নীলাঞ্জনা পর্ব – বোনাস

#নীলাঞ্জনা
#বোনাস_পর্ব (ফ্রম প্রাণ😁)
#লেখনীতে_শুভ্রতা

আকশার বাড়িতে লেগে আছে মানুষের ভিড়। সব জায়গা থেকে আত্মীয় স্বজন এসে বসে আছে বাড়িতে। উপলক্ষ বাড়ির দুই মেয়ের একসাথে বিয়ে। রওনক আকশার ও রেহমান আকশার এর মেয়ে রেহানা আকশার ও মহুয়া আকশার নীলাঞ্জনার বিয়ে ঠিক হয়েছে একই দিনে। ছোট মেয়ের বিয়ে আরো পরে হওয়ার কথা থাকলেও রওনক আকশার তা হতে দেননি। নিজের প্রিয় পাত্রর হাতে যত দ্রুত সম্ভব তুলে দিতে চাইছেন মেয়েকে। অজুহাত স্বরূপ বলেন তিনি বছর খানেকের জন্য দেশের বাইরে যাবেন। তখন যাতে মেয়ের তার ভাইয়ের পরিবার বা বাইরের কারো জন্য কোনো সমস্যা না হয় তাই এই বিয়ে। বাড়ির লোকজন এ কথায় মন খারাপ করলেও রওনক সাহেব তার সিদ্ধান্তে অটল। মহুরও কোনো সমস্যা নেই। তাই বিয়েটা হচ্ছেই।

মহু ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে দেখছে তাঁদের বাড়িতে লোকজনের সমাগম। এত লোক সব তার আর রেহানার বিয়ে উপলক্ষে। মহুর কেবল অবাক লাগে এই ভেবে যে সে এখনো তার হবু স্বামীকে দেখেনি এমনকি নামটাও জানে না। যদিও বাবাই বলেছিলো ছবি দেখতে, সে নিজেই দেখেনি। দেখে কি হবে? সেই বাবাই এর ইচ্ছে অনুযায়ীই তো সব হবে। তার দেখা না দেখা সমান। অজানা একটা মানুষের সাথে ঘর বাধঁতে চলেছে সে। অথচ বাড়ির সবাই সেই অজানা মানুষের সাথে তার বিয়েই তোড়জোড় নিয়ে ব্যাস্ত। অদ্ভুত! সমস্যা কি তার তো আর কোনো মনের মানুষ নেই! আচ্ছা আসলেই কি কেউ নেই? তবে যে লকেটে থাকা ছবির ছেলেটার চাহুনি তাকে খুব করে টানে। বাবাই বলেছিলো ঐটা অভ্রদা কিন্তু ওই চোখ জোড়া তো অভ্রদার চোখের মতো নয়। সেখানে তো নতুন কিছু খুঁজে পায় মহু। তবে সে দেখেছে ওই চোখ। অল্প সময়ের মাঝেই কিন্তু সঠিক মনে করতে পারে না। হবে হয়তো সবই তার মনের ভুল। ঐটা অভ্রদারই ছবি! দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহু।

রেহানা আর মহুকে অভ্রর সাথে বিয়ের শপিং এর জন্য যেতে বলেন রওনক সাহেব। সপ্তাহ খানেক বাকি বিয়ের অথচ এই মেয়ে দুটোর কোনো হুশই নেই! বেশ জোর করেই পাঠান। সাথে যায় পিয়ালও। শপিং মলে গিয়ে রেহানা নিজের মতো শপিং করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেও মহুর ধ্যান থাকে তার হাতে থাকা ফোনে। কেউই হয়তো ভাবতে পারে না যে একটা মেয়ে নিজের বিয়ের শপিং করতে এসে কিছু না দেখে গেমস খেলছে। অথচ ঠিক এই কাজটাই করে চলেছে মিস আকশার। হঠাৎ কেউ একজন এসে একটা শাড়ি জড়িয়ে দেয় তার গায়ে। চেয়ে দেখে অভ্রদা মিষ্টি হেসে তাকিয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে একবার অভ্র তো একবার শাড়ির দিকে তাকায় মহু। নীল রঙা বেনারসিটায় বেশ মানিয়েছে তাকে। ধন্যবাদ দেয় অভ্রকে। অভ্রও সৌজন্যের হাসি দেয়। অতঃপর বাদবাকি শপিং শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে চার ভাইবোন।

বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে ড্রয়িং রুমে রেহমান, রওনক, আয়শা সবাই চিন্তিত মুখে বসে আছে। আপনাআপনি কপালে ভাজ পড়ে যায় তাঁদের। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে রওনক সাহেব কিছু বলতেই যাবেন এমন সময় দেখেন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে তার বোন নয়না। আর পেছনে পেছনে হেটে আসতে আসতে কিছু বোঝানোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে পলাশ সাহেব।

“নয়না বোঝার চেষ্টা করো। নীলাঞ্জনার বিয়ের তোড়জোড় চলছে বাড়িতে। এই মুহূর্তে তুমি এই কথাটা বলতে পারো না।”

স্বামীর কথায় খানিকটা রেগে যান নয়না আকশার।
“তোমার জন্য একবার আমি আমার মেয়েকে হারিয়েছি। এখন আমি চাই না অন্যের পরিচয়ে সে স্বামীর বাড়ি যাক। আজ আমি সত্যিটা বলবোই।”

আবারও বাধা দিতে চেষ্টা করেও ব্যার্থ হন পলাশ চৌধুরী। সেদিন সবকিছুর পরে তিনি নিজেকে সামলাতে পারলেও নয়না আকশার পারেননি নিজেকে সামলাতে। উসখুস করছেন নীলাঞ্জনার আসল পরিচয় সবার সামনে বলার জন্য। কিন্তু হঠাৎ রওনক সাহেব নীলাঞ্জনার বিয়ে ঠিক করে ফেললে স্ত্রীকে বাধা দেন পলাশ সাহেব। এরকম আনন্দের মধ্যে এসব না বলাই ভালো। আর যেখানে রওনক সাহেব ছোট থেকে মানুষ করেছেন নীলাঞ্জনাকে সেখানে রওনক সাহেবের সামনে তাঁদের বাবা মা হয়ে দাঁড়ানো নিতান্তই ঠুনকো ব্যাপার বলে মনে করেন তিনি। কেবল জন্ম দিলেই যে বাবা মা হওয়া যায় না একথা তো সত্য। এগুলো বলেই এতদিন স্ত্রীকে দমন করেছিলেন পলাশ সাহেব কিন্তু আজ আর শেষ রক্ষা হলো না। নয়না তার বারণ না শুনেই সব বলতে প্রস্তুত।

নিচে নেমে এসে স্বামীকে অগ্রাহ্য করে ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে যান নয়না। অতঃপর বলেন
“ভাইয়া আমি তোমাদের কিছু বলতে চাই।”

এবার শেষ চেষ্টা চালান পলাশ সাহেব।
“আজ না বললেই নয় নয়না?”

স্বামীর কথা কানে নেন না তিনি। রওনক সাহেব ভ্রু কুঁচকে ফেলেন। কৌতূহল জাগে বাকিদেরও। রওনক সাহেব গম্ভীর ভাবেই বলেন
“এত হেয়ালি না করে কি বলবি সোজাসুজি বলে দে। বাড়ির দুই মেয়ের বিয়ে, অনেক কাজ আছে সবার।”

“আসলে ভাইয়া নীলাঞ্জনা বা মহুয়া আমার আর পলাশের মেয়ে।”

এ কথা শুনে অভ্র আর পলাশ সাহেব বাদে সকলে একসাথে বলে ওঠে
“মানে?”

অতঃপর একে একে সব খুলে বলেন নয়না। ধপ করে সোফায় বসে পড়েন রওনক সাহেব। মহুর চোখ ছলছল করে ওঠে। এসব কি শুনছে সে? বাবাই তার আসল বাবাই না? ফুপ্পির হাসবেন্ড তার বাবা? তাহলে সে এখানে কীভাবে? নাকি সব মিথ্যে? রওনক সাহেবের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে সে। করুণ কণ্ঠে সুধায়

“ফুপ্পি এগুলো মিথ্যে বলছে তাই না বাবাই? আমার বাবাই তো তুমি বলো। এনারা কেনো আমার বাবা মা হবেন বাবাই বলো। আমি তো তোমার মেয়ে। মহুয়া আকশার। তোমার প্রিন্সেস নীলাঞ্জনা। বলো বাবাই। কি হলো বাবাই কিছু বলো তুমি।”

কাঁদতে কাঁদতে বলা মহুর কথা গুলো শুনে সকলের চোখ ভিজে ওঠে। নয়না আকশার তাকে তুলতে গেলে সে বাধা দেয়। আয়শা বেগম এগিয়ে এসে সালমান মহুকে। সবার নজর এখন রওনক সাহেবের দিকে। মহু তো এই আশায় আছে যে তার বাবাই বলবে এসব মিথ্যে। সে শুধু ওনার মেয়ে, নিজের মেয়ে। কিন্তু তা আর হয় না। রওনক আকশার নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ খোলেন।

“দেখো নয়না তুমি যে নিজের মেয়েকে এভাবে অন্যের কাছে ছেড়ে তাঁদের ছেলেকে নিয়ে গেছো সেটা কেউই জানতো না। এরপর ভাগ্যক্রমে নীলাঞ্জনা আমার কাছে আমার মেয়ে হয়ে এসেছে। এখন হুট্ করে তোমার দরদ জেগে উঠলো, তুমি এসে তাকে চাইলে আর আমি দিয়ে দিলাম। এরকম ভেবে থাকলে ভুলে যাও তা। নীলাঞ্জনা আমার মেয়ে হিসেবে বড় হয়েছে, আমার মেয়েই থাকবে। কিছু দিন পর নভর সাথে তার বিয়ে। এখানে আমি আর কিছু শুনতে চাই না। যে যার কাজে চলে যাও এখন।”

কথা গুলো বলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যান রওনক সাহেব। এদিকে নভ নামটা শুনে দুজন চমকে ওঠে। অভ্র আর নীলাঞ্জনা দুজনেই মনে মনে নামটা আওড়াতে থাকে। কেউ অবাক হয়ে তো কেউ অমীমাংসিত ভাবনার মীমাংসা পেয়ে। তারপর দুজনেই চলে যায় যার যার ঘরে।

এতক্ষণে নয়না আকশারের মনে পড়ে পিয়ালের কথা। তাকে আশেপাশে দেখা কেনো যাচ্ছে না? চিন্তিত হয়ে পড়েন নয়না। নিজের ছেলে না হলেও ছোট থেকে তাকে নিজের ছেলের মতোই তো মানুষ করেছেন। ওনার কথায় কষ্ট পেয়ে চলে গেলো না তো ছেলেটা? গেলোই বা কোথায়? স্বামীকে বলতে গিয়েও সাহস পাননা। পলাশ তো বারণ করেছিল বাড়াবাড়ি করতে। তিনিই শোনেননি। এখন কোথায় খুঁজবেন পিয়ালকে? মস্ত বড় ভুল হয়ে গেলো।

নভ চলে এসেছে তার গ্রামের বাড়ি। এখান থেকেই বরযাত্রী যাবে। নভর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না যে তার নীলময়ীর সাথে বিয়ে হচ্ছে। প্রচন্ড রকম অবাক সে। আবার তার বাড়ির লোকও অবাক নীল বেঁচে আছে সে কথা শুনে। আয়রা বেগম আর আনোয়ারা বেগম তো অস্থির হয়ে আছেন কখন নীলকে দেখবেন। তাঁদের সেই ছোট্ট নীল যে কিনা আধো আধো বুলিতে সবার সাথে কথা বলতো তার বিয়ে! ভাবা যায়?

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here