নিবিদ্রিতা কাহন পর্ব -০১

‘অনেক ব্যাথা করছে নিবিড় ভাইয়া, আর পারছি না। এবার ছেড়ে দিন আমাকে। ব্যাথায় ম,রে যাচ্ছি আমি। প্লিজ দয়া করুন আমার উপর’
আদ্রিতার এই করুণ আকুতি তার সম্মুখের ব্যক্তির উপর বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলল না। সে নির্দয়ের ন্যায় ধমকে বলল,”খবরদার পুতুল! খাট থেকে এক পা নিচে নামাবি তো নিজের পা আর শরীরের সাথে যুক্ত পাবিনা তুই। আরও তিনবার হবে তারপর নিস্তার পাবি।এর আগে না।”
জালিম নিবিড়ের জুলুম সইতে না পেরে আদ্রিতা ঠোঁট উল্টে কাঁদতে শুরু করে দিলো। তার দুঃখের অশ্রু চোখের চাইতে বেশি নাক দিয়ে গড়াচ্ছে।দুই হাত কানে ধরে রাখায় সে নাকের পানি মুছতেও পারছেনা। গত বিশ মিনিট ধরে খাটের উপর কান ধরে উঠবস করার শাস্তি দিয়েছে তাকে, নিবিড়। সামান্য একটা কারণে কেউ এমন নির্দয়ের মতো শাস্তি দিতে পারে তা এই নিবিড় নামক জালিম দৈত্যকে না দেখলে আজীবনও জানতো না আদ্রিতা। নাকের অশ্রু আবারও ভেতরে টানতে টানতে সে বলল,”প্লিজ নিবিড় ভাই,ছেড়ে দেন না। আর পারছিনা। হাত পা প্রচন্ড ব্যাথা করছে।”
“এসব তোর আগে ভাবা উচিত ছিলো। যখন কাউকে কিছু না বলে তুই বান্ধবীদের নিয়ে ধেইধেই করে নাচতে নাচতে মেলায় চলে গিয়েছিলি। তারওপর আবার আমাকে মিথ্যে বলা হচ্ছিল! কত্তবড় সাহস তোর! এই তুই জানিস আমি সময়মত জানতে না পারলে কি হতো!”

আদ্রিতার নাকের পানি, চোখের পানি মিলেমিশে একাকার। কি হতো! সামান্য মেলায়ই তো গিয়েছিলাম। থোড়াই কারোর বাড়ি ডাকাতি করতে গিয়েছিলাম! আর কাউকে বললে যেতে দিতোনা বলেই না, আমি কাউকে বলিনি। তাই বলে এভাবে শাস্তি দিবে! আস্ত একটা দৈত্য। মনে মনে হাজার খানেক গালির বর্ষণ করলেও মুখ দিয়ে তার চুল পরিমাণও বের করতে পারলোনা। দৈত্যের সামনে সেই সাহস কই! নিবিড় তার শাস্তি পূরণ করে তবেই রেহাই দিলো আদ্রিতাকে।

ঘুম থেকে উঠতেই নিজের ফোনে সাত বছর পূরানো সেই কানে ধরার ভিডিও দেখতেই চোখ ফেটে তাকিয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো আদ্রিতা।ভয়ে তার হৃদপিণ্ড এদিক ওদিক দৌড়াতে লাগলো। যেন পালানোর জায়গা খুঁজছে সে। আদ্রিতা ভেবে পাচ্ছে না হঠাৎ এতবছর পর এই ভিডিও কোথাথেকে আসলো। ভয়ে গলা শুঁকিয়ে কাঠকাঠ। ওই বদ লোকটা সেদিন এসব নিজের ফোনে ভিডিও করে রেখেছিলো।আর এই ভিডিও দেখিয়ে দেখিয়ে আদ্রিতাকে ব্ল্যাকমেইল করতো। আদ্রিতা যদি তার কোনো কথা অমান্য করে তাহলে সে এই ভিডিও সবাইকে দেখিয়ে দিবে। ছোট্ট আদ্রিতা তখন ভয় পেয়ে যেত। নিবিড়ের অবাধ্য হওয়া থেকে নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতো সে। যদিও তা কেবল চেষ্টা অবধিই সীমাবদ্ধ থাকতো। কারণ রোজই কোনো না কোনো অবাধ্য কাজতো সে করেই ফেলতো।

কিন্তু বিগত ছয় বছরে আর এই ভিডিও দেখতে পায়নি আদ্রিতা। কারণ ছয় বছর পূর্বে আদ্রিতার ভাষায় সেই দৈত্য মানবটি বিদেশ চলে গিয়েছে। এত বছরে এই ভিডিওর কথা ভুলেই গিয়েছিল আদ্রিতা। আজ হঠাৎ এটা আসার মানে কি? আর কেইবা দিলো? আদ্রিতা দ্রুত ভিডিও প্রেরণকারীর নাম্বারে ফোন দিয়ে দেখলো বন্ধ বলছে৷ অস্থিরতা ছেয়ে গেল মস্তিষ্ক জুড়ে। আদ্রিতার হঠাৎ মনে হলো, এমনতো নয় এই ভিডিও ওই লোকটাই পাঠিয়েছে! হতে পারে এটা তার কোনো হুশিয়ার বার্তা। ভয় আরও আষ্টেপৃষ্টে জেঁকে বসলো আদ্রিতার।নিবিড় মানেই তারজন্য এক বিশাল আতঙ্কের উৎস। গলা শুঁকিয়ে মরুভূমি। মনে পড়লো গত তিন-চার দিন পূর্বের কথা। দাদুন(আবিরের মা, তুলি) কিছুদিন হলো খুব অসুস্থ। ডায়েবিটিস, লো বিপি সহ আরও কিছু সমস্যায় ভুগছেন বেশ কিছুদিন ধরে। সেদিন হঠাৎ বললেন, উনার নাকি তার নাতিকে দেখার ইচ্ছা জেগেছে। কতদিন বাঁচবে, না বাঁচবে। তাই মরার আগে নাতির মুখ দেখতে চান তিনি। চাচ্চুও মায়ের ইচ্ছে পূরণে ক্ষণিকও দের না করে তৎক্ষনাৎ ছেলেকে ফোন করে দেশে আসার কথা বলেছেন। তবে কি সত্যি সত্যিই নিবিড় ভাইয়া দেশে আসছেন? এটা কি সেটারই কোনো আগাম বার্তা?

হৃদপিণ্ড, কলিজা, ফোঁপরা, কিডনি, লিভার সব মিলেমিশে খিচুড়ি হয়ে যাওয়ার উপক্রম আদ্রিতার। আত্মা গলার মাঝে জালে ফাঁসা মাছের মতো ছটফট করছে। নিবিড় ভাইয়া আসবে! আব তেরা কেয়া হোগা, আদ্রিতা! এই এক মিনিট! আমি কেন ভয় পাচ্ছি? নিবিড় আসুক, না কুমির আসুক তাতে কি এই আদ্রিতা ভয় পায় নাকি! এখন আর আমি সেই ছোট্ট আদ্রিতা নেই যে,উনাকে দেখে ভয় পাবো। আমি কাউকে ভয় পাইনা। এখনতো আমি নিজের ঘরে নিজেই ঘুমোতে পারি।
আদ্রিতা নিজের মনে তিনশো ড্রাম সমান সাহস বুকে ভরে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজে নিজে সামনের দিকে আঙুল তুলে বলতে লাগলো,
“আসুক যে খুশি সেই। আদ্রিতা কাউকে ভয় পায়না।”
বলতে বলতে আদ্রিতা হঠাৎ মেঝেতে একটা তেলাপোকা দেখতে পেল। ব্যাস, ফাটা বেলুনের মতো ফুসস করে সব সাহস বেড়িয়ে গেল। মুহুর্তেই সব সাহসের মা-বোন করে ভূমিকম্প সৃষ্টি করে ধরণী কাঁপানো এক চিৎকার দিয়ে উঠল, “আআআআআ…..”

বাড়ি কাঁপানো চিৎকারে সকলে ছুটে এলো আদ্রিতার ঘরে।হুড়মুড়িয়ে ঠুকলো পরিবারের সকল সদস্য। তানি আদ্রিতার কাছে এগিয়ে গিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“কি হয়েছে অরি মামুনি? চিল্লালে কেন?”
আদ্রিতা দিকবিদিক না দেখে এক লাফে তানির কোলে উঠে গেল। দুই পা তানির কোমর পেঁচিয়ে আর দুই হাতে তানির গলা পেঁচিয়ে ধরলো। তানির গলায় মুখ লুকিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
“সোনা মা,তেলাপোকা। বাঁচাও আমাকে। তোমার মেয়েকে মেরে ফেলবে ও। বাঁচাও, বাঁচাও…

উপস্থিত সবাই হতভম্ব হতে নিয়েও খুব একটা হলোনা। আদ্রিতার এসব কান্ডতে তারা অভ্যস্ত। যে মেয়ে সামান্য পিঁপড়া দেখলেই তিন লাফ দেয় তার কাছে তেলাপোকা নিশ্চয় হাতি সমান হবে। আরমান আর আহনাফ, দুই ভাই নাতনীর কান্ড দেখে, স্মিথ হেঁসে হেসে মাথা ডানে বায়ে নেড়ে চলে গেলেন। আবির ভাতিজির সাহস যোগাতে বিদ্রোহী আওয়াজ তুলে বলে উঠল,
“কোথায় তেলাপোকা! এতবড় সাহস ওই ব্যাটা তেলাপোকার! আমার অরি মামুনিকে ভয় দেখায়! আজতো ওর বংশ নির্বংশ করে ছাড়বো আমি। পৃথিবীর বুক থেকে ওদের চিরতরে নামনিশানা মিটিয়ে দেবো। তানহা মামুনি, আমাদের শাহী তলোয়ারটা নিয়ে এসোতো এক্ষুনি।”

বাবার আদেশ স্বরূপ বাণী শুনে, তানহা তার স্বভাব স্বরূপ চোখের চশমার কোনা ঠেলে ঠিক করতে করতে বলল,
“তলোয়ার! কিন্তু বাবা, তলোয়ার দিয়ে তেলাপোকা কীভাবে মারবে? টেকনিক্যালি ইটস টু মাচ বিগ ফর ককরোচ। তোমার অন্য কিছু ট্রাই করা উচিত।”

মেয়ের কথায় আবির হতাশাজনক চাহুনি দিলো।যার অর্থ দ্বারায়, তার মেয়েটা এতো বোকা কেন? সব কিছুতে শুধু লজিক খুঁজে। দ্য গ্রেট আবিরের মেয়ে কিনা এতো ভোলাভালা!
তানি আবিরের দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল,
“এই তুমি চুপ করবে! বুড়ো হয়ে গেলে তাও তোমার ড্রামাবাজি গেলোনা। তুমি যাওতো এখান থেকে। ”
আবির আপসোস করতে করতে বেড়িয়ে গেল। তার গ্রেটনেস আজ পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারলোনা এটাই সবচেয়ে বড়ো দুঃখ। তানি আদ্রিতাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল,
“তুইও বড়ো হলিনা অরি। এই সামান্য কারণে কেউ এভাবে চিল্লায়! আমিতো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। ”
তানি তেলাপোকাটা ঝাড়ু দিয়ে বারি মেরে সেটা ডাস্টবিনে ফেলে দিলো। আদ্রিতাকে বলল ফ্রেশ হয়ে নিচে নাস্তার টেবিলে আসতে। বেচারি আদ্রিতা নাস্তা কি করবে, সে-তো ভিষণ ভাবনায় পড়ে গেল। আজ সকাল সকালই এতকিছু ঘটে গেল। নাজানি আজকের দিনটা কেমন হতে চলেছে!

লিভিং রুমের সোফায় ভাবনাগ্রস্ত হয়ে বসে আছে আদ্রিতা। দাঁত দিয়ে নখ কাটছে।এটা বদঅভ্যেস। চিন্তাগ্রস্ত হলেই সে নখ কামড়াতে শুরু করে দেয়। তখনই সেখানে ছোট্ট ছোট্ট পায়ে উপস্থিত হলো, তিন্নি।হাতে একটা পুতুল, বেবি পিংক কালারের বারবিডল ফ্রক পড়া, মাথায় দুই ঝুঁটি করা।যেন এক জীবন্ত পুতুল। তিন্নি সম্পর্কে আদ্রিতার ভাতিজী,বয়স পাঁচ বছর। আরমান সাহেবের চাচাতো ভাইয়ের নাতী,ফিরোজ-এর মেয়ে। চাকরির সুবাদে ঢাকায় আসার পর থেকে ফিরোজ তার বউ আর মেয়ে নিয়ে এবাড়িতেই থাকে। মূলত আরমান সাহেবই তাদের এবাড়িতে থাকতে বলেছেন। তার কাছে ফিরোজও তাদের আপন নাতী নাতনীদের মতোই। তাহলে সে কেন এত বড় বাড়ি থাকতে বাহিরে বাসা ভাড়া করে থাকবে। দাদার কথা তাই ফিরোজও অমান্য করতে পারেনি। এবাড়িতে সবাই তাদের নিজের পরিবারই মানে। আর এই ছোট্ট তিন্নি তো সবার চোখের মনি। তিন্নি গুটিগুটি পায়ে আদ্রিতার পাশে গিয়ে সোফায় বসে বলে উঠল,
” পিপি(ফুপি), তুমি আন্দুল খাচ্ছো কেন? তোমাল কি ক্ষুদা লেগেছে? আম্মু বলে আন্দুল খায় পচা মেয়ে। তুমি কি পচা?

আদ্রিতা ফট করে মুখ থেকে আঙ্গুল বের করে নিলো। এই পিচ্চিটাও আজকাল জ্ঞান দিতে শুরু করেছে। কি দিনকাল এসে গেল! তিন্নি আবার বলে উঠল,
“পিপি,তুমি নাকি তেলাপোকা দেখে ভয় পেয়েছ? তেলাপোকা দেখে আবাল ভয়েল কি আছে? আমি হলে তো এক ঘুষিতে নাক ফাটিয়ে দিতাম। আমি তোমাল মতো ভীতু না। ভীতু পিপি।”
বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো তিন্নি। যেন সে অনেক মজার বিষয় আবিষ্কার করেছে। আদ্রিতা চোখ কুঁচকে ছোট ছোট করে তিন্নির দিকে তাকালো।তারপর তিন্নিকে কাতুকুতু দিতে দিতে বলল,
“আচ্ছা! আমি ভীতু? তিন্নির বাচ্চা, এখনি দেখাচ্ছি মজা। ”
তিন্নি শুরশুরি পেয়ে সোফার উপর গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে লাগলো আর নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আবির তখন অফিস যাওয়ার উদ্দেশ্যে রেডি হয়ে নিচে এলো। আদ্রিতা আর তিন্নির দুষ্টুমি দেখে সেও মুচকি হেঁসে ওদের পাশে বসে তিন্নিকে কোলে তুলে নিলো। আদ্রিতার উদ্দেশ্যে বলল,
“অরি মা, ভাই ভাবির সাথে কথা হয়েছে আজ? ”
আদ্রিতা বিশাল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আপসোস পূর্ণ কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ হয়েছে চাচ্চু। তোমার ভাই ভাবিটাও কেমন, দেখেছ চাচ্চু? কোথায় ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে ফরেনে হানিমুনে পাঠাবে, তানা নিজেরাই ইটালি ভ্রমণ করে বেড়াচ্ছে। এই বয়সেও তাদের রোমান্সই শেষ হয়না।”

আবির আদ্রিতার থেকে আরও শতগুণ বেশি আক্ষেপের সুরে বলল,
“আর বলিস না অরি মা।তাদের রোমান্সের কথা বলতে গেলে তো দিনও নাই রাতও নাই। আর তাদের এই রোমান্সের খেসারত সবচেয়ে বেশি আমাকেই দিতে হয়। তাদের এই মাত্রাতিরিক্ত রোমান্স আমার গলার ফাঁস হয়ে যায়। তোর মা বাবার রোমান্স দেখে, তোর সোনা মা আমার জান নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয়। বলে, আমি কেন আদিত্যর মতো হতে পারি না। এইডা কোনো কথা! তোমার বাবার জন্য আমাকে অনেক নাকানিচুবানি খেতে অরি মা।”

আবিরের আক্ষেপূর্ণ কথায় ঠোঁট টিপে হাসলো আদ্রিতা। তৎক্ষনাৎ তানি সেখানে উপস্থিত হয়ে আবিরের উদ্দেশ্যে ধমকের সুরে বলল,
“এই তুমি কি সারাজীবনই এমন ড্রামাবাজ থাকার শপথ নিয়েছ? ছেলে মেয়ের সামনে এসব কি কথা? নূর আর আদিত্য ভাইয়া ওখানে বেড়াতে যায়নি। বিজনেসের কাজে গিয়েছে। সাথে আদিত্য ভাইয়ার হার্টের চিকিৎসার জন্যেও গিয়েছে। পাঁচ বছরের কোর্স পুরো করতে হবে।যাতে অপারেশন ছাড়াই ভালো হয়ে যান ভাইয়া। আর এই অবস্থায় নূর কখনো ভাইয়াকে একা ছাড়বে নাকি! সবকিছু জেনেও এসব আবোলতাবোল বলো।”

আবির বিড়বিড় করে বলল,
“এসব হলো বাহানা। এই উছিলায় আরেকটা বাচ্চা নিয়ে ফিরবে নির্ঘাৎ।”
অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে গেল আবির। আদ্রিতা চিপস খেতে খেতে টিভিতে মনোযোগ দিলো। তিন্নির মা জুহি খাবেরর প্লেট হাতে নিয়ে তিন্নির পেছন পেছন ঘুরছে খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু মেয়ে তার খাবার মুখে না নিয়ে সারাবাড়ি দৌড়াচ্ছে। জুহি অতিষ্ঠ গলায় বলতে লাগলো,
“তিন্নি, খেয়ে নে না মামুনি। দেখো আজ অনেক কাজ করতে হবে আমাকে। অনেক রান্নাবান্না করতে হবে। তোমার টম চাচ্চু আসছে আজ। ”

গলায় চিপস আটকে গেল আদ্রিতার। কি শুনলো সে? টম চাচ্চু! তিন্নির টম চাচ্চু মানে যে নিবিড় ভাই তা ভালো করেই জানে আদ্রিতার। একদিন টিভিতে টম ক্রুজ-এর মুভি চলছিল। সেদিনই তিন্নি টম ক্রুজকে দেখে বলে তার নিবিড় চাচ্চুকেও নাকি এমনই দেখা যায়।ভিডিও কলে নিবিড় ভাইকে প্রায়ই দেখে সে। সেদিন থেকেই তিন্নি নিবিড় ভাইয়াকে টম চাচ্চু বলে ডাকে। তারমানে নিবিড় ভাই সত্যি সত্যিই আজ আসছে! আদ্রিতা চকিত কন্ঠে জুহির উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“ভাবি, কে আসবে বললে?”
“আরে আজ নিবিড় আসছে।কেন তুমি জানোনা?”

আদ্রিতা বোকার মতো দুই দিকে মাথা নাড়ালো। মানে সে জানে না। মানে নিবিড় নামের দৈত্য মানবটা আবারও প্রকট হতে চলেছে! আর টিভি দেখা হলোনা আদ্রিতার। এক ছুটে রুমে চলে গেল। আজ আর রুম থেকে বের হবে না এমনটাই তার পণ।

এবং সেই পণ বজায় রেখে সকাল গড়িয়ে রাতে গেল। আদ্রিতা রুম থেকে বের হলোনা।দুপুরে একবার বের হয়ে শুধু খাবার টা খেয়ে আবারও ঘরবন্দী করে নিলো নিজেকে। কেউ ডাকতে আসলে নানান কথা বলে এড়িয়ে গেল। রাত আটটার দিকে বাইরে থেকে শোরগোলের আওয়াজ শুনতে পেল। বুঝতে পারলো দ্য লর্ড গভর্নর হয়তো এতক্ষণে পদার্পণ করে ফেলেছে। বুকের ভেতর ধড়ফড় শুরু হলো আদ্রিতার। হাত পায়ের ভেতর কেমন নিশপিশ করছে। আজব! এমন হওয়ার কি আছে? সে একটা মানুষই তো! কোনো ডাইনোসর তো আর না। বাইরে থেকে ভীষণ হৈচৈ এর শব্দ আসছে। নিবিড় ভাইয়ার আসার কথা শুনে সানা ফুপিরাও এসেছে। তাসান ভাইয়া আর সানভির(সানা-তাসির এর ছেলে মেয়ে) আমোদিত উচ্চ কন্ঠস্বর এখান পর্যন্ত আসছে।সোণা মায়ের কান্নার সুরও হালকা শোনা যাচ্ছে।এতবছর পর ছেলেকে দেখে নিশ্চয় আবেগে আপ্লূত হয়ে পড়েছেন তিনি। এতকিছুর শোনার পর নিজের বেহায়া মনের কৌতুহল দমাতে পারলোনা আদ্রিতা। দরজা হালকা খুলে মাথাটা একটু খানি বের করে দিয়ে চোরের মতো নিচে উঁকি দিয়ে অবস্থা পর্যালোচনা করতে চাইলো। নজর গেল সোজা নিচে সোফায় বসা শ্বেত মানবের দিকে। আদ্রিতার ক্ষণকালের জন্য মনে হলে যেন কোনো গ্রীসের দেব বসে আছে ওখানে। হৃদস্পন্দন তুফান মেলে চলতে লাগলো হঠাৎ । গত ছয় বছরে আদ্রিতা নিবিড়কে দেখেনি। আজই সরাসরি দেখছে। লোকটা দেশে থাকতে তো সুন্দর ছিলোই, কিন্তু ফরেন গিয়ে যেন একেবারে ফরেনারদের মতো হয়ে গেছে। একেবারে স্নো হোয়াইট। বাসার সবাই একেবারে ঘিরে ধরে আছে তাকে। যেন সাত রাজার দৌলত পেয়ে গেছে তারা। হঠাৎ নিবিড় মাথা তুলে তাকালে আদ্রিতাকে দেখে ফেলল। চমকে গেল আদ্রিতা। ফট করে দরজা বন্ধ করে দিলো সে। ধ্যাৎ! দেখে ফেললো।

ডিনার টাইমে আবির ডাকতে এলো আদ্রিতাকে। এতক্ষণ মাথা ব্যাথার বাহানা দিয়ে বসে থাকলেও এবার পারলোনা আদ্রিতা। কারণ খাবার টেবিলে না গেলে একে একে সবাই এসে ওর চিন্তায় হৈচৈ লাগিয়ে দিবে। তাই অগত্যা দরজা খুলে আবিরের সাথে নিচে নেমে এলো। সবাই ডিনার টেবিলে বসে গেছে। আদ্রিতা চোরাচোখে তাকিয়ে দেখলো নিবিড়ও বসে আছে। তার কোলে তিন্নি। তিন্নির হাতে চকলেট দিয়ে তাকে আদর করছে। আদ্রিতা আবিরের হাত ধরে এগিয়ে গেল। আবির আদ্রিতাকে নিবিড়ের পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজেও ওর পাশের চেয়ারে বসলো। একপাশে নিবিড়, আরেকপাশে আবির, মাঝখানে আদ্রিতা রয়ে গেল। সবগুলো চেয়ার বুক থাকায় আর উঠেও যেতে পারলোনা সে। অগত্যা সেখানেই বসে রইলো। আরচোখে নিবিড়ের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। কিন্তু নিবিড় নির্বিকার। সে তার মতো তিন্নিকে খাওয়াচ্ছে। যেন আদ্রিতা যে এখানে এসে বসেছে তা তার চোখেই পড়েনি। আরমান সাহেব আদ্রিতার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন,
“কিরে গিন্নি, আজ এতো চুপচাপ যে! এমনিতেতো বাড়ি মাথায় তুলে রাখিস। আজ কি হলো!

আদ্রিতা একবার আরচোখে নিবিড়কে দেখে নিয়ে জোরপূর্বক হেঁসে বলল,
” কিছুনা বড় দাদু, এমনি একটু মাথা ধরেছিলো তো তাই শুয়ে ছিলাম।”
“ও আচ্ছা। এখন ঠিক লাগছে?”
আদ্রিতা ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বলল। আরমান সাহেব নিবিড়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“দাদুভাই, ওকে কি চিনতে পারছ?
নিবিড় আদ্রিতার দিকে না তাকিয়েই বলে উঠল,
” কেন চিনবোনা? এই বাড়ির একমাত্র বলদিকে আবার আলাদা করে চেনার কি আছে? দেখ ও আসতেই কেমন বলদি বলদি গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। ”
আরমান সাহেব হালকা হেঁসে বললেন,
“কেনরে দাদু ভাই, আমার গিন্নিকে কোনদিক দিয়ে তোমার বলদি মনে হলো? আমার এতসুন্দর গিন্নিটাকে তুমি বলদি বলতে পারলে?”
“হ্যাঁ ঢের পারলাম। বলদিকে তো আর ময়ূরী বলা যায় না। বেচারি ময়ূরীর জন্য এটা বিশাল অপমানজনক হবে। এইযে বাড়িতে একজন বয়সে বড়ো ব্যক্তি আসলো। একবারও তাকে সালাম দিয়েছে? এরথেকেই বোঝা যায় সে একটা আস্ত বলদি।”

নিবিড়ের কথায় তাসান,তানহা, সানভি দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলো। সাথে পুচকি তিন্নিটাও হেঁসে কুটিকুটি হচ্ছে।
বিস্ফোরিত নজর ফেলল আদ্রিতা নিবিড়ের পানে। এত্তবড় অপমান! আমাকে বলদ বলা! ইচ্ছেতো করছে একে গাধার পিঠে চড়িয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দিতে। কত্তবড় বদ! রাগে, দুঃখে,অভিমানে আদ্রিতার মন চাইলো এক্ষুণি উঠে যেতে। কিন্তু তাতে সিনক্রিয়েট হবে।সোনা মা অনেক দিন পর ছেলেকে কাছে পেয়েছেন তাই এখন নিজেকে নিয়ে কোনো ঝামেলা করতে চায়না সে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলো সে। তানি, নিবিড়কে হালকা ধমকালো আদ্রিতাকে এসব বলার জন্য। কিন্তু তাতে ভাবান্তর দেখা গেলনা নিবিড়ের মাঝে। সে আদ্রিতার পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালোনা পর্যন্ত। অভিমান হুরহুর করে বাড়তেই লাগলো আদ্রিতার। তবুও সে চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আজ সব নিবিড়ের পছন্দের খাবার রান্না করা হয়েছে। তানি আদ্রিতার পাতে একটা ইলিশের চাকা দিয়ে গেছে। কিন্তু ঝামেলা হলো আদ্রিতা কাটা বেছে খেতে পারে না।সবসময় তানি,আবির নাহলে অন্য কেউ বেছে দেয়। আর ইলিশ মাছেতো অতিরিক্ত কাটা থাকে। যা আদ্রিতার পক্ষে বাছা দুষ্কর। আদ্রিতা একবার ভাবলো কাউকে বলবে বেছে দেওয়ার কথা। সে মাথা তুলে দেখলো তানি সবাইকে খাবার সার্ভ করতে ব্যাস্ত। বাকিরাও নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় আর আমোদে ব্যস্ত। আদ্রিতা আর কাউকে কিছু বললোনা। এমনিতেও এই লোকের সামনে কাটা বাছতে না পারার কথা সামনে এলে নিশ্চয় আবার কোনো কথা না শুনিয়ে বসে। তাই অগত্যা আদ্রিতা মাছ সাইড করে রেখে শুধু সবজি দিয়ে খেতে লাগলো। হঠাৎ ওর পাশ থেকে কাটা চামচটা কীভাবে যেন পড়ে গেল। আদ্রিতা টেবিলের নিচে ঝুঁকে চামচটা খুঁজে বের করতে লাগলো। চামচ খুঁজে বের করে উপরে রেখে নিজের প্লেটের দিকে তাকাতেই হালকা চমকে গেল সে। তার পাতের কোনায় কাটা বাছা মাছ দেখে ভ্রু কুঁচকে এলো। ভাবতে লাগলো কে তার মাছ বেছে দিলো। হঠাৎ তার মনে হলো নিশ্চয় আবির ওর মাছের কাটা বেছে দিয়েছে। আদ্রিতা আবিরের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
“ইউ আর দ্য বেস্ট চাচ্চু।”

আবির বুঝতে পারলোনা হঠাৎ আদ্রিতা তার প্রতি এতো খুশি প্রকাশ করলো কেন? তাও সে প্রতিত্তোরে বাম হাতে আদ্রিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“আমার অরি মামুনিটাও বেস্ট।”
আদ্রিতা খুশিমনে খেতে আরম্ভ করলো। এখন একবার নিবিড়ের দিকে তাকালে হয়তো তার ঠোঁটে লেগে থাকা নীরব সুক্ষ্ম হাসিটা দেখতে পেত।

চলবে…

#নিবিদ্রিতা কাহন
#মেহরুমা নূর
সূচনা পর্ব

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here