নিশীথচিত্র পর্ব ২৮+২৯

‘নিশীথচিত্র'(২৮)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে

_____________

দীপ্তি, , রিপা,ফৌজিয়া বিছানার এক কাতারে শুয়েছে কেবল।বিছানায় বসেই রিনি চুল বাধছে । বাধা হলেই লাইট নিভিয়ে সুয়ে পরবে । এমন সময় রিপা ইতস্ততভাবে কিছুটা লজ্জা নিয়ে বললো

–“দীপ্তি জানিস আজ দিহান ভাই আমার দিকে বেশ কয়বার তাকাইছে।”

দীপ্তি কিছু বলার আগে রিনি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো।ভ্রুযুগল কুচকে এলো।
–“কে তাকিয়েছে?”
রিপা লজ্জা পাচ্ছে দ্বিতীয়বার বলতে। চুপ থাকতে দেখে রিনি ধৈর্যচ্যুত স্বর উচিয়ে বললো

–“কে তাকিয়েছে বললে? দিহান ভাই তাকিয়েছে?”

রিপা লজ্জা নিয়ে বললো
–“হুম রিনি”।।

রিপাকে লজ্জা পেতে দেখে রিনির রাগের তেজ আরও বেড়ে গেলো।দীপ্তি বুঝতে পারলো অবস্থা বেগতিক। রিনি এবার চিৎকার দিয়ে বললো

–“আমি এখন,এখন দিহান ভাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করবো”

রিনি বিছানা থেকে উঠতে যাবে দীপ্তি হাত টেনে ধরে।রিপা দীপ্তি দুজনের উঠে বসে।রিপার মাথায় কিছু ঢুকছে না।রিনির এমন ব্যবহারে অবাক না হয়েও পারছে না।

–” রিনি আমি বুঝাচ্ছি।তুমি থামো।শান্ত হও প্লিজ। এখন অনেক রাত ঝামেলা হয়ে যাবে”

রিনি অন্যদিকে ঘুরলো। রাগে কপালের রগ নীল হয়ে উঠেছে ফরসা মুখে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।দীপ্তি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে কিভাবে বুঝাবে সে ভাষা তার জানা নেই। আড়ষ্টতা ঘিরে ধরেছে তাকে। শান্ত কণ্ঠে বলা শুরু করলো

–“রিপা দোস্ত তুই ভাইয়াকে পছন্দ করিস তা তুই না বললেও আমি বুঝি। ভাইয়া কিন্তু এসব একদমই জানে না বোঝেও না।আর আমার জানা মতে ভাইয়া তোকে ছোট বোনের মতো জানে। তুই যেহেতু ভাইয়াকে অন্য চোখে দেখিস তাই তোর মনও তাকে অন্য ভাবে ট্রিট করে। এখন যদি দিহান ভাই সাভাবিক ভাবেও তাকায় তাহলেও তোর মনে হবে কি না কি, কি না কি।আর এছাড়াও একটা কারণ হতে পারে যে একজন মানুষ তোর দিকে তাকিয়ে থাকলে, না চাইতেও অটোমেটিক তার দিকে তোর চোখ চলে যাবে।আমি বলতে চাচ্ছি তুই হয়তো তাকায় ছিলি ভাইয়ার দিকে তাই ভাইয়ার চোখ গেছে তোর দিকে। তুই ভাইয়াকে পছন্দ করিস তাই ই যেকোনো কিছুতেই একটু বেশি ভেবে ফেলছিস আর এটা তোর জন্যই ক্ষতিকর”

দীপ্তির এমন সব কথায় রিপা থম মেরে গেছে।সুক্ষ্ম অপমানবোধ হলো তার।

রিনি চোখ মুখ খিচিয়ে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে।দীপ্তি কিছুটা থেমে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো।তারপর আবার বললো

–“রিনি দিহান ভাইকে ভালোবাসে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে।ভাইয়া রাজী হয় নি এখনও।”রিপা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।এবার সে রিনির রিয়াক্ট করার কারণ বুঝতে পারলো।দিহান রিনিকে পছন্দ করে না ভেবে খুশিও হলো। দীপ্তি রিপার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো অতঃপর রিপার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে আস্তে বললো
–” দিহান ভাইও ভালোবাসে কিন্তু রিনিকে বলে নি তবে বলবে। একটা পজিশন তৈরি করেই বলবে। রিনির সামনে এসব বলিস না”

নিরবলম্ব অসহায় চোখ দুটো একবার দীপ্তির দিকে তাকালো তো একবার উল্টো ঘোরা রিনির দিকে। হুট করে রিনিকে সবচেয়ে সুখী মেয়ে বলে মনে হলো রিপার।তার জীবনের চিরন্তন সত্য কথা এটা দাড়ালো যে, তার এইমুহূর্তে রিনিকে একদম সহ্য হচ্ছে না।রিপার কাছে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে অসহ্য, পাশব মেয়ে হচ্ছে রিনি।অসহ্যের সীমারও বাইরের মেয়ে হচ্ছে রিনি।পরক্ষণেই মনে হলো রিনির কাছেও তাহলে আরও অসহ্যকর সে।।কারণ দিহানের উপর তো সব যুক্তি মিলিয়ে রিনিরই অগ্রাধিকার। রিনির চেহারা সৌন্দর্য সব কিছুই পুড়িয়ে দিচ্ছে রিপার ভেতর। চুপ করে উল্টো ঘিরে সুয়ে পরলো।

___________

দীপ্তি রিনি সকালে উঠে রিপা ফৌজিয়াকে পায় নি।দীপ্তির বেশ মন খারাপ হলো।কিন্তু রিনি? সে খুশিতে বাকুম বাকুম।অসহ্যকর মুখটা দেখতে হবে না।সে নিশ্চিত রিপাও তাকে দেখতে চায় না বলেই চলে গেছে।নারীরা সর্বোচ্চ সুবিপুল হিংসায় তখনই পরে যখন ঝামেলাটা হয় ভালোবাসার পুরুষ কিংবা স্বামী নিয়ে।এই বিষয়ে হিংসামুক্ত কোনো নারী নেই।এই প্রেক্ষাপটে রিনি,রিপা কিংবা মিরা সবাই সঠিক।

___________

গায়ে হলুদে কম বেশি সব মেয়েরাই ছেলের বাড়ি থেকে পাঠানো পথ্যের সাথে দেয়া শাড়ি গুলোই পরলো।দীপ্তির শাড়ি পড়া হয়ে গেলে রিনির আচলটা ভাজ দিয়ে পরিয়ে দিচ্ছে।দিহান হুরমুর করে রুমের মধ্যে ঢুকলো।অপ্রস্তুতভাবেই কিছুক্ষণ হা করিয়ে তাকিয়ে রইলো।রিনির মুখ লজ্জায় লাল আভা দিবে বলে।দীপ্তি কেশে বললো

–“কিছু বলবি ভাইয়া?”

রিনির দিকে চোখ নিবদ্ধ রেখেই দিহান চকিতে উত্তর দেয়
–“হ্যা হ্যা”
কিছুটা সময় নিয়ে দম কুড়িয়ে বলে
–” শাড়ি পরছো ঠিক আছে আটা ময়দা দিছো ভালো কথা।মাথায় হিজাব পরা চাই ওকে?”

দীপ্তি আড়ষ্ট কন্ঠে বললো
–“ভাইয়া বিয়া বাড়ি তেও”

দিহান ধমক দিলো
–“চুপ।আর হ্যা পারলে কাউরে বোরকা পরায় নিস।রুপগঞ্জের মানুষ পাগল হলে দায়ভার সরকার আমায় দেবে।এতো ভার আমি নিতে পারবো না বলে দিচ্ছি”

পরোক্ষভাবে রিনিকে বুঝালো দিহান।রিনি হা করে রইলো। দিহান উল্টা ঘুরে চুল টানতে টানতে রুম বের হচ্ছে আর বলছে”আল্লাহ মাথাটা এমন ঝিম ঝিম করতেছে কেন আল্লাহ। আল্লাহ আমায় সহিষ্ণু বানাও আল্লাহ।”

দিহান চলে যাওয়ার পর দীপ্তি ঘর কাপিয়ে হাসলো।হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি দিলো দুটো। রিনি ধমক দিতে বললো
–“দীপ্তি কি করছো তুমি শাড়ির অবস্থা?আমি আর ঠিক করে দেবো না”

___________

রাতে বিছানায় শুয়ে থেমে থেমে হেসে উঠছে দুজন। দীপ্তির হাসির শব্দই বেশি শোনা যাচ্ছে।
রিনি আবার বললো
–“আর মনে আছে ঐ মোকলেস টাইপ ছেলেটার কথা?আমায় দেখে যে হ্যাবলা হাসি দিচ্ছিলো না!!!”

দীপ্তি ডাবল উৎসাহ নিয়ে বলো

–“হ্যা হ্যা মনে আছে।”

–“ওরে একফাকে একটা চোখ টিপ দিলাম। ছেলে দেখি খুশিতে বাক বাকুম করতে করতে কাছে আসছে তারপর দিহান ভাই যা ঝারলো।আমি আর সেখানে নাই পালিয়ে গেলাম। জানো আমাকে খুজে বের করে চাপা কন্ঠে হালকার উপর ঝাপসা একটা ধমক দিছিলো, ভাগ্যিস মানুষ শুনে নাই। একটুর জন্য মানইজ্জত রক্ষা পেয়েছে”

দীপ্তির হাসির বেগ বাড়লো তার মিলিয়ে রিনিও।

রিনি হাসতে হাসতে আবার বলা শুরু করলো

–“জানো পাঁচ সাতটা ছেলে পরাপর নাম জিজ্ঞেস করতে আসছিলো।একজনকে বললাম ছকিনা একজন কে মর্জিনা আর একজনকে জরিনা।কেউ ই আমার নাম নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছিলো না মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো। কি কষ্টে যে হাসি চেপে রাখছিলাম।একজন তো শেষমেষ বলেই বসলো আপনার সাথে নামটা একদম যায় না।”

দীপ্তি হাসতে হাসতে বললো

–“আমার কাছেও তোমার নাম জিজ্ঞেস করছিলো।আই গেস ভাইয়ারেও জিজ্ঞেস করছে।ওর মেজাজ চড়া দেখলাম খুব”

রিনি স্তম্ভিত হলো
–“তাই নাকি?”

–“হুম”

–“তোমার ভাই কোথায়? রাত বারোটা এখনও আসে নাই?”

–“বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় হয়তো ”

রিনি ঠোঁট উল্টে বললো
–“তাই বলে এতো রাত?”
___________

জানালার সামনে দাড়িয়ে বাইরের আকাশটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ব্রাশ করছে রিনি। হাফসা এসে তাড়া দিয়ে গেলো খেতে যাওয়ার জন্য।বিয়ের সময় ছেলে পক্ষ আপ্যায়ন বেশি পায় আর মেয়ে পক্ষের বেশি যেটা হয় সেটা হলো দায়িত্ব। বরপক্ষকে খাওয়াতে খাওয়াতে নিজের বাড়ির কে কি খেলো তেমন খেয়াল করা হয়ে ওঠে না।এমনই কিছু বুঝিয়ে হাফসা চলে গেলো।তার আসল উদ্দেশ্য ছিলো এখন খেতে যেতেই হবে, না বলা যাবে না।

দুজনকেই জামা কিনে দেয়ার পরও রিনির দেয়া দুটো পোশাকের মধ্যে ঘের বেশি গোল জামাটা পরলো রিনির কথায়। কারণ একই পোশাক রিনিও পরবে। আজ তাড়া ম্যাচিং ম্যাচিং হবে।ব্লাক,গোল্ডেন মিশ্রনে রিনির পোশাক আর ব্লু আর রেড মিশ্রনে দীপ্তির পোশাক।দীপ্তিকে মেকাপ করিয়ে দিয়ে নিজে করছে রিনি। দীপ্তি রিনির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বললো

–“আজও ভাইয়া পাগল হবে দেখো।”

রিনি মিষ্টি হাসলো।

____________

সাউন্ড বক্সে গান চলছে। ছেলে মেয়েরা নেচে নুচে হুলুস্থুল টাইপের অবস্থা।নাচ দেখতে অনেক মানুষ সেখানে জড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়েছে।রিনি ভীর ঠেলে বেড়িয়ে এলো।চেয়ারের শেষ কাতারে একলা বসে থাকা দিহানের পাশে গিয়ে বসলো।দিহান চোখ বুজে ছিলো।কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ মেলে তাকালো।রিনিকে দেখে আবার চোখ বন্ধ করলো।রিনি দিহানের মুখের উপর তিন বার ফু দিলো। দিহান চোখ মেলে সরু চোখে তাকালো।সোজা হয়ে বসে বললো

–“ফু দিচ্ছো কেন?”

–“সূরা নাস আর ফালাক পড়ে ফু দিলাম যাতে নজর না লাগে আমার দিহান ভাইয়ের উপর।কি সুন্দর লাগছে!!!!!”

দিহান কৌতুক করে বললো

–“ভূতের মুখে রাম নাম আর সুন্দরীর মুখে আমার গান”।উল্টা হয়ে গেলো না?

–“একদম না।এখানে না এলে কতো কি না জেনেই থাকতাম। সত্যিই সুন্দর আপনি”

রিনির কণ্ঠে রাশভারী হলো।শীতল চোখে তাকিয়ে বললো

–“মিরা আপু আপনাকে ভালোবাসে তাই না”

দিহান হকচকিত।

রিনি আবার বললো
–“আমি কিন্তু প্রথম দিনই বুঝেছিলাম।কিন্তু আপনার গাম্ভীর্যের কারণ বুঝি নি।যাই হোক চিঠিটা মিরা আপু দিয়েছে।”

রিনি উঠে চলে গেলো।ভীর ঠেলে দীপ্তিকে নিয়ে বাসার দিকে যেতে দেখলো।

দিহান চিঠিটা খোলে।অতি আবেগের কিছু না যে রাতের বেলা নিরিবিলি পরিবেশে এই চিঠি পড়তে হবে।তাই সে এখনই পড়ছে।তবুও খানিক খারাপ লাগছে।

দিহু,

রিনি খুব সুন্দর, খুবই সুন্দর। কিন্তু কি বল তো?ওর সুন্দরটা আমার চোখে লাগছে ভীষণ লাগছে।কারণ কিছুটা হলেও সেই সৌন্দর্যে মুগ্ধ তুই।আর বাকিটা হয়তো বাহ্যিক আচরণ,আর কলিজা ছেড়া টান। জানিস আমার অবুঝ মন এই তিন দিন একটা কথা যপ ছিলো বার বার।
আমি কেন রিনি হলাম না!!!!
দিহান ভালোবাসা কি জানিস?ভালোবাসা হলো জীবনের ডায়েরীর মূল্যবান ছেড়া পাতাটা।দ্যাখ কি অদ্ভুত! মুল্যবান তবুও ছেড়া পাতা।আর এর উদ্দেশ্য হচ্ছে এই কষ্টটা কাউকে দেখানো যাবে না।তাই ই পাতাটা ছিড়তে হয়। জায়গা দিতে হয় মনের গোপনে হৃদপিণ্ডের অন্তরালে।জীবনে এর জায়গা দেয়া যায় না।হ্যা কতো মানুষ জীবনে জায়গা দিয়েছে।কিন্তু আমার জীবনের ভালোবাসার সংজ্ঞা এটাই আমি আম্র জীবনে জায়গা দিতে অক্ষম হয়েছি।আচ্ছা তোর জীবনের ভালোবাসার সংজ্ঞা কি?

বিয়েটা নিয়ে অবাক হলি তাই না?আমার একটা ইচ্ছা ছিলো।সেটা হলো তোর বিয়ে পারিবারিক ভাবে অন্য মেয়ের সাথে হলে আমি মেনে নিবো। বিয়ের পর তাকে ভালোবাসবি প্রেম করবি আমার কষ্ট হলেও গায় মাখবো না। কিন্তু বিয়ের আগে তোর ভালোবাসা অন্য কেউ পেলে আমি তাকে কখনো দেখবো না এমনটাই ইচ্ছা ছিলো।কারণ আমার আমাকে নিয়েই আফসোস হবে।আর ভাগ্যের পরিহাস সেটাই হলো।তাই ঘর থেকে বিদায় নিচ্ছি।যাতে রিনি আর যে কয়দিন থাকে সে কয়দিন দেখতে না হয়।শুধু এই কারণেই বিয়েটা করলাম।

আর দোয়া করিস আমার বরটার জানো তোর মতো ভুবন ভুলানো হাসি হয়।যে হাসি দেখলেই দুনিয়ার সব কিছু ভুলে থাকা যাবে।তাকে এখনও দেখেনি।আমার বিশ্বাস তুই দোয়া করলে আমার মন মতোই হবে।

ভালো থাকিস রিনিকে নিয়ে।

ইতি
নাম নাই’বা লিখলাম।

দিহান প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো।একটা কথা মনে মনে আওড়াতে থাকলো”আমি যে আমার ভালোবাসার সংজ্ঞাই স্থির করতে পারছি না।

চলবে

‘নিশীথচিত্র’ (২৯)
ইসরাত আয়রা ইচ্ছে

____________

ভালোবাসাকে মুক্তহৃদয়ে আকাশে ডানা ঝাপটানোর অভিলাষ কার মনেই বা না জাগে? ভালোবাসার অমৃত অনুভূতি নিজের হৃদয়ের অন্তস্তলে ঠাই দিতে কে ই বা না চায়?পরিস্থিতি বাধা হয়ে দাড়ালেও মনে হয় উপরে ফেলে দি সব প্রতিবন্ধকতা । রিনি যেমন ভালোবাসার আর এক রুপ হতে চায় তেমন বেপরোয়া প্রেমিক হওয়ার সাধ দিহানেরও জাগে। আজকার বড্ড বেশিই জাগে। কিন্তু দিহান পারে না।রিনির বাবা সাহায্য না করলে হয়তো বাধাগুলো উপরেই ফেলতো কিন্তু এখন কোথাও একটা বেধে যায়।

ভালোবাসার কথা বুকে আটকে রাখার থেকে শ্বাসরুদ্ধকর কষ্ট কি আছে?ভালোবাসি বলতে চাইলেও বলতে না পারার দমবন্ধ করা অনুভূতি আর হয় কি??দিহান ডান হাত দিয়ে চোখ জোড়া মুছলো নিজের বেখায়ালেই।চোখটার সিক্ত জলো জলো ভাবে দিহান নিজেই অবাক হলো। নিজের অবস্থায় নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ। তাহলে কি খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার?

______________

রিনি সময় বেছেবুছে কবুল বলার সময়টাকেই বেছে নিলো।সবাই ব্যস্ত আর উৎফুল্ল এই কবুল বলার সময়টাতেই থাকবে।ব্যস্ত পায়ে দীপ্তির হাত ধরে পেছনের খালপাড়ে যাচ্ছে।দীপ্তি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে তার পা চলছেই না যেনো।বার বার থেমে যাচ্ছে।কিন্তু রিনি থামতে দিচ্ছে না।পুরো উদ্যোমে টেনে নিয়ে আবার হাটছে।দীপ্তি এমন জোরপূর্বক থেমে যাওয়ায় বিরক্ত না হয়েও পারছে না একদমই।

–“দীপ্তি তোমার পা কি বার বার মাটি আটকে দিচ্ছে?

দীপ্তি কিছুই বলতে পারলো না।কিছুটা যেতেই দেখা গেলো তনয় দাঁড়িয়ে। দীপ্তির বুক ধক করে উঠলো।পা দুটো থেমে গেলো।রিনি মুচকি হেসে বললো

–“যাও কথা বলো।”

দীপ্তির পা নড়ছে না আর না মাথা উঁচু করে তাকাচ্ছে।নিম্নগামী চোখ দুটো শান্ত ভাবে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলেও বুকে ঝড় শুরু হয়েছে।কিভাবে কথা বলবে সে?

রিনি একপ্রকার টেনেই তনয়ের সামনে দাড় করিয়ে দিলো।তনয় হালকা হেসে বললো

–“রিনি আপু একজন মানুষ যদি আমার সাথে নিজে থেকে কথা না বলে আমিও কিন্তু বলবো না। ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে গেলেও বলবো না।”

রিনি দীপ্তির কাধ হালকা নাড়িয়ে বললো “কথা বলো, কথা বলো”

রিনি চলে যেতে চাইল কিন্তু দীপ্তি বাধ সাধলো।চোখ পিট পিট করতে করতে কাদো কাদো সুরে বললো

–“কোথায় যাচ্ছো? যেও না প্লিজ।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

রিনি হায়হুতাস করে বললো
–“আল্লাহ কারো দম বন্ধ হয় কেউ বেহুশ হয় আমারই খালি কিছু হয় না।যাই হোক,টেক ইট ইজি দীপ্তি আমি পাঁচ হাত দূরেই আছি।সাহস জোগাও।আমি তোমার জন্য সব থেকে সেফ জায়গায়ই রেখে যাচ্ছি”

রিনি কিছুটা দূরে গিয়ে দাড়ালো।

দীপ্তি আঙুল মুচরাতে মুচরাতে ভেঙে ফেলার অবস্থা করে ফেলছে।এর মধ্যে তনয়ের গলা শোনা গেলো কিন্তু মানুষটার দিকে তাকানোর সাহস হয় নি।

–“আঙুলকে ওতো কষ্ট না দিয়ে আমাকেই মুচরে শেষ করে দাও।শেষ তো অলরেডি হয়েছি বাকিটাও দাও।ষোলকলা পূর্ণ হোক।”

তনয়ের গলায় কিছুটা কৌতুক।বুকে একহাত রেখে অন্য হাত মুঠ করে থুতনিতে ঠেকাচ্ছে বার বার।গভীর দৃষ্টিতে দীপ্তির হাত পায়ের মৃদু কাপন দেখছে।তনয় আবার বললো

–“আমি কিন্তু সত্যি কথা বলবো না।আর তুমি কথা না বলা অব্দি যেতেও দেবো না।”

দীপ্তি এবার চকিতে তাকিয়ে বলে

–“কেন যেতে দেবেন না কেন?”

তনয় হেসে বললো
–“এই যে মুখ খুলেছো এবার যেতে দেবো।তবে কিছুক্ষণ প্রেম করে”

তনয় এক পা এগিয়ে এলো। দীপ্তি তৎক্ষনাৎ তিন পা পিছনে সরে গেলো। ভয়ভীত কণ্ঠে বললো
–“কিসের প্রেম কিসের?”

তনয় সে কথার উত্তর দিলো না।দুঃখভরাক্রান্ত কন্ঠে বললো
–“এলাম এক কদম এগিয়ে দূরত্ব কমাতে। আর তুমি কিনা তিন কদম পিছিয়ে গেলে?আমার দুই কদম লস হয়ে গেলো রে আল্লাহ।এখন আমার কি হবে?আর আগাবো না, আগালে কিনা ছয় কদম পিছিয়ে যাও”

দীপ্তর বুক ধক ধক করছে মেজাজ খারাপও লাগছে।এই ছেলের প্রত্যেক কথায় ফাজলামো ফাজলামো গন্ধ পাচ্ছে।

এরপর বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা।দীপ্তি বেশ উশখুশ করছে অস্থিরতা ক্রমশই বাড়ছে।তেরো চৌদ্দ মিনিট বাদে তনয় হাটু গেড়ে বসে পরলো দীপ্তির সামনে।দীপ্তি এক কদম পিছিয়ে গেলো আবার।হুট করে ভয় পেয়ে গেছিল সে।কিন্তু তনয়ের হাতে গোলাপ দেখে চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো।ঘটনায় কিছুটা অপ্রতিভ দীপ্তি। এমনটা কল্পনাতেও ভাবে নি তাকেও কেউ এভাবে ভালোবাসা বিনিময় করবে। এটা তার কাছে কল্পনাতীত ব্যাপার।

তনয় মোহনীয় গলায় বলে উঠলো
–“আমার সুখ দুঃখের অর্ধেক ভাগীদার হবেন ম্যাডাম?”

দীপ্তির চোখ দুটো চিক চিক করে উঠলো।সুখ সুখ বাতাস বইছে চারিপাশে।আড়ষ্টতায় কুকড়ে উঠছে।সামনে থাকা এককথায় বলা চলে শুকনো,শ্যামবর্ণের ছেলেটাই তার মন চুরি করে নিয়ে পালিয়ে গেছে।এও ভারী লজ্জার ভাবনা দীপ্তির কাছে।ফুলটা গ্রহণ করলেই আরও লজ্জায় পরবে আর না গ্রহণ করলে অপমানিত হবে তার প্রিয়জন।কাপা কাপা হাতে দীপ্তি ফুল নিলো।নিয়েই নিজের পেছনে লুকিয়ে ফেললো অন্য হাতে মুখ ঢেকে নিলো।কি ভীষণ লজ্জা!!!

রিনি এতোক্ষণের সবকিছুই দেখেছে আড় চোখে। সোজাসুজি তাকিয়ে দেখাটা লজ্জার। শেষ মুহুর্তটা দেখে মনে হলো সেও এমন লজ্জা পেতে চায়।কিন্তু লজ্জা দেয়ার মানুষটাই তো নির্বিকার।রিনি নাড়া দিলে নড়ে একটু, নয়তো যেই লাউ সেই কদু।তাই নিজেকেই সবটা করতে হয়।মুগ্ধ চোখে দীপ্তিতে দেখছে।মুখ থেকে এখনও হাত সরায় নি আর না ফুলটা সামনে এনেছে।আস্ত মানুষটা দাঁড়িয়ে থেকেই মুখ আর ফুল লুকিয়ে তার মনে হচ্ছে পুরো নিজেকেই লুকিয়ে ফেলতে পেরেছে।তনয় কপালে হাত ঠেকিয়ে হাসছে।রিনি সিওর যে এটা প্রশান্তিময় প্রাপ্তির হাসি।যে হাসিটা সে একদমই কম হাসতে পারে। যেটুকি হাসে সেটুকু হাসির কারণও নিজের খুজে নিতে হয়।রিনির মন কিছুটা বিষাদ ছেয়ে গেলো।

–“দীপ্তি”

হুট করে দিহানের গলা পেয়ে তিনজনই হকচকিয়ে গেলো।দীপ্তি হাজার ভয় নিয়ে মুখ থেকে হাত সরিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো।গোলাপটা ওড়নার আড়ালে ভালোভাবে লুকিয়ে নিলো একফাকে।লুকিয়েও খুব একটা লাভ হলো কিনা জানে না দীপ্তি।তনয় প্যান্ট লাগা হালকা ময়লা ঝেরে সোজা হয়ে দাড়ালো।দিহানকে রক্তচক্ষু নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে
রিনি কিছুটা ভয় পেলেও পথ আটকে দাড়ায়।

–” কি হলো কই যাচ্ছেন?”

দিহান রাগী চোখে রিনির দিকে তাকায়।ক্রোধ নিয়েই বলে
–“এটা কি আদোও যুক্তি সংগত প্রশ্ন করছো তুমি??”

–“ওরা তো বাজে কাজ করছিলো না।আর দীপ্তির দোষ নেই। ও জানতো না।তনয় ভাইয়ার সাথে প্লান করে আমিই ওকে নিয়ে এসছি।”

দিহানের মেজাজ আরও বিগড়ে গেলো

–“হাউ ক্যান ইউ ডু দ্যাট রিনি?হাউ???দীপ্তিকেও কি তোমার মতো মেয়ে বানাতে চাইছো নাকি?”

রাগের মাথায় কতো বড় কথা বলে ফেললো তা দিহানও বুঝতে পারলো না।দীপ্তি অবিশ্বাস্য, সংশয়িত চোখে তাকালো দিহানের দিকে।দীপ্তি আর তনয়ও অবাক চোখে তাকালো।কথাটা মাথা এবং বুকে সমানে আঘাত হেনেছে।রিনির চোখ চিক চিক করে উঠলো।কথা বলার শক্তি না থাকলেও জিজ্ঞেস করতে মন চাইছে “আমি কেমন মেয়ে?”
কিন্তু রিনি জিজ্ঞেস করতে পারলো না নাকি চাইলো না বোঝা দায়।গলা আটকে আসছে তার।পাশে থাকা ছোট্ট সুপারি গাছটা খামচে ধরলো।মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করলো।

দিহান সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলো না।এদিয়ে দীপ্তির সামনে এলো।পাশে থাকা তনয়ের দিকে একবার রাগী চোখে তাকিয়ে দীপ্তির দিকে তাকালো।হুংকার দিয়ে বললো

–“আমায় একবার জিজ্ঞেস করে নিতি!একবার জানিয়ে নিতি।তার প্রয়োজন পরলো না মোটেও?পাঁচ বছর ধরে পেছনে ঘুরলেই সৎ প্রেমিক হয়ে গেলো? খুব বিশ্বাস করে ফেললি।ওর যে রিপার সাথেও প্রেমের সম্পর্ক আছে তুই তা জানিস?

দীপ্তির চোখ বিস্ময়ে অক্ষিকোটর থেকে বেড়িয়ে আসবে যেনো।তনয় এতোটাই অবাক হলো যে তার মুখ বিস্ময়ে কিঞ্চিৎ হা হয়ে গেলো।

চলবে,

like and comment Below

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here