নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব -০৮

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৮

‘মিস আবান এ কি আমার মত হ্যান্ডসাম,স্টাইলিশ বসকে দেখে বুঝি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছো না। না হাই,না হ্যালো,ডাইরেক্ট পাপ্পি হাগ!
ওয়াও দ্যাটস নাইস মিট ফর মি।
একটা কথা না বললেই নয়। আমি তো নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। তোমার মত হ…আহহ্।’

আরভীক এর বেহায়া কথা থেকে বাঁচতে তার হাতে হুল-বেঁধানোর মত চিমটি দেয় আনজুমা। ফলে হাতে মালিশ করতে আনজুমাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। বলদের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে দূরে সরে দাঁড়ায় আনজুমা। আরভীককে ফাইল দিতে গিয়ে ভুলবশত টেবিলের কোণায় পা লেগে তার কোলে বসে পড়ে ছিল। বিধেয় আরভীকও তার আদর্শ বাণী ছু’ড়ে দেয়। চিমটির জায়গায় ডলতে থেকে ভস্মীভূত দৃষ্টিতে দেখে আনজুমাকে। সে ফাটাঁবাঁশের ন্যাকামী দেখে বিরক্ত। তাই সে বেরিয়ে যেতে নিল। যা অসম্ভব করে দেয় আরভীক। কেবিনের দরজা অটোমেটিক লকড হওয়ার বাটন প্রেস করে। আনজুমা দরজার হ্যান্ডেল ধরে টান দেয়। কিন্তু খুলল না দরজা। বারংবার টানার সত্ত্বেও যখন খুলছে না। তখন বুঝে গেল কাজটা কার।
শান্তভঙ্গিতে পিছে ঘুরে। আরভীক তার মসৃণ সফেদ দাঁত দেখিয়ে বলে,

‘এত তাড়া কিসের মিস আবান! কাম এন্ড সীট।’

ভাবলেশনহীন তাকিয়ে থাকে আনজুমা। আরভীক কপাল কুঁচকে কিঞ্চিৎ গর্জে বলে,

‘আই সেয়ে সীট!’

ঠাস করে টেবিলের উপর গর্জন সহিত আঘাত করে দেয়। আনজুমা কেঁপে উঠে। দ্বিরুক্তি না করে চেয়ার টেনে বসে। দৃষ্টিনত করে মৌন রইল। আরভীক হেলান দিয়ে তার কাছে ফাইল চাইল। দ্ব্যর্থহীন ভাবে ফাইলটা এগিয়ে দেয় সে। তবুও নেত্রযুগল আরভীক এর দিকে শায়িত করল না। ফাইলটা নিয়ে আগ্রহদীপ্ত নয়নে আয়ত্তে করে আরভীক। ফাইলের শেষপ্রান্তে ‘হিস্টিরি’ লিখা নোট পায়। সেখানে তার স্বামীর নামের পাশে ‘মৃত’ শব্দটির উপর ঠিক চিহ্ন দেওয়া। যা দেখে আরভীক এর বুক মোচড়ে উঠে। কেনো যেন এই ঠিক চিহ্নটা সেখানে না থাকার কথা। ঠোঁট কামড়ে ফাইলের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে।

‘মিসেস সুয়াইব ইত্তেসাম জুমা!’

মর্মঘাতী নামটি শুনে থমকে যায় আনজুমার হৃদস্পন্দন। মূর্তির মত থুতনী তুলে তাকায়। আনজুমা শুকনো ঢোক গিলে, ‘জ…জ্বি’ বলে।

‘আপনার হাজবেন্ডের মৃত্যু কেমনে আর কবে হলো!’

ঠোঁট ঈষৎ কেঁপে উঠে আনজুমার। শিহরিত পলক,দৃষ্টিজোড়া চোরের মত হয়ে যায়। কি জবাব দিবে সেই হৃদয় বিধ্বস্ত রাতের। শরীর কাঁপতে আরম্ভ করে তার। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হাত কচলাতে থেকে বলে,

‘আ আপনার এসব জানতে হবে না। আমি কি সেলার হওয়ার যোগ্যতা রাখি কিনা শুধু তা দেখে বলুন!’

আনজুমার এড়িয়ে যাওয়া বুঝে যায় আরভীক। সেও নাছোড়বান্দা ড্রয়ার থেকে কেবিনেট ফাইল বের করে তাকে দেখায়। আনজুমা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টি ফেলে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) কেবিনেট ফাইলটি খুলে আনজুমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘মিস আবান স্বামীর মৃত্যুর বিবরণ দিতে হবে। এই কেবিনেট মন্ত্রণালয়ের। রুলস অনুযায়ী বাবা বা স্বামী হলে তার বিবরণ আবশ্যক লেখা আছে।’

কুলকিনারা হারিয়ে বিধ্বস্ত চাহনী নিক্ষেপ করে আরভীক এর দিকে। যে চাহনীতে ক্ষতবিক্ষত হলো আরভীক এর হৃদয়। আনজুমা দৃষ্টি লুকিয়ে বলে,

‘সুয়াইব ইত্তেসাম আমার স্বামী। তিনি আমার থেকে পাঁচ বছরের বড় ছিলেন। আমার যখন চৌদ্দ বছর তখন তিনি আমার জীবনে ভালোবাসা নামক ঢেউ হয়ে এলেন। কিশোরী আমি ঐ সুদর্শন মায়াবী চেহারা,চিকন আইভ্রু,কালো-গোলাপী ঠোঁট ও উনিশ বছরের ছেলের প্রেমে পড়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে বড় হওয়ায় শারীরিক বিষয়গুলো নিয়ে ওতটা আকর্ষণ ছিল না। বান্ধবীদের কাছ থেকে ছেলে বন্ধুর নানান গল্প শুনতাম। ছেলেরা যে আমাকে প্রপোজ করেনি তা নয় করেছিল। তবে আমিই রাজি হতাম না। বিয়ে উনিশ বছরের ছেলেটার সঙ্গেই দিয়ে ছিল বাবা-মা। কেননা মেয়ে আমি তাদের সংসারে বোঝা ছিলাম। নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিলাম তখন। হঠাৎ বিয়ে হওয়ায় ঘাবড়ে যায়। রাতদিন যে এক পুরুষের সঙ্গে শয্যাসঙ্গী হবো। তা কল্পনায় আনতেই ভয়ে পালিয়ে যেতে মন চাইতো। তবে সুয়াইব সে সময় ঢাল হয় আমার মনের। তার ফ্যামিলি বলতে এই আমিই ছিলাম। তাকে নিয়ে এক কুটিরে সুন্দর সংসার শুরু করলাম। সে প্রতিনিয়ত আমার মাঝে প্রণয়ের বীজ রোপন করে। ঐ বীজের মূল মজবুত হলে চলে এলো গর্ভে আশফি। তখনো সে উনিশ আর আমি চৌদ্দ বছর ছিলাম। সুয়াইব ভেবে ছিল বিয়ের একবছর পার হলে বাচ্চা নিবে। হঠাৎ আবেগের বশে হওয়া ভুলে যদি আমার ক্ষতি হয় তাহলে সে সহ্য করতে পারবে না। তাই আমাকে বাচ্চা এব্রোশন করিয়ে নিতে বলে। কিন্তু আমি শুনেনি। যে বাচ্চা আমাদের প্রণয়ের তাকে কেমনে ফেলে দেব। আমার শারীরিক ত্রুটি ছিল না। গর্ভে লালন করতে কষ্ট হয়ে ছিল বটে। যেদিন আশফি হবে সেদিনও আমার বয়স পনেরো হয়নি। বরং পনেরো হতে আরো চারমাস বাকি ছিল। ডেলিভারির সময় হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিলাম। সুয়াইব কে তার পুলিশ লাইন থেকে জরুরী ভিত্তিতে কল করা হয়। জানানো হয় কয়েক মিনিটের আলোচনার জন্য আসতে। সেই যে গিয়ে ছিল আর ফিরেনি। অপারেশনের মুহূর্তেও আমার চোখ দুটো মানুষটাকে খুঁজে ছিল। তবে দেখা মিলল না। তথাপি মিলেছে ভোরবেলায় তার মৃতদেহ। বাচ্চা হওয়ার সুখ পেয়েও প্রণয়ের মূখ্য পুরুষকে হারিয়ে মানসিকভাবে উচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। আশফির প্রতিও মায়া কাজ করছিল না। বরং হিংসে জাগছিল এই ছেলেকে রেখে আমিও চলে যেতে চাইছিলাম সুয়াইবের সঙ্গে। এককথায় ট্রমার মধ্যে ছিলাম। দাদী শ্বাশুড়ি আমাকে ট্রমার থেকে ফিরিয়ে আনেন। আশফিকে দেখেই জীবন পার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। নিজের পরিবারের কেউই আসেনি দেখতে। তাই সম্পর্কে বিচ্ছিন্ন। ওহ বলাবাহুল্য দাদী শ্বাশুড়ি ছিলেন বৃদ্ধাশ্রামে শায়িত নারী। সুয়াইব মাঝমধ্যে বাসায় আনতেন। তিনি মিশুক আর খুব সুন্দর স্বভাবী নারী ছিলেন। স্বামীর চলে যাওয়ায় বসে রইলাম না। বাচ্চা হওয়ার শারীরিক যন্ত্রণা ও স্বামী হারানোর বেদনায় নবম শ্রেণিতে এক বছরের গ্যাপ পড়ে গেল। এর পরের বছরে আবারো নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পড়া চালিয়ে গেলাম। পড়াশুনার মাঝে আশফির দেখভাল দাদী করতেন। এই যে আমার আঠারো বছর বয়সে এইচএসসি পাশ করে বের হলাম। তবে অনার্স পড়ার সুযোগ কপালে হয়নি। এক ধাপে পড়তেই যত লাখ টাকা লাগে তার চেয়ে বরং সংসারে আশফির যত্নে মনোনিবেশ করি। তার দিকে তাকিয়ে ক্লাবে চাকরী পেয়ে ছিলাম ওয়েট্রেসের। যা হাতছাড়া হয়ে গেল সেই সঙ্গে স্যালারিও।’

কথার সমাপ্তি টেনে চুপ হয়ে গেল আনজুমা। স্যালারীর কথাটা শুনে নুয়ে গেল আরভীক এর মাথা। অনুশোচনা দীর্ঘ হলো।
আনমনে ‘সরি প্রিটিগার্ল’ বলে।
যা কর্ণপাত হলো আনজুমার। সে ব্যস্ত অতীতের স্মৃতি ঘাঁটায়। আরভীক মেয়েটার দিকে গভীর চাহনী নিয়ে দেখে। এ চাহনীতে কি আছে।
তা সে নিজেও আন্দাজ করতে পারছে না। সন্তপর্ণে পানির গ্লাসটি এগিয়ে দিল আনজুমার দিকে। গ্লাসের দিকে এক পলক তাকিয়ে আরভীক এর শান্ত,ভদ্র চেহারার দিকে তাকায় সে। আরভীক মুচকি হেসে বলে,

‘সামনে এই চেহারা দেখেই দিন কাটাতে হবে তোমার। এখন পানিটা খেয়ে গলা ভিজিয়ে নাও। মূল প্রশ্ন তো এখনো করা বাকি!’

প্রথম দু’লাইনে পাত্তা না দিলেও শেষের লাইনে আপনাআপনি অবুঝ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেল আনজুমার মুখশ্রীতে। আরভীক হাতের ইশারায় পানি নিতে বলে। সেও বিনা দ্বিধায় গ্লাসটি নিয়ে একচুমুকে পুরু গ্লাস খালি করে ফেলে। ঠান্ডা পানি হওয়ায় গলা ভিজিয়ে আরাম পেল।
আরভীক দু’হাত থুতনী বরাবর রেখে গম্ভীর গলায় শুধায়।

‘সুয়াইব পুলিশ লাইনে চাকরী করছিল কত বছর যাবত!’

প্রশ্নটি শুনে ভাবান্তর হলো আনজুমা। মনে পড়ছে না তার। তবে ধোঁয়াশা কল্পনার সহিত বলে,

‘যতদূর মনে পড়ছে তিনি কলেজ জীবন শেষ করে ছিলেন আমার আগে। পরে পুলিশ লাইনে ভর্তি হয়। তাকে ভর্তি করিয়ে ছিল কে সেটা জানিনা! কিন্তু তিনি বলতেন, যিনি তাকে ভর্তি করিয়ে ছিল তিনি সুয়াইবকে খুব দেখতে পারতো, ভালোবাসতো। তাই প্রশিক্ষণের এক বছর পর মানে তিনি যখন বিশ বছর বয়সী হলো। তখন তাকে ডিপুটি কমিশনার অব পুলিশ পদে নিয়োগ করা হয়। উনিশ বছর বয়সে তিনি প্রশিক্ষণরত ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় তখন আমার চার মাস চলছিল প্রেগন্যান্সির। এতে সুয়াইব নিজেও হতভম্ব হয়। কেনো তাকে সরাসরি মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মে নিয়োগ করা হয়। তাকে নিয়োগ দেওয়া ব্যক্তি অন্য কেউ নয় বরং ঐ ভালো মানুষটাই ছিল। যিনি সুয়াইবকে ভালোবাসতো। পদের উন্নতিতে তিনি ন্যায্য মূল্য সর্বোচ্চ হারে পেতেন। ঘরের সংসার অনায়াসে চলে যাচ্ছিল। তিনিও সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা করে পদটা ধরে রাখার চেষ্টা করেন। আমার দায়িত্বের সঙ্গে নিজের কর্তব্য পালন করতে পিছপা হতেন না।’

‘আপনাকে সুয়াইবের মৃত সম্পর্কে কি জানানো হয়ে ছিল!’

আনজুমা চমকিত চোখে আরভীক এর দিকে তাকায়। তার চেহারায় এক অজস্র ক্ষতপূর্ণ অগ্নিকুণ্ড ফুটে উঠেছে। রাগে তার কপালে তীব্র ভাঁজ পড়ে গিয়েছে। তবে তার কণ্ঠ হতে ‘আপনি’ ডাক শুনে আনজুমা অবাক হলো। প্রথমদিন যাও ‘আপনি’ ডেকে ছিল তারপর থেকে ‘তুমি’ ছাড়া ডাকেনি। এমুর্হুতে কি হলো তার জানে না সে! অবুঝ চোখে পলক ফেলে বলে,

‘সুয়াইবের অফিসের গাড়ি বিজ্রের মধ্যে এসে টায়ার পাংচার হয়। তাই ভাঙ্গা গ্রিলের মধ্যে লেগে ব্যালেন্স হারিয়ে গভীর সাগরের মধ্যে গাড়ি পড়ে তলিয়ে যায়। পুলিশ খবর পেলে ডুবুরি নিয়ে খোঁজ লাগায়। মৃতদেহ খোঁজে পেয়ে ছিল ঘটনার চারঘণ্টা পর। তখন আমি হাসপাতালেই ছিলাম। আশফিকে নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম তার আসার। তার কথা এসে জানিয়ে ছিল এক কনস্টেবল।’

শেষের কথায় ঠোঁট কামড়ে কান্না নিবারণের চেষ্টা করে আনজুমা। আরভীক হাতমুঠোয় চেয়ারের হ্যান্ডেল শক্ত করে চেপে ধরে। শেষ প্রশ্ন করতে ইতস্ততবোধ করল না। সরাসরি বলে দেয়।

‘আপনার বাসায় সেই দাদী কোথায় এখন!’

দৃষ্টি নেতিয়ে পড়ে আনজুমার। ক্লান্তির ফলে দুঃখী ভাব ফুটে উঠে তার মুখশ্রীতে। তবুও জবাব দেয়।

‘আমার এইচএসসির দুমাস পরই তিনি গত হয়েছিলেন। জানাযা পালনে আমার প্রতিবেশি বিউটিখালার আত্মীয়স্বজন সহায়তা করে।’

‘এই বিউটিখালা কে!’

‘বললাম তো আমার প্রতিবেশি ছেলে-বউ-নাতী-নাতনী নিয়ে থাকেন।’

ছেলে যে বউছাড়া হয়েছে তা ইচ্ছাকৃত এড়িয়ে যায় আনজুমা। অন্যের সংসারের কথা টেনে লম্বা করার বিষয়টা বলতে মস্তিষ্কে বাঁধে। ফলে সেও শান্ত হয়ে গেল। আরভীক ঢোক গিলে দম আঁটকে নেয়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)ফাইলের উপর সীলমোহর বসিয়ে দেয়। ফাইলটি টেবিলে রেখে রকিং চেয়ারে হেলান দেয়। চেয়ার ঘুরিয়ে গ্রাফিক্স বক্সের দিকে নেই। অকারণে কণ্ঠ কাঁপছে আরভীক এর। তবুও পরিস্থিতি সামলাতে নিলিপ্ত গলায় বলে,

‘কেবিনের বাহিরে অপেক্ষা করো। অঞ্জয় এলে তোমাকে ডেকে দেবো।’

সময় বিলম্ব না করে আনজুমা নজর লুকিয়ে দৌড়ে চলে যায়। আরভীক তৎক্ষণাৎ চেয়ার ঘুরিয়ে আনজুমার যাওয়ার দিকে দৃষ্টি ফেলে। আজ তার দৃষ্টির মধ্যে অসহায়ত্ব, কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনা ফুটে উঠেছে। এ কাছে পাওয়ার বাসনা শরীরের চাহিদা হিসেবে নয়। বরং মনের প্রশান্তি লাভের বাসনা। দহনের ন্যায় তপ্ত শ্বাস ছেড়ে কানে এটেঁ রাখা ব্লুটুথের বাটনে প্রেস করে। কল গেল অঞ্জয়ের ফোনে।
সে তখন সবেই অফিসে প্রবেশ করেছে। লিফ্টে যেয়ে দাঁড়াতেই কল পায় বসের। ফোনটা তড়িঘড়ি কানে ধরে বলে,

‘সালাম বস আমি আসছি এখনি।’

নিসাড়বদ্ধ ভাবে কল কাট করে দেয় আরভীক। অঞ্জয়ের কাছে খটকা লাগে। তার বস কখনো দু’এক লাইন না বলে কল কাটে না। আজ অকথ্যভাবে কল কেটে দিল। অঞ্জয় লিফ্টের পাঁচ নং বাটন প্রেস করে।

১৫.
বেসিনের সামনে অনড়,স্থীর হয়ে অশ্রুসিক্তে ব্যস্ত আনজুমা। কষ্ট,ব্যথাহীন অশ্রু ঝরছে। যে অশ্রুের কারণ অতীত।
একটি ছবি হাজার শব্দের মূল্যবান,তবে একটি স্মৃতি অমূল্য রত্ন। অতীত নিয়ে সবসময় পড়ে থাকলে এক চোখ অন্ধ, অতীত ভুলে এগিয়ে গেলে দুই চোখই অন্ধ। তাই হয়তো জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এসে হলেও অতীত ঘাঁটতে হয়। কই স্মৃতি রয়ে গেছে, বিয়ের পর পর সন্তানসম্ভাবনা, বয়স পনেরো হতে না হতেই স্বামী হারা, পড়াশুনার পরিণতি করুণ হলে সংসার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া ইত্যাদি ইত্যাদি জীবনের ধাপ পার করতে হয়েছে। কত তিক্ত কথা শুনেছে, যখন পুলিশের বউ ছিল তখন সকলের মিষ্টিমধুর কথার যেন শেষ ছিল না। যখন স্বামীহীন হলো তখন লাঞ্ছনা, কামুকতার শিকার অব্দি হতে হলো। তবে আল্লাহর রক্ষার্থে মোকাবেলা করেছে সে। বাচ্চা সামলে, তিক্ত, লালসার নজর থেকে লুকিয়ে ফিরেছে।

‘ম্যাম আপনি কি আনজুমা!’

কোনো মেয়েলী কণ্ঠ কর্ণপাত হতেই আনজুমা চোখ খুলে পিছু ঘুরে। এতক্ষণ যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বুজে অতীতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করছিল। মুখে বার দুয়েক পানি ছিটিয়ে বলে,

‘জ্বি আমি।’

‘নাইস নেইম আপনাকে আরভীক স্যার তার কেবিনে ডাকছে।’

মাথা নেড়ে সায় দিল আনজুমা। মেয়েটি চলে গেলে হিজাব খুলে মাথার চুল ঠিকঠাক করে পুনরায় হিজাব আঁটকে নেয়। আবাইয়া টান টান করে ভাঁজকৃত জায়গা ঢেকে দিয়ে বের হলো। আরভীক এর কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে প্রবেশ করে। আনজুমাকে দেখে হাসি ফুটে উঠে আরভীক এর ঠোঁটের কোণায়। সেই সঙ্গে দুষ্টুমি চিন্তাধারা। তার টেবিলে অঞ্জয় নাস্তা রেখেছে। সে দাঁড়িয়ে আছে বসের চেয়ারের পাশে। আরভীক হেহেহে দাঁত কেলিয়ে হেসে দেয়। আনজুমা তার হাসির কারণ বুঝল না। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল।

‘হেই প্রিটিগার্ল কাম কাম গিভ মি এ পাপ্পি হাগ ফাস্ট!’

নির্লজ্জপূর্ণ কথা শুনে কান গরম হয়ে গেল আনজুমার। কিঞ্চিৎ পূর্বেও যে মনখারাপী কাজ করছিল তার হৃদয়ে সেটা উবে গেল। বরং এ মুহুর্তে সে ঠোঁট কামড়ে শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে আরভীক এর দিকে। অঞ্জয় গোল গোল চোখ করে তার বসের মতিগতি বোঝার চেষ্টা করে। বুঝবে না তাও ব্যর্থ চেষ্টা করে যদি জয়ী হয় তাহলে বিজয়ের খাতায় তার নাম লিখাবে বলে ভেবে রাখে। আনজুমা কাঠিন্যতা বজায় রেখে কর্কশ কণ্ঠে বলে,

‘আর ইউ কল মি টু লিসেন ইউর শামেলেস টকিং!’

‘অভিয়াসলি নট ডেয়ার হেহে।’

আনজুমা সেই গম্ভীর চোখে চেয়ে রইল। যা দেখে আরভীক ঠোঁট পাকিঁয়ে বলে,

‘তোমার জম্মের পর মনে হয় তোমার খিটখিটে মা খেজুরের রস খাওয়াতে ভুলে গেছে। খাওয়ালে আমার মত রসকষ নিয়ে কথা বলতে।’

‘কেনো ডেকেছেন!’

‘আমার সাথে ডেটে যেতে, যাবে কি!’

অধীর আগ্রহদীপ্ত চোখে সটান হয়ে বসে বলে আরভীক। অঞ্জয় বেচারা নিরহ মানুষের মত দাঁড়িয়ে রইল। বিদ্রুপের হাসি দেয় আনজুমা। ব্যঙ্গত্মাক সুরে বলে,

‘আইম নট ইন্টারেস্টড ইন ইউ।’

ব্যস কথাটি শুনে বুকের উপর বার-দুয়েক জোরালো আঘাত করার অভিনয় করে উঠে আরভীক। মুখটা পেঁচার মত করে বলে,

‘আজ কেউ পাত্তা দিলে আনম্যারেড থাকতাম না।’

চোখ ঘুরিয়ে কপাল চুলকে দৃষ্টি এদিক ওদিক করে আনজুমা। অঞ্জয় তাদের কথার মাঝখানে থার্ড পার্সন হতে না চেয়েও কাজের পক্ষ হয়ে বলে,

‘স্যার আপনার কানাডার ফ্লাইট মিস হয়ে আজ তিনদিন হয়ে গেছে।’

‘ভালো হয়ছে।’

তিক্ষ্ম ঝাঁঝালো কণ্ঠে তার দিকে তাকিয়ে বলে আরভীক। অঞ্জয় নিশ্চুপ হয়ে গেল। সে বুঝছে তার বস এ ব্যাপারে পূর্বনিশ্চিত! সেও বা কি করবে কাজের চাপে জিজ্ঞেস করাই তার দায়িত্ব। দুঃখীভরা শ্বাস নিয়ে তাকিয়ে রইল। আনজুমা সময় নষ্ট না করে সত্বর কণ্ঠে বলে,

‘আপনি কিসের জন্য ডেকেছেন সেটা যদি বলতেন তাহলে অনেক উপকার হতো।’

‘পাপ্পি হাগ দিলে….।’

দুষ্টুমিভরা নজরে তাকিয়ে আনজুমার দিকে চোখ টিপ দেয়। সে বেচারী তেঁতে উঠে নাস্তার প্লেটে থাকা নুডলসের বাটি থেকে এক চামচ নিয়ে আরভীক এর গালে ঢুকিয়ে দেয়। সে নিবিড়ভাবে স্পর্শ অনুভব করতে থেকে তৃপ্তি করে চাবাতে লাগে। অঞ্জয়ের দিকে ইশারা করে বলে,

‘অঞ্জয় তোমাকে কেবিন ও কাজের রুলস বুঝিয়ে দেবে। তবে তার আগে একটা পেপারে সাইন লাগবে।’

কাঙ্ক্ষিত কথাটি শুনে আনজুমা মাথা নেড়ে সায় দিল। অঞ্জয় তৎক্ষণাৎ কাগজটি তার সামনে রাখে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)সে কাগজটি নিয়ে রুলসে চোখ বুলিয়ে নেয়। কিন্তু শেষ রুল দেখে চমকে গেল। মুখ হা হয়ে যায় তার। চেঁচিয়ে বলে উঠে।

‘ওয়াট’স দিজ মিস্টার ফাঁটা থুরি ফাওয়াজ! শেষ রুল আপনার কথা মানতে বাধ্য। কেনো! না মানলে কি মহাভারত অতিষ্ঠ হয়ে যাবে।’

‘আইম বস এন্ড ইউ আর সেলার এমপ্লয়। দ্যাটস ওয়াই।’

‘কেন আপনি কি আমাকে চাকরাণী ভাবছেন। যেটা বলবেন সেটা শুনব!’

‘পিএ হলে যেমন চাকরাণী হলেও তেমনি আমার কথা শুনতে হবে। বাট আই সাজেস্ট ইউ টু হেভ মাই হাউজমেইড। যখন তখন সামনে দেখতে পারব আর ইভটিজিং করব।’

বেশরমি কথাগুলো শুনে আনজুমা অসহ্য হয়ে একদমে জ্ঞান হারিয়ে সোফার উপর পড়ে যায়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here