঝিলের কপালের পানি মুছে দিলো। ঝিল লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বলল
_ থ্যাংকস।

_ থ্যাংকস? এটা তো আমার চাই না।

_ তাহলে ?

_ আমার একটা মিষ্টি বউ চাই। একটা বিয়ে করবো। আপনার চেনা জানা কেউ আছে নাকি ?

ঝিল ভ্রু কুঁচকে নিলো। অভিনব বহু কষ্টে নিজের হাসি চেপে রেখেছে। ঝিলের চোখ দুটো কেমন চিন্তিত লাগছে। অভিনব ভাবলো এই বুঝি ঝিল তাকে কিল ঘুষি মেরে দিবে। কিন্তু ঝিল অভিনব কে অবাক করে দিয়ে শুধু হাসলো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে অন্য বাহু বুলিয়ে বলল
_ আছে তো। তবে তার আগে আমাদের ডিভোর্স টা হয়ে যাক ?

অভিনব বোকার মতো চেয়ে রইলো। ঝিল কি কোনো ভাবে চাচ্ছে না সম্পর্ক টা রাখতে ? তাহলে ঝিলের চোখে যে ভালোবাসা সেটা কি করে মিথ্যে হতে পারে ? চিন্তায় চোখ দুটো কেমন দেখাচ্ছে। ঝিল হালকা হাতে অভিনব কে ধাক্কা মেরে দিলো।
হঠাৎ আক্রমনে অভিনব তব্ধা খেল। তবে যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে হালকা হাসলো । তবে সে হাসি টা প্রশস্ত হলো না। ঠোঁটের কোন থেকেই উবে গেল। ঝিলের মনের ভেতর ভাঙচুর হচ্ছে। অভিনব সত্যি বিদেশী দের মতো দেখতে একটা মেয়ে কে ডিজার্ভ করে। কিন্তু ঝিল কি করবে ?
অভিনব যে তার সাথে থাকতে চায় না। ঝিলের চোখ দুটো ভিজে গেল। ভেজা পাপড়ি মেলে লম্বা হাসলো।
_ মাহেরা আপু কে কেমন লাগে ? আই থিংক সি লাভস ইউ। দেখতে পারেন , আপি তো খুব সুন্দরী।

এই মুহুর্তে অভিনবর মুখ টা হলো দেখার মতো। ঝিল যদি একটু আঁচ করতে পারতো তাহলে কখনোই এমন কথা বলতো না। অভিনবর চোখ দুটো ঝিল কে ভস্ম্য করে দিতে চাইছে। এই মেয়ে নিজের বর কে অন্যের বর বানানোর জন্য উঠে পরে লেগেছে।
ঝিলের গালে ঠাস ঠাস দুটো বসিয়ে দিতে পারলে শান্তি হতো।
কতো বড় সাহস মেয়েটার। আজকাল ঝিলের আচারন তো আকাশচুম্বি । আর আলোর থেকে ও অধিক গতিসম্পন্ন তার সাহস।
অভিনব বিরক্তি তে নাক কুঁচকে নিলো । ঝিলের দিকে একবার ফিরে বলল
_ আসুন।

ঝিল মাথা ঝাকিয়ে হাঁটা লাগালো। সময় গুলো থমকে কেন যাচ্ছে না । সূর্য্যি মামা কি পারে না সময় টা কে থমকে দিতে। তাহলে ঝিল এক দৃষ্টি তে শুধু অভিনব কে দেখতো। কিন্তু চিরন্তন সত্য গুলো বোধহয় বদলানো সম্ভব নয়।
ঝিল মলিন হাসলো। ভাগ্য বিড়ম্বনা নিয়ে বেশ চিন্তিত সে।

মাহের তার বউ কে জড়িয়ে পোজ নিচ্ছে। তা দেখে সবাই হো হো করে হাসছে। কারন পোজ টা হয়ে গেছে উল্টো।
মাহের মেকি হাসি দিয়ে ঠিক জায়গায় চলে আসলো। সবাই কে হাসানোর জন্য ই এমন টা করেছিলো সে।

আমরিন মাহের এর পেটে গুঁতো মেরে দিলো। মাস পাঁচেক হয়েছে বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা এখনো উল্টো পাল্টা কাজ করে। আগে না হয় বয়েফ্রন্ড ছিলো এখন তো হাসবেন্ড। সব বিষয়ে মজা করা টা কি ঠিক ?

আমরিন এর মুখ দেখেই মাহের দমে গেল। আমরিন কে জড়িয়ে আরো কিছু ছবি তুলে নিলো। ছবি গুলো অমিত তুলে দিচ্ছে আর শিষ বাজাচ্ছে। দুজনের জুটি টা অসাধারন। কলেজে সবাই বলতো এরা বেস্ট কাপল। কারন এরা ঝগড়া করতো ঠিকি তবে কখনো রেগে রাখতো না। আর তার জন্য ই ছয় বছরে রিলেশন পূর্নতা পেয়েছে ।

অভিনব স্মিত হাসি রেখে ঝিলের দিকে তাকালো। ঝিল ও তাকালো। যে চোখে ঘাড়েল হলো অভিনব। এতো এতো আকর্ষন কেন মেয়ে টার মাঝে । এই রহস্য ময় অনুভূতি গুলো যেমন কষ্টের । ঠিক তেমনি দারুন সুখের। প্রিয় মানুষটাকে পুরোপুরি নিজের করে নিতেই পারলেই এর সার্থকতা ।
অভিনব চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো। কিছু তেই ঝিলের হাত ছাড়বে না ওহ।
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_29

জামতলা সি বিচ থেকে সবাই হাঁটা লাগালো। সময় পাঁচ টার কাছাকাছি। ছয়টায় সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তাই গার্ড রা বললেন টাইগার হিলে যাবে না। কিন্তু সবাই নাছোড়বান্দা। তাই এজেন্সির সবাই রাজি হলেন ।
সবাই সাড়ি বদ্ধ হয়ে হাঁটতে লাগলো। বনের ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা দূরে টাইগার হিলের তিন টা পয়েন্ট আছে। সচরাচর ভাবে 1 আর 2 নাম্বারে পর্যটক দের আনা গোনা বেশি। তাই বাঘ সেখানে আসতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না।
কথা টা শুনেই সবার মুখ চুপসে গেল। বাঘ দেখার সম্ভাবনা একদম কম। তবে বাঘের ছাপ দেখা যাবে 100%। তাতে কী মন ভরে ?
সবাই মনস্থির করলো তিন নাম্বার টিলা তে যাবে। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াতে গার্ড বললেন রিক্স আছে। সবাই সেটা কে পাত্তা দিলো না। সবার ভাষ্য মতে এক ঘন্টায় টাইগার টিলা ঘোরা যাবে।
অবশেষে সবাই কে নিয়ে রওনা হলো টাইগার টিলা। সামনে দুজন গার্ড আর পেছনে দুজন। পড়ন্ত বিকেল হওয়াতে গা ছমছম ভাব। ভুতুরে অনুভূতি নিয়ে সবাই হাঁটা লাগালো।
এই দিকটায় একটু কাঁদা কাঁদা ভাব। ঝিল নাক মুখ কুঁচকে হাঁটছে। কাঁদা দেখলেই ওর গা ঘিন ঘিন করে। অথচ বাংলার বিদেশী অভিনব মুখে হাসি ফুঁটিয়ে রেখেছে। যেন রোজ এক গাঁদা কাঁদায় মাখা মাখি করে। কি দিন কাল এলো। ঝিল তপ্ত শ্বাস ফেলে নিলো। অভিনবর ব্যাগ ধরে ধরে হেঁটে যাচ্ছে। ঝিল ক্লান্ত হয়ে পরেছে। অভিনব হাত বাড়িয়ে দিয়ে ইশারা করলো। ঝিল মৃদু হেসে হাতে হাত রাখলো । অভিনব একবার ভাবলো হাতে চুমু খাবে পরক্ষণেই চিন্তা বদলিয়ে হাঁটা লাগালো।

গেওয়া , কেওড়া গাছ ছাড়া ও হাজারো গাছের ছড়াছড়ি তার ই মাঝ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সবাই। মুখে চঞ্চলতা যেন উপচে পরছে। উদ্দেশ্যে বাঘ মামা কে দেখা।
জঙ্গলে গিয়ে নিজ চোখে বাঘের দেখা মেলা ভার। তবে চেষ্টা চালিয়ে গেলে নিশ্চয়ই দেখা মিলবে। তবে নিতে হবে প্রানের ঝুঁকি। কিছু পেতে হলে অবশ্যই পরিশ্রম করতে হয়।
দিন শেষে সেটাই সার্থকতা। হাতের কাছে পাওয়া জিনিসের কদর নেই। কিন্তু খুব কষ্ট করে যদি পঞ্চাশ টাকা ও অর্জন করা হয় । তাহলে সেই টাকা খরচ করতে গেলে বুক কেঁপে উঠবে। কষ্ট করে পাওয়া ফল এর প্রতি অদৃশ্য ভালোবাসা জন্মে যায়। আর সেই সুবাদে মায়া আর রেশ একটু বেশি দিন স্থায়ী হয়।

একে তো পরন্ত বিকেল তার উপর গাছ গাছালির কারনে সূর্যের আলো ঠিক মতো পৌছাতে পারে নি।
সাথে বিন্দু বিন্দু কুয়াশা নেমে এসেছে। নিঃসন্দেহে এখানে হরর মুভি করা যাবে। এডভেঞ্চার টা একটু বেশি ই লোভনীয় । একজন প্রকৃত প্রেমি ই জানে এর কদর ঠিক কতো খানি। কারন প্রতি টা গাছের সাথে তার আলাদা সক্ষতা থাকে। সে ভালোবাসে সেই গাছ গুলো কে কিংবা প্রকৃতির প্রতি টা সৌন্দর্য কে।
_ কষ্ট হচ্ছে ঝিল ?

_ উহুহহ একদম ঠিক আছি আমি।

_ একটু পানি কিংবা গ্লুকোজ খেয়ে নিন ভালো লাগবে ।

ঝিল মাথা ঝাঁকালো। অভিনব ব্যাগ থেকে গ্লুকোজ বের করে ঝিলের দিকে বাড়িয়ে দিলো। ঝিল ধরার আগেই বোতল টা সরিয়ে নিলো। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ঝিল। অভিনব রোদ্দুরে মেঘের মতো মুখ টা কালো করে নিলো। ঝিল প্রশ্ন ছুড়বে ঠিক তখনি বলল
_ আমি খাইয়ে দেই ?

ঝিল যেন নিজ কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না। হতবুদ্ধি হাড়িয়ে নির্লজ্জের মতো অভিনবর দিকি তাকিয়ে আছে। অভিনব উত্তরের অপেক্ষা করছে। মুখের ভাব ভঙ্গি বলে দিচ্ছে সে চিন্তিত। অভিনবর কথা টা খেয়াল হতেই ঝিল মাথা নিচু করে নিলো। কয়েক সেকেন্ড লজ্জা হাসলো। তারপর স্বাভাবিক হয়ে মাথা ঝাকালো। সম্মতি পেয়ে অভিনবর মুখের কোনে তৃপ্তির হাসি এলো। বোতলের ক্যাপ খুলে ঝিলের মুখের সামনে ধরলো। ঝিল একটু খেতেই অভিনব একি স্থান থেকে গ্লুকোজের পানি খেল। যেটা ঝিলের অগোচরে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঝিলের ঠোঁটের কোনে জমে থাকা পানি টুকু মুছিয়ে বলল
_ ব্যাস। নাও লুকিং ইউ পারফেক্ট।

_ এন্ড লুকিং ইউ সো ব্যাড দ্যাটস লাইক অ্যা জাঙ্গেল।

কথা টা ঝিল রসিকতার ছলেই বলল। অভিনব মৃদু হেসে শাহাদাত আঙুল টা ঝিলের নাকে স্লাইড করে বলল
_ নো নিড টু পারফেক্ট লুকিং । বিকজস আম অলরেডি ম্যারেড।

অভিনবর কথাতে ঝিল অবাক হলো। ঠোঁট প্রশস্ত করবে তার আগেই অভিনব বলল
_ এখনো তো ডিভোর্স হয় নি তাই না ? হয়ে নিক তারপর পারফেক্ট লুক থেকে যা যা হওয়ার সব প্লান করবো।

ঝিলের মুখ টা বিষিয়ে গেল। কুয়াশা ভেদ করে বোধহয় এক পাউন্ড কালো মেঘ এসে ঝিলের মুখে ভর করলো। তবে তেমন কিছু না বলে হাঁটা লাগালো। অভিনব কে পেছনে দাঁড়িয়ে পরতে দেখে ঝিল মুখে শুধু বলল
_ চলুন।

*

টাইগার টিলার কাছাকাছি চলে এসছে সবাই। এখানে হরিনের পরিমান অনেক বেশি। তাই বোধহয় এর নাম টাইগার টিলা। কারন হরিন হলো বাঘের শিকার। তবে এমন নয় যে টিলা নাম মানেই পাহাড়ের মতো উঁচু কোনো জায়গা। সমতল থেকে একটু উঁচু নিচু জায়গা রয়েছে । আশে পাশে বাঘের পায়ের ছাপ । মাটির কয়েকটা হাঁড়ি ভাঙা অবস্থায় পরে আছে।
সবাই একটু একটু ঝুঁকে নিয়ে বাঘের পায়ের ছাপ দেখছে। এক্সাইট মেন্ট খুব বেশি। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে গেছে। ছোট ছোট জঙ্গলের মাঝেই বাঘ লুকিয়ে থাকে। কোথাও শিকারের দেখা মিললেই ঝাঁপিয়ে পরবে। সবাই কে সাবধান হতে বলা হলো। কেমন নিটাল ঠান্ডা পরিবেশ। কিছু পাখির আনা গোনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রচন্ড গা ছমছম ভাব। বাঘের থেকে ভুতুরে পরিবেশ বেশি মনে হচ্ছে। ঝিল কেমন চুপসে গেছে। অভিনবর তীক্ষ্ম দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোনো আওয়াজ ও যেন তার নখ দর্পনের বাইরে না যায়।
ঝিল বার বার কেঁপে উঠছে। অভিনবর দৃষ্টি ছুটে গেল। ঝিল কে এক হাত জড়িয়ে ধরে বলল
_ একদম ভয় নয় । আমি আছি না ? আমি থাকতে কিচ্ছু হতে দিবো না।

ঝিলের চোখ ছলছল করছে। আবারো মিশ্র অনুভূতি সাথে ভয় সব কেমন তাল গোল পাকিয়ে গেছে।

অভিনব এক অসীম সাহসিকতা নিয়ে কাজ টা করেই ফেললো। ঝিলের হাত দুটো মুঠো বন্দী করে পর পর দুটো চুমু খেল । ঝিল শিউরে উঠলো। অভিনবর দিকে অবাক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে। অভিনব সে দিকে পাত্তা না দিয়ে ঝিলের হাত টা বুকে ছোঁয়ালো। ঝিল ঝটপট হাত নামিয়ে নিলো। অভিনবর একটা হার্টবিট অনুভব করলো তাতেই যেন আকাশ পাতাল সব ভেঙে আসলো। অভিনব ঝিলের এক হাত ধরে এদিক সেদিক তাকালো। সবাই জঙ্গলের ভেতরে জড়সড়ো হয়ে আছে। অভিনব আর ঝিল একটু দূরে ছিলো ।
অভিনব স্পষ্ট অনুভব করলো বাঘের আওয়াজ। একজন প্রকৃত ট্রাভেলার হিসেবে এটা স্বাভাবিক । তাছাড়া অভিনব বেশ কয়েকটা জঙ্গলে গিয়েছিলো। সেখানে বাঘের সাথে সাক্ষাৎ ও হয়েছে। বিভিন্ন ট্রেনিং ও নেওয়া আছে তাঁর ।
অভিনব সবাই কে গলা উঁচিয়ে বলল
_ সবাই সাবধান হয়ে যাও। আশে পাশে বাঘের উপস্থিতি রয়েছে।

সবাই প্রথমে ভরকে গেলো। তবে কথায় আছে না যেখানেই যাও দু একটা পন্ডিত তো থাকবেই। তেমনি দলের দুজন অভিনবর কথায় পাত্তা দিলো না। অভিনব ভ্রু কুঁচকে নিলো। ছেলে দুটো কটকা থেকে ওদের সাথে জয়েন হয়েছে। স্পেশাল রেফারেন্স এ , কারন এখানে আসার পর তাদের এজেন্সি ভুল ক্রমে তাদের রেখেই চলে গেছে।
আর তারপর ই অভিনব দের সাথে যোগদান করেছে।

অভিনব বার বার সর্তক করলো কিন্তু ছেলে দুটো শুনলো না। বন বিভাগের গার্ড রা বাঘের উপস্থিতি অনুভব করছে না। তাই তারা ও তেমন পাত্তা দিলো না। অভিনব ফোঁস করে দম ফেললো। আজ কিছু একটা হবেই। এরা কেউ ই অভিনবর কথায় সাড়া দিলো না।

মাহের অভিনবর কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস করে বলল
_ হয়তো তোমার অনুমান সঠিক। কিন্তু এখন আমাদের আগাতে হবে।

অভিনব ও কিছু বলল না। বেশি কিছু বললে নিঃসন্দেহে ওকে সবাই পাগল বলবে। তবে মাহেরা অভিনবর প্রতি টা কথা বিশ্বাস করলো। যদি ও সেটা ভালো লাগার খাতিরে। তবু ও অভিনবর আকর্ষন পেতে সে সর্তক হলো। খানিকটা কাছাকাছি এসেই দাঁড়ালো। যদি ঝিল আর অভিনব এক সাথে না থাকতো। তাহলে মাহেরা অভিনবর হাত টা খামচে ধরতো। কিন্তু তা হলো না কারন ঝিলের হাত টা অভিনব ধরে আছে।

অভিনবর প্রতি পূর্ন বিশ্বাস ঝিলের। ভয়ে বুক কাঁপাকাপি শুরু হয়ে গেছে। ছোট সময়ে বাঘ মামা কে দেখার বড্ড শখ জেগেছিল। পাপারা চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়েছিলো। বাঘ দেখে ঝিল কি কান্না টাই না করেছিল। তবে বড় হওয়ার সাথে সাথে অনুভূতি গুলো ঝুঁকে গেল। বাঘের দেখা পাওয়ার ইচ্ছে হলো। তবে এখন মনে হচ্ছে এমন ইচ্ছে না করলেই ভালো হতো। ভ্যাগা ভ্যাগা দৃষ্টি তে অভিনবর দিকে তাকালো।
অভিনব ঝিলের চোখের সামনে আসা দুটো চুল ফু দিয়ে সরিয়ে দিলো।
_ উহহুহ একদম না। অভিনব যতো দিন আছে ঝিল ও থাকবে।
বাঘ তো সামান্য কিছু ঝিলের জন্য সব কিছুর সাথে লড়াই করবে অভিনব ।

দু চোখের কোন বেয়ে পানি ঝরে গেল ঝিলের। অভিনব সন্তর্পণে ঝিলের দু চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
_ আপনি এখনো আমার স্ত্রী ঝিল। মানছি আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। আমাদের মাঝে স্বামী স্ত্রীর মতো আচারন নেই। কিন্তু আমরা তো বন্ধু তাই না ?

ঝিল কান্নারত মুখেই হেসে দিলো । আচমকা অভিনব কে জড়িয়ে বলল
_ উহুহহ বন্ধু নয় খুব ভালো বন্ধু আপনি।

_ আচ্ছা আমি খুব ভালো বন্ধু। এখন ঝিলের চোখ থেকে যেন পানি না ঝরে।

ঝিল হাসলো। অভিনব চোখের পানি মুছিয়ে হাঁটা লাগালো। সবাই আগাচ্ছে , অভিনব ও আগালো। বাঘের উপস্থিতি গাঢ় হচ্ছে। অভিনব চিন্তায় পরে গেল।

মান সম্মানের তোয়াক্কা না করে আবার বলল
_ সাবধান হও সবাই কাছেই বাঘ আছে।

সবাই পেছন ফিরে তাকালো। অভিনবর কথা টা কেউ কেউ বিশ্বাস ও করলো। কিন্তু ঐ দুটো ছেলে বিশ্বাস করলো না। অভিনবর প্রতি বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেল।

অভিনব ঝিল কে রেখেই সে দিকে ছুট লাগালো। অভিনবর এমন কান্ডে সবাই অবাক হলো। ঝিল হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বিষয় টা পুরো মাথার উপর দিয়ে গেল।

ছেলে দুটো অনেকটা এগিয়ে গেছে। সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকার চারপাশে ছেয়ে যাচ্ছে।
অভিনব চিৎকার করে ছেলে দুটো কে ডাকলো কিন্তু ছেলে দুটো পাত্তা দিলো না। হো হো করে হেসে অভিনবর মজা উড়াতে লাগলো।
তখনি সবাই বাঘের গর্জন শুনতে পেল। সবার আত্মা কেঁপে উঠলো। গার্ড সবাই কে সামনে যেতে বারন করলেন। ঝিল সবার থেকে খানিক টা পিছে ছিলো। সে কিছু ই বুঝতে পারলো না। তবে কিছু যে হয়েছে তা বুঝতে পারলো।
এতোটাই বিস্ময়কর পরিস্থিতি যে ঝিল স্তব্ধ হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো।
সবাই চিৎকার করছে অভিনবর নাম ধরে। ঝিলের ভ্রু বেঁকে গেল। ঝিল দৌড়ে সে দিকে গেল।

ছেলে দুটোর কাছাকাছি বাঘ চলে এসেছে। এবার দুজনেই ভয় পেয়ে গেল। এতো টাই ভয় পেল যে কান্না করে দিলো। অভিনব ছুটে ওদের কাছে গেল। দুটো কে পিছিয়ে যেতে বললো কিন্তু দুটো ওখানে দাঁড়িয়ে ই কান্না করতে লাগলো।

বাঘ সেই সুযোগ টাই কাজে লাগালো। দৌড়ে আসলো দুটোর দিকে। অভিনব চিৎকার করে উঠলো। ওদের ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো। বাঘের দৃষ্টি এলোমেলো হয়ে গেল। গতি বেশি থাকাতে বেশ অনেক দূর চলে গেল।

ঝিল দূর থেকে সেটাই লক্ষ্য করছিলো। অভিনবর কাছে বাঘ দেখে চিৎকার করলো।
ওদের কাছে অশ্রধারী গার্ড আছে। তাই বাঘ এদিকে আসবে না।
তবে অভিনব ছেলে দুটো কে বাঁচাতে গিয়ে নিজে বিপদের মুখে পরে গেল।
কারন মাঝে বাঘ আর অভিনব তার ওপাশে। গার্ড রা এগোনোর সাহস পাচ্ছে না। বাঘ ভয়ঙ্কর গর্জন করে যাচ্ছে।
অভিনবর উপর ঝাঁপিয়ে পরার আগে সুখের গান গাচ্ছে।
ঝিলের বুক ধরপর করছে। দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে। চিৎকার করে শুধু বলতে লাগলো
_ অভিনব অভিনব অভিনব

ঝিল কে ধরে রেখেছে সবাই অভিনব গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে সবাই কে অনুরোধের সুরে বলল
_ তোমরা প্লিজ ঝিল কে আটকাও। ওনি পাগল হয়ে গেছেন। ওনি বুঝতে পারছেন না কতোটা ভয়ঙ্কর এটা ।
ওনাকে ছেড়ো না প্লিজ।

_ কেউ আমার অভিনব কে বাঁচাও । ওনি ওনি বিপদে আছেন । আমাকে যেতে দাও তোমরা ।
আমি অভিনবর কাছে যাবো। দয়া করো , অভিনব আমি আপনার কাছে আসবো।

বলেই ঝিল মাটিতে বসে পরলো। অভিনবর দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে আছে বাঘ টা। বার বার মাথা ঝাঁকিয়ে গর্জন তুলছে কি বিকট সে শব্দ। হঠাৎ করেই বাঘ টা অভিনবর উপর ঝাঁপিয়ে পরলো। অভিনব নিজে ও অপ্রস্তুত ছিলো। সবাই অভিনব বলে চিৎকার করে উঠলো। ঝিল যেন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। সব কিছু ফেলে সবাই কে সজোড়ে ধাক্কা মেরে ছুটে গেল বাঘের মুখে।
তার মাথায় একটা কথাই কাজ করছে আমার অভিনব কে বাঁচাতে হবে। সবাই চিৎকার করে ঝিল কে ডাকলো। ঝিল শুনলো না। ঝোপের জন্য অভিনব কে দেখা যাচ্ছে না আর না বাঘ টাকে দেখা যাচ্ছে। ঝিলের বুক টা কেঁপে উঠলো। আদৌ কি সে পারবে অভিনব কে বাঁচাতে ?
#ধূসর_রঙের_প্রজাপতি
#ফাতেমা_তুজ
#part_30

ঝিল পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছে। বিস্ময়ে অবাক সবাই। কেউ আগাতে সাহস পাচ্ছে না। ঝিল অভিনব যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো সেখানে এসে দাঁড়ালো । চারপাশে উদভ্রান্তের মতো চোখ বুলাতে লাগলো। কোথাও অভিনব কে দেখতে পাচ্ছে না। বুকের ভেতর চিন চিন ব্যাথা অনুভব হলো। অভিনব কে হারিয়ে ফেলার নীল ব্যাথা ওকে স্তব্ধ করে দিলো।
আলগোছে মাটিতে পরে গেল। তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা।
ঝিল হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলো। অভিনব বলে চিৎকার করে উঠলো। পাগলামির শীর্ষে চলে গেছে। নিজের চুল গুলো নিজেই খামচে ধরে রাখলো। পাগলের মতোই দেখাচ্ছে ওকে।

_ ঝিল, ঝিল

মৃদু শব্দে ঝিল কেঁপে উঠলো। চোখ মুখ মুছে নিয়ে আশে পাশে চোখ বুলালো। অভিনবর কন্ঠস্বর ছিলো ঐ টা ? ঝিল এতোটাই জ্ঞান হীন যে অভিনবর নাম ধরে ডাকতে ও ভুলে গেল। শুধু পাগলের মতো আশেপাশে চোখ বুলাতে লাগলো।
মাথার নিউরন গুলো বোধহয় কানে পৌছাচ্ছে না। বাঘের হালকা গর্জনে ও ঝিলের কর্নপাত হলো না।
হঠাৎ এক শক্ত পোক্ত হাত ওকে টেনে জঙ্গলে নিয়ে নিলো। ঝিলের চোখ দুটো ছলছল করছে। অস্ফুটন স্বরে বলল
_ অভিনব আপ

ঝিলের ঠোঁটের কাছে আঙুল দিয়ে অভিনব বলল
_ হুসসস।

ঝিল দমে গেল। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো অভিনবর দিকে। কি শান্তি এই মুখ টাতে। একটু আগে যে ব্যথায় জর্জরিত ছিলো। সে ব্যাথা টা নিমেষেই উধাও। অভিনব লক্ষ্য করলো কিছু দূরে বাঘ টা ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিকার হারিয়ে ফেলায় ক্রুদ্ধ সে। অভিনব পায়ের কাছে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো। আশে পাশে চোখ বুলিয়ে একটু দূরে মাটির চাকা দেখতে পেল। একটু ঝুঁকে ঝিলের কানে ফিস ফিস করে বলল
_ এখানেই দাঁড়ান ,আমি আসছি ।

_ অভিনব

_ আসছি আমি।

অভিনব চলে গেল। নিঃশব্দে মাটির চাকা টা উঠিয়ে ঝিলের দিকে ফিরে আসলো। ঝিলের মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে হাসলো। ঝিল অশ্রু ভেজা নয়নে তাকিয়ে আছে। চোখের পাপড়ি গুলো নোনা জলে ডুবে আছে। তবু ও মেয়েটাকে কি সুন্দর লাগছে । ঠিক যেন সদ্য পানি থেকে উঠা পদ্মফুল। যার মুখে বিন্দু বিন্দু পানি কনা লেগে আছে।

অভিনব চোখ ফিরিয়ে নিলো । কিন্তু ঝিলের কোনো পরিবর্তন নেই। তার চোখ অভিনব তে আটকে গেছে। অভিনব চোখ ঘুরিয়ে আশে পাশে তাকালো। সুযোগ বুঝেই বেশ জোরে মাটির চাকা টা ফেলে দিলো। মাটির চাকা টা উল্টো দিকের ঝোপঝাড়ে গিয়ে ঝনঝন শব্দ তুললো। সঙ্গে সঙ্গে বাঘ টা সে দিকে হুমড়ি খেয়ে পরলো। ভয়ঙ্কর গর্জনে পরিবেশ ভারী হয়ে গেল।
অভিনব ঝিলের মাথা টা বুকে চেপে ধরে নিচু হয়ে বসলো। চোখ দুটো এদিক ওদিক ঘুরে চলেছে।
মিনিট পাঁচেক পর অভিনব স্বস্তির দম ফেললো। অভিনবর ভারী নিশ্বাসের শব্দ ঝিলের কানে এসে লাগলো। তাতেই ঝিলের ধ্যান ফিরলো। ঝিল উঠে দাঁড়ালো। অভিনব ঝিলের দিকে ঘুরে তাকাতেই ঝিলের দু চোখ দেখে থমকে গেল। মেয়েটার চোখ দুটো থেকে অনড়গল নোনা জলের ফোয়ারা চলছে। অভিনবর বুক টা ভারী হয়ে গেল। চাঁপা কষ্টে অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগলো। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারলে ভালো লাগতো। ঝিল কাঁপা হাত টা অভিনবর বুকে রাখলো। সারা শরীরে হাত বুলাতে লাগলো। মানুষ টা সত্যি ই কি তাঁর সামনে দাড়িয়ে আছে? নাকি সব ভ্রম।

হঠাৎ করেই ঝিল দূরে সরে গেল। মাথা চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। অভিনব বিস্ময়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ঝিলের দিকে এগিয়ে আসতেই ঝিল ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো। কাঁপা হাতে ঝিলের মাথায় হাত বুলিয়ে অভিনব বলল
_ আমি ঠিক আছি ঝিল। আপনি কেন পাগলামো করছেন বলুন তো ? তখন যদি আপনার কিছু হয়ে যেত। সেটা কি খুব ভালো হতো ?

_ আমি আমি আমি অভিনব আমি

_ হ্যাঁ আপনি ?

_ জানি না আমি । কিচ্ছু জানি না। আপনার কিছু হয়ে গেলে আমি কি করে থাকবো ?
বলুন কেন চলে আসলেন এখানে ? একটি বার আমার কথা মনে আসলো না ?

ঝিল কথা গুলো চিৎকার করে বলে কাঁদতে লাগলো।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে ঝিল কে আষ্ঠে পৃষ্ঠে জড়িয়ে নিলো অভিনব । ঝিল নাক টেনে কাঁদছে ।
_ ঝিল এভাবে কাঁদে না। পঁচা মেয়েরা ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদে। দেখি দেখি তো

অভিনব ধীর হাতে ঝিলের মাথা উঁচু করলো। ঝিল নাক টেনে তাকালো। আবার কেঁদে উঠলো। দু হাতে অভিনব কে জড়িয়ে ধরলো। ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল
_ আমি আপনাকে ছাড়বো না আর। একদম দূরে যাবেন না আমার থেকে।

_ যদি কেউ নিয়ে যায় ?

_ দিবো না আমি কাউকে। আমার

ঝিল থেমে গেল । অভিনব ভ্রু নাচিয়ে বলল
_ আপনার কি ?

_ কিছু না।

ঝিল পেছন ঘুরতেই অভিনব টেনে কাছে নিয়ে আসলো। একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল
_ মাহেরা কিন্তু নিয়ে যাবে তখন কি হবে ?

_ আমি কি করে জানবো ? আর তাতে আমার ই বা কি?

_ আপনার কিচ্ছু যায় আসে না ?

_ উহুহ

অভিনব বাঁকা হাসলো। ঝিল কে এক হাতে জড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। ঘুটঘুটে অন্ধকার প্রায়। অভিনব ঝিল কে নিয়ে ঝোপ থেকে বেড়িয়ে পরলো। প্যান্ট এর পকেট থেকে লাইটার বের করলো। লাইটার টা সুইচ সিস্টেম খানিকটা টচ এর মতোই ।
মৃদু আলো তে ঝিলের দিকে তাকালো। লেপ্টে থাকা চুল গুলো কানের কাছে গুঁজে দিতে দিতে বলল
_ আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে ঝিল । এই যে চোখের কোনে লেপ্টে থাকা শুকনো নোনা জল । উজ্জল মুখ টায় চিন্তার ছাঁপ । লেপ্টে থাকা কাজলের ছোঁয়া । সব মিলিয়ে কেমন বউ বউ লাগছে।

ঝিলের চিত্ত কেঁপে উঠলো। অভিনবর জ্যাকেট খামচে ধরলো। অভিনব নিঃশব্দে হেসে বলল
_ তাঁতে আমার কি ? আমি তো মাহেরার ই হয়ে যাবো।

অভিনবর কথাতে ঝিল ভ্রু কুঁচকে নিলো। কনুই দিয়ে পেটে গুঁতো মেরে বলল
_ আগে আমাকে তালাক দিন তারপর মাহেরার গলায় ঝুলে পরবেন কেমন ?

_ ঝিল

_ কি ?

_ আপনার তালাক চাই ?

ঝিল তখনি উত্তর দিতে পারলো না।বেশ কয়েক সেকেন্ড ভাবলো। কিন্তু উত্তর মিললো না। অভিনব ঝিল কে কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হতেই মাহেরার কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।
বিরক্তি তে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো। সাথে সাথে আরো অনেকের ডাক শোনা গেল। অভিনব তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল
_ তাড়াতাড়ি চলুন। সবাই আমাদের খুঁজে চলেছে।

ঝিল মাথা ঝাঁকালো । অভিনব এক হাতে ঝিলের হাত চেপে ধরে আগাতে লাগলো।

*

মৃদু লাইটের আলোর আভাস পেয়েই সবাই ছূটে গেল সে দিকে। অভিনব ঝিলের হাত ধরে হেঁটে আসছে। সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। অভিনব লম্বা করে হাসতেই সবাই এসে এটা ওটা প্রশ্ন করতে লাগলো। অভিনব উত্তর দিলো না। সবার এতো এতো প্রশ্নে ঝিলের ভ্রু বেঁকে গেছে। অভিনব ব্যাথাতুর কন্ঠে শান্ত দৃষ্টি রেখেই বলল
_ জঙ্গল থেকে বের হয়ে বলি ?

সবাই আর কথা বাড়ালো না। হাঁটা লাগালো । পাঁপড়ি এসে ঝিল কে জড়িয়ে ধরলো। হাত বুলিয়ে বলল সে ঠিক আছে কি না ? প্রতি উত্তরে ঝিল শুধুই মুচকি হাসলো। সবাই সাড়ি বদ্ধ হয়ে হাঁটছে । ঝিল পাঁপড়ির সাথেই হেঁটে যাচ্ছে।

_ আর ইউ ওকে অভিনব ? তুমি জানো আমি কতোটা ভয় পেয়েছিলাম ?

_ আম ওকে মাহেরা ।

_ কোথাও ব্যাথা পেয়েছো দেখি তো।

অভিনব হাত উঁচু করে বাঁধা দিলো । কৃতঙ্গতার চোখে বলল
_ আমি ঠিক আছি মাহেরা।

মাহেরা তবু ও শুনলো না । অভিনবর হাত ধরে দেখতে লাগলো। অভিনব বিষয় টা হজম করতে পারছে না। মাহেরার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে বলল
_ তুমি সামনে গিয়ে হাঁটো। আম ফাইন নাও ।

মাহেরা মাথা ঝাঁকিয়ে অভিনবর থেকে দূরে স্বরে গেল।

*

কটকা থেকে সবাই বোর্ট এ উঠে বসলো। একে একে সবাই অভিনব কে প্রশ্ন ছুঁড়লো। অভিনব লম্বা করে দম নিয়ে সেই সময়ের ঘটনা বর্ননা করতে লাগলো।

অভিনব বাঘের আক্রমণের অপ্রস্তুত থাকলে ও নিজেকে সামলে নিয়েছিল। বাঘ টা খাবলে পরার আগেই খানিকটা টা ছিটকে দূরে সরে গেল। বাঘ টা গড়ান গাছের সাথে হালকা বারি খায় আর একটু নড়চড় করে উঠে। অভিনব সেই সময় টা তেই নিজেকে সামলে নেয়। তবে পকেট থেকে লাইটার দিয়ে একটু আগুন জ্বালিয়ে ছিলো তবে বনের ভেতরে আগুন জ্বালালে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশংকা থাকে । তাই অভিনব সেটা ও সরিয়ে নিলো। বাঘ টা আবার ঝাঁপিয়ে পরলো। অভিনবর কান ঘেঁষে একদম। তবে অভিনব দ্রুত লুকিয়ে পরেছিলো। তাই বাঘ টা উম্মাদের মতো বিহেভ করতে থাকে। কারন সে তার স্বীকার হারিয়েছে। তারপর পর ই ঝিল চলে আসে।

অভিনব এক দমে কথা গুলো বললো।অমীত ছেলে দুটো কে বেঘোরে বকতে লাগলো । কারন শুধু মাত্র তাদের জন্য ই অভিনবর এতো বড় বিপদ হয়েছিলো। অভিনব সবাই কে থামতে বলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে নিলো।

ঝিল অভিনবর এক বাহু ধরে বসে আছে। যেন ছেড়ে দিলেই অভিনব কোথাও পালিয়ে যাবে । ঠোঁট খানা প্রশস্ত করে হাসলো। ঝিলের চোখ বন্ধ করা , বোধহয় কোনো কিছু নিয়ে বিশাল গবেষণা চালাচ্ছে ।

অভিনব ধীর হাতে ঝিল কে জড়িয়ে ধরলো। মৃদু আলো তে তা স্পষ্ট দেখতে পেল মাহেরা। বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। অভিনব ঝিল কে জড়িয়ে আছে ভাবতেই গা শিউরে উঠলো। হঠাৎ করেই মাহেরা চলন্ত বোর্ট থেকে পানি তে পরে গেল।
অভিনব সে দিকে হা হয়ে তাকালো । সবাই চিৎকার করে উঠলো। মাহেরা হাত পা নাড়ছে বাঁচার জন্য। অভিনব দেরি করলো না আর পানি তে ঝাঁপ দিয়ে পরলো। কারন সে একদম কর্নারে ছিলো।
মিনিট পাঁচেক পর মাহেরা কে এক হাতে জড়িয়ে বোর্ট এর কাছে ফিরলো অভিনব । সবাই টেনে মাহেরা কে উঠালো।
শাকীলের সাহায্য নিয়ে বোর্ট এ উঠে বসলো অভিনব।
মাহেরার জ্ঞান প্রায় যায় যায় অবস্থা । সবাই মাহেরা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে।
শুধু মাত্র একজন ই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আর সে হলো ঝিল।

মাহেরার বিষয় টা তাকে ভাবাচ্ছে। মাহেরা কি ইচ্ছে করেই পরে গিয়েছিলো। ঝিল আর ভাবতে পারছে না। অসহ্য লাগছে তাঁর । অভিনবর মানসিকতায় বিরক্ত সে।
অতিরিক্ত মনুষ্যত্ব ঝিল কে ক্রুদ্ধ করে দিয়েছে।
ঝিল এক পলক তাকালো। অভিনব মাহেরার হাতে মালিক করে যাচ্ছে। ঝিল আর তাকাতে পারলো না।
চাঁপা কান্নায় ভেঙে পরলো। এতো কেন কষ্ট হচ্ছে তাঁর?
জীবন বড্ড নাটকীয়। এক মুহূর্তের জন্য ঝিলের মনে হয়েছিল অভিনব শুধু তাঁর। কিন্তু এখন সব কিছুই মানবিকতা মনে হচ্ছে।

মিনিট দশেক পর মাহেরার পূর্ন জ্ঞান ফিরলো। মাহের বোন কে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কারন এখন বেশি কিছু ভাবলে মাথায় চাপ পরবে। আর তাঁতে মানসিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
অভিনব ফোঁস করে দম ফেলল । সম্পূর্ন ভিজে একাকার সে।
_ মাহের ব্যাগে এক্সট্রা কাপড় থাকলে মাহেরার শরীরে জড়িয়ে দাও।
ঠান্ডা বাড়ছে , পরে অসুস্থ হয়ে পরবে।

মাহের সম্মতি জানালো। অভিনবর প্রতি কৃতঙ্গতার দৃষ্টি রাখলো । অভিনব শুধু হাসলো ।
মিনিট খানেক পর ঝিলের পাশে এসে বসলো। স্বস্তির দম ফেলে ঝিলের দিকে তাকালো অভিনব । কিন্তু ঝিলের দৃষ্টি অন্যদিকে। অভিনব ভেবেছিলো ঝিল এখন তাঁকে ঠান্ডা থেকে বাঁচানোর নানা পাগলামো করবে ।
কিন্তু কিছুই করলো না। অভিনব খানিক টা কষ্ট পেল।

Maimona tabassum toushi আপু তুমি থাকলে একটু পেজ এ কিংবা আমার আইডি তে হাই লিখে নক দিও তো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here