নিষিদ্ধ বরণ পর্ব ৭

#নিষিদ্ধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৭)

” ইনি কে, নিহিতা? ”

নিহিতা উত্তর দেওয়ার আগেই কেউ একজন বলল,
” নিহিতার স্বামী। ”

মুহূর্তে হতচকিত তিনটি মানুষ। চোখে রাজ্য মাপের বিস্ময়, সংশয়। নিহিতার অবিশ্বাস্য চোখ জোড়া আটকাল সুমির দিকে। সে আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছুটে এলো তাদের নিকট। নিহিতার পাশে দাঁড়িয়ে হালকা হাসল। সহাস্যে তাকাল আহাদের দিকে। আহাদের চোখে-মুখে স্পষ্ট সন্দেহ। মাহদীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলল,
” নিহিতা, তুমি বিবাহিত? ”

এবারও উত্তর দিল সুমি,
” হ্যাঁ। আপনি জানতেন না, আহাদ ভাই? ”

আহাদ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল,
” না। ”

সুমি আগ্রহ নিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই আহাদ বলল,
” বিয়ে কবে হলো? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। নিহিতা, চালাকি করছ না তো? ”

নিহিতা ভীত চোখে তাকাল। পর মুহূর্তে দৃষ্টি সরিয়ে নিল সুমির দিকে। কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। সুমি ব্যাপারটা আঁচ করে কৌশলে ফিসফিসে বলল,
” শুধু এক বার বল বিয়ে হয়ে গেছে। উনি বিশ্বাস করে নিবেন। ”

নিহিতার অসহায় চোখ দুটো জ্বলে উঠল। মুখের ভাব কঠিন হয়ে আসল। সুমি ভয় পেয়ে যায়। বুঝতে পারে এত বড় মিথ্যা কথা নিহিতা বলবে না। জীবন চলে গেলেও না। বড়-ছোট কী কোনো ধরনের মিথ্যাই সহ্য করতে পারে না নিহিতা। সুমি মেকি হাসল। আহাদকে কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে সে চট করে বলল,
” তুমি চুপ। আমি নিহিতার মুখ থেকে শুনতে চাই। ”

নিহিতার দিকে আরেকপা এগিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” নিহিতা, তুমি বিবাহিত? ”

নিহিতা চোখ নামিয়ে ফেলল। এক কদম পিছিয়ে গেল। আহাদ পূর্বের প্রশ্নটাই আরও এক বার করল। নিহিতা তখনও চুপ। সুমি দুজনের দিকে ঘন ঘন চোখ ফেলে আশ্রয় নিল মাহদীর কাছে। আচমকা তার কাছ ঘেষে এসে কানে কানে বলল,
” আমার বান্ধুবীকে বাঁচান, প্লিজ। ”

মাহদী সুমির দিকে তাকাল। তার উপস্থিতিতে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে অথচ সে নির্বাক। সুমি অনুরোধের সুরে বলল,
” এক মুহূর্তের জন্য স্বীকার করে নিন নিহিতা আপনার স্ত্রী। তাহলে মেয়েটা বেঁচে যাবে। সাহায্য করুন! ”

মাহদীর ভ্রুর মাঝে ভাঁজ পড়ল। সরু চোখে চেয়ে আছে সুমির দিকে। পুরো ব্যাপারটা এখনও তার মাথায় ঢুকেনি। শুরু থেকেই বুঝার চেষ্টা করছিল। পারছিল না। এতক্ষণে উপলব্ধি করল, নিহিতা সত্যিই বিপদে!

আহাদ আরও এক ধাপ সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে মাহদী দুজনের মাঝে চলে এলো। নিহিতাকে আড়াল করে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলল,
” ফিরে যাও, ছোট ভাই। ”

আহাদ গরম চোখে তাকালে মাহদী স্মিত হাসল। বলল,
” এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, ছোট ভাই। এতক্ষণ চুপ ছিলাম বলে এখনও থাকব এটা বোকামো। আমি শুধু নিহিতাকে বুঝার চেষ্টা করছিলাম। ”

আহাদের গরম চাহনি শীতল হয়ে আসল। কাতর স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” সত্যিই নিহিতার বিয়ে হয়ে গিয়েছে? ”

এ পর্যায়ে এগিয়ে আসল সুমি। বলল,
” এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আপনার? বিয়ে না হলে কি নিহিতাকে এভাবে আগলে রাখতেন উনি? ”

আহাদ আহত চোখে তাকায় সুমির দিকে। নিহিতার দিকেও। চলে যাওয়ার পূর্বে মাহদীর উদ্দেশ্যে বলল,
” দোয়া করি, আপনারা সুখী হোন। ”

আহাদ চলে যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচল সুমি। ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ে কয়েক বার। আনন্দে গলে যাওয়া কণ্ঠে ধন্যবাদ দেয় মাহদীকে। মাহদী সব কিছু উপেক্ষা করে নিহিতাকে বলল,
” এখন বাড়ি যাবে তো? ”

নিহিতা মাথা তুলল না। ঝুঁকা অবস্থায় মাথা উপরনিচ নেড়ে হ্যাঁ বুঝালে মাহদী বলল,
” চলো, তোমাকে রিকশায় তুলে দেই। ”

নিহিতা নীঃশব্দে মাহদীকে অনুসরণ করছিল। পেছন থেকে সুমি দৌড়ে এসে বলল,
” আমিও যাব। ”

নিহিতারা রিকশায় বসলে মাহদী হুড তুলে দেয়। নিহিতার ছড়িয়ে পড়া বোরকার অংশটা ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। রিকশাওয়ার হাতে ভাড়ার সাথে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বলল,
” চাচা, তাড়াহুড়ো করবেন না। ধীরে যাবেন। ”

রিকশাওয়ালা হেসে মাথা নেড়ে রিকশা ছাড়ে। নিহিতারা চোখের আড়াল হতে শিহাবের কণ্ঠ পাওয়া গেল,
” আরে, নায়রা ভাবি চলে গেল নাকি? পরিচয় করিয়ে দিবি না? ”

মাহদী তাৎক্ষণিক বলল,
” ওটা তোর ভাবি না। ”
” তাহলে? ”
” ভাবির বোন। ”

শিহাব খানিকটা উদাস হলো। সহসা বলল,
” সেই পিচ্চিটা? ”

মাহদী উত্তর দিল না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
” চল, কোথাও বসি। তোকে অনেক কিছু বলার আছে। ”

শিহাবও আর কথা বাড়াল না। বন্ধুর পাশাপাশি হাঁটা ধরে। কয়েক কদম এগুতে খেয়াল করল মাহদী মুচকি হাসছে। শিহাব অবাক হলো। কৌতূহল প্রকাশ করে সুধাল,

” হাসছিস কেন? ”

মাহদী বন্ধুর দিকে তাকাল। উত্তর দেওয়ার বদলে আবারও হেসে উঠল। শিহাব হাঁটা থামিয়ে বলল,
” কী হয়েছে বলবি? ”

পাশের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসল মাহদী। শিহাবকে বসার জন্য ইশারা করে বলল,

” নায়রার সাথে দেখা করতে এসে একটা ঝামেলা হয়ে গিয়েছিল। গণ ধোলাই খাওয়ার মতো অবস্থা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মার পিঠে পড়ার আগে কেউ একজন বলল, ‘আমি নায়রার স্বামী’ ব্যস! বেঁচে গেলাম। ”
” নায়রা তোর বউ হলে তুই তো তার স্বামীই হস। এতে আশ্চর্যের কী হলো? ”
” তখন আমাদের বিয়ে তো দূর পরিচয়ও হয়নি! ”

শিহাব বিস্ময় নিয়ে বলল,
” বলিস কী! বিয়ের আগেই স্বামী বানিয়ে দিয়েছে? ”
” হ্যাঁ। অবশ্য, সে ঘটনার জন্যই আজ আমি সত্যি নায়রার স্বামী। ”
” বুঝিনি। খুলে বল। ”

মাহদী কথার ফাঁকে চায়ের কথা বলেছিল। চা চলে আসতে হাতে নিয়ে বলল,
” একে তো বিশ্রী ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেলেছিলাম তার মধ্যে শখানেক লোকের সামনে অপমান বোধও করছিলাম। এসব থেকে রেহাই পেতে ঢাকায় ফেরার জন্য বাসে উঠলাম। সিটে বসতে আমার কী যেন হলো! ”
” কী হলো? ”
” জানি না। শুধু মনে হচ্ছিল, আমি যাকে খুঁজছিলাম যার অপেক্ষায় ছিলাম তাকে ফেলে চলে যাচ্ছি। মুহূর্তে নিজেকে অসহায় লাগল। নিঃসঙ্গ চেপে ধরল। জোর করেও সিটে বসে থাকতে পারলাম না। এক পর্যায়ে চলন্ত গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য হলাম। ফুলবাড়ির মাটি স্পর্শ করতেই নায়রার মুখটা মনে পড়ল। বুঝতে পারলাম ইনিই আমার সেই খুঁজে ফেরা অদৃশ্য টান! ”

শিহাব বেশ উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তারপর? ”
” তারপর আর কী? বাসায় ফোন দিয়ে জানালাম আমি বিয়ে করব। মেয়ে ঠিক হয়ে গেছে। তোমরা চলে এসো। ”
” বিয়ে হয়ে গেল? ”

মাহদী চায়ে চুমুক দিল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” হয়েছে। কিন্তু আমি যত সহজে বলছি তত সহজে হয়নি। ”
” তাহলে কঠিন করে বল। ”
” অন্য এক দিন বলব। মনকে রেখে এসেছি। ও আবার বাবাকে ছাড়া বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। ”

মাহদী চায়ের বিল মিটিয়ে বলল,
” মনের সাথে দেখা করবি নাকি ফিরে যাবি? ”

শিহাব উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না। মাহদীর সঙ্গে হাঁটা ধরে। রিকশায় উঠতে হঠাৎ মনে পড়ল মাহদীর হাসির কারণটায় জানা হয়নি। সে আগের প্রশ্নটা করতে মাহদী বলল,
” আজ আবারও বিয়ে ছাড়াই একজনের স্বামী হয়ে গেছি। ”

শিহাব চোখ বড় বড় করে বলল,
” কার? ”
” নিহিতার। ”

শিহাব মজার ছলে বলল,
” তাহলে কি মাহদীর সেই ‘কী জানি হলো’ ঘটনাটা আবার ঘটতে যাচ্ছে? ”

মাহদী রাগ চোখে তাকাল। শক্ত স্বরে স্পষ্ট করে বলল,
” নিহিতা নায়রার বোন। মানে, আমারও বোন। ”

কথাটা বলেই রিকশা থামাল মাহদী। শিহাবকে জোর পূর্বক নামিয়ে দিয়ে বলল,
” এক সময় নায়রা আমার রাগকে ভয় পেত। এখন আমি আমার রাগকে ভয় পাই। মনের সাথে দেখা করতে অন্য দিন আসিস। ”

__________
” ঐ ছেলেটার কাছে আহাদ তো কিছুই না। তার কথা বলার ধরণ দেখেছিস? শান্ত অথচ দৃঢ়! ”

সুমির কার কথা বলছে বুঝতে না পেরে নিহিতা বলল,
” কোন ছেলে? ”
” কোন ছেলে আবার? তোর স্বামীর অভিনয় করল যে সে। ”
” ওহ। ”

নিহিতার ‘ওহ’ শব্দটাকে উড়িয়ে দিয়ে সুমি বলতে শুরু করল,
” কী সুন্দর অভিনয় করল। আহাদের কাছ থেকে তোকে বাঁচিয়ে নিল। আবার রিকশায় তুলে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে কেমন সাবধান করল খেয়াল করেছিস? রিকশার হুডটাও তো তুলে দিল। নিহিতা, তুই শুধু ভাব একটু অভিনয় করতে বলেছি বলেই এতটা যদি সত্যি স্বামী হত তাহলে কেমন হত? আমার তো ঐ মেয়ের উপর হিংসে হচ্ছে। ”
” কোন মেয়ে? ”
” যে মেয়ে এই ছেলেটাকে স্বামী হিসেবে পাবে। ”

নিহিতা এবার বিরক্ত হলো। খানিকটা বিরক্ত ঝেরেই বলল,
” কী তখন থেকে ছেলে ছেলে করছিস? উনার নাম মাহদী। ”

সুমি আশ্চর্য হয়ে বলল,
” তার নাম তুই কী করে জানলি? চিনিস নাকি? ”

নিহিতা সুমির দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
” হ্যাঁ। উনি নায়রা আপুর স্বামী। ”

সুমি বিস্মিত হলো। পর মুহূর্তে বিদ্রুপ করে বলল,
” নায়রা আপুর স্বামী মানে তোর দুলাভাই। সরাসরি বললেই হয়, ‘উনি আমার দুলাভাই।’ তা না করে একবার নাম ধরে বলছিস আরেক বার নায়রা আপুর স্বামী বলছিস। কেন? ”
” কী কেন? ”
” সহজ পরিচয়কে কঠিন পরিচয় কেন বানাচ্ছিস? মানছি এখনকার দিনে বোনের স্বামীকে দুলাভাই ডাকা চলটা উঠে যাচ্ছে। তাই বলে ওভাবে পরিচয় দিবি? মাহদী ভাইও তো বলতে পারতি। ”
” খেয়াল করিনি। ”
” খেয়াল করিসনি। নাকি অন্য কিছু? ”

সুমির সন্দেহমাখা প্রশ্নে খানিকটা ঘাবড়ে গেল নিহিতা। শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল,
” অন্য কিছু বলতে? ”

সুমি সরাসরি বলল,

” বোনের স্বামীকে নিজের স্বামী বানানোর মতলব। ”

নিহিতা নাক-মুখ কুঁচকে ফেলল। পরক্ষণে দৃঢ় স্বরে বলল,
” এমন কুৎসিত চিন্তা-ভাবনা যেন আমার শত্রুর মনেও না আসে। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here