#নক্ষত্র_বন্দনা
#পর্ব_২
#লেখায়_জারিন
৬.
বিয়েতে আমার পরিবারের পক্ষ থেকে তেমন কোন আয়োজন করা হয়নি। এত সামর্থ্য ছিল কই আমাদের। তবে এই নিয়ে আমার শশুড় বাড়ির কেউ কোন উচ্চবাচ্য করেনি। বিয়েতে তাদের পক্ষ থেকেও তেমন কেউ আসেনি কেন জানি। ভাবী বলেছিল, ছেলে নাকি শুধু তার দু’বোন, কয়েকজন বন্ধু, নিকট আত্মীয়র কয়েকজন মুরুব্বীদের এবং তার কাজিনদের নিয়ে এসেছিলেন বরযাত্রী হিসেবে। মোটামুটি জন ত্রিশ মত মানুষ ছিল তাদের পক্ষ থেকে। আর আমার পরিবার ও আত্মীয় স্বজন,বন্ধুমহল আর মুরুব্বী পাড়াপড়শি মিলিয়ে মোটামুটি ৭০/৮০ জনের মত মানুষ খাইয়েই আমার বিয়ের পাট চুকিয়েছে আমার পরিবার। এই যুগে এত কম মানুষ খাইয়ে সাধ্যের চাইতেও কম খরচ করে মেয়ে বিদায় করা ভাগ্যের ব্যাপার বটে!
বিয়ে কেন্দ্রিক আত্মীয় স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশিদের নানান কথা, ছোটখাটো ভুল ধরা, টিপ্পনী ও কহল বাদে সবমিলিয়ে বেশ নির্বিঘ্নেই হয়ে গেছে আমার বিয়েটা। তিন কবুল বলে, রেজিস্ট্রি পেপারে সই করে আমি তার সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। নিজের অনিচ্ছার ঊর্ধ্বে গিয়ে অসহায়ত্বের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছি একপ্রকার।আমার মূল্য কত দিয়েছে জানেন? নগদ ১০ লক্ষ টাকা এবং উনার নামের প্রতিটা সম্পত্তির অর্ধেকাংশের মালিকানা।এটা নাকি উনাদের বংশের নিয়ম।।স্বামীর সকল ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে অর্ধেক মালিকানা স্ত্রী পাবে। আমার মোহরানার কথা বলছিলাম আর কি ।
বিয়ের আসরে যখন কাজী সাহেব মোহরানার কথা পড়ে শুনিয়ে সমস্ত টাকা ও দলিল আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন, উপস্থিত সকলেরই আক্কেলগুড়ুম অবস্থাই হয়েছিল বটে। এমনকি আমার নিজেরও।
বিয়ের পড়ানোর পর যখন উনাকে আর আমাকে আয়নায় মুখ দেখানোর রীতি পালন করা হচ্ছিল আমি তখনও উনার মুখদর্শন করিনি। যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আয়নায় কি দেখা যায়, আমি সোজাসাপটা উত্তর দিয়েছিলাম আমার অদৃষ্ট। তিনি আমায় দেখেছিলেন কিনা জানিনা তবে ওই একই প্রশ্নের উত্তরে বেশ সাবলিল কন্ঠেই তিনি বলেছিলেন, ‘আমার অর্ধাঙ্গিনী’। সত্যিই তো তাই! বিয়ে হতে না হতেই উনার অর্ধেক সম্পত্তিতে ভাগ যে বসিয়ে দিয়েছিলাম আমি।যদিও সে রীতি তাদের বংশপরম্পরা বলেই হয়েছে এমন। ব্যক্তিগতভাবে তো আর আমি দায়ী ছিলাম না,আর এখনও নই।
৭.
পরিবারের প্রতি অভিমান ছিল কিছুটা, এই বিয়েতে তাদের সম্মতি নিয়ে। তবে তা একেবারেই পঁচে গলে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছিল আমার মনে যখন বিদায়ের আগে যখন ভাবী এসেছিল আমার ঘরে। আমি তখন বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি নিজের ব্যাগপত্র ঠিকঠাক করে। ভাবী তখন আমার পাশে বসে বুঝ দেওয়ার মত করে বলেছিল, ‘শোন ভাই…..রাজ কপাল নিয়ে জন্মেছো বলেই আজ এত বড় ঘরের বউ হয়ে গেলে। কিন্তু, তোমার এই রাজ কপালের অভিষেক করতে গিয়ে আমাদেরও তো কম কিছু গেলো না। বড় ঘরে মেয়ে যাচ্ছে তাই তাদের মান সম্মান রাখতে গিয়ে আয়োজনে তোমার ভাইদের বেশ কসরত করতে হয়েছে। বেশ ধার দেনাও করতে হয়েছে।এমনিতেই টানা পোড়নের সংসার তার উপর আবার এসব। দুদিন বাদেই আবার ফিরানিতে আসবে তোমরা। নতুন মেয়ে জামাই হিসেবে জামাইকে খাতির যত্ন করতে হবে। তারও কত খরচ। তাই বলছিলাম যে, মোহরানার টাকাটা তো একদম হাতে নাতেই পেলে।ওটা তুমি এ বরং বাড়িতেই রেখে যাও। এত এত সম্পত্তি পেয়েছো, এ সামান্য ক’টা টাকার কি দরকার পড়বে তোমার, তাই না? রেখে গেলে ওগুলো অন্তত তোমার ভাইদের কিছুটা কাজে লাগবে। তাছাড়া, যে আসছে সে তো তোমারই ভাইঝি /ভাতিজা। তার প্রতিও তো তোমার একটা দায়িত্ব আছে,তাই না?’
ভাবী পাঁচ মাসের গর্ভবতী। নিজের স্বামী সন্তানের সুখ সুবিধার কথা চিন্তা করা, খেয়াল রাখা হয় তো মেয়েদের অন্যতম নারীগত বৈশিষ্ট্য। ভাবীও এর ব্যাতিক্রম নয়। কিন্তু আমার বেলায়…! ভাবীর কথা শুনে আমি কিছু বলিনি। আমার থেকে কোন উত্তর না পেয়ে ভাবী রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি নিজের দায় দায়িত্বের হিসেব করতে লেগে গেলাম। খানিক ভেবে হিসাব মিলালাম। সমাজ বলে, ছেলে না থাকলে নাকি সংসারের হাল ধরার কেউ থাকে না। মেয়ে তো জন্মগত অন্যের আমানত। কথা সত্য! তবে, কিছু কিছু সময় মেয়েরাও দায়িত্ব পালন করে। কেউ নিজ যোগ্যতায় নিজের আয়ে। আর কেউ এভাবে স্বামীর ঘাঁড়ে চেপে।তার আয়কে নিজের মনে করে বাপের বাড়ির হাতে তুলে দিয়ে। হা..হা..হাস্যকর, না?
আমি সত্যি সত্যি টাকাগুলো মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। ভাবীর সামনেই। বলেছিলাম, আমাকে ভরণ পোষণের সব ঋণ শোধ করে গেলাম। কিন্তু, চক্ষু লজ্জার ভয়েই হোক কিংবা নিজের অপরগতায় পুরোপুরি বশ না হয়েই হোক…মা টাকা নিতে চায়নি । ভাবী বাঁধ সাধলেও সে নিতে চায়লোনা। শেষে আমার জেদের কাছে হার মেনে পাঁচ লাখ টাকা রেখেছিলল। বাকিটা আমাকে দিয়ে দিয়েছে সাথে নেওয়ার জন্য।
৮.
আমার বিদায় বেলায় কেবল আমার ছোট বোনটাকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদেছিলাম আমি। বড্ড আদরের বোনটা আমার। ওই পরিবারে ওর বাকি জীবনটা কেমন কাটবে সেই অনাগত ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই বুকের মধ্যে হাহাকার করে উঠেছে বারেবার।বাকি মা, বোন-ভাই কারও থেকেই বিদায় নেইনি। কেনই বা নেবো! এখানে আমার আর কিই বা আছে। ওহ…হ্যাঁ। আমার মাথার উপর থেকে বাবার স্নেহশীল হাতটা অনেক আগেই উঠে গেছিল।সেই সাথে উঠে গেছিল আমার পরম আশ্রয়খানাও। যেখানে স্বচ্ছতার টানাপোড়ন থাকলেও অবহেলা ছিল না। আমার বিয়ের বছর দুই আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে বাবা মারা যায়। দুই বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তেমন চাপ না পড়লেও কয়েক মাস গড়াতেই বুঝে গেছিলাম, ভাইয়েদের ঘাঁড়ে এই অবিবাহিত দুই বোন আর মায়ের বোঝাটা একটু বেশিই ভারী হয়ে উঠেছিল। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে বিদায় দিয়ে বোঝা কিছুটা হালকা করতে চেয়েছিল তারা।
আর এই সম্বন্ধটা ছিল তাদের জন্য সোনার ডিম পারা হাঁসের মত। তারা বুঝিয়েছে এই সংসারের অভাব অনটন ছাপিয়ে রাজরানীর আসন পাবো আমি ওখানে।চাইলে ভাইয়েদের সংসারেও সাহায্য করতে পারবো সময় অসময়ে। এই পরিবারের প্রতিও তো আমার কিছু দায়িত্ব আছে। যা আমি এই বিয়ের মাধ্যমে অনায়াসে পালন করতে পারবো। তাছাড়া, সোনার আংটি বাঁকা হলেই বা কি! সোনা সর্বদাই মূল্যবান। তাই, সব দিক ভেবে চিনতে আমিও লোভী হয়ে উঠলাম। কি করবো, জীবন তো একটাই। আর সবকিছুই এখানে বাস্তবতা নির্ভরশীল।
৮.
বিদায় বেলায় কনেরা হাউমাউ করে কাঁদে।আজকাল অবশ্য কান্নাটাও দামী মেকআপ বিগড়ে যাওয়ার ভয়ে টিস্যু পেপারে চেপে চেপে চোখের কার্ণিশ থেকেই মুছে ফেলা হয়। কিন্তু আমার বেলায় সেসব কিছুই হলো না। আমি কাঁদিনি। যেটুকু কান্না ছিল ভিতর ঘরে বন্ধ দরজার ওপারে একাই কেঁদে এসেছি। আর বাকিটা রিতুকে জড়িয়ে ধরে। সেটাও ঘরের চৌকাঠ পেরোনোর আগেই। সাজ বলতে ভারী মেকআপ ছিল না। পার্লার থেকে সাজার মত খরচটা আমার ভাই ভাবীরা অহেতুক খরচ এড়িয়ে গেছিল। ফলে, কান্নাকাটিতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। বিগড়ে যাওয়া মুখের সাজটা নিজেই ঠিক করে নিয়েছিলাম।
মায়ের জন্য খারাপ লাগলেও তা সবার সম্মুখে প্রকাশ করিনি। চুপচাপ গাড়িতে বসে পড়েছি।তবে সেদিনও আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি রিতুকে আমাদের মাঝে বসিয়ে সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন আমার শশুড়বাড়ি।
৯.
শশুড়বাড়িতে বেশ ধুমধাম করেই আমার বরণ হয়েছিল। রিতুকে তিনি তার দুই বোনের দায়িত্বে দিলেন। উনার দুই বোনের সাথে ইতোমধ্যেই রিতুর বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল।তাই সেও স্বাচ্ছন্দ্যেই ওদের সাথে চলে যায় থাকার জন্য। তবে এরপরেই উনি একপ্রকার গায়েব হয়ে গেলেন। তারপর,উনার দেখা মিললো সোজা বাসর ঘরে। রাত, ১১ টায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনি এ ঘরে। তার নিজের ঘরে। যেটাকে অর্ধেক মালিকানার খাতিরে আমাকেও বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে নিজের বলে।
১০.
আমার স্বামী…নক্ষত্র। পুরো নাম আদৃত রাওনাফ নক্ষত্র। তিনি তখন তার বাবার গড়া বিশাল ব্যবসা সামলাচ্ছেন বাবার সহযোগী ও ভবিষ্যৎ মালিক হিসেবে। মানুষ বলে নিজের নামের সাথে নাকি মানুষের স্বভাব-চরিত্র ও রূপের মিল থাকে কিছুটা হলেও। তবে উনার ক্ষেত্রে সে কথা একেবারেই ভুল। কিছুটা তো নই-ই বলতে কিঞ্চিৎ পরিমাণ মিলও নেই উনার নিজের নামের সাথে। তবে ভাগ্যের সাথে আছে কিছুটা সাদৃশ্য। আদৃত, অর্থ্যাৎ সকলের আদরের উনি। অঢেল আদরে, আরাম আয়েসেই বড় হয়েছেন উনি।উনার বিলাস বহুল ঘর বাড়ি, চাকরবাকরের সংখ্যা সেটারই প্রমাণ দেয়। কিন্তু, উনার ঘরটা এসব বিলাসিতার বাইরে।
বিশাল একটা ঘর। যেন ছোটখাটো একটা ফুটবল মাঠ। ঘাস না থাকলেও তার বদলে বইপত্রে ঠাসা। ঘরের এক দেয়াল জুড়ে কেবল বই আর বই। ছোটখাটো লাইব্রেরি করে ফেলা হয়েছে ওই দেয়ালটা জুড়ে। এত কিসের বই সেটা বোধয় আমার সাধারণ মস্তিষ্কে ধরবে না। এছাড়া, একটা বিশাল খাট, দুটো সাইড টেবিল, একটা ড্রেসিং টেবিল, চার পাল্লার একটা আলমারি, সেন্টার টেবিল সহ দুটো সোফা , একটা বিন ব্যাগ, হোম থিয়েটার, টিভি আর একটা চেঞ্জিং রুম। এর বেশি কিছু নেই ঘরে। আজ অবশ্য ফুল ও ছোট ছোট গামলায় সুবাসিত মোমবাতি দিয়ে হালকা করে সাজানো হয়েছে ঘরটাকে। সবমিলিয়ে দেখতে সাধারণ তবে রুচিশীলতার ছাপ রয়েছে সবেতেই।
রাওনাফ …যার অর্থ সৌন্দর্য। যার ছিটে ফোঁটাও তার মাঝে নেই। একেবারে কুচকুচে কালো না হলেও উনার গায়ের রঙ বেশ কালো। ছবিতে ওই একবার দেখেই আমার দেখার সাধ মিটে গেছিল। উচ্চতাও খুব একটা নয়। পাঁচ ফিট আট ইঞ্চি মাত্র। একে তো কালো তার ওপর উচ্চতাও কম। ছেলে মানুষ একটু লম্বা চওড়া না হলে হয় নাকি! স্বাস্থ্যও খুব একটা সুঠাম নয়। উচ্চতার সাথে কোনমতে মানানসই। আচোখের মুগ্ধতা হওয়া তো দূর, চোখে মেলে চেয়ে দেখতেও কষ্ট হয়। তাই, নাকচ করেছিলাম এ সম্বন্ধটা। কিন্তু, ভাগ্যের ফেরে এই ব্যক্তির স্ত্রী হয়ে আজীবনের নামে তার মুখদর্শনের পরিণতি হয়েছিল আমার।
আর নক্ষত্র নামটা নিয়ে আর কি বলবো। আমার কাছে উনি ছিলেন এক নিষ্প্রভ নক্ষত্র। আমার জীবন আলোকিত করতে না পারা এক অনুজ্জ্বল নক্ষত্র। বাসর ঘরেই সেটার নমুনা উনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন অনেকটা। তবে সেটাই স্থায়ী হবে কিনা সেই বিষয়ে আমি তখনো নিশ্চিত ছিলাম। যতই হোক পুরুষ মানুষ বলে কথা!
চলবে…