নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব -০৯

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৯

‘মিস্টার ফাওয়াজ কংগ্রাচুলেশন ইউর ওয়াইফ ইজ প্রেগন্যান্ট।’

আরভীক হাতে স্ফট ড্রিংক নিয়ে করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিল। ডক্টরের কথা শুনে তার হাতের গ্লাসটি পড়ে গেল। বোবা,বাকরুদ্ধ হয়ে গেল যেন। বাসর ছাড়াই বাচ্চা এসে গেল! এ আবার কেমনে সম্ভব! যতদূর মনে হলো সে তো এখনো একরাতও কাটাতে পারল না। তার কানে এখন একটা গান বেজে চলেছে,
‘জোরকা ঝাটকা হায় জোরোসে লাগা হে লাগা। ‘
তেমনি গানের তালে বুকের উপর বাঁহাত রেখে হ্যাবলার মত মুখ করে। চোখ বুজানো আনজুমার দিকে তাকায়। ডক্টর দাঁত কেলিয়ে বলে,

‘ম্যাম কে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েছি। একঘণ্টা পরে জাগবে।’

অঞ্জয় এসেছিল আরভীক কে বলতে যে তার বাবা অথাৎ আরাজ সাহেব বাসায় ডেকেছে। তথাপি সে নিজেই সারপ্রাইজড! বস, হিজ ওয়াইফ এন্ড হিজ চাইল্ড। কখন,কেমনে বিয়ে হলো, বাচ্চাও বা কেমনে এলো। শত’খানেক প্রশ্ন জমা হলো তার ব্রেনে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
আহাম্মকের মত চাহনী নিয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘স্যার বড় স্যারকে খুশির খবরটা দেওয়া উচিৎ কি বলেন!’

খুশির চটে চকচকে উঠে অঞ্জয়ের চোখযুগল। যা দেখে রীতিমত বিরক্তিতে আরভীক এর মুখ থেকে ‘চ’ উচ্চারিত হলো। যা কর্ণপাত হতেই চুপছে গেল অঞ্জয়ের মুখখানি। ডক্টর ইতস্ততঃ বোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আরভীক না বলছে যেতে, না দিচ্ছে পেমেন্ট। খালি হাতে এসে ছিল, খালি হাতেই কি তবে ফিরতে হবে! ভেবেই ডক্টরের মেজাজ ঠুঙ্গে গেল। কিন্তু বহিঃপ্রকাশ করার সাধ্য নেই। আরভীক ভাঙ্গা গ্লাসের পাশ কেটে আনজুমার নিকট গেল। কি নিষ্পাপ মুখ! যেখানে মায়ার শেষ নেই। তার মাথায় হাত বুলিয়ে ভাবান্তর হলো। তার আদর্শ ধারণাতীত আনজুমা কখনোই কারো সঙ্গে শুতে পারে না। কেননা মেয়েটি নিজের আদর্শ চরিত্রের কাছে কঠোর প্রখর। যা সে ক্লাবে বুঝে ছিল। এমন মেয়েটির হঠাৎ প্রেগন্যান্ট হওয়া। বিষয়টা ভাবাচ্ছে তাকে। যদি হয় তাহলে কেউ ইচ্ছেকৃত সুযোগ লুপে নিয়েছে, না হয় মেয়েটির অজ্ঞানে তার সম্মানহানি করেছে। এতে তো সামনে তার বিপদ । বিয়ে ছাড়া এক মেয়ে প্রেগন্যান্ট হলে সমাজের জনগণ তাদের অপমানের বর্ষণে মেয়েটিকে পথভ্রষ্ট করে দিবে। না, তাকে তার পদক্ষেপ নিতে হবে। চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল আরভীক এর। বিছানা হতে উঠে দাঁড়ায়। অঞ্জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘অফিসের পেপার’স নিয়ে আয়।’

বুঝে গেল অঞ্জয় কোন কাগজের কথা তার বস বলছে। ফলে সে রুম থেকে বেরিয়ে বসের টেবিলের কাছে আসে। এতক্ষণ তারা বসের বিশ্রাম রুমে ছিল। যেখানে আরভীক কাজ শেষে বিশ্রাম নিতে পারে। আনজুমা অজ্ঞান হওয়ায় ব্যকুল হয়ে উঠে ছিল আরভীক। সে ভাবেনি তার নির্লজ্জ কথার তীব্রতায় মেয়েটি হুঁশই হারিয়ে ফেলবে। সোফার কাছে এসে আনজুমার মুখে বার-দুয়েক পানি ছিটিয়ে দেয়। কিন্তু সাড়া পেল না, নিঃশ্বাস ক্রমান্বয়ে মন্থরগতিতে চলছিল। অঞ্জয়কে তখনি ডক্টর নিয়ে আসার আদেশ দেয়। অঞ্জয় এক মাইল দূরে থাকা এক মেডিক্যালে গিয়ে খোঁজ নিল এমারজেন্সি কেসে কোনো ডক্টর ফ্রি আছে কিনা! নার্স কম্পিউটার চেক করে ডক্টরদের মোটিভ দেখে। বিশ জন ডক্টরের মধ্যে বারো জন ওটি, তিনজন অনুপস্থিত ও দুজন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং তিনজন রেস্টিং টাইমে আছে। অঞ্জয় বিশ্রাম নেওয়া তিনজনের মধ্যে যেকোনো একজনের সঙ্গে কনটাক্ট করতে বলে। নার্স ভালো বুঝে বিশ্রাম নেওয়া তিনজনের মধ্যে শেষজনকে বেছে নেয়। কেননা তিনি অভিজ্ঞ প্রতিটা বিষয়ে। ডক্টরকে রিসেপশন থেকে ফোন করে জানিয়ে দিল অঞ্জয়ের এমারজেন্সি কেসের ব্যাপারটা। তিনি আজ্ঞা দিল যে সে আসছে। পাঁচমিনিটের মাঝে হাজির হলো ঐ ডক্টর। অঞ্জয় দিগিদ্বিক না ভেবে ডক্টরকে টেনেটুনে নিয়ে এলো। ডক্টর প্রথমে ভয় পেলেও, পরে পরিস্থিতি বুঝতে পেরে চুপ থাকে। আরভীক কে দেখে কুশল বিনিময় করে। সে আনজুমার সিচুয়েশন জানায় ডক্টরকে। ডক্টর শুনে ‘দেখছি’ বলে চেকআপে ব্যস্ত হলো।

‘অঞ্জয় আর কতক্ষণ লাগবে!’

ধ্যান ফিরে তার। মুহুর্তেই ভাবনায় হারিয়ে গিয়ে ছিল। বস তোড়জোড় করায় কাগজগুলো নিয়ে তেড়ে এলো রুমে। আরভীককে কাগজগুলো এগিয়ে দেয়। সে নিয়ে ঘুমন্ত আনজুমার পাশে বসে। কাগজগুলো কোলের উপর শায়িত করে ড্রয়ার থেকে নীল কালি বের করে। নীল কালি আনজুমার তর্জনী আঙুলে ঘনভাবে লেপ্টে দেয়। কাগজ এগিয়ে এনে সই করা স্থানে আনজুমার নীল কালি দিয়ে লেপ্টে থাকা আঙুলের সীল লাগিয়ে দেয়। চলচাতুরী দৃশ্য দেখে হা হয়ে গেল অঞ্জয়। ডক্টর দর্শকের মত চেয়ে রইল। সীল বসাতে পেরে বিজয়ের হাসি দিল আরভীক। কাগজটি অঞ্জয়কে দিয়ে দুহাত পকেটে গুজে নেই। বাঁকা হেসে বলে,

‘প্রসেসিং স্টার্ট বেবি।’

পিটপিটে চোখে কাগজের সইয়ের দিকে তাকায় অঞ্জয়। ঢোক গিলে ডক্টরকে নিয়ে রুম থেকে প্রস্থান করে। আরভীক মায়াবতীর দিকে চেয়ে দহনকৃত শ্বাস ছাড়ে। কি ভেবে যেন রুমের দরজা আঁটকে বেরিয়ে যায়।

১৬.
‘মামা কস কি তুই আর্কিটেক্ট আরভীক ফাওয়াজরে বোকা বানালি!’

‘হ মামা বোকা বানালেও কি হবে পকেট গরম করতে পারি নাই। ঐ সাহেব বিনা খরচে চিকিৎসা করায় পেমেন্ট ছাড়াই বিদায় করে দিল।’

‘মামা তুই তো ভুল চিকিৎসা দিলি!’

‘কই ওরা দেখতে জামাই-বউ। বউ জ্ঞান হারালে নিশ্চিত প্রেগন্যান্টই হবে। তাই তো মেশিন দিয়ে চেকআপের ভান করে সরাসরি বলে দিসি।’

দুজন পাগল ছেলে বসে আড্ডা দিয়ে কথাগুলো বলছিল। তখন ডক্টর ডেভিড পাগল দুটোকে ওষুধ খাওয়ানোর জন্য আসে। এসে তাদের কথাগুলো শুনে চমকে গেল। আমেরিকান বয়স্ক পুরুষ ডক্টর ডেভিড। মা দেশী হওয়ায় বাংলা ভাষা বুঝা তার কাছে কোনো ব্যাপারই না। যে বেক্কলমার্কা কাজটা করেছে তার নাম সন্দেশ!
সন্দেশ পাগলার কথা শুনে তিনি রেগে জোর করে প্রথমে ওষুধ খাওয়ায়। দুজন ভয়ে তুষ্ট হয়ে গেল ডক্টরকে দেখে। ওষুধ হজম হলে ডক্টর ডেভিড মুখ চেপে রাগমিশ্রিত গলায় সন্দেশকে হুং’কার দিয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘তুই কাকে বোকা বানিয়েছিস ! কোন সময় এসব করলি বল। না বললে আজ তোকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে মাথা হ্যাং করে দেবো।’

সন্দেশ পাগলটা ইনিয়ে বিনিয়ে হাত কচলাতে থেকে বলে,

‘ডক্টর সাহেব আপনি যখন আমারে কেবিনে রেখে বাহিরে গেছিলেন। তখন নার্স ফোন দিছিল। ফোন আমি ধরে শুনছি আরভীক নামের কে জানি এমারজেন্সি ডাকছে। আপনি ছিলেন না। তাই মজা করতে আপনার এপ্রোন পরে, আপনার রেখে যাওয়া কান দিয়ে চেক করে যে ওই মেশিনটা আর ঘুমের ইঞ্জেকশন ব্যাগে নিয়ে গেছিলাম।’

ডক্টর হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল। বিশাল বড় ভুল হয়ে গেল তার দ্বারা। পাগলকে বন্দি না করে যাওয়া উচিৎ হয়নি তার। তিনি কেনো যে এই পাগলকে ছেড়ে গেছিল। এ নিয়ে পস্তাচ্ছে।
ভালো মানবিকতার রুপ সেজে অভিনয় করতে পারে সন্দেশ। নিশ্চয় সন্দেশের অভিনয় দেখে কারর্স আকিটেক্ট আরভীক বিশ্বাস করে নিয়ে ছিল। না হলে এই পাগল জিন্দা ফিরতো না। শীট! বলে জোরালো আঘাত করে মেঝের উপর ডক্টর ডেভিড। নার্সকে কাঠিন্য গলায় বলে,

‘এই সন্দেশকে দু-তিনেক ঘা লাগিয়ে দিতে বলেন গার্ডকে।’

পাগল সন্দেশ ভয়ে ‘না না প্লিজ’ বলে অনুরোধ করছিল। ডক্টর ডেভিড নম্ন হৃদয়ের হওয়ায়। শাস্তিটা কমিয়ে দিল। শুধু এক ঘা দিয়ে একবেলা খাবার কমিয়ে দিতে বলে চলে যায়। সন্দেশ এক ঘা খেয়ে কেঁদেকুটে ঘুমিয়ে যায়। ডক্টর ডেভিড সিসিটিভি ফুটেজ দেখে হতাশার ভঙ্গি প্রকাশ করে।
মনস্থীর করে ভাবে।

‘কাল অবশ্যই মিস্টার আরভীক এর সঙ্গে দেখা করে ব্যাপারটা জানাতে হবে। না হলে কোথার থেকে কথা কোথায় পৌঁছে যায় ঠিকঠিকানা নেই। এর চেয়ে বড় কথা সন্দেশ ঘুমের যে ইঞ্জেকশনটা দিছে। সেটার ডোজ শেষ হতে সাতঘণ্টা লাগবে। উফফ ড্যামিট !’

_____

মাথা ঝিমঝিম করে উঠে বসে আনজুমা। চোখ খুলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে চোখ খুলতে নিলেই চোখ ফেটে রক্ত বেরিয়ে পড়বে। পড়বেই না বা কেনো! সন্দেশ পাগলটা কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ যে দিয়েছে। নিভু নিভু চোখে ঝিমুনি দিতে থেকে দেওয়ালের দিকে তাকায়। ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা বাজছে। এ দেখেই তার অন্তআত্মা কেঁপে উঠল। আশফি বাসায় একা। মাথায় শুধু এ কথাই বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। কখন, কি হয়েছিল মনেই পড়ছে না তার। বিধেয় ভাবনা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তবে মাথায় তীব্র ডোজের প্রভাবে ঝিমুনি যেন সরছেই না। মাথা চেপে ধরে রাস্তা খোঁজছে। কিন্তু বিস্মিত চোখে পুরু দিকে নজর বুলিয়ে
আনমনে বলে,

‘আ আমি অফ অফিসে ছিলাম। এ এ কার বা বাসায় এলাম! উফ মাথা খুব ব্যথা করছে।’

মাথা চেপে ধরে বসে পড়ে। চোখ খুলার চেষ্টা করেও লাভ হলো না আনজুমার। রুমের বাহিরে মেঝেতে পড়ে ঘুমিয়ে গেল। আরভীক আশফিকে কোলে নিয়ে তার বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখায়। আশফির কাছে আরভীক এর সঙ্গতা মায়াজালের মত যথোচিত মনে হচ্ছে। সে তার কাঁধে মাথা রেখে সরু চোখে দেখছে। আশফি দুষ্টু স্বভাবের হলেও তার প্রতি অদ্ভুত বন্ধন অনুভব করে আরভীক। কিসের এই অনুভূতি তার নাম অজানা। অথচ সে কোনো সময় কারো বাচ্চাকে নিয়ে উম্মাদের মত খেলেছে, হেসেছে বলে মনে পড়ছে না তার। সারাদিন ডিজাইনিং গাড়ির আকাঁবুকিঁতেই সময় কেটেছে।
আশফির খিদে লাগায় সে ‘মাম্মা মাম্মা’ বলে কেঁদে ফেলে। আরভীক পড়ল বিপাকে! কি সাংঘাতিক কান্না! একদম মায়ের স্বভাব পেল যেন। আরভীক হেলেদুলে কান্না থামানোর চেষ্টা করে। না আশফি কেঁদেই চলেছে।
সে বুঝেছে কেনো আশফি এভাবে মরা কান্না দিচ্ছে। তবু সে নিরুপায়। তার মা এখনো অব্দি জাগেনি।
আনজুমার বাসায় গিয়ে বিউটিখালা কে পায়। তিনি আশফির সঙ্গে খেলছিল। আরভীককে প্রথমে না চিনলেও কুশলের বেশভূষায় পরিচয় পেল। সে তাকে আশ্বস্ত করে আশফিকে হেফাজতে মায়ের কাছে নিয়ে যাবে বলে। তিনি কুটিলতা করেনি। মুচকি হেসে আশফিকে রেডি করে আরভীকের কোলে দেয়। সময় নষ্ট না করে আশফিকে তার নিজের বাসায় নিয়ে আসে। আরাজ সাহেব ছোট নাতী রুপে আশফিকে দেখে খুশিতে ঝকমকিয়ে উঠে। আশফিকে কোলে নিয়ে চকলেট খাওয়ায়, ফিছ হাউজ এর সামনে নিয়ে পানির মধ্যে ছোট ছোট মাছ দেখায়। আশফি খিলখিলিয়ে হেসে খেলতে থাকে আরাজ সাহেবের সঙ্গে।
আরভীক আশফিকে নিয়ে এসে ভাবল তার মাকেও নিয়ে আসা যাক! মা-ছেলে মিলে বাসায় মাতলামি করলে মন্দ হয় না।
অঞ্জয়কে আদেশ করে অফিসের সিডিউলগুলো শেষ করে নিতে। আরভীক গিয়ে বিশ্রাম রুমে আনজুমাকে তখনো ঘুমিয়ে থাকতে দেখে হাসিখুশি মুখটা অশান্ত হলো। সন্তপর্ণে কোলে নিয়ে কেবিন থেকে বের হয়। অফিসের এমপ্লয়রা দেখে হা করে তাকায়। অঞ্জয় বসের দিকে এক পলক দেখে কড়া চোখের ঝলসে যাওয়া নজর দেয় সবার দিকে। অঞ্জয়ের নজর দেখে ভীতিগ্রস্থ হয়ে সকলে কাজে মন দিল। তারা তাদের কুৎসিত ধারণা মাটি চেপে দিয়ে ভাবে, তাদের বস মানবিক দয়ালু। নিশ্চয় মেয়েটি বিপদে জ্ঞান হারিয়েছে দেখে তিনি মেডিক্যালে নিয়ে যাচ্ছে।
আশফির ভ্যাঁ ভ্যাঁ কান্না দীর্ঘ হলো। আরভীক এর কাঁধ ঝাঁঝালো ভাবে আকঁড়ে ধরে বলে,

‘মাম্মা মাম্মা খিদে লাগছে। মাম্মা কই আঙ্কেল ওয়েএএ।’

বেচারা আরভীক সীমান্ত না পেয়ে তার মায়ের কাছে নিয়ে গেল। রুমের সন্নিকটে এসে সে নিজেই থমকে গেল। মেঝেতে হুঁশহীন আনজুমাকে পড়ে থাকতে দেখে। উচ্চস্বরে ‘জুমা’ বলে তার ঘনিষ্ঠ হলো। আশফি মাকে দেখে তার গালে চুমু একেঁ দিতে থেকে বলে,

‘মাম্মা চোখ খোলো, আমি আসছি।’

মাকে চোখ খুলতে না দেখে উম্মাদ হয়ে উঠে আশফি। আরভীক মা-ছেলের বেগতিক দশা দেখে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)শান্ত মনে ভেবেচিন্তে আশফির গাল হাতের আদলে নিয়ে বলে,

‘বাবা আমার কাঁধে উঠে শক্ত করে ধরো। তোমার মাম্মাকে এখনি জাগিয়ে দেব।’

অবুঝ চোখে আশফি মাথা নেড়ে আরভীক এর পিঠের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। গলা অব্দি ছোট হাত এনে শক্ত করে চেপে ধরে। আরভীক আনজুমাকে দুহাতে বাহুডোরে আবদ্ধ করে রুমে এনে বিছানায় শুয়ে দেয়। ওজন কম তাই ভার নেই মেয়েটার শরীরে। কাজকর্মে শরীরের দিকে ধ্যান নেই তার। আশফি কাঁধ থেকে নেমে মায়ের বুকের উপর শুয়ে পড়ে। যা দেখে আরভীক চমৎকার লাগল। আবাইয়া পরিহিত অবস্থায় মেয়েটি ঘেমে একাকার। তবু সে কাউকে খুলার আদেশ দিচ্ছে না। এক মেয়ে পর্দায় আবৃত সেহেতু সেও অনাবৃত করে মেয়েটির রুপে উম্মাদী উত্তেজক হতে ইচ্ছুক পোষণ করে না। মা-ছেলের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে। রুমের বাহির থেকে ছেলের অস্থিরচিত্ত মনভাব, ব্যকুল ভাবে আনজুমা মেয়েটির নাম শর্ট করে ডেকে উঠা, আনমনে মেয়েটির কাছে যাওয়ার তীব্র বাসনা দেখতে পাচ্ছে আরাজ সাহেব। তিনি দরজাটা স্বল্প ভিড়িয়ে ছেলের লক্ষণ খেয়াল করছিল। লক্ষণ ভালো কি খারাপ তা অনিশ্চিত তার কাছে। তিনি গম্ভীর মুখে দরজার বাহির থেকে সরে গেল। নিজের রুমে গিয়ে বিছানায় বসে ভাবান্তর হলো।

১৭.
দুদিন পর ডক্টর ডেভিড ওটির ব্যস্ততায় পড়ে আরভীক এর সঙ্গে মিটিং করতে পারেনি। তবে তিনি প্রতিবার ব্রেনে এটেঁ রেখেছিল আরভীক এর নাম। ওটি থেকে বেরিয়ে ক্লান্ত সুরে নার্সকে জিজ্ঞেস করে।

‘আজ আর আছে কি!’

‘নো স্যার ইউ ক্যান লিভ নাউ।’

ব্যস ডক্টর ডেভিড হাতে সুযোগ পেয়ে মেডিক্যাল থেকে বেরিয়ে গেল। গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে বলে,

‘শুনো আরভীক ফাওয়াজ এর অফিসে চলো।’

ড্রাইভার এ মানুষকে চেনে। পত্রপত্রিকায় তার সুখ্যাত ছড়িয়ে আছে। ফলে প্রশ্নহীন মাথা নেড়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়।

_____

নিজ কেবিনের মধ্যে বসে রাগে ফুলছে আনজুমা। সে বুঝছে না এই আরভীক এর কিসের এত আদিখ্যেতা তার উপর! পিছু যেন ছাড়ছেই না। চুইংগামের চেয়েও ই’ত’র,কষাটে রুপ নিয়ে লেপ্টে আছে। নড়বড়ে হলেই যেন হুটহাট কোলে উঠানো,দ্রুত হাঁটতে বারণ করা, ভারী জিনিস বহনে নিষেধাজ্ঞা। যেসব বারণ প্রেগন্যান্টের অবস্থায় করে, সেসব বারণ আরভীক তাকে আনপ্রেগন্যান্ট অবস্থায় করছে। তার চেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এগুলো নিতান্ত বাঁদরামি লাগছে আনজুমার! ঐদিনের হুঁশ হারানোর পর থেকেই মাত্রাতিরিক্ত কেয়ারিং হয়ে উঠেছে ঐ ফাঁটাবাঁশ রসকষা পুরুষ।
বিরক্তিতে তার মুখ থেকে ‘ন্যাকাচু’ ফসকে বের হতে চাইছে। তবুও গা’লি দিতে তার মনে বাঁধছে। ফলে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে টেবিলে থাকা কাগজে চোখ বুলিয়ে গেল। কম্পিউটারে আনজুমার বিরক্তিসূচক চেহারাটির উপর ঘোরলাগা নজরে তাকিয়ে থাকে আরভীক । ঠোঁট পাঁকিয়ে হেসে বলে,

‘শাকচুন্নির মত মুখ করে ফেলছে। আমাকে তো ডিটারজেন্ট ছাড়াই ধুয়ে মুছে দিচ্ছে।’

অঞ্জয় ঝিমুচ্ছে। পুরু একদিন মোটেও ঘুম হয়নি তার। যখন থেকে দু-সংবাদ শুনেছে। তখন থেকে তার রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। বসকে সংবাদটি দিতেও তার বুক ধড়ফড় করছে। যদি রেগে ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করে দেয়!
তাহলে বেচারা সিঙ্গেল থেকে হবু বউয়ের মুখটাও না দেখে কবরে শায়িত হবে। ঢুলুঢুলু হয়ে বসের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে। সাহসিকতা প্রবল করে চোখ বুজে বসকে ডাক দেয়।

‘স্যার…।’

ভাবলেশনহীন নজরে তাকায় আরভীক। যে শান্ত চাহনীতেই শিউরে উঠে অঞ্জয়। আরভীক তার কথা না শুনে সে নিজেই বলে,

‘শোন কানাডার নেক্সট ফ্লাইট কবে সেটা জেনে আমাকে জানাস। আর হে এখন চল আমার গেস্ট দুটোকে দেখে আসি। আজ কতদিন হলো টুনাটুনির সাংসারিক চেহারা দেখছি না। আহামরি প্রেম তাদের! একে অপরকে ছেড়ে বাঁচতেও পারছিল না। একদমে হাত ধরে পালিয়ে গেছিল। ইতিহাসের অমর প্রেম বলে কথা।’

মাথা নেড়ে অসাড়তা পালন করে কেবিন থেকে বের হলো অঞ্জয়। গাড়ির ইঞ্চিন চালু করে কপাল চাপড়ে বলে,

‘কেন যে নাম পরিচয় না জেনে ডক্টর নিয়ে আনছিলাম। এখন স্যার যে হারে কেয়ার করছে ম্যাডামের। যখন শুনবে ইহা মিথ্যে কথা! তখন আমার উপর কিরুপ কেয়ার দেখায় সেটা শুধু তুমিই জানো আল্লাহ্।’

‘ঐ বলদ কি বিড়বিড় করছিস গাড়ি ঘুরা। সেই কবে থেকে এসে বসে আছি।’

থতমত খেল অঞ্জয়। গাড়ি ঘুরিয়ে ফার্মহাউজের দিকে নিল। আনজুমার বোরিং লাগছিল। ফলে সে ফোন বের করে আশফিকে ভিডিও কল দেয়। ছোট আশফিকে আরভীক মোবাইল কিনে দিয়েছে। সারাদিন এখন মোবাইলে ভিডিও,গেমস নিয়ে পড়ে থাকে ছেলেটা। কল এলে বড় ছেলের মত রিসিভ করে ‘হ্যালু’ বলে। আশফি ভিডিও কল দেখে রিসিভ করে। মাকে দেখতে পেয়ে খিলখিলানো হাসি উপহার দেয়। আনজুমাও বিনিময়ে হেসে বলে,

‘পাপ্পা কি করে এখন হে!’

‘মাম্মা আমি কেক খাচ্ছি।’

‘সুন্দর করে খাও। গায়ে-মুখে লাগিয়ে আঁটা করবে না কিন্তু।’

‘ওকে মাম্মা।’

‘ওকে পাপ্পা বায়।’

কল কেটে ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখে। চোখ তুলে আরভীক এর কেবিনের দিকে তাকায়। তাকে না দেখে চোখ এদিক ওদিক বুলিয়ে কোথাও না পেয়ে নিরলসতা অনুভব করে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) অনবরত পটরপটর করা মানুষটি কাছে না থাকলেও সমস্যা। সময়টা যেন কাটেই না।
একাকিত্বে দুরন্ত পুরুষের কথা ভাবছে সে। যা বুঝতে পেরে মাথা নেড়ে আপনমনে আওড়ায়।

‘তার মত রোগ পেল। ধুর আবুল কথা ভাবছি। কিন্তু ঐদিন কি হয়ে ছিল আমার সেটা এখনো জানতে পারছিনা। আরভীক বলেছিল দূর্বল হওয়ায় জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম। বলার পরও তো সে ব’দমা’য়ে’সীর মত মিটমিটিয়ে হাসি দিচ্ছিল। কেন দিচ্ছিল!’

রহস্য লাগছে এ ঘটনায়। মন বিচলিত হবার পূর্বেই কে যেন চিৎকার করে আরভীক এর নাম ধরে ডেকে কেবিনে প্রবেশ করে। আনজুমা চকিত দৃষ্টিতে পিছু ঘুরে। সে এসে ছিল আরভীক আছে কিনা দেখতে! এসেই ভাবনায় মতঁ হলো বুঝে তার নিজের উপর মেজাজ গরম হচ্ছে।

‘এই মেয়ে আরভীক কোথায়!’

উদ্বিগ্ন হয়ে আনজুমা আমতা আমতা করে বলে,

‘স্যার বেরিয়ে গেছে।’

‘ওয়াট! রা’স’কে’ল, ফ’….. কোথায় গেছে!’

‘আই ডোন্ট নো।’

‘কবে আসবে কিছু তো জানবে!’

‘নো ম্যাম স্যার বলে যায়নি কিছু। কিন্তু আপনি কে আমাকে বলুন আমি জানিয়ে দেব।’

‘হেই ছোটলোকের বাচ্চা তুই কি শুনবি হে! আইডিকার্ড দেখে তো এমপ্লয় লাগছে। এমপ্লয় এমপ্লয়ের মত থাক। মুখ বাড়িয়ে কথা বলতে আসবি না।’

অপমানে জর্জরিত হলো আনজুমার মন। তবুও দৃষ্টিনত না করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে মেয়েটিকে শুধায়।

‘ঐ ন্যাকামির ঢং বাহিরে দেখাবেন। এটা অফিস আপনার ঢং-ক্লাব না। ভাববেন না আমি ইনোসেন্ট। যদি লিমিট ক্রস করেন তাহলে আপনার ময়দামাখা মুখ থেতলে দেব বে’য়া’বী মাইয়া কোথাকার। এখনি বেরিয়ে যান এখান থেকে। না হয় স্যারের কেবিনে বিনা অনুমতি নিয়ে ঢুকার অভিযোগে মামলা দেব শ’ঠনামী মহিলা।’

মেয়েটির মেজাজ চওড়ে যায়। তবে অফিস বলে নিসাড়, ঝাঁঝালো চোখের দৃষ্টি নিয়ে আনজুমার দিয়ে কয়েক পলক দেখে বেরিয়ে যায়।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here