নেশাক্ত প্রণয়োণী পর্ব -২৪+২৫

#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৪

জাফর সাহেবকে বেধড়ক পি’ঠি’য়ে যাচ্ছে আরভীক। তার পিঠে প্লাস্টিকের বেল্টের সঙ্গে বেঁধে আছে ছোট আশফি। আয়েশে পচাঁ লোকের মা’ই’র খাওয়া দেখছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে। তখনো রক্তাক্ত হয়নি সে। শুধু লাল আভা ভেসে উঠেছে তার শরীরে। জাফরের চোয়ালে কোনো দাঁত অবশিষ্ট নেই। তার গালের মাংস পুরুপুরি ছন্নছাড়া করে দিয়েছে আরভীক। আশফি ভয়কে প্রশয় দেয়নি। নিশ্চুপে তার বাবাইয়ের কাঁধ শক্ত করে চেপে রেখেছে।
আনজুমা অঞ্জয়কে ঠুকা মেরে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তার। সে মুখ ঘুরিয়ে তার ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে খানিক ঝুঁকে! আনজুমা অসহায় গলায় শুধায়।

‘দেবরজী আমাকে তোমার খচ্চর বস কেন বেঁধে রাখল!’

‘কারণ আপনি ছাড় পেলেই স্যারের কাজে নাক গলাবেন।’

থতমত খেল আনজুমা। মনমতে বুদ্ধিমতীর কাজ করতে চেয়ে ছিল আরভীককে থামিয়ে। তবুও যে সরল পুরুষকে চারবছর পূর্বে বিনা অপরাধে মা’রা হয়ে ছিল! তার অন্তরালে বসবাসরত হিংস্র পশুকে নাড়িয়ে দিয়েছে জাফর ও তার সাথী লিয়াকত। আজ কোনোরকম উপপ্রয়োগ বা সরঞ্জাম ব্যবহার করেনি আরভীক। বরঞ্চ জাফর ও লিয়াকত যেরুপে তার ম’র’ণ নিধারণ করে ছিল, সেও তাদের অতীব পূর্বকথিতে ম’র’ণ দেবে। তফাৎ হবে আরভীক অথাৎ সুয়াইবকে নদীর মধ্যে ফেলা হয়ে ছিল। কিন্তু তাদেরকে ফেলা হবে কিং অফ কোবরার মুখে! এই কোবরা প্রাণীর হিংস্রতা পূর্ব পরিচিত। ক্ষুধার্ত কোবরা আপনজনও মানে না। সে তদারককে মান্য করে শুধু খাবার পাওয়ার লোভে। বিধেয় কোবরা প্রাণীকে পরিকল্পনায় এনেছিল সায়াজ! আরভীক যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার পূর্বে সায়াজকে আজ্ঞা করে।

‘ডুড ভয়ানক প্রাণী লাগবে! যে মাংস,হাড্ডি চাবিয়ে খেয়ে হজম করতে পারে।’

সায়াজ তখন এক প্রাণীর নাম মুখে নেয়।

‘কিং অফ কোবরা !’

তার কথা শুনে অবাক চোখে তাকায় আরভীক। আশ্চর্যের বিষয় কোবরাকে দেশের মধ্যে আনা দুষ্কর! কেননা সুবিশাল দেহের অধিকারী কোবরাকে ধরে বেঁধে সামলানো কোনো একার মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। দশ-বারো ফিট লম্বা সাপ যে, যার দ্রুতপথ প্রায় আঠারো ফিট, যার বাইট পুরু চারশ-পাঁচশ মিলিগ্রাম ভেনোম। সে সাপের পরিধির পরিপক্কতা সামলানো দায়। তখন সায়াজ বুদ্ধি দেয় যে, ‘আমরা শত্রুদের এখানে নয় হংকং এ কোবরার কাছে নিয়ে মা’র’ব। কোনো কেসও হবে না, ফাইল করা তো দূরের কথা।’

সায়াজের কথা ভীষণ পছন্দের ঠেকে আরভীক এর কাছে। উদগ্রীবহীন মনে সরল হাসি দিয়ে চোখের ইশারায় সায় দেয়। বন্ধুর অনুমতি পেয়ে খোশমনে সেও তার হংকং পরিচিত এক সোশাল মিডিয়ার ফ্রেন্ডের কাছ থেকে সহায়তা নেয়। যেন সে তাদেরকে কোবরার নিকট নিয়ে যায়। এতে অপরপাশ্বের হংকং পরিচিত বন্ধু ইতস্ততঃ, ভীতিগ্রস্থ হয়। কারণ কোবরা কোনো স্বাভাবিক প্রাণী নয়। হংকং এর ভয়ানক প্রাণী। বলাবাহুল্য হংকং এর প্রতিটা ম্যাগাজিনে কোবরার বিলুপ্তের কথা ছড়িয়ে আছে। অথচ জঙ্গলে গেলে কোবার চিহ্ন,লেজের সার ঠিক বালি,ঘাসের মধ্যে পাওয়া যায়। বিনিময়ে জঙ্গলে খুব কমই ঘুরাঘুরি করে ট্যুরিস্টগণ। সায়াজ আশ্বস্ত করে কোবরার জন্য তারা উপহার এনেছে। ভক্ষক থেকে শান্ত প্রাণী বানিয়ে দেবে কোবরাকে। কথার আপেক্ষে রাজি না হয়ে পারেনি হংকং বন্ধু। সায়াজকে বলে, যখন সে আসবে তখন যেন তাকে ফোন করে জানায়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
সানন্দে ধারণামাফিক রাজির বিষয়টি আরভীকদের জানায় সায়াজ।

৪৫.
আশফিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে চলছে আরভীক। যেন সে কোনো ঘোরে আছে। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আনজুমা তার নিকটস্থ হয়ে আড়চোখে অঞ্জয়দের দিকে তাকায়। ইতিপূর্বে সে জেনেছে, তার স্বামী মা’রা যায়নি। বরং আরভীক রুপে যে পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। সেই কিনা তার সুয়াইব। ফাহাদ জাফরদের বেহাল দশা হওয়ায় তাদের নিয়ে রাতের মধ্যে হংকং যাওয়ার ফায়সালা করে। লিয়াকতকে পরপর ছু’ড়ি দিয়ে বুকের মধ্যে মে’রে খন্ড খন্ড করেছে আরভীক। যার কারণে বিবর্ষ অবস্থা হয়েছে তার। অঞ্জয় আনজুমার কাছে এসে শুধু বলেছে,

‘ম্যাম স্যারই আপনার সব। চারবছর আগে সুয়াইব ভাইয়ের মৃত্যু হয়নি। এই যে আমাদের আরভীক স্যারই সুয়াইব ভাইয়া।’

কথাটি শুনে স্তদ্ধ হয়ে গেল আনজুমা। কিরুপ আচরণ করবে সেটাই যেন ভুলে গেল। কোনো ধরনের সত্যতা তার সামনে আছেনি! লুকায়িত সত্য জেনেও কিন্তু…..রয়ে গেল!
আনজুমার অভিমান জড়ো হলো। সুয়াইব রুপে আরভীক তার পাশ্বে ক্ষণে ক্ষণে থাকার পরও লুকায়িত সত্যের কথা বলেনি। যার ফলে মন থেকে তার ভীষণ কষ্টের অভিমান একত্রিত হলো। শাস্তি কি আজও সে দিতে পারবে! আজ আনজুমা যতটা সত্যের মুখোমুখি হলো তা হজমে সে নিজেই মরমরা প্রায়!
চোখ বুজে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে আরভীক এর নিকটস্থ হয় সে। অঞ্জয়রা তাদের স্পেস দিয়ে মৃতলাশ নিয়ে প্রস্থান করে। আরভীক আশফিকে চেপে রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। যে কান্নার সুর নেই,শব্দ নেই। নিশ্চুপে মেয়েদের ন্যায় কাঁদছে। হয়তো চারবছরের জমানো ক্ষোপ পানি হয়ে ঝরছে! আনজুমার শরীর মৃদু কাঁপছে। আরভীক নামে পরিচিত পুরুষটি তার চিরপরিচিত সুয়াইব হবে কল্পনাও করেনি কখনো। শুধু আহাট অনুভব করেছে সুয়াইবের অনুভূতিতার! যখন আরভীক তার ঘনিষ্ঠে এসে ছুঁয়ে দিতো মনে হতো স্বয়ং সুয়াইব ছুঁয়ে দিচ্ছে! তখনো ঘাঁটেনি বিষয়ের প্রেক্ষিতে। অথচ না ঘাঁটা বিষয়টিই যেন পরিণয়ে সত্য হলো!

কাঁপান্বিত হাতটি আরভীক এর কাঁধে গভীরভাবে ছুঁয়ে দেয়। প্রশ্নাতীত আশফির সঙ্গে আনজুমার কোমর জুড়ে জম্মানো যন্ত্রণার জোয়ারভাটা বয়ে গেল তার চোখজোড়া হতে! আনজুমা নিজেও শুদ্ধভাবে নিজেকে সামলাতে পারছে না! সুয়াইবের করুণ চাহনী যেন আনজুমার হৃদয় বিক্ষত করে তুলছে। শরীরের প্রতিটা রুন্ধ-নিন্দ্র যেন দ্রুতবেগে গমন করছে তার। মন না চাইতেও আরভীক এর মাথায় হাত দিয়ে কোমরে গুজে থাকা পুরুষটিকে গোপনে আকঁড়ে ধরে। ঢোক গিলে কাঁপান্বিত গলায় বলে,

‘ছাড়েন বাসায় যেতে হবে!’

ছলছল দৃষ্টিতে আরভীক কোমর থেকে থুতনি উঠিয়ে আনজুমার দিকে তাকায়। বাস্তবে আনজুমা দেখতে পেল মায়াবী চেহারার ক্রন্দন দৃষ্টিকোণ! তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে সরল কণ্ঠে শুধায়।

‘আশফির, আপনার খিদে পেয়েছে নিশ্চয় বাসায় চলেন।’

আনজুমা ছটপটিয়ে হাত সরিয়ে দেয় আরভীক এর। আহত হৃদয় নিয়ে সে আশফিকে আগলে রেখেই বলে,

‘আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না প্রণয়োণী!’

নিশ্চুপ উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি আনজুমা। সচল পায়ে কদম পেড়িয়ে প্রস্থান করে। আশফি ঘুমন্ত নয়নে তার মাম্মার যাওয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে তার বাবাইয়ের দিকে তাকায়। তার বাবাইয়ের চোখে অশ্রুপাতের খেলা দেখে। সে নিজ হাতে মুছে দেয়। আবেগে আপ্লুত দৃষ্টিতে আরভীক আশফির মুখপানে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। তার গালে হাত রেখে স্নেহপরশী গলায় শুধায়।

‘ইউ আর রিয়েলি মাই চ্যাম্প আশফি! আইম ইউর ড্যাড! ইউর বাবাইয়ি।’

পিটপিট করে আশফি আদু গলায় ‘বাবাইয়িই’ বলে আকঁড়ে ধরে। আরভীক মনে মনে আওড়ায়।

‘তুমিও এভাবে আমার বুকে আছড়ে পড়বে প্রণয়োণী। অভিমান হয়েছে, তবুও এর প্রতিহার করার উপায়ন্তর আছে।’

দুষ্টু হাসি চওড়া হলো আরভীক এর মুখশ্রীতে। আশফিকে নিয়ে গাড়ির কাছে এসে দেখে তার প্রণয়োণী ঘুমিয়ে পড়েছে। সেও বিনা শব্দে বসে পড়ে ড্রাইভিং করতে। ইশ! পাশে বউ,কোলে ছেলে বাবু তিনজনে মিলে লংড্রাইভে হানিমুন করতে যাওয়ার মজাই আলাদা! ভেবেই ফিক করে হেসে দেয় আরভীক। ঘুমন্ত আনজুমা চোখ খুলতে গিয়েও খুলল না। প্রচন্ড ক্লান্ত সে। এক এক ঝড়ঝঞ্ঝার কারণে তার শরীর দূর্বল হয়ে পড়েছে। আরভীক গাড়ি চালু করে মোড় ঘুরিয়ে নেয়।

৪৬.
ফাহাদ জাফর সাহেবের ডকুমেন্ট তৈরি করছে গাড়িতে বসে! যেহেতু তিনি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এসি পদে সম্মানিত সেহেতু তার উপর লিগ্যাল এক্যাশন তৈরি বিহীন এনকাউন্টারের কোনো পথ নেই। অঞ্জয় গাড়ি এয়ারপোর্টের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একরাতের মধ্যে বুকিং করা হয়েছে হংকং এর টিকেট! যেমনে ঝড়,বাদলের মিলান্তরে বৃষ্টি,বন্যার পরিক্রমণে সূর্য উকিঁ দেয় তেমনে তারাও পরিকল্পনামাফিক একরাতের মধ্যে কাম খাতাম করার উদ্যোগে রওনা হয়েছে। সায়াজ আনমনে বলে,

‘রাজিব কে কোথাও দেখলাম না সে কই গেছিল!’

সায়াজের প্রশ্নে অবাক সহিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফাহাদরা। তাদেরও যেন মনের কোণায় রাজিবের ডেটা সম্পর্কে ঝড় তুলল। অঞ্জয় ভাবান্তর হলো কিঞ্চিৎ পূর্বের ঘটনায়।

পূর্বের ঘটনা….💥

আনজুমাকে লাল জরজেট স্লিভলেস শাড়ি পরিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে ডিলার্সের সামনে। কিন্তু সে কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করে জাফরের কাঁধ থেকে ছুঁ মেরে চাদরটি নিয়ে নিজেকে চাদরে ঢেকে নেই। বে’য়াদ’বির কায়দা হওয়ায় গুটাকয়েক ডিলার্স নারাজ মনভাব পোষণ করে। আনজুমা পুতুলের ন্যায় ঢোক গিলে স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণে ডিলার্সের দিকে নজর বুলায়। কিন্তু সরু কোণারে তার চোখ আটকে যায়। গোল চোখে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে কোণারে বসা পুরুষটার দিকে গভীর চাহনী নিক্ষেপ করে। তবে তার চাহনীকে পরিপূর্ণ লাজুকতায় ফেলে দেয় সেই পুরুষটি চোখ টিপুনি দিয়ে।
অঞ্জয় বসের ক্রিয়াকলাপ দেখে হামি দেয়। যা দৃষ্টিগোচর হলো। আরভীক চোখ রাঙিয়ে তাকায়। ফলে হামির বদলে কাশি চলে আসে অঞ্জয়ের। আরভীক বাঁকা হেসে আনজুমার দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে আওড়ায়।

‘সি ইজ অনলি মাই গার্ল!’

কণ্ঠনালী শুনতে পেয়ে পরম নিশ্চিত হলো আনজুমা। এই তার আরভীক! কিন্তু ঘাবড়ে গেল তার বেশভূষা দেখে। আজও সে মাফিয়ার দৃষ্টপাতে এসেছে। হাতের হাতা ফোল্ড করা, শার্টের কলার তিন বোতাম অব্দি উম্মুক্ত, ফিটিং প্যান্ট, চুলগুলো একসাইডে এলোথেরাপি করে আচড়ানো, মুখের পানে লেগে আছে বাঁকা তিক্ষ্ণ হাসি, চোখজোড়ায় জ্বলছে যাওয়া আগুন থেকে তৈরিকৃত লাভার রক্তিম বর্ণ ফুটে উঠেছে! আনজুমা কিছু একটা মনে পড়তেই আনমনে বলে,

‘তার মানে যুদ্ধ হলো…।’

অসম্পূর্ণ কথার মাঝে জাফর সাহেবের শোরগোল শুনে থুতনী তুলে তাকায়। ডিলার্স যারা ছিল তাদের ছিঁটেফুটোও নেই। বরং রুমে শুধু তারাই আবদ্ধ। নজর বুলিয়ে দেখে ফাহাদ ডিলার্সদের এরেস্ট করে পুলিশ ফোর্সের গাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছে। অন্যত্রে রাজিবের কোলে ছোট আশফি খিলখিলিয়ে হেসে ‘বাবাইয়ে আততে,আততে’ বলে হাত তালি দেয়। আরভীক জাফরের সামনে গিয়ে বাঁহাত পকেটে গুজে,ডান হাতে পি’স্ত’ল নিয়ে সে নিজের কপালে ঠেকায়! গাম্ভীর্য ভরা গলায় শুধায়।

‘ওহ তুই না এককোটি টাকা চেয়েছিলি!’

জাফর আমতা আমতা করে পা পিছিয়ে নিতে থাকে। তার কদম যত পিছাচ্ছে আরভীক এর কদম তত এগোচ্ছে! আরভীক জবাব না পেয়ে একটানা বাক্যধারা বয়ান করে।

‘তুই কি ভেবেছিস খেলা শুধু তুই খেলতে পারিস! চারবছর আগে আমাকে মে’রে শান্তি পাস নাই দেখে আবারো পিছু লেগেছিস।’

হতভম্ব হয়ে যায় জাফর। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

‘তু তুম তুমি কি স সসুয়াইব!’

‘মৃত মানুষকে তাহলে চিনতেই পেরেছেন আব্বাজান!’

‘আব্বাজান’ শব্দটি শুনে ধুক করে উঠে জাফরের হৃদপিন্ড! পরিশেষে তার যম সামনে এলোই। চোরাচুপে নিজেকে আড়াল করতে গিয়েও পারল না। কেননা ঘুরেফিরে মৃত্যুর মুখে চলে এসেছে! আমতা আমতা করে আরভীক এর দিকে করুণ চাহনী নিয়ে বলে,

‘বাবা মাফ করে দে আমাকে! আমি জানি যা কিছু হয়ছে খারাপ হয়ছে। কিন্তু দেখ তুই বেঁচে গেলি। আমার মূল্যায়ন অসফল হয়নি। তোকে ধাক্কা মারার পরও বেঁচে ফিরে…।’

তার কণ্ঠনালী থেকে বের হওয়া বাক্যগুলো আরভীক এর কাছে দহনকৃত অগ্নিকুণ্ড মনে হচ্ছিল। ফলে সে এক ঘু’ষি আ’চ’ড়ে দেয় জাফরের গন্ডদেশ বরাবর! র’ক্ত কফের সঙ্গে দল পাঁকিয়ে তার মুখ থেকে বের হলো। চারবছরের দীর্ঘ কোমার থেকে রেহাই পেয়েও স্মৃতিহীন বেঁচে ছিল মূর্তির মত! তার আরাজ নামক মহৎ মানবকে ড্যাডের নামে আখ্যায়িত করে সে গর্বিত! তার আফসোস নেই এই জাফর নামক খু’নী,অ’প’রাধীকে মেরে ফেললেও। স্মৃতিহীন থেকে যেদিন স্মৃতিশক্তি ফিরে পেলো সেদিন পণ করে ছিল! নির্দিষ্ট সময়ে শত্রুের উপর পাল্টা আক্রমণ করে বিক্ষোভ শোধ নেবে। সঙ্গ হিসেবে ছিল ফাহাদরা। কথাগুলো ভেবেই আরভীক অট্টহাসি দিয়ে উঠে। জাফরের সামনে চেয়ার এনে দেয় অঞ্জয়। আরভীক পায়ের উপর পা তুলে বসে। গালে হাত রেখে ব্যঙ্গ মুখশ্রীর ভাব নিয়ে বলে,

‘বল কু’ত্তে তোর কেমন শাস্তি খেতে মন চাইছে! সেরুপ শাস্তি দেব।’

ছোট আশফি তার বাবাইয়েকে দেখতে পেয়ে ‘বাবাইয়ি’ বলে নিম্ন কণ্ঠে ডাক দেয়। আরভীক ভ্রু কুঁচকে আশফির দিকে তাকায়। আশফি কোনো এক কারণে মুখ লুকিয়ে আছে রাজিবের বুকে। আরভীক সন্দেহের বশে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে তার কাছে গিয়ে হেঁচকা টেনে আশফিকে কোলে নেয়। তার গাল ধরতে নিলে ‘আহ’ করে কেঁদে দেয় সে। আরভীক এর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। আশফির ছোট নরম ডান গালে পাঁচ আঙুলের লাল ছাপ! যার ফলে হাতের সূক্ষ্ম ছোঁয়াও ব্যথাতুর লাগছে আশফির। আরভীক আশফির গালে ওষ্ঠ লাগিয়ে অঞ্জয়কে ফুসফুসানো গলায় শুধায়।

‘বরফ আন!’

অঞ্জয় মাথা নেড়ে তৎক্ষণাৎ গাড়ির কাছে গিয়ে ডিক্কি থেকে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে দৌড়ে ভেতরে যায়। আরভীক এর সামনে ধরে। কথ্যহীন বরফ কাপড়ে পেঁচিয়ে আশফির গালে ধীরস্থির করে লাগায়! মাঝমধ্যে যন্ত্রণার কারণে ‘আহ আহ’ করে শব্দ বের করছে আশফি। ফুঁপিয়ে কাঁদছে! নিশব্দে আরভীক মৃদু হেসে আদুরীয় হাতে বরফ লাগিয়ে মুছে দেয়! ফাস্ট এইড বক্স থেকে অয়েনমেন্ট ক্রিম নিয়ে তার গালে মৃদু চাপে লাগিয়ে দেয়। সে ঢোক গিলে নাকের পানি,চোখের পানি মিলে জমানো সর্দি আরভীক এর শার্টে মুছে। ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে নেয় আরভীক। তার শার্টের উপর অংশ ভেজে জুবুথুবু হলো। তবুও তার মনে উগ্র মানসিকতা ফুটে উঠেনি। বরং ভালো লাগল তার। আশফির কথা বলতে ইচ্ছে করছে না বিধেয় সে তার বাবাইয়েকে জড়িয়ে ধরে। আরভীক জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে রাজিবকে বলে,

‘দেখ তুই আমার শা’লা লাগিস! আনজুমার নামাত্র ভাই। ফলে তোর দ্বারা আশফি উধাও হলো। সেটা জানিয়েছিস কিডনাপ করে তোর তদারকরে বলার পর! কিছু বললাম না। বউটারেও আমার হুঁশ আসার আগে উধাও করে নিলি। বাট নেভার মাইন্ড। সো নাউ আই সেয়ে, হু স্লেপেড মাই সান!’

রাজিব স্বাভাবিক আচরণকৃত আরভীককে দেখে ভীতিগ্রস্থ হলো! তবে তার তারিফ করতে মন চাইছে এ জনাবের প্রতি। একনজরে বুঝে গেল ছেলের কষ্ট। ইশ! বেচারা জাফরের প্রতিও মায়া হচ্ছে তার। আরভীক অধৈর্য কণ্ঠে আওড়ায়।

‘আমি কিছু জিজ্ঞেস কর…।’

রাজিব চোখ বুজে ‘জাফর মার’ছে’ বলে দেয়। আরভীক শুনে ঠোঁট পাঁকিয়ে বাঁহাত দিয়ে কপাল চুলকায়। অঞ্জয়কে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘অঞ্জয় যা তো গাড়ি থেকে প্লাস্টিকের বেল্টটা নিয়ে আয়।’

অঞ্জয় দ্বিরুক্তি করতে নিলে আরভীক এর রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে ভয়ে শব্দহীন গাড়ির কাছে যায়। প্লাস্টিকের বেল্ট নিয়ে এলে আরভীক আশফিকে চেয়ারে বসায়। আনজুমা দৃশ্যপট কি থেকে কি হতে চলেছে বোঝার সাপেক্ষে এগোতে নিলে আরভীক আদেশের সুরে ফাহাদকে বলে,

‘ফাহাদ তোর ভাবীকে চেয়ারে বেঁধে দেয়।’

ফাহাদ থতমত খেল। আনজুমাও চটে এগোনোর পূর্বেই ফাহাদ ধরে টেনে চেয়ারে বসিয়ে হাত বেঁধে দেয়। আনজুমা নিরহ চোখের ইশারায় খুলতে বলে! কিন্তু দৃষ্টিনত করে ফাহাদ সামনে তাকায়। আরভীক বেল্ট তার কাঁধে পেঁচিয়ে আশফিকে কাঁধে আঁটকে নেয়। আশফি তার বাবাইয়ের কোলে হাওয়ার মত উড়ছে ভেবে হৈহুল্লোড় করে উঠে।
আরভীক আশফির হাসিমাখা মুখশ্রী দেখে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘তোমার বাবাইয়ি আইরনম্যানের মত ডুসুম ডুসুম দেবে তুমি ভয় পেও না চ্যাম্প। চ্যাম্পস ডোন্টস বি স্ক্যারেড!’

আশফি মাথা নেড়ে সায় দিল। ব্যস ধুম চেয়ে শুরু হলো মা’ই’র দেওয়া। আরভীক পরপর মে’রে ক্ষত করে ফেলে জাফর ও লিয়াকতের শরীর। লা’ঠি,বে’ল্ট,গাছের ধারালো ডাল,দা দিয়ে পুরু শরীর র’ক্তা’ক্ত করে ফেলে। আশফি খু’নখারাবী দেখার সুযোগ পায়নি। ততক্ষণে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কেননা পিঠে নেওয়ার পূর্বে কৌশলে আরভীক ঘুমের ইনঞ্জেকশন পুষ করে দেয় আশফির কাধে। বিধেয় র’ক্তা’ক্ত দেহদ্বয় দেখেনি ! তথাপি হাওয়ার প্রবল বেগে সে ঠান্ডা অনুভব করার সঙ্গে তার বাবাইয়ের উষ্ণতা পেয়ে শান্তির ঘুম ঘুমিয়ে যায়।
বিপরীতে পরিবেশ হাতের নাগাল এলে অঞ্জয় তার ম্যাডামকে আরভীকই সুয়াইব কথাটির স্বীকারোক্তি দেয়। তবে সেটার মধ্যে লুকানো অতীত তার অজানা হওয়ায় বলতে পারেনি! ব্যথিত মনে আনজুমা সকলের অগোচরে আরভীক এর নিকটস্থ হয়।

‘কি রে অঞ্জয় চল!’

ফাহাদের ডাকে ভাবনার ফোড়ন কাটে অঞ্জয়ের। তারা এয়ারপোর্টে চলে এসেছে। ড্রাইভার ব্যাগপত্র ইমিগ্রেশন অব্দি টেনে এনে দেয়। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভিআইপি লাইনের মাধ্যমে নিশ্বাসকৃত দুটি লাশকে প্লেনে উঠিয়ে নেয় তারা।
অঞ্জয়রা নিজ নিজ সিটে বসার পর কল পায় আরভীক এর। ফাহাদ অঞ্জয়ের ফোন রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দেয়।
আরভীক এর গাড়ি সবেই বাসার রাস্তায় পৌঁছায়। সে ব্লুটুথের মাধ্যমে জিজ্ঞেস করে।

‘এভরিথিংক ফাইন!’

‘ইয়াহ্ ডুড তুই বল ভাবীর অবস্থা কেমন!’

‘বউপাখি নারাজ!’

‘স্বাভাবিক তোর কারণেই হলো।’

‘ঠেং না মেরে বল কতক্ষণ লাগবে!’

‘জাস্ট ওয়ান ডে!’

‘ওকে তোরা একদিনের কেস খতম করে আয় আর আমি একদিনের হানিমুন করে তোদের সুখবর জানানোর ব্যবস্থা করি।’

‘তুই শোধরাবি না শা’লা!’

‘আমার কি শোধরানোর কথা ছিল যে শোধরে সাধুবাবা সেজে নেবো!’

‘ডুড তোর সাধুগিরি ভালোই জানি আমরা। এসব বাদ দিয়ে বল রাজিব কই।’

‘রাজিব তার বউয়ের সঙ্গে লুতুপুতু করতে গেছে!’

‘আমাদের কেন কেসের মধ্যে ঠেলে দিলি!’

মিছামিছি রেগে বলে সায়াজ! আরভীক শুনে পাত্তাহীন বলে,

‘দেখ সামনের শুক্রবারে বেস্ট রিপোর্টার এওয়ার্ড দেওয়া হবে! সো কেসের মধ্যে ফোকার্স না করলে তোর এওয়ার্ড অন্যজন ছুঁ মেরে নিয়ে উড়াল দেবে।’

‘ছেলে আর কিছু পায় না হাতির পাদা একখান! খালি ইমোশনাল ব্লেকমেইল ধ্যাঁত।’

সায়াজ তার দুঃখী ভাব নিয়ে সিটে মাথা হেলিয়ে দেয়। বাকিরাও রেস্ট করবে বলে কল রেখে দেয়। আরভীক ঠোঁট কামড়ে আড়চোখে তার প্রণয়োণীর দিকে তাকায়। ঘুমন্ত নিষ্পাপ বউয়ের মুখে যুবতী রুপের আভা আহা! দেখেই তো মন চাইছে খেয়ে হজম করে নিতে। আরভীক তার ভেজা ওষ্ঠের ছোঁয়া মেখে দেয় আনজুমার গাল ও ওষ্ঠজোড়ায়। ঘুমন্ত আনজুমা ঘুমে কাঁদা হয়ে আছে। স্পর্শের আকস্মিক অনুভবে কেঁপে উঠে। পুনরায় ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের ঘোরে হারিয়ে যায়। অন্যত্রে আরভীক মনে মনে সব সত্য ফাঁস করার দৃঢ় প্রকল্প নেয়।
পরিণয়ে যদি নতুন অধ্যায় শুরু হয় মন্দ কোথায় এতে!
#নেশাক্ত_প্রণয়োণী
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৫(গুপ্তকথন ফাঁস)

জাফরের কুকর্মের নীতি খবরে ছড়ানোর পরদিন হতে আজ পনেরো দিন কেটে গেল।কিন্তু অবহেলিত হলো আরভীক! বেচারা আশফির সঙ্গ পেলেও, বউয়ের সোহাগী আদর পাচ্ছে না! ধূলিসাৎ করে বেড়িয়েছে মেয়েটা। ক্ষমা চেয়ে ঘুষ হিসেবে আইসক্রীম, ফুসকা, কাচ্চি বিরিয়ানী অথাৎ মেয়ের প্রিয় খাবারের লোভ টোভ দেখিয়ে হলেও সোহাগ আদায় করতে চেয়ে ছিল কিঞ্চিৎ প্রণয়ের মুহুর্ত হিসেবে। তবে তার পরিকল্পনায় জল ঢালতে ওস্তাদ তার বউ ! এমন গম্ভীর,শঠ’নামী মেয়ের মত মুখ করে রাখে, যেন সে তাকে অত্যাচার,নিপীরিত করে চলে প্রতিক্ষণে!
আরে ভাই এটা কোনো ইনসাফ হলো!
আশফি তার বাবাইয়ের অসহায় মুখখানি দেখে। বাবাইয়ের খোঁচা দাড়ি ধরে টান দেয়। ব্যথায় ‘আউচ’ শব্দ বের করে উঠে আরভীক। সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকায়। খিলখিলে হেসে কানের কাছে এগিয়ে এলো তার বাবাইয়ের। আদু কণ্ঠে বলে,

‘মাম্মা আততে আততে হাতে তুতি জানো না!’

ভ্রু কুঁচকে আশফির দিকে অবাক সহিত পলক ফেলে সে। ছেলে তার বাবাইয়ের দুঃখ বুঝতে পেরে মায়ের গোপনে হাসার কথ্য বয়ান করেছে। সেও এবার জালে বন্দি করবে! কতদিন হলো কাউকে সে জালে ফেলেনি! আজ থেকি জাল বুনতে আরম্ভ করবে এবং শিকারী হবে বউ অথাৎ মিসেস আনজুমা ফাওয়াজ! বাঁকা হেসে আশফিকে চোখ টিপ দেয়। সে হেসে পরক্ষণে লাজুক হেসে তার বাবাইয়ের কান মলে দেয়। ছেলের আজগুবি কাজে মাঝমধ্যে হতভম্ব হয়ে যায়। কান মলে দেওয়ার কারণ বুঝে না সে ! কান মলে দেওয়ার পরও তার বাবাইয়িকে চুপ থাকতে দেখে মুখ ফুলিয়ে বলে,

‘হিসু কতব! তোমার উপ্রে কতি।’

আরভীক বেক্কলের মত হা করে তাকায়। তার ছেলে কিনা হিসুর জন্য কান মলে দিল। আর সে কিনা ভাবল তার মাম্মার সাথে দুষ্টুমি করছে ভেবে কান মলেছে! ফিক করে ছেলের কথায় হেসে দেয়। আশফি তার বাবাইয়িকে তাড়া দেয়। আরভীক স্বেচ্ছায় ছেলেকে হিসু করিয়ে পরিষ্কার করে দেবে। তার বেশ ভালোই লাগে ছেলের সেবা,স্নেহ করতে।
আনজুমা রান্নাঘরে ঘিন্নির ন্যায় শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুজে খিচুড়ি রাঁধছে। ইতিমধ্যে তার শ্বশুরআব্বুর মন গলেছে আনজুমার উপর থেকে। তবুও বহিঃপ্রকাশ করে না বিষয়টি। পূর্বের ন্যায় প্রাণবন্ত হেসে কথা বলে না তিনি। যা ভীষণ কষ্ট দেয় আনজুমাকে।
টিভির রুমে এসে ধপ করে বসে পড়ে আরাজ সাহেব। গলা ফাটিয়ে সার্ভেন্টকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘কবে থেকে এককাপ কফি চেয়েছি। কেউ কি দেবে আমায়!’

আনজুমা মুচকি হাসল। সে নিজ হাতে কফির পাউডার নিয়ে চায়ের কেটলিতে পানি ঢেলে চুলায় বসায়। গরম সদ্য তৈরিকৃত কফির মগ নিজ হাতে এগিয়ে দেয় আরাজ সাহেবের সামনে। তিনি গম্ভীর রগচটা নয়নে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। মুখ ফুলানো কণ্ঠে শুধায়।

‘সার্ভেন্টকে দিতে বলেছি। তার মানে এই নয় এ কফি আমি খাবো না। কোনো টাকার জিনিস নষ্ট করা ভালো না।’

কফির মগ নিয়ে নিবিঘ্নে চুমুক দিয়ে অশান্ত মাথা ব্যথাকে শান্ত করতে লাগে আরাজ সাহেব। আনজুমা কষ্ট পেলেও প্রকাশ করেনি। মুচকি হেসে নিশ্চুপে রওনা দেয় রান্নাঘরে। আরভীক আড়াল থেকে তার বাবার ভাবভঙ্গি দেখে এগিয়ে এলো। পাশ ঘেঁষে ঘাপ্টি মেরে বসে। ছেলের মতিগতি মন্দ ঠেকছে তার নিকট! বিধেয় নিবিড়ে মগে চুমুক দিয়ে যায়। গলা ঝেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে আরভীক। আরাজ সাহেব স্বাভাবিক কণ্ঠে শুধায়।

‘বউয়ের হয়ে সাফাই গাইতে এলে বলব, ইউ আর কাম ইন রং টাইম।’

‘ড্যাড তুমি জানো যা করছো! এতে আনজুমার খারাপ লাগবে। সে মন খুলে প্রাণহীন না হেসে কতদিন ধরে মূর্তির মত দায়িত্ব আদায় করে চলেছে। অথচ মুখ ফুটে টু শব্দ অব্দি বের করেনি। কেননা সে আমাদেরকে মন থেকে ভালোবাসে। আজকাল তুমি যে বিহেভ করছো মনে হচ্ছে টিপিক্যাল শ্বশুরের ন্যায় বিহেভর! তার আপন বাবা-মা মধ্যবিত্ত বলে সেই চৌদ্দ বছর বয়সে আমার হাতে সপে কেটে পড়ে ছিল। অথচ আমাদের বিবাহিত জীবন পেরানোর পরও তারা আসেনি মেয়ের একবার খবর নিতে! বরং অন্যের উপর সপেছে এই বেশি হলো তাদের ভাষ্যমতে। এই যে আমার আর তার বিয়ের সময় খুঁজে এনেছি কারণ কি জানো! তুমি আর আনজুমা এর পেছনের ঘটনা জানো না।’

আশ্চর্যান্বিত নয়নে আরাজ সাহেব ছেলের দিকে তাকায়। অদ্ভুত চাহনী দেখে মৃদু হেসে আরভীক মুখ খুলতে নিলে আশফির কণ্ঠ শুনে থেমে যায়। আশফি প্যান্টের চেইন বাঁধতে পারছে না! ফলে ঠোঁট ফুলিয়ে ‘বাবাইয়ি, মাম্মা,দাদু’ বলে চেঁচিয়ে উঠছে। রুম থেকে বেরিয়ে তার ছোট দেহের নু’নু দেখিয়ে দৌড়ে হাঁটছে। ইতিমধ্যে আশফির এরুপ দৌড়ানো দেখে দমফাটা হাসি পেল সকলের।
আশফি দৌড়ে আকস্মিক কারো সঙ্গে ধাক্কায় মেঝেতে পড়ে। ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে ‘বাবাইয়ি,মাম্মা,দাদু’ ডাক দেয়। তারা এসে আশফিকে মেঝেতে পড়া দেখে ঘাবড়ে যায়। আরভীক তৎপর হয়ে ছেলেকে কোলে নিয়ে তার বুকে-পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,

‘চ্যাম্প কোথায় ব্যথা লাগছে বলো!’

আশফি কান্না থামিয়ে দেয়। সে তো বাহানা করছিল কোলে উঠার। প্যান্টের চেইন বেঁধে দেওয়ার জন্য ইশারা করে। তার ইশারা করার দৃশ্যটি যে সে দেখবে সেই ফিট খেয়ে ক্রাশ নামক বাঁশ খেয়ে যাবে। ভ্রু নাচিয়ে চোখ নামিয়ে প্যান্টের দিকে ইশারা করছে। আরভীক হেসে প্যান্টের চেইন লাগিয়ে দেয়। ততক্ষণে পিচ্চি খুকির কণ্ঠ পেয়ে আরভীক অবচেতন নয়নে সামনে তাকায়। আশফিও কি ভেবে যেন সামনে তাকায়। তার ধারণামতে সে ধাক্কা খেয়েছে কোনো এক নরম শরীরের সঙ্গে!

‘এই পতাঁ ছেলে ছিছি দেখিয়ে দৌড়ো শরম করে না তোমার হে!’

পিচ্চি খুকির বাক্যধারা শুনে হাসি পেল আনজুমার। খুকি দেখতে দু-তিন বছরের মেয়ে হবে সে,স্বাস্থ্য মোটামুটি গুলুমুলু ধরনের, ধপধাপ পা ফেলে হাঁটে, বেবি গার্লস ফ্রকটি খুকি মেয়ের শরীরে মানিয়েছে! আরভীক তার বউকে খুকির দিকে গাঢ় নজরে চেয়ে থাকতে দেখে কদম ফেলে কান বরাবর এসে ফিসফিসানো কণ্ঠে শুধায়।

‘ওয়ান চান্স প্রিটিগার্ল, নেক্সট ইয়ার উই অলসো হেভ এ লাভলী গার্ল লাইক হার! ডোন্ট সি হার ডিপলী। কোজ আই কান্ট কন্ট্রোল মাই সেল্ফ।’

কথাগুলো বলে চোখ টিপুনি দিয়ে সরে এলো। খুকি মেয়েটি দেখে শাঁসানো কণ্ঠে বয়ান করে।

‘এইত আঙ্কেল তুতি আন্টিকে চোখ মাতছো!’

খুকি মেয়ের কথা শুনে কাশি পেল আরভীক বেচারার। আনজুমা ইজ্জত বাঁচাতে রান্নার নাম করে কেটে পড়ে। আরভীক হাসার চেষ্টা করে খুকি মেয়ের দিকে ঝুকঁতে নিলে থামিয়ে দেয় আশফি। ঠোঁট ফুলিয়ে মাথা নেড়ে ঝুকঁতে বারণ করে। খুকি হাত দেখিয়ে ভাব নিয়ে বলে,

‘আঙ্কেল তুতি নিচু হও না। যদি কোমর ভেঙ্গে যায়।’

আরভীক পড়ল মহা বিপদে! ভেবেছিল খুকি সাদাসিধে হবে কিন্তু এ কি বুড়ি কথা সব একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে। তার মত ইয়াং ছেলেকে কিনা কোমর ভাঙ্গনের কথা বলে বুড়া আখ্যায়িত করছে। ইয়াং থেকে আর লাভ কি! কাঁদো কাঁদো মুখখানি নিয়ে সে তার ড্যাডের দিকে তাকায়। তিনি মিটমিটিয়ে হাসছে।
ড্যাড এগিয়ে এসে খুকি মেয়েকে জিজ্ঞেস করে।

‘তুমি কোথার থেকে এসেছো দিদিভাই!’

‘আতি পাপ্পা মায়ের সাথে আতছি।’

‘ওহ তারা কো….।’

আরাজ সাহেবের বাক্য ব্যয় করতে হলো না। ‘সরি সরি গাইজ’ কথাটি বলে ভেতরে প্রবেশ করে ঊনত্রিশ বয়সের এক সুদর্শন পুরুষ। নিজের মেয়েকে তার বয়োজ্যষ্ঠ বাবার ন্যায় ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখে চওড়া হাসি দেয়।

‘আসসালামুয়ালাইকুম কাকা কেমন আছেন!’

আরাজ সাহেব ও আরভীক ভদ্রপুরুষকে দেখে বিস্মিত হলেও পরক্ষণে খুশিতে আপ্লুত হলো। দুজনে সালামের জবাব দেয়। আরাজ সাহেব ছেলের কাঁধে হাত রেখে আহ্লাদী গলায় শুধায়।

‘কতদিন পর তোকে দেখছি বাপ! এই তাহলে বউমা!’

পুরুষের পাশে বোরকা পরিহিত হিজাবী এক নারীও মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে। সে এসে সালাম করে। বিনিময়ে তারাও সালামের জবাব দেয়। আনজুমা রান্নাঘর থেকে দেখে আবাইয়া পরিদান করে নেয়। পুরুষগণের মাঝে একলা নারী ইতস্ততঃ বোধ করবেই। বিধেয় সে হিজাব পরে সরল হাসি দিয়ে সালাম দেয় ভদ্র পুরুষের সঙ্গে আগত নারীকে। তিনিও হেসে সালামের মাধ্যমে কুশল আদায় করে। আরভীককে দেখে পুরুষটি তার মুখের মধ্যে হাত রেখে পরখ করে দেখে। চওড়া হাসি দিয়ে বলে,

‘আলহামদুলিল্লাহ্ আমার এক্সপেরিমেন্ট সফল। আরভীক ভাই মুখে কি কোনো ব্যথা অনুভব হয়!’

সে নাবোধক মাথা নেড়ে আশ্বস্ত করে। তিনি আনজুমাকে দেখে পরম হাসির বিনিময়ে আহ্লাদময় কণ্ঠে বলে,

‘ভাবী আমি হলাম আরভীক এর কাকাতো ভাই আদাফাত । বয়সে বড়, বাচ্চাকাচ্চা সংসার নিয়ে সুদূর প্রদেশে ব্যস্ত থাকি। ইতঃপূর্বে তোমার কথা জেনেছি ইংল্যান্ডে থাকাকালীন। সুদূর ইংল্যান্ড পেরিয়ে তোমার দর্শনে এসেছি। অবশ্যই আমার ওয়াইফ নাইফা তোমার কথা জানতে পেরে উত্তেজিত ছিল এজ মিট করার জন্যে। আমিও উৎসাহী ছিলাম সাথে আরভীকের চিকিৎসার সুফলতা কতখানি হলো সেটা দেখারও সুবর্ণ সুযোগ হলো।’

আনজুমা অতীব আগ্রহদীপ্ত নয়নে কথাগুলো শুনে মুচকি হাসি উপহার দেয়। নাইফা এগিয়ে এসে তার মেয়ের হাত ধরে একত্রিত হয়ে দাঁড়ায়। আদাফাত মেয়েকে কেন্দ্র করে বলে,

‘এই হলো আমাদের চোখের মণি আহিফা জামান। তো আহিফা তোমার চাচুর,দাদুর সঙ্গে পরিচিত হয়েছো!’

আহিফা ছোট মাথা নেড়ে হ্যা জানায়।আদাফাত সরু দৃষ্টিতে চেয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করে।

‘দুষ্টুমি করেছো!’

হিহি করে দাঁত খেলিয়ে হেসে দেয় আহিফা। সে আদু কণ্ঠে তার পাপ্পাকে ধরে বলে,

‘জানো এ ছেলে ছিছি দেখিয়ে দৌড়ে !’

‘কুহ কুহ’ করে কেশে দেয় আরভীক। আশফি রাগান্বিত দৃষ্টিতে পুচকি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘এ পতাঁ মেয়ে আতি নুনু দেখালে তুমার কি হে! তোমাকে তো দেখাছি না হু।’

বোকা মেয়ে আহিফা ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে বলে,

‘কেনো আমাতে দেখালে কি হবে!’

‘তুতি দেখবে ঠিট আতে বড় হলে তুমাকে দেখাব!’

আহিফাও দাঁত পাঁকিয়ে হেসে ‘আত্তা’ বলে দেয়। শুনে যেন আদাফাত ও আরভীক এর চোখ কপালে উঠে। দুজন বেক্কলের মত তাদের সন্তানকে দমিয়ে আনে। আদাফাত বউ-মেয়েকে নিয়ে গেস্টরুমে অগ্রসর হলো। যেহেতু বহুবছর পূর্বেই ফাওয়াজ বাড়িতে ছিল সেহেতু রুমের দিক নিদের্শনা পূর্ব অবগত।
আরভীক চোখ গোলাকৃতি করে আশফির মুখ মৃদু চেপে হেহে করে হেসে তৎক্ষণাৎ কেটে পড়ে। আরাজ সাহেব কানে কিছু শুনেনি তেমন ভাব নিয়ে নিজের রুমে যায়। আনজুমা গেস্ট এসেছে বলে রান্নার কড়া আয়োজনে সেফকে লাগিয়ে দেয়। নতুন মেহমান আপয়্যনে ত্রুটি চাইবে না নিশ্চয়!
সেফ’স রাজি তাদের দায়িত্বে। মশলা বাটা, মুরগি কসা, মাছ ধুয়ে, সবজি বেছে কেটেকুটে রেখে দেয়। যার কারণে একঘণ্টা ব্যয় হয়েই যায় তার। সেফ’সের কাজ দেখিয়ে সে প্রস্থান করে। রুমে আসতেই কেউ তাকে হেঁচকা টেনে দেওয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে ওষ্ঠদ্বয় একত্রিত করে দেয়। আকস্মিক কার্যে ভীতিগ্রস্থে কেঁপে উঠে সে। পরক্ষণে স্বামীর আদুরীয় ছোঁয়া পেয়ে শান্ত হয়ে যায়। রান্নার সময় থেকে আরভীক এর ওষ্ঠদ্বয় অধৈর্য্য হয়ে ছিল মিলনের আক্ষেপে। কিন্তু মিসেস ফাওয়াজ হতচ্ছাড়ার মত ‘ধুর ধুর’ করে দূরত্ব টানছে। না, সে তো দূরত্ব আসতে দেবে না! এত বছর দূরে ছিল আজ সময় সুযোগ সুদে এসেছে উসুল করার!

আনজুমা কি ভেবে যেন জোরসরো ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। বিস্ময়ের সঙ্গে হৃদয়ে খারাপ লাগা কাজ করে আরভীক এর। আনজুমা ফোঁস করে রক্তিম শ্বাস নিয়ে শাসাঁয়।

‘আপনি এত বে’হা’য়া যে একটা মেয়ের ফিলিং নিয়ে খেলতেও কয়েকমিনিট ভাবলেন না। চার বছর জানেন চারবছর কি হারে মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করেছি! কত কটুতিক্ত কথার সম্মুখীন হয়েছি, এককোলে আশফি কে মানুষ করার জন্য বাজে সমাজের মাঝে সংগ্রামে লিপ্ত হলাম, নিজেই দেখেছেন ক্লাবে কি পরিমাণ হ্যারেসের শিকার হতে হয়েছে আমাকে! আরে আপনি নিজেও আমাকে একরাতের কথা বলে কাছে এসে ছিলেন মনে পড়ে কথাটা! আপনি যে সুয়াইব তা যদি বলতেন বিশ্বাস করেন একরাত কি বহু রাতও আপনার সঙ্গে কাটিয়ে দিতে মঞ্জুর আমি। কিন্তু আপনি ছু’ড়ি’ঘাত করেছেন আমার হৃদয়ে। আশফির সঙ্গে আমাকে পেয়ে ভেবে নিলেন আমি সব জেনে মাফ করেছি ! একদম না ভুল ভাবছেন। অঞ্জয় আমাকে আজ্ঞা করেছে, আপনিই সে নরপশু যে কিনা আমাকে ইচ্ছেকৃত বখাটে মেয়েদের কবলে ফেলেছিলেন! ইশ আমিও বোকা হয়ে আপনার কথায় গলে যেতাম। যত বার জীবন বাঁচিয়েছেন ততবার আমি কৃতজ্ঞ হয়ে আপনার সঙ্গে সুন্দর জীবন পাড়ি দিতে চেয়েছি। অথচ আপনি আমার প্রথম স্বামী সুয়াইব! কেন কি এমন হয়ে ছিল যার কারণে আপনার চেহারা বদল হলো! বলেছেন একটুও! বলেননি সবর্দা অতীতকে লুকিয়ে আমার মনে অভিমানের পাহাড় জমিয়েছেন। এখন তো আপনার প্রতি ভালোবাসাটাও কমে গেছে। আপনার নিম্ন মানসিকতার কথা জেনে। না জানি কপালে আর কি লিখা আছে এই সংসার নিয়ে!’

রাগে ফোঁপিয়ে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে ধড়াম করে দরজা আঁটকে দেয় আনজুমা। অন্যত্রে আরভীক ভাবমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কান ও হৃদয় তিক্ত কথাগুলো নিতে চাইছে না। কষ্ট হচ্ছে তার! মাথা ঝিম ধরেছে। যেন এখনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। আশফি নিশ্চুপে তার বাবাইয়ি ও মাম্মার ঝগড়া দেখে শান্ত রইল। সে তার বাবাইয়ির হাটু জড়ে ধরে। আরভীক চোখের পানি মুছে হেসে কোলে উঠিয়ে নেয় তাকে। নিশব্দে রুম হতে প্রস্থান করে। আনজুমা ফ্রেশ হয়ে টেবিলে খাবার পরিবেশন করে দেয়। কিন্তু টেবিলে আজ আরভীক টু শব্দ অব্দি করেনি। অথচ অন্যদিন হলে আনজুমাকে ঘেঁটে লাজহীন হতো। মুখ বাঁকিয়ে আনজুমা খুশি হলো। কেননা আজ সে লজ্জায় পড়ছে না বড় বাঁচা গেল যেন তার পক্ষে!
রাতে ঘুমানোর সময়ও রুমে এলো না আরভীক। আশফিকে মেইডের কোলে দিয়ে পাঠিয়েছে। ব্যাপারটায় খানিক কষ্ট পেল আনজুমা। তবে আমলে নেইনি। কারণ নিশিরাত্রিতে আরভীক এর দুষ্টুমি বহুগুণে বেড়ে যায়। তাকে বুকে নিয়ে ঘুমাবে,পুরু মুখে পরপর চুমু খাবে, শাড়ির আঁচল সরিয়ে বুকের মধ্যে জোরকৃত মাথা রেখে তাকে আগলে নেবে,উদরে হাত চালিয়ে চিমটি কাটবে ইত্যাদি আরভীক এর বদঅভ্যাস বলা যায়।
রাত পেড়িয়ে যায় আনজুমা এপাশ ওপাশ ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। আশফি বহু পূর্বেই ঘুমিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বজ্জাত ঘুম হানা দিচ্ছে না আনজুমার চোখে! ঘুম আসবেও বা কেমনে একপ্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আরভীক এর বুকে ঘুমানো! এই এক রাত্রি কঠিনচিত্ত হলো আনজুমার কাছে। চোখ বুজে থাকা অবস্থায় দুপুরের দৃশ্য নিয়ে ভেবে আনমনে আওড়ায়।

‘বেশি বলে ফেলেছি মনে হচ্ছে! উনি কি অভিমান করেছেন। যাই করুক আমার কি হু!’

ফাউল কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। অথচ অন্য এক রুমে আরভীক চোখের পানিতে নির্ঘুম রাত্রি পাড় করে দেয়। সকালে নাস্তার টেবিলে আরভীক কে না দেখে মন খারাপ হলো তার! ভেবে নিল ‘সরি’ বলবে। ফলে সে যে রুমে আরভীক গতরাতে থেকেছে সে রুমে গেল। দেখল ঘুমন্ত মুখটি! ইশ! কি মায়াবী চেহারা হুবুহু সুয়াইবের প্রতিচ্ছবি। আড়মোড়া হয়ে বসে ডাক দেয়। জবাব এলো না। পুনরায় ডাকতে নিলে আরাজ সাহেব এসে ধমকে উঠে। আনজুমা ভয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তিনি এসে আনজুমার হাতের কনুই চেপে নিজের রুমে অগ্রসর হয়। আদাফাত ও নাইফা চুপটি করে দেখে গেল। নাইফা আশফিকে বসিয়ে খাওয়ে দেয়। যেহেতু কথা চলছে শ্বশুর ও তার ছেলের বউয়ের মাঝে। আরাজ সাহেব কান্নামাখা গলায় অনুরোধ করে।

‘মা আমার ছেলেটার দোষ নেই সে কিছুই করিনি। কেনো তুমি গতদিনে ওত কথা শুনালে! জানো সে গতরাতে কি করেছে! দু দুটি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিচ্ছিল। ভাগ্যবশত আমি দেখে নেওয়ায় খাইতে পারিনী। পুরু রুম জুড়ে পাগলামী করছিল। আদাফাত ডক্টর হওয়ায় তার কাছে ইঞ্জেকশন ছিল। সে ইঞ্জেকড করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। মা আমার শুনো আরভীক তোমার সাথে কোনোরুপ অন্যায় করেনি! তাকে মেরে নদীতে ফেলেছিল ঐ জাফর ও লিয়াকত! রাজিবকে দেখে ছিলে নিশ্চয়। তাকে তুমি চিনো না কারণ খুব ছোটবেলায় পরিচয় তোমাদের! তুমি বড় হতেই সে হারিয়ে যায়। তবে রাজিব তোমাকে সবসময় চোখে রেখেছে ভাই হিসেবে। তাই যখন তোমার বিয়ে সুয়াইবের সঙ্গে হলো তখন সে সুয়াইব সম্পর্কে বিস্তারিত খবর নেয়। রাজিব পরবর্তীতে এসি জাফরের কুকর্ম সম্পর্কে জানায় সুয়াইবকে সত্য কথা জানিয়ে দেয়। এতে সুয়াইব আইডিয়া দেয় যে রাজিব যেন তার হয়ে কাজ করে। অন্যথায় তার কাজ হবে পুলিশের পক্ষে থেকে এজেন্ট রুপে। ফলে তোমাদের কিডনাপ হওয়া সবটা রাজিবই বলেছে আরভীককে। সে তোমারই সুয়াইব। জানি তার চেহারায় অন্য কারো আদল। এই চেহারা অন্য কারো নয় আমার বড় ভাই ইয়াসিরের। যার বউ-বাচ্চা এক দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। তখন আমি বউ ও ছোট আজীবকে নিয়ে অন্য জেলায় ছিলাম। ভাইয়ের মৃত্যুতে বেশ ব্যথিত হয়। তার সন্তানকেও দেখা সুযোগ পায়নি। যেদিন আরভীককে নদীতে ভেসে যেতে দেখি সেদিনই তাকে হসপিটালাইজড করি। সেবাযত্ন পেলেও ক্ষতি হয়ে ছিল বহু। ডাক্তার নতুন ফেইস চাইল। আমি কার ফেইস এনে দিব স্বল্প সময়ের মাঝে। তখন মাথায় এলো কৈশোরকালীন বয়সে আমার ভাইয়ের মুখখানি। তার ছবি দেখে ডক্টর প্রথমে নাকচ করে দেয়। পরবর্তীতে মেনে নেয়। হে এখন আরভীক এর ফেসে চেঞ্জিং এসেছে! সে পূর্বের চেয়ে বেশি সুদর্শন শ্যামবর্ণ হয়েছে। ফেসের দূবির্ষহ সময় কাটার পরও ভালো খবর পায়নি। বরং খারাপ খবর পেলাম যে সে কোমায় চলে গেছে। মাসখানেক পরই সে কোমা থেকে ফিরে রুমের চারপাশ জুড়ে কি যেন খোঁজছিল! ডক্টর চেকআপ করে জানায় সে তার স্মৃতি হারিয়েছে। তথাপি গ্যারান্টি দিয়ে ছিল স্মৃতি ফিরতেও পারে! সেই আশায় নিজের কাছে রেখে বড় করি তাকে। আজীবের ছোট ভাই হয়ে যায় সে। আজীবও ভীষণ আদর করতো তাকে। স্বল্প পরিচয় যেন আমাদের কে সুগভীর সুখের সন্ধান দিয়ে ছিল। পরক্ষণে এক সুনামি আমার আজীবকে কবরে ঠেলে দেয়, সেই সুনামির মিথ্যে অপবাদকে আরভীক প্রকাশ্যে আনায় ইনসাফ পায় আমার আজীব। আর রইল তোমার সঙ্গে ঘটা নিষ্ঠুর কার্যটি। সেটি নিয়ে আমি অবশ্যই ব্যথিত মন থেকে। তাও নিষ্ঠুরতার কথা ভেবে তুমি যে আরভীককে দূরে ঠেলে দিলে, ভেবেছো কখনো সে ঐ নিষ্ঠুতার পরিপ্রেক্ষিতে আটঁকে রইল না। তার কাছে তোমার সঙ্গ যেন স্বর্গীয় সুখের মনে হতো! ফলে ধীরস্থিরে তোমার জন্য তার সাইকোনেস ফিলিং দেখলাম। বুঝেছি ছেলে আমার তোমার উপর মায়া জম্মে ফেলেছে! আমিও মনপ্রাণে রাজি ছিলাম। অথচ তার স্মৃতি না ফিরলে আমি ভেবেই রেখে ছিলাম জাফরের মেয়ে ঐ শ্রেয়ার সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দেব। ওহ তুমি তো জানো না, শ্রেয়া নামের মেয়েটা হলো ঐদিন তোমার সঙ্গে যে বেয়াদবী করে কথা বলিস না এমন কথা বলেছে। ঐ মেয়েই হলো শ্রেয়া। অতঃপর ছেলে আমার কথার অমান্যে তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে এলো। খুশিও হলাম সেই সঙ্গে কষ্টও পেলাম আরভীকের প্রতি তোমার ব্যবহারে। মা একবার সুযোগ দিয়ে দেখতে ছেলে আমার তার অব্যক্ত কথাগুলো বলে আগলে রাখতো। সেই তুমি কিনা দূরে সরিয়ে দিলে…। আমি জানিনা মা আরভীক জাগলে কি রুপ আচরণ করে! পারলে আগলে রেখো নিজের সুয়াইবকে। একবার হারিয়েছো আশা করি দ্বিতীয় বার হারাবে না।’

নিজের মনে চেপে রাখা তিক্ত কথার সঙ্গে গুপ্তকথন পেশ করে দেয় আরাজ সাহেব। মন শান্ত হলেও তিনি ভাবল সঠিক জায়গায় নিশানা ছুঁড়েছে ! মেয়েটা বড় হলেও একটু আধটু অবুঝ রয়েই গেল এবং বদরাগী ! তবুও জীবনসঙ্গি হিসেবে সে মন্দ নয়। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নাস্তা করতে যায়। আনজুমা নিজের রুমে এসে অজড় ধারায় অশ্রুসিক্তে মগ্ন হলো! সে ভুল করে কষ্ট দিয়ে ফেলেছে তার সুয়াইবকে। চেহারার পরিবর্তন হলেও মানুষটা তো তারই! অথচ সেই মানুষটিকে নরপশু বলতেও তার হৃদয় কাঁপেনি। কান্নার জোয়ার রুমের মধ্যেই আবদ্ধ। সে কোন মুখে দাঁড়াবে আরভীক এর সামনে জানে না! তবে তাকে মানিয়ে ছাড়বে। অভিমান করেছে ভাঙ্গানোর চেষ্টা করবে সে। যদি শত অবহেলা সহেও মানুষটি তোমায় ভালোবাসে তবে সেই মানুষটি নরপশু নয় বরং হৃদপুরুষ!
আকস্মিক হাঁপাতে হাঁপাতে রুমে এসে হাজির হলো নাইফা। দীর্ঘ জোরালো দম ফেলে আনজুমাকে বলে,

‘ভাবী তাড়াতাড়ি আসেন আরভীক ভাই চলে যাচ্ছে।’

ধুক করে উঠে আনজুমার হৃদয়। নিবিঘ্নে দাঁড়িয়ে যায়, হৃদয় তার দহনক্রিয়ায় পরিণত হলো। তৎক্ষণাৎ আবাইয়া পরে বেরিয়ে আসে। গেইটের সামনে এসে দেখে মরমরা হয়ে আরভীক হাতে লাগেজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হৃদয়,শরীর কাঁপছে আনজুমার। মানুষটাকে থামাতে ভীষণ ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু মুখ ফুটিয়ে বলার মত শক্তি পাচ্ছে না। অন্যত্রে আরভীক আড়চোখে আনজুমাকে খেয়াল করলেও পাত্তা দেয়নি। চোখের ও ভাবভঙ্গির মাঝে উপেক্ষা ও অবহেলার কষ্ট কেমন তা বুঝিয়ে দিতে থাকে আরভীক।

চলবে.
চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here