নীলাঞ্জনা পর্ব -১১

#নীলাঞ্জনা
#পর্ব_১১
#লেখনীতে_শুভ্রতা

প্রায় ১৮ বছর আগের কথা!

আমার ডেলিভারির ডেট তখনও একমাস পর। আয়শা ভাবি, অভ্র আর আমি গিয়েছিলাম গ্রামে ভাবির দাদাবাড়িতে ওনার অসুস্থ দাদিকে দেখতে। সেখান থেকে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে আমরা বাড়ি ফেরার রওনা হলে গাড়ি পাওয়ার আগে রাস্তাতেই আমার পেইন শুরু হয়। ডেলিভারি পেইন এ আমার তখন ছটফট করছি কাঁটা মুরগির মতো। ভাবি দিশেহারা হয়ে পড়েন। ভেবে পান না কি করবেন। অনেক খুঁজে একটা ভ্যান পাওয়া যায় কিন্তু ভাড়া চেয়ে বসে অনেক। তখন অত কিছু ভাবার সময় ছিলো না তাই ভাবি ওই অবস্থাতেই ছোট্ট অভ্রকে কোলে নিয়ে আমাকে ভ্যানে করে নিয়ে যান কাছের একটা হাসপাতালে।

ডাক্তার ডেকে বেডে দেওয়া হয় আমাকে। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছে যাওয়ায় তেমন সমস্যা হয় না। জন্ম নেয় আমার মেয়ে। আমার মেয়ে বলার কারণ আমার স্বামীর মেয়ে পছন্দ ছিলো না। এমনকি তিনি আমাকে একথাও বলে দিয়েছিলেন যে যদি আমি কন্যা সন্তানের জন্ম দিই তবে তিনি আমাকে তালাক দেবেন। আমি তখন চরম দোটানায়। এক দিকে মা হওয়ার সুখ তো অন্য দিকে সংসার হারানোর ভয়। বুঝতে পারছিলাম না কিছুই। ভাবি তখন ভাইদের সাথে বাইরে কথা বলছেন। তখনও কেউ জানেন না আমার সন্তান মেয়ে না ছেলে! হঠাৎ চোখ যায় পাশের বেডে। এক মহিলা অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে আছেন তার পাশে একটা ছেলে। সম্ভবত আজই জন্ম নিয়েছে।

সেখানকার যে নার্স আমাদের দুজনের দেখাশোনা করছিলো তাকে অনেক কষ্টে টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করাই। আর তারপর… তারপর ছেলেটা হয়ে যায় আমার আর মেয়েটা হয়ে যায় সেই অচেতন মহিলার। সেই নার্স আর আমি ছাড়া দুনিয়ার কোনো মানুষ জানতে পারে না এই ঘটনা। সারা দুনিয়া জানে নয়না আকশার পিয়াল চৌধুরী নামে এক পুত্রের জন্ম দিয়েছেন।

এই ঘটনার পর থেকে প্রায়ই আমার বাচ্চা মেয়েটার কথা মনে পড়তো। মন কাঁদতো তার জন্য কিন্তু কিছু করার ছিলো না। আমাকে আমার সংসার বাঁচাতে হতো যেকোনো মূল্যে। সেই মূল্য হিসেবেই নিজের মেয়েকে অন্যের কোলে ছেড়ে এসেছিলাম। এছাড়া কোনো উপায় ছিলো না বা হয়তো ছিলো কিন্তু আমি পাইনি। এরপর আমি স্বামী সন্তান নিয়ে আমেরিকাতে পাড়ি জমাই। ভালোই চলছিল আমার মেয়ের বিনিময়ে টিকিয়ে রাখা সংসার।

১৩-১৪ বছর আগে হয়তো!

রওনক ভাইয়া ব্যাবসার কাজে ওই গ্রামেই গিয়েছিলেন। ব্যাবসার কাজ শেষ করে নৌকা করে নদী পাড়ি দিয়ে অন্য একটা গ্রামে যাচ্ছিলেন কিছু দরকারে। মাঝ নদীতে নৌকা ঝড়ের কবলে পতিত হয়। চারপাশে আঁধার ঘনিয়ে আসছিলো। তখন হঠাৎ মাঝি কিছু একটা দেখে চিৎকার করে ওঠে। ভাইয়া চেয়ে দেখেন কলা গাছ ধরে ভেসে থাকতে চাইছে একটা তিন থেকে চার বছর বয়সি বাচ্চা মেয়ে। অবাক হন ভাইয়া। এই মাঝ নদীতে মেয়েটা এলো কীভাবে? তারপর মেয়েটাকে সেখান থেকে নিজের সাথে নিয়ে আসেন বাড়িতে। বড় ভাবি মারা গিয়েছিলেন তার ছয় বছর আগে বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে। মা বাচ্চা দুজনের কেউই বাঁচেনি। তারপর ভাইয়া ছোট ভাইয়ার পরিবার নিয়েই ছিলেন। ভাইয়ার জীবনে আলো হয়ে আসে বাচ্চা মেয়েটা। মেয়েটার গলায় একটা লকেট সহ চেইন ছিলো। যার ওপর লেখা ছিলো নীলাঞ্জনা। হয়তো মেয়েটার নাম। তখন থেকে সেই মেয়েটা বেড়ে উঠতে থাকে আকশার বাড়ির ছোট মেয়ে হিসেবে।

নীলাঞ্জনা মেয়েটার কথা ভাইয়ার কাছ থেকে ফোনে শুনলেও তাকে কখনো দেখা হয়নি আমার। দেখলে হয়তো আরো আগেই বুঝতে পারতাম এই নীলাঞ্জনাই আমার সেই বিনিময় করা মেয়ে যে কিনা দেখতে হয়েছে আমারই মৃত ননদের মতো।

এটুকু বলে থামেন নয়না আকশার। চেয়ে দেখেন নিজের স্বামী পলাশ চৌধুরী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন তার মুখপানে। হয়তো ভেবে চলেছেন এসব কি বলছেন তার স্ত্রী? ওই মেয়েটা তার নিজের মেয়ে? চৌধুরী বাড়ির মেয়ে? তাহলে এতদিন আদর যত্নে যে পিয়ালকে বড় করলো সে তার কেউ না? এগুলো সত্যি? পলাশ চৌধুরীর খুব করে চান এগুলো যেন স্বপ্ন হয়। সে ঘুম ভেঙেই দেখবে আশেপাশের সব আগের মতো। পিয়াল তারই সন্তান। তার মৃত বোনের মতো দেখতে কোনো মেয়ে নেই। কিন্তু আফসোস! তা হয় না। এ যে কঠিন এক বাস্তব। তার অযৌক্তিকতার কাছে হেরে গিয়ে নয়না তারই সন্তানকে বিনিময় করেছে বহু বছর আগে। আর এই কঠিন সত্যটাই এখন পলাশ চৌধুরীর দরজায় এসে কড়া নেড়েছে। ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়েন তিনি। স্ত্রী নয়না ধরতে আসলে তাকে ইশারায় বারণ করেন।

নয়না আকশার স্বামীকে তার মতো একা ছেড়ে দেন। যখন তিনি বেলকনি থেকে রুমে আসেন তখন দেখতে পান দরজা থেকে একটা ছাঁয়া সরে গেলো। কিন্তু বাইরে গিয়ে কাউকে দেখতে পান না। প্রচন্ড ক্লান্ত থাকায় শুয়ে পড়েন তিনি। পলাশ চৌধুরী ঠিক বাস্তবতাকে মেনে নিজেকে সামলাতে পারবেন। হয়তো সময় লাগবে কিন্তু পারবেন তিনি। এটা নয়নার নিজের স্বামীর প্রতি বিশ্বাস।

নিজের বোনকে অতিরিক্ত ভালোবাসতেন পলাশ চৌধুরী। তার একমাত্র বোন পড়শী। কলেজে উঠতে না উঠতেই পলাশের কানে আসে তার বোনের প্রণয়ের কথা। মেনে নিতে পারেন না তিনি আদরের বোনের এমন অধঃপতন। বাবা না থাকায় পরিবারের সবকিছু সে নিজেই সামলাতো। দেরি না করে কলিগের সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেলেন বোনের। বোন পড়শী ভাইয়ের এমন শাসন মানতে না পেরে করে বসে আত্মহত্যার মতো ভুল। সেই থেকেই মেয়ে অপছন্দ ছিলো পলাশ চৌধুরীর। কিন্তু ধীরে ধীরে তিনি বুঝতে পারেন সবাই এক না এবং ভুল তারও কিছু ছিলো। তবে তা বুঝতে বড্ড দেরি করে ফেলেছেন বলে মনে হচ্ছে এখন। তার সন্তান শুধু মাত্র তার এই ভ্রান্তির জন্য অন্যের পরিচয়ে বেড়ে উঠেছে। সে নিজেও পরের সন্তানকে নিজের ভেবে এসেছে এতদিন যাবৎ। ডুকরে কেঁদে ওঠেন পলাশ চৌধুরী।

রওনক আকশারের সামনে বসে আছে মহু। দৃষ্টি তার বাবাই এর মুখ পানে। খাওয়া শেষে বাবাই তাকে নিজের রুমে ডেকেছিলেন। মহু আসতে একটু দেরিই করেছে বটে কিন্তু এভাবে চুপচাপ বসে থাকতেও বিরক্ত লাগছে। অনেক ভেবে মুখ খুললো সে।

“বাবাই তুমি ডেকেছিলে।”

মহুর কণ্ঠ পেয়ে চোখ তুলে তাকান রওনক সাহেব। কিছুক্ষণ ভেবে বলেন
“তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো মামনি।”

আশ্চর্য হয় মহু। বাবাই কবে থেকে তার সাথে কথা বলার আগে এত ভাবতে শুরু করেছে। কই আগে তো এমন দেখেনি কখনো। তবে আজ কি এমন বলবে বাবাই? কৌতূহল দমাতে পারে না মহু।

“হ্যাঁ বাবাই বলো না। এত সংকোচ করছো কেনো?”

কিছু একটা ভাবেন রওনক সাহেব। অতঃপর বলেন
“আমি চাই তুমিও তোমার অভ্রদার মতো ইন্টেলিজেন্ট এজেন্সিতে জয়েন করো।”

এটা তো মহুর নিজেরও স্বপ্ন। এতে এভাবে সংকোচ নিয়ে বলার কি আছে? নাকি আরো কিছু বলতে চাইছে বাবাই?
“তুমি কি শুধু এটাই বলতে ডেকেছো বাবাই?”

মহুর প্রশ্নে যেন কিছুটা ঘাবড়ে যান রওনক আকশার। অতঃপর নিজেকে ধাতস্ত করে এমন কিছু বলেন যাতে মহু পুরোপুরি হতোভম্ব হয়ে যায়।
অবাক হয়ে বলে মহু
“বাট বাবাই আমি সবে মাত্র ভার্সিটি ভর্তি হয়েছি।”

আরো কিছু বলবে তার আগেই থামিয়ে দেন রওনক সাহেব।
“আমি কিছু শুনতে চাই না নীলাঞ্জনা। আমি যা বলছি তাই করবে তুমি। চাকরির সাথে এটা নিয়েও ভাববে। এবং উত্তর অবশ্যই হ্যাঁ হওয়া চাই। কোনো কিছু নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি শুধু নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করো।”

কিছু বলতে গিয়েও বলে না মহু। ছোট থেকে বাবাই তাকে বড় করেছে। কখনো কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেয়নি। এখন সেই বাবাই এর কথা কীভাবে ফেলবে মহু? বাবাই অবশ্যই তার ভালোই চাইবে।

“ঠিক আছে বাবাই। তুমি যা বলবে তাই হবে। আমি প্রস্তুত তুমি ব্যবস্থা করো।”

মেয়ের কথায় তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে তার অধরে। অতঃপর হঠাৎ মনে পড়ে এই মেয়েটা তো তার নিজের নয়। যখন নীলাঞ্জনা জানতে পারবে রওনক সাহেব তার নিজের বাবা না এমনকি আকশার বাড়ির কেউই তার আপন না তখন কি অবস্থা হবে মেয়েটার? সামলাতে পারবে তো নিজেকে? সে তো মেয়েটাকে ভেঙে পড়া অবস্থায় দেখে সহ্য করতে পারবে না। বড্ড ভালোবাসে যে। নিজের সন্তানের চেয়ে বেশিই ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছেন তিনি নীলাঞ্জনাকে। সেই মেয়ের কষ্ট কীভাবে দেখবেন? অনেক ভেবে রওনক সাহেব সিদ্ধান্ত নেন নীলাঞ্জনা যে এ বাড়ির কেউ না তা আজীবন গোপন রাখবেন। জানাবেন না নীলাঞ্জনাকে। সে যেমন মহুয়া হয়ে বেঁচে আছে তেমনই থাকুক। তবু তো ভালো থাকবে। নাই বা থাকলো নিজের আসল বাবা মায়ের পরিচয়। সে তো আর জানছে না।

শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরের একটা জায়গা। এখান থেকে কিছুটা এগোলেই বিলের জমি শুরু হয়েছে। রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে রেখে একটা গাছের নিচে একে অপরের পিঠের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে দুই বন্ধু। দুজনের অন্তরেই বয়ে চলেছে দমকা হওয়া। নভ নাহয় পিয়াল আর নয়ন এর চেহারার সমীকরণ মেলাতে ব্যাস্ত কিন্তু অভ্র? তার কি হলো?

পিয়ালের কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ লেগে এসেছিলো নভর। এমন সময়ে বিকট শব্দে বেজে ওঠে মোবাইল নামক যন্ত্রটি। হাতে নিয়ে দেখে অভ্র। এত রাতে অভ্রর কল পেয়ে অবাক হয়ে পিক করে নভ। তাকে কিছু না বলতে দিয়েই অভ্র বলে সে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। নভ যেন পাঁচ মিনিটের মধ্যে উপস্থিত হয়। এই রাতে মেসের বাইরে আসাটা সহজ ছিলো না কিন্তু তাও সম্ভব করেছে অভ্র আকশার। নব বুঝতে পারছে না এত রাতে অভ্র তাকে কেন এখানে নিয়ে এলো। আর এত চুপচাপই বা আছে কেন ছেলেটা? সে তো সবসময় হাসিখুশি থাকে! তাহলে হলো টা কি? ভেবে পায় না নভ।

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here