-আমার আপনাকে নয় বরং আপনার ছোট বোন নোরাকে ভালোলেগেছিল। আর তাকে ভেবেই আমি এই বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিলাম।
বিয়ের পরেরদিন সকালে স্বামীর মুখের এমন কোন কথা শোনার জন্য কোন মেয়েই হয়তো প্রস্তুত থাকে না। কাল সারারাত প্রত্যয়ের জন্য অপেক্ষা করে বসে থেকে ও সে যখন ঘরে এলো না তখনই হিয়া বুঝতে পেরেছিলো বিয়েটা হয়তো প্রত্যয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হয়েছে। সে হয়তো অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিন্তু তাই বলে প্রত্যয় তার ছোট বোনকে ভালোবাসে এ কথা শুনতে হবে সেটা কল্পনা করতে পারেনি হিয়া । তবে প্রত্যয়ের মুখ থেকে এরকম একটা কথা শুনে সে যে খুব বেশি কষ্ট পেল তা নয়। বরং সে খুব স্বাভাবিক, নির্লিপ্ত। এটা যেন হওয়ারই ছিল। সে নিজেও যে এই বিয়ের খুব একটা রাজি ছিল তা নয়। ভালোবাসা, বিয়ে এসব বন্ধনের তার বিশ্বাস নেই বহু আগে থেকেই। তবুও সে তার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে। আর বাবার জন্যই হিয়া এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলো। হিয়ার মা নেই। মা নেই বললে ভুল হবে। তার বাবা আর মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছে। হিয়ার যখন ছয় বছর বয়স তখন তার মা আর বাবা আলাদা হয়ে যান । তার মা আর বাবা দুজন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। হিয়া জানে না তার মা-বাবার কি কারণে বিচ্ছেদ হয়েছিল। সে তার বাবাকে প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে তার মায়ের ছবি বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখে। তার মাও নাকি তার মাও নাকি কাঁদে তার বাবার জন্য। এই কথাটা সে জেনেছে তার বোন দিয়ার কাছ থেকে। তারা দুইজন জমজ। তাদের বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর থেকে সে তার বাবার কাছে থাকে আর দিয়া কানাডায় তার মায়ের কাছে থাকে। তাদের চিঠিতে কথা হয়। এতো ভালোবাসার পরেও তার বাবা-মাকে আলাদা হতে হয়েছে। প্রতিনিয়ত হিয়া চোখের সামনে তার বাবাকে মায়ের জন্য কষ্ট পেতে দেখে। আর ঠিক এই কারণে সে ভালোবাসায় বিশ্বাস করে না। তবুও আজ তিন কবুলের জোরে পাওয়ার স্বামী নামক মানুষটির মুখে অন্য কাউকে ভালোবাসে জেনে তার কোথাও যেন একটা শূন্যতা অনুভূত হচ্ছে। চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে হৃদ মাঝারে। কেন এমন হচ্ছে? তবে কি এক রাতেই সে লোকটা প্রেমে পড়ে গেল?
কথাটা ভাবতেই ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো হিয়া। প্রেমে পড়েও লাভ নেই। কারণ লোকটা তো স্পষ্টই বলে দিল যে, হিয়াকে তার পছন্দ নয়। সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। অবশ্য প্রত্যয়ের মতো একটা ছেলে তাকে পছন্দ করবেই বা কি দেখে? সে তো দেখতে আহামরি কিছু নয়। ৫ ফিট ২ উচ্চতা, শ্যামলটে গায়ের রং, কুচকুচে কালো মণির চোখ দুটো সবসময় মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালেই ঢাকা পড়ে থাকে। নারী সৌন্দর্য তার চুলে। দীঘল কালো কেশে! হিয়ার চুলও সুন্দর নয়। ঘাড় অবধি লম্বা চুল। পোশাক পরিচ্ছদে ও সে খুব আনাড়ি। সবমিলিয়ে প্রত্যয়ের মতো স্মার্ট, সুদর্শন একটা ছেলের তাকে পছন্দ করার মতো কোন গুণ তার মধ্যে নেই। প্রত্যয়কে কি সুন্দর দেখতে। সে তো নোরার মতো একজনকেই তার জীবনে চাইবে। এটাই স্বাভাবিক। নোরা হিয়ার ফুপির মেয়ে। সদ্য অষ্টাদশে পা দিয়েছে। দেখতে অসম্ভব রূপবতী। যে কেউ একবার দেখলেই তার প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য। নোরা যখন লাল রঙের জামা পড়ে, হালকা সাজে, লম্বা চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে দিয়ে সামনে আসে হিয়া নিজেই তো তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। মাঝে মাঝে মুগ্ধ হয়ে বলতো,
-নোরা তুই দিন দিন এতো সুন্দর হচ্ছিস কেন রে?
নোরা তখন হেসে কুটিকুটি হতো। আর বলতো,
-বা রে আমাকে সুন্দর হতে হবে না। সুন্দর না হলে তোমাকে রেখে তোমার বর তার শ্যালিকার প্রেমে পড়বে কিভাবে? তাই তো কষ্ট করে সুন্দর হচ্ছি।
হিয়া তখন তেতে উঠতো। বিয়ের কথা শুনতে তার একদম ভালো লাগতো না। আর নোরা তাকে এই নিয়েই খেপাতো। আর নোরার সেই মজার ছলে বলা কথাটাই আজ সত্যি হলো। হিয়ার বর সত্যিই হিয়াকে নয় বরং নোরাকেই পছন্দ করে। হিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রত্যয়ের উদ্দেশ্য ধীর কন্ঠে বললো,
-আপনি চিন্তা করবেন না। আমাকে খুব বেশি দিন আপনার সহ্য করতে হবে না। আমি ভার্সিটিতে হলে সিটের জন্য এপ্লাই করেছি। হলে সিট পেলেই আমি এই বাসা থেকে চলে যাবো।
হিয়ার কথা শেষ হতেই প্রত্যয় তাকে তাকে সুধানোর জন্য বললো,
-আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না হিয়া। আপনি এখানে থাকে নিয়ে আমার কোন প্রব্লেম নেই। আমি শুধু আপনাকে বলতে চেয়েছি, এই মুহূর্তে আপনাকে আমার স্ত্রীর অধিকার দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা পবিত্র সম্পর্ক। বিশ্বাস, ভরসা আর ভালোবাসা হচ্ছে এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি। আপনাকে যখন আমি বিয়ে করেছি আমি অবশ্য আপনাকে আমার স্ত্রীর অধিকার আর প্রাপ্য সম্মান দুটোই দেব। তবে আমার একটু সময় লাগবে। ততোদিন না হয় আমরা বন্ধু হয়ে থাকবো। বন্ধু হয়ে একেঅপরের জানান, চেনার চেষ্টা করবো।
হিয়া কিছু বললো না। সে নিশ্চুপ হয়ে প্রত্যয়ের সব কথা শুনলো। হিয়া কে এমন চুপ থাকতে দেখে প্রত্যয় তাকে আবার জিজ্ঞেস করলো,
-কি হিয়া বন্ধু হবেন আমার?
হিয়া প্রত্যুত্তর করার আগেই রুমের বাইরে থেকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেল। তাই হিয়া আর কিছু না বলে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। দরজার বাইরে নোরা আর প্রত্যয় বোন প্রত্যশা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হিয়া নোরাকে দেখে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে একপলক প্রত্যয়ের পানে তাকালো। প্রত্যয় তাদের দিকেই তাকিয়ে ছিল। তাই হিয়ার দৃষ্টিতে প্রত্যয় বেশ অপ্রস্তুত হলো। হিয়া দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকালো। প্রত্যশা বললো,
– ভাবি আম্মু তোমাকে নিচে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠালেন।
প্রত্যশার কথায় হিয়া তার পড়নের সবুজ রঙের সিল্কের শাড়ির আঁচলটা দিয়ে মাথায় ভালো করে ঘোমটা টেনে মিষ্টি হেসে বললো,
– চল।
হিয়া নিচে নামতেই প্রত্যয়ের মা মেহেরুন্নেসা এগিয়ে এলো। তার মুখটা দেখে বললো,
-মাশআল্লাহ আজ খুব মিষ্টি লাগছে আমার হিয়া মাকে কে।
পাশের বাসা থেকে আন্টিরা, প্রত্যয়দের আত্নীয় স্বজন সবাই বসে আছে নতুন বউকে দেখবে বলে। মেহেরুন্নেসা তাকে সোফার নিয়ে বসালেন। সবাই হিয়াকে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে আর হিয়াও ঠোঁটে হাসি রেখে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে ভিতরে ভিতরে সে খুব নার্ভাস হচ্ছে। এর আগে কখনো এরকম পরিস্থিতিতে সে পড়েনি। ছোট বেলা থেকেই বাইরের মানুষের সাথে খুব বেশী মিশেনি সে। হিয়ার বন্ধুমহলের সদস্য সংখ্যাও খুব কম। তার পৃথিবী বলতে ছিল তার বাবা আর বই। হিয়ার বেশিরভাগ সময় কাটে বই পড়ে। তার প্রিয় শখ যেমন বই পড়া তার প্রিয় বন্ধুও তেমন বই ই। এর মাঝে প্রত্যয়ের এক মামী বলে উঠল,
-তা বউয়ের গায়ের রং এতো চাপা কেন? আমাদের প্রত্যয় বাবা কি কোন দিক দিয়ে কম। ভালো পড়াশোনা, ভালো চাকরি করে। দেখতে ও কতো সুন্দর। তা মেহেরুন এই মেয়েরে প্রত্যয়ের বউ বানাইলা কি দেখে? না আছে কোন রূপ আর না আছে ফর্সা গায়ের রং।…
ভদ্র মহিলার কথা শুনে হিয়ার মনটা মূহুর্তেই বিষিয়ে উঠলো। তা দু চোখে জল টলমল করছে। হয়তো চোখে চশমা থাকার কারণে কেউ তা দেখতে পাচ্ছে না। হিয়া খুব ইচ্ছে করছে তাকে কিছু কথা শক্ত কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু সে পারবে না। তার সেই সাহস নেই। হিয়ার ভাবনার মাঝেই পাশ থেকে নোরা বলে উঠলো,
-গায়ের রং সুন্দর হলেই কি ভালো মানুষ হওয়া যায় আন্টি? আপনি ও তো দেখতে খুব সুন্দর অথচ দেখুন অন্যদেরকে কিভাবে সম্মান দিতে হয় সেটাই জানেন না।
~চলবে, ইনশাআল্লাহ
.
.
.
#নীল_জ্যোৎস্নার_রাত_ও_তুমি
#লেখনীতে- সুমাইয়া জান্নাত
#পর্ব-০১