নেশাক্ত তোর শহর পর্ব ২+৩

#নেশাক্ত‌_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::০২ + ০৩

সাজগোজহীন বাসর ঘরে বসে আছে তৃষ্ণা।মনের মাঝে অগোছালো স্বপ্ন গুলো হানা দিচ্ছে তার।
রুমটা বিয়ে উপলক্ষে ডেকরেশন করে নেই বটে তবে একদম পরিপাটি । ছেলেদের রুম এতো গোছালো হয় জানা ছিলো না তৃষ্ণার। ঘরের দেয়ালটা পিংক এন্ড ব্লু কালারের সংমিশ্রণে সাজানো। বিশাল জানালায় সাদা পর্দা টানায় ঘরের ভেতর শীতল শীতল ভাব বিরাজ করছে।ঘরের আলমারি, সোফা , ড্রেসিং টেবিল, ইভেন্ট বেডের পাশে রাখা ছোট সাইজের টেবিলটাও শুভ্র রঙের। সাইড টেবিলের উপর রাখা শুভ্র রঙের ফুলদানি টায় লাল সাদা দুটো গোলাপ । গোলাপ দুটো লুকিয়ে আছে ।দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন আগের। ডান পাশের দেয়ালে চোখ আটকে গেল তৃষ্ণার ।দেয়ালে বড় করে বাঁধানো একটা ছবি।যেখানে একটি প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে হাতে থাকা একটা লাল গোলাপের দিকে তাকিয়ে আছে। ছবিটার নিচে ফ্রেমটাতে সোনালী অক্ষরে লেখা,,” তৃষ্ণার্থ আয়াত”। ভ্রু যুগল কুঁচকে এলো তৃষ্ণার। ঠোঁট জোড়া প্রশস্ত করে শব্দহীন উচ্চারণ করলো “আয়াত”।

একটু পরপর দরজার দিকে তাকিয়ে আয়াতের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলো। এখন পর্যন্ত তার স্বামী নামক ব্যক্তিটিকে দেখা হয়নি। আসার সময় আয়াতের ছোট বোন আরোহী তার পাশে বসে ছিল। প্রথমবার ছবিতেই আয়াতকে দেখলো সে।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো তৃষ্ণা।ঘড়ির কাঁটা একটা ছুঁই ছুঁই । এতোক্ষণে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকতো সে।চরম বিরক্ত হলো তৃষ্ণা। চেয়েছিল আয়াত নামক মানুষটার থেকে কিছুটা সময় চেয়ে নিবে। কিন্তু তার চাওয়া টাকে চাওয়া রেখে ,এক টানে মাথার ঘোমটা খুলে নিল সে।দুহাতে শাড়ি পেঁচিয়ে উঠে দাঁড়ালো ।লাল রঙের শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল ।শাড়িটা পাল্টে চোখ মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এলো । বেডের একদম কর্ণারে বালিশ চেপে শুয়ে পড়লো।।

তৃষ্ণা যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন তখন শব্দ করে রুমে প্রবেশ করলো আয়াত। একপা বেডের উপর রেখে তৃষ্ণা দিকে তাকিয়ে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। পিঠ ছাড়া অন্য কিছু আয়ত্তে এলো না তার । কিন্তু কিছুতেই রাগ কমছে না। বরং বেড়েই চলেছে। নিজেকে সংযত করতে টেবিলের উপর রাখা ল্যাম্পটা ছুঁয়ে ফেলল। অতঃপর ফুলদানিটা। দুহাতে মাথা চেপে চেঁচিয়ে বলল…

— “কী মনে করে আমাকে ,, খেলার পুতুল। ইচ্ছে হলো জোর করে বিয়ে করিয়ে দিলো।এখন আবার বাসর ঘরে পাঠিয়ে দিল। আমার জীবনের কোনো ব্যালু নেই তাদের কাছে।
আজ সব শেষ করে ফেলবো”।

কিছু ভাঙ্গার শব্দে ধক করে উঠে বসলো তৃষ্ণা ।রুমের নাজেহাল অবস্থা ,, আয়াতের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেল। আয়াতের জন্য অপেক্ষা না করে ঘুমিয়ে ছিল, তাই এমন বিহেব করছে কিনা বুঝতে পারলো না। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো সে ।আয়াতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে , কাঁচ বিঁধে গেল তৃষ্ণার পায়ে ।মুখ থেকে আপনাআপনি বের হয়ে গেল “” আহহ””!
উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে ছিল আয়াত ।মেইলি কন্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে তাকিয়ে থমকের গেল সে ।তার সামনে লাল শাড়ি পরিধিতা একজন অপুরুপ রমনী দাঁড়িয়ে আছে। ঘনঘন পলক ফেলে কৌতূহল নিয়ে বললো…

— “তুমি!! তুমি এখানে কি করছ”??

চরম বিদ্বিষ্ট হলো তৃষ্ণা। দাঁতে দাঁত চেপে বললো…

— “আমি ভূত ! বাসর রাতে দেরী করে এসেছেন, তাই আপনার ঘাড় মটকে দিতে এসেছি!! আশ্চর্য..
বিয়ের সময় দেখেননি না-কি ? এখন ভেজা বেড়াল কেন সাঝছেন”??

সময় নষ্ট করলো না আয়াত ।দুকদম এগিয়ে গিয়ে দৃঢ় বাধনে আবেষ্টিত করে নিল তৃষ্ণাকে। প্রথমবার অজানা পুরুষের সংস্পর্শে এসে স্তব্ধ হয়ে গেল তৃষ্ণা। ধীরে ধীরে পিনবিহীন শাড়িটা কাঁধ থেকে খড়ে পড়লো নিচে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁপা হাতে স্পর্শ করলো আয়াতের চিবুক। মৃদু স্বরে বলল..

–” ক-কি ক-করছেন? পায়ে ব্যাথা পাচ্ছি” ।

সাথে সাথে দূরত্ব বজায় রেখে সরে এলো আয়াত । তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে খসে পড়া আঁচলটা টেনে পেঁচিয়ে দিলো সে । দুহাতে আলতোভাবে কোলে তুলে অতি সাবধানে বেডে বসিয়ে দিল আয়াত। হাঁটু গেড়ে নিচে বসে আঘাত প্রাপ্ত চরণটা হাঁটুর উপর তুলে নিলো ।
পায়ে স্পর্শে হুস ফিরলো তৃষ্ণার। আয়াতের হাঁটুর উপর থেকে পা নামিয়ে আনতে নিয়ে চাইলে চোখ গরম করে তাকালো আয়াত । চুপসে গেল তৃষ্ণা।
সাবধানতা অবলম্বন করে বিঁধে যাওয়া কাঁচটা বের করে আনলো। কাবার্ড থেকে ফাস্ট এইড বক্স বের করে স্বযত্নে পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিল।আস্তে আস্তে পা সরিয়ে এক প্রকার দূরত্ব বেগে রুম প্রস্থান করলো আয়াত।

সামান্য পরিমাণ ব্যাথায় ব্যথিত হলো না তৃষ্ণা। পুরোটা সময় এক ধ্যানে আয়াতের দিকে তাকিয়ে ছিল। ধীরে ধীরে পূর্ণরায় নিজের জায়গায় এসে চোখ জোড়া বন্ধ করে গভীর নিদ্রায় হারিয়ে গেল সে।

____________________
প্রত্যুষের সোনালী রোদের আভা দিগন্ত থেকে দিগন্তের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে । উষার দুষ্টু মিষ্টি রোদ হানা দিচ্ছে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে পুরো পৃথিবী জুড়ে। রোদের সাথে তাল মিলিয়ে মিষ্টি সুরে পাখিরা ডেকে চলেছে । জানান দিচ্ছে পৃথিবীর দিনের আলোয় আলোকিত হয়েছে ।
জানালার পর্দা ভেদ করে উঁকি দেওয়া সকালের রোদের রশ্মি এসে পড়ছে তৃষ্ণার মুখে। তির্যক আলোতে চোখ যুগল ধীরে ধীরে কুঁচকে এলো তার। হাত বাড়িয়ে নয়ন যুগল আড়াল করে নিল সে। তথাপি কোনো উন্নতি হলো না। উল্টো হাতটা গড়িয়ে নিচে পড়ে গেল। আশে পাশে হাতরিয়ে কোনো কিছু আয়ত্তে পেল না । শাড়ির বাজে হাত পড়তেই আতংকে উঠলো সে। অঙ্গরুহ সংস্পর্শে এলে ধক করে চোখে খুলে তাকালো সে । চোখজোড়া শাড়ির উপর যেতেই এক ঝোঁক বাদামি রঙের উপর চোখ আটকে গেল। এক চিৎকার দিয়ে শাড়িটা খুলে বিছানায় থেকে নেমে গেল সে ।
নিষুপ্তির উগ্রে নিস্বন ধ্বনি শ্রুবণপথে যেতেই আবদ্ধ নয়ন যুগল মেলে গেল আয়াতের । আচম্বিতে নিদ্রা বিচ্ছিন্ন হওয়াতে আঁখি জোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চোখের সামনে তৃষ্ণাকে শাড়িবিহীন দেখে সশব্দে উঠে বসলো । দ্রুত তৃষ্ণার দিকে এগিয়ে গিয়ে দিকে হতাশাগ্রস্থ কন্ঠে বলল…

— “কি হয়েছে তৃষ্ণা । দুঃস্বপ্ন দেখেছ?? শরীর খারাপ লাগছে?
দুহাতে মুখ থেকে মলিন কন্ঠে বলল…

— “ঐ দেখুন । বেডের উপর ভুত”??

ঘাড় ঘুরিয়ে বেডের উপর আঁখি জোড়া দিতেই ঠোঁট দুটি চেপে হাসলো সে । দুহাত চিবুকে গুঁজে কৌতূহলী কন্ঠে বলল..

— “কালকে রাতে তো দিব্বি বলেছিলে ,, তুমি না-কি ভুত! তা কেমন ভুত শুনি ? যে ভুত ভুত কে ভয় পাচ্ছে? সাথে নিজের এই অবস্থা করলে “?

মুখশ্রী থেকে হাত নামিয়ে বেডের উপর দৃষ্টি দিতেই বাকরুদ্ধ হয়ে গেল । বাদামী আর কালচে রঙের মিশ্রণে তৈরি মাঝারি সাইজের খরগোশ । খরগোশটা শাড়ির বাজে ঘুমিয়ে আছে ।খরগোশটা এতোটাই সুন্দর , তৃষ্ণার মন অনায়াসেই কেড়ে নিল। এগিয়ে গিয়ে খরগোশটাকে ছোঁয়ার আগেই চোখ গেল শাড়ির দিকে। শাড়ির খেয়াল হতেই নিজের দিকে তাকালো তৃষ্ণা। নিজেকে উদ্ভর অবস্থায় আবিষ্কার করে দ্রুত অন্য একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

তৃষ্ণার কান্ড দেখে মনে মনে হাসলো আয়াত । নিজের ব‌্যবহৃত তোয়ালে টা নিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় নক করলো । তৃতীয় বার নক করতেই ওপাশ থেকে তৃষ্ণার কন্ঠস্বর ভেসে এলো ..

— “নক করছেন কেন ? আমি এখুনি আসছ ..

পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে আয়াত বলল..

— “আসতে হবে না । শুধু দরজাটা সামান্য খুলে তোয়ালে টা নিয়ে নাও ।আর একবারে শাওয়ার শেষ করে বের হও । বেলা অনেক হয়েছে “।

ছিটকিনি টা সামান্য খুলে হাত এগিয়ে দিল তৃষ্ণা । তোয়ালে টা দিল না আয়াত ।বরংচ শুকনো হাতটার দিকে কিছুক্ষণ গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যেন প্রথমবার এই হাত জোড়া সে দেখেছে । হাতের রেখাগুলো হিজিবিজি । আঙুলের ডগায় থাকা নখগুলো ধবধবে সাদা। আর কিছু পর্যবেক্ষণ করার আগেই তৃষ্ণার বিরক্তিকর কন্ঠ ভেসে এলো..

— “মজা করছেন আমার সাথে । তোয়ালে দিলে দিন , নাহলে প্রয়োজন নেই “।

সময় নষ্ট না করে তৃষ্ণার হাতের বাজে তোয়ালে টা বন্দী করে দিল । হাতের আওতায় তোয়ালে টা আসার পরই মৃদু শব্দে দরজাটা লাগিয়ে নিল । মৃদু শব্দে হুঁশ ফিরল আয়াতের । ঘুমন্ত খরগোশটা দিকে তাকিয়ে নিচে নেমে এলো।
মায়ের মুখে বিয়ের কথা শুনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিল আয়াত। নিজের যত্ন , খরগোশদের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো। দায়িত্ব টা আরোহীকে দিয়েছিলো । কিন্তু কালকে বিয়ের জন্য হয়তো খরগোশকে খাবার খাওয়াতে ভুলে গেছে ।

(চলবে)

শুক্রবার বিধায় একটু দেরী হলো । কেমন লেগেছে ,, জানাতে ভুলবেন না কিন্তু….

#নেশাক্ত_তোর_শহর
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::০৩

বিয়ের প্রথম সকালেই সময় নিয়ে শাওয়ার নিচ্ছে তৃষ্ণা। কালকে রাতে তেমন কিছুই হলো না ,অথচ..! যদি কিছু হতো, তাহলে হয়তো আজ ওয়াশরুম থেকে বের হতো না।
লেটুস পাতা আর গাজর নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো আয়াত । ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে তৃষ্ণার অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে নিল । দরজা ভেতর থেকে বন্ধ অর্থাৎ এখনো ওয়াশরুমের ভেতরে । দৃষ্টি সরিয়ে বেডের উপর দিল। খরগোশ টা তৃষ্ণার আঁচল জুড়ে ঘুমিয়ে আছে । বড্ড হিংসা হচ্ছে আয়াতের । যার বিয়ে করা বউ সে এখনো ছুঁয়েও দেখলো না আর খরগোশটা বিনা বাঁধায় শাড়িটা নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে ।
লেটুসপাতা আর গাজর গুলো একহাতে নিয়ে, অন্যহাতে খরগোশ টাকে তুলে বেলকেনিতে নিয়ে গেল।

দরজা খুলে বেরিয়ে এলো তৃষ্ণা ।ভেজা চুলে তোয়ালে না পেঁচিয়ে, কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। চারদিকে আয়াতের উপস্থিতি অনুভব না করে বেলকেনিতে পা বাড়ালো । বেলকেনির মনোরম দৃশ্য দেখে ওষ্ঠ যুগল একে অপরের থেকে সামান্য ফাঁক হয়ে গেছে । বেড রুমের থেকে শতগুণ সুন্দর তার এই ছোট বেলকেনিটা।গ্ৰিলহীনতা বেলকেনির সৌন্দর্য কয়েকশত গুন বাড়িয়ে তুলেছে । একপাশে তাকের উপর কৃত্রিম গাছ-পালা দিয়ে ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে তৈরি করা । কৃত্রিমের মাঝে কিছু কিছু সত্যিকারের গাছ রয়েছে । মাটি রাঙা মাঝখানে লম্বা হাতলযুক্ত ঝুড়ি। যেখানে ছোট ছোট তিনটে খরগোশ থাকে । উপরে গাঢ় সবুজ রঙের পাতলা কাপড় । তার পাশেই ওয়াটার ফলস রাখা । ফলসের মধ্যে ছোট ছোট লাল, হলুদ রঙের মাছ ও পাথর রয়েছে। উপরে অনেক শেওলা জমে আছে। বাংলায় যাকে বলে জলপ্রপাত কিংবা পানি চক্র। তাকের নিচে গাঢ় সবুজ নকশি পর্দা দিয়ে ঢাকা। বেলকেনির পুরোটা জুড়ে কৃত্রিম আর প্রাকৃতিক গাছ । মাঝে ফুঁলের গাছগুলো লক্ষ্য করে যাচ্ছে। যেখানে থোকায় থোকায় ফুল ফুটে আছে । অন্যপাশে একটা ঝুলন্ত দোলনা । দোলনার আশেপাশে অর্ধগলা ক্যান্ডলগুলো নিভে আছে । বেলকেনির দেয়ালে প্রাকৃতিক দৃশ্য আর্ট করা ।পায়ের নিচে মাটি রাঙা ফ্লোর। তৃষ্ণা একটু ঝুঁকে হাত দিয়ে মেঝে স্পর্শ করলো। কিন্তু না ,, এটা মাটি না ইট সিমেন্টের তৈরি ফ্লোর । চোখের দৃষ্টি বাইরে যেতেই আরো চমকে উঠল তৃষ্ণা । সামান্য কিছু দূরত্বে পাখিরা উড়ছে আর কিচিরমিচির ডাকছে । এই বেলকেনিটা তৃষ্ণার কাছে শুধু বেলকেনি নয় ,, একটা জঙ্গল।
ভাবনার মাঝেই একটা লেটুসপাতা তুলে তৃষ্ণার হাতের মুঠোয় বন্দী করে দিল । চোখের সামনে তুরি বাজিয়ে বললো..

— “এভাবে হাঁ না করে থেকে ওদের খাইয়ে দাও” ।

কাঁপা কাঁপা হাতে তৃষ্ণা গাজরটা খরগোশের দিকে এগিয়ে দিলো । খরগোশটা এগিয়ে দাঁত দিয়ে কুটকুট শব্দ করে গাজর খাচ্ছে । তৃষ্ণা আয়াতের দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বলল..

— “এগুলো সব কি আপনি পোষেন” ??

আয়াত তৃষ্ণার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দুহাত গ্ৰিলে রাখল । রেলিং এ সর্বশক্তি ভর করে তৃষ্ণার দিকে ফিরে বসলো। চোখজোড়া বন্ধ করে ধরা গলায় বলল..

— “জানো তৃষ্ণা ,, মানুষ মানুষকে ছেড়ে গেলেও অবুঝ পশুপাখি কখনো ছেড়ে যায় না। যখন আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে রিজেক্ট করেছিল ,, আমি পাগল গিয়েছিলাম। তবে সে আমাকে ঠকায় নি ।সে অন্য একজনকে ভালোবাসে , আমাকে ভালোভাবেই সেটা বুজিয়েছে । নিঃস্ব লাগছিল নিজেকে । তাকে আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিয়েছি ।যদি আমার ভাগ্যে সে থাকে তাহলে আমি ঠিক তাকে পাবো । তখন প্রকৃতিকে আপন করে নিয়েছি ।মন ভালো রাখতে এই প্রিয় বেলকেনিটাকে নিজের পছন্দমত সাজিয়েছে ।
এই খরগোশ দুটির মাঝে আমি,, আমাকে আর সেই প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে পাই । আর পাখিরা রাতে এখানে থাকে । সারাদিন এদের দেখা পাওয়া যায় না ।
পূর্ণিমার রাতে এই বেলকেনিটাকে আমার কাছে রুপকথার গল্পের মতো মনে হয় “।

তৃষ্ণা গাজরটা খরগোশকে খাইয়ে, ছানাটাকে সাবধানে দুহাতে তুলে নিলো । আলতোভাবে খরগোশের কপালে অধর ছুঁইয়ে দিল । অঙ্গরুহ তে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল…

–” জানেন আমারও এক জোড়া খরগোশ ছিল । ভাইয়া এনে দিয়েছিল” ।

— “এখন নেই” । (বুকে হাত গুজে আয়াত)

মলিন হাসলো তৃষ্ণা । রিজভী খরগোশটাকে কি করছে জানা নেই তার। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল..

— “তাও এক বিশাল কাহিনী । অন্য একদিন বললো”।

— “ভাবী কোথায় তুমি? প্রতিবেশী আন্টিরা তোমাকে দেখতে এসেছে” ।(রুমে প্রবেশ করে দু’জনকে খুঁজে না পেয়ে আরোহী)

আরোহীর কথায় ধ্যান ভাঙলো তৃষ্ণা- আয়াতের । হাতের বাজে বন্দী রাখা খরগোশের ছানাটাকে আয়াতের হাতে দিয়ে আরোহীর ডাকে সাড়া দিল ।

— “আরোহী আমরা এখানে । দাঁড়াও আসছি”!

গোটানো শাড়ির কুচিগুলো ধরে আরোহীর সামনে এগিয়ে গেল । তৃষ্ণার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে খরগোশের মাথায় দিকে গভীর ভাবে তাকালো আয়াত। খরগোশটাকে হিংসে হচ্ছে প্রচুর । নিজের বিয়ে করা বউকে এখনো ছুঁতে পারলো না এদিকে তৃষ্ণা আয়াতকে ছেড়ে খরগোশকে চুমু খেয়েছে ।দুহাতে খরগোশটাকে উপরে তুলে নিলো । তৃষ্ণার ঠোঁট ছুঁয়ে দেওয়া জায়গাটায় গভীর ভাবে নিজের ঠোঁট ছুয়ালো । পারলে যেন স্থানগুলো খেয়ে ফেলতো ।
আড়চোখে বেলকেনিতের দিকে তাকিয়ে ভাইয়ের উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নিল । দুজনে একসাথে বেলকেনিতে দেখে তৃপ্তিকর শ্বাস ছাড়লো । কিছু একটা ভেবে বলল…

— “ভাবী। নিচে আমাদের প্রতিবেশী আন্টিরা এসেছে তোমাকে দেখতে ।হুট করে বিয়েতে আসতে পারেনি তো তাই”।

তব্ধ নিঃশ্বাস ছাড়ল তৃষ্ণা । প্রতিবেশী আন্টিদের সাথে তেমন কোনো পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তাদের । কেমন স্বভাবের তাও তার অজানা । ঠোঁট কামড়ে ফোস ফাস করে মলিন কন্ঠে বলল…

— “তুমি যাও আরোহী। আমি আসছি”!!

রহস্যময়ী হাসি দিয়ে দ্রুত রুম প্রস্থান করলো সে । যেন বেরিয়ে গেলেই বেঁচে যাবে। পুরোটা সময় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল ।
বোধশক্তি হারিয়ে আরোহীর পেছনে পেছনে বেরুতে নিল তৃষ্ণা । বের হওয়ার আগেই থামিয়ে দিলো আয়াত । বাহুতে হাত রেখে টেনে বেডে বসিয়ে দিল । কাঁধে ঝুলন্ত তোয়ালে টা দিয়ে মাথার চুল গুলো স্বযত্নে মুছিয়ে দিল । কাবার্ডে গুছিয়ে রাখা হেয়ার ড্রায়ার বের করে নিল । তৃষ্ণার পাশে বসে প্রতিটা চুলগুলো সূক্ষ্মভাবে ড্রায়ার করে করে দিল ।
গা গুলিয়ে উঠলো তৃষ্ণার । কখনো কোনো ছেলের সংস্পর্শে যায়নি সে । ছাড়িয়ে নিতে চাইলে আরো দৃঢ় বান্ধনে আবদ্ধ করে নিল আয়াত । চুলের বাজে হাত রেখে তীক্ষ্ম কন্ঠে বলল..

— “খরগোশের ব্যবহার করা হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে সুন্দর ভাবে চুল গুলো শুকিয়ে দিচ্ছি । যদি আরেকবার মোছড়া – মুচড়ি করো, তাহলে খরগোশের মতো হাতে নিয়ে জানলার ফাঁক দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিবো ।মাইন্ড ইট” !

দমে গেল তৃষ্ণা । চোখের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো শ্রাবণপথের পেছনে গুঁজে দিয়ে শান্তভাবে বসে রইল সে ।

পূর্ণরায় হেয়ার ড্রায়ার কাবার্ডে গুছিয়ে রাখল । প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় একপা দিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো । মোহনীয় চোখে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে ঘোরলাগা কন্ঠে বলল…

— “বাইরে যাও আর যেখানে যাও। যাওয়ার আগে শাড়িটা পাল্টে যাও ।
তোমাকে এই অবস্থায় শুধু আমি দেখবো ।অন্যকেউ যাতে না দেখে”।

দরজা বন্ধ করার শব্দে হুঁশ ফিরল তৃষ্ণার । আয়াতের কথাগুলো মাথায় আসতেই নিজের দিকে তাকালো । লজ্জায় কুঁকড়ে উঠলো সে। ইতিমধ্যে গালের খানিকটা অংশ রক্তিম আকার ধারণ করেছে । চুলের পানিতে পেছনের অংশ ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে ।

_________________________
— “মা ! ঘোমটা সরিয়ে একটু চুলগুলো দেখাও তো”?

বিরক্তির উপর চরম বিরক্তি হলো তৃষ্ণা । প্রতিবেশীদের এর জন্য তার ভালো লাগে না ।এই নিয়ে আঠারো না উনিশ বার বলেছে, ” মা একটু হেঁটে দেখাও? , হাতের রেখা দেখাও? , এতো চিকন কেন”? এটা ওটা বলতে বলতে তৃষ্ণার মধ্যে এমনিতেই বিরক্তিকর ভাব চলে এসেছে ।
মাথার ঘোমটা ফেলে খোঁপা করা শুষ্ক চুলগুলো ছেড়ে দিল । কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তৃষ্ণাকে দেখে থামলেন তারা । তৃষ্ণার এমন বিরক্তিকর ভাবটা প্রকট হলো আয়াতের মা মনিকার কাছে । চায়ের ট্রে টা টি টেবিলের উপর রেখে তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললেন..

— “তুমি এবার যাও! গিয়ে দেখ আয়াতকে কি প্রয়োজন হয়” ।

মনিকার মুখে রহস্যময়ী হাসি দেখে চাপা হাসলো তৃষ্ণা। সবাইকে সালাম দিয়ে রুমের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো । দু-সিড়ি অতিক্রম করে থেমে গেল সে । নিচের দিকে তাকাতেই কপালের কোণে তিনটি উদ্বিগ্ন ভাজ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। উপর থেকে শাড়ির কুচিগুলো খুলে এসেছে । তট জলদি বাড়ির কুচিগুলো ঠিক করতে নিলে , কুঁচিগোছা ছুটে পায়ের কাছে পড়ে গেল । চোখ মুখে বিরক্তিকর ভাব নিয়ে পেছনে ফিরে তাকালো সে । সবাই তার দিকে বিষন্ন চোখে তাকিয়ে আছে । কয়েকজনে ইতিমধ্যে বলেও ফেলেছে ..

— “মনি! এ-কেমন বউ এনেছিস ।শাড়িটাও ঠিকভাবে পড়তে পারে না”।

— “আমি হলে এমন মেয়েকে ছেলের বউ তো করতামই না । যদি হয়ে যেত পিটিসে সোজা করে দিতাম । বাবা মা আদরে আদরে বাঁদর তৈরি করেছে ।
যে মেয়ে নিজেকে সামলে উঠতে পারেনা। সে মেয়ে তোর ছেলেকে কি করে সামলাবে ।দেখিস হিতে বিপরীত হয়ে না যায় ।এখনো সময় আছে বউকে শাসনে জব্দ করে নে ..

ঠাস ঠাস শব্দে করে নিচে এলো আয়াত । প্রতিবেশী আর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে। মেয়েটার চোখজোড়া ছলছল করছে । এই বুঝি আটকে রাখা অশ্রু গুলো কান্না রুপে বাইরে বেরিয়ে এলো। হাঁটু কাছের ট্রাউজার টা সামান্য গুটিয়ে নিল । হাঁটু ভাঁজ করে তৃষ্ণার কাছে বসে পড়লো। পায়ের কাছ থেকে অগোছালো কুচিগুলো গুছিয়ে পূর্ণরায় তৃষ্ণার হাতে ধরিয়ে দিলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here