#নীল_জ্যোৎস্নার_রাত_ও_তুমি
লেখনীতে- সুমাইয়া জান্নাত
পর্ব-০৭
হিয়াকে দেখে প্রত্যয়ের ঠোঁটের কোণেও হাসির রেখা ফুটে উঠল। এতোক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সে খুব বিরক্ত হয়েছিল। কিন্তু অপেক্ষার পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে যেন তার সব বিরক্তি যেন নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেল।
-আপনার ক্লাস শেষ হলো তবে? সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করছি।
হিয়া খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-আপনি কি এখানেই ছিলেন? আর যাননি?
প্রত্যয় এক কথায় উত্তর দিলো,
-না।
-আপনার আফিস?
প্রত্যয় হেসে বললো,
-একদিন অফিসে না গেলে কিছুই হবে না। তাছাড়া স্যার জানে আমি নতুন নতুন বিয়ে করেছি। এখন একটু আধটু এরকম হবেই। এতো জীবন তো অফিসই করলাম এখন না হয় বৌয়ের সাথে একটু টাইম স্পেন্ড করি।
প্রত্যয়ের মুখে ‘বৌ’ শব্দটা শুনে হিয়া কেমন যেন লজ্জা পেল খুব। লজ্জায় তার মুখশ্রী মূহুর্তেই লাল বর্ণ ধারণ করলো। প্রত্যয় হিয়ার অবস্থা দেখে মৃদু হাসলো। তারপর গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে একটু নাটুকে সুরে বললো,
-আসুন মহারাণী। আপনার পদধূলি ফেলে এই অধমকে কৃতার্থ করুন।
লোকটার আজ কি হয়েছে? কথায় কথায় হিয়াকে লজ্জা দিচ্ছে । হিয়া কোন কথা না বলে ধীর পায়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। প্রত্যয়ও ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসলো। প্রত্যয় মাঝে মাঝেই হিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। এতে করে হিয়া আরো লজ্জা পাচ্ছে। প্রত্যয়ের এরূপ কর্মকান্ডে দেখে হিয়ার খুব অস্বস্তি হচ্ছে । তাই হিয়া ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে বই পড়ার ভান করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর হিয়া বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে বাইরের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় তাদের গাড়িটা একটা শহরে থেকে বাইরে অচেনা একটা রাস্তা দিয়ে চলেছে। তাই হিয়া অবাক হয়ে প্রত্যয়কে জিজ্ঞেস করে,
-এদিকে কোথায় যাচ্ছি আমরা?
-একটু ধৈর্য ধরুন হিয়া। গেলেই দেখতে পাবেন।
হিয়ার একটা বাজে স্বভাব হচ্ছে কোন প্রশ্ন তার মনে উদিত হলে তার উত্তর না জানা পর্যন্ত তার কিছুতেই শান্তি মিলেনা। তারা কোথায় যাচ্ছে সেটা এখনি না জানতে পারলে তার একদম ভালো লাগবে না। তাই সে প্রত্যয়কে আবার জিজ্ঞেস,
-প্লীজ বলুন না কোথায় যাচ্ছি আমরা?
-সারপ্রাইজ। আগে থেকে বলে দিলে তো সারপ্রাইজের মজা থাকবে না।
হিয়ার মুখ কালো করে বসে রইল। তার ভালো লাগছেনা। তারা কোথায় যাচ্ছে? খুব জানতে ইচ্ছে করছে। হিয়ার অবস্থা দেখে প্রত্যয় মৃদু হাসলো। প্রায় এক ঘন্টার মতো ড্রাঈভ করার পর প্রত্যয় একটা মাঠের সামনে গাড়িটা দাঁড় করালো। গাড়ি থেকে নেমে হিয়ার পাশের দরজা খুলে বললো,
-আর মুখ ফুলিয়ে না থেকে নামুন হিয়া। আমরা চলে এসেছি।
হিয়া এতোক্ষণ বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে ছিল। প্রত্যয়ের কথা শুনে সে বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে প্রত্যয়ের দিকে তাকাল। প্রত্যয় তাকে আবারো নামার জন্য তাড়া দিলো। হিয়া বইটা ব্যাগে রেখে গাড়ি থেকে নামলো। চারপাশে দৃষ্টি মেলতেই তাথ চোখ দুটো একরাশ মুগ্ধতায় ছেয়ে গেল। হিয়ার চোখে খুশির ঝিলিক। জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। সরু পিচঢালা রাস্তার পাশে বড় একটা মাঠ। মাঠের শেষ পান্তে দোলাতা পুরোনো ধাঁচের একটা দালাত। সেখানে ঘাট বাঁধানো একটা পুকুর আছে। পুকুরের পাড়ে সারি সারি নারিকেল গাছ। কী অপূর্ব সুন্দর জায়গাটা। এখন পড়ন্ত বিকেল। শেষ বিকেলের হলদে আলো এসে পড়েছে পুকুরের পানিতে নারিকেল গাছের মাথায় টকটকে লাল রাঙা সূর্যটা দেখা যাচ্ছে। প্রত্যয় হিয়াকে বললো,
-জায়গাটা আমার খুব পছন্দ। আমার যখন মন খারাপ থাকে কিংবা স্টেচে থাকি তখন আমি এখানে আসি। এখানে আসলেই আমার মনটা ভালো হয়ে যায়।
-এটা এতিমখানা?
-হ্যা। আমার দাদাভাই দিয়েছিলেন এই এতিমখানাটা। যদিও
এখানে বাচ্চাদের দেখাশোনা করার যথেষ্ট লোকজন আছে। তবুও আসি প্রায়ই এখানে আসি। বাচ্চাগুলোর সাথে সময় কাটাতে খুব ভালো লাগে।
হিয়া দেখলো মাঠের মধ্যে কিছু বাচ্চারা খেলাধুলা করছে। হিয়া তাদের দিকে এগিয়ে গেল। তার বাচ্চা খুব পছন্দ। হিয়ার শৈশবটাও আনন্দহীন ভাবেই কেটেছে তাই ছোট বাচ্চাদের খেলতে দেখলে তার খুব আনন্দ লাগে। তাদের সাথে তারও ছোট হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
হিয়ার পেছন পেছন প্রত্যয় ও বাচ্চাগুলোর দিকেই এগিয়ে গেলো। তাকে দেখেই বাচ্চাগুলোও ছুটে এলো। প্রত্যয় হাঁটু গেড়ে বসে তাঁদের সবাইকে আদর করলো আর চকলেট দিলো। বাচ্চাগুলোও চকলেট পেয়ে খুশি হলো। তারা আবার খেলতে শুরু করলো। হিয়াও তাদের সাথে জয়েন করলো। প্রত্যয় এখিমখানার ভেতরে গিয়েছিল কথা বলতে। সেখান থেকে এসে দেখলো হিয়া বাচ্চাদের সাথে দৌড়াচ্ছে। আবার কখনো খিলখিল করে হাসতে। প্রত্যয় অবাক হয়ে দেখলো হিয়া। তার গত এক সপ্তাহ ধরে দেখা হিয়া আর এই হিয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। এই হিয়া প্রাণোচ্ছল। কি সুন্দর এক নিমিষেই বাচ্চাগুলোর সঙ্গে মিশে গেছে সে। প্রত্যয়ের নিজের ফোন বের করে দূর থেকে এই মূহুর্তগুলো ক্যামেরা বন্দী করলো। সারাটা বিকেল হিয়া বাচ্চাদের সাথে আনন্দ করেই কাটলো। হিয়ার জীবনের চেষ্টা বিকাল এটা। গাড়িতে উঠে হিয়া প্রত্যয়কে বললো,
-ধন্যবাদ আপনাকে। আমাকে এতো সুন্দর একটা বিকেল উপহার দেওয়ার জন্য। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিকেল এটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে এই বিকেলটার কথা।
হিয়ার কথায় প্রত্যয় ঠোঁট প্রসারিত করে হেসে কুর্নিশ করে বললো,
-মাই প্লেজার।
_
হিয়া-প্রত্যয়ের বেডরুমের পাশের রুমটাই প্রত্যয়ের স্টাডি রুম। প্রত্যয়ের স্টাডি রুমে বসেই পড়ছিল হিয়া। প্রত্যয় নিজেও ফিজিক্সের ছাত্র ছিলো। তাই তার বুকসেল্ফে ও ফিজিক্সের অনেক বই আছে। হিয়া বুকসেল্ফ থেকে একটা বই নেওয়ার সময় অন্য একটা বই নিচে পড়ে যায়। হিয়া বইটা তুলতে গিয়ে কলেজ ড্রেস পরিহিত একটা মেয়ের ছবি দেখতে পেল। বইয়ের ভিতরে ছিল হয়তো। হিয়া ছবিটা হাতে নিলো। ছবির মেয়েটা দেখতে নিঃসন্দেহে খুব সুন্দরী। সুন্দর গোলগাল মুখশ্রীতে কি সুন্দর টানা টানা দুটি চোখ, ঠোঁটে কোণে বিস্তর এক হাসির রেখা। কলেজের সাদা ড্রেসের সাথে
মিলিয়ে চুলগুলো দুই পাশে ঝুটি করা। হিয়া ছবিটার দিকে বেশ তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, মেয়েটা কে? তখন ছবির পেছনের দুই শব্দের একটা বাক্য তার দৃষ্টিতে এলো। ছবিটার পেছনে লেখা মাই লাভ। ‘মাই লাভ ‘ দুই শব্দের এই বাক্যটাই হিয়ার মস্তিষ্কে বারবার বাজছে। কে এই মেয়ে? প্রত্যয়ের গার্লফ্রেন্ড? হিয়ার ভাবনার অবকাশ ঘটলো প্রত্যাশার আগমনে। সে এখানে হিয়ার সাথে বসে পড়াশোনা করতে এসেছে। প্রত্যশার হাতে দুটো কফি মগ। সে মিষ্টি হেসে একটা মগ হিয়ার দিকে এগিয়ে দিল।
-অনেকক্ষণ ধরে পড়াশোনা করছো। নিশ্চয়ই মাথা ধরে গেছে। তাই তোমার জন্যে কফি নিয়ে এলাম। আমি নিজ হাতে বানিয়েছি। তাড়াতাড়ি খেয়ে বল কেমন হয়েছে?
হিয়া মৃদু হেসে কফি মগটা হাতে নিলো। তার পর কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললো,
-খুব ভালো হয়েছে।
হিয়ার কথায় প্রত্যাশা ভীষণ খুশি হলো। কারণ আজ প্রথম নিজের হাতে কফি বানিয়েছে সে।
ছবিটার কথা মনে ঐ হিয়া প্রত্যাশাকে ছবিটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা এই মেয়েটা কে? তুমি চিনো?
প্রত্যাশা ফট করে বলে ফেললো,
-হ্যা চিনি। এটাতো নিধি আপু। কলেজ লাইফে ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড….
এইটুকু বলেই জ্বিভে কামড় দিলো প্রত্যাশা। কি বলতে যাচ্ছিল সে। এখনই তো তার ভাইয়ের সদ্য গড়া সংসারটা তার এক কথায় এখনি ধসে পড়তে যাচ্ছিল । সে জোরপূর্বক হেসে বললো,
-ভইয়ার কলেজ ফ্রেন্ড ।
~চলবে, ইনশাআল্লাহ।