নিয়তি পর্ব -০৩

#নিয়তি
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি

৩.
‘তুমি এরকম পাগলের মতো করছো কেন বলো তো! তোমার কী মনে হয়, ৭ বছরের সম্পর্ক আমি এভাবে নষ্ট হতে দেবো? অবশ্য দোষ সম্পূর্ণ তোমার। আমার সাথে রাগারাগি না করলে আজ এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না বুঝছো?’

আমি স্তম্ভের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘরে ঢোকামাত্রই কথাগুলো কানে এলো। প্রহর সাহেব বারান্দায় কথা বলছেন কারো সঙ্গে,ফোনে। উক্তিগুলো তারই, তাহলে আমাকে অবহেলা করার পেছনের কারণ এই! উনার সাত বছরের সম্পর্ক আছে! ছিঃ ছিঃ ছিঃ- আমার জীবনটাকে এভাবে নষ্ট করে দিলেন উনি! এইভাবে? ঢোক চেপে ডুকরে উঠলাম। গোঙানির শব্দটা এতোটাই জোরে হলো যে উনি টের পেয়ে গেলেন। শশব্যস্তভাবে ফোন রেখে ছুটে এলেন আমার সামনে। আমি তখন মাটিতে বল ছেড়ে পড়ে আছি। শরীরটা নিশ্চল লাগছে। চোখ বেয়ে মেঘের বারিধারা, আমি কোনোদিন ভাবতে পারিনি কারো মাঝে থার্ড পারসন হয়ে দাঁড়াব!
প্রহর সাহেব ঠোঁট চুলকালেন, গাল চুলকালেন, ঘন দাঁড়িতে হাত বুলালেন। উনি নিশ্চয়ই ভাবছেন আমাকে কী বলে স্বান্তনা দেওয়া যায়। আমিও কাঁদতে কাঁদতে ভাবছি, কোন বাণী শুনলে নিজের মনটাকে শান্ত করতে পারব। অদ্ভুত হলেও সত্যি, এতকিছুর পরও আমার মন বলছে, একবার,শুধু একবার উনি আমাকে জড়িয়ে ধরুক। তাতেই দগ্ধ মনের জ্বলুনি কমবে। কী আশ্চর্য! এতটা বেহায়া কবে থেকে হলাম আমি! ছলছল চোখে আমি তার দিকে তাকালাম। তিনি বলার চেষ্টা করলেন, ‘রূপ, শোনো…’
আমার যে কী হলো তখন! কোনো কথাই কর্ণকুহরে গেল না। নির্লজ্জের মতো ঝাপিয়ে পড়লাম উনার গায়ের উপর। উনি টাল সামলাতে না পেরে আমাকে ধরলেন কোনোমতে। আমি হাউমাউ করে কাঁদছি, কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে যাচ্ছে। তবুও থামাতে পারছি না। লজ্জায় গাল,নাক- সব লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। এতটা অপমানিত আর কোনোদিন হইনি বোধহয়! যখন হুশ ফিরে এলো, তখন কান্নার বেগ কমলো। তবুও অসাড় হয়ে তার কাঁধে মুখ গোঁজ করে রাখলাম। তার বুকের কম্পন আমাকে সহ কম্পিত করে তুলছে। অদ্ভুত শিহরণ শিরায় শিরায়, রগে রগে- পাজরে পাজরে কাঁপন ধরছে। কালো মেঘের ঘনঘটা সরে বসন্তের মৃদুমন্দ বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে মনবাড়ি। উনার সাড়াশব্দ নেই,কোনো বাক্যও উচ্চারণ করেননি। কেমন যেন লাগছে আমার, আমি নিজেকে যথাসম্ভব সামলে মুখ তুলে তাকানোর চেষ্টা করলাম। আবিষ্কার করলাম, উনি ড্যাবড্যাবে চোখে আমাকে দেখছেন। লজ্জায় মিইয়ে গেলাম নিমিষেই। আখিপল্লব নামিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। বেশ কিছু সময় এভাবেই কেটে গেল। আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকবো তা ভাবতে শুরু করলাম। ঠিক তখনই শুনতে পেলাম তিনি বলছেন, ‘এভাবে কান্নাকাটি করার কারণ কী?’
আমি উত্তর দিতে পারলাম না। নিজেকে আরও গুটিয়ে এদিক ওদিক মাথা নাড়ালাম। উঠবার চেষ্টা করলে তিনি আমার হাত ধরে টান দিলেন। নিচু হয়ে গেলাম। হুট করে বুক থেকে শাড়ির আঁচল খসে পড়ল। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তিনিও স্তব্ধ হয়ে গেলেন। লজ্জারা আমাকে আপাদমস্তক ঘিরে ধরলো। দ্রুত হাতে আঁচল তুলে উঠে দাঁড়ালাম। চলে যাওয়ার পা বাড়াতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘শরীর দেখিয়ে আমাকে বশ করার চেষ্টা কোরো না। আমি একজনকে কথা দিয়েছি।’
‘তাহলে আমাকে কেন বিয়ে করলেন? আমি তো যেচে আপনার ঘরে আসিনি।’ গলায় কাঠিন্য যুক্ত করলাম। মেনি বিড়ালের ন্যায় কথা হয়েছে অনেক, এবার যা হবে সব খোলাখুলি। আমার জীবনটা পুতুল খেলা নাকী! চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে আমার,দেখলাম উনি খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছেন। আমতা আমতা করে বললেন, ‘ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল কিছু। সবকিছু বলতে পারব না।’
‘ঠিক আছে,আমাকে বলতে হবে না। যেহেতু আমাদের বিয়েটা পরিবার থেকে হয়েছে তাই যেকোনো ডিসিশন তারাই নিবে। আমি আমার আব্বা আম্মাকে জানাবো। আপনার আম্মাকেও জানাচ্ছি৷ তাদেরকেই বলুন কোন কারণে আমার জীবন নিয়ে খেললেন আপনি।’
সাধারণত আমি ভীষণ দুর্বল মনের অধিকারী। কিন্তু অন্যায় দেখলে আর সহ্য করতে পারি না। কীভাবে যেন খুব শক্ত হয়ে যাই! আর এখানে তো আমাকে নিয়ে অন্যায় হচ্ছে,কীভাবে চুপ করে থাকবো আমি?
গতি বাড়ালাম, শ্বাশুড়ি গিয়ে এক্ষুনি বলব সবটা- তার আগেই আমার স্বামী মহাশয় আমার পায়ের উপর আছড়ে পড়লেন। আমি চমকিত, তিনি অনুরোধের স্বরে বললেন, ‘প্লিজ, এরকম টা কোরো না, প্লিজ! আগে আমার কথাটা শোনো…’
আমি রুক্ষ স্বরে জবাব দিলাম, ‘আর কী বলবেন আপনি? কীভাবে আমাকে বোকা বানাইছেন, সেটা বলবেন?’
‘উঁহু,কীভাবে তোমাকে ঝটকা খাওয়ালাম, সেটা বলব।’
‘মানে!’ আমি এবার ভীষণ অবাক হলাম। দেখলাম, উনার ঠোঁটের কোণায় হাসি, আমাকে উদ্দেশ্য করে বিদ্রুপ ভরা হাসি ছুঁড়ছেন। আমার রাগ তখন আরও বেড়ে গেল। আমি চলে যেতে চাইলে উনি দ্রুত উঠে দরজা বন্ধ করলেন। তারপর আমার হাত ধরে টেনে বিছানায় নিয়ে বসালেন। আমি নাক উঁচু করে রেখেছি, একটা কথাও বলব না বলে ঠিক করেছি। উনি বলতে লাগলেন, ‘তোমার সাথে মজা করলাম একটু। দেখলাম, ক্ষেপালে তোমাকে কেমন লাগবে।’
ভেতরে ভেতরে চমকালেও আমি বাহির থেকে ঠাঁট বজায় রেখেছি। প্রত্যুত্তর করলাম না। তিনি আবার বললেন, ‘বোকা মেয়ে! আমার যদি কারো সাথে সম্পর্ক থাকতোই তবে কেন তোমাকে বিয়ে করতাম? আর বিয়ের আগে ক্লিয়ার করতাম না বলো?’
‘তাহলে কেন অবহেলা করলেন?’ অভিমানে গলা ভার হয়ে এলো আমার,চোখ টলমল করছে। উনি এবার আমার কাছে এলেন, খুব কাছে, যত কাছে এলে আমার নিঃশ্বাসের উত্তাপ উনার গায়ে লাগে। আমি শিহরিত বোধ করলাম। আঁটসাঁট হয়ে বসে রইলাম উত্তরের আশায়, ভেতরটা খুশিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই মজা করেছেন উনি!
‘আমি ভীষণ নার্ভাস ছিলাম, কীভাবে বললে তুমি ব্যাপারটাকে মজার চোখে দেখবে না তা ঠিক করতে গিয়ে এই পন্থা মাথায় এলো। তাই একটু রুড সেজেছিলাম আর আলাদা থেকেছি। নিজেকেও প্রস্তুত করেছি,আর তোমার কাছে হাসির পাত্রও হয়নি। নইলে তো সারা দেশে বলে বেড়াতে, বিয়ের রাতে তোমার ভয়ে আমি অন্যঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম!’
আমি ঠোঁট বাঁকিয়ে বললাম, ‘এতোটাই খারাপ না আমি। একবার বলে দেখতেন, আমি কখনোই অন্য মাইন্ডে নিতাম না বরং আপনাকে সময় দিতাম, নিজেও নিজেকে প্রস্তুত করতাম।’
‘কীসের জন্য? আমার আদর খাওয়ার জন্য?’ বলেই উনি চোখ টিপলেন। আমি অভিমান রাগ সব ভুলে লজ্জায় মিশে গেলাম। মাথা নুইয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছি। আমার অবস্থা দেখে তিনি খানিকটা সরে বসলেন। আমি স্বস্তি পেলাম, মিটিমিটি চোখে তার দিকে তাকালাম। প্রসঙ্গ ঘোরাতে প্রশ্ন করলাম, ‘আর ওই কথাগুলো? আপনি ফোনে কাকে বলছিলেন যে আপনার সাত বছরের সম্পর্ক?’
‘ওটা…!’ উনি হাসলেন, পকেট থেকে ফোন বের করে নাম্বার দেখালেন। “অধরা” নাম দিয়ে সেভ করা। বললেন, ‘দেখো,অধরাকে বলছি। আরে, তুমি আসছো আমি টের পেয়েই এমনটা করছি,বলছি। তোমার সাথে প্র‍্যাংক করছি। আর অধরাকে আগেই সেট করে নিছিলাম। বিশ্বাস না হলে ওর সাথে কথা বলে দেখতে পারো।’
‘বিশ্বাস করেছি।’
‘আচ্ছা যাও, আমি মাফ চাইলাম। জানি, যা করেছি খুব ভুল… মজা করতে গিয়ে তোমাকে অজান্তেই অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলছি। অবশ্য,এটা না করলে কখনোই বুঝতাম না আমাকে তুমি ইতিমধ্যেই কতটা ভালোবেসে ফেলছো।’
আমি চুপ করে রইলাম। এই কথার জবাবে কী বলতে হয়, আমি জানি না।
তিনি ক্ষণকাল চুপ করে থেকে ফের প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা রূপ, যদি সত্যিই আমার জীবনে কেউ থাকতো আর তুমি সেটা বিয়ের পর জানতে পারতে তবে কী করতে?’
আমি অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালাম। জানি না কেন, ভীষণ কান্না পাচ্ছে আমার। কেন পাচ্ছে,বলতে পারব না। কিছু কিছু কান্নার কারণ হয় না! হয়তো এটা সুখ কান্না!
আমি নির্মল গলায় বললাম, ‘আমি চলে যেতাম। কারো কাছে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে থাকতে চাই না,অভিশাপ কুড়োতে চাই না।’
‘নিজের স্বামীকে এত সহজে ছেড়ে দিতে?’
‘দিতাম, কেন আপনি শোনেননি, জোর করে কাউকে ধরে রাখা যায় না। আপনি তো মানুষ, বিড়াল কুকুর না যে জোর করে খাঁচায় ভরে পোষ মানাবো।’
উনি চুপ হয়ে গেলেন৷ আমি উঠে দাঁড়ালাম। উনি ডাকলেন, ‘রূপ..’
‘জি..’
‘কই যাচ্ছো?’
‘বারান্দায়।’
‘কী দরকারে?’
‘চাঁদ দেখবো।’

***

ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। নিস্তব্ধ নিগুঢ় প্রকৃতি। বারান্দার সামনে একটা চিপা গলি, আপাতত গলিতে কেউ নেই। গলির শেষ মাথায় টিমটিমে আলো দেওয়া হলদেটে আলো জ্বলছে, সেই আলোর দয়ায় গলির এই মাথায়ও হালকা পাতলা সবকিছু দেখা যাচ্ছে,কিন্তু সবই অস্পষ্ট,অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমি একপলক সেদিকে চেয়ে পুনরায় আকাশ দেখায় মনোযোগ দিলাম। আমার ভেতরটা ঢিপঢিপ করে কাঁপছে। আমি জানি উনি আসবেন, আমি জানি আজ রাতে কিছু হবে- যা বদলে দেবে আমার চিরচেনা পুরো পৃথিবী। আমাকে হারিয়ে নিয়ে যাবে নতুন কিছু আস্বাদনে। আমি জানি নিজেকে হারিয়ে তাকে চিনতে পারবো পুরোপুরি। এই আকুতি, এই কামনা, এই প্রণয়- আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মন চিৎকার করে বলছে, আপনি আসুন, আমাকে ভালোবাসুন, আদর করুন। সাক্ষী থাকুক এই রাতের প্রহর, ওই চাঁদ যেন লজ্জা পেয়ে নিজেকে মেঘের তলায় আড়াল করে নেয়। কোথায় আপনি? আসছেন না কেন? নাসিকাপথ বেয়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ঠিক তখনই আমার পেছনে তাকে আবিষ্কার করলাম। আমাকে আড়াল করে,আমার উপর দিয়ে দু’হাতে গ্রিল চেপে ধরেছেন উনি, উনার বুক আমার পিঠে মিশে গেছে। আমার শরীর ঘাম ছাড়লো,এতটা নার্ভাস জীবনে আর কখনোই হইনি। আমি গুটিশুটি মেরে রইলাম। উনি প্রশ্ন করলেন, ‘আকাশটা ভীষণ সুন্দর তাই না?’
আমি মাথা হেলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম।
‘তোমার মতো?’
আমি মাথা হেলিয়ে ‘না’ বললাম।
‘তোমার চাইতেও বেশি?’
আমি মাথা হেলিয়ে ‘না’ বললাম।
‘তোমার চাইতে কম?’
এবার মুখে বললাম, ‘জানি না।’
উনি ফট করে আমাকে টেনে মুখোমুখি করে নিলেন এবং অধরে অধর মেশালেন। আমি স্তম্ভিত পুরোপুরি, ওখানেই আমার নিঃশ্বাস আঁটকে এলো। ওখানেই আমার মরণ যেন! আমি অপেক্ষার প্রহর গুণতে লাগলাম। নিজের হাতজোড়া কখন যে উনার পিঠ খামচে ধরেছে,জানি না। যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম তখন অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। আমার ঘাড়,গলা,গাল,চোখ- সবকিছুতে উনার স্পর্শ লেগে গেছে। এলোমেলো চুলের আমি এক ছুটে ঘরে প্রবেশ করবার সিদ্ধান্ত নিলাম। উনার দিকে পিঠ দিয়ে বুকের আঁচল ঠিক করছি, খেয়াল করলাম কেউ একজন গলির কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। তার জ্বলন্ত চোখ আমাদের দেখছে। আমার আপাদমস্তক শিরশির করে উঠল। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে চিৎকার বেরিয়ে এলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here