নীলাঞ্জনা পর্ব -০২

#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_২
#লেখনীতে_শুভ্রতা_জাহান

খালামনিকে নিয়ে সবাই মিলে হাসপাতালের দিকে রওনা হয়ে গেলো। আম্মু আর বাবাও সাথে গেছেন। খালুজান আর আমি বাড়িতে এসে শুনলাম খালামনি নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কি হয়েছে তা কেউ আমার সামনে বললেন না। তবে আমার মনে হয় খালামনির বাবু হবে।
আমাকে রেখে গেলেন নীলময়ীর কাছে, তার খেয়াল রাখতে। তিনি ঘুমিয়ে আছেন কিনা। ঘুম ভাঙলে না জানি কি কান্ড করেন আমাকে দেখে। আমি মজা করার জন্য বিচ্ছুটার পিছে লাগলেও ও আমাকে সহ্যই করতে পারে না। আরে বাবা আমি কি তোর থেকে খুব বেশি বড় নাকি। এই তো হবে খুব বেশি হলে ৭ বছর। সুন্দর করে কথা বলা যায় না? আমাকে বলে কিনা অসভ্য! ভাবা যায়। এই টুকুন একটা বিচ্ছু না মানে বাচ্চা আরকি। বিচ্ছু বলেছি শুনলে আবার লঙ্কা কান্ড হবে হুহ। যাই হোক বসে থেকে লাভ নেই। নীলময়ীর পাশে শুয়ে পড়ি।
দরজা জানালা সব বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম নীলময়ীর সাথে। এমনিতেই বিকেল হয়ে এসেছে। কিছু চিনলে বাইরে খেলতে যাওয়া যেত। এখন ঘুমানোই শ্রেয়। আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে পাড়ি জমালাম ঘুমের রাজ্যে। সেখান থেকে স্বপ্নের রাজ্যে। রাজ করতেই যাচ্ছিলাম তখনই ঠিক কে যেন চিৎকার করে উঠলো। উঠে বসে দেখি নীলাঞ্জনা বিবি উঠে আম্মু আম্মু বলে চিল্লাচ্ছেন।

“কিরে চিৎকার করিস কেন?”

“তুমি আমাল পাছে তি তলো? আল আমাল আম্মু, মনি, থালুজান, আব্বু তোথায়?”

“সবাই হাসপাতালে।”

“তেনো?”

“তুই জেনে কি করবি? চুপচাপ ঘুমা।”

“আমাল কিদে পেয়েতে।”

“কি খাস তুই?”

“তুমি তি থাও?”

“কেনো ভাত তরকারি।”

“তালে আমি ত্যান অন্য তিচু থাবো?”

পিচ্চিটার প্রশ্নে ভেবাচেকা খেয়ে গেলাম। ভারী ফাজিল তো। আমার কথায় আমাকে গেথে দিলো। আল্লাহ মালুম বড় হলে কি চিজ হবে! বাবাগো বাবা যেন ধানীলঙ্কা!

“আচ্ছা বুঝলাম তুইও ভাত খাস। কীভাবে খাবি?”

“তুমি যেলকম কলে থাও।”

“আল্লাহ তুমি দড়ি ফালাও আমি উইঠা আসি। আমি বলতে চাইছি নিজের হাতে খেতে পারিস নাকি খালামনি খাইয়ে দেয়?”

“আম্মু আব্বু থাইয়ে দেয়।”

“এখন তো ওরা নেই চল আমি খাইয়ে দিই।”

আমার কথাটা বলতে দেরি আছে তার দৌড় লাগাতে দেরি নেই। আবার যেতে যেতে বলে তোমাল মতো অছব্যল তাছে থাবো না আমি। বাহ্ ভাই বাহ্। আরে দৌড়াস না পড়ে যাবি। বলতে বলতেই ঠাস করে পড়ে গেলেন নীলময়ী বিবি। এখন আবার ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছেন। গিয়ে তুলে দেখি হাঁটুর কাছে ছিলে গেছে কিছুটা। আবারও সেই ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না।

“বলেছিলাম না দৌঁড়াতে? আমার কথা শুনলে আর পড়ে গিয়ে হাঁটু ছিলতে হতো না। আয় কোলে আয়।”

“তুমি অছব্য তোমাল তোলে জাবু না।”

“ঠিকাছে মাটিতে বসে থাকেন আপনি। আমি গেলাম তাহলে?”

“আত্তা উতবো তোমাল তোলে তিনতু বেতা দেবে না।”

উত্তর না দিয়ে কোলে তুলে নিলাম নীলকে। এখন কথা বললে ও প্যাচাতেই থাকবে। তারচেয়ে ভালো চুপ থাকি। নীলকে কোলে করে নিয়ে বিসানায় বসিয়ে দিলাম। হাঁটু থেকে হালকা রক্ত বের হচ্ছে আর সেও ব্যথায় কান্না করছে। কি করি এখন? কোথায় কি আছে তা তো জানিনা আমি। হঠাৎ মাথায় এলো আমার কোথায় কেটে গেলে আম্মু গাঁদা ফুলের পাতা চটকে লাগিয়ে দেয়। অমনি ছুটে গেলাম পাতা আনতে। আসার সময় খালামনির রান্না ঘরের পাশে দেখেছিলাম। আমাকে ছুটতে দেখে বারান্দায় শুয়ে থাকা খালুজানের ফুফু চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন কোথায় যাচ্ছি। ছেলে মেয়ে দেখাশোনা না করায় খালুজান তাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। আমাকে আর নীলময়ীকে অনেক আদর করেন দাদি। কিন্তু এখন বলতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। নীলাঞ্জনা বিবি পরে কেঁদে ভাষাবেন। এখন বলার সময় নেই বলে দৌড়ে গেলাম গাছের কাছে। সেখান থেকে কিছু পাতা ছিঁড়ে তা চটকাতে চটকাতে ঘরের দিকে এগোলাম। তখন দাদি আবার জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে।

“আরে দাদি নীল পড়ে গিয়ে হাঁটু ছিলে ফেলেছে তাই গাঁদা ফুলের পাতা নিয়ে যাচ্ছি।”

বিলাপ করে বললেন
“ক্যামনে পড়লো আমার নাতিডায়? ম্যালা ব্যথা লাগছে নি দাদা?”

“ঘুম থেকে উঠে দৌঁড়াতে গিয়ে পড়ে গেছে দাদি। চিন্তা করো না বেশি লাগেনি। আর পাতা লাগিয়ে দিলে ঠিক হয়ে যাবে।”

“আইচ্ছা আস্তে লাগাইয়ো দাদাভাই। নাতিডায় বহুত ছুডো তো।”

মাথা নেরে সায় দিয়ে চলে গেলাম ঘরে। গিয়ে দেখি নীল ঠোঁট ফুলাচ্ছে। আস্তে করে পাতাটুকু হাঁটুতে লাগিয়ে দিলাম। ব্যথা কমেছে কিনা জিজ্ঞেস করলে কিছু না বলে ভ্যাবলার মতো চেয়ে রইলো। আবার সেই ঠোঁট লাল। এ মেয়ের ঠোঁট কাঁদলেই এমন লাল হয় কেনো কে জানে। কই আমার তো হয় না কখনো। নাকি মেয়ে হলে আমারও হতো? ধুর কিসের মাঝে কি ভাবছি।

“কিরে ব্যথা কমেছে কিনা বললি না তো।”

“থিদে পেয়েতে।”

যাবাব্বা জিজ্ঞেস করি কি আর বলে কি।
“আচ্ছা খাইয়ে দেবো আগে বল ব্যথা কমেছে কিনা।”

“ইত্তু।”

“আচ্ছা বস আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

“তোমাল নাম তি?”

চলতে গিয়েও থেমে গেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম
“নভ সওদাগর।”

“তোমাল নাম নবু ছদাগল?”

“এডি কুনো কতা? মানলাম আমি কালকে তোরে গোলুল থুক্কু গরিব মানুষ হওয়ার দরুন পুতুলের শখ করতে বারণ করেছি। তাই বলে এভাবে আমার নামটা খেয়ে দিবি আফা?”

“নাম তি থাওয়া যায়? আমি তি কলে তোমাল নাম থেলাম?”

“থাক আফা তুই বস আমি তোর খাবা নিয়ে আসছি। আর আমার নাম নবু না নভ। সওদাগরটা নাহয় নাই বা বললি।”

“আত্তা নবু তুমি আমাল দন্য থাবাল আনো থিকাতে!’

“হুহ না থিক থাকলে তো আপনি আমাতেই থেয়ে দেবেন নীল বিবি।”

“তি বলতো?”

“তিছু নাহ।”

“যাও না তেনো?”

“যাচ্ছি রে বাপ।”

এ্যাহ যাচ্ছো না কেনো! আমি যেন গোলাম ওর। আমার মতো একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে ওই বিচ্ছু এভাবে খাটাচ্ছে। আসুক বাবা আজ। আমি আর একটুও থাকবো না এখানে। আল্লাহ কিসব কইতাছি আমি। ভাই নভ তুই কি নীলময়ী পাগলের সাথে থেকে থেকে তার মতোই পাগল হচ্ছিস? নো নো তোকে পাগল হলে চলবে না। আরো অনেক বছর বাঁচতে হবে। বিয়ে করতে হবে, নাতি নাতনি বিয়ে দিতে হবে আরো কত কি। এখন মরলে এগুলো কীভাবে হবে? আল্লাহ গো আমি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বকবক করে চলেছি। ওই মেয়ে আবার চিৎকার না করে।
খাবার নিয়ে এসে দেখি গালে হাত রেখে কি যেন ভাবছে বিচ্ছুটা। আমি কথা না বলে চুপচাপ খাইয়ে দিতে লাগলাম। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো খাওয়ার মধ্যে নীল একটা কথাও বললো না। নিজেই তো ছোট মানুষ তারপর আবার আরেকটা বাচ্চাকে খাওয়ানো। আহা কপাল! নীল খাইয়ে তারপর নিয়ে গেলাম বারান্দায় দাদির কাছে। তিনি ওকে পেয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন নাতনি কোথায় ব্যথা পেয়েছে তাই দেখতে। এমন সময় এক মহিলা এসে খবর দিলো খালামনির নাকি একটা ছেলে বাবু হয়েছে। তাঁদের নিয়ে আসবে কালকে। নীল একা থাকতে পারবে না বলে আম্মু চলে আসছে।

মহিলা বসে পড়লেন দাদির কাছে গল্প করতে। তখন তাঁদের কিছু কথা কানে এলো। যেগুলোর মানে এরকম যে নীল এর বেলায় নাকি খালামনির ছেলে হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু পরে নীল হলো। অদ্ভুত ব্যাপার! ছেলে দেখলে আবার মেয়ে কীভাবে হয়। উমম হয়তো ডাক্তার এর ভুল হবে। ভাবনায় ছেদ পড়লো নীলময়ীর প্রশ্নে।

“নবু আম্মুল বাবু হয়েতে?”

“হুম তোর আম্মুর বাবু আর তোর একটা ভাই হয়েছে।”

“ভাই তি তোমাল মতো?”

“আমার মতো মানে?”

“চুন্দল।”

হেসে ফেললাম কথাটা শুনে। আমি নাকি চুন্দল! হাহাহা। একটু খোঁচা মারতে বললাম
“আমি সুন্দর ঠিকাছে কিন্তু তুই নজর দিচ্ছিস কেন?”

“নজল তি কলে দেয় নবু? আল নজল দিলে তি হয়?”

“তোমার এত কিছু জানতে হবে না নীলময়ী।”

“নীলমই তে?”

“চুপ কর আফা আর কথা কইস না। তুই তো পাগল করে ছাড়বি আমাকে।”

আমাদের কথার মাঝেই আম্মু চলে এলো সাথে বাবাও। আম্মুকে দেখে নীলময়ী বিবি আমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আম্মুর কোলে চলে গেলেন মনি মনি করতে করতে। আম্মুর তাকে আদর করায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন। সাথ দিলেন আমার বাবা। তাঁদের বাচ্চা ছেলেটা যে এখানে বসে আছে সেদিকে খেয়ালই নেই।

“তোমরা আমাকে ভুলে গেলে বাবা মা!তোমাদের থেকে এরকম আশা করিনি আমি। আম্মু নাহয় নিজের বোনের মেয়েকে পেয়ে ভুলে গেছে কিন্তু বাবা তুমি! তুমি কীভাবে ভুলে গেলে তোমার একমাত্র পুত্রকে? রাখবো না এই জীবন আমি। যাচ্ছি কঁচু গাছের সাথে গলায় দড়ি দিতে।”

আমার কথা শুনে বাবা মা আহাম্মকের মতো চেয়ে রইলেন আমার মুখ পানে। আমি সেদিকে ধ্যান না দিয়ে নেমে পড়লাম বারান্দা থেকে। উদ্দেশ্য পাশের পুকুরে যাওয়া। আসতে আসতে শুনতে পেলাম পেছনে বাবা মায়ের হাসি। আহ আমার গলায় দড়ির কথা শুনে হাসছেন তারা। কি লাভ বেঁচে থেকে?

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here