#নেশাক্ত_ভালোবাসা
#Season_2
#লেখিকাঃ Tamanna Islam
#পর্বঃ ০৬
আব্রাহাম পেছন থেকে আইরাতের হাত খপ করে ধরে নিজের দিকে এক হেচকা টান দেয়। যার ফলে আইরাত একদম তার মুখোমুখি হয়ে যায়। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আইরাত তার হাতের দিকে খেয়াল করে দেখে আব্রাহাম বেশ শক্ত করে ধরে আছে। সে হাত ছাড়ানোর জন্য কিছুটা মুচড়া মুচড়ি করলে আব্রাহাম আবারও এক টানে তাকে গাড়ির সাথে চেপে ধরে। আইরাত চোখ খিচে বন্ধ করে রাখে। আলতো করে তাকিয়ে দেখে আব্রাহাম তার দিকেই সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
আব্রাহাম;; সমস্যা কি তোমার?
এবার আইরাতের যেনো বুলি ফুটলো।
আইরাত;; সমস্যা? আপনি জিজ্ঞেস করছেন আমার সমস্যা কি?
আব্রাহাম;; অবশ্যই সমস্যা আছে তোমার তাও এখানে (আইরাতের মাথার পাশে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে)
আইরাত;; একদম বাজে বকবেন না বলে দিলাম।
আব্রাহাম;; কথা ঘুড়ানো বাদ দিয়ে যা জিজ্ঞেস করছি তাই বলো।
আইরাত;; জিজ্ঞেস তো করবো আমি আর বলবেন আপনি।
আব্রাহাম;; কি?
আইরাত;; আমার চাকরি কেনো খেয়েছেন বলুন!
আব্রাহাম এবার নিজেই আইরাত কে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ায়।
আইরাত;; কি হলো বলুন!
আব্রাহাম;; আমার কি খেয়ে-দেয়ে আর কোন কাজ নেই যে আমি তোমার চাকরি খেতে যাবো।
আইরাত;; একদম মিথ্যে বলবেন না আমি জানি আপনিই কিছু একটা করেছেন।
আব্রাহাম;; ওকে তো আমিই যে তোমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করিয়েছি তার ব্যাপারে কোন প্রুভ আছে কি তোমার কাছে?
এবার আইরাত চুপ হয়ে যায়। আসলেই তো তেমন কোন প্রুভ নিয়ে আইরাত আসে নি। তৌফিক যেভাবে বললো সেভাবেই সে এসে পরেছে যদিও সে তৌফিক কে অনেকটা বিশ্বাস করে।
আব্রাহাম;; স্পিক আপ।
আইরাত;; না (কপাল কুচকে অন্য দিকে তাকিয়ে)
আব্রাহাম;; তাহলে কিসের ভিত্তিতে তুমি আমার ওপর এই অপবাদ দিচ্ছো?
আইরাত;; হয়েছে এতো ভোলা সাজতে হবে না। আপনাকে এই ক”দিনে এটুকু তো চিনেই গিয়েছি। বেশ গভীর জলের মাছ আপনি।
আব্রাহাম;; সামনে আরো কতো চেনা বাকি আছে।
আইরাত;; কিছু বললেন?
আব্রাহাম;; বললাম যে এখানে কি করো?
আইরাত;; আপনার সুদর্শন মুখমণ্ডল খানা দর্শন করিবার জন্য এসেছিলাম তবে আপনাকে ভেতরে না পেয়ে পেলাম এখানে।
আব্রাহাম;; তো এখন এখানে দেখে নাও যত ইচ্ছে (আইরাতের দিকে বেশ ঝুকে)
আইরাত;; আব, না না থাক দেখতে হ হবে না। আম আমি যাই।
এই কথা বলেই আইরাত দ্রুত সেখান থেকে কেটে পরে। আর আব্রাহাম কতোক্ষন আইরাতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর এসে পরে। আইরাত মনে মনে হাজারো বকা ঝকা করে এসে পরে। আব্রাহাম অফিসের ভেতরে যেতে না যেতেই রাশেদ আসে।
রাশেদ;; স্যার যাক আপনি অবশেষে এসেছেন।
আব্রাহাম;; কেনো, ইজ এভরিথিং ওকে?
রাশেদ;; স্যার আতিক রহমান এসেছেন, আপনার সাথে দেখা করতে চাইছে।
আব্রাহাম;; কেবিনে পাঠিয়ে দিও।
আব্রাহাম যেতে যেতে এই কথা বলে, কেবিনে চলে গেলে রাশেদ আতিক রহমান কে আব্রাহামের কেবিনে যেতে বলে। এই আতিক রহমান নিজেও এক বিজন্যাস ম্যান। সে বলতে গেলে এক প্রকার মরিয়া হয়ে রয়েছে আব্রাহামের সাথে ডিল ফাইনাল করার জন্য কিন্তু আব্রাহাম তাতে রাজি না। রাজি না থাকার কারণ হচ্ছে এই আতিক রহমানের কোম্পানি আর আতিক রহমানের নিজের কারোরই রেকর্ড ভালো না। মার্কেটে ভেজালযুক্ত প্রোডাক্ট চালান দেওয়ার জন্য যে ঠিক কতো শত বার একে জেলে যেতে হয়েছে তার হিসেব নেই। আর পারসোনাল ভাবেও আব্রাহাম তাকে পছন্দ করে না। ইদানিং বেশ গরম পরেছে, আর আব্রাহাম কে ওলয়েজ ফরমাল গেটাপে থাকতে হয়। সে নিজের জেকেট টা খুলে রেখে দেয়। কোল্ড ড্রিংকস এর ক্যান টা খুলে খাচ্ছে। কাচের ডেস্কের সাথে হেলান দিয়ে একহাত প্যান্টের পকেটে গুজে রেখেছে আরেক হাতে ফোন ঘাটছে। তার কিছুক্ষন পরেই কেবিনের দরজাতে নক পরে। আব্রাহাম ফোনের দিকে নজর রেখেই গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে…..
আব্রাহাম;; কাম ইন…
আব্রাহাম ফোন টা রেখে দিয়ে শার্টের হাতা গুলো গুটিয়ে নেয়। এবার মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে দেখে আতিক।
আতিক;; হ্যালো স্যার, কেমন আছেন?
আব্রাহাম;; এইতো ভালো, আপনি?
আতিক;; জ্বি ভালো।
আব্রাহাম;; কিছু দরকার?
আতিক;; স্যার আসলে আমার কোম্পানির সাথে আপনার ডিল টা যদি………..
আব্রাহাম;; দেখুন মিস্টার আতিক. আমি আপনাকে আগেও বলেছি আর এখনো ক্লিয়ারলি বলছি যে আমি আপনার কোম্পানির সাথে কোন ডিল ফাইনাল করতে পারবো না। আমি তো আর জেনে শুনে মানুষের ক্ষতি করতে পারবো না তাই না।
আতিক;; কিন্তু স্যার আমি সিওরিটি দিচ্ছি আপনাকে যে কোন ঝামেলা হবে না।
আব্রাহাম;; কিছুদিন আগে এক পেট্রোল পাম্পে আগুন লাগতে লাগতে বেঁচেছিলো। ভাগ্য ভালো ব্যাপার বেশি সিরিয়াস হয় নি। আর সবশেষে নাম কার উঠে এসেছে আপনার। দেখুন তা আপনি যতই বলুন না কেনো ভেজাল না হওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু আপনি নিজেও দিতে পারবেন না। সো অযথা এখানে আপনার এবং আমার উভয়েরই সময় বরবাদ না করে কীভাবে আপনার কোম্পানি কে পদে তোলা যায় তার দিকে নজর দিন।
আতিক;; কিন্তু স্যার আ………
আব্রাহাম;; ইউ ক্যান লিভ, যাওয়ার রাস্তা টা ওইদিকে।
আতিকের বেশ লাগলো আব্রাহামের কথা গুলো তাই সে অপমান বোধ করেই সেখান থেকে চলে যায়। আব্রাহাম ব্যাসিকালি খুব বেশি স্ট্র্যাইট ফরওয়ার্ড। অফিসে তখন অয়নও ছিলো। ওহ বাই দি ওয়ে অয়ন আর কৌশল আব্রাহামের আন্ডারেই কাজ করে। তো আব্রাহামের কেবিন থেকে আতিক কে বেশ রেগে মেগে বের হতে দেখে অয়ন তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চলে যেতেই অয়ন আব্রাহামের কেবিনে যায়।
অয়ন;; আসবো?
আব্রাহাম;; হুম আয়।
অয়ন;; কি হয়েছে রে আতিক ওভাবে রেগে গেলো কেনো?
আব্রাহাম;; সত্য কথা সবসময় তেতোই হয়।
অয়ন;; কি আবার ডিলের কথা বলার জন্য এসেছিলো নাকি?
আব্রাহাম;; হুমমম, এই শোন রাশেদ কে বলে দিস তো যেনো এই আতিক রহমান কে আর আমার সামনে না দেখি সবকিছু টোটালি অফ।
অয়ন;; আচ্ছা।
আব্রাহাম;; আর এই তোরা জীবনে একটা কাজ ঠিক ভাবে করতে পারবি না তাই না!
অয়ন;; ওমা আবার কি করলাম?
আব্রাহাম;; কি করলি মানে! আইরাত কীভাবে জানলো যে ওর চাকরি যাওয়ার পেছনে আমি আছি।
অয়ন;; I Don’t know i swear…
আব্রাহাম;; 🤨
অয়ন;; ভাই বিশ্বাস কর।
আব্রাহাম;; যা করলাম।
অয়ন;; আচ্ছা একটা কথা বল তো!
আব্রাহাম;; হুমমম (ফাইল চ্যাক করতে করতে)
অয়ন;; তুই প্রেমে পরেছিস তাই না?
আব্রাহাম;; হঠাৎ এই কথা।
অয়ন;; শোন বুঝি সবই বুঝলি, যে ছেলে কখনো কোন মেয়েকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে নি সে একটা মেয়েকে এতো দিন যাবত ফলো করছে, সব ডিটেইলস বের করছে, না জানি তোর ল্যাপটপে কতো ছবি আছে ওই মেয়েটার। শেষে কিনা চাকরিও খেয়ে নিলি। আসলে ইরাদা কি তোর?
আব্রাহাম ঠাস করে হাত থেকে ফাইল তা অফ করে দিলো। কপালের এক সাইডে হাত দিয়ে স্লাইড করতে করতে বলে ওঠে….
আব্রাহাম;; প্রেমে পরা বা ভালোবাসা একে বলে কিনা জানি না। আর সত্যি আমার জানার প্রোয়জনও নেই। আমি শুধু আইরাত কে চাই তাও নিজের করে ব্যাস আর একে যদি ভালোবাসা বলে দ্যান ইয়েস আ”ম ইন লাভ উইথ হার। আই লাভ দ্যাট গার্ল। এতে যদি আইরাত সোজা-সাপটা ভাবে মেনে রাজি হয়ে যায় তাহলে ভালো আর যদি রাজি না হয় তাহলে কোনকিছুই আর আস্তো থাকবে না। থাকবে না বলতে আমি রাখবো না।
অয়ন;; ট্রিট দে ভাই।
আব্রাহাম;; এইযে শুরু হলো তোর।
অয়ন;; না দে।
আব্রাহাম;; চুপ কর, আর কি ট্রিট ট্রিট করছিস যা মন চায় খেয়ে নে যা।
অয়ন;; 😁
আব্রাহাম অয়নের দিকে একটা প্যান ঢিল দেয়।
অন্যদিকে আইরাত রেগে মেগে তার বাসায় যায়। সে আব্রাহামের কথা বলার ধরন দেখে এবার স্পষ্ট বুঝেছে যে আব্রাহামই তার চাকরির ‘ওয়াট’ লাগিয়ে দিয়েছে। আইরাত কে তেড়ে বাসায় আসতে দেখে অনামিকা বলে…..
অনামিকা;; কিরে আবার কি হয়েছে?
আইরাত;; কিছু না, আমি কাল থেকে ভার্সিটি যাচ্ছি।
অনামিকা;; আচ্ছা তা তো ভালো কথা।
আইরাত;; হুমম আমি রুমে গেলাম বেশ কিছু পড়া বাকি আছে তা পড়তে।
আইরাত রুমে চলে যায়। ঠাস করে রুমের দরজা টা খুলে এক ঘুড়ান্টি দিয়ে বিছানার ওপর শুয়ে পরে। কয়েকবার দম ফেলে। চোখ টা বন্ধ করে নিতেই আব্রাহামের এক একটা চটাং চটাং কথা আর উইন্ড তে লিপস্টিক লাগিয়ে দেওয়ার সময় ধরা খাওয়ার ব্যাপার টা ভেসে আসে। ফট করে চোখের পাতা মেলে ফেলে। উঠে রেগে চুলগুলো বাধতে বাধতে আপনা আপনিই বক বক করতে লাগে।
আইরাত;; হাহ, ঢং দেখলে গা জ্বলে যায়। এতো এটিটউড দেখানোর কি আছে। আমার চাকরি ওই বজ্জাত আব্রাহামই খেয়েছে আমি জানি। আমার এতো স্বাধের চাকরি টা। রাগ যে লাগছে না। ওকে, ওকে আমি পুকুরের পানিতে চোবাবো। শয়তান পোলা কোথাকার।
চুলগুলো কে পেছনে বেধে ফ্রেশ হয়ে এসে পড়তে বসে। এভাবেই বেশ সময় চলে যায়। প্রায় দুঘন্টা এক টানা পড়ে আইরাত উঠে পরে। রুমে পানি শেষ তাই পানি আনার জন্য নিচে কিচেনে যেতেই হুট করে বাড়ির কারেন্ট চলে যায়। আইরাত এতে চমকে যায়। সাধারণত আইরাত অন্ধকার দেখে বেশ ভয় পায়, তার দম বন্ধ হয়ে আসে। হাতে ওয়াটার পট নিয়ে অন্ধকারের মাঝেই হাতিয়ে হাতিয়ে লাইটার খুঁজে যাচ্ছে। রান্নাঘরের জানালার ফাক দিয়ে বাইরে থেকে হালকা আলো আসছে কিন্তু তাতেও যেনো তেমন কিছু একটা দেখা যাচ্ছে না। এখন আইরাতের নিজের ওপর নিজেরই বেশ রাগ লাগছে কেনো নিজের সাথে করে ফোন টা আনলো না। ফোন আনলে আর এই বিপদে পরতে হতো না তাকে। হাতের বারি লেগে একটা স্টীলের থালা ফ্লোরে পরে যায়। অন্ধকার নিস্তব্ধ জায়গায় স্টীলের থালা পরে যাওয়ার শব্দ টা যেনো কানের একদম নলি অব্দি গিয়ে বারি খেলো। ওপর থেকে অনামিকার ডাক আসলে আইরাত তাকে নিচে নামতে মানা করে দেয়। আইরাত তার হাত থেকে ওয়াটার পট টা রেখে দিয়ে এখন ভালোভাবে লাইটার খুঁজতে লাগে। ভাগ্যক্রমে তা পেয়েও যায়। তবে তা যেনো জ্বলছে না। বারবার ট্রাই করছে জ্বালানোর কিন্তু জ্বলছে না। হঠাৎ রাতের অন্ধকারে বিড়ালের ডাক এলো। সাথে সাথে আইরাতের শরীরের লোম গুলো দাঁড়িয়ে পরে। বেশ ভয় লাগছে এখন। আইরাতের কেনো যেনো মনে হচ্ছে যে তার ঠিক পেছোনেই কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। তবে পেছন ফিরে তাকানোর সাহসটুকু হচ্ছে না। তবুও এখন উপায় না পেয়ে আইরাত আস্তে আস্তে করে ভয়ে পেছন ফিরে তাকায়। তাকানোর সাথে সাথে লাইট জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে কাউকে দেখতে পায় অর্থাৎ মোমবাতি। মোমবাতির আলোতে অনামিকার মুখ টা হুট করেই সামনে চলে আসে। এতে আইরাত চমকে গিয়ে দেয় এক চিল্লানি। চিৎকার দেওয়ার পরপরই বাড়িতে কারেন্ট চলে আসে। আর অনামিকা আইরাতের বাহুতে একটা থাপ্পর বসিয়ে দেয়।
অনামিকা;; দিবো না একটা থাপ্পড় মেরে, এভাবে কেউ চিল্লায়?
আইরাত;; আরে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তো। তোমাকে না বারণ করলাম নিচে নামতে।
অনামিকা;; তুই এখানে একা কি না কি করছিস তাই মোম জ্বালিয়ে নিয়ে আসলাম আর তুই কিনা আমাকেই ভূত ভাবছিস। এখানে কি করিস?
আইরাত;; পানি নিতে এসেছিলাম।
অনামিকা;; বাইরের অবস্থা ভালো না, অনেক বৃষ্টি হবে হয়তো। ইলেক্ট্রিসিটি ডিস্টার্ব করবে। পানি নিয়ে যা বেশি করে আর লাইট নিজের কাছেই রাখিস।
আইরাত;; আচ্ছা।
আইরাত ওপরে নিজের রুমে চলে আসে। অনামিকাও চলে যায়। আইরাত পড়া শেষে ফোন টা নিয়ে একটু ফেইসবুক ঘাটাঘাটি করে। বাইরে তখন বেশ জোরে সোড়ে বিদুৎ চমকাচ্ছে। হাত থেকে ফোনটা রেখে এলোমেলো ভাবেই ঘুমিয়ে পরে।
।
।
রাত যখন বেশ গভীর আর আইরাত নিজেও গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেছে তখন কেনো জানি আইরাতের মনে হতে লাগে যে কেউ তার কাছে, তার পাশেই বসে আছে। হয়তো তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখছে। আইরাত বুঝতে পারছে যে কেউ একজন তো তার কাছে এখন আছেই। তবে সে চোখ মেলে তাকিয়ে যে তাকে দেখবে সেই শক্তি টুকু এখন তার মাঝে নেই। তার কিছুক্ষন পরই হঠাৎ আকাশ কাপিয়ে বিদুৎ চমক দিয়ে ওঠে। আইরাত হাত দিয়ে বালিশ টা আরো শক্ত করে চেপে ধরে। হ্যাঁ, আসলেই একজন ব্যাক্তি এখন আইরাতের রুমে তার ঠিক সামনেই বসে আছে। তার চোখজোড়া আইরাতে স্থির। একদম কাছে এসে রয়েছে,, আইরাতের সারামুখে বিচরণ করে চলেছে তার চোখগুলো। তুমুল বৃষ্টির পর একসময় চারিদিক শান্ত হয়ে যায় আর সেই ব্যাক্তিটিও চলে যায়।
সকালে এলার্মের কর্কশ শব্দে আইরাতের ঘুম ভেঙে যায়। হাই তুলতে তুলতে উঠে বসে এলার্ম টা বন্ধ করে দেয়। ওরনা টা গলায় জড়িয়ে চুল গুলো এক পাশে নিতে নিতে উঠে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আর দাঁড়াতেই তার চোখগুলো যেনো ছানাবাড়া হয়ে যায়। কারণ আয়না তে গাঢ় লাল রঙ দিয়ে লিখা “”গুড মর্নিং বেবিগার্ল””। আইরাত কপাল কুচকে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। এটা কে লিখলো, কেনো লিখলো কিছুই মাথায় ঢোকে না। আর লিখলোই বা কিভাবে। আর এই কথাই বা কেনো লিখবে। সব প্রশ্ন মাথায় এসে বারি খাচ্ছে। তখনই আইরাতের চোখ যায় তার রুমের বড়ো থাই গ্লাসের দিকে। সেটা খোলা। গ্লাসের কাছে চলে যায়। আইরাতের কপালে চিন্তার ভাজ আরো দু-একটা পরে। তার ভালোভাবেই খেয়াল আছে যে গতকাল রাতে সে গ্লাস লাগিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলো তাহলে এটা খোলা কীভাবে! আর কে এমন কথা লিখবে? এগুলো ভেবে ভেবেই আইরাত আবার গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। পানির মতো স্বচ্ছ আয়নাতে গাঢ় লাল রঙের লিখা যেনো চকচক করছে। সে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে আলতো হাতে আয়নাতে বুলিয়ে দেয়। বাই দি ওয়ে লিখা গুলো যেই লিখে থাকুক না কেনো ভারি সুন্দর, টানাটানা হাতের লিখা অনেক বেশিই সুন্দর দেখতে। আইরাত একমনে তাকিয়ে ছিলো আয়নার দিকে তখনই তার রুমে অনামিকা আসে। এসে দেখে আইরাত দাঁড়িয়ে আছে।
অনামিকা;; কিরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো ভার্সিটি যাবি না?
অনামিকার কথা শুনে আইরাত দ্রুত পেছন ফিরে তাকায়। এমন ভাবে আয়নার সামনে দাঁড়ায় যেনো অনামিকার নজরে তা না পরে।
অনামিকা;; কিরে?
আইরাত;; আব….হুম হুম
অনামিকা;; যা জলদি রেডি হ, আমি ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি।
আইরাত;; আচ্ছা আমি আসছি।
অনামিকা চলে যেতে ধরেও আবার কপাল ভাজ করে আইরাতের দিকে ফিরে তাকায়।
অনামিকা;; কিছু কি হয়েছে?
আইরাত;; হা! আরে ন না না কিছু হয়নি।
অনামিকা;; হুমমমম।
অনামিকা চলে যায়। আর আইরাত হাফ ছেড়ে বাঁচে। ক্লিনার জেল এনে দ্রুত আয়নাতে থাকা কালার টুকু মুছে ফেলে। তারপর খেয়ে-দেয়ে রেডি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে চলে যায়।
আইরাতের বাসা থেকে বের হতেই একজোড়া নজর তাকে দেখে। তারপর সোজা আব্রাহাম কে ফোন করে।
— স্যার, আইরাত ম্যাম বাসা থেকে বের হয়ে গেছে।
আব্রাহাম;; ওকে।
আব্রাহাম ফোন কেটে দেয়। সে নিজের অফিসেই বসে বসে ক্লাইন্ট দের সাথে কথা বলছিলো কিন্তু তখন সবকিছু বাদ দিয়ে দ্রুত চলে যায়। তবে আব্রাহামের বাইরে যেতেই অর্থাৎ কেবিন থেকে বের হতেই রিয়ানা নামে একটা মেয়ে তার পথ আগলে দাঁড়ায়।
রিয়ানা;; ওহ আব্রাহাম কোথায় যাচ্ছো তুমি?
আব্রাহাম;; Mind your own business…
রিয়ানা হচ্ছে আব্রাহামের বিজন্যাস পার্টনার। অর্থাৎ আব্রাহামের সাথেই কাজ করে তবে আব্রাহামের ডিরেকশনে। মেয়েটা বেশ গায়ে পড়া স্বভাবের। কোন না কোন বাহানা দিয়ে আব্রাহামের কাছে ঘেঁষতেই চায়। তবে সে যেনো আব্রাহামের দু-চোখের বিষ। রিয়ানা কে এই কথা বলেই আব্রাহাম দ্রুত বের হয়ে পরে। সিড়ি বেয়ে বাইরে নেমে আসলে গার্ড গাড়ির দরজা খুলে দেয় তারপর ড্রাইভিং সীটে বসে সোজা চলে যায়।
।#নেশাক্ত_ভালোবাসা
#Season_2
#লেখিকাঃ Tamanna Islam
#পর্বঃ ০৭
আইরাত ভার্সিটিতে তার ক্লাসে বসে ছিলো। আইরাতের সাথে দিয়াও বসে রয়েছে। আর তাদের সামনেই প্রফেসর ফাটা স্বরে লেকচার দিচ্ছে। দিয়া আইরাতের দিকে তাকিয়ে দেখে সে গালে হাত দিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। তা দেখে দিয়া সামনে চোখ স্থির রেখেই একটু আইরাতের দিকে ঝুকে বলে….
দিয়া;; লেকচার বুঝতাছোস কিছু?
আইরাত;; আগা-মাথা কিছুই বুঝতাছি না। তাও সামনে তাকায় থাক এমন ভাব ধর যেনো সব বুইঝা একেবারে উল্টায় ফেলতাছোস।
দিয়া;; বাদাম খাবি? আমার কাছে আছে? (দাঁত সব বের করে দিয়ে)
আইরাত;; ক্লাস থেকে বাইরে বের হওয়ার শখ আছে তোর! এই টাক্কু দেইখা ফেললে সোজা বাইরে বের করে দিবো চুপ করে বসে থাক।
এভাবেই দেখতে দেখতে ক্লাস টাইম শেষ হয়ে যায়। দিয়া আর আইরাত ভার্সিটির মাঠে বসে বসে এখন বাদাম চিবুচ্ছে। তখনই হঠাৎ দৌড়ে অবনি আসে। এসেই ধিরিম করে মাঠের মাঝে বসে পরে।
আইরাত;; কিরে তুই?
অবনি;; হ্যাঁ।
আইরাত;; অফিসে যাস নি?
অবনি;; মাত্র আসলাম। বাসায় আর না গিয়ে ভাবলাম যে তোমাদের চাঁদবদনী মুখখানা একটু দেখে যাই তাই এসে পরলাম।
দিয়া;; হুমম ভালা করছোস। নে বাদাম খা।
অবনি;; আজকে লেকচার ছিলো?
দিয়া;; হ ছিলো।
অবনি;; কি কি বললো?
আইরাত;; আল্লাহ জানে।
অবনি;; মানে, তোরা ক্লাসে ছিলি না?
আইরাত;; ওই থাকা না থাকা সমান।
অবনি;; তোরা চোর সমিতির সদস্য, পড়া চোর।
আইরাত;; হুমমম।
অবনি;; আচ্ছা শুনলাম কাল নাকি ভার্সিটিতে ফাংশন।
দিয়া;; কি?
আইরাত;; আবার কিসের জন্য ফাংশন?
অবনি;; শুনলাম সবাই বলতাছে আর স্যার রাও বললো।
দিয়া;; কিরে আইরু, আমরা কোথায় ছিলাম রে?
আইরাত;; কি জানি এখানে থেকেও কিছুই জানতে পারলান না আর তুই না থেকেও জেনে গেলি।
অবনি;; হিহিহিহি, দেখেছো আমি কতো স্মার্ট।
দিয়া;; ওই বিবিসি নিউজ।
আইরাত এবার জোরেই হেসে দেয়।
আইরাত;; কিন্তু আমি বুঝলাম না যে কিসের ফাংশন।
অবনি;; আরে নিউ স্টুডেন্ট”স রা এসেছে তাই। মানে নিউ ব্যাচ এসেছে তো তাদের নিয়েই হয়তো।
আইরাত;; কোন ব্যাচ আসলো কোন ব্যাচ গেলো ভাই আমি কিছুই বলতে পারমু না কারণ আমি আসাই শুরু করলাম ভার্সিটি আজ থেকে। আচ্ছা যাক ভালোই হলো মজা হবে।
অবনি;; হ ঠিই কইছোস।
আইরাত;; তোর কাল অন্য কোথাও যেতে হবে না ভার্সিটি আসিস।
অবনি;; হ্যাঁ আসবো তো।
দিয়া;; কিন্তু আমি ভাবতাছি আরেক কথা।
আইরাত;; কিতা?
দিয়া;; শাড়ি পরবি?
আইরাত;; এইযে শুরু হইছে। আমি ভাই পারবো না আগেই না করে দিলাম। আমার দ্বারা সম্ভব না আরে অনেক কঠিন কাজ এই শাড়ি পরা।
অবনি;; আন্টি কে বলবি পড়িয়ে দিবে।
আইরাত;; না মানে আমার শাড়ি নাই।
দিয়া;; মিছা কথা আর কইস না।
আইরাত;; আচ্ছা তোরা কি পরবি?
অবনি-দিয়া;; অবশ্যই শাড়ি।
আইরাত;; 🙂
দিয়া;; এই পড় না, ভালো লাগবো। তিনজন একসাথে শাড়ি পরে আসবো।
আইরাত;; আচ্ছা দেখি।
আরো বেশখানিক সময় আড্ডা দিয়ে তারা উঠে যায়। আইরাত বাইরে এসে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে লাগে, কিন্তু পায় না। এত্তো গরম যার জন্য আইরাত কে কপালের একপাশে হাত রেখে কপাল কুচকে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এই কাঠফাটা রোদে আর দাঁড়িয়ে না থেকে হাঁটা ধরে। তবে কয়েক কদম এগোতেই সাই করে একটা গাড়ি এসে আইরাতের পাশে দাঁড়ায়। এতে আইরাত কিছুটা হকচকিয়ে যায়। তাকিয়ে দেখে একটা গাড়ি বাট তার উইন্ড উঠানো তাই ভেতরে কে আছে তা দেখা যাচ্ছে না। তা এড়িয়ে গিয়ে আইরাত আবার হাঁটা শুরু করে দেয়। আইরাতের সাথে সাথে এবার সেই গাড়িটাও আরো একটু এগোয়। আইরাত থামলে সেই গাড়িও থামে। আইরাত আবার হাঁটে গাড়িও কিছুটা এগোয়, সে আবার থামে গাড়িও থামে। এমন প্রায় বেশ কয়েকবার হয়। এভাবে মেইন রোডে এমন করার কোন মানে হয়! আইরাতের বেশ রাগ লাগছে এবার। এই কে রে! চেনে না জানে না এভাবে গাড়ি নিয়ে তার সাথেসাথে কেনো চলছে। আইরাত এবার তার দুইহাত কোমড়ে রেখে মুখ টা বাকিয়ে গাড়ির উইন্ড এর দিকে তাকায়। কয়েক সেকেন্ড পরে উইন্ড গ্লাস টা নিচে নেমে পরে। উইন্ড যত নিচে নামে আইরাতের চোখগুলোও যেনো তত বড়ো হতে লাগে। সে খেয়াল করে দেখে গাড়ির ভেতরে আব্রাহাম। আব্রাহাম তার চোখে থাকা সানগ্লাস টা নাকের ডগায় খানিক নামিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আইরাত এবার দ্রুত সেখান থেকে চলে আসতে ধরলে আব্রাহাম গাড়ি থেকে নেমে পরে।
আব্রাহাম;; এই যে মেয়ে।
আইরাত থেমে যায়।
আইরাত;; আমার একটা সুন্দর নাম রয়েছে ‘আইরাত’।
আব্রাহাম;; সবাই তোমাকে এই নামে ডাকে রাইট বাট আমি ডাকবো না। মানে সবাই যা করে আমি তা কেনো করবো।
আইরাত;; এহহহ। আপনি এখানে?
আব্রাহাম;; কেনো আসতে পারি না!
আইরাত;; না মানে তা বলি নি কিন্তু….
আব্রাহাম;; এভাবে রোদে ঘুরাঘুরি করলে তো সাদা মুখ টা কালো হয়ে যাবে।
আইরাত;; কালোই ভালো।
আব্রাহাম;; গাড়িতে উঠো।
আইরাত;; কি?
আব্রাহাম;; গাড়িতে উঠতে বলেছি।
আইরাত;; আজব! আমি কেনো আপনার গাড়িতে উঠবো।
আব্রাহাম;; আমি বলেছি তাই।
আইরাত;; আমার চাকরি টা খেয়ে কি আপনার শান্তি হয় নি, এখানেও এসেছেন আমার মাথা খেতে।
আব্রাহাম;; শান্তি তো তোমাকে পাওয়ার পরই হবে।
আইরাত;; কি?
আব্রাহাম;; রাস্তায় সিন ক্রিয়েট না করতে চাইলে সোজা গাড়িতে উঠো। নয়তো বাকা পথের বাপ আমি।
আইরাত বুঝলো যে এখন আর চাপাচাপি করে লাভ নেই। এই আব্রাহাম তাকে আর ছাড়বে না। আইরাত খেয়াল করে দেখে রাস্তায় মানুষজন যাচ্ছে আর তাদের দিকে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে আছে। আইরাত দ্রুত আব্রাহামের গাড়ির দিকে এগোয়। গাড়ির দরজা খোলে পেছনের সীটে বসতে নিলে আব্রাহাম আইরাতের বিপরীত মুখী দাঁড়িয়েই কড়া গলায় বলে ওঠে….
আব্রাহাম;; সামনে বসো, আমি অবশ্যই তোমার ড্রাইভার নই।
আইরাত যেনো এবার তেলে-বেগুনে জ্বলে গেলো। ঠাস করে পেছনের দরজা লাগিয়ে দিয়ে সামনে এসে বসে পরে। কাধের ব্যাগটা কোলে নিয়ে নেয়। আব্রাহাম এসে ড্রাইভিং সীটে বসে পরে। গাড়ি চলছে আপন গতিতে। তার মাঝে কারো কোন শব্দ নেই। আব্রাহাম ড্রাইভ করার মাঝেই কয়েকবার আইরাতের দিকে তাকিয়েছে। এবার আইরাতও বাকা চোখে বার দুয়েক আব্রাহামের দিকে তাকায়।
আব্রাহাম;; দেখতে কি কেউ মানা করেছে নাকি। বাকা চোখে না দেখে সোজা দেখলেই পারো।
ইশশশ একদম কাঁচা লজ্জা দিয়ে দিলো। আইরাত মুখ কুচকে ফেলে।
আইরাত;; আমার এতো দেখার শখ নেই। আপনি দ্রুত ড্রাইভ করুন আমি বাড়ি যাবো।
আব্রাহাম;; হুমমম।
একসময় বাসায় এসে পরলো আইরাত। গাড়ি থামতে দেরি কিন্তু আইরাতের বাইরে বের হয়ে আসতে দেরি না। আইরাতের দ্রুত চলে আসতেই আব্রাহাম বেশ জোর গলায় বলে….
আব্রাহাম;; হেই বেবিগার্ল! নিয়ম করে প্রতিদিন একটু মধু খেয়ো বুঝলে।
আইরাত থেমে তার পেছন ঘুড়ে।
আইরাত;; কেনো?
আব্রাহাম;; এতে মুখ দিয়ে এতো তেতো কথা না ঝরে কিছুটা মিষ্টি বুলি ফুটবে।
আইরাত;; আমার ঝাল পছন্দ। আর এতো মিষ্টি কথা দিয়ে কি হবে তেতোই ভালো।
এই কথা বলেই আইরাত এসে পরে। সামনে কয়েক কদম যেতেই আইরাতের খটকা লাগে। কপাল কুচকে আরেক দফা পেছন ঘুড়ে তাকায়। কিন্তু ততক্ষণে আব্রাহাম সেখানে ছিলো না।
আইরাত;; Wait, what? আব্রাহাম আমাকে কি নামে ডাকলো!
আইরাতের অবাক হয়ে তাকায়। আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠে আইরাত তার রুমের আয়নাতেও এই নামই দেখেছে ‘বেবিগার্ল’। উনি এই নাম ডাকলো। বায় এনি চান্স আব্রাহামই রাতে আইরাতের রুমে যায় নি তো! এটা ভেবেই যেনো আইরাতের কলিজা-আত্না সব শুকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই এইসব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। আব্রাহামের কি আর খেয়ে দেয়ে কোন কাজ নেই যে এতো শত মেয়ে রেখে আইরাতের জন্য এমন করবে। এটা হয়তো একটা Coincidence ছাড়া আর কিছুই না। সে নাচতে নাচতে তার বাড়ির ভেতরে চলে যায়। বাড়ির ভেতরে যেতেই দেখে সাবিলা বসে আছে। তার মায়ের সাথেই কথা বলছে।
অনামিকা;; এসে পরেছিস?
আইরাত;; হ্যাঁ
সাবিলা;; শুনলাম তোর নাকি চাকরি চলে গিয়েছে?
আইরাত;; হ্যাঁ
সাবিলা;; তো এমন কি করলি যে চাকরি থেকেই বের করে দিলো তোকে? আগেই বলেছিলাম ভাবি তোমাকে যে মেয়েকে পড়াশোনা কোন মতে করিয়ে বিয়ে দিয়ে দাও। কিন্তু না তুমি তো আমার কথা শুনলেই না। মেয়েদের সংসারী হতে হয় বুঝলে।
আইরাত;; আমার বিয়ের চিন্তা করার জন্য আমি আছি ফুপি। তোমার এতো মাথা না ঘামালেও চলবে। আশা করি একটু মাথা তুমি তোমার ছেলে নিলয়ের জন্য ঘামাও। প্রতিনিয়ত বাসায় তো তার নামে কমপ্লেইন পাচ্ছোই তাই নয় কি!
অনামিকা;; আইরাত চুপ কর। যা ফ্রেশ হয়ে আয়।
আইরাত চলে গেলো তার রুমে। ফ্রেশ হয়ে এসে আবার ফোন নিয়ে বসে পরে। ফোনে বসে বসে শাড়ি দেখছে আসলে। শাড়ি না পরে গেলে অবনি আর দিয়ার সাথে মিলবে না আর না মিললে তাকে তারা আলু ভর্তা বানিয়ে দিবে। কিছুক্ষন পর আইরাতের রুমে অনামিকা আসে। এসেই দেখে আইরাত আধো শোয়া হয়ে ফোন ঘাটছে।
অনামিকা;; কিরে এসে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরলি কেনো, খাবি না?
আইরাত;; তোমার ননদ বাসা থেকে গিয়েছে। সে না গেলে আমি নিচে খেতে যাচ্ছি না।
অনামিকা;; হ্যাঁ চলে গিয়েছে এবার তুই আয়।
আইরাত;; যাচ্ছি।
আইরাত ফোন বিছানাতে রেখে উঠে পরে। তবে অনামিকা এবার খেয়াল করে দেখে যে আইরাত তার ফোনে শাড়ির ছবি দেখছে।
অনামিকা;; কিরে শাড়ি কিনবি তুই?
আইরাত;; আব…. না মানে এমনি
অনামিকা;; কি হয়েছে?
আইরাত;; কাল নাকি ভার্সিটি তে ফাংশন আছে। আর
অনামিকা;; আর শাড়ি পরে যাবে সবাই তাই তো।
আইরাত;; প্ল্যান আমার ছিলো না অবনি আর দিয়ার ছিলো।
অনামিকা;; আচ্ছা তুই এখন ফোনে এইসব শাড়ির ছবি দেখা বন্ধ কর। এই ব্যাপার টা তুই আমার ওপর ছেড়ে দে। কাল কের টা কাল দেখা যাবে। এবার চল।
অনামিকা চলে যায় আর তার পিছে পিছে আইরাত নিজেও। সেইদিনের সময় টা এভাবেই চলে যায়। রাতের বেলা দুই মা-মেয়ে বসে হলরুমে ছিলো তখনই সাবিলার ছেলে নিলয় আসে।
নিলয়;; মামি, মামি!
অনামিকা;; আরে নিলয় কেমন আছিস?
নিলয়;; হ্যাঁ ভালো। তুমি?
অনামিকা;; ভালো, আয় ভেতরে আয়।
নিলয় ভেতরে চলে যায়। আর আইরাতের নজরে পরতেই আইরাতের মাঝে একটা বিরক্তি ওয়ালা ভাব দেখা যায়।
নিলয়;; কিরে আইরু কেমন আছিস?
আইরাত;; ভালো, তুমি?
নিলয়;; ভালো, শুনলাম কাল নাকি অনুষ্ঠান আছে!
আইরাত;; হ্যাঁ
নিলয়;; সেখানে চিফ গ্যাস্ট হিসেবে নাকি আব্রাহাম চৌধুরীও আসবেন।
আইরাত;; কি?
নিলয়;; হ্যাঁ, কেনো জানিস না?
আইরাত;; না তো। মাত্র জানলাম তাও তোমার কাছ থেকে।
নিলয়;; ওহ আচ্ছা, ভার্সিটির কমিউনিটি তে আব্রাহাম চৌধুরীর অনেক হাত রয়েছে। মূলত তাকে ঘিড়েই ফাংশন টা এরেঞ্জ করা হয়েছে। আর তুই জানিস না।
আইরাত;; আমি যাবো না।
নিলয়;; কেনো যাবি না?
আইরাত;; না এমনি।
অনামিকা;; আরে বাসায় বসে থেকে আর কি করবি আর তুই না শাড়ি দেখলি সেখানে পরে যাওয়ার জন্য। তাহলে যাবি না কেনো অবশ্যই যাবি।
আইরাত;; কেউ আমাকে বললো না যে আব্রাহাম চৌধুরীও সেখানে যাবে।
অনামিকা;; তার সাথে কি সম্পর্ক তুই যাবি।
আইরাত;; হুম।
নিলয়;; আমার সাথেই যাস সকালে পিক করে নিয়ে যাবো নি।
আইরাত;; না না, লাগবে না আমি একাই যেতে পারবো।
নিলয়;; সিওর?
আইরাত;; হ্যাঁ প্রতিদিন তো একাই যাই।
নিলয়;; আচ্ছা।
নিলয় ঘন্টা খানিক আইরাতের বাড়িতে থেকে তারপর এসে পরে।
।
।
অন্যদিকে এতোরাতে আব্রাহাম একা এক অন্ধকার রুমে রয়েছে। সাদা স্লিভল্যাস একটা গেঞ্জি পরে হাতে গ্লাপ”স পরে ইচ্ছেমতো নিজের সামনে থাকা হ্যাঙ্গীং ব্যাগে ঘুষি মেরে যাচ্ছে। অর্থাৎ হাতে যতো কোলায়। ব্যাগ টা যেনো ফেটে যায় যায় এমন দশা। রুম টা বেশ অন্ধকার, গরমে ঘেমে আব্রাহামের সামনের চুলগুলো বেয়ে বেয়ে ঘাম গুলো ঝরে পরছে। ঘুষির এক একটা শব্দ যেনো চারিপাসে দেওয়ালে বারি খাচ্ছে। লাস্ট একটা পাঞ্চ দিতে আব্রাহাম থেমে যায়। পানির বোতল টা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নেয়। হাত থেকে গ্লাপ”স গুলো খুলে সামনের চুলগুলো ঝেড়ে ফেলে। চোখ গুলো খানিক বন্ধ করতেই আইরাতের মুখ টা, তার হাসির শব্দ গুলো যেনো ভেসে আসে। এখন তো আইরাতের জন্য তার চোখ বন্ধ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে। হঠাৎ আব্রাহামের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে আর সে ভেবে নেয় যে তাই করবে। আব্রাহাম সেই রুম থেকে বের হয়ে পরে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর সোজা রাশেদ কে ফোন দেয়। যা যা করতে হবে রাশেদ কে সব বলে ফোন কেটে দেয়। এখন শুধু কাল সকাল হবার পালা।
।
।
নিজের সামনে প্রায় ৬-৭ টা শাড়ি এলোমেলো করে উল্টিয়ে রেখে দিয়েছে আইরাত। আর তার নিজের পরনে একটা জলপাই কালারের শাড়ি। শাড়ি কে ধুতির মতো করে পরে রেখে দিয়েছে। তারপরেই হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে অনামিকা আইরাতের রুমে যায়।
অনামিকা;; কিরে কি পরে রেখেছিস এইটা?
আইরাত;; কোন শাড়িই তো পছন্দ হয় না।
অনামিকা;; তুই সেগুলো রেখে আগে এইটা দেখ। এটা দেখার পর আর বাকিগুলো দেখার প্রয়োজন হবে না আমার মনে হয়।
আইরাত তার মায়ের হাত থেকে ব্যাগ টা নিয়ে নেয়। ব্যাগ থেকে বের হয় একটা সুন্দর কারুকাজ করা কালো কালারের শাড়ি।
অনামিকা;; পছন্দ হলো?
আইরাত;; থাংকুউউউউউউউউ।
অনামিকা;; জানতাম পছন্দ হবে। এর সাথে হালকা কিছু অর্নামেন্ট”স আছে। পরে নিস।
আইরাতকে অনামিকা সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দেয়। প্রথমে একটু অদ্ভুত লাগলেও এবার যেনো ঠিক আছে। একদম কালো শাড়ি, সাথে সাদা স্টোনের কিছু চুরি আর বড়ো ঝুমকো, চোখ ভর্তি কাজল, চুলগুলো পিঠের ওপর ছড়ানো এইতো রেডি।
অনামিকা;; অনেক মিষ্টি লাগছে।
আইরাত;; সত্যি? (আয়নাতে নিজেকে দেখতে দেখতে)
অনামিকা;; না মিথ্যা।
আইরাত;; মা!
অনামিকা;; আচ্ছা এবার যা। সাবধানে যাস।
আইরাত;; আচ্ছা।
আইরাত বাইরে বের হয়ে আসে। ভার্সিটি যেতেই দেখতে পায় গেইট একদম ফুল দিয়ে সাজানো। ভেতরে যায়। ভার্সিটি যেনো চেনাই যাচ্ছে না। সবকিছু এত্তো সুন্দর করে সাজিয়েছে। আইরাত এইসব ঘুড়ে ঘুড়ে দেখছিলো তখনই অবনি আর দিয়া আসে।
অবনি;; আরে এই কে আইরাত নাকি!
দিয়া;; দেখছোস প্রথমে বললো শাড়ি পরেই আসবে না আর এখন দেখ কত্তো সুন্দর করে সেজে এসেছে।
অবনি;; এমনিতেই কপালে বফ নাই তোকে আজকে দেখে আরো থাকবে না। সবাই তোকে দেখবে।
আইরাত দেয় দুজন কেই কতো গুলো ঝারি মেরে।
আইরাত;; আর এই তোরা দুইজন আমাকে কাল বলিস নি কেনো?
দিয়া;; কি বলবো?
আইরাত;; আব্রাহাম….
অবনি;; হ্যাঁ উনিও আসছেন আর এটা আমরাও প্রথমে জানতাম না পরে জানতে পেরেছি।
আইরাত;; আচ্ছা যাক চল ভেতরে যাই।
দিয়া;; আরে আমাদের জুনিয়র রা নাকি স্টেইজে পার্টিসিপেইট করবে।
অবনি;; কি নাচবে নাকি ওরা?
দিয়া;; হয়তো।
আইরাত;; কি গানে নাঁচবে! ও টুনির মা তোমার টুনি কথা শোনে না।
আইরাতের কথায় সবাই হেসে দেয়।
আইরাত;; আয় ঘুরি।
তিনজন ভার্সিটির ভেতরে গিয়ে সবকিছুই এক এক করে দেখতে লাগলো আবার অনেকের সাথেই কথা বলছে। তবে কিছুক্ষন পর যেনো ভার্সিটিতে এক প্রকার দৌড়াদৌড়ি লেগে গেলো। আইরাত সহ দিয়া আর অবনি বোকার মতো তাকিয়ে থাকে।
আইরাত;; সবাই এতো তাড়ায় আছে কেনো রে?
অবনি;; হয়তো….
দিয়া;; আব্রাহাম স্যার এসেছেন তাই।
অবনি;; চল যাই।
আইরাত প্রথমে যেতে না চাইলেও অবনি, দিয়া আইরাত কে নিয়ে যায়। তবে হুট করেই ভার্সিটির একজন প্রফেসর তাদের সামনে আসেন।
ফারুক;; আইরাত, অবনি আর দিয়া!
তারা তিনজনেই থেমে পরে।
আইরাত;; জ্বি স্যার।
ফারুক;; তোমরা ভার্সিটি লেভেলের রাইট, কলেজ তো না।
অবনি;; এই কথা কি স্যার আজকে জানতে পারলো নাকি রে! (ফিসফিস করে)
আইরাত;; জ জ্বি স্যার।
ফারুক;; তো তোমরা এখানে কি করো। আরে আব্রাহাম আহমেদ চৌধুরী এসেছেন উনাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানাতে হবে তো। আর তোমরা সিনিয়র। তোমরা ফুলের তোড়া নাও আর সামনে গেইটের কাছে যাও দ্রুত।
অবনি আর দিয়া সুন্দর করে ফুল নিয়েও নেয়। আর আইরাত মুখ লটকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলতে যাবে তার আগেই ইয়া বড়ো একটা ফুলের তোড়া আইরাতের হাতে দিয়ে প্রফেসর চলে যান। অবনি আর দিয়া আইরাতের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে।
আইরাত;; এই চুপ কর হারামি রা। আমি এতো পরিপাটি হয়ে ভালো করে আসলাম ওই আব্রাহামের বাচ্চাকে ওয়েলকাম জানানোর জন্য নাকি, যত্তসব। এখন মূর্তির মতো গেইটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে হবে ধুর।
দিয়া;; আরে আয় না আগে যাই।
আইরাত;; লুচ্চি সব 😒
অবনি-দিয়া-আইরাত চলে যায়। এখানে সবাই আছে। প্রফেসর-ম্যাম, জুনিয়র বা আইরাত দের সিনিয়র সব। আইরাত বিরক্তিমাখা মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তখনই তিনটা গাড়ি আসে। একে একে সবাই ব্যাস্ত হয়ে এগিয়ে যায়। গার্ড রা নেমে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিলে আব্রাহাম বের হয়ে পরে। ব্লেক প্যান্ট পরে, ভেতরে একটা লাইট এশ কালারের টি-শার্ট আর তার ওপরে ওলিভ কালারের জেকেট, হাতে ব্লেক ওয়াচ। নিজের ভারি ভারি কদম ফেলে ভেতরে এগিয়ে আসে। একজন একজন করে ফুল দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। আর আব্রাহামও হাসিমুখে তা নিচ্ছে সবার সাথে বিনয়ের সাথে কথা বলছে। আব্রাহামের আসতেই আইরাত ফুলের তোড়া দিয়ে নিজের মুখ টা ঢেকে ফেলে। আর দিয়া দেয় এক গুতো মেরে।
দিয়া;; বইন, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে নয়তো স্যার বকবে।
আইরাত;; স্যার দের আর কাজ কি।
আব্রাহামের নজর আইরাতের দিকে পরে। আর আইরাত চোখ নামিয়ে ফেলে। আব্রাহাম এমন ভাবে তাকিয়ে আইরাতের কাছে আসে যেনো তার কাছ থেকেই ফুলের বুকে টা নিবে। তবে না তা আর হলো কই, আব্রাহাম আইরাতকে না দেখার ভান করে বাকি মেয়েদের কাছ থেকে ফুল নিয়ে নেয়। অর্থাৎ একমাত্র আইরাত বাদে আর বাকি সব মেয়েদের কাছ থেকেই সে ফুল নিয়েছে। আব্রাহাম সেখান থেকে ভেতরে চলে যায়। আর বাকিরাও তার সাথে চলে যায়। এতে যেনো আইরাত জ্বলে কয়লা হয়ে গেলো। না না তার কাছ থেকে যে ফুল নেয় নি তার জন্য না। এখানে অহেতুক দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য। আইরাত অবনিকে ফুলের বুকে টা ঠাস করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে এক ঝটকায় সেখান থেকে এসে পরে। তারপর প্রায় ঘন্টা খানিক সময় পার হয়ে যায়। সবাই ফাংশনে আছে। আইরাত একাই ভার্সিটির ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে আসছিলো। হঠাৎ খেয়াল করে যে তার কানের ঝুমকো টা সমস্যা করছে। তাই ঠিক করতে করতে আসছিলো। হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পাস টা পার করে ভার্সিটির হলরুমের দিকে আসতেই হঠাৎ আইরাতের বাহুতে হেচকা টান পরে। টেনে নিয়ে সোজা ক্লাসরুমের ভেতরে। চিৎকারও দিয়েছে কিছুটা কিন্তু আগে-ভাগেই এক শক্ত হাত তার মুখ চেপে ধরে। আইরাত নিজের হাত দিয়ে সেই ব্যাক্তির হাত সরানোর চেষ্টা চালালে এবার যেনো সেই ব্যাক্তির আরেক হাত এসে আইরাতের দুইহাত চেপে একদম পেছনে মুড়িয়ে ধরে। জোরে জোরে দম ফেলা ছাড়া এই মূহুর্তে আইরাত আর কিছুই করতে পারছে না। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে এক উষ্ণ নিঃশ্বাস ক্রমেই তার মুখে-ঘাড়ে আছড়ে পরছে। বেশকিছুক্ষন নিস্তব্ধ থেকে হুট করেই আইরাতের বেশ কাছে এসে তার কানে কারো কন্ঠস্বর ভেসে আসে……
আব্রাহাম;; বেবিগার্ল…!
ডাকটা শোনা মাত্রই কেনো জানি আইরাতের শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল স্রোত প্রবাহিত হয়ে যায়। হয়তো অবাকে বা হয়তো ভয়ে।
।
।
।
।
চলবে~~
।
।
।