নিষিদ্ধ বরণ পর্ব ৯+১০

#নিষিধ_বরণ
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৯)

এরশাদ রহমান চমকে উঠলেন। কিছুটা ভয়ও পেলেন বোধ হয়। উত্তর দেওয়ার পূর্বে মাহদী নিকটে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
” এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন? ”

এরশাদ রহমান তখনও নিজেকে ধাতস্থ করতে পারেননি। আরও কিছু সময় পর দুর্বল স্বরে বললেন,
” নিহিতাকে আনতে। ”

মাহদী বিস্মিত! পরক্ষণে উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল,
” নিহিতা কোথায় গেছে? ”

এরশাদ রহমান বড্ড তাড়াহুড়ায় থাকলেও মাহদীর প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে পারলেন না। দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে পড়া বদনে সবটা খুলে বললেন। মাহদী সাথে সাথে বলল,
” আপনার যেতে হবে না। আমি যাচ্ছি। ঠিকানা দেন। ”

এরশাদ রহমান সংশয় চোখে তাকালেন। ভ্রু জোড়ার মাঝে ভাঁজ পড়ল। চোখের চাহনিতে অনাস্থা ফুটে উঠতে মাহদী বলল,
” এভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আপনার মতো ধর্মপ্রাণ না হলেও চরিত্রে কোনো দাগ নেই। বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিয়ে দেখেন। ”

এরশাদ রহমানের তাকানোর ভঙ্গি পাল্টাল না। মাহদী দৃঢ় স্বরে বলল,
” অন্য চোখে যদি তাকিয়ে থাকি সেটা আপনার মেয়ে নায়রার উপর। তাও সাত দিনের মাথায় বিয়ে করেছি। অবশ্য আপনি রাজি থাকলে দ্বিতীয় দিনই হয়ে যেত! ”

এরশাদ রহমানের ভ্রুযুগলের মধ্যিখানের ভাঁজ আরও ঘন হলে মাহদীর স্বর নরম হয়ে গেল। অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,
” বিশ্বাস না হলে আর কী করার। যাই ঘুমাই। ”

মাহদী কথা শেষে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। এক পা ছেড়ে আরেকপা ফেলতে এরশাদ রহমান বললেন,
” আমি করিমকে ঠিকানা বলে দিচ্ছি ও তোমাকে নিয়ে যাবে। ”
মাহদী থামল। ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” করিম কে? ”
” আমাদের গাঁয়ের ছেলে। রিকশা চালায়। এত রাতে রিকশা ভ্যান কিছু পাবে না। হেঁটে যাওয়ারও সময় নেই। ”

মাহদীকে নিয়ে গেইটের সামনে দাঁড়াতেই রিকশা চলে এলো। তাকে রিকশায় তুলে দিয়ে ফোনে নিহিতার নাম্বারটাও তুলে দিলেন এরশাদ রহমান।

______________
কেক কাটার আগেই নাচ-গানের আসর জমেছিল নাদিমদের বাসায়। নিহিতা সব কিছু এড়িয়ে বার বার ঊর্মির দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা চালাচ্ছিল। কোনো ভাবেই কথা বলার সুযোগ করে উঠতে পারেনি। নিহিতা যত বারই কথা বলার চেষ্টা করেছে তত বারই সে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। অপমান বোধটুকু ছুড়ে ফেলে আবারও যখন ঊর্মির সাথে কথা বলতে চাইল তখনই ইমনের আগমন ঘটল। মুহূর্তেই গা গুলিয় উঠল নিহিতার। ঘৃন্য দৃষ্টি ছুঁড়ে সবার থেকে আলাদা হয়ে রুমের কোণে গিয়ে বসল। সেখান থেকে অবাক হয়ে দেখল তার অন্যান্য বন্ধুরা কী সুন্দরভাবে ইমনকে বরণ করছে। তাদের সহজ ব্যবহারে বুঝে গেল ইমনকে আগে থেকে চেনে। এখানে আসার দাওয়াতও তারাই দিয়েছে।

কেক কাটা শেষ হতেই ইমনকে নিয়ে পাশের রুমে ঢুকে গেল ঊর্মি। ভেতর থেকে ছিটকানি তোলার শব্দে নিহিতার ভেতরটাও কেঁপে উঠল! অসহায় চোখে বন্ধুদের দিকে তাকাল। তার সেই চাহনির অর্থ কেউ বুঝল না। সকলকে ফেলে নিহিতাই দরজায় টোকা দিল। অসহায় কণ্ঠে ডাকল,
” ঊর্মি? ”

ভেতর থেকে উত্তর আসার পূর্বে তাকে টেনে সরিয়ে নিল সেতু। সকলের মাঝে নিয়ে হাতে একটা কাঁচের গ্লাস তুলে দিয়ে বলল,
” এটা খা। ”

নিহিতার চক্ষুদ্বয় তখনও ঊর্মিদের রুমের দরজার দিকে নিবদ্ধ। চুম্বকের মতো লেগে থাকা সেই দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হলো এক অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠে,
” মুখত কাপড় বান্ধি থুলে কেইংকা করি খাবু? ”

নিহিতা চমকে তাকাল মানুষটির দিকে। মোটামুটি গড়নের মানুষটার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। পরনের শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা। বুক পকেটে ভারী কিছু থাকায় শার্টের কলার এক দিকে হেলে গিয়ে কাঁধের এক অংশ দেখা যাচ্ছে। মানুষটার হলদে চোখে চোখ পড়তে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল নিহিতা। সেতুর একটা হাত চেপে ধরে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” উনি? ”
” নাঈমের চাচা। লোকটা কিন্তু দারুন। আমাদের জন্য উপহার এনেছেন। ”
” কী উপহার? ”

সেতু নিহিতার হাতে থাকা গ্লাসে হাত রাখল। চোখ টিপে বলল,
” খেলেই বুঝবি। ”

নিহিতার খেতে হলো না। তার আগেই একটা তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগল। নিহিতা নেকাব পড়া অবস্থায় বমি করে দেওয়ার মতো অবস্থা হলো। হাতের গ্লাসটা কোনোমতে সেতুর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরের নির্মল হাওয়াই দীর্ঘ নিশ্বাস টানল। ফাঁকা ঢোকর তুলল কয়েক বার। বেশ কিছুক্ষণ পর পেটের ভেতরের মোচড় বন্ধ হলো। একটু ভালো অনুভূত হতে ঘুরে দাঁড়াল বন্ধুদের দিকে। তারা কিছু একটা নিয়ে হাসাহাসি করছে আর মদ গিলছে। নিহিতার মায়া হলো। ভয় হলো। এক অদ্ভুত আশংকায়ও পড়ল। হঠাৎই সবাইকে অপরিচিত বোধ হলো। এরাই তার বন্ধু এ কথা স্বীকার করতে কষ্ট হচ্ছে!

নিহিতা ছুটে এলো তাদের কাছে। এসব খেতে নিষেধ করল। শুনল না কেউ। তাকে নিয়ে উপহাস করল, ব্যঙ্গ করল, ঠাট্টা বিদ্রুপে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখন নিহিতার চোখ গিয়ে পড়ল নাঈমের চাচার দিকে। সে দূরে বসে থাকলেও চোখ দুটো এদিকেই আটকে আছে। লোলুপ দৃষ্টি চিনতে ভুল করল না নিহিতা। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেতুর দিকে তাকাতে খেয়াল করল তার কালো টপসটা পেটের এক দিক থেকে সরে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সেতুকে আড়াল করে দাঁড়াল সে। টপসটা ঠিক করে দিয়ে বলল,
” অনেক রাত হয়েছে। আমি এখন বাসায় যাই। ”

পাশ থেকে সুমি বলল,
” যাই মানে? তুই তো কিছু খেলিই না। ”

সানোয়ার বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,
” কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। আজ সারা রাত মজা-মাস্তি চলবে। এমন দিন কবে আসবে কে জানে! ”

নাঈমও সুর মেলাল,
” তোকে আগে কখনও এভাবে পাইনি। ভবিষ্যতে পাব নাকি তারও ঠিক নেই। ”

সুমি নিহিতার কাছে এসে দরদি স্বরে বলল,
” সেই সন্ধ্যা থেকে এগুলো পরে আছিস। এবার একটু পাল্টা। ”

সানোয়ারও সহমত হয়ে বলল,
” হ্যাঁ, আমরা আমরাই তো। ”

নিহিতা নিজের বক্তব্য পেশ করার পূর্বে সেতু ওর নেকাবে হাত দিয়ে বলল,
” এটা আগে খোল। তোকে দেখে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে! ”

নিহিতা তাৎক্ষণিক সরে গেল। মুখের নেকাব হাত দিয়ে চেপে ধরে বলল,
” দরকার নেই। তোদের ইচ্ছে ছিল তাই এসেছি। এখানে আসার জন্য বাবা অনুমতি দিলেও থাকার অনুমতি দেয়নি। ”

সানোয়ার কিছু বলার জন্য উদ্যত হতে সুমি থামিয়ে দিল। নিহিতার কাছে গিয়ে বলল,
” ঠিক আছে। চলে যাস। কিন্তু একটু কিছু খাবি না? ”

নিহিতা চুপ থাকলে সুমি আবারও বলল,
” যা ভেতর থেকে হাত-মুখ ধুয়ে আয়। ততক্ষণে তোর খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। ”

নিহিতা সেতুর মুখের দিকে তাকালে সে আস্থা দিয়ে বলল,
” কেউ দেখবে না। সানোয়ারদের বাইরে পাঠিয়ে দিব। ”

এই এতক্ষণে নিহিতার চোখে-মুখে খুশি দেখা গেল। সব কিছু ভুলে হাত-মুখ ধুতে চলে যায়। নেকাব খুলে বোরকার হাতা গুটিয়ে নেয়। মুখে পানির ঝাপ্টা দিয়ে কী মনে করে পেছনে তাকাল। সাথে সাথে সানোয়ারের মুখোমুখি হলো। নিহিতা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর পূর্বেই সানোয়ার চিৎকার করল,
” দেখেছি। নিহির মুখ দেখেছি। নাঈম আমার এক হাজার টাকা রেডি কর। ”

নিহিতা কাঠ শরীরে দাঁড়িয়ে থাকল। পরক্ষণেই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল! কাঁদতে কাঁদতে সে জায়গায় বসে পড়তে ছুটে এলো সুমি। তাকে ঝাপটে ধরে বলল,
” কী হয়েছে, নিহি? ”

নিহিতা উত্তর দিল না। কাঁদল অনেক্ষণ। মুহূর্ত কাল পর চোখ মুছে বলল,
” আমি বাড়ি যাব। ”

সুমিকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। রুমে ছুটে এসে নিজের ফোন খুঁজতে এসে দেখল তার কাঁধ ব্যাগটি নেই।

_______________
মাহদী রিকশায় বসা থেকেই একাধারে কল দিচ্ছে নিহিতাকে। প্রতি বারই সুইচ অফ বলছে। এরশাদ রহমানের দুশ্চিন্তা এবার মাহদীর মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ল। করিমকে তাড়া দিতে লাগল বার বার।

নাঈমদের বাড়ির সামনে এসে রিকশা থামলে লাফিয়ে নামল মাহদী। গেইটে ঢুকে উঠোন শেষে পা রাখল বারান্দার সিঁড়িতে। একটুখানি এগিয়ে যেতে একটা বড় দরজা দেখে। কড়াঘাত দিতে দরজা খুলে দেয় কেউ। সামনের মানুষটির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি ঠিক আছো? ”

এই সময়, এই জায়গায় মাহদীর উপস্থিত একদমই কাম্য ছিল না নিহিতার। বিস্ময়ে স্তব্ধ! ভাষা হারিয়ে বোকা চোখে তাকিয়ে আছে।

” তোমার ফোন বন্ধ কেন? ”

নিহিতার চৈতন্য ফিরল। বলল,
” ফোন খুঁজে পাচ্ছি না। ”
” খুঁজে পাচ্ছ না মানে? কখন হারিয়েছে? ”

নিহিতার পাশে এসে দাঁড়াল সুমি। দ্রুত বলল,
” হারায়নি। এখানেই কোথাও একটা আছে। ”

মাহদী সুমির দিকে না তাকিয়ে রুমের ভেতরে তাকাল। একটু দূরেই সানোয়ার আর নাঈম বসে আছে। চোখ-মুখের ভাব বিরক্ত! সে দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে নিহিতার উদ্দেশ্যে বলল,
” বাসায় যাবে তো? ”

নিহিতা মাথা নাড়াল হালকা। মাহদী ফিরে হাঁটতে গিয়ে আবার ঘুরল। সন্দেহি কণ্ঠে বলল,
” সব ঠিক আছে তো, নিহিতা? ”

মুহূর্তে চোখের কোল ভরে উঠল নিহিতার। অশ্রু গড়িয়ে পড়ার আগে বন্ধুদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বিদায় নিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” সেতু কোথায়? ”

সুমি রুমের ভেতর তাকাল। চার পাশে চোখ বুলিয়ে নাইমদের উদ্দেশ্য প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” সেতু কোথায়? ”

ওরা দুজন বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। দুজনেই এদিক-ওদিক ছুটে এসে বলল,
” কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। বাইরে গেল নাকি? ”

নিহিতা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
” দরজা তো ভেতর থেকে আটকানো ছিল। ”

সুমি এবার ঊর্মিদের রুমে টোকা দিল। বেশ কয়েক বার টোকা পড়তে ঊর্মি আর ইমন বেরিয়ে আসে। জানায় সেতুর কথা তারা জানে না। সকলের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে মাহদী বাইরে থেকে বলল,
” কোনো সমস্যা? ”

নিহিতা কান্না প্রায় গলায় বলল,
” সেতুকে খুঁজে পাচ্ছি না! ”

পর্ব (১০)

নিহিতা কান্না প্রায় গলায় বলল,
” সেতুকে খুঁজে পাচ্ছি না! ”

মাহদী সাথে সাথে কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। এক পলকে সবার দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে বলল,
” খুঁজে পাচ্ছ না বলতে? সে কি বাচ্চা? ”

নিহিতা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসল। দিশাহারা ভঙ্গিতে বলল,
” না। সেতু আমাদের বন্ধু। ভেতরের রুমে আড্ডা দিচ্ছিল। তারপর…”

নিহিতা চুপ হয়ে গেলে মাহদী জিজ্ঞেস করল,
” তারপর? ”

নিহিতার মনে পড়ল সানোয়ারকে নিয়ে ঘটে যাওয়া ঘটনায় সকলেই ব্যস্ত ছিল। সেই ফাঁকে কি সেতুর সাথে কিছু হলো? ”

” নিহিতা? ”

নিহিতা ভাবনা থেকে বেরিয়ে বলল,
” তারপর আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। ”

মাহদী ব্যাপারটাকে সাধারণভাবে নিয়ে বলল,
” হয়তো কোথাও বেরিয়েছে। ”

নিহিতা মনে করিয়ে দিল,
” না। দরজা ভেতর থেকে আটকানো ছিল। আপনি যখন আসলেন তখন খুলেছি। ”

এবার মাহদীর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। চোখে-মুখে উদ্বিগ্নতা স্পষ্ট! গুরুতর চিন্তায় পড়তে টনক পড়ল। সহসা বলল,
” মেয়েটি কি কালো রঙের কিছু পরেছিল? ”

নিহিতা আরেকপা এগিয়ে আসল মাহদীর দিকে। দ্রুত মাথা নেড়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল,
” হ্যাঁ। আপনি কী করে জানলেন? ”
” আমি যখন দরজায় কড়া নাড়ছিলাম তখন একটা মেয়ের গলা পেয়েছিলাম। পেছন ঘুরে দেখি একজন মাঝ বয়সী লোকের কাঁধে মাথা ফেলে উঠোন পার হয়ে কোথাও একটা যাচ্ছে। ”

সুমি জায়গায় দাঁড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে বলল,
” এটা কী করে হতে পারে? ”

পেছন থেকে সানোয়ার জিজ্ঞেস করল,
” কী বলতে চাচ্ছিস? ”
” সেতু বাইরে গেল কী করে? যদি দরজা খুলে যায় তাহলে ভেতর থেকে আটকাল কে? ”

সকলের চোখ গিয়ে পড়ল নাঈমের উপর। সে ভয় পেয়ে গেল। শরীর থেকে ঘাম ছোটার পূর্বে মিনমিনে বলল,
” আমি লাগাইনি। ”

সানোয়ার বন্ধুর কাছে গিয়ে বলল,
” তাহলে কে আটকাল? ”

নাঈম সাথে সাথে উত্তর দিতে পারল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ বলল,
” রান্নাঘর দিয়ে বেরিয়েছে মনে হয়। ওখানে আরেকটা দরজা আছে। ব্যবহার করা হয় না। ”

সুমি সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রাখল,
” সামনে দরজা থাকতে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বের হলো কেন? ”
” ও বের হয়নি। কেউ বের করেছে। ”

নিহিতার কথা শুনে সকলে চমকে তাকাল। সচকিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল সুমি,
” কে? ”

নিহিতা নাঈমের দিকে তাকাল। পরক্ষণে দৃষ্টি সরিয়ে দুর্বল স্বরে বলল,
” নাঈমের চাচা। ”

সানোয়ার এগিয়ে এসে বলল,
” নাঈমের চাচা বললেই ও যাবে কেন? ”

এবার মুখ খুলল মাহদী। রুষ্ট স্বরে বলল,
” বোধ শক্তি হারিয়েছে বলে। সেতু এলোমেলো পায়ে হাঁটছিল। মদ খেয়েছিল নাকি? ”

কেউ উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে ফেলল সকলে। এতে মাহদীর রাগ আকাশ ছুঁলো। রাম ধমক দিয়ে বলল,
” এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে সেতুকে খুঁজে বের করো গাধার দল। কী ঘটতে যাচ্ছে তোমরা ভাবতেও পারছ না! ”

মাহদী আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। বারান্দা পেরিয়ে উঠোনে চলে আসল। নিজের উপর রাগ হচ্ছে খুব। তখন যদি একটু ভালো করে খেয়াল করত তাহলে ব্যাপারটা এত দূর গড়াত না!

নিহিতা, সুমি, সানোয়ার এমনকি নাঈমও সেতুর অনুসন্ধানে নেমে পড়ছে। একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছুটাছুটি করছে বাড়ির ভেতর ও বাহিরে। নিহিতা বাড়ির মধ্যেই খুঁজছিল। আশেপাশের পুরো জায়গাটা চষে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল দেয়ালের কাছের পেয়ারা গাছটির নিচে। চিন্তা আর অস্থিরতায় শরীর বেয়ে ঘাম ছুটছে তার। দুর্বল শরীরে নিশ্বাস নেওয়া কষ্টসাধ্য। বড় নিশ্বাস টেনে ডানে তাকাল। সাথে সাথে চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল বাড়ি ও দেয়ালের মধ্যের সরু জায়গায়টায়। অন্ধকারে পুরুষের ছায়া নড়ছে। নিহিতা উদ্বেগ নিয়ে একটু এগিয়ে গেল। ছায়াটি দৃষ্টি সীমায় আসতেই নিহিতা ভয়ে জমে গেল। হা-পা কাঁপছে! কাঁপুনি নিয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে নাঈমের চাচার দিকে। শরীরের উপরের ভাগে কাপড় নেই। অঙ্গপ্রতঙ্গে পাগলের মতো অস্থিরতা। সে অবস্থায় সেতুর কালো জামাটি ছিঁড়ে ফেলার তুমুল প্রচেষ্টা!

নিহিতার জমে যাওয়া শরীরটি আরও এক বার কেঁপে উঠল মাহদীর কণ্ঠ স্বরে। নাঈমের চাচার গলা চেপে ধরে চিৎকার করছে। চোখে-মুখে উগ্র ভাব। ভয়াবহ কিছু করে ফেলার মতো অবস্থা। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে প্রায়। নিহিতা ভয় ফেলে ছুটে এসে মাহদীকে সাবধান করল,
” উনি মারা যাবেন তো! ছাড়ুন। ”

ততক্ষণে সুমি, সানোয়ার, নাঈমও চলে এসেছে। নিহিতার মতো সাহস করে উঠতে পারল না কেউ। এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করছে সবটা। নিহিতার কথায় হোক অথবা অন্য কিছু মাহদী লোকটাকে ছেড়ে দিল। লোকটা দেয়ালের সাথে লেগেই মাটিতে বসে পড়ল। কাঁশি থামছেই না!

নিহিতা ছুটে যায় সেতুর কাছে। সে অজ্ঞান হয়ে গেছে! সুমি একটু সাহস সঞ্চয় করে নিহিতার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। সেতুকে ধরে রাখতে সাহায্য করছে। সেই ফাঁকে মাহদীকে দেখছে বার বার। রাগে তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে। কণ্ঠ হার বের হয়ে যাওয়ার যোগাড়! তপ্ত নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে পায়চারি করছে। কয়েক বার এপার থেকে ওপার ঘুরে অকস্মাৎ ভারী ইট তুলে নিল হাতে। তীর বেগে ছুটে এসে লোকটির মাথায় বাড়ি দিতে গিয়েও থেমে গেল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
” নায়রার জন্য বেঁচে গেলি! ”

তারপরেই নিহিতার উদ্দেশ্যে বলল,
” এর কী শাস্তি হওয়া উচিত বলো। তুমি যা বলবে তাই করব। ”

নিহিতা লোকটার দিকে তাকাল। ঘৃণায় ভেতরটা তেতো হয়ে আসলে চোখ ফিরিয়ে নিল। বলল,
” মৃত্যু ব্যতীত যা ইচ্ছে হয়। ”

মাহদী নির্দয় দৃষ্টিতে তাকাল। ইচ্ছে হচ্ছে ইট দিয়ে বিকৃত মস্তিষ্কটা ছেঁচে দিতে! পারছে না বলে রাগটা কমছে না। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
” তোমরা গেইটের বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, আমি আসছি। ”

সেতুকে নিয়ে নিহিতা আর সুমি সাবধানে হাঁটা ধরে। সানোয়ার আর নাঈম পেছন ধরলে মাহদী বলল,
” নাঈম, তুমি এখানেই থাকো। ”

নাঈমের পা আটকে গেল। ভীত চোখে মাহদীর দিকে তাকালে সে বলল,
” বাসায় দড়ি আছে? মোটা দড়ি? ”

নাঈম মাথা নাড়লে মাহদী বলল,
” নিয়ে আসো। জলদি। ”

নাঈম বাসার ভেতর ঢুকে গেল। দড়ি নিয়ে যখন ফিরল তখন লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেলল। তার চাচার শরীরে সুতো বলতে কিছু নেই!

মাহদী বস্ত্রহীন লোকটিকে পেয়ারা গাছের সাথে বেঁধে নাঈমের উদ্দেশ্যে বলল,
” আজ রাতটা তুমি আমার সাথে ঘুমাবে। চলো। ”

_________________
সে রাতে সেতু আর সুমি নিহিতাদের বাড়িতেই ছিল। শেষ রাতের দিকে ঘুমিয়েছিল বিধায় সুমির ঘুম ভাঙল দেরিতে। সেতু তখনও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নিহিতা নেই। তাকে খোঁজার আগ্রহ দেখা গেল না সুমির মধ্যে। সে অগোছাল ভাবে গিয়ে দাঁড়াল বারান্দায়। উঠোনের দক্ষিণ পাশে নজর পড়তে তার ঘুম ঘুম ভাব কেটে গেল। ফোলা চোখ দুটিতে মুগ্ধতা ভর করল। ঘোর লাগা সেই দৃষ্টি আটকাল মাহদীর উপর। একটা বাচ্চা ছেলের সাথে দুষ্টুমিতে নেমে কী সুন্দর হাসছে!

” এখানে কী করছিস? চল নাস্তা করবি। ”

নিহিতার দিকে ফিরেও তাকাল না সুমি। বিমুগ্ধ চোখ জোড়া তখনও মাহদীর সুশ্রী মুখখানায়! নিহিতা সুমির চুলগুলো খোঁপা করে দিল। গলায় পড়ে থাকা ওড়নাটা মেলে মাথাসহ বাহু ঢেকে বলল,
” বাবা বাইরে বের হবেন। ভেতরে চল। ”

নিহিতার কথা উপেক্ষা করে সুমি ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
” এই মানুষটাকে পাওয়ার জন্য শুধু বাবার অবাধ্য কেন পুরো পৃথিবীও ছাড়া যায়। নায়রা আপুর পছন্দ নেশা ধরানোর মতো! ”

নিহিতা ভ্রু বাঁকাল। সুমিকে জোর করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
” কী বিড়বিড় করছিস? ”

সুমি আপ্লুত কণ্ঠে বলল,
” আপুর লাভ স্টোরি শোনা হলো না। ”
” কোন আপুর? ”
” নায়রা আপুর। আজ শুনাবি? ”

নিহিতা বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
” নায়রা আপুর লাভ স্টোরি থাকলে তো শোনাব। ”

সুমি অবাক হয়ে বলল,
” লাভ স্টোরি নেই? কিন্তু আমি যে শুনেছিলাম নায়রা আপু ভালোবেসে মাহদী ভাইয়াকে বিয়ে করেছিল।
” না। ”
” তাহলে? ”
” তাহলে কী? ”
” তাহলে বিয়ে করেছিল কেন? ”

নিহিতা উত্তর দিল না। তার হঠাৎ মনে হলো সে নিজেও জানে না তার আপু কেন বিয়ে করেছিল।

নিহিতার চুপ থাকার মধ্যেই সুমি আরেক বার মাহদীর দিকে তাকাল। বলল,
” উনার হাসিটা দেখেছিস? মনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো। ”

সুমিকে অনুসরণ করে নিহিতাও তাকাল মাহদীর দিকে। নিমিষেই নিহিতার বিস্ময়াভিভূত চোখ জোড়া চুম্বকের মতো আটকে গেল মাহদীর মুচকি হাসি টানা ঠোঁট জোড়ায়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here