নীরবে তুমি রবে পর্ব -১১

#নীরবে_তুমি_রবে
লেখনীতেঃ রিধিমা জান্নাত রূপা
পর্বঃ ১১

.
গায়ে পাতলা একটা গেঞ্জি, হাতে তোয়ালে। সেটা দিয়েই চুল মুছছে তাসফি। তাকে দেখেই মনে যাচ্ছে সদ্য গোছল সেরে বেড়িয়েছে। গায়ে লেগে থাকা বিন্দু বিন্দু পানির কোণা দ্বারা সেটাই যেন বোঝাচ্ছে। এদিকে তাসফির হঠাৎ বলা কথায় হতভম্বের মতো রুমের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে রূপা। তাসফির বলা কথায় সে যেন পুরাই আশ্চর্য! হয়ে গেছে। হাসবেন্ড, শ্বাশুড়ি এই শব্দগুলো তার কাছে অকল্পনীয় ছিলো যেন।

“কি হলো? ফ্রেশ হওয়ার ইচ্ছে নাই? এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবে?”

ঘোর কাটলো রূপার। আমতা আমতা করে বলতে লাগলো কিছু। তাকে থামিয়ে দিলো তাসফি, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হতে বলে তার ব্যাগটা দেখিয়ে দিলো। ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়লো রূপা, ব্যাগ থেকে একটা জামা হাতে নিয়ে বেশি যেতে লাগলো রুম ছেড়ে। সেদিকে খেয়াল হতেই তাকে থামিয়ে দিলো তাসফি। বললো,
“আরে, কই যাচ্ছো জামা হাতে।”

“আপনিই না বললেন ফ্রেশ হতে। তাই তো…..”

“তাহলে? বাইরে কেন যাচ্ছো?”

“আমি তো ওই রুমে….”

“আশ্চর্য! রূপা। তুমি কি গাধী?”

“আপনি আমাকে গাধী বলছেন? কোন দিক থেকে মনে হচ্ছে?”

বেশ জোরেই বললো রূপা। তাতে কিঞ্চিৎ হেঁসে উঠলো তাসফি। মুহুর্তেই হাসি’টাকে সামলে নিলো। বললো,
“তাইলে? এটা ছাড়া তো আমার মাথায় আর কোন ওয়ার্ল্ড আসছে না।”

বলেই একটু থামলো তাসফি। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলো, “এতবড় রুমে ওয়াশরুমের দরজা’টা কি তোমার চোখে পড়ছে না?”

মুহুর্তেই যেন নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো রূপা। সামান্য লজ্জা পেয়ে তাসফির দিকে তাকালো। তার দিকেই তাকিয়ে আছে তাসফি, ঠোঁটে লেগে আছে হাসি। মনে মনে বলে উঠলো,
“উফ্! রূপা, তুই সত্যিই গাধী। থাকবি এ রুমে, আর ফ্রেশ হতে যাচ্ছিস অন্য রুমের ওয়াশরুমে?”

তবে তাসফি কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, “না মানে, আসলে তো সবসময় ওই রুমেই থাকা হতো, তাই অভ্যাস হয়ে গেছে।”

“আজ থেকে এই রুম’টাকে নিজের অভ্যাসে পরিণত করো। সাথে রুমে থাকা….. ”

থেমে গেল তাসফি। ইচ্ছে করেই যেন কথাটার সমাপ্তি করলো না। তবে কিছুটা হলেও যেন সেই অসমাপ্ত কথাটা আন্দাজ করে নিলো রূপা। অবাকের রেশ নিয়ে তাকিয়ে রইলো তাসফির দিকে।
মিনিট দুয়েক সময় অতিক্রম হতেই যখন রূপা একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো, তখন তাসফি তাকে আবারও তাড়া দিলো। রূপাও আর কথা বাড়ালো না, বুকের দ্রিমদ্রিম শব্দের প্রতিধ্বনি নিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

ওয়াশরুমে ঢুকে কিন্তু মুহুর্ত নিজের হৃদপিণ্ডকে স্বাভাবিক করতে সময় নিলো রূপা। তারপর যখন হাতের জামা-কাপড় রাখতে নিলো তখনই খেয়াল হলো তোয়ালে তো সে আসে নি। উঁহু! ব্যাগ থেকে নয়, বাসা থেকেই আনে নি। তাসফির কথা মতো জাস্ট প্রয়োজনীয় কিছু আনবার চক্করে যে আরও কতকিছু প্রয়োজনীয় জিনিস সে আনে নি, সেটা ভেবেই মন খারাপ হলো। আর কিঞ্চিৎ পরিমাণ রাগ এসে জমা হলো তাসফির প্রতি। আর দাঁড়ালো না ওয়াশরুমে। মুখটা গোমরা করে বেড়িয়ে এলো, দাঁড়িয়ে পড়লো তাসফির সামনে।
এতক্ষণে নিজের মনোযোগ মোবাইলে নিবদ্ধ করেছে তাসফি। যখন বুঝতে পারলো কেউ এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে, তখন মাথা তুলে চাইলো। রূপার করা গম্ভীর মুখখানা দেখে মাথা নাড়িয়েই জিজ্ঞেস করলো –কি হয়েছে? তাসফির ভাবভঙ্গিতে রূপা যেন আরও গভীর করে ফেললো মুখটা। বললো,
“কি হবে? আপনার কথায় লাগেজ ফাঁকা রেখে মাত্র কয়েকটা জামা নিয়ে আসলাম, আর যেগুলো অতি প্রয়োজন সেগুলো আনলাম না।”

“তোমাকে বলেছিলাম যেগুলো বেশি প্রয়োজন সেগুলোই সাথে নিতে।”

“হ্যাঁ! আমিও তো সেটাই বলেছিলাম, সবকিছুই তো আমার প্রয়োজন হয়।”

“আচ্ছা, আচ্ছা রিলাক্স! বিকেলে তোমাকে নিয়ে বের হবো। যা যা লাগবে নিয়ে নিও।”

তাসফির কথায় কিছুটা দমে গেল রূপা। পরমুহূর্তেই ফ্রেশ হবার কথা ভাবতেই মনে পড়লো তোয়ালের কথা। বলে উঠলো, “কিন্তু এখন? আমি গোছল করবো না? তোয়ালে’ই তো আনি নি।”

সহসায় কিছু বললো না তাসফি। সামান্যক্ষণ চুপ করে থাকলো। ভাবলো কিছু একটা। তারপর পাশে থেকে তার তোয়ালে’টা রূপার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে,
“আপাতত এটা ইউজ করো। বিকেলে নিয়ে নিও।”

“কিন্তু আপনার টা….”

“নিতে পারো না? সমস্যা আছে?”

“না মানে….”

“গো ফাস্ট! সারারাত জার্নি করার পরও যে এভাবে কিভাবে আছো?”

আর কথা বলার সুযোগ পেল না রূপা। হাতের তোয়ালে’টা তার হাতে ধরিয়ে দিলো তাসফি, জলদি করে ফ্রেশ হতে বললো। সমস্ত দ্বিধা সরিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল রূপা। মনে মনে ভাবলো —সামান্য তোয়ালেই তো, তাছাড়া পুরো মানুষটার প্রতি’ই তো তার অধিকার জন্মেছে, তার জিনিস ব্যাবহার করতে তো বাধা নেই।
ফ্রেশ হয়ে রুমে থাকতে পারে নি রূপা, সরাসরি নিচেই চলে এসেছিলো। হয়তো তাসফির রুমে থাকতে হবে বলেই। খাওয়া দাওয়া শেষে সময়টা ফুপির সাথেই কাটিয়েছে, ফুপার সাথেও নানান গল্পে কাটিয়েছে। এর কিছুটা সময় তাসফিও তাদের সাথে ছিলো।

বিকেলের তাসফির মতোই শপিংয়ে নিয়ে যায় রূপা কে, যাবতীয় সবটাই কিনে দেয়। যদিও মেয়েটা নানান ভাবে বারণ করে গেছে তাসফি কে। তার থেকে এতকিছু কিনে নেবার জন্যই অস্বস্তি হচ্ছিলো সেটাও বুঝিয়েছে তাসফি কে। তাসফিও তাকে ধমকের সুরে চুপ করিয়ে দিয়েছে। বলেছে,
“আগের কথা সব বাদ। এখন তো তুমি আমার বউ, আমার দ্বায়িত্ব, আর এগুলো তোমার অধিকার। সো! চুপচাপ যা লাগবে নিয়ে নিবা, এত ভাবতে হবে না। আমি আছি তো।”

ব্যাস! এরপর আর কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারে নি রূপা। শুধু দেখছিলো তাসফি কে, আর অনুভব করছিলো তার প্রতি তাসফির অধিকার।

.
“আমার সময় নেই আম্মু, থাকলে ওকে কলেজে নামিয়েই যেতাম।”

“সামান্য দেরি হলে তোর ভার্সিটি উড়ে যাবে না তাসফি। একই রাস্তায় যাচ্ছিস, ওকে নিয়ে গেলে সমস্যা কোথায়?”

“উফ্! আম্মু বোঝার চেষ্টা করো। আজকে ফাস্ট ক্লাস’টা আমার আছে।”

তাসফির কথাতে হাল ছাড়লেন না রেহেনা। তিনি যেন ভেবেই নিয়েছেন যে ভাবেই হোক তাসফির সাথেই রূপা কে পাঠাবেন।
মাঝে কেটে গেছে তিনটা দিন। আজকে কলেজের প্রথম দিন রূপার। ভার্সিটিতে এডমিশন দিয়েছিলো মেয়েটা। কিন্তু ভার্সিটিতে পড়াটা হয়তো তার ভাগ্যে ছিলো না। কিছু নাম্বারের জন্য চান্স’টা আসে নি। তারপর’ই এখানকার সরকারি নামি কলেজে তার এডমিশন’টা হয়ে যায়। ভর্তির সময় বড় বাবার সাথেই এসেছিলো সে। টুকটাক অনেকটাই তখন চিনিয়ে দিছেন তিনি। তবুও মেয়েটাকে একটা ছাড়তে রাজি নয় রেহেনা। ঢাকা শহরের সবটাই তো নতুন রূপার জন্য। তাসফির সাথেই মেয়েটাকে পাঠাবেন বলে মনস্থির করলেন।

“একদিন নিস না ক্লাস, তাতে কি? তাছাড়া মেয়েটাকে কার সাথে পাঠাবো? তুই ‘ই সাথে যাবি।”

অনেকটা জেদ দেখিয়েই বলে উঠলো রেহেনা। এবার যেন বেশ বিরক্ত হলো তাসফি। বললো,
“আশ্চর্য! আম্মু। ভার্সিটিতে জয়েন করেছি মাত্র কয়েক মাস হলো। এর মাঝে এত এত ছুটি, বিয়ের সময়ও তো কতদিন ছুটিতে থাকলাম। এরপরও বলছো আজকে না যেতে?”

বলেই একটু থামলো তাসফি। সেকেন্ডের মতো সময় নিয়ে আবারও বলে উঠলো, “তাছাড়া আব্বু তো আজকে বাসাতেই আছে। আব্বুকে বলো, নয়লে তুমি যাও। আমার সত্যিই আজ হবে না।”

বলেই আর দাঁড়াতে চাইলো না তাসফি। তাড়াহুড়ো করে হাতঘড়ি দেখে বেড়িয়ে যাবার উদ্যোগ নিলো। দুই কদম পা ফেলে থেমে গেল, পিছন ফিরে রূপার দিকে তাকালো। বললো,
“ক্লাস শেষ হলে কোথাও যাবা না, আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। ফোন অন রাখবা।”

বলেই আর দাঁড়ালো না, আর না জবাব দেবার সুযোগ দিলো। পিছন থেকে রেহেনা ডেকে উঠলো ছেলেকে, কিন্তু কোন কথা কানে না নিয়েই বেড়িয়ে গেল তাসফি।
পড়াশোনার অর্ধেকটা শেষ করেছে তাসফি। ইলেকট্রনিক ইন্জিনিয়ারিং শেষ করেছে প্রায় বছর হতে চললো। তারপর’ই পাবলিক ভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে ঢুকেছে পাঁচ থেকে ছয় মাস হতে চললো। স্কলারশিপে দেশের বাইরে যাবার কথা থাকলেও তার মোটেও দেশের বাইরে যাবার ইচ্ছে নেই। দেশেই থেকে বিসিএস’টা দিতে চায়।

এতক্ষণ নীরব শ্রোতা হয়েই যেন দাঁড়িয়ে ছিলো রূপা। কিছু বলেও লাভ হয় নি তার, বারংবার তাকে থামিয়ে দিয়েছে রেহেনা। এবার ফুপিকে বলে উঠলো,
“আমি একাই যেতে পারবো ফুপি।”

“হয়ছে তোমার একা যাওয়া। তারপর হুটহাট রাস্তা ভুলে কোথাও চলে যাবি, আর ছেলে এসে আমাকে বলবে —আম্মু আমার বউ কোথায়? তাড়াতাড়ি বউ এনে দাও।”

ফুপির কথায় হাসলো রূপা। তাসফির কথা শুনে কিঞ্চিৎ লজ্জাও পেল। ফুপি কে বাঁধা দিয়ে বললো,
“তোমার ছেলে মোটেও এমন বলবে না।”

.
মোবাইলে একবার সময়টা দেখে নিলো রূপা। অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেছে, কিন্তু এখনো তাসফি তাকে নিতে আসে নি। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভীষণ বিরক্ত সে। কলেজের প্রথম দিন হওয়ায় শুধু পরিচয় পর্বই ছিলো, হালকা করে ক্লাস নিয়েই ছাড়া হয়েছে। তার সাথেও টুকটাক কয়েক জনের পরিচয় হয়েছে, সবাই চলে যাবার পর থেকেই তাসফির অপেক্ষা করে চলেছে সে।
ভাবলো, সে একাই চলে যাবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই ফুপির বলা কথাটা মনে পড়লো যেন। সকালে রেহেনা’য় তাকে কলেজে রেখে গেছেন। যাবার সময় বারবার বলে গেছে, কোন মুহুর্তেই যেন একা ফেরার কথা না ভাবে। তাসফি যখন বলেছে তাকে নিতে আসবে, তো আসবেই।

হাতে থাকা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ভাবলো, তাসফি ফোন করবে। হয়তো তাকে নিতে আসবার কথা খেয়ালেই নেই। হবে হয়তো। কথাটা ভাবনায় এনেই কল দিলো তাসফি কে। রিং হয়ে কেটে যাবার আগ মুহুর্তেও রিসিভ হলো না। অধিক বিরক্ত এসে যেন ধরা দিলো তার চোখে মুখে। বিরক্তির রেশ নিয়েই আবারও কল দিলো। সামান্যক্ষণ রিং হতেই কেউ একজন তার সামনে এসে দাঁড়ালো। মাথা উঁচিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা তাসফি কে। তাকে দেখেই কানে থেকে ফোনটা নামিয়ে নিলো। বলে উঠলো,

“এতক্ষণ ফোন দিচ্ছিলাম আপনাকে। ফোন কোথায় আপনার?”

“ইস্! ক্লাস নিতে গিয়ে সাইলেন্ট করে রাখছিলাম, একদম ভুলে গেছি।”

“কোনটা?”

প্রশ্ন’টা ঠিক ধরতে পারলো না তাসফি। ফিরতি জিজ্ঞেস করলো,
“মানে?”

“মানে, কি ভুলে গেছেন? ফোন জেনারেল করতে, না কি আমাকে?”

রূপার কথায় সামান্য হাসলো তাসফি। সহসায় জবাব না দিয়ে খানিকটা সময় নিলো। তারপর সুর তুলে বলে উঠলো,

“নিজেকে আমি ভুলতে পারি, তোমাকে যাবে না ভোলাআ…..!”

.
.
চলবে……

রি-চেক দেওয়া হয় নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন, ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন।🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here