#নূরবাহার ( ৩ )
#মিমি_মুসকান ( লেখনিতে )
একটি একটি ফুল গুলো জড়ো করছে নিজের কোলের মাঝে। কিঞ্চিত হেসে ফুল গুলোর তাকাল বাহার। দুর্গা দূর থেকে হাঁক ছেড়ে বলল, —“জলদি আয় বাহার, পুজোর সময় যে হয়ে এলো। মা এখনি তুলসী তলায় যাবে।
—“আসছি আমি!
জবাব পেয়ে দুর্গা ছুটতে লাগলো। তার পিছু পিছু ছুটছে বাহারও। বড় বটগাছের পাশ থেকে কেউ মিষ্টি স্বরে তার নাম ডাকতেই থমকে গেল বাহার। চঞ্চল চোখে এদিক ওদিক দেখছে। কে এখানে? কে ডাকলো তাকে? গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো মহেন্দ্র। বাহার চটজলদি জিজ্ঞেস করে বসল, —“কে গো তুমি?
জবাব দেবার বদলে মহেন্দ্র হা হয়ে তাকিয়ে রইল। এ কে তার সামনে, এ কোন দেবী! এই দেবী কে মাথায় তুলে রাখবে নাকি ভক্তি ভরে পুজো করবে। এমন মিষ্টি কোমল স্বরে আজ অবদি কেউ তার সাথে কথা বলেছে কি না মনে করতে পারছে না। মহেন্দ্রের মন উথালপাথাল করছে। কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। কেন ডেকেছিল সে বাহার কে? কি বলার ছিলো তার?
—“কথা কইছো না যে। কে তুমি?
—“আমি মহেন্দ্র!
—“মহেনদ!
হেসে উঠলো মহেন্দ্র! তার অগোছালো নামটা এই ফুলের মুখে শুনতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে। কৌতূহলী বাহার আবারো জিজ্ঞেস করল, —“আমারে ডাকছো কেন?
—“তুমি কেমন আছো জিজ্ঞেস করতে?
—“আমি ভালা আছি, তুমি ভালা আছো তো মহেনদ?
—“হুঁ, তোমাকে দেখার পর ভালোলাগা আরো বেড়ে গেলো।
ছোট বুদ্ধিসম্পন্ন বাহার কথাটির অর্থ বুঝলো না। শুধু হেসে উঠলো। মহেন্দ্রের চোখ জুড়িয়ে গেল বাহারের হাসি দেখে। ফতুয়ার পকেট থেকে লজেন্স বের করে বাহারের সামনে ধরে বলল, —“নাও বাহার!
—“এইটা কি?
—“লজেন্স, খুব মজা। আমার মামা শহর থেকে এনেছে আমার জন্য।
—“শুধু এই একটাই আনছে , তইলে তুমি আমারে কেন দাও?
—“এটা তোমার জন্য যে।
বাহার লজেন্স হাতে নিল। সন্ধ্যে গড়িয়ে যাচ্ছে। এখন বাড়ি না গেলে ঠাকুমা ফের রেগে যাবে। বাহার দৌড়ে বলল, —“আচ্ছা যাই গো,ম্যালা দেরি হইতাছে আমার।
বলেই সে ছুটতে লাগল। মহেন্দ্র চেঁচিয়ে বলল, —“কাল আবারো এসো বাহার, আমি তোমার জন্য এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো!
কথাটা বাহারের কানে পৌঁছালো কি না জানা নেই। কিন্তু মহেন্দ্র মন আজ প্রফুল্ল! বাহারের সাথে দুটো কথা বলে যে আনন্দ সে পেয়েছে তাকি আর কোথাও পাবে সে।
________
পরদিন বিকেলে উঠনো বাহারের চুলে তেল দিতে ব্যস্ত ঠাকুমা। নিজের প্রতি কোন যত্ন নেই বাহারের। ঠাকুমা তুলে তেল না দিয়ে দিলে, আঁচড়ে না দিলে এই চুল গত দু সপ্তাহেও ছুঁয়ে দেখবে না। এতোটুকুনি মেয়ে কি আর পারে নিজের যত্ন করতে। ঠাকুমা যত্ন করে চুলে তেল দিয়ে দিলেন। সুন্দর করে দুটো বেনীও পাকিয়ে দিলেন। বাহার দ্রুত দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, —“তেল দেওয়া শেষ গো ঠাকুমা ?
—“এতো তড়িখড়ি কিসের তোর মুখপরী?
—“ফুল তুলিতে যাবো যে, তোর তোমার মায়ের পায়ে ছোঁয়াবি না।
—“না, আজ থাক, কোথাও যাস নে।
—“কেন গো ঠাকুমা।
—“মনটা কেমন কেমন করতাছে। থাক আজ তোর কোথায় যাওন লাগতো না।
—“দূর্গা, মুনতাহা, তোয়া যে আমার লইগা অপেক্ষা করতাছে।
—“আহ্ বড্ড জ্বালাতন করছিস দেখি। কইলাম তো যাইতে না।
বলেই ঠাকুমা ঠাকুর ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। বাহার তার পিছু পিছু এসে দুয়ারে ঠায় দাঁড়াল। ঠাকুমা দুই হাত জোড় করে বসে আছেন। বাহার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। এই ঘরে তার প্রবেশ নিষেধ। কখনো সাহস করেও ঘরের দিকে পা বাড়ায় নি সে। মাটিয়ে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল বাহার। ঠাকুমা বারণ মানে ঘর ছেড়ে বের হবে না সে। সময় পেরিয়ে গেলো। ঠাকুমা উঠে দাঁড়িয়ে দেখলেন মেঝেতে পান্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে বাহার। নিষ্পাপ এই মেয়েটি যেন দেবীর এক রূপ! তার রাজলক্ষ্মীরও এতো রূপ ছিল না। সে ছিল মা কালীর মতো।
গাছের ধারে দাঁড়িয়ে সারাটা বিকেলের অপেক্ষা যেন এভাবে এভাবে কেটে গেল। বাহারের দেখা পায় নি মহেন্দ্র। তবে কি বাহার তাকে ভুলে গেল, সে যে বলেছিল আজ আসবে। তবে এলো না কেন? আচ্ছা অসুখ করে নি তো আবার। কিন্তু গতকাল যে দিব্যি ছিল। হৃদয়খানি ভেঙে গেল মহেন্দ্রর। সে আশায় সে এসেছিল তা পুরোই যেন নিষ্প্রাণ হয়ে গেল। এমন কেন লাগছে তার! এ কি বাহারের মায়া। এভাবে নিজেকে তার মায়ায় জড়িয়ে ফেলা কি ঠিক। তবে বাহারের প্রত্যাখান কিভাবে মেনে নেবে সে। তার হৃদয় যে এই ক্ষুদ্র প্রয়াস মেনে নিতে চাইছে না।
পরদিন অনেক আশা নিয়ে আবারো এসে দাঁড়াল গাছের ধারে। আজ বাহার না এলে তার বাড়িতে গিয়েই হাজির হবে। ওই তো , ওই তো দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা মেয়ে দলবেঁধে এদিকেই আসছে। কিন্তু তার নয়ন জোড়া যে ফুল কে খুঁজছে তাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না। মনের আশা একটু একটু করে আবারো নিষ্প্রাণ হতে নিল। জলের মাছ ডাঙায় এসে বাঁচবার জন্য যেমন ছটফটায় তেমনি ছটফটানি করছে সে। অবশেষে তার চোখ জুড়াল! তার দেবীর দর্শন পেয়ে গেছে সে।
—“তুমি এসেছো বাহার?
—“আপনে? আপনে আজ এহানে কি করেন?
—“তোমার অপেক্ষা বাহার।
—“আমার লইগা অপেক্ষা কেন করতাছেন?
—“তোমার দু’চোখ ভরে দেখবার আশায়।
—“আমারে এতো দেখতে চান কেন?
—“সে যদি তুমি বুঝতে বাহার, আমার ব্যথিত হৃদয় শান্ত হবে তোমায় একটি নজর দেখিলে!
কথার গুরুত্ব অধিক! বাহার ঘাড় বাঁকিয়ে রইল। এই কথার মর্ম সে বুঝেনি। এইটুকু তরুণের মনে বাহারের জন্য যে প্রেম, যে সাধনা, তা বোঝবার বয়স ছোট্ট বাহারের হয় নি। মহেন্দ্র একটু হাসল। হয়তো একটু শক্ত কথাই বলে ফেলছে সে। বুকভরা সাহস নিয়ে বলল,
—“বাহার আমায় বিয়ে করবে তুমি?
—“কেমন বিয়ে? আপনার পুতুল আছে, সেই পুতুলের লগে আমার পুতুলের বিয়ে দিবেন?
—“না, সে তো মিথ্যে বিয়ে। আমি বলছি সত্যি বিয়ের কথা।
বাহারের চাঞ্চল্য মুখ মলিন হয়ে গেল। পায়ের দিকে তাকিয়ে কইলো, —“আমার বিয়া হইতে এহনো অনেক দিন বাকি। আমি আরো বড় হমু, তখন আমার বিয়ে হইবো। শশুর বাড়ী যামু!
—“তুমি আরো বড় হয়ে বিয়ে করতে চাও বাহার।
জোরে জোরে মাথা দুলিয়ে আচমকা এক হাসি দিল। মহেন্দ্রের মন গলে গেল সেই হাসিতে। মৃদুস্বরে বলল, —“বেশ তো! আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য বাহার। তুমি আরো বড় হও, আমি তখন আবারো আসবো তোমার কাছে। তোমায় নিজের পেতে। তুমি তখন হবে তো আমার। অপেক্ষা করবে তো আমার জন্য। কি হলো বাহার, কথা দাও অপেক্ষা করবে!
ছোট্ট বাহার চিন্তা ভাবনা করতে লাগল। কিন্তু সেই ভাবনা এক নিমিষেই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল এক আগন্তুক এর আগমনে। দূর থেকে সমবয়সী এক ছেলে গলা ছেড়ে ডাকছে, —“বাহার, এই বাহার! কি করোস তুই ওখানে!
আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মহেন্দ্র দ্রুত সরে গেল সেখান থেকে। বাহার ছুটতে ছুটতে বলল, “নুহাশ! নুহাশ তুই আইয়া পড়ছোস! কি আনলি আমার লইগা?
—“পিঠা আনছি, মা তো বাসায় আইতে কইছে। আয় আমার লগে!
বলেই সেই ছোট্ট ছেলের ছুটতে লাগলো। তার পিছন পিছন ছুটতে বাহার। একসময় দুজনেই চোখের আড়াল হয়ে গেল। মহেন্দ্র দুইজনের অদৃশ্য হওয়া অবদি দাঁড়িয়ে রইল! বাড়িতে পৌঁছে বিয়ের সব বন্দোবস্ত বাতিল করল।বাহার আরো পরে বিয়ে করতে চায়। এর অর্থ তখন সে আরো বুদ্ধিমতী মেয়ে হবে। তার চাহিদা বাড়বে, এমন কম লেখাপড়া শেখা ছেলেকে বিয়ে করতে চাইবে না সে। মহেন্দ্র মনস্থির করল। শহরে মামার কাছে যাবে, সেখানে পড়ালেখা শিখে আবারো আসবে এই হলুদ বুনিয়া গ্রামের রূপবতী কন্যা বাহারের কাছে। তার মন বলছে বাহার ততোদিন তার অপেক্ষায় থাকবে, সেই পাবে বাহার কে।
#চলবে….
[ /