নিস্তব্ধ বিচরণ,পর্ব-১৬+১৭

#নিস্তব্ধ_বিচরণ
#তানজিলা
#পর্ব -১৬

দুপুরের দিকে পড়ে গিয়ে পা মচকে বসে আছে রেহানের দাদী জেরিন। খবর পেয়ে সবাই ছুটে আসে। ডাক্তার সম্পূর্ণ রেস্টে থাকতে বলেছে। নাজনীন জেরিনের পাশেই বসে আছে। রেহান আর ইনায়াও মাত্র এলো। দুপুরের দিকে ইনায়াকে নিতে গিয়েছিল রেহান। তখনই ওর দাদীর খবরটা শুনেই ইনায়াকে নিয়ে সোজা এ বাড়িতে এসেছে। জান্নাতকে একটু দেরিতে আসতে দেখেই মুখটা কালো করে সরিয়ে ফেললো জেরিন।

-“এতক্ষণ পর আসার সময় হলো! সারাদিন ঐসব পাগলদের নিয়ে ব্যাস্ত থাকলে সময় হবেই বা কিভাবে!”

জান্নাত হাসিমুখেই ওর দাদীর সামনে গিয়ে বসলো। এসব কথা ওর জন্য নতুন কিছু না। জান্নাত পেশায় একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। এছাড়াও বেশ কয়েক বছর যাবৎ একটা মেন্টাল হেলথ্ অরগানাইজেশানের সাথে কাজ কাছ করছে ও। বিষয়টা জেরিন একদমই ভালো ভাবে নেয় না।
-“এই যে তোমার পা মচকানোর সাথে সাথে তোমার ছেলে বেস্ট ডাক্তার বাসায় নিয়ে এলো। সে যেই কাজ করে আমিও তাই করি। শুধু ধরণটা আলাদা। সে শারিরীক রোগের চিকিৎসা করে আর আমি মানসিক। ব্যাপারটাকে এতো তুচ্ছ ভাবে নিও না দাদী।”

জেরিন ঝাড়ি মেরে বললো,
-“আমাকে বুঝাতে আসিস না। তোর থেকে বেশি দুনিয়া দেখেছি আমি। একটাই ভয়, কবে না জানি তুই নিজেই পাগল হয়ে বসে থাকবি! তাহলে যদি একটু শান্তি হয় তোর!”
জান্নাত জানে এখন কিছু বললে শুধু কথাই বাড়বে। লাভ হয়তো হবে না।

তিন ভাই বোনের মধ্যে রেহানই শুধু জেরিনের চোখের মণি। ওর দিকে তাকিয়ে কোন কিছুতে মানা করতে পারে না। ইনায়ার ব্যপারটায় জেরিনের আপত্তি থাকলেও রেহানের ওপর কিছু বলতে পারেনি। ইনায়াকে খুব বেশি অপছন্দ করে তাও না। কিন্তু তারপরও মনে খুঁতখুঁত লেগেই আছে। বিশেষ করে ঐদিনের পর থেকে। ইনায়ার আর কোন সমস্যা আছে কি-না এ নিয়ে বেশ টেনশনে আছে জেরিন। বিয়ের পর কয়েকদিন মোটামুটি স্বাভাবিক মনে হয়েছিলো ওকে। সেজন্য ওতটা মাথা ঘামায় নি জেরিন। রেহানের জন্য অনেক কষ্টে মেনে নেয় ইনায়াকে।
কিন্তু বারবার এটা পারবেনা। এই বাড়ির মান সম্মান তো অর্ধেক গেছে। বাকি অর্ধেকও যাবে মনে হচ্ছে! এখন যদি ইনায়ার কোন মেন্টাল প্রবলেম থাকে তাহলে হয়তো অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে!দাদী হয়ে চোখের সামনে ছেলেটার জীবন এভাবে নষ্ট হতে কি করে দেখতে পারে ও! তারউপর জান্নাতও যদি উল্টাপাল্টা কিছু বুঝিয়ে দেয় ইনায়াকে! এই বাড়ির ছেলের বউ পাগল আর বাড়ির মেয়ে পাগলের ডাক্তার! কেমন বিচ্ছিরী দেখায় ব্যাপারটা!

রেহান আর ইনায়ার দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলো জেরিন হঠাৎ ইয়াসমিনের কথায় টনক নড়লো।
-“মা, দুপুরের খাবার হয়ে গেছে প্রায়! এখনি খাবেন? তাহলে আপনার খাবারটা এখানেই দিচ্ছি।”
জেরিন মৃদু কন্ঠে ইয়াসমিনকে ঠিক আছে বলে রেহানকে নিজের কাছে এনে বসালো। নাজনীন, ইনায়া আর জান্নাত ইয়াসমিনের পিছু পিছু চলে গেল।

-“রেহান, কয়েকটা দিন এখানে থেকে যাবি?”
জেরিনের চাহনি দেখে না করতে পারলো না রেহান। খুশির ঝলক দেখা যাচ্ছে জেরিনের মুখে। ইনায়া চোখের সামনে থাকলেই বুঝা যাবে। যাই মেনে নিক কোন পাগলকে এই জেরিন বেগম কখনোই মেনে নেবে না। সেই ভয়ানক স্মৃতি মনে পড়লেই মাথা নাড়া দিয়ে ওঠে ওর। জান্নাতকে তো সামলাতে পারলো না। এখন যদি ইনায়াও সেই দলের হয়! মনে হতেও মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে জেরিন বেগমের। আবার মনে হয় ইনায়া তো স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছে সবার সাথে। ভাঙা পা নিয়ে নিজ চিন্তার শহরে ডুবকি দিয়ে বসে আছে জেরিন।

ইনায়া সেই কখন থেকে ওর শ্বাশুড়ি ইয়াসমিনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু জান্নাত আর নাজনীন সাথে থাকায় কিছু বলতে পারছে না। অপরদিকে হুট করে কোথা থেকে যেন মারিয়া এসে ইনায়ার ওড়না টানতে শুরু করলো। ঘটনার আকস্মিকতায় ইনায়াও প্রথমে চমকে উঠেছিল পরে নিচে তাকিয়ে দেখে মারিয়া।
মারিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ইনায়ার দিকে। কিন্তু কিছু বলছে না। চুইংগাম খেতে খেতে ওড়না টেনে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে ইনায়াকে। স্টোর রুমে এসে থামলো ও। ওপরের একটা তাকে হাত দিয়ে ইশারা করে বললো,
-“আমাকে ওই বল টা নামিয়ে দাও!”
মারিয়ার মুখে চুইংগাম থাকায় কথাটা বুঝতে কিঞ্চিত সময় লাগে ইনায়ার।

একটা ছোট্ট টুলের ওপর দাড়িয়ে তাকের মধ্যে থাকা বলটা নিতে গিয়েও মনে হলো টুলটা কেমন যেন নড়বড়ে। হঠাৎ ঠাস করে নিচে পড়ে গেল ইনায়া। টুলের এক পায়া খানিকটা নড়বড়ে ছিল যেটা ইনায়া খেয়ালও করেনি। পায়ে ভিষণ চোট লেগেছে। মনে হচ্ছে মচকে গেছে। নিজ থেকে উঠতে গিয়েও পারছে না। ওপরদিকে ইনায়াকে হঠাৎ করেই এভাবে পড়ে যেতে দেখে মারিয়া বেশ ঘাবড়ে গেছে। ইনায়ার আগে মারিয়া নিজেই ছুটে গেলো চিৎকার করে পুরো ঘর এক করতে!

চলবে…

#নিস্তব্ধ_বিচরণ
#তানজিলা
#পর্ব-১৭

নাজনীন ধরে ইনায়াকে রেহানের রুম পর্যন্ত নিয়ে আসে। পা টা হয়তো বেশি বেকায়দায় পড়েছে। একটা কাপড়ে বরফ পেঁচিয়ে ধরে রেখেছে ইয়াসমিন।
-“বেশি ব্যাথা করছে?”
ইয়াসমিন চিন্তিত হয়ে প্রশ্নটা করলেই ইনায়া মৃদু হেসে বলে,
-“না মা। টেনশন করার কিছু নেই। এইতো কি সুন্দর হেঁটে হেঁটেই তো এলাম। অতটা ব্যাথা পাই নি।”
ইয়াসমিনের মুখে সন্তুষ্টির কোন ছিটেফোঁটা নেই। সে বেশ মনোযোগ দিয়ে ইনায়াকে পর্যবেক্ষণ করছে।
মারিয়া ইয়াসমিনের পেছন থেকে উঁকি দিয়ে ইনায়াকে দেখছে।
-“আমার কোন দোষ নেই!”
ইনায়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে কথাটা বললো মারিয়া। জান্নাত আর নাজনীনও রুমে নেই। ইয়াসমিন একবার মারিয়ার দিকে তাকিয়ে উঠে বাইরে চলে গেল জান্নাতকে খুঁজতে। অনেকক্ষণ যাবৎ দেখছেনা ওকে। না জান্নাতকে আর না রেহানকে।

মারিয়া ইনায়ার পাশে বসে একটু পর পর ইনায়ার কোমরে গুটা দিচ্ছে।
-“কি করছো তুমি!”
-“কোমড় ভেঙেছে না-কি দেখছি!”
-“ভাঙেনি!”
ধীর কন্ঠে কথাটা বলে উঠে দাড়ালো ইনায়া। কোমরটা হালকা টনটন করলেও তেমন ব্যাথা পায়নি। শুধু হাটতে গেলেই পায়ে টান লাগছে। ইয়াসমিন এসে জোর করেই ইনায়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ইনায়া মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। হসপিটালে যেতে ওর মোটেও ভালো লাগে না। তবে মনে প্রশান্তির আভাস পায় ও। শুধু শুধু ভয় পেয়েছিলো এ বাড়ি নিয়ে।

রেহান পার্কিং প্লেসে গাড়ি রেখে ওখানেই বসে আছে। জান্নাত জরুরি কিছু হসপিটালে ফেলে আসায় আবারও এভাবেই দ্রুত হসপিটালে ফেরত আসতে হলো। প্রায় পনেরো মিনিট পর জান্নাত এসে গাড়িতে উঠতেই রেহান গাড়ি স্টার্ট করলো।

-“ইনায়ার সাথে কথা বলেছিস তুই?”
-“এখনও না। ও খুব সেনসিটিভ একটা মেয়ে। আমার মনে হয় না ওকে কোন প্রফেশনাল হেল্প নেওয়ার কথা বললে ও ব্যাপারটা ভালোভাবে নেবে। হয়তো মনে করবে আমিও ওকে সবার মতো পাগল মনে করি!”
মৃদু হাসলো জান্নাত। মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টা বেশিরভাগ মানুষের কাছেই সবচেয়ে অবহেলিত বিষয়।শারিরীক স্বাস্থ্য যতটা গুরুত্বপূর্ণ ভাবে দেখা হয় মানসিকভাবে স্বাস্থ্য ঠিক ততটাই যেন ফেলনা।

-“পিটিএসডির জন্য কাউন্সিলিং কিন্তু খুব হেল্পফুল হতে পারে। থাক তোকে কিছু বলতে হবে না। আমি নিজেই ওর সাথে কথা বলবো!”
রেহান এক ভ্রু উঁচু করে বললো,
-“দাদী জানলে কী হবে জানিস!”
সাথে ভ্রু কুঁচকে ফেললো জান্নাত।
-” তোর ব্যাপারে জানে দাদী?”
রেহান বাঁকা হেসে বললো,
-” সেটা নিয়ে তোর এতো ভাবতে হবে না। আমি এমনিও দাদীর ফেবারেট।”
জান্নাত মুখ ফুলিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। যত কথা হয়তো ওকেই শুনতে হবে!
বাড়ির সামনে এসে গাড়ি ব্রেক করতেই রেহানের ফোন বেজে ওঠে। জান্নাত গাড়ি থেকে বের হয়েই লক্ষ্য করে রেহান চোয়াল শক্ত করে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে। ফোনটা এখনও কানে। কী হলো কিছুই বুঝতে পারলো না জান্নাত।

রেহানের আসতে সেদিন রাত হয়ে গেল। হাতে দুইটা বড় ব্যাগ। ইনায়া তখন বসেই ছিল।
-“কয়েকদিন এখানেই থাকবো আমরা।”
ইনায়া জেরিনের কাছ থেকে আগেই শুনেছিল। এগিয়ে এসে ব্যাগগুলো ধরলো ও।
রেহান ইনায়ার পায়ে তাকিয়ে বললো,
-” একটু দেখেশুনে চললে কী হয়!”
ইনায়া কোন উত্তর দিল না। কিছু জামাকাপড় বের করে আলমারি গুছাতে শুরু করলো। রেহান কিছুক্ষণ ইনায়ার পায়ের দিকে তাকিয়ে ওর হাত চেপে ধরলো।
-“তুৃমি রেস্ট নাও। এসব আমি করছি!”

ইনায়া একবার নিজের হাতে লক্ষ্য করে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেই রেহান আরও শক্ত ভাবে ওর হাত চেপে ধরে।
-“সকালে কোথায় ছিলে তুমি?”
ইনায়া নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললো,
-“আমার ফ্রেন্ডের বাসায়।”
-“ইনায়া আমি কিন্তু জানি তোমার ফ্রেন্ডসদের! নিষেধ করেছিলাম তোমাকে!”
ইনায়ার চোখে ফুটে উঠলো ক্রোধের নেশা।
-“তো কী করবো আমি! আপনি আমার বাবার ব্যাপারে একটা কথা বলবেন আর আমি মেনে নেব! এতো সহজে!”
মুহূর্তেই ইনায়ার হাত ছেড়ে ওর দুই বাহু চেপে ধরে রেহান।
-“তুমি আমার কথা বিশ্বাস করো বা না করো সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু এর পর থেকে কখনও আমাকে ছাড়া ঘরের বাইরে যেন তোমার পা না পড়ে নইলে আমি কী করবো আমি নিজেও জানি না!”
রেহান ইনায়াকে ছেড়ে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। ইনায়া এখনও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। মুখ দিয়ে ফোপাঁনোর আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলো কাঁদছে ও।

ওয়াশরুম থেকে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হলো রেহান। ইনায়া উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে পড়েছে। রেহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়ার পাশে গিয়ে বসলো। ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে ইনায়া এখনও ঘুমায়নি।

-“রাতে খেয়েছো?”
যা ধারণা করেছিলো তাই। কোন জবাব পেল না ও। রেহান নিজেও এক দ্বিধায় পড়েছে। হয়তো একটু বুঝিয়ে বললে ইনায়া বুঝবে। কিন্তু সেই সুযোগটাও যেন পাচ্ছে না রেহান। প্রতিনিয়ত মনে ভয় জাগে ইনায়ার জন্য! তার মধ্যে ঐ সাদাফ!

-“আপনি এতো জোরালো ভাবে কি করে বলতে পারেন সাদাফই খুনি না?”
ইনায়ার কথায় টনক নড়লো রেহানের। ইনায়ার মনে হয়েছিলো হয়তো রেহান কিছু বলবে না। কিন্তু ইনায়ার ধারণাকে ভুল প্রমান করে রেহান দাতে দাত চেপে বললো,
-“ঐ দিন আমিও অফিসেই ছিলাম। সাদাফ শুধু করিডোর পর্যন্ত এসেছিল। যখন চিৎকারের আওয়াজ শুনি আমরা একসাথেই ছিলাম! তারপর আর ওকে আমি দেখিনি। আমি নিজেও জানি না তোমার বাবা সাদাফের কথাই কেন বললো। যেখানে এটা স্পষ্ট যে খুন না আমি করেছি আর না সাদাফ!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here